ঈসায়ী নববর্ষ ও বাংলাদেশ


আওয়ার ইয়ার অব দ্য লর্ড। প্রভুর বছর। ANNO DOMINI (AD) | AD বা আফটার ডেথ : যিশুর মৃত্যুর পরের বছর; BC বা Before Christ, বা যিশুখ্রিষ্টের জন্মের আগে ইত্যাদি। প্রভু যিশুর জন্মকে কেন্দ্র করে বছরের হিসাব রাখা এবং খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী বছর গণনার নিয়মে আরেকটি খ্রিষ্টীয় বছর শেষ হতে চলেছে। সবাইকে -- বিশেষত আমার খ্রিস্টান বন্ধুদের নববর্ষের শুভেচ্ছা।

নতুন খ্রিষ্টীয় বছরে নববর্ষ উদযাপনের ঐতিহ্য রোমানদের কাছ থেকে পাওয়া। রোমান ঈশ্বর জানুসকে (Janus) নিবেদন করা খাওয়া-দাওয়ার উৎসব থেকে এই চলের শুরু। জানুসকে রোমানরা কল্পনা করেছে দুই দিকে তাকিয়ে থাকা মুখ হিসেবে। এক মুখ তাকিয়ে আছে অতীতে, আরেক মুখ ভবিষ্যতের দিকে।

ধর্ম, ঐতিহ্য কিম্বা সংস্কৃতি কোন দিক থেকেই ইংরেজি নববর্ষের সঙ্গে আমাদের যোগ নাই। বাংলায় সময় ঋতুর ধারণার অধীন। ঋতু ও ঋতুচক্রের ধারণা বঙ্গে প্রবল। এই দেশে মেয়েরা 'ঋতুমতি' হয়, কারন সময় প্রকৃতির রূপান্তর মাত্র। সময় এখানে কখনই সরলরেখা নয়, বৃত্ত। তার শেষ নাই শুরুও নাই। কোন শেষবিন্দু বা আরম্ভ মূহূর্ত নাই। বৃত্তরেখার যে কোন বিন্দুই যুগপৎ শেষ এবং শুরু। সময় এখানে ঋতু ফলে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বিমূর্ত বা নৈর্ব্যক্তিক সময় বাংলার সময় না। বাংলার সময়কে ঘড়ির কাঁটায় পাওয়া যায় না, তার অধিষ্ঠান প্রকৃতিতে। যিনি ‘পুরুষ’ তিনি ‘প্রকৃতি’ থেকে ভিন্ন, বিচ্ছিন্ন বা আলাদা কোন সত্তা নয়, বায়লজির পার্থক্য দিয়ে প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের দাবি বাংলা মানে না, সেই কারনে বঙ্গেই কেবল শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকার পদযুগল স্পর্শ করে বলতে পারে, ‘আমি কৃষ্ণদাস চরণে রহিলাম’, আর বাংলার মানুষ উভয়ের বিচ্ছেদ দূরে থাকুক, বিচ্ছেদ সম্ভাবনার যাতনায় কেঁদেকেটে একাকার হয়। বাংলার মানুষ বিচ্ছেদ গানে এতো কাতর হয়ে পড়ে কেন সেটা তাদের রোমান্টিক ট্যাগ দিয়ে বোঝা যাবে না, তাদের ভাবজগতের সমুদ্রের তলার সন্ধান নিতে হবে। নইলে গ্রামের সাধারণ ভাবসমৃদ্ধ মানুষগুলোর জগত আমাদের অচেনা থেকে যাবে।

প্রকৃতি ও পুরুষের সম্বন্ধ বিচার বাংলার গোড়ার অনুমান ও প্রস্তাব। এটাই বাংলাভাষীর বিশ্বজগতে প্রবেশের সদর রাস্তা, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ নয়। মনে রাখবেন, এই বঙ্গে, এই বঙ্গেই শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকার ঋণ শোধ করবার জন্য পুরানের গল্প আর মর্তের ইতিহাসের ফারাক মানলেন না। ইহলোক আর অপরলোকের ভেদ অস্বীকার করে গৌরাঙ্গ হয়ে নদিয়ায় অবতরণ করলেন। এই সেই ভগবান যিনি প্রকৃতি ভজনা করেই ভগবান হয়েছেন, পুরুষকে ভগবান কিম্বা ভগবানকে পুরুষ দাবি করে ‘ঈশ্বর’ হন নি।

যিনি প্রকৃতির রূপান্তরের মধ্যে নিহিত তাকে প্রকৃতির মধ্যে শনাক্ত না করে ঘড়ির কাঁটা দিয়ে হিসাব করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। সেকেন্ড মিনিটের কাঁটা দিয়ে তৈয়ারি মেকানিকাল টাইম বাংলার সময় না। টেকনলজি আমাদের গিলে বসে আছে। আমরা ঘড়ি দেখে সময় ঠিক করি, তাই প্রকৃতি কী, তিনি আসলে দেখতে কেমন, তাঁর রূপান্তর কিভাবে ঘটে এইসব দেখতে ভুলে গিয়েছি। প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ বিচারও আমরা আর জানি না। ‘প্রকৃতি জয়’ করতে গিয়ে প্রকৃতির সর্বানশ ঘটিয়েছি। এমনকি ইংরেজদের পাশাপাশি একটা বাংলা নববর্ষও আবিষ্কার করেছি। শাহবাগে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আমরা সেটা পালন করি। আবার প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য হা হুতাশও করি। অথচ সময়, ঋতু প্রকৃতি ইত্যাদির ভেদবিচার ছাড়া বাংলার ভাবজগতের থৈ পাওয়া অসম্ভব।

বঙ্গে একই ঋতু বারবার নতুন সম্ভাবনার খবর জানাতে প্রত্যাবর্তন করে। ঋতুবদলের খবর আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাই নব বা নতুন বছরের ধারণা ছয় ঋতুর বৃহৎ বঙ্গে পরদেশী ধারণা। ঔপনিবেশিক। লর্ড ক্লাইভের ঘোড়ায় চড়ে পলাশির আম্রকাননে মীর জাফর ও জগৎ শেঠদের বেইমানির কারনে ঢুকে পড়েছে।

ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি পুরানা খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডারের সংস্কার করেন, তাঁরই করা খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার সারা দুনিয়ায় এখন জনপ্রিয় ও চালু। এর ফলে বছর গণনার খ্রিষ্টীয় রীতিই আমরা গ্রহণ করেছি। ঐতিহাসিকভাবে বিচার করলে খ্রিষ্টীয় ক্যালেন্ডার মানা ও ব্যবহা্রের মধ্যে প্রভু যীশুর মহিমা ধারণের আনন্দ আছে, ফলে এটা অন্যায় কিছু নয়, কিন্তু একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক গোলামির চিহ্ন ধারণ ও চর্চা বটে। আমাদের দেশে এর আগমন ঘটেছে ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে। ঔপনিবেশিকতা কিভাবে পরাধীন জনগোষ্ঠির সংস্কৃতির বিকৃতি, ক্ষয় বা বিলোপ ঘটালো সেই প্রশ্ন অতএব এড়িয়ে যাবার উপায় নাই। তার পরিণতির বিচার তো আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। তবে নতুন খ্রিষ্টীয় বছরে বিতর্ক তোলা আমার উদ্দেশ্য নয়। এতটুকুই আপাতত উদ্দেশ্য যে গোলামির চিহ্ন ও ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা থেকে মুক্ত হবার লড়াই যেহেতু বর্তমানকে অতিক্রম করে যাবার বাসনার সঙ্গে যুক্ত; অতএব অতীত মনে রাখা জরুরি। অর্থাৎ ইতিহাস। এই যুক্তিতে ইতিহাস মনে করিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য বটে।

গোলামির চিহ্ন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে, ইতিহাস পর্যালোচনা এবং নিরন্তর নতুন সম্ভাবনার অনুসন্ধান।

হ্যাপি নিউ ইয়ার, সিস্টার্স এন্ড ব্রাদার্স। সবাইকে নতুন ঈসায়ী বছরের শুভেচ্ছা।

খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যের যীশুখ্রিস্ট ইসলামেরও নবি: হজরত ঈসা(আ.)। আরেকটি ঈসায়ী বছর শেষ হচ্ছে। লিখছি দুই হাজার ষোল সালের শেষ দিন ভোরে। ছাপা হবে নতুন ঈসায়ী বছর ২০১৭ সালে। আমার ঘরের জানালার বাইরে কুয়াশা। খুব ঘন নয়, খুব তরলও নয়। এর একটি প্রতীকী তাৎপর্য থাকতে পারে, হয়তো ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য খুব অস্পষ্ট নয়, হতাশার প্রাবল্যে আমরা সাধারণত নেতিবাচক ভাবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। নতুন ঈসায়ী বছরে আমি নেতিবাচক কিছু ভাবতে চাই না। বরং মনে হচ্ছে একটি সন্ধিক্ষণের মূহূর্তই বরং স্পষ্ট হয়ে উঠছে। নিজেদের ইতিহাস নিয়ে নতুন ভাবে ভাববার এবং বিশ্বে বাংলাদেশের যোগ্য স্থান আদায় করে নেবার কর্তব্য আমাদের সামনে দ্রুত হাজির হচ্ছে। সুযোগ অনেক বাড়বে, সুযোগ অনেক বাড়ছে। আমাদের জানতে হবে কিভাবে বর্তমান বাস্তবতার মধ্য থেকে আমাদের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় আমরা আদায় করে নিতে পারি।

প্রশ্ন হচ্ছে, সন্ধিক্ষণের মুহূর্তের সম্ভাবনা আদায় করে নিতে আমরা তৈরি কিনা? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার একার দায় না। যারা বর্তমান অবস্থানের পরিবর্তন চান, তাদের সকলকে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকেই এই উত্তর দিতে হবে। সে ব্যাপারে তাই কিছু বলতে চাইছি না। আমি বর্তমান সময়কে সন্ধিক্ষণের মূহূর্ত বলছি সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জের জায়গা থেকে। নতুন ঈসায়ী বছরে সেই বিষয়েই দুই একটি কথা বলব।

দুই

বছর গণনার ক্যালেন্ডার দিয়েই শুরু করি। যীশুখ্রিস্টের জন্মদিন কেন্দ্র করে বছর গণনার পদ্ধতিকে এখন আর একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় পদ্ধতি বলে সাধারনত গণ্য করা হয় না। এতা আধুনিকদের বছর গণনা চর্চার অন্তর্ভূক্ত। যারা বাংলা সন বা হইজরি সন অনুসরণ করে তারা গ্রাম্য, পশ্চাতপদ কিম্বা মুসলমান। আমরা বছরের উল্লেখ করতে গিয়ে খ্রিস্টাব্দ বলি বা লিখি বটে কিন্তু একে সেকুলার বর্ষগণনা পদ্ধতি হিসাবেই গণ্য করি। এই অতি সাধারণ উদাহরণ থেকেই আমরা বুঝি যাকে আমরা নির্বিচারে ‘সেকুলার’ অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষ গণ্য করা হয় তা মোটেও ধর্ম নিরপেক্ষ নয়। এই দিকটা বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই ইতিহাস সচেতন হতে হবে। খ্রিস্টিয় কিম্বা ভিন্ন কোন ধর্মের ঐতিহ্য হলেই আমরা তা অস্বীকার করব তা না। কিন্তু যা একটি বিশেষ ধর্ম, সংস্কৃতি বা ইতিহাসের অন্তর্গত তাকে সার্বজনীন বা ‘সেকুলার’ দাবি করে ধর্ম নিরপেক্ষ বানাবার চেষ্টা আমরা অবশ্যই প্রতিহত করব। যা বিশেষ তাকে বিশেষ গণ্য করেই বিচার করতে হবে।

নিজেদের বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও বিবেচনার জায়গা থেকে গ্রহণ বা বর্জনে কোন দোষ নাই। কিন্তু যা বিশেষ (particular) তাকে সামান্য (universal) বা সার্বর্জনীন দাবি করা শুধু জ্ঞানগত ভুল না, সেই দাবি আধিপত্য কায়েমের দাবি, অপরকে পরাধীন করবার রাজনীতি। খ্রিস্টিয় ইউরোপীয় সভ্যতার  ভালমন্দ আছে, কিন্তু তা সার্বজনীন সভ্যতা নয়। আমরা নিজেরাও যদি তা মনে করি তখন আমরা নিজেদের নিজেরাই পরাধীন করি। যারা নিজেদের সংস্কৃতিকে সার্বজনীন দাবি করে তারা অন্য জনগোষ্ঠির ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চায়। তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধই তখন কর্তব্য হয়ে ওঠে। এর বিস্তর নজির আমরা আমাদের আশপাশ থেকেই দিতে পারব।

চ্যালেঞ্জটা এখানেই। কোন বিশেষ ধর্মের কিম্বা বিশেষ কোন দেশ, জাতি বা জনগোষ্ঠির ঐতিহ্য নানান ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক কারনে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। গ্রহণযোগ্যতা কিম্বা জনপ্রিয়তা সার্বজনীনতার মানদণ্ড নয়। যেমন মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় ঐতিহ্য। কারো ভালো লাগলে তারা ঘরে কিম্বা বাইরের অনুষ্ঠানে প্রদীপের আলো জ্বালাতেই পারেন। আমি নিজে আলো জ্বালাতে ভালবাসি। গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাটির কুপি জ্বালানো হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে গ্রামের মানুষের সংস্কৃতি। কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত এবং তথাকথিত সংস্কৃতিবান শ্রেণি যখন কোন অনুষ্ঠানে আলো জ্বালানোকে ‘মঙ্গলপ্রদীপ’ বলে অভিহিত করে তখন সেটা অবাঞ্ছিত তর্ক তৈরি করে। সেই তর্ক বিশেষ আর সামান্যের বা বিশেষ আর সার্বজনীনতার তর্ক। সেটা হয়ে দাঁড়ায় সেকুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষ সংস্কৃতির নামে একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় চর্চাকে সার্বজনীন বাঙালির সংস্কৃতি বলে দাবি করা। বলা বাহুল্য এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হবেই। এই দাবির অনুমান হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিকে বাঙালির সার্বজনীন সংস্কৃতি হিসাবেই সকলকে -- অন্য ধর্মাবলম্বী বাঙালিদেরকেও মেনে নিতে হবে। হিন্দু বাঙালির সংস্কৃতি অবশ্যই। কিন্তু সকল বাঙালির সংস্কৃতি নয়। এর মধ্য দিয়ে ধর্ম বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের নিরাকরণ ঘটাবার মতলব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।  'মঙ্গলপ্রদীপ' তখন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সাধনার বিপরীতে অনৈক্য, বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতার কারন হয়ে ওঠে। সারা বিশ্বের বাঙালিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা শতে ৬৭ জন। মঙ্গলপ্রদীপের রাজনীতি এ কারণে অসাম্প্রদায়িক নয়, সাম্প্রদায়িক আধিপত্য বিস্তারের উপায় মাত্র।

বাংলাদেশে মঙ্গলপ্রদীপ নিয়ে তীব্র তর্ক আছে বলে এই উদাহরণ দিলাম। বলাবাহুল্য তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই। উঠেছেও বটে। যারা প্রতিবাদ করেন সেকুলাররা তাদের সাম্প্রদায়িক বলে নিন্দা করেন। অথচ ব্যাপারটা উলটা। যারা বিশেষকে সার্বজনীন বলে চাপিয়ে দিতে চাইছে তারাই মূলত সাম্প্রদায়িক। এর নিকৃষ্ট দিক হচ্ছে এই কাজ করা হয় আধুনিকতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার নাম। মঙ্গল্প্রদীপ তখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

পূজায় মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালানো সাম্প্রদায়িক নয়, বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতি বলে সেটা বাঙালিরও সংস্কৃতি। কিন্তু সেকুলার বা তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ অনুষ্ঠানে আলো জ্বালানো কে ‘মঙ্গল প্রদীপ’ বলা, তাকে সার্বজনীন বাঙালির সংস্কৃতি বলে দাবি করা আর তার বিরোধিতাকারীদের সাম্প্রদায়িক বলা চরম সাম্প্রদায়িক চিন্তা। এই পার্থক্য বা ভেদ বিচারের ক্ষমতা অর্জন করাটাই এখন বাংলাদেশের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।

এর উলটা দিকও আছে। যেমন একমাত্র আরবদের সংস্কৃতিকে ইসলামি বা মুসলমানদের সংস্কৃতি বলে দাবি করা। যেন মুসলমান হতে হলে আমাদের ট্রাইবাল আরব, সামন্ত পাকিস্তান, কিম্বা উত্তর ভারতের সংস্কৃতি অনুকরণ করতে হবে। আমরা আরব, পাকিস্তানী কিম্বা উত্তর ভারতের পোষাককেই অনেক সময় ইসলামি পোষাক বলে গণ্য করি। আমরা আর্য নই, ফলে আর্য ইরান ও মধ্য এশিয়ার অনেক জাতির সঙ্গে আমাদের ফারাক আছে। তারা মুসলমান হতে পারেন, সেটা তাদের ঈমান ও আমল।  কিন্তু আল্লা তাদের আরব, ইরানি, তুরানি বানিয়েছেন, আমাদের বানিয়েছেন বাঙালি, বাংলাভাষী। আরব ইরান তুর্কি পাঠান সংস্কৃতি আর বাঙালির সংস্কৃতি এক নয়। আমামদের ভাষাও এক নয়।  কিন্তু পরস্পরের মধ্যে ঐতিহাসিক দেনাপাওনা আছে। আরবে ইসলামের নবি পয়গম্বররা এসেছেন, ফলে আরব সংস্কৃতির প্রতি বাঙালি মুসলমানের দুর্বলতা থাকা অন্যায় কিছু নয়। তেমনি আর্য সভ্যতা ও উত্তর ভারতের প্রতি বাঙালি হিন্দুর দুর্বলতাও অন্যায় নয়। কিন্তু এগুলো গুরুতর সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাভাষীদের নিজের ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সেই ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা আত্মঘাতী। কিভাবে এই আত্মঘাতী পথ পরিহার করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

দৈনন্দিন জীবনচর্চার সাধারণ দিক থেকেও আমরা ভাবনা শুরু করতে পারি। যেমন, বাঙালির পোষাকের ওপর বাংলা সংস্কৃতির কোন ছাপ থাকবে কি থাকবে না। তাকে আরব দেশীয় কিম্বা উত্তর ভারতের কোর্তা কামিজ হতে হবে —এর কি কোন যুক্তি আছে? নাই। তেমনি শার্ট প্যান্ট স্যুট টাই পরলেই আমরা আধুনিক হয়ে যাবো সেটাও অযৌক্তিক হাস্যকর চিন্তা। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উপনিবেশোত্তর কালপর্বে আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের প্রত্যাবর্তনের কোন যুক্তি কিম্বা ঐতিহাসিক ন্যায্যতা আছে কিনা। একে আমি কোন জাতিবাদী প্রকল্প গণ্য করি না। সাঁওতাল, চাকমা, ম্রং বা বাংলাদেশের অন্যন্য জাতিগোষ্ঠির ওপর কোন সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম এর উদ্দেশ্য। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈচিত্র ও ভিন্নতার ঢ় গুরুত্ব অনুধাবন এবং যা 'বিশেষ', তাকে বিশেষ হিসাবেই গণ্য করা। যদি ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে কোন জনগোষ্ঠি  বিশ্বব্যবস্থায় নিজেদের স্থান করে নিতে চায় তাহলে আর কোন গত্যন্তর আছে কিনা আম মনে করি না। হতে পারে দর্শন ও কাব্যের প্রতি অতি আগ্রহের কারনে ভাষা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার মতো দুর্দশা ভয়ংকর। ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ এই কাণ্ডটি ঘটায়। এর প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় স্থান করে নিতে হবে।

দেখা যাচ্ছে বিশেষ আর সামান্যের ভেদ নিছকই দার্শনিক তর্ক নয়। এই তর্কে আশার আলো ওখানে যে এই বিষয়গুলো ক্রমশ পরিচ্ছন্ন হতে শুরু করেছে। ফলে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের জনগণ কিভাবে তাদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে এবং নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধের মীমাংসা সম্পন্ন করে শক্তিশালী জনগোষ্ঠি হিসাবে ফিরে দাঁড়াবে তার চিহ্নগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট।

তিন

সংস্কৃতির উদাহরণ দিচ্ছি, সহজে কিছু কথা বোঝাবার জন্য। যদি কিছুটা তা বুঝে থাকি তাহলে এই দিকটিও আমরা বুঝব যে ইসলামের ইতিহাস শুধু আরবদের ইতিহাস নয়, বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসও বটে। আবির্ভাব ও বিকাশের নিজস্ব ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস জানা ও বোঝাই একালে আমাদের বড় একটি কাজ। ঠিক তেমনি আর্য ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস নয়, আর্য অনার্যের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসকে আর্যের বিজয় আর অনার্যের পরাজয় হিসাবে পাঠ করার অভ্যাস থেকেও মুক্ত হওয়ার দরকার আছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেকে প্রায়ই হতাশা ব্যক্ত করেন। দুর্নীতি, নাগরিক ও মানবিক অধিকারের বিপর্যয়, শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে সারা বছরই আমরা লেখালিখি করেছি। বলা বাহুল্য আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমখুন, হেফাজতে মৃত্যু, সর্বোপরি সন্ত্রাস দমনের নামে রাষ্ট্রের দানবীয় সন্ত্রাসী রূপ আমাদের ভয়ংকর হতাশ করে। নতুন বছরে সেই দিকগুলো নিয়ে হাহুতাশের ইচ্ছা আমার নাই। আমরা নিজেদের কিভাবে দেখি এবং আগামি দিনে কী হতে চাই সেই বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়াটাই সবচেয়ে বেশী জরুরী।

আশার কথা আমরা একটি সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। বাংলাভাষী বা বাঙালি হিসাবে নিজের ইতিহাস বুঝতে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণ একবার আরব ইতিহাস আরেকবার বর্ণহিন্দুর ইতিহাসের মধ্যে খাবি খেয়েছে। নিজেদের লড়াই সংগ্রামে নিজেদের আবিষ্কার করার চেষ্টা না করে বেপথু হয়েছে বারবার। বাংলা ভাষার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, বাংলার বিচিত্র ও বিভিন্ন লোকাচার ধর্ম সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের তাৎপর্য বোঝার পথ ও পদ্ধতি নির্ণয়ের সাধনা নাই বললেই চলে। মনে হয়, এই পর্ব দ্রুত শেষ হতে চলেছে। এর প্রধান কারন হচ্ছে 'বাঙালি' জাতিবাদের প্রবল ও প্রকট উত্থানের কারনে আমাদের বোঝানো হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির অগ্রাধিকার কায়েমের যুদ্ধ, ধর্মকে প্রাইভেট কিম্বা সমাজ ও ইতিহাসের গৌণ বিষয়ে পরিণত করার লড়াই। উগ্র বাঙালি জাতিবাদীরা বিভিন্ন ভাবে দাবি করেছে একাত্তরে ইসলাম পরাজিত হয়েছে। জয় হয়েছে 'বাঙালি'র। এই 'বাঙালি'র সংজ্ঞায় মুসলমান নাই। ইসলাম অনুপস্থিত।  বর্ণহিন্দু যেভাবে ঔপনিবেশিক কালপর্বে যবনদের বিপরীতে নিজের হিন্দু জাতিবাদী পরিচয় নির্ণয় করেছে তাকেই সার্বজনীন বাঙালির পরিচিয় হিসাবে হিন্দু জাতিবাদীরা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যার গুরুত্বপূর্ণ নজির। এই 'বাঙালি' মূলত বর্ণহিন্দুর প্রকল্প। বর্ণহিন্দুর প্রকল্প হিসাবে আগামি দিনে বাংলাদেশে ইসলাম নির্মূলই 'বাঙালি'র আত্মপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ-- বাঙালির একমাত্র রাজনীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। এই রাজনীতির কদর্য রূপ গত চার দশকের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের জনগনের কাছে স্পষ্ট। বর্ণহিন্দুর বয়ানে তৈয়ারি উগ্র বাঙালি জাতিবাদের শেষ ছোবল বাংলাদেশ দেখেছে ২০১৩ সালে।

উগ্র জাতিবাদের শেষ ছোবল কাজ করে নি। আজ ২০১৬ সালের শেষ দিনে আমি নিশ্চিত ধর্ম ও জাতি পরিচয় নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ বিশাল একটি সাংস্কৃতিক উল্লম্ফন দিয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের নতুন ভাবে সম্পর্ক নির্মান করতে হবে। পুরানা অনুমান ও বয়ানগুলোকে প্রশ্ন করতে হবে। যাতে সম্পর্ক নির্মাণের  পথ ও পদ্ধতির হদিস আমরা পাই। এই কাজ আগের চেয়ে অনেক বেশী স্পষ্ট ও পরিচ্ছিন্ন। আমরা পিছিয়ে যাই নি, এগিয়ে গিয়েছি। এর রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ আমরা আগামিতে অবশ্যই দেখব।

ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস পরস্পর বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তাদের বিবর্তন ও বিকাশ, রূপান্তর ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করবার ক্ষমতা রাখি। এই শক্তিটুকু আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে।

নতুন বছরে এই আশাই ব্যাক্ত করছি। নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধের মীমাংসা সম্পন্ন করে শক্তিশালী জনগোষ্ঠি হিসাবে ফিরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। তার চিহ্নগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট।

 

৩১ ডিসেম্বর ২০১৬। ১৭ পৌষ ১৪২৩। শ্যামলী, ঢাকা

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।