সার্চ কমিটি ও ‘সুশীল’ এর সংজ্ঞা
বলা হচ্ছে, ২০১৯ সালে জাতীয় নির্বাচন হবে। নিয়ম অনুযায়ী তেমনটাই হওয়ার কথা। সে উপলক্ষে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের দাবি আছে সর্ব মহলে। নির্বাচনকে ঘিরে, অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আরো নানা দাবি আছে বিভিন্ন পক্ষের। নিরপেক্ষ কমিশন গঠন তার অন্যতম। এ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত ডিসেম্বর মাসজুড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করেছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ মোট ৩১টি দল তাতে অংশ নেয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নানা দল নিজেদের মতো করে নানা দাবি তার কাছেতুলে ধরে ।
এরপর গত ২৫ জানুয়ারি কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি করে দেন। অতীতেও ইসি গঠনে এমন সার্চ কমিটি হয়েছে। যেমনটি হয়েছিল ২০১২ সালেও। বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ওই কমিটির প্রধান ছিলেন। বিচারপতি মাহমুদসহ তার কমিটির সদস্যরা সার্চ করে যাদেরকে বের করেছিলেন, তাদের থেকেই বহুল আলোচিত-সমালোচিত কাজী রকীবউদ্দীনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। এবারের সার্চ কমিটিরও প্রধান করা হয়েছে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে। আগের বার তার নেতৃত্বে আরো তিনজন সদস্য ছিলেন, যাদের সবাই ছিলেন বিচারপতি কিম্বা আমলা। তবে এবার রাষ্ট্রপতি সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা অবলম্বন করেছেন। আগের বারের চার সদস্যকে বাড়িয়ে ছয় সদস্য করেছেন, এবং বিচারপতি ও আমলাদের বাইরে থেকে দুইজনকে যুক্ত করেছেন।
এই নতুন যুক্ত দুইজনকে দেশীয় মিডিয়া পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ‘সুশীল সমাজের প্রতিনিধি’ হিসেবে। এবারের কমিটির বিচারপতি সদস্যরা হলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মাহমুদুল হাসান। আমলা সদস্যরা হচ্ছেন, মহাহিসাব নিরীক্ষক মাসুদ আহমেদ এবং পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। বাকি দু’জন হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক শিরীণ আখতার। বলা হচ্ছে শেষের দুইজন হলেন ‘সুশীল সমাজের প্রতিনিধি’।
‘সুশীল সমাজ’ কী জিনিস? বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের কারনে ‘সুশীল’ বাংলাদেশে নিন্দাবাচক শব্দ। তারপরও গণমাধ্যম ‘সুশীল সমাজ’ বলতে বাংলাদেশে খুব সহজ সরলভাবে কিছু কথা বোঝাতে চায়। যেমন, বাংলাদেশে সুশীল সমাজের সদস্যরা এমন সব গণ্যমান্য এবং সমাজে অবদান রাখা ব্যক্তিবর্গ, যাদের কোনো ঘোষিত বা প্রকাশ্য দলীয় অবস্থান থাকে না বা নাই। তারা যাবতীয় দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে উঠে দেশ ও সমাজের স্বার্থ রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নানা বিষয়ে কথা বলে থাকেন। এই ভাবমূর্তি অবশ্য গণমাধ্যমই তৈরি করে। কিন্তু সমাজ এই ধারণাটিকে একদম পরিত্যাগ করে তা নয়। নিদেনপক্ষে সুশীলতার এই চরিত্র লক্ষণ যদি মানি তাহলে প্রকাশ্যে কোনো দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা বা কোনো দলীয় অবস্থানকে নিজের অবস্থান হিসেবে ঘোষণা করা কোনো ব্যক্তি আর যাই হোন না কেন, ‘সুশীল’ হয়ে উঠতে পারেন না।
উপরের কথাগুলো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর দেয়া সংজ্ঞা থেকে উল্লেখ করিনি। আমরা সমাজের নাগরিকরা গণ্মাধ্যমের দ্বারা ইতিবাচক ভাবে প্রভাবিত হয়ে ‘সুশীল সমাজ’ শব্দের যে মানে বুঝি তা-ই তুলে ধরেছি। এই লেখা যিনি পড়ছেন তিনিও নিজের মনের ভাবের সাথে মেলালে এই ক’টি কথাই পাবেন ‘সুশীল সমাজ’ এর পরিচয় হিসেবে। যারা ‘সুশীল’ বলে নিজেকে অন্যকে 'পরিচয় করিয়ে দেন, তারাও এ কথাগুলো বুঝিয়ে থাকেন।
যাইহোক, এবার দুয়েকটা প্রমাণ দেয়া যাক যে, কে কোথায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক শিরীণ আখতারকে ‘সুশীল সমাজের প্রতিনিধি’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
সার্চ কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণার দিন ২৫ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত "সার্চ কমিটিতে যাঁরা থাকছেন” শিরোনামের সংবাদটি থেকে উদ্ধৃতি:
"রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দুটি সূত্র জানিয়েছে, সার্চ কমিটি গঠন করতে জিল্লুর রহমানের ওই ফর্মুলা বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও অনুসরণ করেছেন। তবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং নারী প্রতিনিধি হিসেবে শিরীণ আখতারকে অন্তর্ভুক্ত করে এর আকার বাড়িয়েছেন।"
এখানে “তবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং নারী প্রতিনিধি হিসেবে শিরীণ আখতারকে অন্তর্ভুক্ত করে এর আকার বাড়িয়েছেন” কথাটি সরকারের, নাকি প্রথম আলোর, তা আলাদা করার উপায় নেই। তাই আরেকটু স্পষ্টভাবে দেখা যাক প্রথম আলো নিজেই সৈয়দ মনজুরুলকে ‘সুশীল সমাজের প্রতিনিধি’ মনে করে কিভাবে?
২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত "প্রথম আলোর মিলনমেলা" শিরোনামের খবরটি থেকে উদ্ধৃতি:
"সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ, আইনবিদ রফিক-উল হক, হাসান আরিফ ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রাশেদা কে চৌধূরী, রশীদ হায়দার, শিল্পী আবুল বারক আলভী, শহীদ কবির, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আতিউর রহমান, আইনুন নিশাত, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, জাহেদা আহমেদ, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ, অধ্যাপক শরিফ উদ্দিন আহমেদ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপকেরা।"
প্রথম আলোর করা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের এই তালিকায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর নাম রয়েছে। এখানে লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, ‘বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপকেরা।” বলে এই পদগুলোকে ‘বাই ডিফল্ট’ ‘সুশীল সমাজ’- এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে! যেনবা, অধ্যাপক বা উপাচার্য হলে কেউ আর কোনো ‘দলের লোক’ হতে পারেন না!
উপরের দুটি উদ্ধৃতি থেকে সার্চ কমিটির দুই অধ্যাপক সদস্যকে ‘সুশীল’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার একটা মানদণ্ড পাওয়া গেল। এবার যাওয়া যাক ভিন্ন প্রসঙ্গে।
যেই প্রথম আলো ‘বাই ডিফল্ট’ অধ্যাপক এবং উপাচার্যদেরকে ‘সুশীল সমাজ’- এর অন্তর্ভূক্ত করেছে উপরের রিপোর্টে, সেই প্রথম আলোর আরো দুয়েকটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি নিচে খেয়াল করা যাক:
২০১৩ সালের ১২ জুন "বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার বৈঠক" শিরোনামের সংবাদটির ইন্ট্রো ছিল:-
"বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। খবর ইউএনবির।"
এখানে বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদেরকে ‘বিএনপিপন্থী’ হিসেবে দলীয় তকমা লাগানো হয়েছে। এই শিক্ষাবিদদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক অধ্যাপক বা উপচার্য ছিলেন- যাদেরকে প্রথম আলো ‘বাই ডিফল্ট’ ‘সুশীল’ হিসেবে গণ্য করে থাকে! কিন্তু এই অধ্যাপকরা এখানে ‘সুশীল সমাজের প্রতিনিধি’ না হয়ে হয়েছেন ‘বিএনপিপন্থী’।
যদিও খবরটির ভাষা মূলত ইউএনবির বরাতে দেয়া, তবু এই ভাষা ব্যবহারের দায় প্রথম আলো এড়াতে পারে না। কারণ অবশ্যই ‘বিএনপি বীট’-এ কাজ করা এক বা একাধিক রিপোর্টার পত্রিকাটির রয়েছেন। তাদের রিপোর্টকে ব্যবহার করেনি প্রথম আলো।
এভাবে শুধু প্রথম আলো নয়, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব মিডিয়াই বিএনপি-ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীদেরকে ‘বিএনপিপন্থী’ হিসেবে তকমা লাগিয়ে দিতে পছন্দ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলানিউজের নিচের রিপোর্টটি। "খালেদার সঙ্গে বুদ্ধিজীবী-নেতাকর্মীদের সাক্ষাৎ" শিরোনামে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রথম প্যারাটি হল:
"বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী ও দলীয় নেতাকর্মীরা। শনিবার রাতে চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে দেখা করেন তারা।"
আরেকটি উদাহরণ হতে পারে- "অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা আর নেই" শিরোনামে ২০১৬ সালের ১৩ জুন প্রকাশিত বিডিনিউজের সংবাদটি। এর শুরুটা হচ্ছে হুবহু এরকম—
"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী মনিরুজ্জামান মিঞা অসুস্থতার কারণে অনেকদিন ধরেই অনেকটা আড়ালে ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
মনিরুজ্জামান মিঞা বিএনপি সমর্থক পেশাজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক জাতীয় কমিটির সদস্য ও জিয়া পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় পুনর্গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে কমিশনারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।"
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, ‘বিএনপি সমর্থক পেশাজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক জাতীয় কমিটির সদস্য ও জিয়া পরিষদের চেয়ারম্যান’ থাকার কারণে মনিরুজ্জামান মিঞা ‘বিএনপিপন্থী’। তিনি কোনো ভাবেই ‘সুশীল’ ’ নন।
এবার আমরা দেখবো, সার্চ কমিটিতে ‘সুশীল’ কোটায় স্থান পাওয়া, এবং মিডিয়াও যাদেরকে ‘সুশীল’ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেছে, সেই দুই অধ্যাপকের (অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক শিরীণ আখতার) দলীয় সংশ্লিষ্টতার কী অবস্থা?
ঢাকাটাইমস24ডটকম নামে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে, "শেখ হাসিনার বিকল্প নেই আ.লীগে"। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় আওয়ামী লীগের ওই বছর অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে। দুইজন বুদ্ধিজীবী ব্যক্তির সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন। ব্যক্তি দু'জন হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক এবং আরেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
প্রতিবেদনটির শেষাংশে একটি প্যারা হচ্ছে:
"এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মনজুরুল বলেন, “২০১৯ সালের নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই হতে হবে। তবে আমার মনে হয় আওয়ামী লীগের বিকল্প নেতৃত্ব নিয়ে ভাবতে হবে। একজন মানুষের ওপর নির্ভরতা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না। আওয়ামী লীগে এখন থেকেই সেই ভাবনা শুরু হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী হয়তো সেই ভাবনারই ইঙ্গিত দিয়েছেন।”
লক্ষ্যণীয় বাক্যটি হল- “২০১৯ সালের নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই নির্বাচন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই হতে হবে”।
২০১৯ সালের নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে হবে- এটি আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য দলীয় অবস্থান। এর ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত অবস্থানে রয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের অবস্থানটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত। যাইহোক, অধ্যাপক মনজুরুলের করা মন্তব্যটি যে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য দলীয় অবস্থান তা প্রমাণ করতে মাত্র দুটি সংবাদের শিরোনামই যথেষ্ট।
শিরোনাম ১: “শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে : তোফায়েল” (কালের কণ্ঠ, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬)
http://www.kalerkantho.com/online/Politics/2016/12/26/445478
শিরোনাম ১: “শেখ হাসিনার অধীনে '১৯ সালে নির্বাচনে অংশ নেবেন খালেদা: নাসিম (জনকণ্ঠ, ৪ এপ্রিল ২০১৬)
উপরিউক্ত মন্তব্যের পর সৈয়দ মনজুরুলের আওয়ামী দলীয় আনুগত্য প্রমাণের জন্য আর কিছু দরকার পড়ে না। তবু আরেকটি বিডিনিউজের সংবাদ তুলে ধরা যায়। “বঙ্গবন্ধু শাসনামলের ইতিহাস বিকৃত করেছে পরের সরকারগুলো” শিরোনামে ২০১৬ এর ৯ আগস্ট রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে তিনি বলেছেন:
"পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো জাতির জনকের শাসনামলের ইতিহাসকে ‘অশুভ উদ্দেশ্যে’ বিকৃত করেছে বলে মন্তব্য করেছেন কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীতে এক একক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “১৯৭২ থেকে ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধুর এই শাসনামল নিয়ে সমালোচনা হতো অশুভ উদ্দেশ্যে, মানুষের ঐক্য নষ্টের উদ্দেশ্যে।"
http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1195710.bdnews
অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমালোচনা সহ্য হয় না অধ্যাপক মনজুরুলের। যেমনটি সহ্য হয় না কোনো আওয়ামী লীগ নেতারও। দল-নিরপেক্ষ এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী কোনো মানুষ পক্ষে এমন ‘সমালোচনা-বিরোধী’ হওয়ার সুযোগ আছে কি?
‘সুশীল’ কোটায় সার্চ কমিটিতে স্থান পাওয়া আরেক অধ্যাপকের রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আরো প্রত্যক্ষ। তিনি একদম সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন।
"বিচারপতি মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সার্চ কমিটি"- এই শিরোনামে ২৫ জানুয়ারি প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার তথ্য:
"প্রথম আলোর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই শিরীণ আখতার আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ দলের সঙ্গে রয়েছেন। ২০১৪ সালে হলুদ দলের প্যানেল থেকে শিক্ষক সমিতির কার্যকরী সদস্য হয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, শিরীণ আখতারের বাবা মৃত আফসার কামাল চৌধুরী কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।"
পরদিন ২৬ জানুয়ারি প্রথম আলো ইংরেজি ভার্সনে আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। যেটির শিরোনাম- "Shireen’s CV belies Quader’s claim".
তাতে লেখা হয়েছে—
"Bangladesh Awami League (AL) general secretary Obaidul Quader on Thursday claimed that the president appointed no person affiliated with any political party as members of the search committee.
But the very biodata of one of the six committee members, Shireen Akhter, contradicts the claim of the ruling AL general secretary.
Shireen Akhter's biodata which remains posted on the website of the Chittagong University reads she is a member of Cox’s Bazar Mahila Awami League, the woman front of the ruling AL."
http://en.prothom-alo.com/bangladesh/news/137205/Shireen%E2%80%99s-CV-belies-Quader%E2%80%99s-claim
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় থাকা, কিম্বা আওয়ামী লীগের বিতর্কিত দলীয় অবস্থানের সাথে নিজের অবস্থান তুলে ধরার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা প্রোভিসি হওয়ার সুবাদে একপক্ষ বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী ‘সুশীল’ হতে পারেন, নিরপেক্ষ হতে পারেন। এবং মিডিয়াও তাদের ‘সুশীল’ পরিচয় হাইলাইট করে প্রচার করে। অন্যদিকে, বিএনপির কোনো দলীয় পদ ধারণ না করে, বা প্রকাশ্য বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের পক্ষে প্রচারণায় না নেমে অধ্যাপক-উপচার্য হওয়ার পরও ‘সুশীল’ হতে পারেন না আরেকটি পক্ষ। মিডিয়া তাদেরকে ‘বিএনপিপন্থী’ তকমা দিয়ে ‘দলীয় বুদ্ধীজীবী’ আকারে প্রচার করে।
অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও মিডিয়ার প্রচারণা মতে, বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা দুই প্রকার: এক. বিএনপিপন্থী। দুই. সুশীল। কোনো আওয়ামীপন্থী নেই! চলমান বাংলাদেশে ‘সুশীল’ এর সংজ্ঞা এভাবেই পড়ানো হচ্ছে।