‘বুর্জোয়া’


 আমরা ‘বুর্জোয়া’বুঝি কি?

বামপন্থায়, তবে বিশেষ ভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনে, একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হচ্ছে ‘বুর্জোয়া’। শ্রেণি-রাজনীতি যারা করেন তাদের কাছে এই শব্দটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আমরা তরুণ বয়সে যখন কমিউনিস্ট রাজনীতিতে দীক্ষা নেই তখন শব্দটার প্রতি আমাদের আকর্ষণ ছিল প্রবল। শব্দটি মনের মধ্যে প্রচণ্ড শত্রু শত্রু ভাব জাগাতো কারন এই শ্রেণির বিরুদ্ধেই শ্রমিক শ্রেণি বা কমিউনিস্ট ভাষায় ‘প্রলিতারিয়েত’কে লড়ে বিপ্লব করতে হবে। এ বছর ২০১৭ সালে রুশ বিপ্লবের একশত বছর উদযাপিত হচ্ছে। সেই উপলক্ষে আমরা বিশেষ ভাবে ‘বুর্জোয়া’ শব্দটি নিয়ে আলোচনা করব। বিপ্লবী রাজনীতির কিছু পরিচিত কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা রয়েছে। ‘বুর্জোয়া’ তেমনই একটি শব্দ।

‘বুর্জোয়া’বলতে আমরা এখনও স্রেফ অর্থনৈতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ধনি বা বড়লোক বুঝি। এর দ্বারা সমাজের শোষক শ্রেণিকে বোঝানো হয়। সরল ভাবে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রাম বোঝানোর জন্যই বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে সর্বহারার লড়াই কথাটা বলা হয়। কিন্তু এটা খুবই সরলীকরণ। এতে বিস্তর বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক কিম্বা কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠল না তার পেছনে বিপ্লবী পরিভাষা বা বর্গের অর্থ নৈতিক ও রাজনৈতিক মর্ম এবং উভয়ের সম্পর্ক সম্বন্ধে যথাযথ পর্যালোচনার অভাব বড়সড় একটি কারণ বলেই আমার মনে হয়। রাজনীতি মূলত সমাজের চিন্তাশীলতারও একটি মাত্রা। ফলে ভাষার বিচার দিয়ে সমাজকেও চেনা যায়। এইটুকু যদি বুঝি তাহলে এ কথাও আমরা মানতে বাধ্য যে নিজেদের সমকালের চিন্তা ও তৎপরতার সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই, আগামির বিপ্লবী তরুণদের কাছে হয়তো বিগত দিনের দায় কিছুটা মেটানো সম্ভব।

ভাষা, পরিভাষা বা সামগ্রিক ভাবে বিপ্লবী রাজনীতির বিকাশের জন্য রাজনৈতিক সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে মার্কস, লেনিন বা মাওজে দং অনুপ্রাণিত রাজনীতির রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিপ্লবী পরিভাষার অপরিচ্ছন্নতা কতোটা নির্ধারক ছিল তা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক গবেষণার ক্ষেত্র এবং বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিপ্লবী পরিভাষার সম্যক উপলব্ধি ছাড়া বিপ্লবী রাজনীতির সফলতা আশা করা বাতুলতা। সে কারনেই বিপ্লবী পরিভাষার তাৎপর্য বিচার বাংলাদেশে রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আরেকটি শব্দ হচ্ছে ‘প্রলিতারিয়েত’। এর অর্থ করা হোত শ্রমিক শ্রেণি। ‘বুর্জোয়া ’শব্দটির মতো এই ধারণাটিকে নিয়েও আমরা বিপাকে পড়তাম। যদি ‘বুর্জোয়া’ মানে ধনিক শ্রেণি আর প্রলিতারিয়েত মানে শ্রমিক হয়, তাহলে সেভাবে বললেই তো সহজ হয়, আলাদা করে শব্দ দুটি জারি রাখবার কি দরকার? নাকি ‘বুর্জোয়া’ ও ‘প্রলিতারিয়েত’-এর এমন কিছু অতিরিক্ত অর্থ বা তাৎপর্য আছে যাকে অর্থনৈতিক বর্গে পর্যবসিত করলে রাজনৈতিক মানে হারিয়ে যায়। যাদের আমরা বাংলাদেশে কমিউনিস্ট হিসাবে সক্রিয় পেয়েছি তারা সাধারণতএই সকল গুরুত্বপূর্ণ শব্দকে কেবলই অর্থনৈতিক ক্যাটাগরির জায়গা থেকেই মানে করতেন, এটাই আমার অভিজ্ঞতা। অন্যদের ভিন্ন উপলব্ধি থাকতে পারে। বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিভাষার ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক পরে নিষ্ঠার সঙ্গে কার্ল মার্কস পড়ে বোঝার চেষ্টা করেছি।

‘বুর্জোয়া’ বাংলা শব্দ নয়, ফরাসি। প্রবলআকর্ষণ থাকলেও রহস্যে টইটুম্বুর এই বিদেশি শব্দের মানে– আক্ষরিক কিম্বা রাজনৈতিক --কখনই বাংলাদেশে স্পষ্ট ছিল না। অভিধান ঘেঁটে আক্ষরিক অর্থ দিয়ে শব্দটির মানে বোঝা যাবে না, যে কারনে বলা হয় এটি একটি ‘পলিসিমি’’ (polesemy)– অর্থাৎ লেখালিখির মধ্যে শব্দটি কিভাবে ব্যবহৃত হোল তার দ্বারাই অর্থ বুঝতে হবে।অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তি শুধু বাংলাদেশে নয়, অন্য দেশেও ছিল। এঙ্গেলস ১৮৮৮ সালে কমিউনিস্ট ইশতেহারের ইংরেজি সংস্করণে শব্দটির অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন: “বুর্জোয়া বলতে আধুনিক পুঁজিপতি শ্রেণীকে বোঝায়, যারা সামাজিক উৎপাদনের উপায়গুলোর মালিক এবং মজুরি-শ্রমের নিয়োগ কর্তা। প্রলিতারিয়েত হোল আজকালকার মজুরি-শ্রমিকেরা, উৎপাদনের উপায় নিজেদের হাতে না থাকার দরুন যারা বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় শ্রম শক্তি বেচতে বাধ্য হয়” (কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ১৮৮৮ , p. ২৮)।

এঙ্গেলসের এই ব্যাখ্যা মূলত অর্থনৈতিক। ‘বুর্জোয়া’ শব্দটিকে প্রথমত ব্যক্তি নয়, শ্রেণি হিসাবে বোঝার প্রশ্ন রয়েছে। ব্যক্তি এবং শ্রেণি এক নয়। অন্যদিকে শব্দটিকে যদি আমরা চেতনাগত ভাবে বুঝতে চাই তাহলে ব্যক্তি কিম্বা শ্রেণির অর্থনৈতিক সংজ্ঞার সঙ্গে চেতনার সম্পর্ক বিচার জরুরী। এরপর রয়েছে রাজনৈতিক চেতনার সম্পর্ক বিচারের প্রশ্ন। এঙ্গেলসের ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তির চেতনা সম্পর্কে যে ধারণা গড়ে উঠেছে তা হোল অর্থনৈতিক অবস্থা কিম্বা উৎপাদনের উপায়ের ওপর মালিকানা থাকা না থাকার ওপর মানুষের চেতনা এবং তার রাজনৈতিক ভূমিকা সরাসরি সম্বন্ধযুক্ত। বাংলাদেশে এর একটা নৈতিক মানে দাঁড়িয়েছে ধনি বা সম্পদশালী ব্যক্তি মানেই মন্দ। এমনকি এঙ্গেলসও বিষয়টিকে সম্পদের মালিকানা দিয়ে বিচার করেন নি, উৎপাদনের উপায়ের ওপর মালিকানা এবং মজুরি-শ্রমের নিয়োগ কর্তা হিসবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারপরও অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনা ও কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক বিচারের কর্তব্য থেকে যায়, কিন্তু বাংলাদেশে কমিউনিজম ধনসম্পদের প্রতি এবং সম্পদশালীদের বিরুদ্ধে যে বিশেষ মানসিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর গড়ে উঠেছে তা শুরুতেই এর বিকাশের সম্ভাবনাকে সীমিত এবং এক পর্যায়ে রুদ্ধ করে দিয়েছে বলা যায়। মার্কস এবং এঙ্গেলসের জর্মান ভাবাদর্শের পর্যালোচনা, মার্কসের অর্থশাস্ত্র, লেনিনের অর্থনৈতিক বিচার বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয়ের বিজ্ঞান – প্রভৃতির কোন দৃশ্যমান বিকাশ বাংলাদেশে ঘটে নি। কমিউনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক কিম্বা শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল পেটি বুর্জোয়া নীতি নৈতিকতা চর্চার অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে নি। বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের ধাক্কায় ধনসম্পদ ও ধনবানদের বিরোধিতা করে রাজনীতি করবার পরিসর যতোই সংকীর্ণ হতে শুরু করেছে ততোই নিজেদের রাজনৈতিক ন্যায্যতা ধরে রাখার জন্য নানান কিসিমের বামপন্থি শিবির নিজেদের বাঙালি জাতিবাদি বয়ানের কাছে আত্মসমর্পন করেছে কিম্বা শ্রেণি সংগ্রাম বাদ দিয়ে ইসলাম, ইসলামী মৌলবাদ, ইসলামী জঙ্গিবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়তে নেমে পড়েছে।

মস্কোর প্রগতি প্রকাশনী থেকে এঙ্গেলস সম্পাদিত ইংরেজি সংস্করণের বাংলা অনুবাদ বেরোয় মাত্র ১৯৮৫ সালে। মূল জর্মান থেকে বাংলায় কোন অনুবাদ দেখি নি। সেখানে বুর্জোয়া বা প্রলিতারিয়েতের কোন বাংলা অনুবাদ করা হয় নি; শব্দগুলোর কোন বঙ্গীয় রূপান্তর ঘটে নি। ফলে তাদের অর্থও হয়েছে নানান জনের কাছে নানান রকম। তবে এটা ঠিক যে প্রায় সবক্ষেত্রেই ‘বুর্জোয়া’ একান্তই অর্থনৈতিক বর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সম্পর্ক নির্ণয় জটিল বলে উপেক্ষিত হয়েছে, নাকি বোঝাবুঝির ঘাটতি সত্ত্বেও কোন জিজ্ঞাসা তৈরি হয় নি সেটা আলাদা গবেষণার বিষয় । তবে উপেক্ষিত হয়েছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। ধরে নেওয়া হয়েছে বুর্জোয়া মানে কলকারখানার মালিক মাত্র। আর তাদের বিরুদ্ধে কলকারখানার শ্রমিকরাই তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়ে।

বাংলাদেশে কমিউনিস্ট রাজনীতির সবচেয়ে রমরমা অবস্থায় ষাট থেকে নব্বই দশক অবধি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পরিভাষা হিসাবে ‘বুর্জোয়া’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে এটা দাবি করা যাবে না। অধিকাংশ সময়ই ব্যবহৃত হয়েছে ‘ধনি’ বা ‘ধনিক শ্রেণি’র প্রতিশব্দ হিসবে। ‘বুর্জোয়া’ সুনির্দিষ্ট ভাবে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি শ্রেণির চেতনা এবং বাস্তব কিম্বা সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভুমিকা বোঝাবার জন্য ব্যবহার হবার কথা। কিন্তু সেটা বাংলাদেশের চিন্তার চর্চায় কিম্বা রাজনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে কখনই পরিষ্কার ছিল না। এখনও নয়।

তারপরও মনে রাখতে হব বাংলাদেশে ষাট থেকে আশির দশক অবধি বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট বা কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বামপন্থার অবদান অসামান্য। ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতিবাদি লড়াই সংগ্রামেও তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সেই অবদান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন কেন শক্তিশালী মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি অর্জন করতে পারল না সেই জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক পরিভাষা নিয়ে এই আলোচনা।

অর্থনৈতিক অবস্থা বনাম রাজনৈতিক চেতনা

বুর্জোয়া চেতনাকে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যায় পর্যবসিত করা অতি সরলীকরণ; মানুষের বৈষয়িক জীবনের সঙ্গে তার চেতনার সম্পর্ক নির্ণয় জটিল একটি ক্ষেত্র যা নিয়ে বিস্তর তর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে এ যাবতকাল কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রধান প্রধান ধারা মূলত এঙ্গেলসের তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছে, মার্কস নয়। বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ভূমিকা আধুনিক পুঁজিপতিদের দিয়ে বোঝা কঠিন।‘পুঁজি’ আর ‘পুঁজিপতি শ্রেণী’ এক নয়। পুঁজির আত্মস্ফীতি এবং পুঞ্জিভন প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিভিন্ন শ্রেণী তৈরী হয়। মানুষের চিন্তাচেতনা ও ধ্যানধারণাও পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্যে বিশেষ রূপ পরিগ্রহণ করে। কার্ল মার্কসের ‘পুঁজি’ বোঝা আর পুঁজিপতি শ্রেণি বোঝা সমার্থক নয়। কিন্তু উভয়ের সম্পর্ক চেতনাগত বা রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যাখ্যার একটা ঘাটতি রয়ে গিয়েছে।

‘ধন’ বা ‘ধনী’ অর্থনীতির ভাষা বা বর্গ, রাজনীতির – অর্থাৎ রাজনৈতিক চেতনা নির্ণয়ের নির্দেশক নয়। ‘বুর্জোয়া’ ও ‘প্রলিতারিয়েত’ শুধু অর্থনীতির দ্যাওতক নয়, একই সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চেতনার নির্দেশকও বটে। যে কারনে এই দুটি ফরাসি শব্দের অনুবাদ কঠিন। সমাজের বৈষয়িক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে সঙ্গে সমাজের চেতনার সম্পর্ক আছে, কিন্তু কে ধনি বা গরিব তার দ্বারা ব্যক্তির রাজনৈতিক চেতনার মর্ম বা মাত্রা বোঝা যায় না। ফলে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সমাজে কে কেমন রাজনৈতিক চেতনা ধারণ করে এবং ভূমিকা রাখে সেটা শুধু সম্পদের পরিমান দিয়ে বা ধনি/গরিব বাইনারি দিয়ে বোঝা মার্কস বা লেনিনের পদ্ধতি নয়। ব্যক্তিগত জীবনে একজন সম্পদশালী মানুষও কমিউনিস্ট চিন্তাচেতনা ধারন করতে পারেন। অন্যদিকে গরিব হতে পারে লোভী ও লুম্পেন; গরিবের রাজনৈতিক ভূমিকা হতে পারে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের ঘোরতর বিরোধী।

এই সত্য সত্ত্বেও সমাজে গরিবের প্রতি করুণা, সহানুভূতি, সহায়তা ইত্যাদি নৈতিক মানবিক চর্চা গুরুত্বপূর্ণ। ধনিদের ভোগী ও অপচয়মূলক জীবন যাপনের নৈতিক নিন্দা জরুরী। কিন্তু রাজনীতিকে যদি সমাজবিজ্ঞানের ওপর দাঁড়াতে হয় তাহলে নীতিনৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা জরুরী। নীতিবিদ্যা কেউ চর্চা করবে না তা নয়, অবশ্যই করবে। নিজের জন্য নৈতিক মানদণ্ড ঠিক করা কিম্বা অপরের প্রতি ব্যক্তি পর্যায়ে আচরণ নির্ণয় করা আর সমাজের বাস্তব বৈষয়িক সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক চেতনা চর্চা ও প্রয়োগ সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ এবং তার সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমাধান নীতিবিদ্যার বিষয় নয়, বরং বিজ্ঞানচর্চার অন্তর্গত। এই অর্থে বিজ্ঞান যে বিশেষ বিশেষ দেশে এবং কালে বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন সঠিক ভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেই বিভিন্ন শ্রেণির সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভূমিকা বোঝা মার্কস অনুসারী বিপ্লবী রাজনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

‘বুর্জোয়া’র বিপরীত বা শত্রু শ্রেণি হচ্ছে‘প্রলিতারিয়েত’, যার মানে ছিল গরিব, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, সর্বহারা জনগণ বা মেহনতি মানুষ। ষাট দশকের শেষের দিক থেকে প্রলিতারিয়েত-এর অনুবাদ হিসাবে শ্রমিক বা মেহনতির পরিবর্তে ‘সর্বহারা’ খুব গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ধারণা হিসাবে দুইয়ের পার্থক্য কিছু আছে কিনা সেটা অস্পষ্ট ছিল। আজ অবধি তা বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে অস্পষ্ট।

ধনি বনাম গরিব এই অর্থনৈতিক বিভাজন দুই পক্ষের অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনা, রাজনৈতিক চেতনার নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থার বর্ণনাও এইক্ষেত্রে অস্পষ্ট। একজন ধনি সামন্ত বা জোতদার হতে পারে, হতে পারে পণ্য ব্যবসায়ী, সুদ খোর মহাজন, কিম্বা পুঁজির মালিক। পুঁজির মালিক বাজার থেকে শ্রম ও উৎপাদনের হাতিয়ার কেনে এবং কারখানায় উৎপাদন করে মুনাফা কামায়। কিন্তু ব্যবসায়ী বা সুদ খোর সেটা করে না। ব্যবসায়ী মাল কিনে বাজারে অধিক দামে মাল বিক্রি করে; বেচাবিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়ী মুনাফা কামায়। সুদ খোর অন্যকে সুদে টাকা দেয়, যার পরিবর্তে গ্রহিতা সুদখোরকে আসলের চেয়ে বেশি টাকা দেয়। এই দুই শ্রেণি উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত নয়, কিন্তু প্রত্যক্ষ কোন অবদান না রেখেও সামাজিক উৎপাদনে ভাগ বসায়। একটি দেশের বিভিন্ন শ্রেণির বাস্তব ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভূমিকা বুঝতে হলে সুনির্দিষ্ট ভাবে উৎপাদনের সঙ্গে কোথায় কিভাবে তারা জড়িত এবং সেই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সমাজের বৈষয়িক উন্নতি কিম্বা অবনতিতে তাদের ভূমিকা বিচার জরুরী। অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও ভূমিকার সঙ্গে বাস্তব বা সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভূমিকা বিচার করে দেখতে চাইলে এই ফারাকগুলো গুরুতর।

সর্বহারা আর শ্রমিকও এক কথা নয়। প্রথমত আক্ষরিক অর্থে যে শ্রম করে সেই শ্রমিক, তার মধ্যে কারখানার শ্রমিক অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশে কমবেশী পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত একটা তর্ক ছিল যে বাংলাদেশের কলকারখানার শ্রমিককে শ্রমিক বলা যায় না, কারন তাদের অনেকেরই গ্রামে বাড়িঘর ও জমিজমা আছে। সেখানে অনেকে ছুটিছাটায় চাষাবাদও করে। তাদের বাড়তি আয়ের একটা উৎস এই ভুমি মালিকানা। ষাটের আন্দোলন ও গণ অভ্যূত্থানে ক্ষুদে উৎপাদক হিসাবে শ্রমিকদের বা কমিউনিস্টদের ভাষ্য অনুযায়ী জমির সঙ্গে যুক্ত পেটিবুর্জোয়া চরিত্র বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল নিশ্চয়ই। শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্টদের অপরিসীম অবদান থাকা সত্ত্বেও বংলাদেশের শ্রমিকেরা জাতিবাদী রাজনীতির দিকে ষাটের শেষের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল কিনা সেটা দরকারি গবেষণার বিষয়। মৌখিক তর্কবিতর্ক ছাড়া এ নিয়ে কোন নির্ভরযোগ্য গবেষণা চোখে পড়ে নি। পরিশ্রমের কাজ ফেলে রাখা দেখে বোঝা যায় বাংলাদেশে কমিউনিস্ট চিন্তা কখনই পুষ্ট কোন বিজ্ঞানচিন্তার ওপর দাঁড়ায় নি।

‘প্রলিতারিয়েত’-এর অর্থ হচ্ছে সর্বহারা – যার কিছুই নাই, এবং নিজের শ্রম শক্তি পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া তার বেঁচে থাকার আর কোন উপায় নাই। পুঁজিপতি বল প্রয়োগের মাধ্যমে কিম্বা রাষ্ট্র থানাপুলিশ দিয়ে ধরে বেঁধে শ্রমিককে প্রাচীন দাস ব্যবস্থার মতো কারখানায় আনে না, বা দাস শ্রমিকের মতো শ্রম শোষণ করে না। শ্রমিক অবশ্যই বোঝে তাকে শোষণ করা হচ্ছে, এটা শ্রমিক নিজের শরীর দিয়েই বোঝে। কিন্তু শোষণের উপলব্ধি নিছকই শারিরীক নয়, শ্রমিক যা উৎপাদন করে তা তার নিজের নয়, উৎপাদনের সময়টুকু তার জীবন থেকে আলাদা করে শ্রমিক পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করে। অতএব কলকারখানায় শ্রমিকের কাজের অবস্থা কেমন শুধু তার দ্বারা মার্কসের এক্সপ্লয়টেশান বা ‘শোষণ’ কথাটার ব্যাখ্যা চলে না। শ্রমিক তার সন্তুষ্টি অনুযায়ী মজুরি পেলেও মার্কসীয় বিচারে শোষণের অবসান ঘটে না। শ্রমের সঙ্গে উৎপন্নের বিযুক্তি থেকেই যায়। এর জন্য উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদিত বস্তু বা বিষয়ের সঙ্গে শ্রমের সম্পর্ক বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যাক্তি মালিকানা মার্কসের সমাজ বিশ্লেষণের গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এটা পেটি বুর্জোয়া শোষণতত্ত্ব নয়।

শ্রমিক নিজেই শ্রমের বাজারে গিয়ে নিজের শ্রম শক্তি আর দশজন পণ্য বিক্রেতার মতো বিক্রি করে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শ্রমিক তো দাস নয়, সে নিজেকে শোষিত হতে দেয় কেন? এখানেই দাস ব্যবস্থা এবং আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক বা বুর্জোয়া ব্যবস্থার পার্থক্য। শ্রমিকের কিছু নাই, হতে পারে সে আদতে সর্বহারা । হলেও সে বুর্জোয়া ব্যবস্থায় নিজেকে ‘বুর্জোয়া’ই গণ্য করে। শ্রমিক মনে করে তার কোন সম্পত্তি না থাকলেও সে নিজের শ্রম শক্তির মালিক অতএব স্বাধীন ও মুক্ত একজন নাগরিক । এই মালিকানা বোধ ও ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে মুক্ত উপলব্ধি মূলত বুর্জোয়া চেতনা। শ্রমিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেখে যে তার কারখানা মালিকের যেমন একটি ভোট আছে, তারও একটি ভোট আছে। সেও চাইলে একদিন ভূসম্পত্তি বা কারখানা বা ছোট ব্যবসার মালিক হতে পারে। অতএব তারা উভয়েই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান। এই রাজনৈতিক সাম্যবাদ – বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি – শ্রমিক বুর্জোয়া ব্যবস্থায় বুর্জোয়া চেতনাতেই আচ্ছন্ন থাকে। শ্রমিক বলেই তার মধ্যে আপসে আপ বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়া চেতনাড় পরিবর্তে সর্বহারার চেতনা থাকবে এই অনুমানের কোন ভিত্তি নাই।

শ্রমিকের বুর্জোয়া চেতনা দ্বারা আচ্ছন্ন থাকা অবাস্তব যেমন নয়, তেমনি অন্যায়ও নয়, বরং এটাই স্বাভাবিক। যে কারণে লেনিন খুবই স্পষ্ট করে বলেছিলেন শ্রমিককে দিয়ে বড় জোর ট্রে্ড ইউনিয়ন আন্দোলন হতে পারে। যা আসলে বুর্জোয়া আন্দোলন; ট্রেড ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে মজুরি ও কাজের নিরাপদ পরিবেশের আন্দোলন মূলত বুর্জোয়া রাষ্ট্রে বুর্জোয় অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। নিজের শ্রমশক্তিকে পণ্য জ্ঞান করা এবং নিজেকে তার মালিক গণ্য করে মালিকের কাছে অধিক দামে বেচাবিক্রির জন্য দরকষাকষি করাই ট্রেড ইউনিয়নের কাজ। কারখানার মালিকও তার পণ্য নিয়ে বাজারে দর কষাকষি করে। শ্রম শক্তি নিয়ে দর কষাকষি পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির অন্তর্গত বৈশিষ্ট। ট্রেড ইউনিয়ন মানেই কমিউনিজম বা সর্বহারার চেতনা চর্চার জায়গা ভাবা ঠিক নয়। কিন্ত শ্রমিকদের যে কোন সাংগঠনিক তৎপরতার ক্ষেত্র কমিউনিস্ট চিন্তচেতনার বিস্তার ঘটানোর ক্ষেত্রও বটে।

লেনিনের যুক্তি ছিল বিপ্লব একান্তই পেশাদার বিপ্লবীদের কাজ, যারা সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থান এবং রাজনীতিতে তারা কি ধরণের ভূমিকা রাখবে সে সম্পর্কে আগেই ওয়াকিবহাল থাকে। ইতিহাসকে তার অনাগত সম্ভাবনা বাস্তবায়নের অভিমুখে নিয়ে যেতে হল বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যৎ আবিষ্কার করতে বিপ্লবীরাই পারদর্শী। বিপ্লব কোন রোমান্টিক কল্পনাবিলাস নয়, পেটি-বুর্জোয়াদের মধ্যে যদিও এই অসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, তবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড আগাগোড়াই সমাজ ও রাজনৈতিক বিজ্ঞান চর্চার বিষয়।

তাহলে বাধ্য না হয়েও শ্রমিক মজুরি-দাস হয়ে কারখানা মালিকের কাছে নিজেদের বিক্রি করে কেন? কমিউনিস্ট উত্তর হচ্ছে থানাপুলিশ দিয়ে শ্রমিককে বাধ্য করা হয় না বটে, কিন্তু আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা বুর্জোয়া সমাজ একটা কাঠামোগত হিংসা বা সহিংসতার সম্পর্কের ওপর গড়ে ওঠে। উৎপাদন করবার উপায় থেকে বিপুল সংখ্যক আগেই জবরদস্তি বিচ্ছিন্ন করা হয়। অর্থাৎ আগে গ্রাম ও কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা এবং জমি থেকে মানুষকে উৎখাত করা পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে তোলার শর্ত। যেন বেঁচে থাকবার আর কোন উপায় না পেয়ে দলে দলে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে অফিস-আদালতে বা কারখানায় চাকুরি খোঁজে। নিজের শ্রম কারো না কারো কাছে বেচে দিয়ে তার পরিবর্তে মজুরি পেয়েই সর্বহারা মানুষ বাঁচতে পারে। সেই মজুরি সে ব্যয় করে বাজার থেকে ভোগ্য পণ্য কেনার কাজে। নিজক বিক্রি করা এবং বিক্রির পয়সা দিয়ে বাজার থেকে ভোগ্য পণ্য কেনে উভয় দিকেই শ্রমিক পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে। এই কাঠামোগত সহিংসতা, যাকে আমরা সহজে ধরতে পারি না – এই অদৃশ্য সন্ত্রাস পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই সন্ত্রাস জারি না রেখে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না।

কারখানা একজনের হাতে আর যারা শ্রম দেবে বা উৎপাদন করবে তারা উৎপাদনের উপায় থেকে আলাদা । অন্যদিকে শ্রমিককে যদি স্রেফ রক্তমাংসে বেঁচে থাকতে তাহলে অবশ্যই কারখানার মালিকের কাছে তার শ্রম বেচতে হবে এবং সেই মজুরি দিয়ে বাজার থেকে ভোগ্য পণ্য কিনে তাকে বাঁচতে হবে। প্রলিতারিয়েত বা সর্বহারা মানুষের এই বিশেষ অবস্থা – এই বিশেষ কাঠামোগত দাসত্ব – সম্পূর্ণ নতুন ধরণের বল প্রয়োগের নির্দেশক, যাকে বল প্রয়োগ বা সন্ত্রাস বলে মনে হয় না। এই ক্ষমতা রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ থানা, পুলিশ, মিলিটারি, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি দিয়ে কাঠামগত সহংসতা বা সন্ত্রাসকে বোঝ যায় না। এমনকি আধুনিক কালের মিশেল ফুকোর ‘ক্ষমতা’র ধারণা দিয়েও এই কাঠামোগত দাসত্ব ও ক্ষমতার চরিত্র বোঝা যাবে না। এই দিক থেকে ‘প্রলিতারিয়েত’ অর্থনৈতিক বর্গ হিসাবেও ‘বুর্জোয়া’র মতোই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা।

বুর্জোয়া সমাজের সাধারণ অর্থনৈতিক সংজ্ঞা হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের সার্বত্রিক চরিত্র। অর্থাৎ সবকিছুই এখানে পণ্য হিসাবে বাজারে বিক্রির জন্য ওঠে কিম্বা উৎপাদিত হয়। মানুষের শ্রমেরও একই নিয়তি ঘটে। শুধু কারখানার শ্রমিক নয়, সুট-টাই পরে কেউ যখন কম্পানির চাকুরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যায়, তখন নিজেকে বিক্রির জন্যই স্যুট-টাইওয়ালা বাজারে হাজির হয়। কম্পানি বাজার থেকে নতুন চাকুরেদের কেনার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়, আর শিক্ষিত তরুণরা লাইন ধরে ইন্টারভিউ দেয়। কারন চাকুরি ছাড়া সে সমাজে অচল। চাকুরি না করলে তার বেঁচে থাকা দায়, ঘর-সংসার বিয়ে শাদি সবই চাকুরি ও ক্যারিয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। বুর্জোয়া আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কাঠামোটা এমনই সহিংস ও সন্ত্রাসী যে মানুষকে তার বেঁচে থাকার উপায় থেকে থে্কে বিচ্ছিন্ন রাখার মধ্য দিয়েই খোদ ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখে। যে কারনে একজন তরুণ নিজেকে বেচে দিয়েই এই সমাজে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও সে মার্কস বা কমিউনিস্ট বিরোধী হয়, কারন এই কাজের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সে আসলে তার বুর্জোয়া চেতনাই চরিতার্থ হতে দেখে। ভাবে, সেতো আসলে দাস বা গোলাম নয়; বরং স্বেচ্ছায় ও স্বাধীন ভাবেই চাকুরি খুঁজে নিয়েছে। তারুণ্যও যে শ্রমের বাজারে একটি পণ্য মাত্র, এই বোধটুকু তার থাকে না। পণ্যের এই সার্বত্রিক বিস্তার ও সমৃদ্ধির মধ্যে ব্যক্তির এই স্বাধীনতা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরিসর বিদ্যমান রাখা এবং তার উপলব্ধি সঞ্চারিত করা – বুর্জোয়া সমাজের এই বিশেষ দিক দিয়ে এই ব্যবস্থার শক্তি বোঝা যায়। মানুষ পুঁজির গোলাম, অথচ ভাবে সে স্বাধীন ও সার্বভৌম – বুর্জোয়া রাজনৈতিক চেতনার এটাই মৌলিক বৈশিষ্ট্য। যে কাঠামগত সহিংসতার জন্য মানুষ নিজেকে পুঁজির গোলামে পর্যবসিত করে বুর্জোয়া ব্যবস্থা তাকে অদৃশ্য করে রাখতে সক্ষম। অতীতের সমাজগুলোর তুলনায় বুর্জোয়া সমাজের এখানে বিশাল পার্থক্য যেমন, তেমনি এটা তার শক্তিরও দিক।

ধনি মানেই পুঁজিপতি হবে এমন কোন কথা নাই। ফলে সামন্ত, আধা সামন্ত এবং পুঁজিপতির মধ্যে চেতনারও তারতম্য থাকবে, রাজনীতিতে তাদের ভূমিকাও এক রকম হবে না। তেমনি শ্রমিক হলেই অর্থনৈতিক ভাবে প্রলিতারিয়েত হবে এমন কোন কথা নাই। এই ফারাকগুলো গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে ধারনাগুলো সঠিক ভাবে ব্যবহার কার্যকর রণনীতি ও রণকৌশল নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট সাহিত্যে এই পার্থক্যের প্রতিফলন হয় নি বললেই চলে।

তাহলে অর্থনৈতিক মর্ম ছাড়াও পরিভাষা হিসাবে ‘বুর্জোয়া’ও ‘প্রলিতারিয়েত’ যে মূলত রাজনৈতিক বর্গ এই দিকটি অনুধাবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে তারা সম্ভাব্য কী ভূমিকা রাখবে বা রাখে তার নির্দেশক। বাংলাদেশে ধারণাগুলো ব্যবহৃত হয়েছে মূলত অর্থনৈতিক ক্যাটাগরি্ হিসাবে, রাজনৈতিক বর্গ বা পরিভাষা হিসাবে নয়। অর্থনৈতিক মর্মের অতিরিক্ত কোন রাজনৈতিক মর্ম যদি শব্দগুলোর থেকে থাকে তবে বাংলাদেশে তার তাৎপর্য কখনই পরিচ্ছন্ন ছিল না। এই অপরিচ্ছন্নতার প্রভাব বাংলাদেশের সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট আন্দোলনে পড়তে বাধ্য। কারন সামগ্রিক ভাবে সমাজে চিন্তা চর্চার যে বাস্তবতা বিপ্লবী রাজনীতি তার মোকাবিলা ছাড়া এই পর্যায় অতিক্রম করে যেতে পারে না। সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি এবং বিশেষ ভাবে বাম রাজনীতির দুর্দশার সঙ্গে অতিশয় প্রাথমিক এই সকল ধারণার অস্পষ্টতা বড় একটি কারন।

নীতিনৈতিকতা বনাম বিপ্লবী রাজনীতি

নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি দিয়ে লেখাটি শুরু করছি যাতে অনেকে নিজের সঙ্গে মেলাতে পারেন। আসলেই এটা সত্য ‘বুর্জোয়া’ ধারণাটিকে বাংলাদেশে টাকাওয়ালা ব সম্পত্তিবান হিসাবেই বোঝা হয় এবং এখনও অধিকাংশ মানুষ সেটাই বোঝেন। হয়তো ব্যতিক্রম আগেও অনেকে ছিলেন এবং এখনও আছেন। কিন্তু তাদের চিন্তা ও কাজের কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখা যায় না। বাংলাদেশের চিন্তা বা রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী চিন্তার কোন প্রভাব চোখে পড়ে না। ফলে এটা ধরে নিতে পারি সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম মানে ধনিদের বিরুদ্ধে গরিবদের লড়াই – এটাই বাংলাদেশের প্রচলিত অনুমান, এই ধারনারই প্রত্যক্ষ প্রভাব আমরা বামপন্থী আন্দোলনে যেমন, একই ভাবে বাম বিরোধী প্রতিক্রিয়া -- উভয়পক্ষেই দেখে আসছি এবং এখনও দেখছি। সমাজে যে শ্রেণি এখনও সর্বহারা নয়, কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে সবময়ই সমাজের নীচের তলানিতে পড়ে যাবার আতংকে থাকে, তাদের সাধারণত মধ্যবিত্ত বা পেটি বুর্জোয়া বলা হয়। পেটি বুর্জোয়া ধনি হতে চায়, কিন্তু হতে না পেরে ধন বা ধনিকে নীতিনৈতিকতার অজুহাতে ঘৃণা করে। ধনসম্পদের প্রতি নৈতিক উন্নাসিকতা এবং ধনিদের নৈতিক কারনে অপছন্দ বা ঘৃণা পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক চেতনার বৈশিষ্ট। যে কারনে ‘দুর্নীতি’র বিরোধিতা পেটি বুর্জোয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে আমরা যা সাধারণত দেখি। দুর্নীতিকে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিচার না করে তাকে নীতিনৈতিকতা দিয়া বিচার করা পেটি বুর্জোয়া চেতনার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

বুর্জোয়া শ্রেণির ঐতিহাসিক আবির্ভাব এবং ইতিহাসে তার বৈপ্লবিক ভূমিকার রাজনৈতিক তাৎপর্য এখনও পুরাপুরি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। যার কারনে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই মূহূর্তে বিপ্লবী রাজনীতির কর্তব্য কী, সে ব্যাপারে কোন অর্থপূর্ণ তর্ক আমরা দেখি না। এই তর্ক হাওয়াই কায়দায় করবারও কোন অর্থ নাই। কারন রাজনৈতিক মর্ম দূরে থাকুক এমনকি অর্থনৈতিক ভাবে ‘বুর্জোয়া’ কথাটার মর্ম বাংলাদেশে স্পষ্ট কিনা সে ব্যাপারেও সন্দেহ রয়েছে। অর্থনৈতিক শ্রেণি হিসবে ‘বুর্জোয়া’একটি নিন্দাবাচক শব্দ হিসাবেই সকলে জানে, বোঝে এবংকাউকে গালি দেবার জন্য ব্যবহার করে।

যদি আভিধানিক অর্থ অনুসন্ধান করি তাহলে ‘বুর্জোয়া’ অর্থ মধ্যবিত্ত ব্যক্তি, ধনি নয়। ইংরেজি থেকে বাংলা সংসদ ডিকশানারিতে এই অর্থই দেওয়া আছে। আরেকটি অর্থ হচ্ছে ‘ব্যবসাদার’। তবে আমাদের আলোচনার জন্য ইন্টারেস্টিং আরেকটি দিক হচ্ছে অভিধানে আরেকটি অর্থের অন্তর্ভূক্তি। সেটা হোল, “(আধুনিক অর্থে) বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কায়েমি স্বার্থসম্পন্ন ব্যক্তি”। আমি ৪র্থ সংস্করণের (১৯৮০) চল্লিশতম মূদ্রন (১৯৯৫) থেকে টুকেছি। কিন্তু ‘বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা’টা কী, এবং সেখানে কায়েমী গোষ্ঠি কোন শ্রেণির এবং তাদের স্বার্থটাই বা কী -- ইত্যাদি কিছুই এই আভিধানিক অর্থে নাই। সমাজ ব্যবস্থা কি সামন্তীয়? নাকি বুর্জোয়া এবং যারা ‘কায়েমী’ অর্থাৎ ক্ষমতায়, তার কোন্‌ শ্রেণি? – বলাবাহুল্য, অভিধান সমাজ বিজ্ঞান নয়, ফলে ওর মধ্যে এসবের ব্যাখ্যা আশা করা অযৌক্তিক। কিন্তু এর দ্বারা সাধারণ ভাবে বাংলাভাষীরা ‘বুর্জোয়া’ বলতে কী বোঝে তার ভাল একটা ইঙ্গিত আমরা পাই। সমস্যাটা শুধু বাংলাদেশের নয়, পশ্চিম বাংলারও বটে।

শব্দটি বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে আরেকটি ঘাটতি ছিল। বুর্জোয়া শব্দটির মধ্যে স্বাধীন ‘ব্যক্তি’র ধারণা নিহিত রয়েছে সেটা সবসময়ই উপেক্ষিত হয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণির আবির্ভাব মানে সামন্ত বা বিভিন্ন প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক শৃংখল ভেঙে একটি অর্থনৈতিক শ্রেণির আবির্ভাব, যারা ধনি, কিন্তু সামন্ত নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে চেতনা বা রাজনীতির সম্পর্ক আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিল না। এই ধারণাই প্রবল ছিল যে ধনি হওয়াটাই একটা খারাপ জিনিস এবং এটা অপরাধ। এটা আরও বদ্ধমূল হয়েছিল কারন অন্যদিকে কমিউনিস্টদের মুখে শুনতান কমিউনিস্ট হতে হলে 'ডি-ক্লাস' বা শ্রেণিচ্যূত হতে হবে, অর্থাৎ কোন ভাবেই ধনি থাকা বা ধনি হওয়া যাবে না। এরই সমান্তরাল ধারণা হচ্ছে 'ত্যাগী' হতে হবে। ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু সন্ত্রাসবাদী ধারা থেকে কমিউনিস্টদের বড় একটি অংশ আসার কারণে অনেক গুলা পুরানা আবর্জনা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকেও বহন করেছে। যার মধ্যে রয়েছে নিজেকে সর্বত্যাগী সন্যাসী ভাবা। ব্যক্তির ত্যাগ তা যতোই আহাম্মকি কিম্বা অপচয়মূল হোকনা কেন তাকে মহিমান্বিত করবার একটা রেওয়াজ দেখেই আমরা বড় হয়েছি। এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন ছিল। তার জের এখনও শেষ হয় নি।

সামন্ত, আধা-সামন্ত বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের ভাঙনকে অর্থনৈতিক ভাবে বোঝা এক কথা আর তাকে চেতনাগত বা রাজনৈতিক ভাবে বোঝা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ব্যাপার। বলাবাহুল্য সেটা বিপ্লবী চিন্তা ও চর্চার অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দিক যা সত্তর আশির দশকে বিক্ষিপ্ত ভাবে আলোচিত হয়েছে, কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিভাষা গুরুতর সমস্যা হিসাবে রয়ে গিয়েছে।

সামন্ত, আধাসামন্ত কিম্বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের ভাঙন চেতনাগত বা রাজনৈতিকভাবে সমাজে একই সঙ্গে ‘ব্যক্তি’র আবির্ভাবেরও শর্ত।এই গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যটুকু বুঝে উঠতে পারা কঠিন। অর্থাৎ ইতিহাসে এমন এক কর্তাশক্তির আবির্ভাব ঘটা যে নিজেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণ্য করে। কিন্তু কেউ ধনি হলেই সামন্ত চেতনা থেকে মুক্ত হবে, কিম্বা পুঁজির মালিক হলেই আর সামন্ত থাকবে না, ব্যপারটা এতো সরল নয়। মনে পুষিয়ে রাখা শত্রু শত্রু ভাবের জন্য ‘বুর্জোয়া’কে ঘৃণা করতে হবে, এটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যারাম, যা আসলে পুরানা সামন্ত মানসিকতার বোঝা বয়ে বেড়ানো।। এই মানসিক বাধা বাংলাদেশ – বিশেষত বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এখনও অতিক্রম ককরতে পারে নি।

‘বুর্জোয়া’ ও ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’কে ঐতিহাসিক ভাবে বোঝার পদ্ধতি বাংলাদেশের বামপন্থা এখনও রপ্ত করি নি। ক্রিটিকাল দিকগুলো বোঝাবার ও শেখাবার মতো তরুণ বয়সে আমরা কাউকে পাই নি। কমরেডদের কাছ থেকে এতোটুকুই বুঝতাম যে ‘ধনি’ বা ‘বড়লোক’ শ্রেণিকে বোঝাতেই ‘বুর্জোয়া’ কথাটার ব্যবহার। আমরা সেভাবেই অর্থ করতাম। এ থেকেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত টানতাম, কমিউনিস্টদের লড়াই ধনিদের বিরুদ্ধে। তারা খারাপ, আমরা ভালো। নৈতিক দিক থেকে এটা খুব আরামের আর নিজেকে এর জন্য খুব উচ্চস্তরের আদর্শবান মনে হোত। সেই নৈতিক আদর্শের জন্য আমরা জান দিতে তৈরি ছিলাম। অনেকে দিয়েছেনও বটে। শোষিত নিপীড়িত মজলুম জনগণের প্রতি তাঁদের নৈতিক পক্ষপাত অমূল্য। তাঁদের অবদানকে খাটো করবার কোন সুযোগ নাই। বুর্জোয়া কথাটি বোঝা, বুর্জোয়া শ্রেণি কথাটার তাৎপর্য অনুধাবন এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে বাস্তবোচিত ঐতিহাসিক অবস্থান নির্ণয় না করে একে ধনির বিরুদ্ধে গরিব-মেহনতি জনগণের লড়াই হিসাবে বোঝা ও চর্চার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। এই ফারাক বোঝার অক্ষমতা বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন ব্যর্থ হবার একটি প্রধান কারন। সেটা বুঝতে হলে নিজেকে অতি নীতিবান আদর্শবাদী জ্ঞান করে নৈতিক যুক্তিতে ‘অপর’কে ঘৃণার চর্চাকে শ্রেণী সংগ্রাম ভাবা ঠিক নয়।

কমিউনিজমে নীতি আছে, কিন্তু সেটা ইতিহাস ও বাস্তবতার বাইরে বিমূর্ত ও মনগড়া চর্চা নয়।আমরা কথায় কথায় ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’আউড়াই বটে, কিন্তু সেটা পেটি বুর্জোয়া নৈতিক আদর্শবাদের অধিক কিছু পয়দা করে নি। এই চরম সত্য বুঝতে অনেক রক্তক্ষয় হয়েছে। এই চর্চার ধারাবাহিকতা এখনও বাংলাদেশে তীব্র মাত্রায় রয়েছে। অনৈতিহাসিক নৈতিক আদর্শবাদ থেকে অপরকে ঘৃণার রাজনীতি পুষ্টি পায়। সেই নীতি নৈতিকতার উৎপত্তি ধর্ম থেকে হোক, কিম্বা হোক ধর্মের বাইরে সেকুলার চিন্তাভাবনার পরিমণ্ডলে। এর ফলে বাস্তবে সমাজের বিভিন্নক্ষেত্রে যে সকল দ্বন্দ্ব বা সংঘাত তৈরি হয় তা মীমাংসার জন্য যথোপযুক্ত রাজনীতি গড়ে ওঠে নি।

নৈতিক ঘৃণাকে সব সময় অযৌক্তিক বা মিথ্যা ভাববারও কোন কারন নাই। বাংলাদেশে এখনকার ধনিকশ্রেণির লুটতরাজ, ডাকাতি ও লুম্পেন চরিত্র দেখে ধনি শ্রেণিকে ঘৃণা ছাড়া ভালবাসা কঠিন বটে। মাত্রায়, চরিত্রে ও বৈশিষ্ট্যে ষাট থেকে নব্বই অবধি ধনিক শ্রেণি এবং তার পরের ধনিদের দের পার্থক্য আছে, কিন্তু ঘৃণা কবার মতো যথেষ্ট গুণ তাদেরও বর্তমান ছিল, বর্তমানের ধনিদেরও আছে। কর্তব্য হচ্ছে নৈতিক ঘৃণাকে ঘৃণার রাজনীতিতে পর্যবসিত না করে বাস্তব ইতিহাসের বাস্তব দ্বন্দ্ব-সংঘাত মীমাংসার অভিমুখেপ্রবাহিত করতে পারা। নৈতিক উপলব্ধিকে রাজনৈতিক কর্তাসত্তায় রূপান্তর ঘটানো। এই কাজে বাংলাদেশ আগেও ব্যর্থ হয়েছে, এখনও সফল হবার সম্ভাবনা দেখছি না। নৈতিক শক্তিকে ঐতিহাসিক রূপান্তরের কর্তাশক্তিতে পরিণত করা কঠিন তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশ্ন। এই জন্যই বিপ্লবের পরিভাষাগুলোর পর্যালোচনা জরুরী হয়ে পড়েছে।

সব সময় না হলেও বড়লোক বা ধনিশ্রেণির প্রতি অনেক সময় ন্যায়সঙ্গত বিদ্বেষ থাকে বলেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৃহৎ একট অংশ প্রগতিশীলতার নামে ধনীদের বিরুদ্ধে একটা বিমূর্ত নৈতিক অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করে। কমিউনিস্ট আন্দোলন লুটতরাজ ও লুন্ঠনের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থানকে অস্বীকার করে না। নিপীড়িত শ্রমিক, কৃষক ও গরিবের দিক থেকে দেখলে একে অস্বীকার করবার কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু কাজ হচ্ছে বাস্তব অবস্থা বোঝা এবং বস্তবোচিত বিশ্লেষণ। শ্রমিক কৃষক সর্বহারাকে যেমন, তেমনি নৈতিক তাগিদে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে রাজনীতিতে আসা তরুণ বিপ্লবীদেরও সামগ্রিক ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া ও সচেতন করাই কমিউনিস্টদের কাজ।

তবে সেই সময় টের পেতাম ‘বুর্জোয়া’ মানে স্রেফ ধনি না, আর ‘প্রলিতারিয়েত’মানেও নিছক শ্রমিক না। ছাত্রাবস্থায় এ নিয়ে আমরা তর্ক করেছি, কিন্তু ফয়সালা করতে পেরেছি তা হলফ করে বলতে পারব না। মার্কস, লেনিন বা মাওজে দং কিভাবে মানুষের জীবনের বৈষয়িক অবস্থা এবং চেতনাগত অবস্থার ফারাক কিম্বা মিল বিচার করতেন এবং তার ভিত্তিতে বিপ্লবী রণনীতি ও রণকৌশলের ব্যবহার করেছেন সে ব্যাপারে সত্তর দশক অবধি বাংলাদেশে কোন স্পষ্ট ধারণা বামপন্থিদের ছিলনা। তাদের লেখালিখি বইপত্রই তার প্রমাণ।

তবে মার্কস বা লেনিনের বই সহজ লভ্য ছিল না। প্রগতি প্রকাশনীর কিছু অনুবাদ পাওয়া যেত, চিনাদেরও নিজস্ব অনুবাদের কিছু কিছু বই ছিল। কিন্তু এই ধরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মীমাংসার জন্য যে ধরণের মৌলিক বইপত্র হাতের কাছে থাকার দরকার, আমাদের তা ছিল না। ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পুরা ষাট থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত ‘প্রগতিশীল’ বা ‘কমিউনিস্ট’ আন্দোলন বলতে প্রধানত বুঝত গরীবের হয়ে ধনি বা বড়লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই। বঞ্চিত মানুষদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা। বিপ্লবের অর্থ ছিল শ্রমিক গরিব সর্বহারার পক্ষে ক্ষমতা ‘দখল’ করে সবাইকে ‘সম্পদ সমান ভাবে বিতরণ’, ‘সাম্যবাদ’ কায়েম, ইত্যাদি। উৎপাদনব্যবস্থা, উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাখ্যার মূল ভারকেন্দ্র ছিল কিভাবে ধনিক শ্রেণি রাষ্ট্রকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। কিভাবে শ্রমিক কৃষকদের ন্যায্য পাওনা বা তাদের দ্বারা উৎপাদিত ‘উদ্বৃত্তমুল্য’শোষণ ও ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্র ভূমিকা রাখে। কিভাবে রাষ্ট্র জনগণকে সর্বহারায় পরিণত করে, আর সমাজের সম্পদ ধনিদের হাতে পুঞ্জিভূত করে। ফলে শ্লোগান উঠত ‘এই রাষ্ট্র ভাঙতে হবে, এই রাষ্ট্র বুর্জোয়া রাষ্ট্র’। বিপ্লব মানে‘শোষণহীন সমাজ’কায়েম করা। ‘শোষণ’ না হয় কিছুটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা দ্বারা বোঝা যেত।কিন্তু ‘শোষণহীন সমাজ’ মানেকি? গরু না মহিষ ? তার কোন কুলকিনারা বোঝা যেতনা।

কমিউনিস্টরা শ্রমিক হয়ে কারখানায় কাজ নিতো, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতো, শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলত, ইত্যাদি। সেই ক্ষেত্রে তাদের আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা ছিল অপরিসীম। শ্রমিক আন্দোলন শুধু নয়, উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানেবামপন্থিদের গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক অবদান আছে। কিন্তু প্রগতিশীল আন্দোলন বলতে যেহেতু বোঝাত অর্থনৈতিক ভাবে যারা ধনি তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অতএব কমিউনিস্টদের সম্পর্কে শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের ধারণা হয়ে উঠল গরিবদের অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায় করবার পার্টি: যেমন, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান। সেই সুবিধা আদায়ের জন্য জনগণ কমিউনিস্টদের চাইতো বটে, কিন্তু রাজনীতির জন্য ভিড়ত সত্যিকারের রাজনৈতিক দলের পেছনে।

বাংলাদেশে স্বায়ত্ব শাসনের দাবির মধ্যে অর্থনৈতিক মর্ম আছে, কিন্তু স্বায়ত্ব শাসন একান্তই রাজনৈতিক দাবি। এই দাবি সামনে এনে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্বশাসন থেকে মুক্তিযদ্ধের কালপর্ব অবধি কিভাবে বৃহৎ জাতীয় দলে পরিণত হোল সেটা বুঝতে হলে অর্থনৈতিক স্বার্থ বনাম রাজনৈতিক চেতনার ফারাক বুঝতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই শেখা যায়। কমিউনিজমকে অনুবাদ করা হোত ‘সাম্যবাদ’। কিন্তু কোন অর্থে ও কিভাবে সেই ‘সাম্য’ কায়েম হবে সে সম্পর্কে কোন স্পষ্টধারণা ছিল না। অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদের বিলোপ ঘটিয়ে সবাইকে সমাজে অর্থনৈতিকভাবে একই কাতারে নিয়ে আসার অধিক কোন চিন্তা কমিউনিস্টদের ছিল তার প্রমাণ দেওয়া কঠিন। কমিউনিজম সমাজের বৈষয়িক অসাম্য নিরসন করে অর্থনৈতিক ভাবে সবাইকে সমান মাত্রায় সম্পদশালী করবার অলীক প্রতিশ্রুতি হিসাবেই জারি ছিল।

শ্রেণি চেতনা?

প্রায়ই মুশকিল বাঁধত ‘শ্রেণিচেতনা’ নিয়ে। বামপন্থি ও কমিউনিস্টদের সবসময়ই ‘চেতনা’ নিয়ে খুব বিব্রত হতে দেখেছি। শ্রেণিচেতনা অর্থনৈতিক স্বার্থবোধের অধিক কিছু অর্থ বহন করতো না। অর্থনৈতিক ভাবে কেউ একজন শ্রমিক হতেই পারেন। তাহলে শ্রমিকের চেতনা মানে কি? বাস্তবের শ্রমিকের মন মানসিকতা? শ্রমিকের দৈনন্দিনের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতাজাত চেতনাই কি সর্বহারার চেতনা?

কিন্তু কমিউনিস্ট রাজনীতির দিক থেকে সর্বহারার চেতনা বিপ্লবী রাজনীতির দিক থেকে ঐতিহাসিক চেতনা, তাহলে অনুমান হচ্ছে এই যে শ্রমিক বা সর্বহারাকে একই সঙ্গে ‘ইতিহাস সচেতন’ হতে হবে। তার মানে কি? নিজের বর্তমান অবস্থার উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শ্রমিক বা সর্বহারা শ্রেণীকে মানবেতিহাসের অতীত ব্যাখ্যা এবং ভবিষ্যত অভিমুখ নির্ণয়ে সক্ষম হতে পারা। এই সক্ষমতা অর্জন একটা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ, মূলত একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী চর্চা্র বিষয়। প্রলিতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণির ভূমিকা ‘ঐতিহাসিক’ বলার মানে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের সর্ভারা শ্রেণির পক্ষে এই সক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনা স্বীকার করা।

গ্রামে জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব মানুষ যখন শহরের বস্তিতে এসে মাথাগোঁজার জন্য একটা ঘর বাঁধে সর্বহারার চেতনা কি তাদের সব হারাবার বেদনা? ধনিদের বিরুদ্ধে ক্রোধ? বাংলাদেশে আসলে এটাই ছিল প্রধান চিন্তা। শ্রমিক বা সর্বহারার চেতনা বলতে কী বোঝায় সে সম্পর্কে কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখালখি বাংলাদেশে দেখ যায় না। কমিউনিস্টদের কাজ হোত শ্রমিক বা সর্বহারার মধ্যে ধনিদের বিরুদ্ধে ক্রোধ আরও উসকে দেওয়া এবং কোন এক ‘বিপ্লবের’ মধ্য দিয়ে ধনিদের জমিজমা ধনসম্পত্তি দখল করে বঞ্চিতদের মধ্যে সমান ভাবে বিতরণ। সর্বহারা বা শ্রমিক শোষিত, নির্যাতীত ও বঞ্চিত; সেই বঞ্চনার চেতনাই শ্রমিকের চেতনা। শ্রমিকের চেতনার অর্থ বড়লোক বা ধনিকে ঘৃণা করা, তাদের সম্পত্তি একদিন জব্দ করে সবাইকে বিলিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখা। জবরদস্তি সম্পত্তির মালিকানা বদল হল বিপ্লবের আসল কথা– এই ধারণাই প্রবল ছিল। সম্পত্তির মালিকদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সেই সম্পদ বঞ্চিত দের বিতরণ করা --এই ধরনের রবিনহুড মার্কা চিন্তার আধিপত্য ছিল। এখনও তার জের আছে। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির চেতনা বলতে ধনির সম্পত্তি অধিকার করে নেওয়ার অধিক কিছু বাংলাদেশে বোঝায় কিনা তা রীতিমতো সমাজতাত্ত্বিক গবেষনার বিষয়।

কমিউনিস্ট্ হতে হলে সেই সময় জীবন যাপনে শ্রেণিচ্যুতির (de-class) কথা কমিউনিস্টরা বলতেন, নিজেরাও রীতিমতো ধর্ম বিশ্বাসের মতো ত্যাগী বা সন্ন্যাসীর জীবনকে কমিউনিস্ট আদর্শ হিসবে মানতেন। এর প্রকোপ সেই সময় বাংলাদেশে বেশি হবার একটা বড় কারণ মনে করা হয় বাংলাদেশে যাদের হাত দিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাদের প্রায় অনেকেই এমন এক ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে এসেছেন যেখানে ত্যাগ বা সন্ন্যাসব্রতকে উচ্চস্তরের নৈতিক আদর্শ হিসাবে গণ্য করা হয়।ধর্মীয় ঐতিহ্য কমিউনিস্ট আন্দোলনেও মারাত্মক ছাপ ফেলেছিল। সন্নাসীর মতো ভোগের বদলে ত্যাগের জীবন আদর্শ মনে করা হত। অনেকে বৃটিশ বিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, ফলে পরমার্থিক উদ্দেশ্যে নিজেকে আত্মাহুতি দেওয়া কিম্বা আত্মত্যাগের আদর্শ জীবনের ব্রত হিসাবে তারা মানতেন। তাঁদের মিতাচারি সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনের আত্মপরায়ন শক্তি অস্বীকার করবার জো নাই। সেই আড়ম্বরহীনজীবন তরুণদের অনুপ্রাণিত করতো। মনে করা হোত, এটাই কমিউনিস্ট হবার ছহি পথ।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ব্যাক্তগত মালিকানা এবং কমিউনিস্ট ইশতেহার

কমিউনিজম ধনির বিরুদ্ধে সর্বহারার লড়াই। সর্বহারা শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়ত, কারণ ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ আছে বলেই একশ্রেণির মানুষ সম্পত্তির মালিক, আর বাকিরা সম্পত্তিহারা। এই ক্ষেত্রে কালপ্রিট হচ্ছে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’। এই ছিল সরল ব্যাখ্যা। তাই বাংলাদেশে ‘কমিউনিজম’-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’র উৎখাত। অথচ কমিউনিস্ট ইশতেহার পরিষ্কার বলছে, “প্রচলিত মালিকানা সম্পর্কের উচ্ছেদটা মোটেও কমিউনিজমের একান্ত বৈশিষ্ট্য নয়...সাধারন ভাবে মালিকানা উচ্ছেদ নয়, বুর্জোয়া মালিকানার উচ্ছেদই কমিউনিজমের বৈশিষ্ট্যসূচক দিক”। বাংলাদেশে চালু ‘কমিউনিস্ট’ নামের আদর্শ সাধারণ ভাবে ব্যাক্তি মালিকানার উচ্ছেদকেই কমিউনিজম গণ্য করেছে এবং সেভাবেই প্রচার করেছে। এর অধিক ভাবতে তারা অতীতে অক্ষম ছিল, এখনও অক্ষম। এই ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের চিন্তায় আজ অবধি খুব একটা হেরফের হয় নি। যে কারনে ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েম করতে চাই বলে যারা নিজেদের‘কমিউনিস্ট’দাবি করতেন কিম্বা এখনও করেন ধন, ধনোৎপাদন বা ধনির প্রতি তাদের বিদ্বেষটাই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ব্যবস্থা ঠিক কিভাবে বাংলাদেশের বিকাশের প্রতিবন্ধক আর সেই সুনির্দিষ্ট প্রতিবন্ধকতা বা বাধা কিভাবে আমাদের টপকাতে বা নিরসন করতে হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা দিতে পারেন নি।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি –যারা সর্বহারা ও ধনির মাঝখানে থেকে সবসময়ই আরও গরিবহয়ে যাবার ভয়ে ভীত থাকে তাদের ধনসম্পদ অর্জনের প্রতি নজর, আবার অন্যদিকে ধনি শ্রেণির প্রতি ঈর্ষা ও নেতিমূলক প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে পাশ্চাত্য দর্শনের সবচেয়ে বিকশিত ক্ষেত্র জার্মান ভাবাদর্শের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে কার্ল মার্কস ‘কমিউনিজম’কে যেভাবে দার্শনিক ভাবে বিচার করেছিলেন তার সঙ্গে এই ধরণের মধ্যবিত্ত সুলভ প্রতিক্রিয়ার সম্বন্ধ নাই বললেই চলে। বাংলাদেশে কমিউনিজম জ্ঞাঙ্গত ভাবেও আমামদের চিন্তার ক্ষেত্রে কোন বিকাশ ঘটাতে পারে নি।

শ্রেণি চেতনা বা ইতিহাস চেতনা বলতে কার্ল মার্কস ঠিক কী বুঝিয়েছিলেন তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু কমিউনিজম মানবেতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ধারা ও রাজনৈতিক চর্চার ঐতিহ্য। সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের ব্যর্থতা আছে, সন্দেহ নাই। কিন্তু মানবেতিহাসে শক্তিশালী চিন্তা ও রাজনৈতিক তৎপরতার ধারা হিসাবে কমিউনিজম জারি রয়েছে। শেষ হয়ে যায় নি।

‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’র ওপর উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়েছি একারণে যে‘ ব্যাক্তিগত মালিকানা’ আর ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ এক নয়। যদিও ইংরেজি Private Property-র অনুবাদ হিসাবে দুটোরই চল বাংলা ভাষায় আছে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় এই দুটো ধারণা একই অর্থে ব্যবহার করা হোত। এখনও তার বিশেষ অন্যথা হয় না। নিজের ভোগের জন্য অনেক কিছুই আমার নিজের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু সেই অধিকার উৎখাতের কথা কমিউনিজম বলে না। কমিউনিজম মানেই ব্যাক্তিগত সম্পত্তির অর্থাৎ নিজের ভোগের জন্য ধার্য সম্পত্তির অধিকার থেকেও উৎখাত --এটা কার্ল মার্কসের ভাষ্য নয়।

কমিউনিস্ট ইশতেহার এ ব্যাপারে পরিষ্কার:
‘‘সাধারণ ভাবে মালিকানার উচ্ছেদ নয়, বুর্জোয়া মালিকানার উচ্ছেদই কমিউনিজমের বৈশিষ্ট সূচক দিক...। এই অর্থে কমিউনিস্টদের তত্ত্বকে এক কথায় প্রকাশ করা চলে: ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ”
(কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ১৮৮৮ , p. ৪৩)

কমিউনিস্ট ইশতেহার ও কমিউনিজমের মূল প্রতিপাদ্য উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা, মোটেও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ব্যাক্তিগত মালিকানা আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি সমার্থক না। কমিউনিস্ট ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ চায় না, কারণ ব্যক্তির ভোগের অধিকার কমিউনিজম অবশ্যই স্বীকার করে। আদতে বেঁচে থাকার জন্য ব্যক্তির প্রয়োজনীয় ভোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য। ওপরের উদ্ধৃতিতে কমিউনিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। সেটা হোল সাধারণ ভাবে ব্যাক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ কমিউনিজমের দাবি নয়, সুনির্দিষ্ট ভাবে ‘বুর্জোয়া মালিকানা’ – অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপায়কে ব্যক্তিগত মালিকানার শৃংখল থেকে মুক্ত করে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়াই কমিউনিজমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই সামাজিকীকরণ (socialization) প্রক্রিয়ায় পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার গতিশীলতা নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।

কমিউনিস্ট ইশতেহার বলছে, ‘সাধারণভাবে মালিকানার উচ্ছেদ নয়, বুর্জোয়া মালিকানার উচ্ছেদই কমিউনিজমের বৈশিষ্ট্যসূচক দিক’। অর্থাৎ কমিউনিজমের লক্ষ্য হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের উচ্ছেদ: অর্থনৈতিক ও তার আইনী রূপ উভয় অর্থে। কিন্তু ‘বুর্জোয়া' বলার মানে হোল একে শুধু অর্থনৈতিক ও আইনী অর্থে বুঝলে চলবে না। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অর্থেও বুঝতে হবে। যদি সমাজে আমিত্বের ভাব প্রবল থাকে তাহলে ডিক্রি জারি করে ‘আমি’ বা ‘আমার’নিরাকরণ ঘটানো যাবে না। একটা দীর্ঘ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের দরকার আছে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে কমিউনিজম বললে কেন মনে করা হয় যে সাধারণ ভাবে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদই চাওয়া হচ্ছে? এখনও অধিকাংশই কমিউনিজমকে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গূলিয়ে ফেলেন, কিম্বা মনে করেন কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎখাত চায়। কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সম্পর্কে গোড়া থেকেই এই ধরণের আজগবি অনুমানই বাংলাদেশে বদ্ধমূল হয়েছে। যারা নিজেদের কমিউনিস্ট দাবি করেন তারাও হয়তো এটাই মনে করেন, নইলে এর বিরুদ্ধে কোন লেখা আজ অবধি আমাম্র চোখে পড়ে নি। 

কমিউনিস্ট ইশতেহারের ব্যাখ্যা হচ্ছে, “শ্রেণি বিরোধের উপর, অল্পলোকের দ্বারা বহুজনের শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন এবং উৎপন্ন দ্রব্যগুলিকে নিজেদের অধিকারভূক্ত করার ব্যবস্থার চূড়ান্ত ও পূর্ণতম প্রকাশ হল আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিগত মালিকানা। এই অর্থে কমিউনিস্টদের তত্ত্বকে এক কথায়প্রকাশ করা চলে: ব্যাক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ’। ‘ব্যাক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ’ কথাটা সাধারন ভাবে মালিকানার উচ্ছেদ হিসাবে বলা হচ্ছে না। পুঁজি বিশ্বব্যবস্থা হিসাবে যতোই পরিণত রূপ নিচ্ছে ততোই ব্যাক্তিগত মালিকানা বিশেষ ঐতিহাসিক রূপ পরিগ্রহণ করছে। তাহলে মালিকানার এই পরিণত রূপের উৎখাত ঘটানোই –অর্থাৎ বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিলয় ঘটানোই কমিউনিজমের লক্ষ্য। যদি তাই হয়, তাহল কমিউনিজমের দিন শেষ হয়েছে বলা যাবে না, বরং ঝড়ের মতো সামনে আসছে, এটাই বরং বুঝতে হবে।

শুধু কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার থেকে উদাহরণ দিয়েছি, কারণ মার্কসের অন্য বই না থাকলেও এই পুস্তিকাটি যে কোন কমিউনিস্ট দাবিদারের কাছে থাকার কথা।উদাহরণ দিচ্ছি তিনটি কারনে।

এক. কমিউনিজম, ব্যাক্তিগত মালিকানা, সমাজ, ইতিহাস, শ্রেণি, শ্রেণি চেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে মনগড়া ধারণা দিয়ে বিপ্লবীরাজনীতির পুনর্গঠন সম্ভব নয়। যদি আমরা মার্কসের ছাত্র হতে চাই তাহলে নিষ্ঠার সঙ্গেই তাকে পাঠ করতে হবে। অনুমানে কথা বললে হবে না। এতে কমিউনিস্ট আন্দোলন আগায় না, পিছিয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, মার্কস আসলে কিভাবে ধারণাগুলো ব্যবহার করেছেন তা মার্কসের সামগ্রিক লেখালিখি পাঠ ও পর্যালোচনা করেই বুঝতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন প্রসংগে একই পরিভাষা তিনি ব্যবহার করছেন কিন্তু তার অর্থভেদ আছে, এবং

তিন. নতুন বৈপ্লবিক রাজনৈতিক কর্তাসত্তা নির্মানের দরকারে মার্কসের লেখালিখিরও পর্যালোচনা জরুরী। মার্কসের পরেও মানুষের চিন্তা ভাবনা বহুদূর এগিয়েছে। তাদের আমলে নিতে হবে, সব কিছুকেই পর্যালোচনার অধীন করতে হবে। মানুষের চিন্তা চেতনার অনেক বিকাশ ঘটেছে, এই সত্যটুকু না মানলে সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়।

এটা স্বীকার করা দরকার যে ছাত্রাবস্থায় আমরা যারা কমিউনিস্ট ইশতেহার মনোযোগ দিয়ে পড়েছি তারা পদে পদে হোঁচট খেয়েছি। কারণ নতুন নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি যা কমিউনিজম সম্পর্কে প্রচলিত বা প্রথাগত ধারনার সঙ্গে মিলত না। অন্যদিকে মীমাংসার জন্যযে বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা বা পরিমণ্ডল দরকার সেটাও অনুপস্থিত ছিল।

কমিউনিস্ট ইশতেহার পড়তে গিয়ে প্রথমেই যে বাক্যটির ওপর প্রচণ্ড ভাবে হোঁচট খেয়েছিলাম সেটা হোল: ‘উৎপাদনের উপকরণে অবিরাম বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে এবং তাতে করে উৎপাদন সম্পর্ক ও সেই সঙ্গে সমগ্র সমাজ-সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি বাঁচতে পারে না’। বুর্জোয়া শ্রেণি যে ঐতিহাসিক ভাবে বৈপ্লবিক শ্রেণি এটা জোরের সঙ্গে মার্কস বলেছেন। ‘বুর্জোয়া’ সম্পর্কে আমাদের ধারণার সঙ্গে যা একদমই খাপ খেতোনা। এর পরের কয়েকটি ছত্রে বুর্জোয়া শ্রেণির বৈপ্লবিক ভূমিকার প্রশংসা করেছেন মার্কস ও এঙ্গেলস। ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে কমিউনিজমের নামে যে ঈর্ষা, বিদ্বেষ প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখি তার সঙ্গে এর কিছুরই মিল নাই। কিছুই সেখানে নাই।

আরো হোঁচট খেয়েছিলাম যখন ছাত্রাবস্থায় প্রথম পড়ি, ‘শ্রমিক শ্রেণির অন্যান্য পার্টিগুলির প্রতিপক্ষ হিসাবে কমিউনিস্টরা পৃথক পার্টি গঠন করেনা’।দেখা যাচ্ছে কমিউনিস্টদের আলাদা পার্টি গঠনের কথা কমিউনিস্ট ইশতেহার বলছে না। কেন করে না? কারন ‘প্রলেতারীয় আন্দোলনকে রূপ দেওয়া বা গড়েপিটে তোলার জন্য তারা (কমিউনিস্টরা) কোন গোষ্ঠিগত নীতি খাড়া করে না’।দেখা যাচ্ছে কমিউনিস্ট দল গঠন করে কোন ‘গোষ্ঠিগতনীতি’চর্চা কমিউনিস্টদের কাজ নয়। কমিউনিস্টরা অবশ্য অধিকাংশ সময় এটাই করেছে, বা এটাই করে।

আমরা যেভাবে কমিউনিজম সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি সেই পরিস্থিতি নিশ্চয়ই এখন নাই। বইপত্র পাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ। সোশ্যাল নেট ওয়ার্কে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনাও অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। অনেক কিছুই হয়তো একালে আর আগের মতো না। কিন্তু আমার মনে হয় না ধনি/নির্ধন অর্থনৈতিক বিভাজন এবং 'ব্যাক্তিগত সম্পত্তির উৎখাত'-এর বাইরে চিন্তার দিক থেকে বাংলাদেশের বামপন্থা খুব একটা অগ্রসর হতে পেরেছে। এর দোষ পুরাটা বাংলাদেশের বলা যাবে না। আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রধান প্রধান কমিউনিস্ট ধারার ব্যাখ্যা বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের তুলনায় খুব আলাদা ছিলনা। বিশেষত যে সকল ধারার সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা সম্বন্ধ রাখতেন। বিপ্লবী শ্রেণি রাজনীতি নিজেও নানান সংকটের মধ্যে রয়েছে।

তবে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এখনও একটা চরে ঠেকিয়ে রেখেছে সেটা হোল বৈষয়িক অবস্থা মানুষের চেতনাকে নির্ধারণ করে নাকি চেতনা বৈষয়িক অবস্থার নির্ণায়ক? এই তর্কের চূড়ান্ত মীমাংসা হয়েছে বলে আমার জানা নাই। যদি বৈষয়িক অবস্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রে চেতনার কোন ভূমিকা না থাকে তাহলে ইতিহাস-সচেতন অগ্রসর চেতনা সম্পন্ন কমিউনিস্ট পার্টিরও বা কী দরকার? পার্টি কথাটার অর্থই হচ্ছে কোন না কোন চেতনা –অর্থাৎ মতাদর্শ, উদ্দেশ্য, ইচ্ছা, অভিপ্রায়, প্রতিজ্ঞা বা সংকল্প বাস্তবায়নের জন্য মানুষের সংগঠিত তৎপরতা। যদি মানি যে পার্টি সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে পারে, তাহলে এটাও মানতে হয় যে মানুষের চেতনা বৈষয়িক অবস্থার বদল বা রূপান্তর ঘটাতে সম্ভব। চেতনা অবশ্যই ঐতিহাসিক কর্তা হিসাবে ভূমিকা রাখতে পারে ও রাখে; বৈষয়িকতা যে অর্থে ইহলৌকিক এবং সত্য, ইতিহাসের কর্তাসত্তা হিসাবে চেতনাও ঠিক সেই অর্থেই বৈষয়িক ও সত্য। ঐতিহাসিক ভাবে তৈয়ার হওয়া মানুষের কর্তাসত্তার ইতিহাস বদলাবার কিম্বা মানবেতিহাসের বিশেষ অভিমুখ নির্ণয়ের ভূমিকা থাকে। ব্যক্তির উদ্ভব ও বিকাশের ফলে তার সম্ভাবনা আগে চেয়ে বেড়েছে, কমে নি।

প্রশ্নগুলো তুলছি রাজনৈতিক কর্তাসত্তা নতুন ভাবে নির্মাণের দরকারে। বিপ্লবী রাজনীতি সম্পর্কে প্রথাগত চিন্তা পাল্টানো জরুরি হয়ে পড়েছে। দর্শন বা চিন্তার ইতিহাসে যে সকল গোড়ার প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত রয়েছে তাকে এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নাই। তার জন্য আমাদের নিজেদের অন্তর্গত বিপ্লবী কর্তাসত্তাকে জন্ম দেওয়া এবং সবসময়ই সজাগ রাখা জরুরী। দরকার সব কিছুকেই পর্যালোচনা করবার হিম্মত অর্জন এবংবর্তমানের করণীয় নির্ধারণ। তার জন্য দরকার নিজের চিন্তাকে শাণিত করা। চিন্তা যেসকল প্রশ্নের মুখোমুখি হয় তাকে ধামাচাপা না দিয়ে দরকার মোকাবিলা করবার সাহস ও শক্তি অর্জন।

বুর্জোয়া শ্রেণি ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব

আগেই বলেছি, ‘বুর্জোয়া’ শব্দটি ফরাসি ভাষা থেকে আসা। কোন লেখায় শব্দটি কিভাবে ব্যবহার করা হোল তার ওপর শব্দটি কি বোঝায় সেটা নির্ভর করে। মূলে বা আদিতেবোঝাত গ্রামের বিপরীতে শহরে যারা বিশেষ পৌর এলাকায় বাসিন্দা এবং পৌর আইনে বিশেষ সুবিধাভোগী। ইউরোপে ১১ শতাব্দি থেকে বুর্জোয়ার আবির্ভাব শুরু হয় আর ১২শতাব্দিতে নগরায়নের সময় থেকে গ্রাম থেকে শহরে মানুষ আসা শুরু করার পর রেনেসাঁর সময় থেকে তারা বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান হতে শুরু করে। ‘বুর্জোয়া’পরিভাষা হিসাবে ব্যবহার শুরু হয় ১৩ শতাব্দি থেকে। বুর্জোয়া সুনির্দিষ্ট কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ভোগ করত। বুর্জোয়ারা শহরবাসী বটে, কিন্তু সব শহরবাসি মানেই ‘বুর্জোয়া’নয়, কারন তারা বুর্জোয়ার আইনী অধিকার ভোগ করত না।

প্রাচিন যুগ (Ancient Regime) শেষ হচ্ছে আর নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটছে, সেই সন্ধিক্ষণে ফ্রান্সের মধ্য যুগে নগরবাসী হিসাবে ‘বুর্জোয়া’ বিশেষ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করত। ‘বুর্জোয়া বলতে তাহলে আদিতে তাদেরকেই বোঝাত যারা পৌর আইনে বিশেষ ‘নাগরিক’ অধিকারের অধিকারী হয়ে শহরে ব্যবসাবাণিজ্য দোকানপাট কলকারখানা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল। অর্থাৎ ‘বুর্জোয়া’শুধু অর্থনৈতিক বর্গ নয়, তার আইনী অধিকারও ছিল। বুর্জোয়াকে শুধু তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে বুঝলে তাহলে চলছে না, তার আইনও ‘বুর্জোয়া’র সংজ্ঞা নির্ণয় করে। এরপর রয়েছে চেতনা গত দিক। বুর্জোয়ার বিশেষ চেতনা, ইচ্ছা ও সংকল্প রয়েছে যার ভিত্তিতে এই শ্রেণি সমাজে রাজনীতিতে সংস্কৃতিতে এমনকি আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। চেতনার দিক থেকে যেমন তেমনি বুর্জায়ার সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকা বুর্জোয়া আইন ও রাষ্ট্রের দ্বারাও সংজ্ঞায়িত হয়।

আইন ও অধিকারের জায়গা থেকে বুর্জোয়াকে বুঝতে হলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে রাখতে হবে। বুর্জোয়া শ্রেণি যখন অধিকারের কথা বলে তখন মূলত ব্যক্তির অধিকারের কথাই বলে – যার মধ্যে সম্পত্তির মালিক হবার অধিকার ও ব্যাক্তি স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। এই অধিকার আইনের দ্বারা সিদ্ধ (positive law) কিন্তু আইনের বাইরেও আইনে অনুপস্থিত (passive law) মানবিক অধিকার মানুষের আছে – বুর্জোয়া শ্রেণি সেই অধিকারও স্বীকার করে এবং ধারণ করে। ইতিহাসে বুর্জোয়া শ্রেণির এই অধিকার দুই প্রকার অধিকার হিসাবে ব্যক্ত ও হাজির হয়েছে: ১.নাগরিক অধিকার, আর ২. মানবিক অধিকার। যে কারণে আমরা দেখি ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামন্ত শ্রেণির বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্বে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে তার আদর্শিক ভিত্তি ‘মানুষ ও নাগরিক অধিকারের ঘোষণা’ (Declaration of the rights of Man and of the Citizens (১৭৯৩)। এই ঘোষণা ইতিহাসে বিখ্যাত।

এই ঘোষণায় কেন মানুষের অধিকারের কথা নাগরিক অধিকার থেকে আলাদা করে বলতে হোল? এক. রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা সিদ্ধ ‘নাগরিক’অধিকার আর অন্যদিকে আইনে অনুপস্থিত ‘মানবিক’ অধিকার। দুইয়ের পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠনতন্ত্রে স্বীকার করুক আর না করুক, ‘মানুষ’ সম্পর্কে এমন কিছু মানবতাবাদী ধারণা রয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণি তার শ্রেণি চেতনার আদর্শ হিসাবে সাধারণত মানে। মানবতাবাদ আদতে বুর্জোয়া মতাদর্শ, এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সংগ্রাম বুর্জোয়া চেতনার বৈশিষ্ট্য।

‘মানুষ ও নাগরিক অধিকার’ঘোষণা মূলত বুর্জোয়া শ্রেণির ভাবাদর্শিক ও রাজনৈতিক ঘোষণা। ন্যূনতম যে সকল মানবিক ও নাগরিক অধিকার স্বীকার করলে কাউকে ‘বুর্জোয়া’বলা যায় তার মানদণ্ড হচ্ছে ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণা। ফরাসি বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণি শুধু নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষান্ত থাকে নি, এই ঘোষণা এবং ঘোষণার ভিত্তিতে সামন্ত ও রাজারাজড়াদের বিপরীতে নতুন ধরনের জনগণের রাষ্ট্র (Republic) গড়ে তুলেছিল, যে কারণে বিপ্লবের চরিত্রটিও ছিল বুর্জোয়া। কমিউনিস্টরা একেই ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ হিসাবেঅভিহিতকরে। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে ফরাসি বিপ্লব থেকে যে শিক্ষা কমিউনিস্টরা নেয় তার তাৎপর্য হচ্ছে যেসব দেশে বুর্জোয়া নাগরিক ও মানবিক অধিকার এখনওকায়েম হয় নি, সেইসব দেশে জনগণের সাংবিধানিক বা গঠনতান্ত্রিক আইনসিদ্ধ অধিকার হিসাবে নাগরিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। যে সব দেশে বুর্জোয়াশ্রেণি দুর্বল কিম্বা এই অধিকার কায়েমে অক্ষম কমিউনিস্টদের কাজ হচ্ছে তাদের নেতৃত্বে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ সম্পন্নকরা। এইঅধিকারকে গঠনতান্ত্রিক ভিত্তি দেবার জন্য নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম। বুর্জোয়া বিপ্লবের জন্য কমিউনিস্টদের ‘শ্রমিক আরকৃষকের বৈপ্লবিক মৈত্রী’গড়েতুলতেহবে –লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা এই নীতি অনুসরণ করে সফল হয়েছিল।

এখানে বোঝার বিষয় হচ্ছে আমাদের মতো দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্বে বুর্জোয়া শ্রেণি না থাকলেও সেই বিপ্লবের চরিত্র ‘বুর্জোয়া’ই হবে। কারণ বুর্জোয়া নাগরিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠাই এই বিপ্লবের আশু উদ্দেশ্য হতে বাধ্য। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে। ‘বুর্জোয়া’কথাটি বাদ দিলে আমরা এই বিপ্লবকে স্রেফ বলতে পারি ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’বা জনগণের বিপ্লব। এখানে জঙ্গণ হচ্ছে তারাই যারা এইন্যূন্তম বুর্জোয়া নাগরিক ও মানবিক অধিকার স্বীকার করে। যারা এমন এক রাষ্ট্র গঠন করতে চায় যেখানে প্রত্যকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত রাখবার রাজনীতি করে। লেনিনও গণতান্ত্রিক বিপ্লবই করেছিলেন। তবে তিনি নতুন একটি যুক্তি দিয়েছিলেন। সেটা হোল কমিউনিস্ট পার্টি যদি সক্ষম হয় তাহলে শুধু গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সন্তুষ্ট থাকবে কেন, সরাসরি ‘সমাজতন্ত্র’কায়েম করা গেলে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি সেটাই কায়েম করবে। রাজনৈতিক দর্শন ও বিপ্লবের ইতিহাসে লেনিনের এই চিন্তা ও রাজনীতি খুবই বড়সড় তর্ক হয়ে আছে।

রাজনৈতিক ক্ষমতার একটা ব্যাখ্যা লেনিন দাঁড় করিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রাজনৈতিক ক্ষমতা শ্রমিক ও কৃষকের বৈপ্লবিক মৈত্রীর ওপর নির্ভর করে।গণতন্ত্র মানে সবার জন্য গণতন্ত্র নয়, কৃষকের ও শ্রমিকের জন্য গণতন্ত্র, কিন্তু যারা শ্রমিক এবং বঞ্চিত চাষাভূষাদের স্বার্থের বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে একনায়কতন্ত্র বা সোজা কথায় ‘বলপ্রয়োগ’। একই যুক্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে ‘সমাজতন্ত্র’বলতে লেনিন বুঝিয়েছিলেন শ্রমিক শ্রেণির নিজেদের জন্য গণতন্ত্র, কিন্তু অন্য সকল শ্রেণির জন্য একনায়কতন্ত্র।গণতন্ত্র বনাম একনায়কতন্ত্রের সম্বন্ধ এবং এই বিষয়ে কমিউনিস্টদের অবস্থাননিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক আছে।

লেনিনের সঙ্গে তর্কে এখানে আমরা যাবো না। রুশ দেশের বাস্তব ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই লেনিনকে বিচার করতে হবে বিমূর্ত তর্ক হিসাবে নয়। লেনিন আসলে রাষ্ট্র ‘ক্ষমতা’ নিয়ে কথা বলছিলেন। বলা হয়ে থাকে, লেনিন পার্টি আর রাষ্ট্র একাকার করে ফেলেছিলেন। একালে ‘ক্ষমতা’ নিয়ে আলোচনা শুধু বলপ্রয়োগ ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক করা হলে সেটা হবে অসম্পূর্ণ। একালে যা নিয়ে নতুন ভাবে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ক্ষমতা সম্পর্কে লেনিনের ধারণার মধ্যে নিহিত ছিল কিনা সেটা রাজনৈতিক দর্শন ও ব্যাবহারিক রাজনীতির অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তর্ক হিসাবে এখনও হাজির রয়েছে। সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেবার উপায় হচ্ছে ‘বুর্জোয়া’ আকাংখাকে পূর্ণভাবে আমলেনেওয়া। মানুষ ‘স্বাধীন’ এই বুর্জোয়া চেতনাকে গায়েরজোরে দাবিয়ে রেখে ইতিহাস সামনে অগ্রসর হতে পারে নি, বহু রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে সেটা বোঝা গিয়েছে। আগামিদিনের নতুন রাজনৈতিক চর্চার জন্য এই শিক্ষা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে এটাওঠিক যে ‘মুক্তি’, ‘স্বাধীনতা’ ইত্যাদি বিমূর্ত ধারণাগুলোর পর্যালোচনা জরুরী। অবশ্যই। ধারনাগুলোর সীমা ও সম্ভাবনার বিচার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একে ‘বুর্জোয়া’বলে‘ ধরো তক্তা মারো পেরেক’ জাতীয় রাজনীতি দিয়ে দমন করা যায় না; লাফ দিয়ে অতিক্রম করে যাওয়াও অসম্ভব। মানবেতিহাসে ‘স্বাধীন ব্যক্তি’র ভূমিকা, কিম্বা ‘মানুষ স্বাধীন ওসার্বভৌম’এই অনুমান বা ধারনার প্রতাপ ভালো ভাবে বোঝার দরকার। পুঁজির সঙ্গে তার সম্বন্ধের জায়গাও সকল দিক থেকে বিচার করা জরুরি। ব্যক্তির ‘ব্যক্তিত্ব’ঐতিহাসিক ভাবে তৈয়ার হয়, ‘ব্যক্তি’ মানুষের অন্তর্গত কোন রহস্য জনক শক্তি না। অতএব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, কামনা, বাসনা অভিপ্রায় পুঁজির দ্বারাই নির্ধারিত হয়। কিন্তু একই ভাবে মুক্ত ও স্বাধীন কর্তাসত্তা হিসাবে ব্যক্তি চেতনাগত ভাবে ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে পুঁজিতান্ত্রিক শৃংখলের বিরোধিতাও করে। করতে সক্ষম। ব্যক্তি মাত্রেই এইসম্ভাবনা সমান মাত্রায় ধারন করে। সেই কর্তাসত্তার উদ্বোধনের জন্য রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতা বাংলাদেশে কিভাবে গড়ে তোলা যায় সেটাই এখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একে আমলে না নিয়ে নতুন নতুন রাজনীতির নির্মান সম্ভব কিনা সন্দেহ।

‘ব্যক্তি ’বহুকাল ধরেই দর্শনের কেন্দ্রীয় বিষয়। বুর্জোয়া বিশ্ব ব্যবস্থা আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। বুর্জোয়া সমাজে মানুষের নিজেকে ‘স্বাধীন’গণ্য করা ও ব্যক্তি অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকাই স্বাভাবিক। অসচেতনতা শুরু হয় যখন নিজের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে আমরা অপরের অধিকার অস্বীকার করে বসি, আমল করিনা বা স্বীকার করতে চাই না। – এখানেই অসচেতনতা। মানুষ নিজেকে ‘মুক্ত’ উপলব্ধি করতে চায়, স্বাধীনতার স্বাদ চায়। শুধু উপলব্ধি করে ক্ষান্ত থাকে না, তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক রূপও দেখতে মানুষ আগ্রহী। তাহলে মুক্তির এইআকাঙ্ক্ষা, তাগিদ ও স্বাদকে দাবিয়ে রেখে ইতিহাসের বুর্জোয়া কালপর্ব অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব কিনা সেটাই একালের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও রাজনোইতিক প্রশ্ন। নিজেরটা চাইতে হলে একই ভাবে পরের অধিকার ও অপরের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সক্রিয় থাকতে হয়, এটা বোঝানোই এখনও প্রথম, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজ। এতে বোঝা যায় বুর্জোয়া যুগ অতিক্রম করবার ঐতিহাসিক শর্ত আসলে এখনও বাংলাদেশে তৈরি হয় নি। বাংলাদেশে বুর্জোয়া পর্বই এখনও এলো না, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা ও তৎপরতা হিসাবে ব্যক্তির বিকাশ ঘটলোনা, সেখানে বুর্জোয়া যুগ অতিক্রম করে পরের পর্যায়ের আশা আকাশকুসুম মাত্র।

শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের অনুপস্থিতিতেও মাও জেদং দং চিন দেশেকমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার নাম দিলেন ‘জনগণতান্ত্রিক’বা‘নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এটা নতুন ধরণ। তরুণ বয়সে মাও জে দং-এর নীতি ওকৌশলের প্রতি আমামদের অনেকের প্রবল ভাবে আকর্ষণ বোধ করবার কারণ হচ্ছে চিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে জনগণকে সংগঠিত করবার দর্শন ও কৌশল আমাদের মতো দেশেও কার্যকর হতেপারে। কিন্তু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বাংলাদেশে সম্পন্ন হয় নি।

মার্কসের পরিভাষা হিসাবে ‘বুর্জোয়া’

মার্কস শুরুর দিকে হেগেলকে অনুসরণ করছিলেন। আমরা এখন ‘নাগরিক সমাজ’, ‘সিভিল সোসাইটি’, ‘সিভিল সমাজ ’বলতে যা বুঝি হেগেল তার কালে ‘সিভিল সোসাইটি’ শব্দবন্ধ দিয়ে মোটেও সেটা বুঝতেন না। বুঝতেন আইন ও রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে স্বার্থপর ব্যক্তিদের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা হিসাবে; সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক হচ্ছে সমাজ স্বার্থপর ব্যক্তির ব্যক্তিগত কামনা বাসনা চরিতার্থ করবার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্র। ধারণা হিসাবে নাগরিক সমাজ হেগেলের রাষ্ট্রের ধারণার অধীন। আইন ও রাষ্ট্র সম্পর্কে হেগেলের সামগ্রিক ধারণার আলোকে ‘সিভিল সোসাইটি’ বুঝতে হবে। তবে সমাজ বলতে আমরা যেভাবে গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষ বুঝি হেগেল ঠিক সেভাবে বুঝতেন না। বরং ব্যক্তি ও পরিবার তাদের বৈষয়িক স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য হাজার কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকে—হেগেল সেই ধারণাকেই তার‘অধিকারশাস্ত্রে’একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্গ হিসাবে গড়ে তুলেছেন। সিভিল সোসাইটির বিপরীতে রাষ্ট্র হচ্ছে বিশেষ বিশেষ স্বার্থের উর্ধে উঠে সকলের সার্বজনীন ইচ্ছা ও অভিপ্রায় পূরণের জায়গা। হেগেলের সিভিল সোসাইটিতে সমাজ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করবার জায়গা, কিন্তু সমাজ থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। মানুষের নৈতিকতা তার আপন তাগিদে তাড়িত হয়ে সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়ে রাষ্ট্রের রূপ পরিগ্রহণ করে – কিভাবে ঘটে হেগেল সেটাই তার অধিকার শাস্ত্রের দর্শনে দেখাতে চেয়েছেন। হেগেলের কাছে ‘রাষ্ট্র নৈতিকতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা; নীতি ও অধিকার বোধের যৌক্তিক পরিণতি’।

তাহলে সিভিল সোসাইটি ( জর্মন ভাষায় burgerliche Geesellschaft) স্বার্থপর ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করবার জায়গা, এই ধারণা অধিকার শাস্ত্রের বিচার ও রাষ্ট্রচিন্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ এখানে, এই আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে, তার বিশেষ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করে। নীতিতাড়িত সার্বজনীন বা সামষ্টিক বিবেচনা থেকে এই স্বার্থপরতার উর্ধে উঠতে গিয়ে মানুষ রাষ্ট্র গড়ে তোলে। রাষ্ট্র নৈতিক আদর্শের পরিণত রূপ, রাষ্ট্র পরিগঠিত হয়ে ওঠার শর্ত ।

হেগেলের ছাত্র হবার কারনে ‘বুর্জোয়া’ বলতে মার্কস তরুণ বয়সের লেখালিখিতে স্বার্থপর সমাজে ব্যক্তির ছোটলোকি স্বার্থপরতাই বুঝতেন। বাংলাদেশে আমরা তরুণবয়সে স্বার্থপর ধনি শ্রেণিকে যেভাবে বুঝতাম, ১৮৪২ সালের দিকে মার্কস আইন ও দর্শনের বাইরে এসে সবে যখন ‘বৈষয়িক’বিষয়াদি নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলেন, তখন তার বোঝাবুঝি আমাদের চেয়ে আলাদা কিছু ছিল না। রাইনল্যান্ডের যেসব অর্থশালীরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল তাদের সম্পর্কে বলতেগিয়ে মার্কস মন্তব্য করছেন:

‘আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে বুর্জোয়াদের, নগরবাসীদের (citoyen) না’। নগরায়ন সামন্ত অর্থনীতির বদল ঘটাচ্ছে, তাকে তিনি ইতিবাচক ভাবছেন, কিন্তু ‘বুর্জোয়া’তখনও তার কাছে খারাপ, ছোটলোক, সংকীর্ণ। ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের (১৮২২-৭৩) কিম্বা হেনরিক ইবসেন (১৮২৮ –১৯০৬)যেভাবে বুর্জোয়াদের হীনমন্য, সংকীর্ণ আর টাকা দিয়ে সম্মান আর আভিজাত্য কিনে নেবার জন্য কাতর চরিত্রে রূপ দিয়েছিলেন মার্কসের ফরাসি ভাষা থেকে ধার করা ‘বুর্জোয়া’পরিভাষাটির ব্যবহার সেইসময়ের সাহিত্যিক অনুষঙ্গ থেকে খুব আলাদা ছিল না। মার্কস তখনকার প্রচলিত ধারণা থেকে ভিন্ন কিছু ভাবছিলেন বলে মনে হয়না। বুর্জোয়া তার প্রথম দিকের লেখালিখিতে স্বার্থপর সম্পত্তিবান শ্রেণি।এই শ্রেণির হীনমন্য ও সংকীর্ণ মানসিকতাকে মার্কস সমাজের বৃহত্তর বৈপ্লবিক আকাংখা বা সার্বজনীন আকুতির বিপরীতে স্থাপন করেছিলেন।

শুরুতে মার্কস লেখালিখি করছিলেন বন থেকে গরীবদের কাঠ চুরি করা নিয়ে আইনসভার তর্ক বিতর্কে গরিবদের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে। কিন্তু ১৮৪২-৪৩-এর দিকে লিখতে গিয়ে তার মনে হোল এই ধরণের বৈষয়িক বিষয় বোঝার মতো পড়াশুনা তাঁর নাই। অর্থশাস্ত্র নিয়ে তিনি তখনও পড়াশুনা করেন নি। নিজের বোঝাবুঝির এই অভাববোধ তাঁকে আইন ও দর্শন থেকে অর্থশাস্ত্র পাঠ ও পর্যালোচনায় প্রতি আগ্রহী করে তুলল। এর পরের ইতিহাস আমাদের জানা। নিজের জীবনের এই কালপর্ব সম্পর্কে মার্কস নিজেই লিখছেন, পত্রিকায় বনের কাঠচুরি নিয়ে লেখালিখির সময়তিনি “প্রথম নিজেই খুব বিব্রত বোধকরলেন’ আর এটাই তাকে‘অর্থনৈতিক প্রশ্ন’গুলোর দিকে নজর ফেরাতে বাধ্য করল (দেখুন, ১৮৫৯ সালের অর্থশাস্ত্রপর্যালোচনা ক্ষেত্রে একটি সংযোজন (Marx, 1972, p. ১৯)।

তবে ১৮৪৫-৪৪ এর সময় থেকে ‘বুর্জোয়া’ সম্পর্কে তাঁর ধারণা বদলাতে শুরু করে। বুর্জোয়া ফ্রান্সের সামন্ত সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে সেটা তিনি দ্রুতই টের পেয়েছিলেন। এটা তিনি পেরেছিলেন কারন ততোদিনে তিনি অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন শ্রেণিকে বোঝার কাজে এগিয়ে গিয়েছিলেন। “সাধারণ ভাবে ফরাসি অভিজাত শ্রেণি এবং ধর্ম যাজকদের ইতিবাচক চরিত্র বোঝা যায় পাশাপাশি বুর্জোয়া শ্রেণিকে দিয়ে, যারা তাদের বিরোধী” (Marx, 1844) । যাজক ও সামন্ত শ্রেণির বিপরীতে বুর্জোয়া ইতিবাচক। এর চার বছর পর কমিউনিস্ট ইশতেহারে আমরা বুর্জোয়া সম্পর্কে একদমই নতুন ধরনের কথা শুনি।

“বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সমানে চলেছিল সে শ্রেণির রাজনৈতিক অগ্রগতি। এই যে বুর্জোয়ারা ছিল সামন্ত প্রভুদের আমলে একটা নিপীড়িত শ্রেণী, মধ্যযুগের কমিউনে যারা দেখা দেয় একটা সশস্ত্র ও স্বশাসিত সংঘ রূপে, কোথাও বা স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক নগর রাষ্ট্র (যেমন ইতালি ও জার্মানিতে) আবার কোথাও বা রাজতন্ত্রের করদাতা ‘তৃতীয়মণ্ডলী’রূপে (যেমন ফ্রান্সে), তারপর হস্তশিল্প পদ্ধতির প্রকৃত পর্বে যারা আধা সামন্ততান্ত্রিক বা নিরংকুশ রাজতন্ত্রের সেবা করে অভিজাতবর্গের বিরুদ্ধে সমভার শক্তি হিসেবে, সেই বুর্জোয়া শ্রেণি অবশেষে আধুনিক শিল্প ও বিশ্ববাজার প্রতিষ্ঠার পর আজকালকার প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের জন্য পরিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করে নিয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রের শাসকমণ্ডলী হোল সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণির সাধারণ কাজকর্ম ব্যবস্থাপনার একটা কমিটি মাত্র

ঐতিহাসিকভাবে বুর্জোয়া শ্রেণি খুবই বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে”। (কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ১৮৮৮ , pp. ৩০-৩১)।

‘ঐতিহাসিক ভাবে বুর্জোয়া শ্রেণি খুবই বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে’ – মার্কস-এঙ্গেলসের লেখায় বুর্জোয়ার এই ভূয়সী প্রশংসা শুনতে আমরা অভ্যস্ত না। যে কারণে ব্যবসা বাণিজ্য ধনোৎপাদন ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী বাংলাদেশের বামপন্থার মধ্যে নেতিবাচক। বলা বাহুল্য, এই পর্যালোচনাহীন নেতিবাচক অজ্ঞতার সঙ্গে মার্কসের কিম্বা কমিউনিস্ট ইশতেহারের বিশেষ সম্পর্ক নাই। কারন বাংলাদেশে কমিউনিস্ট রাজনীতি মূলত স্বঘোষিত পরচয়ের অধিক একটি সুসংবদ্ধ মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ধারা হিসাবে গড়ে ওঠে নি। বাংলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণির সম্ভাব্য ইতিবাচক ঐতিহাসিক ভূমিকা কি হতে পারে, এবং বুর্জোয়া শ্রেণির দিক থেকে জনগণের বিপদের ক্ষেত্রগুলো কী, সেই সকল বিষয়ের যথেষ্ট পর্যালোচনা হয় নি। করবার কর্তব্যবোধও জাগে নি।গতিশীল অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবার জন্য প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঠিক কিভাবে এবং কেন দরকার সেই কর্তব্য নিয়েও যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা হয় নি। উপযুক্ত কমিউনিস্ট নীতি ও কৌশল গড়ে তোলা যায় নি। লেনিনের ভাষায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের ‘দ্রুত ও ত্বরান্বিত’ বিকাশ নিশ্চিত করা এবং গতিশীল শক্তিশাল জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে বামপন্থি আন্দোলন বরং সবসময়ই বাধা বা নুইসেন্স হিসাবে ভূমিকারেখেছে।

মার্কস ‘বুর্জোয়া’শ্রেণির বৈপ্লবিক ভূমিকার ভূয়সি প্রশংসা করে ক্ষান্ত থাকেন নি, তার হাতে হেগেলের ‘সমাজ’ (burgerliche Geesellschaft ) সংক্রান্ত ধারণার আমূল বদল ঘটে। নাগরিক ও মানবিক অধিকার হেগেল বিমূর্ত নীতিনৈতিকতার বিষয় হিসাবে হাজির করেছিলেন। ব্যাক্তির ‘স্বাধীনতা’, ‘অধিকার’ ইত্যাদি ছিল বিমূর্ত ধারণা। এমন বিমূর্ত রাষ্ট্রের ধারণা আগে অনুমান করে নিয়ে হেগেল ‘অধিকার’-এর ধারণা তাঁর ‘অধিকারশাস্ত্রের দর্শন’ গ্রন্থে নিষ্পন্ন করেছেন। মার্কস দেখালেন রাষ্ট্র আসলে বুর্জোয়ার অর্থাৎ এই স্বার্থপর মানুষের --নিজ নিজ ব্যক্তি স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা ওপ্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল হিসাবে গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের কাজই হচ্ছে ব্যক্তির বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষা করা। রাষ্ট্র ব্যক্তি স্বার্থপরায়নতারই অভিপ্রকাশমাত্র, কারন ব্যক্তিগত মালিকানার ওপর গড়ে ওঠা সমাজই রাষ্ট্রের বৈষয়িক ভিত্তি। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি বিশেষ শ্রেণির স্বার্থই রাষ্ট্র রক্ষা করে আর সেই শ্রেণি হচ্ছে যারা পুঁজির মালিক। ব্যক্তিগত সম্পত্তির এই বিশেষ ধরণই আধুনিক রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণ করে। পুঁজির মালিকরাইআধুনিক রাষ্ট্রের চরি্ত্র নির্ণয় করে। মার্কস লিখছেন, ‘সামন্তবাদেরবিরুদ্ধে বিপ্লব’বুর্জোয়া শ্রেণির এই বিশেষ সম্পত্তির ধরণেরই বিপ্লব। এইবিপ্লবে “মানুষ সম্পত্তি থেকে স্বাধীন হয়নি, বরং সম্পত্তির মালিক হবার স্বাধীনতা লাভ করেছে’ ( (Marx, 1844, p. 167)।

এই কারণে কমিউনিস্ট ইশতেহারে ‘বুর্জোয়া’কথাটা পুঁজির প্রতিনিধি বা পুঁজির স্বভাব যে শ্রেণির মধ্যে ‘কর্তা’রূপে প্রকাশিত হয় সেই অর্থে মার্কস ব্যবহার করেছেন। কিন্তু করেছেন এমন ভাবে যাতে পরিষ্কার যে বুর্জোয়া শ্রেণির ঐতিহাসিক ভূমিকা বিপ্লবী হলেও এই শ্রেণী ইতিহাসে চিরকাল থাকার জন্য আসে নি।সামন্ত শ্রেণির মতো তার বিলয়ও ঐতিহাসিক বিকাশের গতিপ্রক্রিয়ার মধ্যে নিহিত। সেটা ঘটবে তার বিপরীতে নতুন বিপ্লবী শ্রেণি বা নতুন ঐতিহাসিক কর্তাসত্তার আবির্ভাব ও বিকাশের মধ্য দিয়ে।

বিপ্লবের নতুন কর্তা হিসাবে মার্কস কারখানার শ্রমিকদের কথা ভেবেছেন। শ্রমিক শ্রেণি নতুন বিপ্লবী শ্রেণী। এখানেই অর্থনৈতিক শ্রেণি আর ইতিহাসসচেতন রাজনৈতিক কর্তাসত্তার তর্কটা ক্রমে ক্রমে একালে সামনে চলে আসে। শ্রমিক শ্রেণি বাস্তবে আদৌ একালে বিপ্লবের কর্তা কিনা, তা নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক আছে। তর্কটা বৈষয়িক অবস্থা মানুষের চেতনা নির্ণয় করে নাকি চৈতন্য বৈষয়িকতার --সেই গোড়ার দার্শনিক তর্কের সঙ্গে যুক্ত।

অন্য দিক থেকেও তর্ক আছে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের সমাজতন্ত্রে রূপান্তর স্রেফ বিপ্লবী কর্তাসত্তার মামলা না। শ্রমিক শ্রেণি বিপ্লবী হলেও তারা ঐতিহাসিক ভাবে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরে ব্যর্থ হবে যদি উৎপাদন শক্তির বিকাশ না ঘটে। বিকাশ এমন পর্যায়ে যেতে হবে যাতে বিপ্লবী রূপান্তরের বৈষয়িক শর্ত তৈরি হয়।

এই তর্কগুলো আমরা আপাতত এখন করব না। আগামি কোন লেখার জন্য তুলে রাখলাম। বলা বাহুল্য বিপ্লবের কর্তাসত্তা একালে কিভাবে তৈরি হয় আর বাস্তবে সেই কর্তা কারা এই প্রশ্নের সুরাহা দরকার। এ ছাড়া একালে নতুন বিপ্লবী কর্তাসত্তার আবির্ভাব অসম্ভব।

৬ জুন ২০১৭। ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪। শ্যামলী।

... ... ...
বইপত্রের হদিস

Marx, K. (1972)
A Contribution to the Critique of Political Economy (1859). New York: International Publishers.

কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস. (১৮৮৮ )
কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার (বাংলা অনুবাদ ১৯৮৫). মস্কো: প্রগতি প্রকাশন.


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।