‘বিপ্লব’


‘বিপ্লব’ নিয়ে কেন?

‘বিপ্লব’, ‘বৈপ্লবিক’, ‘বৈপ্লবিকতা’ ইত্যাদি শব্দ হামেশা ব্যবহারের ফলে শব্দগুলো ক্লিশে হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ; অনেকটা ছেঁড়া টাকার মতো। বিধিবদ্ধ, প্রচলিত বা আগাম কোন নিয়ম না মেনে পুরানা অথচ বিদ্যমান অবস্থা বদলে দেওয়াকে বাংলায় আমরা সাধারণত ‘বিপ্লব’ বলে থাকি।

বিপ্লব নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক রূপান্তর নয়। সে কারণে বিপ্লবের সঙ্গে আমরা সশস্ত্রতা বাসহিংসতার যোগ আছে অনুমান করি। বিপ্লব মানে সশস্ত্র বা সহিংস কায়দায় রাজনৈতিক ক্ষমতায় রূপান্তর ঘটানো।

কিন্তু এর মানে আমাদের আছে পুরাপুরি স্পষ্ট নয়। প্রথমত এই অনুমান মূলত বিপ্লবের পদ্ধতি বা উপায় সংক্রান্ত। বিপ্লবের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এতে পরিষ্কার হয় না। রাজনীতির দিক থেকে সমাজের গুণগত রূপান্তরের জন্য সহিংস ভাবে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা এবং রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটানো দরকার হয় কেন? বিপ্লব কি স্রেফ ক্ষমতার হাত বদল? তাছাড়া যারা বিপ্লবে ভূমিকা রাখেন তাদের কর্তাভূমিকা বাদ দিলে বৈপ্লবিক রূপান্তর কি কোন নৈর্ব্যক্তিক অনিবার্য তাগিদের কারনে ঘটে, নাকি ইচ্ছা করলেই সহিংস রাজনৈতিক পন্থায় ‘বিপ্লব’ ঘটানো যায়। ‘বিপ্লব’ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণার মধ্যে এই জিজ্ঞাসার পরিচ্ছন্ন উত্তর নাই। তাই বিপ্লবের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক বা উৎপাদন সম্পর্ক ঠিক কী আমরা তা বুঝি না। যেমন, বলপ্রয়োগ বা রাজনৈতিক-সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক বিপ্লব করলেই কি উৎপাদন সম্পর্ক আপনা আপনি বদলে যায়? বোঝার সুবিধার জন্য প্রশ্নটি আরও সহজ ভাবে তোলা যায়; যেমন, কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় গেলেই কি উৎপাদন সম্পর্কে রূপান্তর ঘটানো সম্ভব? অর্থাৎ পুঁজিতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটে যায়?

প্রশ্নটি উলটা দিক থেকেও তোলা যায়। এটা কি ঠিক যে উৎপাদন সম্পর্কের একটি পর্যায়ে বিরোধ বা দ্বন্দ অনিবার্য ভাবেই বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পরিবর্তন অনিবার্য করে তোলে? ব্যবহারিক রাজনীতির জন্য প্রাচীন বামপন্থা এই জিজ্ঞাসাকে দুটো ভাগে ভাগ করে আলোচনা করে। একটি হচ্ছে বিপ্লবের বাস্তব পরিস্থিতি যা নৈর্ব্যক্তিক অবস্থা (Objective Condition) নামে পরিচিত। অপর দিক হচ্ছে রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক শক্তির বাস্তবতা (Subjective Condition) অর্থাৎ বৈপ্লবিক কর্তাশক্তির অবস্থা।

আমাদের চিন্তা, বাসনা, সংকল্প ইত্যাদি বা এক কথায় সংস্কৃতির সঙ্গে বিপ্লবী আকাংখার সম্বন্ধ বিচারও জরুরি বিষয়। বিপ্লবের ধারণার মধ্যে এই অনুমানও কাজ করে যে বিপ্লব আপনা আপনি ঘটে না, এটা ঘটাতে হয়। তাহলে বিপ্লবের কর্তা কিভাবে তৈরি হয় এবং সংস্কৃতি সেই ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখে সেটাও একটি জরুরি প্রশ্ন। এইসকল কঠিন জিজ্ঞাসার মীমাংসা না করে আমরা যখন বিপ্লবের হাঁকডাক করি তখন তা ‘ক্লিশে’ – অর্থাৎ বহু ব্যবহারে জীর্ণ মনে হয়।

আমি নিজেও বিভিন্ন সময় সেই ক্লিশের ফাঁদে স্বেচ্ছায় পা দিয়েছি। ব্যবহার করেছি। এখনও করি। বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের বাসনা বা ইচ্ছা প্রকাশ করবার জন্য এটা বেশ যুৎসই শব্দ। যে বিষয় নিয়ে লিখি এবং যা বোঝাতে চাই তার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন এই ব্যবহারে মেটে। কিন্তু চিন্তার বর্গ হিশাবে 'বিপ্লব' নানান অনুমান ধারণ করে। সেই অনুমানগুলো আমলে নিয়ে চিন্তার বর্গ হিশাবে 'বিপ্লব' শব্দটির একটা ব্যবচ্ছেদ জরুরি। কাঁটাছেঁড়া করে শব্দটি না বুঝলে 'রূপান্তর' বা 'আমুল পরিবর্তন' বলতে আমরা আসলে কী বুঝি বা কী ধরণের রূপান্তর বা পরিবর্তন ইঙ্গিত করি সেটা যারপরনাই অস্পষ্ট এবং ধোঁয়াটে থেকে যায়। ‘বিপ্লব’, ‘বৈপ্লবিক’, ‘বৈপ্লবিকতা’ ইত্যাদি শব্দও সে কারণে বাগাড়ম্বর হয়ে পড়ে।

কেউ যখন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই বলার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থাকে। সেই ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন বলতে সুনির্দিষ্ট ভাবে কি চাওয়া হচ্ছে তার দ্বারা কী ধরণের রূপান্তর কাম্য পরিষ্কার বোঝা দরকার। বোঝা না গেলে ক্লিশে পরিভাষার ব্যবহার নিছকই কথার কথা ছাড়া অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে না। বিদ্যমান অবস্থা কারো কাছে অসহ্য মনে হলে একদিন তার খোলনলচে বদলে ফেলার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতেই পারে। সেটা বাস্তব দুর্দশার প্রতি মানুষের সাধারণ প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সমাজ বদলের ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি এবং বিশেষ ভাবে ক্ষমতা বা বলপ্রয়োগের দার্শনিক বিচার ছাড়া একালে ‘বিপ্লব’ কথাটার সুনির্দিষ্ট মানে দাঁড় করানো খুবই কঠিন। এই সকল বিষয়ে আমাদের সমাজে মনোযোগ, গবেষণা ও বিশ্লেষণ নাই বললেই চলে।

এই লেখার উদ্দেশ্য সরল। শব্দ ও ধারণা হিশাবে 'বিপ্লব' নিয়ে ভাবাভাবি শুরু করা। বিস্তর ভাবাভাবির দরকার আছে এই প্রাথমিক কথাটা বোঝানো। পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এখানে অসম্ভব কারন নিদেন পক্ষে বিপ্লবের সঙ্গে আরও পাঁচটি ধারণা অঙ্গাঙ্গী জড়িত। যেমন: সময়, ইতিহাস, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি। বিপ্লব হঠাৎ ঘটে, অতএব সময় সম্পর্কে সরলরৈখিক ধারণা মাথায় রেখে ‘বিপ্লব’ বোঝা যায় কিনা একালে সেই সন্দেহ গাঢ় হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ইতিহাসের ধারণা। ইতিহাসের কোন উল্লম্ফন নাই; পূর্ব নির্ধারিত এক অমোঘ উদ্দেশ্যের দিকে ইতিহাস ছুটে চলেছে। এই ধারণার মধ্যে আকস্মিক পরিবর্তন বা বৈপ্লবিক রূপান্তরের ধারণা মেলানো কঠিন।

বিপ্লবের ব্যবচ্ছেদে নামলে ধর্মের প্রশ্নও এসে যায়। কারণ বিপ্লবের সঙ্গে ‘মুক্তি’র ধারণা জড়াজড়ি করে থাকে। তাই তর্ক ওঠে ‘বিপ্লব’ মূলত ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা। একদিন ইমাম মেহেদি আসবেন এবং শেষ বিচারের আগে মানুষের মুক্তি ঘটবে। দুষ্ট শাস্তি পাবে এবং ভালো মানুষেরা পুরষ্কৃত হবে। এই দিকগুলো নিয়ে এখানে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করবো না। বরং আলোচনার প্রয়োজনীয়তা ধরিয়ে দেওয়াই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

বলাবাহুল্য ‘বিপ্লব’ একটি ক্লিশে শব্দ। কিন্তু ক্লিশে শব্দ ব্যবহারের বিপদ রয়েছে। যে বিষয় নিয়ে সাধারণত আমরা লেখালিখি করি সেই পরিপ্রেক্ষিতে 'বিপ্লব' কথাটির একটি মানে দাঁড়ালেও বোঝাবুঝির ঘোরতর অভাব থেকে যায়। সে কারনে 'বিপ্লব' বাংলা ভাষায় একটি জীর্ণ শব্দ। একালে, বিশেষত বর্তমান বাংলাদেশে, নতুন ধরনের সমাজ পরিগঠনের বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা সঞ্চার কিম্বা রাজনৈতিক শর্ত এই শব্দ দ্বারা তৈরি আদৌ সম্ভব কিনা সেটা এক বিরাট জিজ্ঞাসা হয়ে উঠেছে।

তারপরও বলা যায়, ফরাসি বিপ্লব এবং বলশেভিক বিপ্লব ইত্যাদির কেচ্ছা কাহিনী বয়ানের মধ্য দিয়ে 'বিপ্লব' কথাটির একটা অনুমান-নির্ভর লোকভাষ্য তৈরি করেছে। বিপ্লবের বাস্তব ঘটনাঘটন ও পর্যালোচনার চেয়েও একটা রক্তারক্তি তুলকালাম কাণ্ড ঘটানোর প্রতি রোমান্টিক আবেগ এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাব কাজ করেছে। বলশেভিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা 'বিপ্লব'-এর ধারণা অনেকটা জাতীয় টাঁকশালে ছাপা টাকার মতো কাজ করে। টাঁকশালের ছাপ টাকাকে বৈধ বিনিময়ের মাধ্যম হিশাবে চালু রাখে। তেমনি 'বিপ্লব' বলশেভিক বিপ্লবের ছাপ বহন করে বলে শব্দটিকে অর্থপূর্ণ মনে হয়। জাতীয় টাঁকশাল থেকে ছাপা টাকা সবসময়ই বৈধ। ছেঁড়া টাকাও বিনিময়ের বৈধ মাধ্যম; বিপ্লবের পুরানা কেচ্ছার গীত গেয়ে এখনও আমরা কাজ চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু বাজারে পুরানা ছেঁড়া টাকা চলে না, কেনাবেচা কঠিন হয়ে পড়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর ‘বিপ্লব’ কথাটিরও হয়েছে সেই দশা।

ক্লিশে শব্দ ব্যবহারের আরও বিপদ আছে। ফরাসি বিপ্লবের কারণে এই অনুমান প্রবল যে বিপ্লব বুঝি একান্তই ইউরোপীয় ব্যাপার। ফলে ক্ষমতার যে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে বুঝি ইউরোপীয় ইতিহাসের আলোকেই আমাদের বিচার করতে হবে। এই অনুমানের কারনে ইরানের বিপ্লবকে বিপ্লব মেনে নিতে ইতঃস্তত করা হয়। কিম্বা ইরানের বিপ্লবের সামনে ‘ইসলামী’ কথাটা বসিয়ে তাকে বিশেষ বৈশিষ্ট দেবার দায় আমরা বোধ করি। সেটা ্কেউ করে সদর্থে, কেউ করে কেউ ইরানের বিপ্লবকে নাকচ বা নেতিবাচক মূল্যায়নের জন্য। অনুমান হচ্ছে ইউরোপের মত না হয়ে ভিন্ন কিছু হলে সেটা বুঝি খারাপ কিছু হোল।

বিপ্লব নিয়ে নতুন করে ভাববার আরও যুক্তি আছে। সমাজে বিভিন্ন জনের পারস্পরিক চিন্তার বিনিময়ের জন্য কিছু উপযুক্ত ভাষা-পরিভাষার দরকার আছে, চিন্তার টাঁকশাল থেকেই তাদের উৎপত্তি। কিন্তু অতি ব্যবহারে সেটা যখন জীর্ণ হয়, তখন ভাবের বিনিময় ও চিন্তার বিকাশ বাধা পায়। যার সঙ্গে ভাবের বিনিময় ঘটাতে চাই তিনি শব্দটির অন্তর্গত মর্ম বিশেষ কবুল করতে রাজি হন না। সেই ক্ষেত্রে ভাষা ও পরিভাষার মধ্যেও বদল আনা জরুরি হয়ে পড়ে। নতুন পরিভাষার দরকার হয়, কিম্বা ছেঁড়া টাকা টাঁকশাল থেকে বদলিয়ে ঝকঝকে নতুন ছাপা টাকা নিয়ে চিন্তার বাজারে কেনাবেচায় নামতে হয়। ক্লিশে পরিভাষাগুলোর হয়েছে সেই দশা। যদি নতুন শব্দ না থাকে কিম্বা ভাষায় নতুন ধারণা ও অর্থ জ্ঞাপনে সক্ষম নতুন কিছু বানাবার হিম্মত আমরা অর্জন না করি, তাহলে পুরানা শব্দ ব্যবহার ছাড়া গতি থাকে না। ‘বিপ্লব’ শব্দটি এমনই শব্দ যা বাংলাদেশের দুই টাকা নোটের মতো। কাজে আকামে কোথাও কোথাও চালিয়ে দিলেও, চিন্তা বা ভাবের গভীর ও বিস্তৃত বিনিময়ে এখন খুব একটা কাজে আসে না।

পরিভাষা গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যখন ব্যবহার করে তখন ব্যবহারকারীর আকাংখার দিকটা হয়তো কিছুটা বোঝা যায়, কিন্তু চিন্তার চর্চা হিশাবে তার বিশেষ গুরুত্ব থাকে না।। পরিভাষার আবেদন জীর্ণ হয়ে গেলে এর সংস্কার কিম্বা নতুন পরিভাষা নিয়ে ভাবা দরকার আছে। রোমান্টিক ভাবাবেশে ‘বিপ্লব’ শব্দটি ধরে রাখতে গিয়ে পুরানা চিন্তা আঁকড়ে ধরে রাখা ঠিক না। বরং দরকার পরিভাষার আড়লে বদ্ধমূল ধ্যানধারণার কঠোর ও নির্মোহ পর্যালোচনার। পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র, আইন, ক্ষমতা ইত্যাদি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ইতোমধ্যে দেশে বিদেশে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে। আমরা তা আত্মস্থ করি নি এবং আন্তর্জাতিক চিন্তায় নিজেদের অবদানের কথাও ভাবি না। সেটা ঠিক না। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনী, রাষ্ট্রিক, আইনী সম্পর্ক রূপান্তর বা পরিবর্তন নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তাভাবনার দরকার আছে।

রাজনৈতিক দিক থেকে ক্ষমতার বিচার এখন পর্যালোচনার গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। ক্ষমতার বিচারও আর রাষ্ট্রকেন্দ্রিক চিন্তা দ্বারা যথেষ্ট বলে বিবেচিত নয়। 'বিপ্লব' কথাটির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয় নতুন ভাবে পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। নতুন নতুন প্রশ্নও উঠছে। পুরানা ভুল ও ব্যর্থতা নিষ্ঠার সঙ্গে পর্যালোচনার তাগিদ বেড়েছে। সামগ্রিক ভাবে বিচার করলে চিন্তার বর্গ হিশাবে 'বিপ্লব' একালের নতুন নতুন জিজ্ঞাসা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এই দিকটি ধরিয়ে দিতেই এই লেখা।

‘বিপ্লব’ অনুবাদিত শব্দ

বাংলায় বিপ্লব কথাটা আর দশটা পরিভাষার মতো পাশ্চাত্যের ‘রেভলিউশান’-এর অনুবাদ হিসাবেই এসেছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’ বইতে ‘প্লব’ কথাটার মানে হচ্ছে ‘লম্ফ দিয়া গমন করা’, ‘লম্ফন’, যে লম্ফ দিয়া চলে, যেমন ব্যাঙ, বানর, শশক বা খরগোশ; আরও রয়েছে যার দ্বারা ‘প্লাবন’ করা বা ‘পরপারে যাওয়া’ যায়, যেমন ভেলা। ‘প্লব’ লম্ফ দেয় সামনের দিকে, আর ‘বিপ্লব’ কথাটার মানে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধান অনুযায়ী ‘বিপরীত দিকে গমন করা’ (দাস, ১৯৮৮ -পুনর্মূদ্রণ) । অর্থাৎ উলটা লাফ দেওয়া। ফলে এর প্রাথমিক অর্থ ‘আপদ’, ‘বিপদ’ ইত্যাদি। যদিও বিপ্লব অর্থে ‘বিদ্রোহ’ এবং ইংরেজিতে Revolution শব্দটিও জ্ঞানেদ্রমোহন অভিধানভূক্ত করেছেন, কিন্তু সংস্কৃত ভাষা থেকে তৈরি এই শব্দটির মুল অর্থ বিপরীত দিকে ব্যাঙ, বানর বা খরগোশের মতো লাফ দেওয়া।

হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ ‘প্লব’-এর অর্থ প্রধানত ‘লম্ফন’ নির্দেশ করেছেন। ফলে তিনিও ‘প্লব’ অর্থ ব্যাঙ, বানর, ‘ক্রৌঞ্চাদি জলচর পক্ষী’ বা বক জাতীয় পাখি বলে নির্দেশ করেছেন (বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৯৬৭)। বিপ্লবের মানে তাহলে বিপরীত দিকে লাফানো, উলটা দিকে লাফিয়ে যাওয়া।

দর্শনের দিক থেকে বিপরীত দিকে লাফ দেওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত। পাশ্চাত্য যদি বিপ্লব বলতে সামনে যাওয়া বোঝে, অতীতের সঙ্গে আমূল ছেদের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে প্রাচ্য কি বিপরীত দিকে লাফ দেওয়া বলতে কী বোঝাতে চায়। জাগতিকতার যে উপলব্ধি আমরা বর্তমানে হারিয়ে ফেলেছি তার পুনরুদ্ধার? জীবন ও জগতের প্রাথমিক সম্বন্ধ, বা মার্কসের ভাষায় যাকে আমরা উৎপাদন সম্পর্ক বলে জানি, সেই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আমরা বর্তমান হই। বর্তমান হওয়ার অর্থ সেই জীবন্ত সম্পর্কের ওপর দাঁড়ানো বা টিকে থকা। প্রাচ্যে বিপ্লবে ধারণা কি সেই গোড়ার সম্পর্ক – জাগতিকতা বা বর্তমান থাকার যা প্রাথমিক শর্ত – তাকে নতুন করে উপলব্ধি এবং জগতের পুননির্মাণ? পাশ্চাত্য বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করে চায়, প্রাচ্য কি তাহলে পুরাতনকে নতুন করে আবিষ্কার করাকেই বিপ্লব বা বিপরীত দিকে লাফ দেওয়া বোঝায়? এই প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব বোঝার জন্য প্রাচ্য/পাশ্চাত্যের বাইনারি অনাবশ্যক। বরং নতুন ভাবা ও জাগতিকতা নির্মাণের সূত্র হিশাবে কথাগুলো বলে রাখলাম।

বলাবাহুল্য বিপরীত দিকে লাফ দেওয়া অর্থে আমরা এখন ‘বিপ্লব’ বুঝি না। একে ইংরেজি Revolution-এর অনুবাদ হিসাবে ব্যবহার করতে করতে এখন আমরা বাংলা ভাষার ভেতরে নিয়ে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, বিপরীত দিকে লাফ দেওয়া, নিজের অতীত, ঐতিহ্য ও সনাতন চিন্তা ও সংস্কৃতির ইতিহাসের মধ্যে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার ও পুনর্নিমানকে আমরা প্রতিক্রিয়াশীল গণ্য করি। প্রগতির বিপরীতে বিপরীত গতি বা প্রতিক্রিয়াশীলতা আমরা চাই না।

দেখা যাচ্ছে বাংলায় 'বিপ্লব' আদতে বাংলা না। এই অর্থে যে এটা তৈরি শব্দ। ‘রেভলিউশান’-এর অনুবাদ করবার দরকারে সংস্কৃত থেকে বানানো। শব্দটা মূলত ল্যাটিন থেকে আসা: revolutio; অর্থ হচ্ছে, ঘোরা, ঘূর্ণন, আবর্তন, আবর্তিত হওয়া, ইত্যাদি। রেভলিউশান বলতে আমরা এখন যা বুঝি সেটা একদমই না। ঘোরা কিম্বা ঘূর্ণন অর্থ বৃত্তাকারে বা চক্রাকারে ঘোরা। সংস্কৃতে এর জন্য আলাদা শব্দ আছে: ‘ক্রান্তি’। কিন্তু আধুনিক কালে ‘রেভলিউশান’-এর আধুনিক মানে ধরবার ক্ষেত্রে বাংলায় ‘ক্রান্তি’ খুব উপযুক্ত মনে হয় নি। নতুন শব্দ ‘বিপ্লব’ বানাতে হয়েছে।

পাশ্চাত্যে 'বিপ্লব' বলতে এখন নিশ্চয়ই আবর্তন, ঘূর্ণন বা ঘোরা বোঝায় না। অর্থের এই বদল বা রূপান্তর ঘটল কিভাবে? ত্রয়োদশ শতক থেকে ফরাসি ভাষায় 'revolucion' কথাটির চল ছিল। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে গ্রহনক্ষত্রের আবর্তন বা ঘোরা অর্থে ইংরেজিতে 'Revolution' কথাটিরও ব্যবহার ছিল। সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার আকস্মিক বদল বা রূপান্তর অর্থে 'রেভলিউশান' কথাটির ব্যবহার অনেক পরের ঘটনা। অন্তত ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই ব্যবহার দেখা যায় না। রাজা তৃতীয় জেমসকে সরিয়ে তৃতীয় উইলিয়ামকে ক্ষমতায় বসাবার মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন ঘটেছিল তার ব্যাখ্যা হিশাবে 'গ্লোরিয়াস রেভলিউশান' কথাটার ব্যবহার শুরু হয়। বাস্তব পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তন হিশাবে শব্দটির ব্যবহার তাহলে ১৬৮৮ সালের দিক থেকে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। বাংলা ‘বিপ্লব’-এর ধারণা গ্রহ নক্ষত্রের আবর্ত বা ঘূর্ণনের সঙ্গে যুক্ত নয়। ফলে অনুবাদিত হলেও পাশ্চাত্য ‘রেভলিউশান’-এর ভাব ‘বিপ্লব ধারণ করেছে বলা যায় না।

‘বিপ্লব’ ইংরেজি ‘রেভলিউশান’-এর অনুবাদ হলেও একে স্রেফ অনুবাদ ভাবা ঠিক না। কারণ অনুবাদের ঘাড়ে চড়ে ঘটনা ও ইতিহাস সম্পর্কে অনেক অনুমান আমাদের চিন্তায় ও মননে গভীর ভাবে পোঁতা হয়ে গিয়েছে, যা থেকে মুক্ত হওয়া ও নিজেকে মুক্ত রাখা কঠিন কাজ। যেমন, আমরা ধরে নেই যে পাশ্চাত্যের ঘটনাবলীর মধ্য দিয়েই সর্বজনীন মানবেতিহাস রচিত হয়ে চলেছে। যেমন, ফরাসী বিপ্লব। আমাদেরকেও অতএব এই সর্বজনীন ঘটনা আবার ঘটিয়ে সর্বজনীন মানুষের ইতিহাসে প্রবেশ করতে হবে। অর্থাৎ আমাদেরও ইউরোপের মতোই একটা ‘বিপ্লব’ ঘটাতে হবে। ইউরোপ যা হয়েছে, আমাদেরও তাই হতে হবে। প্রগতির ইতিহাসের মানদণ্ড অনুযায়ী 'সভ্য' হবার এটাই একমাত্র তরিকা; এর বাইরে থাকার অর্থ ইতিহাসহীন 'উদ্ভিদমার্কা জীবন' বা স্রেফ প্রকৃতি হয়ে থাকা।

ইউরোপের অনুকরণ এবং ইউরোপের ইতিহাস যে পথে গিয়েছে সেই পথেই আমাদের যেতে হবে এই বিশ্বাস আমাদের মধ্যে কতোটা বদ্ধমূল ও গভীর সেটা আমরা বুঝব যদি ইরানের বিপ্লব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ‘বিপ্লব’ই যদি কাম্য হয় তাহলে ১৯৭৯ সাল – অর্থাৎ অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ইরানের বিপ্লব কাম্য নয় কেন? কেন শুধু ফরাসি বিপ্লব? ইরানের বিপ্লব সুনির্দিষ্ট ভাবে পাহলভি রাজবংশ এবং মার্কিন সমর্থন পুষ্ট রেজা শাহ পাহলভির রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরানা ইরানি রাজতন্ত্রের কবর দিয়ে ইরানি জনগণ নতুন যে রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল তাকে তারা নাম দিয়েছিল ‘ইসলামি বিপ্লব’। উভয়ের তুলনা, ঐতিহাসিক পেক্ষাপটের পার্থক্য এবং ভালমন্দ বিচার ছাড়া আমরা বলতে পারি না আমরা শুধু গ্রিক-খ্রিস্টিয় সভ্যতার মধ্যে তৈয়ারি ইউরোপের বিপ্লব চাই, কিন্তু ইরানি বিপ্লব চাই না। চার্চ এবং মসজিদের সঙ্গে শাসক ও শোষক শ্রেণির সম্পর্ক গ্রিক-খ্রিস্টিয় সমাজ ও ইসলামি সমাজে আলাদা। সম্পর্কের এই পার্থক্য বোঝা জরুরি। ইতিহাসের প্রতিটি বৈপ্লবিক ঘটনার পর্যালোচনা এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা যাচাই করে ‘বিপ্লব’ অর্থে কি কাম্য আর কি কাম্য নয় তা আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। বলাবাহুল্য তার মধ্যে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, মাও জে দং-এর নেতৃত্বে চিনের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ (১৯৪৫-৪৯) এবং ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রতিষ্ঠা, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর জুলাই আন্দোলন এবং কিউবার বিপ্লব (১৯৫৯) – ইত্যাদি প্রতিটি রাজনৈতিক বিপ্লবের পর্যালোচনা ছাড়া ‘বিপ্লব’ কথাটার কোন সর্বজনীন মর্ম আমরা উদ্ধার করতে পারব না। ‘সর্বজনীন’ কথাটার অর্থ এখানে কোন বিমূর্ত মনগড়া ধারণা নয়, বিভিন্ন বিপ্লবী অভিজ্ঞতার একটি সাধারণ সারসংকলন।

ইউরোপীয় ইতিহাস বা সভ্যতা মানেই মন্দ এটা ঠিক না। প্রশ্ন হচ্ছে সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হলে তা পর্যালোচনারপদ্ধতি আবিষ্কার করা চাই। সেটা ইউরোপকে নকল করে হবে না। কিম্বা আমরা ইউরোপ হবো না, অতএব ইউরোপের বাইরে আমাদের নিজেদের বিশুদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে – এই প্রকার কাল্পনিক ও আজগবি কল্পনাও আমাদের খুব একটা সহায়ক হবে না। আসলে ইতিহাস পর্যালোচনা এবং কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের শিক্ষা আত্মস্থ করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নাই। পর্যালোচনার শক্তিই আমাদের বলে দেবে, বিশেষ দেশে এবং বিশেষ কালে কি আমরা গ্রহণ করব, আর কি পরিহার করব।

‘জগত’ ও ‘বিপ্লব’

আমরা ভাষা বা পরিভাষা দিয়ে আলোচনা শুরু করেছি, কারণ ভাষার মধ্যে বাস করেই আমরা বাস্তব জগত ও ইতিহাস উপলব্ধি করি, জানি ও পর্যালোচনা করি। 'জগত' ধারণাটি 'গম্‌' ধাতু থেকে তৈরি: যা গতিশীল তাই জগত। তো গতিশীলতার হেন ধারণা আমাদের ভাষা, চিন্তা ও মননে যদি থেকে থাকে তাহলে আমরা তো নিত্য এই গতিশীলতার মধ্যে বর্তমান হই। অথচ শুধু পাশ্চাত্যই যদি 'ইতিহাস' হয় তো তারই বিপরীতে প্রাচ্যকে ভাবা হোল স্থির ও অনড় সমাজ হিসাবে। 'বিপ্লব' নামক বিপ্লবী শব্দ বা ধারণা আমদানি করেও আমরা রক্ষা পেয়েছি বলা যাবে না। 'রেভলিউশন'কে অনুবাদ করে আমদানি করায় এই তর্কগুলো তৈরি হয়ে আছে। আজ অবধি মীমাংসা হয় নি। নিজেদের সমাজের পরিপ্রক্ষিতে আমাদের সুনির্দিষ্ট সমস্যার দিকে আমরা ফিরেও তাকাই নি। আমরাও বিশ্বাস করেছি, প্রাচ্য স্থির, নিশ্চেতন ও ইতিহাস বঞ্চিত। নিশ্চল ও গতিহীন; পাশ্চাত্যের বাইরে প্রাচ্যের নিজের কোন পথ গড়ে উঠবার কোন সম্ভাবনা অতীতে ছিল না, এখনও নাই। প্রাচ্যের কর্তব্য অতএব ইউরোপকে অনুকরণ করা। ফরাসি বিপ্লবের মতো একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসে প্রবেশ করা। ইরান যখন একটি ভিন্ন ধরনের 'বিপ্লব' ঘটিয়ে ফেলল, অনেকে তা মেনে নিতে পারছে না। খ্রিস্টিয় সমাজের সুনির্দিষ্ট সমাধানের জন্য ফরাসী বিপ্লব একটি ইউরোপীয় প্রয়াস। তেমনি একটি ইসলামি সমাজের সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য ইরানের বিপবও দারুন গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে ইরানের জনগণ শুধু পাহলভি রাজবংশ ও রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটায় নি, একই সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। কিন্তু ইরানের বিপ্লব তার আগে ঘটে যাওয়া সকল বিপ্লবের সারার্থ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বাস্তবে যে ভূমিকা রেখেছে মানবেতিহাস পর্যালোচনার জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তুআমরা তা মানতে চাই না। বরং তাকে বিপ্লবের ইতিহাসে গৌণ ঘটনা হিসাবে গণ্য করি। বিশেষণ জুড়ে দিয়ে বলি, 'ইসলামি বিপ্লব'। এমনকি আরও বিশেষায়িত করে বলি শিয়াদের বিপ্লব।

বিপ্লব সম্পর্কে নির্বিচার অনুমান ও পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক চিন্তা আমাদের বাদ দিতে হবে। পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব সোভিয়েত রাশিয়া বিপ্লবের ওপর রুশীয় অভিজ্ঞতার ছাপ মেরেছে, যা ইউরোপের মতো নয়। তেমনি কিউবা ল্যাটিন এবং চিন চৈনিক অভিজ্ঞতার ছাপ মেরেছে। ইরান ইরানি অভিজ্ঞতার ছাপ মারার মধ্য দিয়ে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছে রাজনৈতিক বিপ্লব সফল করবার ক্ষেত্রে ইসলাম এ কালে গুরুত্বপূর্ণ মতাদর্শ।

ইউরোপীয় বিপ্লবকে মানদণ্ড ধরে বলা হয় আধুনিক সমাজের গতিশীলতা, দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ছিল না। সমাজ একদমই নিশ্চল ছিল কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ, তবে আধুনিক সমাজের তুলনায় অনেক নিস্তরঙ্গ ছিল। প্রাচ্যের জাতপাত ও আভিজাত্যের সুস্পষ্ট পার্থক্যে বিভক্ত নিশ্চল সমাজকে কার্ল মার্কস নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্র’ (Oriental Despotism); জীবন ছিল নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া উদ্যমহীন ব্যাঙের ছাতা, মার্কসের ভাষায় ‘মর্যাদাহীন, আটকে পড়ে থাকা উদ্ভিদমার্কা জীবন ( undignified, stagnatory, and vegetative life’ that this passive sort of existence)। এই নিস্তরঙ্গ সমাজে ‘বিপ্লব’-এর কোন ধারনা ও পরিভাষা গড়ে ওঠা অসম্ভবই বলা যায়। ফলে পাশ্চাত্যের ‘রেভলিউশান’ অনুবাদ করে আমরা ‘বিপ্লব’ বানিয়েছি; কেন তা করতে হয়েছে নিশ্চল সমাজ তার একটি কারন হতে পারে। বিপ্লব সম্পর্কে আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নাই বললেই চলে। একটা রোমান্টিক ধারনা হিসাবে এর আমদানি হয়েছে।

রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র

রাজনৈতিক পরিভাষা হিসাবে রেভলিউশানের বাংলা অনুবাদ ‘বিপ্লব’-এর মধ্যে ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯-৯৯) বৈপ্লবিকতা ধারণের চেষ্টা আছে। ইউরোপে গির্জা, পুরোহিত ও সামন্ত শ্রেণির একচ্ছত্র ক্ষমতা সাধারণ জনগণ সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক থেকে উৎখাত করে; এরই চূড়ান্ত পরিণতিতে প্রাচিন রাজতন্ত্র (Monarchy) জনসাধারনতন্ত্রে (Republic) রূপ নেয়। পার্থক্য থাকলেও ‘রিপাবলিক’ বা জনসাধারণতন্ত্রকে আমরা সাধারণত ‘গণতন্ত্র’ বলেই গণ্য করি। মনে করি, ইংলণ্ড ও ইউরোপের আধুনিক সাংবিধানিক রাজতন্ত্রও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটি রূপ। তাদের সাধারন মিল থাকলেও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে আমরা মনোযোগী থাকি না।

ইংলণ্ড নিজেকে ‘ইউনাইটেড কিংডম’ বা রাজাদের ‘যুক্তরাজ্য’ বলে। কিন্তু একে আমরা সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য করি। ফরাসি বিপ্লবের আগে ইংলণ্ডে সাধারণ জনগণের বিপ্লব ঘটেছে ১৮৮৮ সালে। রাজা বা রানির রাজকীয় ক্ষমতা ইংলণ্ডে বিল অব রাইটস ১৬৮৯ এবং এক্টস অফ সেটেলমেন্ট ১৭০১ দ্বারা সীমিত। তাই ইংলণ্ডকে সীমিত রাজতন্ত্রও বলা যায়। রাজা বা রাণীর ক্ষমতা সীমিত করার ইতিহাস অবশ্য আরও অতীতে, ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টায়। বিপ্লবে সাধারণ জনগণের বৈপ্লবিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় সংবিধান ও আইনে রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (Constitution) হিসাবে রূপ নেয়। গঠনতন্ত্র ‘ইংলিশম্যান’কে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দান করে।মৌলিক অধিকার স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র নিজের সার্বভৌম ক্ষমতার সীমা কবুল করে নেওয়া । জনগণের নাগরিক ও মানবিক অধিকার রাষ্ট্র ক্ষুণ্ণ করবে না এই প্রতিশ্রুতির ওপর রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্বন্ধ তৈরি করা।

আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্ম বা গির্জার সম্পর্ক নিয়েও বাংলাদেশে বিস্তর বিভ্রান্তি আছে। ইংলণ্ডে চার্চ অফ ইংলণ্ডকে বলা হয় ‘প্রতিষ্ঠিত গির্জা’ (Established Church), রাষ্ট্রের মধ্যেই তার প্রতিষ্ঠা। এখানে ধর্ম রাষ্ট্র থেকে আলাদা বলার সুযোগ নাই, কারন আইনের চোখে গির্জা রাষ্ট্রের বাইরে নিছক সামাজিক বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। পার্লামেন্টে বিশপ গির্জার প্রতিনিধিত্ব করেন। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিখিত গঠনতন্ত্রের প্রথম সংশোধনীতে পরিষ্কার উল্লেখ করা রয়েছে যে “কংগ্রেস ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য কোন আইন করবে না, কিংবা স্বাধীন ভাবে ধর্ম পালনে কাউকে বাধাও দেবে না...’, ইত্যাদি। মার্কিন আদালত একে সাধারণত ব্যাখ্যা করে এভাবে যে সকল সরকারী কর্মকাণ্ডে, স্কুলে বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্র ধর্মকে আলাদা রাখবে কিম্বা ধর্ম থেকে বিযুক্ত থাকবে, কিন্তু একই সঙ্গে সমাজে ধর্ম চর্চার স্বাধীনতাও রাষ্ট্র নিশ্চিত করে। অন্যান্য আধুনিক সেকুলার রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্র ও ধর্মের বিযুক্তির ব্যপারে এতো কড়া নয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ধর্মীয় চরিত্রের দিক থেকে অতিশয় ধর্মীয় সমাজগুলোর অন্যতম।

সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক বিপ্লব বা গণতান্ত্রিক বিপ্লব

এই ঐতিহাসিক পার্থক্যগুলো মনে রেখে বিপ্লব সম্পর্কে ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা কিছু বিষয় সতর্কতার সঙ্গে আলোচনা করতে পারি। যদিও সেটাও খুব সহজ নয়। কারন সেই ক্ষেত্রে অনেক নির্বিচার অনুমান প্রশ্ন করেই আমাদের চিন্তা পরিচ্ছন্ন করা দরকার হয়ে পড়ে।

যেমন, 'জনগণ'। জনগন মানে একাট্টা একপ্রকার জনগোষ্ঠি না। জাত, শ্রেণি, লিঙ্গ, আচার, ব্যবহার, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানান ভাবে জনগণ বিভক্ত। তারপরও ‘জনগণ’ কিভাবে একটি ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি’ হয়ে ওঠে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। 'জনগন' কথাটিকে ইউরোপীয় সমাজ ও বিপ্লবের আলোকে যদি আমরা বোঝার চেষ্টা করি তাহলে সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক বিপ্লব বা গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলতে বোঝায়: সামন্ততন্ত্র বা প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক ক্ষমতা সম্পর্কের খোলনলচে বদলে দেওয়া, এর বিশেষ অর্থ হচ্ছে সামন্তশ্রেণি ও রাজরাজড়ার বিপরীতে ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র দাবি নিয়ে ‘বিজয়ী জনগণ’-এর ঐতিহাসিক আবির্ভাব। ‘জনগণ’ তাহলে নিছকই একটি অক্ষর বা শব্দ নয়, ইউরোপীয় ইতিহাসের দিক থেকেই যদি ‘জনগন’ বুঝতে চাই তাহলে এটাও মানতে হবে ‘জনগণ’ ইউরোপীয় ইতিহাসে গির্জার ক্ষমতা ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বিজয়ী গণ অভ্যূথানের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে হাজির হয়েছে। ‘জনগণ’ একটি রাজনৈতিক পরিভাষা, স্রেফ কিছু লোকের সমষ্টি নয়। একে আক্ষরিক ভাবে বোঝার সুযোগ নাই।

তাহলে ‘বিপ্লব’ কথাটা বুঝতে হলে জনগণের ঐতিহাসিক আবির্ভাব কথাটিকে ঐতিহাসিক ভাবেই বুঝতে হবে। ইউরোপের ইতিহাসকে ‘সর্বজনীন মানবেতিহাস’ হিসাবে আমরা যদি তর্কের খাতিরে মানি তাহলে এটাও মানতে হবে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ‘জনগণ’-এর আবির্ভাব ঘটেছে। অর্থাৎ ‘জঙ্গণ’ কথাতার একটা রাজনৈতিক মানে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজিতে ‘উই দ্য পিপল’ কথাটা একদিকে রাজনৈতিক ইতিহাস ও জনগণের লড়াই সংগ্রামের প্রেক্ষাপট যেমন নির্দেশ করে, একই ভাবে জনগণের ঐতিহাসিক বিজয়ও ধারণ করে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে রক্ত, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়, পরিচয় ইত্যাদি সকল প্রকার সামাজিক বৈচিত্র্যের উর্ধে নিজেদের একক ও অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে জনগণ হাজির করে। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সামাজিক বৈচিত্র ও পরিচয় মুখ্য নয় – হোক তা ধর্মীয়, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, কিম্বা অন্য কিছু। কারণ তা রাজনৈতিক ঐক্য ও অখণ্ডতার বিপরীত। অন্য দিকে সমাজে এই বৈচিত্র, পার্থক্য ও পরিচয় ভেদ আছে বলেই জনগণকে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখতে হয়। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে সামাজিক আর সামাজিক পরিমণ্ডলকে রাজনৈতিক ভাবা চলবে না। ‘উই দ্য পিল্পল’ বা ‘আমরা জনগণ’ এই বিশেষ ঘোষণা একান্তই রাজনৈতিক, যা স্রেফ সংবিধানের কয়েকটি হরফ নয়। অর্থাৎ ‘আমরা জনগণ’ এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বে জানান দিতে হয় যে রক্ত, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিচয় ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও পার্থক্য সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্রের ‘জনগণ’ রাজনৈতিক ভাবে এক ও অখণ্ড রাজনৈতিক সত্তা এবং বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি থেকে আলাদা। ‘উই দ্য পিপল...’ বলার অর্থ নিজেদের ঐক্য ও অখণ্ডতা বজায় ও রক্ষার জন্য একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের (Constitution) ভিত্তিতে ‘জনগণ’ একটি ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি’ হিশাবে নিজেদের আবির্ভাব ঘোষণা করছে এবং একটি মূর্ত রাষ্ট্রের রূপ ও অস্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে।

এই দিকটা যদি আমাদের কাছে স্পষ্ট থাকে তাহলে বিপ্লবের ইউরোপীয় অর্থ অনুযায়ী ইরানের ইসলামি বিপ্লব জনগণকে ধর্মের পরিচয় থেকে মুক্ত করতে পারে নি, এটাই ইরান বিপ্লব সম্পর্কে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান আপত্তি। তাতে অবশ্য ইরানি বিপ্লবের তাৎপর্য কোন অংশেই কমে যায় না। বরং আমাদের জানতে হবে ইরানে বিপ্লবের রূপ ‘ইসলামী’ হোল কেন? তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা কী ছিল? সামন্ত ইউরোপে গির্জা ও পুরোহিতের যে অবস্থান ও ভূমিকা এবং সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ ইরানে মসজিদের অবস্থান ও ভূমিকা এক ছিল না। কিন্তু যখন ইরানি বিপ্লবকে নাকচ করা হয়, তখ্ন ইউরোপীয় বিপ্লবের মানদণ্ডকেই আমরা বিপ্লবের একমাত্র মানদণ্ড বলে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে মানি। অথচ দরকার অবাস্তব ও অনৈতিহাসিক না হয়ে নির্মোহ পর্যালোচনা।

বাংলাদেশে আমরা গণতান্ত্রিক বিপ্লব করতে পারি নি, কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিশাবে গণ্য করি। স্বাধীনতার ঘোষণায় আমরা মানুষ হিশাবে নিজেদের অধিকারের কথা বলেছি। স্বাধীনতার ঘোষণার মর্মার্থ হচ্ছে আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইন্সাফের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখ ‘সংবিধান’ প্রণয়ন করলো তখন স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতার চেতনা বাদ দিয়ে দলীয় দাবিনামাকে বাংলাদেশের সংবিধানের মধ্যে চাপিয়ে দিল। একাত্তরের সংবিধানে ‘জনগণ’ কথাটা থাকলেও নিজেদের ‘জনগণ’ হিসাবে নয়, দাবি করা হয়েছে ‘বাঙালি’ হিশাবে। যে কারনে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ বাংলাদেশের সংবিধানের নীতি ও ভিত্তি হিসাবে স্থান পেয়েছে; ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উর্ধে উঠে আমরা নাগরিক ও মানবিক হতে পরি নি। নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে ঘোষণা দিলেও এই বাঙালির ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের আদ্ধেকের চেয়েও কম পেয়ে সন্তুষ্ট থেকেছি। সীমান্তের ওপাশে যারা নিজেদের ‘বাঙালি’ বলে তারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে কেন নিজদের রাজনৈতিক ভাবে ভারতীয় গণ্য করে, ‘বাঙালি’ নয় সেই প্রশ্ন তলি নি। এই প্রশ্ন তোলার গুরুত্বও বুঝি নি।

একথাগুলো বলার অর্থ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন অস্বীকার করা নয়। বরং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ‘বাঙালি’ জনগণের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের চিন্তা ও চেতনার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা। যার রাজনৈতিক কুফল আমরা এখন ভোগ করছি। দ্বিতীয়ত কথাগুলো বলার অর্থ ইতিহাস ও ভূগোল সম্পর্কে চরম অজ্ঞতার প্রতি নজর নির্দেশ করা।

বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটেনি বললেই চলে। আমরা ‘জাতিবাদী’ হয়েছি, কিন্তু গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থে ‘জনগণ’ হতে পারি নি। সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ ও ‘গণতন্ত্র’ সম্বন্ধে আমাদের অনুমান, ধারণা বা বিশ্বাস এখনও অতিশয় অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন। গণতান্ত্রিক বিপ্লব বাংলাদেশে শুধু অসম্পূর্ণ থেকে যায় নি, এমনকি ‘গণতন্ত্র’ ‘জনগণ’ ইত্যাদি রাজনৈতিক পরিভাষার মর্ম আমরা এখনও ধরতে পারি না। যার মূল্য আমাদের নিত্য দিন দিতে হচ্ছে।

খেয়াল করতে হবে ‘ধর্মের পরিচয়’ থেকে মুক্তি মানে ধর্ম থেকে মুক্তি নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘উই দ্য পিপল’ বলার অর্থ হচ্ছে জনগণের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায় হচ্ছে কোন বিশেষ বিশ্বাস, ভাষা, সংস্কৃতি কিম্বা অন্য কোন পরিচয়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হবে না। গঠনের ভিত্তি হবে জাতি, ধর্ম , ভাষা, সংস্কৃতি বা অন্য যে কোন পরিচয় নির্বিশেষে সুনির্দিষ্ট নাগরিক ও মানবিক অধিকার; সেই অধিকারের মধ্যে বিশ্বাস, বিবেক, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার নিশ্চয়তা থাকবে।

সশস্ত্রতা ও বিপ্লব

বিপ্লবী রাজনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশে প্রচলিত ধারনা হচ্ছে যারা বিপ্লবের কথা বলেন তারা সশস্ত্র ও সহিংস কায়দায় তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন। বাস্তবে সশস্ত্রতা ও সহিংসতার চর্চা শুধু বিপ্লবী রাজনীতি করে সেটা মোটেও ঠিক নয়। বাংলাদেশে বড় বড় দলগুলোর সশস্ত্র দলীয় তৎপরতা এবং সহিংস চরিত্র দেখলেই আমরা সেটা বুঝব। সশস্ত্রতা ও সহিংসতাকে সামগ্রিক ভাবে ক্ষমতা ও রাজনীতির বিচার থেকে আলাদা করে ভাবা ঠিক না। শ্রেণি রাজনীতির বিরুদ্ধে নিছকই প্রপাগাণ্ডা হিশাবেই ক্ষমতাসীন শ্রেণি বা ধনি শ্রেণি এটা প্রচার করে। ক্ষমতাসীন শ্রেণি নিজেরা সহিংসতার চর্চা করলেও শান্তি, সহনশীলতা ও ঔদার্যের কথা বলে। উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমিক, কৃষক বা মজলুম নিজেরা সশস্ত্র হয়ে রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগের প্রতিষ্ঠান বা ধনি শ্রেণির পাহারাদারদের বিরুদ্ধে যান লড়তে নেমে না যায়। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে এই পরিস্থিতি সবসময়ই একট সম্ভাবনা হিশাবে জারি থাকে। রাষ্ট্রের সশস্ত্র সংগঠন, যেমন পুলিশ, সেনাবাহিনী, রক্ষী বাহিনী, র্যা ব ইত্যাদির কাজ ধনিদের সম্পত্তি রক্ষা করা। শ্রেণি রাজনীতির আলোচনায় বিপ্লবের প্রশ্ন একারণে অনিবার্য ভাবেই সশস্ত্র লড়াই বা সশস্ত্র গণ অভ্যূত্থানের আলোচনা থাকে আলাদা করা কঠিন।

অনেকে সেনা অভ্যূত্থানকেও ‘বিপ্লব’ বলে থাকেন। ক্ষমতাসীনদের একাংশকে বল প্রয়োগ করে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়। সমাজে ক্ষমতাসীন শ্রেণিরই একটি অংশ বা গোষ্ঠি যখন তাদের প্রতিযোগী বিরুদ্ধ গোষ্ঠি বা অংশকে সশস্ত্র কায়দায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সেটা বিপ্লবী গণ অভ্যূত্থানের চেয়ে আলাদা। সেটা এক শ্রেণির দ্বারা অন্য শ্রেণিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত, রাষ্ট্রের গাঠনিক ও রাজনৈতিক রূপের কোন মৌলিক পরিবর্তন নয়।

রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে অস্ত্রের জোরে কোন গোষ্ঠি বা দল কাকে অস্ত্রের জোরে বা নির্বাচনের মাধ্যমে সরালো বৈপ্লবিক রূপান্তরের দিক থেকে তাতে কিছুই বিশেষ আসে যায় না। বড়জোর সেটা সমাজের ক্ষমতাসীন শ্রেণির বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্ব পরস্পরের মধ্যে মীমাংসার ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত হতে পারে। দ্বন্দ্বের উৎপত্তি সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে ঘটে। ক্ষমতাবান শ্রেণির পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব শ্রমিক, কৃষক ও নিপীড়িত শ্রেণিকেও বিভক্ত করে এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে যারা নিপীড়িত শ্রেণির পক্ষে রাজনীতি করেন তাদের কাজ হচ্ছে দ্বন্দ্বের চরিত্র ভাল ভাবে বোঝা।

সমাজে ক্ষমতাসীন শ্রেণির বিভিন্ন অংশ সব সবসময়ই পরস্পরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও সহিংস আক্রমণ জারি রাখে। সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকালেই আমরা বুঝব। সশস্ত্রতা ও সহিংসতা চর্চার একচেটিয়া রাষ্ট্রের হাতে থাকে। ক্ষমতাসীন শ্রেণির বিভিন্ন অংশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যা ব, আইন আদালত ইত্যাদি – অর্থাৎ বল প্রয়োগের রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারগুলো ব্যবহারের জন্য নিরন্তর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভুত সশস্ত্র শক্তির সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের মতো দেশে ক্ষমতায় যাবার অন্য কোন বিকল্প নাই। ফরাসী বিপ্লব বৈপ্লবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে মানে তৈরি করেছে – বিপ্লব কথা্টার যে অর্থ তৈরি করেছে -- সেটা নিছক সশস্ত্র ও সহিংস কায়দায় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী কিম্বা অন্য কারো ক্ষমতা দখল নয়। সেনা অভ্যূত্থান আর বিপ্লব সে কারনে সমার্থক নয়।

বিপ্লব ও আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক

বিপ্লব নিয়ে আলোচনা অনেক সময় দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা হয়। এক. রাজনৈতিক বিপ্লব – রাষ্ট্রশক্তি ও রাষ্ট্র কাঠামো বৈপ্লবিক কায়দায় রূপান্তর অর্থে, দুই. রাজনৈতিক বিপ্লবের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক বা উৎপাদন সম্পর্ক বদলানো অর্থে। এ কারনে বিপ্লবী রাজনৈতিক আলোচনায় আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও শ্রেণির প্রশ্ন মুখ্য বিষয় -- বিশেষত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণি কী ধরণের সম্ভাব্য রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করে বা করতে পারে বা করে সেই প্রসঙ্গ। মার্কস, লেনিন, মাও জে দং প্রমুখের দিক থেকে বিপ্লব শুধু রাজনৈতিক অর্থে ক্ষমতা হস্তান্তর নয়, এর সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক মানে আছে। সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক যখন অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে এবং দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশ অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী শ্রেণীকে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা দরকার হয়ে পড়ে। নতুন উৎপাদন সম্পর্কের জন্য বাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করাই বিপ্লবের প্রধান উদ্দেশ্য। ফরাসি দেশে সামন্ত শ্রেণি ও তাদের ক্ষমতার রাজনৈতিক রূপ ‘রাজতন্ত্র’ সমাজের বিকাশের জন্য বাধা হয়ে উঠেছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে তাদের উৎখাত করে রাষ্ট্র ও রাজনীতির নতুন গণতান্ত্রিক বিন্যাস জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করবার নেতৃত্ব দিচ্ছিল তারা ছিল ‘বুর্জোয়া’ শ্রেণি। সামন্ত শ্রেণির শাসন শোষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য শ্রমিক, কৃষক ও মজলুম জনগণ এই বুর্জোয়া শ্রেণিকেই সমর্থন দিয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবের সামন্ত শ্রেণির পরাজয় ঘটে এবং বুর্জোয়া শ্রেণি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে ‘গণতন্ত্র’ কায়েম করে। অপরদিকে সামন্ততান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক উৎখাত করে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ নিশ্চিত করে।

যেহেতু বুর্জোয়া শ্রেণির কাজ পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম ও গতিশীল করা, এজন্য ‘বুর্জোয়া’ বলতে আমরা সাধারণত ধনি শ্রেণি বুঝি। কিন্তু ‘বুর্জোয়া’ কথাটা বিপ্লবী রাজনীতির পরিভাষা হিসাবে শুধু অর্থনৈতিক বর্গ নয়, মূলত রাজনৈতিক বর্গ। অর্থাৎ এই পরিভাষাটিকে বুঝতে হবে একটি শ্রেণির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকার দিক থেকেও। অর্থনৈতিক স্বার্থে যে শ্রেণি রাজনৈতিক রূপান্তরে ভূমিকা রাখে। এই বর্গের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা ও রাজনৈতিক চেতনা কিভাবে সম্বন্ধযুক্ত – বিপ্লবী রাজনীতির দিক থেকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তর্ক।

অর্থনৈতিক শ্রেণি এবং তাদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনার সম্পর্ক বিচারের ওপর বিপ্লবী রাজনীতির নীতি ও কৌশল নির্ভর করে। এটি পুরানা তর্ক। যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রমিক হলেই কি একজন শ্রমিক শ্রমিকের চেতনা ধারণ করে? ‘শ্রেণি চেতনা’ কথাটার মানে কি তাহলে? অর্থনৈতিক অবস্থা আর শ্রেণী চেতনার সম্পর্ক নির্ণয়ের পদ্ধতি কি হবে? এই তর্কের মীমাংসা হয়েছে তা বলা যায় না। ফলে তর্কটা বিভিন্ন ভাবে নানান দিক থেকে আজকাল করা হচ্ছে। যারা ‘বৈপ্লবিক’ পরবর্তনে আগ্রহী ও বিপ্লবী রাজনীতি সম্পর্কে নতুন ভাবে বিচার ও নতুন পথ অন্বেষণের কাজ করছেন পুরানা ধ্যান ধারণা কেন্দ্র করে দানা বাঁধা আন্তরিক তর্কগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচিত হয়ে ওঠা জরুরি। এই লেখাটি সেই সকল তর্কে প্রবেশের উপক্রমণিকা মাত্র। নতুন প্রশ্ন উঠেছে, যা এড়িয়ে যাবার উপায় নাই বললেই চলে। যেমন বিপ্লবের এজেন্ট বা কর্তাসত্তা নির্ণয়ের উপায় কি? কাজটা কি শুধু শহরের শ্রমিকরাই করবেন? তারাই নেতৃত্ব দেবেন? তাহলে কি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে ‘উই দ্য পিপল...’ কথাটার আর কোন তাৎপর্য বা ভূমিকা নাই? থাকলে সেটা কি? পরিবর্তন যারা ঘটাবেন সেই ‘জনগণ’ কারা? বিপ্লবের এজেন্সি বা কর্তাসত্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক অবস্থানই কি একমাত্র বিবেচ্য, নাকি ধর্মচিন্তাসহ মতাদর্শ, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সব কিছুকেই আমলে নেওয়া জরুরী।

বলাবাহুল্য বাস্তবে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মধ্যে কিভাবে প্রকাশিত হচ্ছে তাকে বাস্তবিক ভাবে বোঝাটাই প্রাথমিক কাজ। বাংলাদেশে সেই দ্বন্দ্ব ধর্ম নিরপেক্ষতা বনাম ইসলামপন্থা হিসাবে হাজির হোল কেন? এর উত্তর আগাম মাথায় তৈয়ার করে রাখা মতাদর্শের খোপে ফেলে বা মানদণ্ডে মেপে বোঝা অসম্ভবও বটে। ধর্ম নিরপেক্ষ প্রাচীন সেকুলার চিন্তা হোক, কিম্বা হোক ধর্মতত্ত্ব খোপবদ্ধ মতাদর্শ দিয়ে বাস্তব বিচার ভাল ফল দিতে পারে না। আসল কথা হচ্ছে বাস্তবে কি ঘটছে তাকে বাস্তবোচিত ভাবেই বুঝতে হবে। সেটা বুঝতে হলে প্রাচীন পরিভাষার বোঝা বহন করা আদৌ জরুরী কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।

সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস, মতাদর্শ চর্চা থাকবেই। কারণ মানুষ কথাসম্পন্ন চিন্তাশীল প্রাণী, তাহলে কিভাবে এই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে মান্য করেও সকলকে ধারণ করা যায় সেটা একালে বিপ্লবের একটা গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক ও কৌশলগত ব্যবহারিক প্রশ্ন। বিপ্লব নিজের মত অন্যের ওপর বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে চাপিয়ে দেবার মামলা নয়। এই পরিপ্রক্ষিতেই 'রাজনৈতিক পরিসর' নির্মাণ কথাটা আজকাল বলা হয়। আদৌ বাংলাদেশে ‘রাজনৈতিক পরিসর’ বা ‘রাজনৈতিক পরিমণ্ডল’ নির্মানের কোন উপযোগিতা আছে কিনা আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি।

তবে গ্রিক-খ্রিস্টীয় পরিমণ্ডলে রাজনীতি ও আধুনিক রাষ্ট্র সংক্রান্ত যে সকল ধ্যান ধারণা গড়ে উঠেছে তাদের উপযোগিতা নিয়ে তর্ক একালে অনেক তীব্র হয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে আমরা এখন রাজনৈতিক সমাজে বাস করছি না, বরং বাস করছি নজরদারি, শাস্তি, শৃংখলা ও গণনিয়ন্ত্রণের কারিগরির মধ্যে। এই ব্যবস্থা নিত্য বিভিন্ন স্তরে যে কর্তা বা কর্তাচতনা তৈরি করে, তাদের মধ্য দিয়েই ক্ষমতা কাজ করছে। ‘ক্ষমতা’ শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতা নয়। ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদিত হতে থাকা বিভিন্ন 'কর্তা'দের চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা কাজ করছে। একালের বিপ্লবকে ক্ষমতার এই নতুন চরিত্রকে আমলে নিতে হবে। 'জনগণ' কথাটা আগের মতো আর খাটে না। এখানে সেই বিষয়ে আলোচনা করি নি। ক্ষমতা, সার্বভৌমত্ব, নজরদারি, সাধারন মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য শুধু রাষ্ট্রের আইন শৃংখলা ব্যবস্থার স্তরে নয়, বরং সমাজের সকল ক্ষেত্রে শাস্তি ও শৃংখলার বিবিধ কারিগরি নিয়ে বাস্তব পর্যালোচনা জরুরী। ক্ষমতা এক জায়গায় ঘনীভূত বা কেন্দ্রীভূত নয়, বরং তার কারবার সর্বত্র।

অর্থাৎ বিপ্লবী ধ্যান ধারনা ও বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। বিপ্লবের পুরানা চিন্তা দিয়ে যা আর বুঝবার উপায় নাই বললেই চলে।

আমরা অনুমান করি ধারনা হিশাবে ‘সমাজ’ বোধহয় সবসময়ই রাষ্ট্রবিদ্যা ও রাজনৈতিক শাস্ত্রে হাজির ছিল। এটা ঠিক না। ‘সমাজ’ একান্তই আধুনিক কালের ধারণা এবং পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কে গড়ে ওঠার পরই ‘সমাজ’ ধারণা দানা বাঁধে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য যে ‘সমাজ’ বলতে আমরা আসলে কী বুঝি সেটা আজো তর্ক সাপেক্ষ বিষয়।

ইতিহাস একটা নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিশাবে কোন ছেদ ছাড়া বয়ে চলেছে, এই অনুমানও আমরা করি। ইতিহাসে নানান বাঁক ও মোড় আছে বটে কিন্তু শেষাবধি দ্বন্দ্ব ও মীমাংসার মধ্য দিয়ে ইতিহাস নিজের গতিতে বয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যে আঠারো শতকের দিকে এই সকল ধারণায় বড়সড় পরিবর্তন হতে শুরু করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের পরিবর্তনকে দেখা হোত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তন হিশাবে। হেগেল জানালেন মানুষের ইতিহাস মানুষের চিন্তার ইতিহাসের সঙ্গে সমান্তরালে চলে।

তবে মার্কস এসে দেখালেন চিন্তা বা রাজনৈতিক ঘটনাঘটন দিয়ে ইতিহাস বোঝা যাবে না। ইতিহাসের মূল চালিকা শক্তি অর্থনৈতিক সম্পর্ক। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিচারের মধ্য দিয়ে ‘সমাজ’ নামক এক নতুন বর্গ আধুনিক কালে হাজির হয়। বিপ্লবের অর্থ যখন আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের রূপান্তরকেও বোঝানো শুরু করল, তখন সেটা আর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ রইল না। সমাজের রূপান্তর হিশাবেও অর্থ ধারণ করতে শুরু করল।

 

এবার সারমর্মে আমরা আরেকবার কয়েকটি কথা বোঝার চেষ্টা করি।

এক: রক্ত, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, সংস্কৃতি, পরিচয় ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও পার্থক্যের উর্ধে উঠে রাজনৈতিক ভাবে এক ও অখণ্ড রাজনৈতিক সত্তা হিসাবে হাজির হবার রাজনৈতিক ইচ্ছা, অভিপ্রায় বা সংকল্পই হচ্ছে ইউরোপীয় অর্থে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এটাই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ন্যায্যতা ও সিদ্ধতা লাভের ভিত্তি, আধুনিক গঠনতন্ত্রে (Constitution) যা বিধৃত থাকে। উই দ্য পিপল’ বা গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রে যেভাবে লেখা হয়, ‘আমরা জনগন...’-- কথাটার এটাই মানে। বাংলাদেশের গঠনতন্ত্রে ‘আমরা বাংলাদেশের জনগন’ কথাগুলো আছে, কিন্তু সংবিধানের চরিত্রের কারণে তা্রা গণতান্ত্রিক মর্ম নয়, বরং জাতিবাদী আকাংখাই ব্যক্ত করে।

দুই: ‘বিপ্লব’ বা জনগণের বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের রাজনৈতিক অর্থ হচ্ছে (ক) সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের এক ও অখণ্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে পরিগঠন; (খ) অন্য রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করা (গ) নিজেদের রাষ্ট্র হিসাবে গঠনের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠন সভা আহ্বান এবং গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং (ঘ) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন ও বাস্তবায়ন।

তিন: জনগণের ঐতিহাসিক আবির্ভাব বা জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার উত্থানের মানে দাঁড়ায় ধর্মের নামে বা ঈশ্বরের নামে ধরায় ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে গির্জা বা পুরোহিত শ্রেণি যে সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করত তার অবসান। ইউরোপের গির্জা ও পুরোহিতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের চরিত্র আর ইসলাম প্রধান দেশে মসজিদ ও ধর্মনায়কদের সঙ্গে বিরোধের চরিত্র ভিন্ন। কারন তাদের বাস্তবতা ভিন্ন। অতএব ধর্ম ও ধর্ম প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বাস্তবের বিচার করেই নির্ণয় করতে হবে।

চার: আদত কথা হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ছাড়া অন্য কোন অজুহাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা রাজা, অভিজাত শ্রেণি কিম্বা পুরোহিতরা আর দাবি করতে পারে না। ইংলণ্ডে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার রূপ হচ্ছে ভোটে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ব্রিটিশ পার্লামেন্ট। যে কারণে পার্লামেন্টই ‘সার্বভৌম’ বলে একটা কথার চল আছে। যা নিয়ে আমাদের দেশেও তর্ক চলে। ‘সার্বভৌমত্ব’ মূলত রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ওপর একচেটিয়া এখতিয়ারের তর্ক। খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। আধুনিক পাশ্চাত্য রাষ্ট্রের ‘সার্বভৌমত্ব’ খ্রিস্টিয় ধর্মতাত্ত্বিক ধারণারই ইহলৌকিক বিকার। এই দিকটির আলাদা আলোচনা দরকার। ‘সার্বভৌমত্ব’ বা ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র বিচার একালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

পাঁচ: বিপ্লব একটি প্রক্রিয়া; হঠাৎ একদিনের, এক মাসের বা দুই এক বছরের ব্যাপার। বিপ্লব হঠাৎ হাতে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে রাজার প্রাসাদ দখল করা নয়। এর জন্য সমাজেরও বিপুল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতির দরকার হয়। বিপ্লবী বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকে ন্যায্য ও সিদ্ধ প্রমাণ করার নীতি ও কৌশলের অন্তর্গত। লেনিন যে কারনে বিপ্লবী তত্ত্বচর্চা ও প্রচারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এ ছাড়া বিপ্লবের সফলতা অসম্ভব। দাবি করা হোত রাজা, পুরোহিত ও চার্চের ক্ষমতা ঈশ্বরের দৈব ক্ষমতারই ইহলৌকিক রূপ। এই দৈব উৎস ও চরিত্রই সার্বভৌম ক্ষমতার ন্যায্যতা হিসাবে জনগণের কাছে স্বীকৃত এবং দৈবগুণেই সিদ্ধ। তাহলে এর বিপরীতে জনগণের ক্ষমতাকে ন্যায্য ও সিদ্ধ করার জন্য নতুন বিপ্লবী বয়ান বিপ্লবীদের করতে হয়েছে। সামন্ত শ্রেণি, রাজা ও গির্জার ক্ষমতার বিরোধী হলেও বিপ্লবী বয়ানে ধর্মকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন হয়েছে। যার ফলে ধর্মের নানান ফেরকা, মজহাব ও তরিকারও উদ্ভব ঘটেছে। দেশ ও রাষ্ট্র ভেদে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই ও সংগ্রামে ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের এবং ধর্মের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীরও নানান রূপান্তর ঘটেছে। ধর্মতত্ত্বেরও বিবর্তন ঘটেছে। ইউরোপ বিপ্লবের চূড়ান্ত নজির নয়।

ছয়: দেশ, কাল ও পাত্রভেদে বিপ্লব ইউরোপের ফটোকপি হবে তার কোন যুক্তি নাই। সেই দিক থেকে পাশ্চাত্য চিন্তার পরিমণ্ডলে থেকে বলশেভিক বিপ্লব বা চিনা বিপ্লবের বয়ান সেই দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী যেমন হয়েছে তেমনি ইরানের বিপ্লব সেই দেশের ধর্ম, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের চরিত্র থেকে ভিন্ন কিছু হয় নি। হওয়া আশা করাটাই বাতুলতা। ইরানের বিপ্লব বিপ্লবের ইতিহাসে নতুন কি যুক্ত করল সেটা একালে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। উপেক্ষা করার উপায় নাই।

১৬ জুন, ২০১৭, ২ আষাঢ়, ১৪২৪, শ্যামলী।

বইয়ের সূত্র

দাস ১৯৮৮

জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাস (১৯৮৮ -পুনর্মূদ্রণ). বাঙ্গালা ভাষার অভিধান। কলিকাতা: সাহিত্য সংসদ.

বন্দোপাধ্যায় ১৯৬৭

হরিচরন বন্দ্যোপাধ্যায়, (১৯৬৭). বঙ্গীয় শব্দকোষ (দ্বিতীয় খণ্ড)। নতুন দিল্লী: সাহিত্য অকাদেমি.

 

 













 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।