'দুর্ঘটনা' নয়, নিয়মিত মৃত্যু


দুর্ঘটনা এখন ‘নিয়মিত’ ঘটনা

পাহাড় ধসের কারনে মানুষ মরছে। এটা এখন আর দুর্ঘটনা নয়, নিয়মিত ঘটনা। বর্ষা এলেই কোন কোন উপজেলায় পাহাড় ধসে মানুষ জ্যান্ত কবর হয়ে যাচ্ছে। এবার একটু আগাম ও টানা বর্ষণ নামতে না নামতেই চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে ১৫০ জনের বেশী মানুষ মরেছে বলে কিছু পত্রিকা দাবি করেছে। দৈনিক যুগান্তরের ১৪ জুনের সংবাদ বলছে, ‘পাহাড় ধসে নিহত বেড়ে ১৪১’; একই তারিখে দৈনিক প্রথম আলোর হিসাব ১২৬ (‘পাহাড় ধসে নিহত ১২৬’)। এর আগে ২০০৭ সালে ১২৭ জন মারা যায়। এবার মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লো। গত ১০ বছরে (২০০৭-১৬) ২০১ জন নিহত হয় প্রথম আলো ১৪.০৬. ১৭)। এক রাঙামাটিতেই মৃতের সংখ্যা একশর বেশী। তবে এবার পাহাড় ধসে এতো মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে এটাই শুধু প্রমাণিত হোল, ‘দুর্ঘটনা’র ধারণা দিয়ে আমরা মানুষের মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান হার আর ব্যাখ্যা করতে পারছি না। পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু নিছকই ‘দুর্ঘটনা’ নয়। কিম্বা যা আদতে নিছকই ‘দুর্ঘটনা’ ঘটবার ব্যাপার বলে আমরা মনে করতাম তা এখন ‘নিয়মিত’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

যা একটি কি আধটি ‘দুর্ঘটনা’ হবার কথা, তা কি করে ‘নিয়মিত’ মানুষের মৃত্যুসংখ্যা হয়ে উঠল তা রাষ্ট্র, আইন, জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার ব্যাপার হয়ে ওঠে সেই দিক থেকে বোঝা দরকার। এই বোঝার দিকটাতেই আমাদের মারাত্মক অভাব আছে। সেটা বুঝলে আমরা ‘দুর্ঘটনা’র সঙ্গে একদিকে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা আর অন্যদিকে রাষ্ট্র, আইন ও জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার সম্পর্ক বুঝব। তখন বুঝব পাহাড় ধসে মানুষ মরা, কারখানায় ভস্ম হয়ে যাওয়া কিম্বা জ্যান্ত কবর হওয়া, যানবাহন দুর্ঘটনায় ‘মফিজ’দের মরে যাওয়া ইত্যাদি আর্থসামাজিক এবং আধুনিক রাষ্ট্রের জনব্যবস্থাপনার অন্তর্গত ব্যাপার। বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

মাঝে মধ্যে ‘দুর্ঘটনা’ ঘটতেই পারে। সেটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হোক, কিম্বা মানুষের তৈয়ারি যান্ত্রিক বিপর্যয়ে, যেমন, যানবাহনজনিত দুর্ঘটনা। যানবাহনজনিত দুর্ঘটনাতেও প্রচুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তা রোধ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক আন্দোলন চলছে, কিন্তু কমতির কোন লক্ষণ নাই। সড়ক দুর্ঘটনাও নিয়মিত ঘটনা এবং গা সওয়া ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।

গার্মেন্টে পোশাক শ্রমিকদের পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়া, কিম্বা রানা প্লাজার মতো পুরা বিল্ডিং ধসে পড়ে ধ্বংসস্তুপে জ্যান্ত কবর হয়ে যাওয়াকে মোটেও আর ‘দুর্ঘটনা’ বলা যায় না।

শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার না থাকার মানে

আন্তর্জাতিক পুঁজির যে প্রান্তে বাংলাদেশ সেখানে শ্রমিকের দাম সস্তা রাখা বিশ্ববাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের টিকে থাকার শর্ত। শ্রমের দাম সস্তা রাখতে হলে প্রথম কাজ হচ্ছে শ্রমিকদের কোন ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার না দেওয়া। এখানেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিক মৃত মানুষদের সংখ্যা বাড়ায়। তারা জনসংখ্যার সেই অংশ রাষ্ট্র যাদের আইন ও অধিকারের বাইরে রাখে, নইলে সস্তা দামে তাদের শ্রম কেনা যায় না। আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারেও রপ্তানি করা যায় না।

ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রমিকের অধিকার। তাহলে এই ক্ষেত্রে ‘অধিকার’ কথাটার অর্থ কি? বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে এটা বুঝি শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের কিম্বা কারখানার মালিকদের নিছকই সদয় থাকার ব্যাপার। মোটেও তা নয়। বুর্জোয়া আইন ব্যক্তি স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ব্যক্তি স্বাধীনতার অর্থ স্রেফ চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলা ফেরার স্বাধীনতা, ব্যক্তি কি পোশাক পরবে না পরবে ইত্যাদি সব কিছুরই স্বাধীনতা। কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতার এটা মর্মের নাকি বাহ্যিক দিক তা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে তর্ক আছে। ব্যক্তি যে বিমূর্ত ব্যাপার নয় আসলেই বাস্তবেই মূর্ত একটি ব্যাপার সেটা ব্যক্ত হয় ব্যক্তিগত মালিকানায়। এটা জর্মন দার্শনিক হেগেলের ভাষ্য। এখান থেকে মার্কস ব্যক্তি মালিকানা কিভাবে ঐতিহাসিক ভাবে বুর্জোয়া মালিকানা অর্থাৎ উৎপাদনের উপায়ের উপর পুঁজির মালিকানা হয়ে উঠেছে সেটা তাঁর ‘পুঁজি’ গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেছেন। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন হয়ে উঠেছে ‘সামাজিক’, অর্থাৎ পুরা সমাজ – এমনকি পুরা বিশ্বই একসঙ্গে উৎপাদনে শামিল হচ্ছে, যাকে আমরা এখন ‘গোলকায়ন’ (globalization) বলি; অথচ অন্য দিকে উৎপাদনের উপায়ের মালিক থাকছে পুঁজিপতি। একদিকে উৎপাদনের সামাজিকীকরণ ঘটেছে অথচ অন্য দিকে উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা রয়ে গিয়েছে ব্যক্তির হাতে। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে এটা ছিল কার্ল মার্কসের গুরুতর আপত্তি। পুঁজিতন্ত্র শোষণ্মূলক অবশ্যই কিন্তু এটা শোষণের তত্ত্ব নয়। চরিত্রের দিকে থেকে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক স্ববিরোধী সেটা প্রমান করাই ছিল মার্কসের অন্যতম উদ্দেশ্য।

উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকার অর্থ সমাজের আরেকটি অংশকে মালিকানা আইনের নিয়মে মালিকানাহীন রাখা। মালিকানা বহাল রাখা ও অন্যদের মালিকানাহীন করা একই প্রক্রিয়ার দুটো দিক মাত্র। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা বহাল রাখবার বিধান নিশ্চিত করা। যারা উৎপাদনের উপায়ের মালিক না তারা বেঁচে থাকতে হলে পুঁজিপতিদের কাছে শ্রম বিক্রি না করে সমাজে বেঁচে থাকতে পারে না। ব্যক্তি মালিকানা নিশ্চিত করতে গিয়ে মালিকানাহীন জনসংখ্যার ব্যবস্থাপনাও রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হয়। মার্কসের পঠন-পাঠন থেকে আমরা বুঝি ‘পুঁজি’ নামে ব্যাক্তিগত মালিকানার চরম বিকাশের মধ্য দিয়ে একদিকে মালিক আর অপরদিকে সর্বহারা এই দুই ভাগে জনসংখ্যা বিভক্ত রাখা এবং তাদের ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্র নিশ্চিত করে। এটাই পুঁজির স্ববিরোধিতা। এই স্ববিরোধিতা জিইয়ে রেখে পুরানা উৎপাদন সম্পর্ক ও ব্যবস্থার তুলনায় পুঁজিতন্ত্র ‘বৈপ্লবিক’ ও ‘প্রগতিশীল’ হলেও মানুষের ইতিহাস আর সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। এগিয়ে যেতে হলে মালিকানা সম্পর্কের এই ধরণের ওপর গড়ে ওঠা বিশ্ব ব্যবস্থাকে অবশ্যই মানুষকে ভাঙতে হবে। কিন্তু সেই ভাঙ্গন বা রূপান্তর মার্কস যেভাবে ঘটবে অনুমান করেছিলান সেভাবে ঘটে নি বলে সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্র নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু মার্কসকে বাদ দিয়েও নতুন বাস্তবতার ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। বিশেষত পুঁজির গতি-প্রকৃতি এবং স্ববিরোধিতা বোঝার জন্য মার্কসকে দরকার।

আমাদের এখনকার আলোচনার জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হোল ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানার মধ্যে সম্পর্কটা বোঝা। এটা বুঝলে কেন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আবার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অর্থে ‘বুর্জোয়া’ বলা হয় আমরা তা বুঝব। পুঁজিপতি তার পণ্য নিয়ে বাজারে দরদাম করতে পারে, এটা ‘বুর্জোয়া’ আইনে সিদ্ধ, কারন পণ্যের মালিক পুঁজিপতি। এটাই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিধান। অন্যদিকে ব্যাক্তিগত মালিকানার দিক থেকে বিচার করলে শ্রমিকও ‘বুর্জোয়া’। কোন্‌ অর্থে? কিভাবে? মালিকানা অর্থে। কিন্তু সর্বহারা কিভাবে মালিক হয়? মার্কস বলছেন শ্রমিকের সম্পত্তি নাই, ঠিক, কিন্তু শ্রমিক তার নিজের শ্রম শক্তির মালিক। যদি তাই হয় তাহলে বুর্জোয়া হিসাবে নিজের পণ্যের দরদাম নিয়ে দরকষাকষি করবার অধিকার তার আছে। শ্রমিক সেই কাজ করে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে। শ্রমিকের শ্রম শক্তির দরদামের অধিকার বুর্জোয়া আইনে সিদ্ধ হবার কথা। কারণ বুর্জোয়া আইন ব্যাক্তিগত মালিকানা মানে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় সেটা মানা হচ্ছে না। শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে তার শ্রমশক্তি নিয়ে দরদাম করবে বাংলাদেশের বুর্জোয়ারা সেটা চায় না। ঘোরতর ভাবে তারা তার বিরোধী। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে এমন এক বুর্জোয়া শ্রেণী গড়ে উঠেছে যারা নিজেদের মালিকানা স্বত্ব রাষ্ট্রের মাধ্যমে কার্যকর রাখে, কিন্তু শ্রমশক্তির ওপর শ্রমিক বা সর্বহারার মালিকানা স্বত্ব মানে না। বাংলাদেশে এমন এক ধন্তান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যেখানে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বুর্জোয়া অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে।

তাহলে প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশে ধনি বা পুঁজিপতি শ্রেণি ‘বুর্জোয়া’ হতে পারছে না কেন? তারা পুঁজি ও পণ্যের ওপর নিজেদের মালিকানা মানে, কিন্তু শ্রমশক্তির ওপর শ্রমিকের মালিকানা মানে না। শুধু তাই নয়, শ্রমশক্তির ওপর শ্রমিকের মালিকানা তারা আইন করে নিষিদ্ধ করে। অর্থাৎ শ্রমিককে ট্রেড করবার অধিকার দেয় না। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মাস্তান লেলিয়ে দেয়। সম্পত্তিতে ব্যক্তির অধিকার ব্যক্তি মালিকানার নিয়মের মধ্যেই পড়ে। সমাজে সামগ্রিক ভাবে ব্যক্তির ( পড়ুন, বুর্জোয়া) অধিকারের কথা বাংলাদেশের বুর্জোয়া শ্রেণি বলে, কিন্তু গরিব, সর্বহারা ও মেহনতি জনগণের ক্ষেত্রে সেই অধিকার রাষ্ট্রীয় ভাবে অস্বীকার করা হয়। এই দিকটি বুঝলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির খুবই গোড়ার দ্বন্দ্বটা আমরা বুঝতে পারব।

ওপরের ব্যাখ্যা থেকে আমরা বুঝব, বাংলাদেশে যেখানে পুঁজি মালিকানার ব্যক্তি অধিকার স্বীকৃত সেখানে শ্রম শক্তির ওপর শ্রমিকের ব্যাক্তিগত মালিকানা অস্বীকার করা হয় – অর্থাৎ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করবার অধিকার দেওয়া হয় না। জনসংখ্যার বৃহৎ অংশকে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে শ্রমের দাম সস্তা রাখা। শ্রমিক যদি ট্রেড ইউনিয় করবার অধিকার পায়, তখন শ্রমশক্তির জন্য আরো বেশী দাম বা মূল্য শ্রমিকেরা ধনিদের কাছ থেকে আদায় করতে পারে। কিন্তু শ্রমে দাম সস্তা রাখাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইন ও নীতি। কেন? কারন শ্রমের দাম যদি বাড়ে তাহলে গার্মেন্ট ইন্ড্রাস্টির মুনাফা কমে, এবং বাংলাদেশের পক্ষে সস্তা পোশাক রপ্তানি অসম্ভব হয়ে ওঠে। একই কারণে শ্রমের দাম সস্তা রাখতে গিয়ে শ্রমের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার – অর্থাৎ কারখানায় শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য বাড়তি বিনিয়োগ পুঁজি করে না। কারখানার মালিকরা তা করতে বাধ্যও নয়।

পাহাড়ের পাদদেশে ছাপড়া বাঁধা মানুষ

এবার আমরা পাহাড় ধসের ঘটনায় আসি। এটা তো বাস্তব যে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাহাড়ের পাদদেশে ছাপড়া বেঁধে থাকা মানুষের জীবন পাহাড় ধসের মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। কিন্তু বাংলাদেশে অল্পকিছু ধনী ছাড়া সকলের জীবনই হুমকির মুখে। সেটা আগামি দিনে আরও তীব্র হবে।

এর দুটো দিক আছে। একটি দিক হচ্ছে নিরাশ্রয়, গরিব, সর্বহারা মানুষ যারা চরম বিপদ সংকুল জেনেও পাহাড়ের পাদদেশে ঘর বানায়। একই ভাবে প্রশ্ন করা যায়, পোশাক কারখানায় পুড়ে মরবার কিম্বা জ্যান্ত কবর হয়ে যাবার বিস্তর উদাহরণ থাকার পরও পোশাক কারখানায় চাকরির জন্য মানুষ যায় কেন? প্রশ্ন হোল এরা কারা? এই মানুষগুলো কোথা থেকে আসে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা উন্মূল উদ্বাস্তু উৎখাত হয়ে যাওয়া মানুষ। শ্রমের সবরাহ নিশ্চিত করবার জন্য কৃষিজীবী, বনবাসী, জেলে, কামার, কুমার – অর্থাৎ উৎপাদনের উপায়ের সঙ্গে যাদের উৎপাদন ও বেঁচে থাকার সম্বন্ধ প্রাকৃতিক, ঐতিহ্যিক কিম্বা নানান প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মিশ্রণ -- পুঁজি তা নিরন্তর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ গরিব ও সর্বহারায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের গ্রাম, বন, নদি, সমুদ্রে নানান ভাবে বিন্যস্ত বিভিন্ন জনপদ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম ছিল না। পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের তুলনায় তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা মন্থর ছিল অবশ্যই, কিন্তু তার নিজের একটা গতি ছিল। ফলে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও নিত্য দিনের জীবন ব্যবস্থা থেকে সম্বন্ধ ছিন্ন করে তাদের সস্তা শ্রম হিসাবে বাজারে হাজির করা সহজ ছিল না। সেই সম্বন্ধ ছিন্ন করবার রাষ্ট্রকে কাঠামগত সহিংসতা বা সন্ত্রাস করতে হয়েছে।

আইন ও নীতির মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র যে সমাজ বা জনব্যবস্থাপনা গড়ে তোলে অনেকে তাকে ‘কাঠামোগত সন্ত্রাস ও সহিংসতা’ বলে থাকেন। গ্রামীণ জনপদে, জলমহালে ও বনে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি সংক্রান্ত মালিকানা ব্যবস্থা রক্ষা ও তার প্রয়োগ এমন ভাবে আধুনিক রাষ্ট্র করে যা মানুষকে উন্মূল, উদ্বাস্তু, আশ্রয়হারা এবং জীবিকা বঞ্চিত সর্বহারা করে তোলে। সাধারণ ভাবে বাংলাদেশের কাঠামোগত সংস্কার, রপ্তানি মুখী উন্নয়ন নীতি কিম্বা সুনির্দিষ্ট ভাবে কৃষিনীতি ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ইত্যাদির বিচার করলে আমরা এই চিত্রটাই পাবো। উত্তর-উপনিবেশী আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক জবরদস্তি আরোপ ও বিস্তৃত করা। কাঠামোগত সহিংসতার মধ্য দিয়ে গ্রামাঞ্চলে জীবন জীবিকার যে সংকট রাষ্ট্র তৈরি করে তার ফলে জমি বা গ্রামীণ জীবন ও জীবিকা থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন বা বিযুক্ত হয়ে যেতে বাধ্য হয়। কাঠামোগত সহিংসতা বা সন্ত্রাসের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামকে সর্বহারা তৈয়ারির কারখানায় পরিণত করা। গ্রাম হয়ে ওঠে সর্বহারা যোগান দেবার ক্ষেত্র, যারা দেশে কিম্বা বিদেশে সস্তায় নিজেদের বিক্রি না করে বেঁচে থাকতে পারে না।

ঔপনিবেশিক আমলের দুর্ভিক্ষ কিম্বা বাংলাদেশে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ যে ঔপনিবেশিক ও বাকশালী শাসনের ফল সেটা কমবেশী স্বীকৃত। তাকে ব্যতিক্রম ভাববার কোন কারণ নাই। সস্তা শ্রমের সরবরাহ নিশ্চিত করা বাংলাদেশের গ্রামীন জীবন ও জীবিকা ব্যবস্থার আভ্যন্তরীণ কোন সংকট থেকে জাত নয়। রাষ্ট্র আর্থ-সামাজিক নীতি ও শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে উৎপাদন থেকে বিচ্ছিন্ন সর্বাহারার যোগান নিশ্চিত করে। গ্রামীন ব্যবস্থা নানা কারনে ভেঙ্গে পড়তে পারে, সেখানে সংকট নাই যে তা নয়, তার চরিত্র আলাদা। তার জন্য আলাদা বিশ্লেষণ ও বিচার দরকার। বাংলাদেশে গ্রামীন ব্যবস্থা বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে যেখানে যুক্ত সেই সম্বন্ধের ক্ষেত্রগুলো আমাদের আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। যাতে দুইয়ের পার্থক্য আমরা আরও ভালভাবে বুঝতে পারি। গ্রাম, বন, জনপদ – অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে গ্রামীন জীবন ও ব্যবস্থাকে পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্য দিয়েই ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য সর্বহারা মানুষ শহরে কিম্বা পাহাড়ে কোন না কাজের জন্য ছুটে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ‘কাজ’ মানেই যা পুঁজির জন্য মুনাফাকারী, অতএব শ্রম সস্তায় বিক্রয়ের বাজার তৈয়ারি। সেই বাজার নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে। মানুষ ‘মফিজ’ হয়ে গ্রাম থেকে শহরে ছোটে, কারখানায় শ্রমিক হয়, তেমনি পাহাড়ে যে পুঁজি মাটিকাটার শ্রমিক নিয়োগ করে তাদের কাছে সস্তায় নিজেদের শ্রম বেচে। নিরাশ্রয় মানুষ বনজঙ্গল কেটে ফেলার সস্তা মজুর হতে গিয়ে বিপজ্জনক পাহড়ের পাদদেশে ছাপড়া তুলতে বাধ্য হয়।

ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউনেপ) প্রতিবেদনে পাহাড় ধসসহ দুর্যোগকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ বলা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি আইন ও ব্যবস্থাপনাকে বিচার বিশ্লেষণ থেকে বাইরে রেখে দোষ চাপানো হোল প্রকৃতির ওপর। দাবি করা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে ‘অরক্ষিত’ (ভালনারেবল) দেশটির নাম বাংলাদেশ। কিন্তু এই অঞ্চলের জনপদ্গুলো ‘অরক্ষিত’ হয়েছে মোটেও প্রাকৃতিক কারণে নয়। বরং আর্থ-সামাজিক নীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে। সুনির্দিষ্ট ভাবে যেসব অঞ্চল পোশাক তৈরির কারখানার শ্রমিক কিম্বা উদ্বাস্তু সর্বহারাদের সরবরাহ করে সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করলেই আমরা বুঝব বাংলাদেশে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা’ বলে কিছু নাই যা বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন নিছকই একটি ‘প্রকৃতি’ বা ভূগোল। প্রতি বছর নানা দুর্যোগে এ দেশের কিছু সুনির্দিষ্ট জেলা বা অঞ্চলের মানুষের জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। কিন্তু এই লণ্ডভণদ হয়ে যাওয়া নিছক ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা নয়। এর সঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রের নীতি জড়িত।

‘ল্যাংটা জীব’ কিম্বা রাষ্ট্রীয় বা আইনী অধিকারহীন প্রাণী।

বুর্জোয়া অধিকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ‘জীবনের অধিকার’ (Right to life)। কিন্তু বাংলাদেশে যে আইন, নীতি ও শাসনব্যবস্থা চেপে বসেছে সেখানে নিরাশ্রয় সর্বহারা মানুষ এবং শ্রমিকের জীবনের কোন মূল্য নাই। তাকে আইনী ভাবে রক্ষার কোন ব্যবস্থা নাই। এরা সর্বত্রই ‘মফিজ’। এরা বাসে চেপে ট্রাকে চেপে শহর থেকে গ্রামে আসতে বা ফিরতে দুর্ঘটনায় মরে। অনেকে আর ফেরে না। পরিবার তাদের কোন হদিসও আর পায় না। মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পোষাক কারকানার শ্রমিক কিম্বা সর্বহারা নারী যারা নিজের শ্রম বাজারে বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়ে যৌনতা বিক্রি করা ছাড়া পেটের দায় মেটাতে পারে না। স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যৌন সহিংসতা থেকে নারীকে রক্ষা করার কোন দায় রাষ্ট্র বোধ করে না।

‘জীবনের অধিকার’ তথাকথিত বুর্জোয়া নাগরিক ও মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলেও তার প্রয়োগ হয় অসম ভাবে। এই অসমতাকে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ‘বিকার’ না বলে, এটাই রাষ্ট্রের নিয়ম হিসাবে বোঝা দরকার। একদিকে দেশের অধিকাংশ জনগণের জীবনের কোন অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করে না, জনসংখ্যার বৃহৎ অংশই ‘অধিকার’ পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে যায়। অন্যদিকে যারা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়, সাহসের সঙ্গে লড়ে, তারা পুরা ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে বুঝতে না পেরে ব্যাপক জনগনের কাছে পৌঁছানোর শর্টকাট রাস্তা বেছে নেয়। সহজে পৌঁছানো যায় সেই প্রকার মতাদর্শের আশ্রয় নিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা লড়ে। ষাট থেকে আশির দশক ব্যাপী মেহনতি সর্বহারা শ্রেণীর লড়াকু মতাদর্শ গ্রামের গরিব ও সর্বহারাদের আকৃষ্ট করেছে। আশি্র দশকের পর থেকে তা ক্রমে ক্রমে ধর্মীয় মতাদর্শ বিশেষত ইসলামি মতাদর্শের দিকে ঝুঁকেছে। রাষ্ট্র তখনও কমিউনিস্ট ‘জঙ্গী’দের আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন, দমন পীড়নের মধ্য দিয়ে নির্মূল করেছে। আর এখন ইসলামি পন্থি ‘জঙ্গী’দের একই ভাবে আইন বহির্ভূত ভাবে হত্যা, গুম খুন দমন পীড়ন চালাচ্ছে। বিশেষ ফারাক নাই। কমিউনিস্ট হোক কিম্বা ধর্মীয় – স্রেফ মতাদর্শ দিয়ে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজের চিন্তা চেতনায় যে পরিবর্তন ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি করেছে তা বোঝা সম্ভব না। বাস্তবতার প্রতি আমাদের ঘনিষ্ঠ ও নির্মোহ ভাবে তাকাতে হবে। বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের সমাজ এখন একদিকে ‘সেকুলার’ আর অন্যদিকে ‘ইসলামপন্থি’ হয়ে উঠেছে। বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ ছাড়া আগেই মাথার গেঁড়ে রাখা বদ্ধমূল প্রগতির ‘আদর্শ’ কিম্বা ধর্মীয় আদর্শের মানদণ্ড দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির কিছুই বোঝা যাবে না। মোকাবিলা করাও কঠিন হবে। সমাজে বিভকি ও বিভাজনের রাজনীতিই প্রবল হবে।

বাংলাদেশে যে আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে তার মূল কারিগরি হচ্ছে ‘ব্যক্তি’কে আইনের বাইরে স্থাপন করা, আইনের সুরক্ষার বাইরে রাখা। যে মানুষগুলো পাহাড় ধসে মরল, কিম্বা যারা পোশাক কারখানায় জ্যন্ত কবরস্থ হোল, কিম্বা পুড়ে মরল, এরা স্রেফ ‘সংখ্যা’ মাত্র। স্রেফ জীব। নাম নাই, ঠিকানা নাই, সাকিন নাই। ফলে তাদের সুরক্ষার কোন দায় রাষ্ট্রের নাই। আইন থাকলেও রাষ্ট্র আইন করে, কিন্তু প্রয়োগ করে না -- শুধু এই অভিযোগ দিয়ে রষ্ট্রের চরিত্র বুঝব না।ভাবতে হবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার মধ্যেই এমন অনুমান রয়েছে কিনা যার দ্বারা একাংশের জীবন আইনের সুরক্ষা দ্বারা আবৃত আর আরেক অংশ সদাই অনাবৃত। ল্যাংটা। নগ্ন। এমন এক জীব যাকে একালের দার্শনিকরা নাম দিয়েছেন ‘ল্যাংটা জীব’ (bare life) কিম্বা ল্যাংটা জীবন। রাষ্ট্র ও আইনের পোশাক দ্বারা সমাজের বিশাল একটি অংশকে আবৃত না রাখা অস্বাভাবিক নয় মোটেও বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারনার মধ্য দিয়েই এই জনসংখ্যা তৈয়ার হয় যারা সদাই রাষ্ট্রের বাইরে -- রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কিম্বা আইনী পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে যায়। তাদের চাইলেই মারা যায়। মরেও। এর জন্য কারো কোন বিচার হয় না। তারা গুলি খেয়ে মরুক, কিম্বা মরুক পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড় ধসে কিম্বা পোশাক কারখানায়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিভাবে তাদের ‘জনব্যবস্থাপনার কৌশল হিসাবে রাষ্ট্র ও আইন ব্যবস্থার মধ্যে সমাজের বিশাল একটি অংশকে স্রেফ অধিকার হীন নগ্ন, অনাবৃত বা ল্যাংটা জীব হিসাবে পর্যবসিত করে ল্যাংটা জীবের ধারণ চর্চা করে সেটাই একালের দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

একদিকে মালিকানা আর মালিকানা হীনতা দ্বারা বিভক্ত জনগণ। অন্যদিকে আরেক বিভক্তি আমরা দেখি: এক. রাষ্ট্র ও আইনের দ্বারা সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি পাওয়া ‘নাগরিক’ এবং দুই. রাষ্ট্র ও আইনের বাইরে পড়ে থাকা ল্যাংটা জীব, যারা যে কোন সময়েই বর্জ্য হতে পারে। একদিকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা্র মধ্য দিয়ে অধিকারহীন করবার প্রক্রিয়া, অন্যদিকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার কারা আইনী অধিকারের অন্তর্গত, আর কারা বর্জ্য মাত্র।

নতুন বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে শহরে ব্যাপক এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে যারা মনে করে ‘মফিজ’, পাহড় ধসা মানুষ কিম্বা গৃহস্থ ঘরের বাঁধন ছিন্ন ছিটকে বেরিয়ে আসা কারখানার শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করবার কোন দায় তাদের নাই। তারা কাঁটাতারে ‘ফেলানি’কে ঝুলতে দেখে, আবেগে আপ্লূত হয়, হঠাৎ ‘ফেলানি’ বাংলাদেশের ‘নাগরিক’ হয়ে ওঠে, ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ফেলানিকে গুলি করে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়া রাখা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়, কিন্তু পোষাক কারখানার মেয়ে কিম্বা ঢাকা শহরের যৌনতা নামক ‘কাজ’ বিক্রি করে বেঁচে থাকা মেয়েটিও যে ‘ফেলানি’ – তার নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় আইন ও অধিকারের পরিমণ্ডলে বর্জ্য মাত্,র সেটা তারা ধরতে পারে না। দার্শনিকদের ভাষায় ‘ল্যাংটা জীব’ – তাদের অবস্থান আইনের সুরক্ষা কিম্বা নাগরিক ও মানবিক অধিকারের বাইরে, সেটা আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাতিক্রম কিছু নয়। সেটা আমরা সহজে ধরতে পারি না। আমাদের বোঝার দিকটা হতে হবে এই যে কাঁটাতার তথাকথিত আধুনিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, শুধু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নয়। এখানে মফিজ আর ফেলানিদের লাশ নিত্যই ঝুলছে। ‘জীবনের অধিকার' সেখানে এক চরম অট্টহাস্যের ও তামাশার বিষয়।

তাহলে নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা, বৃক্ষনিধন, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত, মাইন বিস্ফোরণ প্রভৃতি কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ব্যাখ্যা করা অতি পরিচিত কিন্তু সীমিত ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা বেকার। এর দ্বারা মধ্যবিত্ত, ধনি বা বড়লোকরা নয়, কেন ‘ছোটলোক’ মরে তার কোন ব্যাখ্যা আমরা পাই না। ‘দুর্ঘটনা’ কেন বাংলাদেশের সংবিধান আইন, নীতি ইত্যাদির দ্বারা রাষ্ট্রের জনসংখ্যার স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে, মোটেও আর ‘দুর্ঘটনা’ নয়, আমরা তা বুঝতে পারব না। এটা ‘নিয়মিত’ ব্যাপারে পরিণত হতে বাধ্য। ভূমিদস্যুদের নির্বিচার ও অবৈধ পাহাড় কাটাকে দোষারোপ করেও রাষ্ট্র ও আইনের এই বিশেষ ‘আধুনিক’ প্রকৃতি বোঝা যাবে না। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী পাহাড় কাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনটির ৬খ ধারায় বলা হয়েছে, “অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া ‘ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাবে না।’ অন্যথা তাকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে [ধারা-১৫(১)]। আসলে ১৯৯৫ সালের মূল আইনে ওই বাধা-নিষেধ ছিল না। পনেরো বছর পর ২০১০ সালের সংশোধনীতে এই প্রকার বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। পরিবেশবাদী ও পরিবেশ আইনবিদদের ধারণা বিদ্যমান ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের মধ্যে ‘আইন’ সংযোজন করে সমাধান হয়ে যাবে, আশা করি তারা উপলব্ধি করবেন যে সেটা হবে না। আধুনিক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার যে বিশেষ কারিগরি গড়ে উঠেছে তাকে সামগ্রিক ভাবে বুঝতে না পারলে এখানে এক টুকরা ঐ খানে আরেক টুকরা আইন দিয়ে কোন ফল লাভ হবে না। আগের চেয়ে পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে, কমে নি।

আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ হয় নি বলে অনেকে আমার কথার আপত্তি তুলতে পারেন। তাঁদের তাহলে ব্যাখ্যা করতে হবে, পরিবেশ আইন ‘অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজন’ কথাটার মানে কি? কে সেই ‘জাতীয় স্বার্থ’ নির্ধারণ করে? পরিবেশ অধিদপ্তর? প্রথমত পুঁজির স্বার্থ রক্ষার বাইরে পরিবেশ অধিদপ্তরের কী এমন ক্ষমতা আছে যে তারা পাহাড়ের গাছ কাটা বন্ধ করতে সক্ষম? আইন কিম্বা প্রশাসনিক ক্ষমতা দিয়ে? অর্থনৈতিক দিক বাদ দেবার পরও আধুনিক রাষ্ট্রের জনসংখ্যাব্যবস্থাপনার যে কারিগরি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে গড়ে উঠেছে, সেখানে মফিজ’ ও ‘ফেলানি’রা মরবেই -- সেটা পাহাড়ের পাদদেশে হোক, বাসের ওপরে বসে কম ভাড়ায় যাতায়তে দুর্ঘটনায় হোক, কিম্বা হোক রানা প্লাজায় বিল্ডিং ধসে পড়ে। কিম্বা ‘জঙ্গী’ বলে যাদের হত্যা করা হয় তারাও আধুনিক রাষ্ট্রের জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার অংশ। কারণ রাষ্ট্র এর দ্বারা বোঝাতে চায় যে শহরের মানুষের – অর্থাৎ ভদ্রলোকদের – যারা রাষ্ট্রের আইনশৃংখলা মেনে চলে --রাষ্ট্রের অনুগত -- তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্যই জঙ্গীদের মারা হচ্ছে।

২৩ জুন ২০১৭। ৯ আষাঢ় ১৪২৪। শ্যামলী।

 

 

 

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।