লেনিনের স্বাস্থ্য ভাবনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতাল


ঈশ্বর বাস করেন বহু উঁচুতে স্বর্গে
জার থাকেন বহুদূরে মস্কোতে’
-- বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার কৃষকদের লোকগীতি

পূর্বকথা

বহু মনীষী পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছেন যুগে যুগে। লেনিন নামে খ্যাত ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ (Vladimir Ilyich Ulyanov: ১৮৭০ – ১৯২৪) তাদের অন্যতম।

পুঁজিবাদী বিশ্বে ১৮৯৫ একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এই বছর বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও কবি সাহিত্যিকদের সম্মানিত করার জন্য আলফ্রেড নোবেল পুরষ্কার তহবিল সৃষ্টি করেছিলেন । এই একই বছর রাশিয়ান ফার্মেসী সোসাইটি স্থাপিত হয়।

১৮৯৫ সন পৃথিবীর পরিবর্তনের সূচনার বছর। সেন্ট পিটার্সবার্গে শ্রমিকদের সংঘটিত করে লীগ অব স্ট্রাগলের মাধ্যমে আন্দোলন এবং দার্শনিক প্লেখানভের (Georgi Plekhanobh: ১৮৫৬-১৯১৮) সাথে যোগাযোগের অভিযোগে ডিসেম্বর ১৮৯৫ তে লেনিন গ্রেফতার হন। শাস্তি হিসেবে আইনের ছাত্র লেনিন ফেব্রুয়ারী ১৮৯৭ পর্যন্ত এক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড; পরে আরও তিন বছর নির্জন বাসের দণ্ড ভোগ করলেন সাইবেরিয়াতে। দণ্ড শেষে ফেব্রুয়ারী ১৯০০ সনে লেনিন ফিরে এলেন সেন্ট পিটার্সবার্গে। নির্বাসন কালে লিখলেন ‘The Development of Capitalism in Russia’ and the Tasks of Russian Social Democrats’ -- যা অচিরে সকল বিপ্লবীর পাঠ্য পুস্তকে পরিণত হয়।

স্মরণ প্রয়োজন যে, জার সম্রাটকে হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে লেনিনের বড় ভাই আলেকজান্ডার ইলিচ উলিনভের ফাঁসি হয়েছিলো ২০ মার্চ ১৮৮৭ তারিখে। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আলেকজান্ডার উচ্চ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বিপ্লব অনিবার্য। আমি মৃত্যু আলিঙ্গনে ভীত নই।’ জার-এর পুলিশের নজর এড়িয়ে এবং ইউরোপের শিল্প বিপ্লবকে সম্যকভাবে জেনে রাশিয়ার কৃষক শ্রমিকদের সংগঠিত করে বিপ্লবের চারণভূমি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৯০০ সনের এপ্রিল মাসে গোপনে লেনিন যাত্রা করলেন ফিনল্যান্ড ও জার্মানী হয়ে সুইৎজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।


Lenin

ডিসেম্বর ১৯১৭ সালে সুৎজারল্যান্ডের Schweizer Illustrierte প্রথম পাতায় বিপ্লবী ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ছবি।


শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে, ঐ একই বছর সুইৎজারল্যান্ডের শিল্প নগরী বাজেল (Basel) শহরে জন্ম নেয় ভবিষ্যতের ফার্মাসিউটিকেলস্ দানব সিবা (CIBA) । বাসেলে আরো রয়েছে ডাচ দার্শনিক এরাসমাসের (Desiderius Erasmus: 1466_1536) সমাধি।

সিবা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫০ সনে সিল্কে রঙ করার রাসায়নিক দ্রব্যাদি উৎপাদনের শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে। ১৯০০ সনে সিবা ফার্মাসিউটিকেলস্ উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করে। ১৯৭০ সনে সিবার সাথে যুক্ত হয় অপর রাসায়নিক প্রতিষ্ঠান জি আর গেইগী (Geigy) । গেইগীর গবেষক পল মুলার মশা নিরোধক ডিডিটি (Dichloro diphenyl dichlorethane: DDT) আবিস্কার জন্য ১৯৪৮ সনে ‘নোবেল পুরষ্কার’ পেয়েছিলেন। ক্যান্সার সৃষ্টিতে সহায়তা করে বিধায় বাংলাদেশ সহ ৪৯টি দেশে DDT ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং অপর ২৩টি দেশে সীমিত ব্যবহারের অনুমতি আছে।

১৯৯৬ সালে সিবা-গেইগীর সাথে একত্রিভূত হয় পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ফার্মাসিউটিকেলস্ কোম্পানী নোভারটিস (Novartis) এবং সুইৎজারল্যান্ডের বৃহত্তম ব্যক্তি মালিকানাধীন ওষুধ কোম্পানী স্যানডোজ (Sandoz) । স্যানডোজ কোম্পানীই মাদক আসক্তির উপাদান LSD (Lysergic Acid Diethylamide)-এর আবিষ্কারক। নেশা বিস্তারের সাথে সাথে গড়ে উঠেছে স্যানডোজের অবৈধ অর্থের ভান্ডার।

কার্টেল প্রথায় বিশ্ব চাম্পিয়ান হফম্যান লা রোস (Hoffman La Roche)-এর ফ্যাক্টরিও বাজেল শহরে অবস্থিত। রোস কোম্পানী সৃষ্টি হয় ১৮৯৬ সনে বিভিন্ন ভিটামিন উৎপাদক বড় কোম্পানী হিসাবে। ১৯৫৭ সনে রোস কোম্পানী বাজারজাত করে স্নায়ু নিস্তেজক এবং অস্থিরতা ও অনিদ্রা নিবারক ভ্যালিয়াম (মূল নাম ডায়াজিপাম) এবং লিবরিয়াম (মূল নাম ক্লোরডায়াজিপক্সাইড)। রোস কোম্পানীই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিকর গ্যাস ডাইঅক্সিনের (Dioxin) আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠান। রোস কোম্পানীর ইটালীর সাভেসো শহরের ফ্যাক্টরীতে ১৯৯৬ সনে দুর্ঘটনায় ভুপালের ন্যায় শতসহস্র নগরবাসী শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং বহু নাগরিক মারাও গিয়েছিলেন।

দীর্ঘদিন ধরে রোস কোম্পানী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিটামিন ও স্নায়ু নিস্তেজক ওষুধের মনোপলি কার্টেল সৃষ্টি করে ব্যাপক হারে আকাশচুম্বী লাভ করেছিলো। এই তথ্য ফাঁস করে দেবার অপরাধে রোস কোম্পানীর ইউরোপীয় ম্যানেজার স্ট্যানলী এডামসের ৭ বছর জেল হয় এবং তার স্ত্রী মর্মাহত হয়ে আত্মহত্যা করেন। বৃটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) কে প্রতারনার দায়ে বিলেতের মনোপলি কমিশন রোস কোম্পানীকে দুই মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা করেছিলো। বাজেল শহরে ৯০০ বিভিন্ন প্রকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন কোম্পানী আছে। সিবা (CIBA) কোম্পানির পুরো নাম (Chemical Industries of Basel), ‘অর্থাৎ বাজেল শহরের কেমিকেল শিল্প সিবা’।

সুইৎজারল্যান্ডে পৌঁছে লেনিন সাময়িক আস্তানা গাড়লেন সুইৎজারল্যান্ড কনফেডারেশনের বর্তমান রাজধানী বার্ণ শহরের প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছোট মিউনিসিপ্যলিটি গ্রাম জিমারওয়ালডে (Zimmerwald) । ছোট দেশ সুইৎজারল্যান্ড ২৬টি প্রদেশ তুল্য কেনটনে বিভক্ত। প্রত্যেক কেনটনের আলাদা রাজধানী আছে, বার্ন কেনটনের রাজধানীও বার্ন। একই সময়ে অপর রুশ বিপ্লবী লিউওন ট্রটস্কী বাসস্থান গড়েন জিমারওয়ালড (Zimmerwald) থেকে ১৬৫ কিলোমিটার দূরে ভিন্ন কেনটন জেনেভা শহরে। সুইৎজারল্যান্ডের নিভৃত গ্রাম জিমারওয়ালডে অস্থায়ী বসতি গড়ে লেনিন তাঁর অখণ্ড অবসরের সদ্ব্যবহার করলেন অধ্যয়ন ও গবেষণায়; অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন সুইস শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনকারীদের জীবিকা ও জীবন যাত্রা, তাদের স্বাস্থ্য ও কর্মদক্ষতা। কয়েকবার জার্মানীও গেলেন, দেখলেন ও বুঝতে চেষ্টা করলেন বিসমার্কের স্বাস্থ্য উদ্যোগ। লেনিন আরও অনুধাবনের চেষ্টা করলেন, পুঁজিবাদী সুইৎজারল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে লব্ধ জ্ঞানের কতটুকু বিপ্লবোত্তর সোভিয়েতের কৃষক শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কাজে লাগানো যাবে।

লেনিন ঘুরে বেড়ালেন এক কেনটন থেকে অন্য কেনটনে, বার্ন থেকে বাজেল, জুরিখ থেকে জেনেভায়। লক্ষ্য করলেন প্রদেশ সম কেনটনের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, প্রায় সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় গণভোটের মাধ্যমে। ছোট দেশ সুইৎজারল্যান্ডের কতক কেনটনের রাজস্ব আসে কৃষি পণ্য ও দুগ্ধজাত দ্রব্য উৎপাদন থেকে যা বাজারজাত হয় সমবায় পদ্ধতিতে। কতক কেনটনে হস্ত শিল্প হিসেবে বিভিন্ন মূল্যের ঘড়ি শিল্পের সমারোহ, কয়েকটি কেনটন একবারে অতি সূক্ষ্ম; অপরদিকে বড় বড় যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন ও নির্মানে ব্যস্ত, দেশবিদেশে রপ্তানীতে নিয়োজিত। কতক কেনটনে বিভিন্ন উন্নত মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা ওষুধের মৌলিক গবেষণা ও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনে নিমগ্ন। জেনেভা কেনটন জাতিসংঘ অফিস আদালতের কেন্দ্রস্থল। তবে সকল কেনটন বিজ্ঞান শিক্ষা গবেষণা এবং শিল্প বিস্তারে সমভাবে উৎসাহী। শিল্প বা কৃষি যা হোক না কেন, সকল শ্রমিক ও কৃষক স্বাস্থ্যবান, স্বাস্থ্যবতী এবং প্রায় নিরোগ। সকল কৃষি শ্রমিক ও অন্যান্য জনগণের জন্য রয়েছে সুলভে স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধা এবং জার্মানীর বিসমার্কের চিন্তার বিপরীতে প্রাইভেট স্বাস্থ্য বীমার মাধ্যমে চিকিৎসা সুবিধা ও ওষুধের প্রয়োজনীয় সরবরাহ।

প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপক প্রসার ও প্রয়োগ দেখে লেনিন বিস্মিত হলেন। লক্ষ্য করলেন, সুইৎজারল্যান্ড ও জার্মানীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সুলভে উন্নত মানের ওষুধ প্রাপ্তি। আশ্চর্যান্বিত হলেন ইউরোপীয় নার্সদের কর্মদক্ষতা ও প্রেরণ দেখে। চমৎকৃত হলেন সুইস ও বৃটিশ নার্সদের ওষুধের ফলাফল সম্পকে জ্ঞান, হঠাৎ মূর্ছিত রোগী ও মানসিক ভাবে উত্তেজিত রোগীকে শান্ত করা কিংবা নাকের রক্তপাত বন্ধ করার দক্ষতা দেখে। নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে লেনিন কয়েকবার সুইস জেনারেল প্রাকটিশনার চিকিৎসক (GP) ও পলি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁর উপলব্ধি হলো, সবাই নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী হবার উপযুক্ত নয়। পরবর্তীতে লেনিন লিখেছিলেন, ‘রোগীর প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন, ব্যবহারে উষ্ণতা, কাজে নিষ্ঠাবান এবং কঠিন অবস্থাতে রুগ্ন অবসন্ন ব্যক্তিদের যন্ত্রনা লাঘবে নিবেদিত ব্যক্তিরাই নার্স হবার উপযুক্ত। চোখ ঝলসানো পোষাক ও অতিরিক্ত অলংকারে সজ্জিত নার্সদের প্রতি রোগীদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা থাকে না। দয়া, সততা ও ভালমন্দ বিচারের শক্তি নার্সের আচরণের মূল কথা।’ বিপ্লবোত্তর সময়ে লেনিন সমাজ ও সাধারণ মানুষকে উপলব্ধির জন্য নার্স, ডাক্তারী ছাত্র, ও স্বাস্থ্যকর্মীদের লিও টলস্টয়, আন্তন চেকভ, ইভান বুনিন, কনস্টানটিন পাউস্তভসকি ও কবি মিখাইল লেরমন্টোভ, ফিওডর তিউৎচেভ, আলেকজান্ডার ব্লক, সারজেই এসেনিন, ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি প্রভৃতি অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন। বিপ্লব পরবর্তীকালে বয়স্কদের প্রতি সহমর্মিতার জন্য লেনিন লিখলেন ‘তাঁরা দেশের মঙ্গলের জন্য নিজেদের যৌবন ও শক্তি ব্যয় করেছেন, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধির জন্য তাদের দান অপরিসীম। তাদের প্রতি অমনোযোগ সোভিয়েত স্বাস্থ্য বিভাগের নীতিবোধের পরিপন্থী।”

লেনিনের বিপ্লবের শিক্ষায় উদ্দীপ্ত সোভিয়েত নার্স ও ডাক্তাররা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে অপরিসীম সাহসিকতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সোভিয়েত সার্জনরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিস্ফোরনের মধ্যেও নার্সদের সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রোপচার করে বহু জীবন বাঁচিয়েছেন। নার্স নাটালিয়া পেসকোভা (পেট্রোভা), নিচিপচুরকেভা পানফিলোভা, আন্না তারান-দিসিট্রিয়েস্কো ও আরও অনেক নার্স নিজেদের জীবনের মায়া অগ্রাহ্য করে বহু বিপ্লবীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

রোগীর আকস্মিক প্রয়োজনে তাসখন্দ ৪নং শিশু পলি ক্লিনিকের মাৎলিউবা ইশানখোদজেভা তাঁর ৪০ বৎসরের নার্সিং জীবনে অসংখ্যবার রক্ত দান করে রুশ জনগণের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।

রুশ বিপ্লবীদের দিগ নির্দেশনার জন্য লেনিন জিমিরওয়ালডে বসবাসকালে ১৯০২ সনে প্রকাশ করলেন ‘What is to be Done?’- ‘কি করিতে হইবে।’

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিপরীতে কি করে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের অধীনে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামালের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞানের ব্যবহার এবং সুলভ মুল্যে বাজারজাত ও সরবরাহের পদ্ধতি কি হবে তা নিয়ে ভাবতে থাকলেন, ছক আঁকলেন নিজ মনে এবং প্রস্তুতি নিতে থাকলেন অচির ভবিষ্যতে কৃষক, শ্রমিক ও সৈনিকের সম্মিলিত বিপ্লবের জন্য।


Lenin

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন: এমন একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি যিনি দোকানে প্রদর্শনীর ফটোগ্রাফ নন, যদিও সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে পড়ার পর অনেকে তা মনে করতেই পারেন। ইতিহাস স্রেফ ঘটনা না, ফলে সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে বলে মানবেতিহাস পুরানা জায়গায় ফিরে যায় নি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প সমাজ গড়বার চিন্তা ও পরীক্ষানিরীক্ষায় বিস্তর সীমাবদ্ধতা ও ভুলত্রুটি রয়েছে, কিন্তু তার আগুন নিভে গিয়েছে ভাবা ভুল, সফলতাও কোন অংশে কম নয়।

অক্টোবর বিপ্লব পৃথিবীব্যাপী যে প্রেরণা জাগিয়েছিল তার ঢেউ বাংলাদেশেও গভীর ভাবে পড়েছিল। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক উদ্যোগ ইত্যাদির মধ্যে তার ছাপ নানাভাবে পড়েছে -- বিশেষত স্বাস্থ্য আন্দোলনে, সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসা সেবা পৌঁছিয়ে দেবার গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ধারণা ও চর্চার মধ্যে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের ভূমিকা বিশেষত ডা. জাফরুল্লাহ্‌ চৌধুরীর ভূমিকা আমরা জানি। মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতাল হিসাবে গড়ে ওঠা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বিখ্যাত ওষুধ নীতি ইত্যাদি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অনায়াসেই উপলব্ধি করতে পারি যে অক্টোবর বিপ্লব নানাভাবে ব্যক্তি ও সমাজকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই দিক থেকে লেখাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অক্টোবর বিপ্লবের একশ বছর উপলক্ষে ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই লেখা বহুজাতিক কর্পোরেশানের বিপরীতে জনগণের স্বাস্থ্য ও জরুরী ওষুধ নিয়ে কিভাবে ভাবতে হবে তার সূত্র আমরা পাব। আশা করি স্বাস্থ্য ও ওষুধ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এই লেখাটি আমাদের আরও ভাবতে ও পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করতে অনুপ্রাণিত করবে। - সম্পাদনা বিভাগ, চিন্তা।


শিল্প বিপ্লবের পরিণতি ও শ্রমিক জীবনে বিপ্লবের প্রভাব মূল্যায়ন এবং বিপ্লবী সংগঠন সৃষ্টির প্রয়াসে পার্টি কংগ্রেসের প্রয়োজনে লেনিন ভ্রমণ করলেন ১৯০৩ সনে ব্রাসেলস হয়ে লন্ডন, ডিসেম্বর ১৯০৫ সনে ফিনল্যান্ডে, যেখানে জোসেফ স্টালিনের সাথে তার প্রথম পরিচয় ঘটে। এই সময়ে লিখলেন ‘Left Wing Communism:An Infantile Disorder’ ১৯০৬ সালে পরিভ্রমণ করলেন সুইডেনের ষ্টকহোম। ১৯০৭ সনের আগষ্ট মাসে যোগ দিলেন জার্মানীর ষ্টুটগার্টে সমাজতন্ত্রীদের সম্মেলনে; ১৯০৮ সনে প্যারিসে প্রকাশিত হয় ‘Notes of an Ordinary Marxist on Philosophy’; ১৯১২ সনে গেলেন প্রাগ, পরে অস্ট্রিয়ার অধীনস্থ পোলান্ডের ক্রাকাওতে। জার্মানী গিয়েছেন বেশ কয়েকবার বিসমার্কের চিন্তার বাস্তবে প্রয়োগ দেখতে। ৫-৮ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ তে অনুষ্ঠিত হয় জিমারওয়াল্ড কনফারেন্স। মুক্তির নির্দেশনা ছিল জিমারওয়াল্ড ইশতেহারে।

জিমারওয়াল্ডে বাস করে লেনিন কেবল সুইৎজারল্যান্ডের কৃষক শ্রমিকদের চিনলেন, জানলেন, তা নয়, মাঠে ময়দানে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি ও দুগ্ধ শিল্প বিকাশ, পরিবার ভিত্তিক অত্যাধুনিক পরিপূর্ণভাবে নির্ভুল আকর্ষনীয় উচ্চ মূল্যের ক্ষুদ্র হাতঘড়ি নির্মাণ ও উৎপাদন এবং বাজারজাত করনে বিশ্ববাজার দখল প্রক্রিয়া দেখলেন। চমৎকৃত হলেন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত মানের ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামালের ব্যাপক উৎপাদন এবং সর্বোপরি উচ্চমূল্যে রপ্তানীর মাধ্যমে ও মনোপলি কার্টেল পদ্ধতিতে কল্পনাতীত লাভে বিশ্ব বাজার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পর্যবেক্ষন করে।

প্রথম মহাযুদ্ধের মূল সময়টা লেনিন কাটালেন সুইৎজারল্যান্ডে। বুঝতে চাইলেন প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শাস্ত্রের পীঠস্থান জুরিখের ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সসের ব্যবস্থাপনা। লেনিন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এই টেকনোলজী ইনস্টিটিউট সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন একাধিকবার। কেবল তাই নয় নিজের বাসস্থান স্থানান্তর করলেন জুরিখে। বিপ্লবোত্তর সোভিয়েতে বিজ্ঞান গবেষণা ও শিক্ষার প্রসারের ভিত্তি ছিল জুরিখ ইনস্টিটিউটের প্রেরণা, বৃহত্তর জনকল্যানে বিজ্ঞানের ব্যবহার করে পুঁজিবাদের বিপরীতে সমাজতন্ত্রের সুফল অর্জন।

এই ইনস্টিটিউটের ২৫ জন ছাত্র শিক্ষক “নোবেল পুরষ্কার” পেয়েছেন। তাদের অন্যতম হচ্ছেন কনরেড রন্টজেন ও আলবার্ট আইনস্টাইন। এরা জুরিখ ইনস্টিটিউটের ছাত্র ও পরে শিক্ষক হয়ে ছিলেন।

৯ জানুয়ারী ১৯১৭ তারিখে একযোগে একসাথে পেট্রোগ্রাড (সেন্ট পিটার্সবার্গ) মস্কো, বাকু ও আরও কয়েকটি শহরে ধর্মঘট ও শ্রমিক বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৬ এপ্রিল ১৯১৭ তারিখে জুরিখ থেকে ট্রেনে লেনিন সেন্ট পিটার্সবার্গের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ৭ অক্টোবর গোপনে সেন্ট পিটার্সবার্গে হাজির হন এবং ১০ অক্টোবর বলশেভিকদের কেন্দ্রীয় কমিটি বৈঠকে বিপ্লবোত্তর সকল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক সরকারের প্রথম ডিক্রি ঘোষিত হয়েছিলো ২৬ শে অক্টোবর ১৯১৭ তারিখে। গঠিত হলো প্রথম সোভিয়েত সরকার। কৃষক হলো সব জমির মালিক, কাউন্সিল অব পিপলস্ কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। লেনিনের জুরিখের জীবন, বন্ধু ক্রুপস্কায়ার সাহচর্য এবং চিন্তা ও অধ্যয়নে হারিয়ে যাবার বিবরণ আছে Lenin in Zurich বইতে।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আমন্ত্রণে তাদের একটি বই সম্পাদনার কাজে আমি কয়েক সপ্তাহ জেনেভাতে ছিলাম। অবসর সময়ে সলঝেনিৎসিনের ‘লেনিন ইন জুরিখ’ বইটি পড়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনি-রোববারে আমি সুইৎজারল্যান্ডে লেনিনকে অবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলাম। পুঁজিবাদী পশ্চিমী জগতের একটি বৈশিষ্ট্য সকল প্রকার ইতিহাস সংরক্ষণ। অথচ জিমারওয়াল্ড বা জুরিখ, কোথাও লেনিন ও ক্রুপস্কায়ার বাসস্থানের কোন ফলক পাইনি। জিমারওয়াল্ড মিউনিসিপাল লাইব্রেরীতে গিয়ে জেনেছিলাম স্থানীয় পত্রিকা ইলাসট্রেটেড সোয়াইটজার (Schweitzer Illustrated) ১৫ ডিসেম্বর ১৯১৭ তারিখে প্রথম পৃষ্ঠায় লেনিনের ছবি সহ একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সুইৎজারল্যান্ডে লেনিনের অজ্ঞাতবাসের তথ্য সহজ প্রাপ্য নয়। তথ্যকন্ঠরোধ পুঁজিবাদের অপর প্রক্রিয়া। আমাদের কমিউনিস্ট বন্ধু ও ইতিহাসের ছাত্ররা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন।

সুইৎজারল্যান্ডে অবস্থান কালে লেনিন পড়াশুনা করেছেন বিস্তর, লিখেছেন অনেক বই ও নির্দেশিকা, ভ্রমণ করেছেন ইউরোপের দক্ষিণ থেকে উত্তর, পূর্ব থেকে পশ্চিম। ১৯২২ থেকে ১৯২৪ এর মধ্যে লেনিন কয়েক বার পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বিপ্লবোত্তর সোভিয়েতে চিচিৎসা নিয়েছেন সোভিয়েত চিকিৎসকদের কাছে। তাকে সেবা দিয়েছেন বিপ্লবী সোভিয়েত নার্সরা। তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডন, জেনেভা বা হাইডেলবার্গ ছুটে যাননি। চিকিৎসা নিজ দেশে নিয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রতিষ্ঠার প্রধান নায়ক লেনিন ২১ জানুয়ারী ১৯২৪ সনে গর্কি শহরতলীতে দেহত্যাগ করেন এবং সমাহিত আছেন মস্কোর রেড স্কয়ার সমাধি ভবনে।

বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দরা কি কখনও জ্ঞান চর্চা করেছেন ? লিখেছেন কি কিছু ? যা বক্তৃতায় বলেছেন তা বিশ্বাস করেছেন কি ? সামান্য অসুখেও ছুটে গেছেন পশ্চিমের দেশে, নিদেন পক্ষে পূর্বে ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুর। কমিউনিস্ট নেতারা ছুটে গেছেন ভারতে। অসুস্থাবস্থায় বিপ্লবি নগেন সরকার চিকিৎসা নিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। মৃত্যুর পূর্বে বিপ্লবী নেতা তোয়াহার নিকট তার একটি আবেদন ছিল, তাকে চীনে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর জন্য। নেতাদের কথা ও কাজে মিল নেই বলে দেশ ও জনগণের সার্বিক উন্নয়ন সুদূর পরাহত। খ্যাতনামা সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি প্রশ্ন করেছিলেন জাতির এক বিখ্যাত নেতাকে - ‘তিনি কোন কোন বই পড়ে বেশী আনন্দ পেয়েছেন, কোন বই বা জীবনী পড়ে রাজনীতির পথ স্থির করেছেন’? উত্তরে নেতা দম্ভভরে বলেছিলেন, ‘আমার বই পড়তে হবে কেন, আমার বই পড়ার সময় কই? আমাকে নিয়ে সবাই বহু বই লিখবে।” তাঁর ভবিষ্যত বাণী সত্য হয়েছে।

সোভিয়েত বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য চর্চার সাথে পরিচয়

১৯৫৭ সনে আমি ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে বছর পৃথিবীতে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিলো।

৪ অক্টোবর ১৯৫৭ রাতে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রেরন করলেন পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক’। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো দুই ফুটের কম ব্যাসার্ধের ১৮৪ পাউন্ড ওজনের মানুষের তৈরী উপগ্রহটি প্রতি দেড় ঘন্টায় পৃথিবী পরিভ্রমণ করছে। দ্বিতীয় স্পুটনিক মহাকাশে পৌঁছলো জানুয়ারী ১৯৫৮ তে। পরপরই মার্কিন বিজ্ঞানীরা তাদের সেটেলাইট এক্সপ্লোরার মহাকাশে পাঠালো ৩১ জানুয়ারী ১৯৫৮ তে।

ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের কোন ডাক্তার ছাত্র উচ্চ শিক্ষার জন্য সোভিয়েত রাশিয়া যাবার চিন্তা করতো না। মনে করা হতো স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রাশিয়া অনুন্নত দেশ। আমাদের দেশের নবীন ডাক্তাররা সুযোগ পেলেই ছুটতো বৃটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমাদের মেডিকেল কলেজের পাবলিক হেলথের কারিকুলামের কোথাও পড়ানো হতো না যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ উত্তর বৃটিশ যুক্তরাজ্যে শ্রমিক দলের মার্কসীয় কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী ওয়েলসের কয়লাখনির শ্রমিক সন্তান এবং নিজেও কয়লাখনির শ্রমিক এন্যুরিন বিভান স্বাস্থ্য মন্ত্রী নিযুক্ত হবার পর পরই ১৯৪৮ সনে বৃটেনের সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জাতীয়করণ করে বৃটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেস (NHS)-এর পত্তন হয়েছিলো সারা দেশের সকল শ্রেণীর জনগণের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। বিলেতের এই যুগান্তকারী ব্যবস্থা প্রবর্তনের ত্রিশ বছর পূর্বে লেনিন সবার জন্য পানি, পয়:ব্যবস্থা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত করে সবার জন্য স্বাস্থ্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯১৭ সনে। সর্ব সোভিয়েত নার্সেস ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় একই সনে লেনিনের অপর ডিক্রিতে। পরবর্তী বৎসর ১৮,০০০ বিপ্লবী নার্স এই সংঘটনের সদস্য হন।

সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ১৯১৮ সালে জনগণের পাবলিক হেলথ কমিশন গঠনের মাধ্যমে। এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন প্রখ্যাত চিকিৎসক ও সমাজ বিজ্ঞানী নিকোলাই সেমাসকো Nicolai Semashko) । অধ্যাপক সেমাসকো উচ্চারণ করেছিলেন “নার্সদের সিসটার (Sister) ডাকেন, কারণ নার্সরা কেবল স্বাস্থ্যকর্মী নন, তারা একই ঘরের লোক এবং পরমাত্মীয়।” ডিক্রি বলে যক্ষা, টাইফয়েড, টাইফাস সহ সকল সংক্রামক রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সকল ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীদের চাকুরীর জাতীয়করণ করা হয়। অসংক্রামক রোগের ব্যাপক গবেষণা অগ্রাধিকর পায়। সকল স্থানে সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ক্রমে ক্রমে স্থাপিত হয়। অনেক গুলো জরুরী বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানমূলক (Epidemiology) ইনস্টিটিউট এবং মেডিকেল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয়করণ করা হলো সকল ফার্মেসী ও ওষুধ শিল্প, যুক্ত হলো ওষুধ সৃষ্টির জন্য ব্যাপক গবেষণা। জুরিখ ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স টেকনোলজী এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং আদলে বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা। রশ্মি ও সুক্ষ্ম ক্যামেরার মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরে চিকিৎসা প্রচেষ্টার জন্য আবিষ্কৃত হলো শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ কর্তন ও সংযোজনের দ্রুত সেলাই যন্ত্র।

একজন রুশ শৈল্যবিদ (Surgeon) ১৯৬৩ সনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাতের তালুতে রাখা যায় এরূপ একটি ছোট সেলাই যন্ত্র ব্যবহার করে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে একজন রুশ নার্স নিয়ে প্রায় পুরো পাকস্থলী কেটে বাদ দিয়ে অন্ত্রীর নীচ থেকে জেজুনাম এনে সংযুক্ত করে ক্যাটগাট ও সিল্ক দিয়ে সেলাই করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের বিস্ময়াভূত করেছিলেন।

সেদিনের দর্শকদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। সোভিয়েত চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে এই আমার প্রথম পরিচয়। লেনিন ও বলশেভিকদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সকল শ্রেণীর মানুষকে, স্কুলের ছাত্র, দমকল বাহিনীর কর্মী, পুলিশ, নার্স, ল্যাবরটরী কর্মী, দাঁত বাঁধাই কর্মী, যানবাহন চালক, সেনাবাহিনীর সদস্য ও গোটা জনসাধারণকে বাধ্যতা মূলকভাবে প্রাথমিক জরুরী চিকিৎসার বিষয় গুলো শিখিয়ে পরীক্ষা নিয়ে সনদ দেবার পদ্ধতির প্রচলন।

 বলশেভিক বিপ্লবের সময় ১৯১৭ সনে সোভিয়েতের মোট চিকিৎসকদের প্রায় ৪০% মস্কো শহরে বসবাস করে প্রাকটিস করতেন। অধিকাংশ পল্লী ও উপশহরে গুটি কতক চিকিৎসক ছিল। এসব এলাকায় কদাচিত চিকিৎসক দেখা যেতো।

১৯৭১ সনে বাংলাদেশের চিত্র ঠিক এরূপ ছিল !

লেনিন নতুন ডিক্রি বলে গ্রামের অধিক সংখ্যক ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের সুযোগ করে দিলেন। স্কুল কলেজের পরীক্ষায় উচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির চেয়ে জনগণের সেবায় যাদের আকর্ষণ আছে, তারা বিনা টিউশন ফিতে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের সুযোগ পেলো। অধিকাংশ ছিল পল্লী ও নিভৃত জনপদের কৃষক-শ্রমিকের সন্তান। মেডিকেল প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ভর্তির সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ৬০,০০০ অতিক্রম করলো। জোসেফ স্ট্যালিনের সময়ে এই সংখ্যা ৭৬,০০০ এ উন্নীত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বৎর পরও, বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজে ভর্তির সংখ্যা ১০,০০০ অতিক্রম করেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর কৃষক শ্রমিকের বিপ্লব এক কথা নয়। চিকিৎসার মান কোন অংশেই ইউরোপের পশ্চাতে নয়। যক্ষা আক্রান্ত শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামালয় স্থাপিত হলো সকল শহরে। ১৯২৫ সনের মধ্যে ইয়াল্টাতে কৃষক ও তার পরিবারের বিনোদন কেন্দ্র স্থাপিত হলো। কেবল মেধা নয়, সেবার মনোবৃত্তির প্রমাণ রাখতে হতো ধাপে ধাপে গ্রাম থেকে উপশহরে, উপশহর থেকে শহরে সকল শ্রেণীর অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে। সেবা চিকিৎসকের উন্নতির মান নিয়ামক।

চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জনগণের প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে একটি আইন আছে। সেই আইনে বলা আছে ‘পেশাদারী কর্তব্য পালনে অবহেলা এমনিতেই দণ্ডনীয় অপরাধ যদি না সেটা ফৌজদারী আইনে সোপর্দনীয় হয়।”

পলি ক্লিনিকের ডাক্তাররা (পশ্চিমা জগতের ‘GP’ সমতুল্য) প্রয়োজনে বাসায় গিয়ে রোগীর চিকিৎসা দেন, আকস্মিক বিপদজনক অসুখে বা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে বা আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি বা রেফারেলের প্রয়োজন আছে কিনা সিদ্ধান্ত দেন। ‘সর্বত্যাগী পরিশ্রম ও রোগীদের প্রতি সীমাহীন ভালবাসার জন্যই সোভিয়েত চিকিৎসা কর্মীরা সর্বজনের শ্রদ্ধার পাত্র এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত সরকারের যত্ন পরিবেষ্টিত। উল্লেখ্য যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে মেডিকেলে সকল চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা দান হয় বিনা খরচে। নিয়মিত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ রয়েছে। পল্লী বা অবহেলিত জনপদের চিকিৎসক তার প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন না, এবং অগ্রাধিকার পান।’ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে পার্থক্য এখানে।

১৯৬৯ সন ! হফম্যান লা রোসের বিরুদ্ধে বৃটিশ মনোপলি কমিশনের শাস্তি বিধানের সম্ভবত: পরের বছর। বিলেতের ‘ দ্য অবজার্ভার পত্রিকার সামনের পৃষ্ঠায় এক খবরে ইংলিশ স্কটিশ চিকিৎসকগণ এবং কমনওয়েলথ দেশসমূহ থেকে উচ্চ শিক্ষার কামনায় আগত ডাক্তাররা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে জানলো যে, তারা যে বৃটিশ ও আমেরিকান ওষুধের উন্নত মানের গর্ববোধ করে তা বৃটেন বা আমেরিকায় উৎপাদিত নয়। প্রায় সকল কাঁচামাল উৎপন্ন হয়েছে পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত ব্লকের ছোট সমাজতন্ত্রী দেশসমূহে। বৃটেনের গর্ব আই.সি.আই (Imperial Chemical Industries) এর টেরামাইসিন (মূল নাম টেট্রাসাইক্লিন) বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ফার্মাসিউটিকেলস্ কোম্পানী ফাইজারের পেনিসিলিন ও অন্যান্য এন্টিবায়োটিক সমূহ ট্রান্সফার প্রাইসিং পদ্ধতিতে সমুদ্রের মাঝপথে উৎপাদক দেশের নাম বদলে ‘USA’ তকমা লাগিয়ে বৃটেন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রেসক্রিপসন বাণিজ্য করছে এবং চিকিৎসকদের বোকা বানাচ্ছে। ট্রান্সফার প্রাইসিং পুঁজিবাদের অন্যতম প্রতারণা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ওষুধ কোম্পানী ফাইজার এজিথ্রোমাইসিনের আবিষ্কারক নয়। ফাইজার মাত্র একলাখ ডলার দিয়ে শ্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রীয় ওষুধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের আবিস্কৃত এজিথ্রোমাইসিনের বিশ্বের সকল দেশে বাজারজাতকরনের স্বত্ব কিনে প্রথম বছরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশ যুক্তরাজ্যে বাজারজাত করে এক বিলিয়ন ডলারের অধিক লাভ করেছিলো। পরবর্তী বছর গুলোতে একই লাভের হার বহাল ছিল। বলিহারী পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা!! ওষুধ শিল্পের প্রকৃত সূতিকাগার বৃটেন বা আমেরিকা নয়, মূল ওষুধ অর্থাৎ ওষুধের কাঁচামাল উৎপন্ন হয় সমাজতন্ত্রী দেশসমূহে। এই সত্য মেনে নিতে বৃটেনের চিকিৎসকদের ভয়ানক মানসিক যাতনা হয়েছিলো।

এলো ১৯৭১ সন। রুশ বিপ্লবের ৫৪ বৎসর পর।

মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতাল

বৃটেনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েসনের পক্ষ থেকে আমি ও ডাক্তার এম এ মবিন ১৯৭১ সনের মে মাসে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা পৌঁছলাম। জেনারেল ও ভাসকুলার সার্জারী আমার জীবিকা। মবিনের রয়েছে অর্থোপেডিক ও কার্ডিয়াক সার্জারীর অভিজ্ঞতা। আমি পাশ করেছি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে, মবিন ঢাকার ছেলে কিন্তু পাশ করেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে।

আগরতলায় সাক্ষাত পেলাম মেজর জিয়ার, যিনি শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার মুখে শুনলাম সে দিনগুলোর কথা। দেখা পেলাম মেজর শফিউল্লাহ, মীর শওকত আলী, নুরুল ইসলাম শিশু এবং আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ক্যাপ্টেন শওকত আলীর।


Field Hospital

ত্রিপুরারা 'মেলাঘর'-এ 'বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল' বা মুক্তিযুদ্ধ হাসপাতাল হিসাবে পরিচিত ঐতিহাসিক হাসপাতালের দুটি দুষ্প্রাপ্য ছবি।


মেজর খালেদ মোশাররফ আমাদেরকে নিয়ে গেলেন রণক্ষেত্রে। দেখালেন কি করে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ইমামুজ্জামানরা ফেনীর বিলোনিয়া দখলে রেখে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীয়মান রেখেছেন। কমান্ডো মেজর এটি এম হায়দার কিশোর তরুনদের গেরিলা যুদ্ধের টেকটিকস প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, ক্যাপ্টেন মাহবুব, গাফফার, লেফটেন্যান্ট হারুন, হুমায়ুন কবির, জয়নুল অনেকের সাথে পরিচয় হলো। বিভিন্ন সাবসেক্টরে আহত মুক্তি যোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রস্তাবে খালেদ মোশাররফ বললেন, ‘দশজন আহত হলে আমি তখনি একশত গেরিলা পাঠাতে পারি, আরও ৫০০ জন রেডি আছে। আমার ডাক্তার দরকার নেই, আমার প্রয়োজন গানস্ এন্ড বুলেটস্।’ আপনারা বিলেতে ফিরে যান, অর্থ সংগ্রহ করুন, IRA-এর সাথে যোগাযোগ করুন, চেকোশ্লোভাকিয়ায় যান, অস্ত্র যোগাড় করে পাঠান। ভারত আমাদের চাইনিজ অস্ত্রের বদলে তাদের অস্ত্র দিচ্ছে সীমিত সংখ্যক।’

কয়েক দিনের মধ্যে  গেরিলা যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লো, আহতের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চললো। তখন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী ও প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ পূর্ব সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ফিল্ড হাসপাতাল তৈরীর নির্দেশ দিলেন, কিছু অর্থ সাহায্য করলেন। মূল টাকার যোগান দিলো বৃটেনস্থ বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েসনের সদস্যরা। তবে বিলেতের রেষ্টুরেন্টের সিলেটী সাধারণ কর্মচারীরা তাদের আয়ের তুলনায় চিকিৎসকদের চেয়ে অনেক গুন বেশী অর্থ নিয়মিত দান করেছেন। বুড়ী বাড়ীওয়ালীর চোঁখ ফাঁকি দিয়ে এক রুমে তিন শিফটে পালা করে দশজন বাস করে অর্থ সঞ্চয় করে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দিয়েছেন। সীমান্ত সংলগ্নে মেলাঘরে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের দেহরক্ষী হাবুল ব্যানাজীর আনারস বাগানে স্থাপিত হলো ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। পুরোপুরি বাংলাদেশী ডাক্তার ও স্বাস্থ্য সেবিকা পরিচালিত।

খোঁজ নিয়ে দেখলাম পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় ৫০০০ চিকিৎসক থাকলেও ভারতে এসেছে দেড় ডজন চিকিৎসক, অধিকাংশই তরুন। একজন সিনিয়র শল্য চিকিৎসক, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক এম এন দত্ত FRCS ভারতে এসে কলকাতাতে প্রাইভেট প্রাকটি জাঁকিয়ে বসেছেন। অপর FRCS ডা.টি হোসেন প্রবাসী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব নিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের নার্সদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিন্দু ও খ্রিষ্টান। খ্রিষ্টান নার্সরা দেশত্যাগ করেনি। হিন্দু নার্স যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছেন, তারা প্রাণ ভয়ে ভীত, সীমান্তের ফিল্ড হাসপাতালে কাজ নিয়ে পুনরায় বিপদের সম্মুখীন হতে রাজী নন।

কেবল সার্জন দিয়ে হাসপাতাল চলে না, বিশেষত: রণাঙ্গণের হাসপাতাল। প্রস্তাব দিলাম বিলেত থেকে নার্স আনার জন্য। ওসমানী সাহেব সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিলেন, বললেন, ‘বৃটিশ নার্সেস আর দি বেষ্ট।’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি বার্মার রণাঙ্গনে আহত হয়েছিলেন। সেবা দিয়ে তাকে বৃটিশ নার্স সুস্থ করে তুলেছিলেন। সে কথা তিনি ভুলেন নি। কিন্তু বাদ সাধলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন। তিনি বললেন, রণাঙ্গনের হাসপাতালে বিদেশী নার্স নিয়োগ ঠিক হবে না। কারণ সমরে ও প্রেমে সব কিছু নিয়ম মেনে চলে না বরঞ্চ সত্যই জয়ের প্রধান বাধা।

বিকল্প পথের সন্ধান নিতে হলো। অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী অনেক ছাত্র ইউনিয়ন নারী কর্মীদের নিয়ে আগরতলায় আর্ট এন্ড ক্রাফটস হোষ্টেলে অবস্থান করছিলেন। সাক্ষাত করে বললাম, ‘আপনি রণক্ষেত্রে নার্সেস বিগ্রেড তৈরীর দায়িত্ব নিন।’ উত্তরে বললেন, ‘তাদের ভিন্ন পরিকল্পনা আছে, তারা নির্দেশের অপেক্ষায় আছেন।’ উপলব্ধির চেষ্টা করলাম Left Wing Communism: An Infantile Disorder এর মর্মার্থ। হতাশার মাঝে মনে পড়লো লেনিনের অমোঘ বাণী- ‘কি করিতে হইবে’? ‘বিপ্লব সাজানো বাগান নয়, কর্ষন করে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হয়। প্রশিক্ষণে কৃষক শ্রমিক পরিনত হয় বিপ্লবের সৈনিকে, তরুণী হয় সিসটার, পরমাত্মীয় নার্স’। দীর্ঘ তিন বছর হাসপাতাল চত্বরে সাদা পোশাকে ভূষিত হয়ে প্রশিক্ষণের চেয়ে উষ্ণ ব্যবহার ও কঠিন অবস্থাতে রুগ্ন আহত ব্যক্তির যন্ত্রণা লাঘবে নিবেদিত ব্যক্তিই নার্স হবার উপযুক্ত। চোখ ঘুরাতেই নজরে এলো শত শত নার্স হবার মন মানসিকতার তরুণী। খুঁজে বের করা হলো আধা ডজন ফাইনাল ইয়ারের এমবিবিএস ছাত্র, শ’খানেক কিশোরী তরুণী দশম শ্রেণীর ছাত্রী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো ২-৪ সপ্তাহের, শেখানো হলো ‘সেবা, সহমর্মিতা ও দয়াশীল আচরণ,’ পরিচিত হোল কতক সাধারণ মেডিকেল যন্ত্রপাতির সাথে, অতি সর্তকতার সাথে শিখলো যন্ত্রপাতি নির্বীজকরন পদ্ধতি ও ওষুধ সহকারে ড্রেসিং করা এবং আরও জানলো খান তিরিশেক অতি প্রয়োজনীয় সহজ প্রাপ্য ওষুধের গুণাবলী, ব্যবহার ও ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাশ টঙ্গীর ডা. নাজিম উদ্দিন আহমদ আগরতলার জিবি হাসপাতালে চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪৮০ বেডের বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান অবেদনকারীর (Anaesthetist) দায়িত্ব নিলেন। শত শত আহত মুক্তিযোদ্ধা সেবা পেয়েছে এই হাসপাতালে। অনেকের বুকের পাঁজর থেকে গুলি বের করে আমরা জীবন বাঁচিয়েছি। আহত মেজর খালেদ মোশাররফের প্রাথমিক চিকিৎসা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালেই হয়েছিল। পরে তাঁকে লক্ষ্মী সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীল সার্জনরা কুমিল্লার তরুন মুক্তিযোদ্ধা বাহারের পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। ডা: মবিনের চিকিৎসা এবং গীতা, ইরা, পদ্মা, আসমা, রেশমার যত্নে বাহারের টুকরো হয়ে যাওয়া নিম্নাঙ্গ এখনো অক্ষুন্ন আছে। স্বাধীনতা উত্তর কালে বাহার একবার কুমিল্লা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

শেষ কথা: পুঁজিবাদের অন্তিম শয্যা না সমাজতন্ত্রের উদরে প্রবেশ ?

লেনিন মনোনীত পাবলিক হেলথ কমিশনার অধ্যাপক নিকোলাই সেমাসকোর মূলমন্ত্র ছিলো অগনিত সিসটার নার্স ও বহু চিকিৎসক নিয়োগ, শহর গ্রামে দ্রুত বহু হাসপাতাল নির্মাণ এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৃষ্ট ও সহজলভ্য হাসপাতাল সেবা। লক্ষনীয়, চীনের মাও সে তুংগ এর স্বাস্থ্য চিন্তা ধারার সাথে লেনিনের স্বাস্থ্য ভাবনার পার্থক্য।

আশির দশকের মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চারগুন বেশী চিকিৎসক ও হাসপাতাল শয্যা সৃষ্টি হলো।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়ায় প্রতি ১০০০ জন লোকসংখ্যার জন্য ছিল ৯.৩ টি শয্যা যা OECD দেশসমূহের দ্বিগুণ। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল মোট ছয় লাখের বেশী চিকিৎসক এবং ১৩ লাখ নার্স, শহরে প্রতি ২২৭ জন লোক সংখ্যার জন্য একজন চিকিৎসক, গ্রামে ৮৩৩ জন লোক সংখ্যার জন্য একজন চিকিৎসক। অর্থাৎ গ্রাম ও শহরে স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য বেড়েছে। সার্বজনীন জাতীয় স্বাস্থ্যবীমা থাকা সত্ত্বেও বড় শহরের ৫% অবস্থাপন্নরা প্রাইভেট স্বাস্থ্যবীমা কিনছেন। রাশিয়ায় প্রাইভেট স্বাস্থ্যবীমার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন, মেডসি, সোগাজ, এলিয়েন্স, রেসো-গ্রানতিয়া ও আলফা ষ্ট্রাকহোবানি। জার্মান কোম্পানী ফ্রেসেনাস বিকল কিডনীর চিকিৎসা ডায়ালাইসিসের পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে।

লেনিন ও নিকোলাই সেমাসকোর স্বপ্ন কি পর্যদুস্ত হয়েছে ? ৯২ বৎসর সময়ের ব্যবধানে।

মস্কোর রেড স্কযার সমাধি ভবনে শায়িত কমরেড লেনিন ওরফে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ কি ভাবছেন ?

সম্ভবত: ইটালিয়ান সাংবাদিক টিৎজিয়ানো টারজানীর ‘Goodnight Mister Lenin’ অধ্যয়নের এখন উত্তম সময়

১০ অক্টোবর ২০১৭। ২৫শে আশ্বিন ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

[লেখাটি অক্টোবর বিপ্লবের একশ বছর উদযাপন উপলক্ষ্যে রচিত]

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।