অর্থশাস্ত্রের দার্শনিক চাবি: ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’


মার্কস পাঠের ক্ষেত্রে এই সাধারণ ভুলটা মার্কস অনুসারী কিম্বা মার্কস বিরোধী প্রায় সকলেই করে থাকেন যে মার্কস দর্শন থেকে প্রস্থান করেছেন। বাংলাদেশে এর অতিশয় স্থূল মানেও আছে। সেটা অনেকটা এরকম যে মার্কস বলেছেন, চিন্তাভাবনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা করবার সেটা এ যাবতকাল দার্শনিকরা করেছেন। দর্শনচর্চা বা তত্ত্ব গিরি করা বিপ্লবীর কাজ নয়। এখন কাজ হচ্ছে দর্শন বা চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে শুধু বিপ্লব করা। মার্কস সম্পর্কে এই ধারণা যে একদমই ভুল সেটাই আমরা এখানে আলোচনা করব।

এরপর মার্কসের অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণার সঙ্গে আমরা পরিচিত হব। সেটা হচ্ছে মানুষ ও জগতের ‘ইন্দ্রিয়পরায়ন মানবিক ব্যবহারিক চর্চা’ (practical, human sensuous ativity) বা সংক্ষেপে ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’।

ল্যুদভিগ ফয়েরবাখের বস্তুবাদ সমালোচনা করতে গিয়ে মার্কস ফয়েরবাখ সংক্রান্ত পাঁচ নম্বর থিসিসে এই ধারণার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বলছেন:

“ফয়েরবাখ বিমূর্ত চিন্তায় সন্তুষ্ট নন বলে চিন্তামগ্নতা চান; কিন্তু তিনি ইন্দ্রিয়পরায়নতাকে ব্যবহারিক, ইন্দ্রিয় পরায়ন মানুষের তৎপরতা বলে ধরতে পারেন না” (Marx, 1974, p. ৪২২) -- গুরুত্বারোপ মার্কসের।

ফয়েরবাখ দর্শনকে শুধু দর্শন দ্বারা পর্যালোচনা করবার জন্য আরও চিন্তামগ্ন হতে চান, কিন্তু তিনি জগতের সঙ্গে মানুষের ইন্দ্রিয় পরায়ন ব্যবহারিক সম্বন্ধ ধরতে পারেন না। জগত তো শুধু চিন্তার বিষয় নয়; জগতের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ নিছকই চিন্তার নয়, বরং একই সঙ্গে দৈহিক, শারীরিক বা ইন্দ্রিয়পরায়ন সম্পর্ক। যে কারণে ইন্দ্রিয়, চেতনা, বুদ্ধি আবেগ, কল্পনা ইচ্ছা অভিপ্রায় ইত্যাদি সামগ্রিক বৃত্তি নিয়েই আমরা জগতের সঙ্গে নিত্য ব্যবহারিক সম্বন্ধে সক্রিয় হই। কিন্তু ফয়েরবাখসহ বস্তুবাদীরা জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধকে সামগ্রিক ভাবে বিচার ও বুঝতে অক্ষম। এই সম্বন্ধের ‘ব্যবহারিক’ দিক তারা ধরতে পারে না। দেখা যাচ্ছে ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ মার্কসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। মার্কস বলছেন:

“এ পর্যন্ত যে সকল বস্তুবাদ দেখা যায় -- যার মধ্যে ফয়েরবাখেরও অন্তর্ভূক্ত – তাদের মূল সমস্যা হোল বস্তু , বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়পরায়নতাকে ধারণা করা হয়েছে কেবল বাইরে হাজির বিষয় বা ধ্যান রূপে, কিন্তু মানুষের ইন্দ্রিয়পরায়ন তৎপরতা, চর্চা হিসাবে – অর্থাৎ কর্তার সক্রিয়তার দিক থেকে নয়” (Marx, 1974, p. ৪২১) । -- গুরুত্বারোপ মার্কসের।

ফয়েরবাখ ‘তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গী’ বা দার্শনিক বিচারকেই একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গী বলে মেনেছেন, কিন্তু সকর্মক কর্তার সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার দিকটা বোঝেন নি।

দর্শন বা জ্ঞানচর্চার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে জ্ঞানকর্তা (Subject) হিসাবে একদিকে মানুষ আর জ্ঞানের বিষয় (Object) হিসাবে অন্যদিকে জগতের হাজির হওয়া। ‘জগত’ কথাটা আমরা এখানে ব্যবহার করছি বাংলাভাষায় সাধারণত কথাটা যেভাবে আমরা ব্যবহার করি সেই অর্থে: মানুষ যা কিছু তার বাইরে ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধি বা বুদ্ধির বিষয় হিসাবে হাজির দেখে। অধিকাংশ সময় আমরা জগত আর প্রকৃতি অদল বদল করে ব্যবহার করি। কিন্তু জগতের সঙ্গে গম্‌ বা গমনের সম্বন্ধ আছে যে কারণে জগতের আরও গভীরতর অর্থ হচ্ছে যা কিছু গমনশীল, সতত গমন যা করছে, ইত্যাদি।

দর্শন প্রায়শই মানুষের বুদ্ধির দ্বারা বিচারের বিষয়ে পর্যবসিত হয়। কিন্তু মানুষ শুধু বুদ্ধিসর্বস্ব প্রাণী নয়। বুদ্ধি মানুষের ইন্দ্রিয়জাত উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতাকে জানা, বোঝা বা জ্ঞানে রূপান্তরিত করে। মার্কসের আগে ইম্মেনুয়েল কান্ট তাঁর ‘বিশুদ্ধ বুদ্ধির পর্যালোচনা’ (Critique of Pure Reason) গ্রন্থ শুরুই করেছেন একথা বলে যে আমাদের সকল জ্ঞানের শুরু হয় ‘অভিজ্ঞতা’ থেকে। তিনি প্রশ্ন করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির কাজটা আর কিভাবেই বা শুরু হতে পারত যদি না জগত আমাদের ইন্দ্রিয়ের ওপর সক্রিয় হয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়োপলব্ধি প্রদান (representation) না করত? ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ভেঙেচুরে আলাদা আলাদা শনাক্ত ও বাছবিচার করা বুদ্ধির কাজ; তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দাঁড় করালেই আমরা জগত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করি; এরপর তিনি বলছেন “যদি কালানুক্রমিক’ভাবে বিচার করি অভিজ্ঞতার আগে কোন জ্ঞান নাই এবং অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের সকল জ্ঞানের শুরু” (Kant, 1964, p. ৪১)। কান্ট ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন।

বলা যায় জগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয় পরায়ন মানবিক ব্যবহারিক চর্চাজাত উপলব্ধিকে কাঁচামালের মতো প্রক্রিয়াজাত করা বুদ্ধির কাজ। বুদ্ধির কারখানায় কিভাবে সেই কায়কারবার ঘটে তারই ব্যাখ্যার বই হচ্ছে ‘বিশুদ্ধ বুদ্ধির পর্যালোচনা’। ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কহীন ভাবে বুদ্ধি নিজের প্রক্রিয়া নিজে বোঝার চেষ্টা করতে পারে, নিজের কায়কারবার পর্যালোচনা করে বুদ্ধির নিয়মনীতি বিধিবিধান আবিষ্কার বা সংবিধিবদ্ধ করবার চেষ্টাও বুদ্ধি করতে পারে। কিন্তু বুদ্ধির বিধিবিধান বা নিয়মের বাইরে বুদ্ধিকে যদি ভুল বিষয়ের ওপর আমরা খাটাতে চাই তাহলে আমরা ভুল করব। বুদ্ধি যখন নিজের সীমা অতিক্রম করে এবং নিজের এখতিয়ার ও সামর্থ্যের বাইরের বিষয়ে নাক গলায় কান্টের কাছে তার নাম ‘পরাবিদ্যা’ (Metaphysics)। কেন? কারন, সেই ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রমকারী বুদ্ধি যাই বলুক তার সত্যমিথ্যা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আর যাচাই করা সম্ভব হয় না। সেটা হয়ে ওঠে ‘অশেষ তর্কবিতর্কের যুদ্ধক্ষেত্র’; যেমন, ‘আল্লাহ’, ‘আত্মা’, ইত্যাদি (Kant, 1964, p. ৭)।

মার্কস ছিলেন আইনের ছাত্র। তরুণ বয়সে জর্মান দার্শনিক হেগেলের দ্বারা তুমুল প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ দর্শন যেভাবে নিছকই দার্শনিক বিষয় হিসাবে বিচার  করছিল তরুণ বয়সেই মার্কস সেই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। এটা একই সঙ্গে পরাবিদ্যা থকে বেরিয়ে আসার প্রয়াসও বটে। হেগেলের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে দর্শনের শক্তি ও সীমাবদ্ধতা দুটোই টের পেয়েছিলেন। লুদভিগ ফয়েরবাখের পর্যালোচনা করতে গিয়ে মার্কসের পরাবিদ্যা পরিহারের চেষ্টা স্পষ্ট হতে শুরু করে। তাঁর সময়ের ‘জর্মান ভাবাদর্শ’ – বিশেষত তরুণ ইয়ং হেগেলিয়ানদের দর্শন চর্চার সীমাবদ্ধতাও তাঁর চোখে পরিষ্কার ধরা পড়তে শুরু করে। দর্শন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তিনি মানুষ ও জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধের ধারণা তরুণ বয়সেই গড়ে তুলছেন, পরিণত বয়সে যা ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ নামক ধারণায় রূপ নিয়েছিলো। অবশেষে যা অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা হিসাবে তাঁর বিখ্যাত ‘পুঁজি’, ‘উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব’ ইত্যাদি নামে প্রকাশিত হয়।

পাশ্চাত্য দর্শন মানুষের বৃত্তিকে মটামুটি তিন ভাগে বিচার করে। প্রথমত ইন্দ্রিয়বৃত্তির জায়গা থেকে, দ্বিতীয়ত বুদ্ধির বিচার, তৃতীয়ত বুদ্ধির কায়কারবার বা ব্যাকরণকে বুদ্ধির নিজেরই পর্যালোচনা। প্রতিটি বৃত্তিকেই আলাদা আলদা করে বিচারের ধারা রেনে দেকার্তের সময় থেকেই গড়ে ওঠে। মার্কসে এসে আমরা একটা ছেদ লক্ষ্য করি। সেতা হোল জগতের সঙ্গে মানুষের সামগ্রিক সম্বন্ধ বিচার করতে হলে মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধকেও মানুষের সকল বৃত্তির সামগ্রিক পরিসর থেকে বিচার দরকার। জগতের সঙ্গে মানুষের ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ চর্চাকে তাহলে শুধু ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হিসাবে কিম্বা নিছিক বুদ্ধিজাত জ্ঞান ভাবলে চলবে না, বরং জগতের সঙ্গে সমগ্র মানুষের সক্রিয় ও সজীব সম্বন্ধ হিসাবেই বুঝতে হবে। এখানেই তরতাজা ধারণা হিসাবে ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ নামক শব্দবন্ধ ও ধারনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য। এখানে সেই বিষয়েই আমরা আলোচনা করব। ধারনাটি স্পষ্ট বুঝতে পারলে আমরা অনুধাবন করব যে মার্কস কিভাবে দর্শন – বিশেষত পরাবিদ্যা থেকে বেরিয়ে এসেও মূলত দর্শনকেই আরও বৃহৎ পরিসরে স্থাপন করেছেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা দর্শনের অনিবার্য ক্ষেত্র হিসাবে হাজির হয়েছে: অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা আসলে দার্শনিক পর্যালোচনারই অন্তর্গত। এটাও আমরা বুঝব যে মার্কস দর্শন থেকে প্রস্থান করেছেন কথাটি আজ অবধি নিতান্তই রটনা হিসাবে রয়ে গিয়েছেন। এই রটনার মীমাংসা হওয়া দরকার।

মার্কসের ‘দর্শন’থেকে প্রস্থান!

দর্শনের দরকার নাই, এখন শুধু দরকার বিপ্লব এই রটনার একটা ভাল দিক হচ্ছে খামাখা বুলি কপচানো বাদ দিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলাবার কাজে নেমে পড়ার প্রণোদনা তৈরি করা। কিন্তু এর খারাপ দিকটা মারাত্মক। সেটা হচ্ছে আমাদের আর নতুন কোন চিন্তাভাবনার দরকার নাই, নতুন কোন জিজ্ঞাসা তা যতোই গুরুতর হোক তা নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নাই। মার্কসকে এভাবে ব্যাখ্যা করার ফলে এক প্রকট চিন্তাহীনতা ‘মার্কসবাদ’ নামে গড়ে ওঠে। দার্শনিক চিন্তা বা পর্যালোচনা নিন্দনীয় ব্যাপার হয়ে ওঠে এবং দার্শনিকতা মাত্রই ‘ভাববাদ’ হিসাবে তিরস্কৃত হতে শুরু করে । পরিণতিতে ‘মার্কসবাদ’ ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে বদ্ধ চিন্তার আধুনিক নজির। যারা মার্কসকে ভালভাবে বুঝতে চেয়েছেন তারা চলতি ‘মার্কসবাদ’ দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে মার্কসের চিন্তার পর্যালোচনা জরুরি মনে করেছেন। মার্কসকে পর্যালোচনার মধ্য বৈপ্লবিক জিজ্ঞাসাকে আরও অগ্রসর করে নেবার কাজ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে ‘মার্কসবাদ’ নামক চিন্তার বন্ধ্যাত্ম থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হয়েছে। এতে ‘সরকারি’ মার্কসবাদ বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে বটে, কিন্ত চিন্তার আর দরকার নাই এখন কাজ খালি বিপ্লব করা --এই ধরণের স্থূল চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হয়েছে। মার্কস জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ যেভাবে বিচার করেছেন তাতে চিন্তা ও তৎপরতাকে আরও বিস্তৃত পরিসরে বিচার করবার ক্ষেত্র ধীরে ধীরে পরিগঠিত হয়ে উঠছে।

পরাবিদ্যা বা জর্মান দর্শনের বিমূর্ত পরিমণ্ডল থেকে মার্কস বেরিয়ে গিয়েছেন বটে, কিন্তু দর্শন – অর্থাৎ চিন্তার সক্রিয় ও সজীব পরিমণ্ডল থেকে মার্কস কখনই প্রস্থান করেন নি। ধর্ম, দর্শন বা চিন্তা জগতে বাস্তবিক ভাবে কিভাবে বিরাজ করে মার্কস তা বুঝতে চেয়েছেন। সেটা বুঝতে চাওয়ার অর্থ হচ্ছে মানুষের সঙ্গে বাস্তব জগতের ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ বিচার বা পর্যালোচনা করা। সেই ব্যবহারিক সম্বন্ধই চিন্তা ও চিন্তার ইতিহাস নির্ণয় করে, মধ্যে ধর্ম ও দর্শন দুটোই যার অন্তর্গত। চিন্তাশীল রক্তমাংসের বাস্তব মানুষের সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ বিচারের দিকেই মার্কস ধর্ম ও দর্শন উভয়েরই অভিমুখ ফেরাতে চেয়েছেন। এতে, বলা যায়, মার্কসের মধ্য দিয়ে ধর্ম ও দর্শন বিমূর্ত পরিমণ্ডলে না থেকে আরও জাগতিক এবং আরও বাস্তব হয়ে উঠেছে। মানুষের চিন্তা, বাসনা ইচ্ছা অভিপ্রায়কে বিমুর্ত বা পারলৌকিক গণ্য না করে মানুষের সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ রচনা ও চর্চার আলোকে এখন উভয়কেই আমরা বিচার করতে পারি।

পারলৌকিকতা আসলে জাগতিক ব্যাপার, মোটেও পরলোকের রহস্য নয়, কারন জগতে বসেই এবং জগতে থেকেই আমরা পরলোক নিয়ে ভাবি -- জগতের সঙ্গে নিত্য বৈষয়িক সম্বন্ধে যুক্ত থেকেই মানুষ ধর্ম ও দর্শন নিয়ে ভাবে, ভাবনাচিন্তা করে, সেই অনুযায়ী কাজ করে। জগতের সঙ্গে মানুষের সেই ব্যবহারিক নিত্যসম্বন্ধ কিভাবে চিন্তার রূপ ও মর্ম নির্ণয় করে তা বিচার করবার জায়গায় মার্কস দর্শনকে উন্নীত করেছেন। কিন্তু একে তিনি আর দর্শন বলেন নি, বলেছেন জাগতিক ভাবে বিরাজ করবার বাস্তবতা পর্যালোচনা। আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্য দিয়ে মানুষ যেভাবে টিকে থাকে তার পর্যালোচনা। আর মানুষ তো স্রেফ দেহ সর্বস্ব জিনিস নয়, মানুশ চিন্তো করে এবং তার বিবিধ সৃষ্টিশীল কর্ম তৎপরতা আছে। ফলে মানুষ যে রূপেই ভাবুক – হোক তা ধর্মতাত্ত্বিক, কাল্পনিক, নান্দনিক কিম্বা দার্শনিক – জগতের সঙ্গে মানুষে সম্বন্ধ চর্চার ধারা বুঝলে সেই সকল ভাবনার আবির্ভাব ও হাজির থাকবার জাগতিক শর্ত ও কারণ ব্যাখ্যার একটা বিজ্ঞান আমরা হাতে পাই।

ধর্মের বা দর্শনের সত্য ঠিক না বেঠিক সেটা কখনই মার্কসের মুল তর্ক ছিল না। দেশকালপাত্র ভেদে মানুষ ধর্ম দর্শন রাজনীতি সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে যেসব কথা বলে সেই সব বলার পেছনে জারি থাকা জাগতিক শর্ত ও বাস্তবতা উন্মোচনই মার্কসের প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক বিজ্ঞানের কাজ। মানুষ আর জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ উন্মোচন করতে গিয়েই তিনি ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ নামক ধারণা তৈরি করেছেন। অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে মার্কস যার ভিত্তি গেঁড়ে দেবার জন্য বাকি জীবন কাটিয়েছেন।

মার্কসের পর ‘দর্শন’ চর্চা আর আগের মতো রইলনা, চিন্তাকে পরাবিদ্যা সম্পর্কে সজ্ঞান হতে হয়েছে; পরাবিদ্যা থেকে মুক্ত না হয়ে বা নিদেন পক্ষে সতর্ক না থেকে দর্শন চর্চা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ধর্মের তাৎপর্য মার্কসের পর শুধু পারলৌকিক রইল না, বরং তার ধর্মের ইহলৌকিক ভূমিকা এবং তার ঐতিহাসিক বিচার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। আস্তিকতা/নাস্তিকতার তর্ক মার্কসে গৌণ তর্কে পর্যবসিত হোল। কারণ উভয়ই প্রকার সিদ্ধান্তই মানুষের চিন্তা থেকে জাত অতএব আস্তিক কি নাস্তিক -- চিন্তার জাগতিক কারণ ব্যাখ্যা করাই আসল কাজ। সেই জাগতিক কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে জগতের ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ বিচারই মৌলিক কাজ বলে গণ্য হোল। জাগতিক কারণে ধর্ম বিপ্লবী ভূমিকা পালন করতে পারে, এবং স্রেফ জাগতিক কারণেই ‘মার্কসবাদ’ হয়ে উঠতে বিপ্লবের প্রধান প্রতিবন্ধক। তাহলে বাস্তবে ধর্ম বা মতাদর্শ কী ভুমিকা পালন করছে তার বিচার ছাড়া কে প্রগতিশীল আর কে প্রতিক্রিয়াশীল এই ফতোয়াবাজি নিরর্থক। একটি সমাজে মানুষের বৈষয়িক বা আর্থ-সামাজিক ‘বর্তমান’ অবস্থার বিচারটাই সে কারণে নির্ধারক। এই বিচার দার্শনিক বিচার, নিছকই অর্থনৈতিক বিবেচনা নয়। ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি কিভাবে জাগতিক ভাবে বিরাজ করে এবং এতোকাল করে এসেছে তা ব্যাখ্যা করবার দায় এখন মার্কসের পর খোদ দর্শনের ঘাড়েই এসে পড়েছে। তাই মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ বিচার ছাড়া বা অন্য কথায় অর্থশস্ত্রীয় বিচার ছাড়া দর্শন কথাটার আর কোন মানে দাঁড়ায় না।

রক্তমাংসের মানুষই দর্শন চর্চা করে। দর্শন হাওয়াই কায়কারবার নয়। তাহলে দর্শন জাগতিক ভাবে কিভাবে বিরাজ করে তা বুঝিয়ে ব্যাখ্যা করতে হলে দর্শনকে অবশ্যই মানুষের সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধের প্রতি নিবিষ্ট হতে হবে। সেই সম্বন্ধ পর্যালোচনা ও জানার মধ্য দিয়েই দর্শনের আত্মোপলব্ধি ঘটে। দর্শন বুঝতে শেখে কিভাবে জাগতিকতা মানুষের চিন্তার মধ্যে – চিন্তার রূপ বা মর্মে অভিব্যাক্ত হয়। দর্শন তখন আর স্রেফ বুদ্ধির বিমূর্ত চর্চা হয়ে থাকে না, জাগতিক হয়ে ওঠে।

দার্শনিক ভাবনা বা চিন্তা করার মানে কী? মানুষ যখন চিন্তা করে তখন চিন্তার ‘কর্তা’ হিশাবে মানুষ নিজেকে একদিকে আর অন্যদিকে চিন্তার ‘বিষয়’ হিশাবে জগত বা প্রকৃতিকে স্থাপন করে। দার্শনিক চিন্তাও চিন্তার এই সাধারণ চরিত্র থেকে আলাদা নয়। দর্শনের আদিতেও রয়েছে জগতকে এই রকম দুই ভাগে ভাগ করে ভাবনা এবং মানুষ ও জগতের দ্বিবিভাগ অনুমান করে চিন্তার ‘কর্তা’ এবং চিন্তার বিষয়’-এর মধ্যে সম্বন্ধ নির্ণয়। মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ মার্কসের আগে জর্মান দর্শনের পরিমণ্ডলে নিছকই দর্শনের বিষয় হিসাবে হাজির হয়েছিল, মার্কস তরুন বয়সের রচনায় – বিশেষত ‘জর্মান ভাবাদর্শ' নামক খসড়ায় তারই পর্যালোচনা করেছেন।

এই সম্বন্ধ বিচার করতে গিয়ে তরুন বয়সেই মার্কসের প্রাথমিক ও প্রধান আবিষ্কার হচ্ছে মানুষ ও মানুষের বাইরের জগত নিছকই ভাবাভাবির বা দার্শনিক সম্পর্ক নয়, বরং একটা বাস্তব ব্যবহারিক সম্পর্ক, যা পরবর্তীতে পরিণত রচনায় মার্কসের ভাষায় ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ নামে পরিচিত। তাহলে চিন্তার কাজ হচ্ছে এই জাগতিক বাস্তবতা – মানুষের সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধকে চিন্তার বিষয় হিসাবে সামনে হাজির করা। মানুষ কিভাবে বাঁচে তার হদিস নেওয়া।

দ্বিতীয়ত আমরা যখন ভাবি বা চিন্তা করি তখন বাস্তব জগতের সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক সম্বন্ধ কিভাবে চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে সেই জিজ্ঞাসা জারি রাখা মার্কসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তা কোন হাওয়াই ব্যাপার নয়। রক্তমাংসের জাগতিক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে চিন্তা নিজেকে জারি রাখে। জাগতিক উপস্থিতির যে বৈষয়িক কায়কারবার তার মধ্য দিয়েই চিন্তা বিরাজ করে। মার্কস চিন্তাকে রক্তমাংসের জাগতিক বাস্তবতা দিয়ে – মানুষের সঙ্গে জগতের নিত্য ব্যবহারিক সম্পর্কের জায়গা থেকে বিচার করবার কথা বললেন। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে এটা ছিল বিশাল বিপ্লব।

দর্শনের দিক থেকে দেখলে একে পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত কিন্তু দুই প্রকার বিপ্লব বলা যায়।

এক. চিন্তার প্রথাগত অভ্যাসে বিপ্লব। চিন্তা অভ্যাসের বশে নিজেকে সাধারণত শুধুই জ্ঞানের কর্তা হিসাবে ভাবে এবং জগতকে নিছকই চিন্তার বিষয়ে পর্যবসিত করে। অথচ চিন্তা যে নিত্য চিন্তার বাইরে সদা উপস্থিত জাগতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত সেটা চিন্তার নজরে থাকে না। সেই বাস্তবতার পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকে বলেই জীবিত মানুষ চিন্তা করতে পারে, চিন্তা সেটা খেয়াল করে না। এই পাটাতন বা জাগতিক বাস্তবতা চিন্তার দ্বারা তৈরি হয় না, বরং মানুষ জগত নিয়ে চিন্তা করবার আগেই জগত পয়দা হয়ে আছে, আর রক্তমাংসের চিন্তশীল জীব হিসাবে মানুষ বাস্তব জগতে জীবিত আছে বলেই চিন্তা করতে পারে।

এই সহজ সত্য, বিস্ময়কর মনে হলেও, পাশ্চাত্য দর্শনে মার্কসই শক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ চিন্তা হাওয়াই বা আসামনি কোন ব্যাপার না, বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষের প্রতিভা। তাহলে মানুষ ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, কিম্বা তার বাইরের জগত – অথবা আমরা সাধারণত যেভাবে বলি – মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক কথাটার মানে হচ্ছে (ক) মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বাস্তবিক বা জাগতিক সম্বন্ধ এবং একই সঙ্গে (খ) চিন্তার বিষয় হিসাবে বিষয়ীর অর্থাৎ চিন্তার কর্তার সম্পর্ক। প্রথম সম্পর্ক মার্কসের ভাষায় উৎপাদন সম্পর্ক। অর্থাৎ যে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের এবং প্রজাতি হিসাবে মনুষ্য প্রজাতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন সম্পন্ন করি। সেই সম্পর্ক চর্চার মধ্য দিয়েই মানুষ ‘ইতিহাস’ হয়ে ওঠে। মার্কসের কাছে তাই ইতিহাস হচ্ছে উৎপাদন সম্পর্কের বিবর্তন, কিম্বা সামগ্রিক ভাবে উৎপাদনের ইতিহাস। দ্বিতীয় সম্পর্ক জ্ঞানতাত্ত্বিক সম্পর্ক হিসাবে পরিচিত; এই ক্ষেত্রে সম্পর্ক চর্চা সাধারণত ‘দর্শন’ নামে অভিহিত হয়।

দুই. দ্বিতীয় বিপ্লব হচ্ছে এই দুই প্রকার সম্পর্কের মধ্যে সম্বন্ধ বিচার। অর্থাৎ কিভাবে উৎপাদন সম্পর্ক চিন্তাকে এবং চিন্তা আবার উৎপাদন সম্পর্ককে প্রভাবিত ও নির্ণয় করে তার সম্বন্ধ বিচার।

মার্কসের এই দার্শনিক বিপ্লব স্পষ্ট ভাবে প্রথম ধরা পড়ে ‘জর্মন ভাবাদর্শ’ নিয়ে তাঁর আর এঙ্গেলসের খসড়া পাণ্ডুলিপিতে, যা তাদের জীবদ্দশায় তাঁরা প্রকাশ করতে পারেন নি। দর্শন বা দর্শন চর্চা কথাটার মানে কী? দর্শন চর্চার মানে হচ্ছে চিন্তার ‘কর্তা’ হিশাবে মানুষ নিজেকে একদিকে রেখে অন্যদিকে জগত বা প্রকৃতিকে চিন্তার ‘বিষয়’ গণ্য করে জগতকে বোঝা, জানা, বিশ্লেষণ করা বা এক কথায় বিচার। ‘জর্মন ভাবাদর্শ’ পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে বিকশিত দার্শনিক পর্যায়। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে জর্মান ভাবাদর্শের ভাবাদর্শিক মূল্য অপরিসীম। কিন্তু মার্কস আর এঙ্গেলস ‘জর্মন ভাবাদর্শ’-এর পর্যালোচনা আমাদের দেখায় যে চিন্তার বিষয় আর বিষয়ীর সম্পর্ক নিছকই দার্শনিক সম্পর্ক নয়, একই সঙ্গে উৎপাদনের সম্পর্কও বটে। জর্মন দার্শনিকদের জিজ্ঞাসার মীমাংসা অতএব স্রেফ চিন্তার পরিমণ্ডলে সম্ভব না। বরং তাঁদের জিজ্ঞাসার উৎপত্তি, জিজ্ঞাসার ধরণ এবং মীমাংসার অভিমুখ উৎপাদন সম্পর্ক এবং তার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত।

এতোকাল ভাবা হোত চিন্তার পরিমণ্ডলে আমরা যে সকল অনুমান ও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি এমনকি চিন্তার যে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণ করি সেইসব বুঝি চিন্তার দ্বারাই পুরাপুরি বোঝা সম্ভব। মার্কস পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝি আসলে তা ঠিক না, চিন্তাকে বুঝতে হলে চিন্তার বৈষয়িক বাস্তবতাও আমাদের আমলে নিতে হবে। উভয়ের সম্পর্ক বিচারের মধ্য দিয়েই দেশ, কাল ও পাত্র ভেদে চিন্তার অনুমান, প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্তের অর্থ আমরা বুঝব। নইলে বুঝব না, কিম্বা সেই বোঝাবুঝি অস্পষ্ট বা একপেশে হবে।

এটা ভাববাদ এবং বস্তুবাদের ঝগড়া নয়। কারণ ‘বস্তু’ কিম্বা ‘ভাব’ দুটোই চিন্তার নির্ণয়; কাকে আমরা ‘বস্তু’ বলি, কিম্বা ‘ভাব’ বলি সেটা চিন্তাই ঠিক করে দেয়। এটা বরং যে জাগতিক বাস্তবতায় বিশেষ বিশেষ চিন্তার উৎপত্তি ও রূপ পরিগ্রহণ সেই বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে সেই বিশেষ বিশেষ চিন্তার ব্যাখ্যা ও বোঝার ব্যাপার।

কথাটা রটল কেন?

দর্শন থেকে মার্কসের প্রস্থান কথাটা যেভাবে জারি রয়েছে সেটা অতএব ঠিক নয় কিন্তু কথাটা এতো রটে যাবার কারন কি? মার্কসের নিজের লেখার মধ্যে এ ধরনের কথা জারির কোন সূত্র আছে কিনা তার হদিস নেওয়া যাক। আসলে সেই সূত্র রয়েছে ফয়েরবাখ সংক্রান্ত মার্কসের এগারো নম্বর থিসিসে। সেখানে মার্কস ঘোষণা দিয়ে বলেছেন:

‘দার্শনিকরা বিস্তর জগত ব্যাখ্যা করেছেন, এখন কাজ হচ্ছে বদলে দেওয়া”। (গুরুত্বারোপ মার্কসের)

মার্কসকে যারা সরাসরি পড়েননি,এমনকি পড়বার প্রয়োজনও বোধ করেননি, তারাও মার্কসের এই ঘোষণার কথা জানেন, কিন্তু জানেন বেশ স্থূল ভাবে। এতে মার্কস সম্পর্কে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে মার্কস দর্শন বিরোধী মাথামোটা লোক। যিনি খালি বিপ্লব চান। তাই তিনি দার্শনিকদের দোষারোপ করে বলেছেন দার্শনিকরা এতোদিন জগৎ খালি ব্যাখ্যাই করেছে, আসলে দরকার তাকে বদলে দেওয়া। অথচ অতি তরুণ বয়সে এই ঘোষণা দেবার পরেও মার্কস জগত ব্যাখ্যার দায় এক মূহূর্তের জন্যও পরিহার করেননি। এটা বলেননি যে এখন আমাদের আর কোন কিছুর ব্যাখ্যা, বর্ণনা, বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনার দরকার নাই। এখন শুধু ধরো তক্তা, মারো পেরেক। এই বিশ্ববিখ্যাত ঘোষণার পরও, ক্রমাগত তাঁর লেখালিখি চালিয়ে গিয়েছেন, এবং তাঁর বিখ্যাত ‘পুঁজি’ গ্রন্থ ছাড়াও আরো বিস্তর লেখালিখি করেছেন। লেখালিখি করতে গিয়ে লেখালিখির ধরনেও বদল ঘটিয়েছেন মার্কস। লেখালিখিকে তিনি ঠিক ব্যাখ্যা, বর্ণনা বা বয়ান না বলে একে চিন্তার সজীব বা জীবন্ত ব্যবহারিক ক্ষেত্র গণ্য করলেন। লেখালিখির একটা বিশেষ চর্চার ধারা গড়ে উঠল। এই ধারা ‘ক্রিটিক’ বা ‘পর্যালোচনা’নামে খ্যাত। পর্যালোচনার এই প্রেরণা তাঁর আগের ও সমসাময়িক জর্মান দার্শনিকদের কাছ থেকেই পাওয়া। এই প্রসঙ্গে ইম্মেনুয়েল কান্টের বিশুদ্ধ বুদ্ধির বিচার (Critique of Pure Reason) গ্রন্থ সহ অন্যান্য পর্যারোচনামূলক চিন্তার নজির আমরা দিতে পারি। পর্যালোচনার ধারা কান্টের পর হেগেল হয়ে এবং ইয়ং হেগেলিয়ানদের হাত ধরে প্রথমে ফয়েরবাখে এবং পরে মার্কসের হাতে আরো বিকশিত হয়েছে।

এই সংকল্প বা ঘোষণা থেকে জগত বদলে দেবার গুরুত্ব আমরা বুঝি সহজেই। কিন্তু চিন্তার জগতকেও মার্কস জগতের বাইরের কোন ব্যাপার গণ্য করেন নি,জগতেরই বিষয় গণ্য করেছিলেন, সেই দিকটা সাধারণত নজরে আনা হয় না। আজ অবধি, বলা যায়, তা নজরের বাইরেই থেকে গিয়েছে। চিন্তা বদলে দেওয়া মার্কসের বিপ্লবী সংকল্পের-অর্থাৎ জগতকে বদলে দেওয়ার সংকল্পেরই অন্তর্ভুক্ত। একটির বিকল্প অন্যটি নয়।

চিন্তা করার মানে নিছকই ‘মত’ প্রকাশ করা নয়। যদি চিন্তা ও বাস্তবতাকে আমরা আলাদা দুটো জগত অনুমান করি তাহলে কেন বিশেষ সময়ে, বিশেষ কালে বা বিশেষ অবস্থায় বিশেষ একটা মত দানা বাঁধলো, প্রকাশিত হোল,আধিপত্য বিস্তার করলো তাকে আমরা বুঝবো কিভাবে? তাকে চিন্তার ভেতর থেকে শুধু নয়,-চিন্তার বাইরে হাজির বাস্তব জগতের বাস্তবিক অবস্থার আলোকেও বিচার করতে হবে – মার্কস আমাদের এটাই বুঝিয়েছেন। বিদ্যমান মতাদর্শগুলোর সমালোচনা-পর্যালোচনা শুধু নয়,বরং যে-জাগতিক অবস্থা, সম্পর্ক বা বাস্তবতার মধ্যে আমরা চিন্তা করি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি বা মত প্রকাশ করি সেই জাগতিক সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিচার করতে হবে। জগত বদলানোর মানে শুধু বস্তু জগত বদলানো নয়, চিন্তার জগতেও বদল ঘটাবার দরকার আছে। বদলটা বাইরের যেমন দরকার,তেমনি ভেতরেও জরুরি- আর দুটো মিলেই ‘জগত বদলানো’ কথাটার মানে দাঁড়ায়। মার্কসের কাছে যার অর্থ বৈষয়িক বা বাস্তবিক ভাবে বর্তমান থাকার অবস্থার বদল। জগত বদলানো মানে যেমন শুধু চিন্তার বদল হতে পারে না,ঠিক তেমনি চিন্তার বাইরে হাজির জগত বদলানোও শুধু নয়। বরং দুটোই। দুটো নিয়েই জগত। মানুষ আর জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ বদলাবার মামলা। দুইয়ের সম্বন্ধ বদলানোর অর্থ জগত এবং জগত সম্পর্কে মানুষের ধ্যানধারণার ক্ষেত্রেও বদল ঘটা।

মার্কস দর্শন থেকে প্রস্থান করেছেন এটা তাহলে একান্তই রটনা। বলা যায় ‘মার্কসবাদী’ রটনা, এই রটনার আসলে কোন ভিত্তি নাই। দর্শনের সঙ্গে অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনার সম্বন্ধ না বোঝার অজ্ঞতা থেকেই এই রটনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই দিকটি অস্পষ্ট থাকার কারনে মার্কসকেও দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা এখন রেওয়াজ হয়ে উঠেছে। এক ভাগে রয়েছে দার্শনিক মার্কস আর আরেক ভাগে আছে অর্থশাস্ত্রবিদ মার্কস -- যিনি ‘পুঁজি’ রচনা করেছেন বা অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আধুনিক পুঁজিতান্ত্রি্ক ব্যবস্থার চরিত্র আমাদের বুঝিয়েছেন। এমনভাবে দুইজন মার্কস হাজির হয়েছেন যাতে মনে হয় তারা দুইজন দুই ভিন্ন ব্যাক্তি। অথচ কার্ল মার্কস একজনই আছেন।

দুই মার্কসকে এক ও অভিন্ন ভাবা এই সময়ের সবচেয়ে বড় দার্শনিক ও ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ বটে।

দর্শন চর্চার মানে বদলে দেওয়া

এটাও তাহলে বুঝতে হবে যে মার্কসের আগে দার্শনিকদের কাছে দর্শনচর্চার যে মানে ছিল মার্কস তা বদলে দিয়েছেন। এই যে বিভাজন – একদিকে চিন্তাশীল দর্শন চর্চাকারী মানুষ বা জ্ঞানচর্চার কর্তা, আর অন্যদিকে চিন্তা, জ্ঞান বা দর্শনের বিষয় হিশাবে মানুষের বাইরের ইহলৌকিক জগত বা প্রকৃতি – এই দ্বিবিভাগকে মার্ক প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন। মানুষের জগৎ নিছকই বস্তুতান্ত্রিক জগত নয়, একই সঙ্গে আচার, সংস্কৃতি, ভাষা, পারলৌকিক বিষয়াদি কিম্বা আলৌকিক প্রসঙ্গও অন্তর্ভূক্ত। ‘জগত’ বলতে বোঝায় যা তাৎক্ষণিক ভাবে চিন্তার বিষয় হিসবে আমাদের সামনে হাজির হয়। এই সম্বন্ধের মধ্যে থেকেই দার্শনিকরা চিন্তা করেছেন, বা চিন্তার চর্চা হয়েছে। চিন্তার কর্তা (Subject) ও চিন্তার বিষয়ের (Object) এই সম্বন্ধের মধ্যেই নানান চিন্তা চেতনা দর্শন বিদ্যা বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে। একদিকে চিন্তাশীল ‘মানুষ’ অন্যদিকে মানুষের চিন্তার বাইরে হাজির থাকা চিন্তার বিষয় হিশাবে ‘প্রকৃতি’ বা পারলৌকিক ও অলৌকিক বিষয়াদি। চিন্তাভেদে আমরা ‘জগৎ’,‘প্রকৃতি’ ‘বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’ নিয়ে যেমন ভাবি,তেমনি অতীন্দ্রিয় ‘বিষয়’ নিয়েও চিন্তা করি। চিন্তার ‘বিষয়’ যে শুধু ইহলৌকিক হবে তা নয়, তা হতে পারে আল্লা, ঈশ্বর, নীতিনৈতিকতা, রাষ্ট্র, ভাল, মন্দ কিম্বা দর্শনের বিমূর্ত কোন বর্গ, গণিত, জ্যামিতি-ইত্যাদি। যা দেশকালপাত্রে আছে তা যেমন চিন্তার বিষয় হতে পারে, যা নাই --যা দেশকালপাত্রের অতীত --তাকেও চিন্তা তার ‘বিষয়’ নির্ণয় করতে পারে। চিন্তা তার সম্মুখস্থ প্রকৃতিকে যেমন ‘বিষয়’ করে, তেমনি ‘বিষয়’ করতে পারে যা তার সামনে হাজির নাই, কিম্বা কখনই হাজির করা যাবে না - এমন ‘বিষয়’-কেও। চিন্তা যে কোন বিষয়ের সত্য নিশ্চিত বা নির্ণয় করবার জন্য তাকে চিন্তার সামনে ‘হাজির’ করে। সেই উপস্থিতির একদিকে চিন্তার ‘কর্তা’ রূপে মানুষ, অন্যদিকে চিন্তার ‘বিষয়’ হাজির থাকে -- উভয়ের এই সম্বন্ধের মধ্যে চিন্তার চর্চা বা দর্শনের যে ধারা বহাল ছিল মার্কসের হাতে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে।

মার্কসের আগে -- বিশেষত জর্মান ভাবাদর্শিক দর্শনের মধ্যে একদিকে চিন্তা (Subject) আর অন্যদিকে চিন্তার বিষয় (Object) --এই দ্বিপাক্ষিক সম্বন্ধের মধ্যেই চিন্তার জানা, বোঝা ও পর্যালোচনা চলছিল। প্লেটো থেকে হেগেল অবধি বিকশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই সম্বন্ধ চর্চার প্রধান ধরন ‘দ্বান্দ্বিক’ চিন্তা পদ্ধতি হিশাবে পরিণতি লাভ করে। এই সম্পর্কের ঐতিহাসিক ধরন যাই হোক, কিম্বা তার পরিণতি যেখানেই এসে দাঁড়াক, মূল কথা হচ্ছে ইহলৌকিক, পারলৌকিক বা অলৌকিক ‘জগত’ বা বিষয় হিশাবে মানুষ যা কিছুই ভাবছিল সেই ভাবাভবি সীমাবদ্ধ ছিল চিন্তারই সংকীর্ণ জগতে। অর্থাৎ মানুষ ও তার চিন্তার বিষয়ের সঙ্গে ‘সম্বন্ধ’ চর্চার প্রক্রিয়া ও বৈশিষ্ট্য জানা, বোঝা ও বিচার চলছিল দর্শনে, যা সাধারণত ‘ভাবাদর্শ’ নামে মার্কসবাদে পরিচত। কিন্তু সেটা কম শক্তিশালী ছিল না। কান্ট হেগেল হয়ে জর্মানিতে শক্তিশালী উপ্সথিতি ছিল। চিন্তার অনুমান, পদ্ধতি, প্রকরণ ও সিদ্ধান্তের এক সমৃদ্ধ দর্শনচর্চার ধারা হাজির ছিল মার্কসের সামনে। সেইসব নিয়ে মার্কস লেখালিখি করেছেন তরুণ বয়স থেকেই।

কিন্তু মার্কসের অবদান বোঝার দিক থেকে যে দিকটা আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য নির্ধারক সেটা হচ্ছে ‘সম্বন্ধ’ : চিন্তা ও চিন্তার বিষয়ের মধ্যে ‘সম্বন্ধ’ চর্চার বিচার। ‘সম্বন্ধ’ বা ‘সম্পর্ক’ মার্কসের বিপ্লবী চিন্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। এই ‘সম্বন্ধ’ সজীব ও সক্রিয়; কোন স্থির, অনড় বা অনৈতিহাসিক বিবর্তনরহিত সম্পর্ক নয়। এই অর্থেই এটা ‘সম্বন্ধ’ চর্চা। এই সম্বন্ধ চর্চাকেই মার্কস প্রথমে স্রেফ দর্শন হিসাবে বুঝতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা টের পেয়ে চিন্তাকে রক্তমাংসের ইহলৌকিক মানুষের চিন্তা হিসাবে সহজেই গণ্য করতে পারলেন। চিন্তা হাওয়ায় বাস করে না, রক্তমাংসের মনুষ্য শরীরেই বাস করে। তাহলে ধর্ম হোক কিম্বা দর্শন -- মানুষের চিন্তাকে বুঝতে হলে রক্তমাংসের মানুষের সঙ্গে জগতের বাস্তব ইহলৌকিক জীবন্ত সম্বন্ধকেই আগে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ চর্চার বিবর্তন। তাই মানুষ আর জগতের সম্বন্ধ চর্চাকে ঐতিহাসিকভাবে বোঝা মার্কসের দর্শনের কেন্দ্রীয় তাগিদ হয়ে উঠল। মার্কস দর্শন থেকে প্রস্থান করেন নি, বরং ধর্ম ও দর্শনকে তার জাগতিকতা বা ইহলৌকিকতা সম্পর্কে সচেতন ও সজ্ঞান করে তুললেন।

এই দিকটি বুঝলে দার্শনিক মার্কসের অবদানটা আমরা সহজেই ধরতে পারব। মার্কসের আগে দর্শনের মধ্যে এমনভাবে চিন্তার চর্চা চলছিল যেন চিন্তা মানুষের ইহলৌকিক বা প্রাকৃতিক সত্তার বাইরে বিমূর্ত কিন্তু পরম এক সত্তা হিশাবেই শুধু বিরাজ করে। বুঝি চিন্তার জন্য কোন শরীরের, কোন পাত্রের কোন রক্তমাংসের জীবনের প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ চিন্তাকে খেতে হয় না, পরতে হয় না, চিন্তার কোন ঘুম বা ঘাম নাই। ঘরগেরস্থি নাই। চিন্তার বুঝি কোন জীবন-জীবিকা নাই। চিন্তা বুঝি হাওয়ায় ভাসে। চিন্তা ও চিন্তার বিষয়ের মধ্যে সম্বন্ধ বিচারের এই অনুমানকে মার্কস মানেন নি।

চিন্তা ও তার বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ চর্চার সংকীর্ণ ‘দার্শনিক’ পরিমণ্ডল থেকে মার্কস বেরিয়ে এলেন। বললেন স্রেফ দার্শনিক ব্যাখ্যা এখনকার কাজ নয়, বরং কাজ হচ্ছে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ চর্চার ধরণ বদলানো। ‘এতোদিন দার্শনিকরা শুধু দুনিয়া ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু দরকার বদলে দেওয়া’ বলতে তিনি দর্শন থেকে প্রস্থান বোঝান নি, বরং তাঁর অবস্থান বদলাবার ঘোষণা দিয়েছেন। জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ চর্চার মধ্যে চিন্তা অন্তর্ভূক, অতএব দর্শন বাদ দেবার কথা তিনি বলেন নি। দাবি করেছেন, চিন্তার প্রথাগত পরিমণ্ডল থেকে চিন্তাকে বেরিয়ে আসতে হবে। দর্শন থেকে প্রস্থান করার অর্থ চিন্তা করা ছেড়ে দেওয়া নয়, কিম্বা দর্শনকে মূল্যহীন জ্ঞান করাও নয়। তিনি বলেন নি চিন্তা করা এখন বাদ দিতে হবে, দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। ধরো তক্তা মারো পেরেক জাতীয় ‘চর্চা-র কথা বলছেন না মার্কস। চিন্তার জগত বদলানোর কাজও চিন্তারই কাজ, কারণ চিন্তাশীল মানুষের বৈপ্লবিক কর্মোদ্যোগই জগতকে বদলায়, চিন্তাহীনতা নয়। চিন্তা দেশকালপাত্রের অধীন মানুষেরই চিন্তা। রক্তমাংসসম্পন্ন মানুষ ও তার জীবন-জীবিকা ও দিনানুদিনের বেঁচে থাকার আয়োজন ও কর্মকাণ্ডের মধ্যেই চিন্তা সক্রিয় থাকে। তার উর্ধে চিন্তা পরম কোন সত্তা নয়।

তিনটি সদর দরজা উন্মোচন

মার্কসের পর শুধু ‘বিষয়’ ভাবনাকেই চিন্তা বলা যাচ্ছে না, বিশুদ্ধ দার্শনিকতাকে দর্শন বলা যাচ্ছে না আর, কারণ চিন্তা যে জাগতিক বা বৈষয়িক শর্তে চিন্তা করে তাকেও বিষয়বিদ্যার অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। চিন্তা যে বিষয় নিয়েই চিন্তা করুক তার জাগতিক শর্ত চিন্তার জানার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ কোন্‌ পরিপ্রেক্ষিতে বা কোন বাস্তবতার মধ্যে চিন্তার বিশেষ মর্ম ও রূপের আবির্ভব ঘটছে তাকে সেই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝা দর্শনের নতুন দায় হয়ে উঠেছে। ইহলৌকিক জগতকে ইহলৌকিকভাবে বদলাবার আয়োজন ও কর্মোদ্যোগের মধ্যেও চিন্তা কি ভাবে সক্রিয় সেই দিকগুলোও আমাদের জানতে হবে। চিন্তা ও চিন্তার বিষয় বদলে যাওয়ার সঙ্গে মানুষ ও তার জগতের সম্বন্ধ বদলে যায়। সেটাও বিচার করতে জানতে হবে।

চিন্তা ও চিন্তার বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধের বিবর্তন বা রূপান্তরকে তাহলে একই সঙ্গে চিন্তাশীল সত্তা -- অর্থাৎ ‘মানুষ’ এবং মানুষের ইহলৌকিকভাবে হাজির থাকা – এই উভয়ের সম্বন্ধে রূপান্তর বা বিবর্তন হিশাবে বিচার জরুরী। মানুষ ও জগতের ইতিহাস বা অর্থশাস্ত্রীয় অর্থে নানান ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে রক্তমাংসের মানুষের বেঁচে থাকার জন্য উৎপাদন, ভোগ ও বিতরণের যে ‘সম্পর্ক’ গড়ে তোলে সেই সম্পর্কের মধ্যেই মার্কস মার্কস মানুষ ও জগতের সম্বন্ধের বিবর্তন বা ইতিহাস অন্বেষণ করেছেন। মার্কসের আগে চিন্তা ও চিন্তার বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিচারের যে ধারা ‘দর্শন’ হিশাবে চর্চা হচ্ছিল, মার্কস তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চিন্তাকে মানুষের বৈষয়িক জীবন উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন সম্পর্ক পর্যালোচনায় উন্নীত করলেন। দর্শন হয়ে উঠল অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা। দর্শনের জগতে এটা একটা বৈপ্লবিক ঘটনা।

মার্কসের আগের দার্শনিক ধারা থেকে চিন্তার বেরিয়ে আসার অর্থ তাহলে নিজের ইহলৌকিক সত্য চিন্তার আগেই হাজির রয়েছে খোদ চিন্তাকে উপলব্ধি করা এবং পর্যালোচনার অধীন করা। চিন্তা ইহলৌকি -- অর্থাৎ দেশকালপাত্রে হাজির রক্তমাংসের মানুষের মধ্যেই চিন্তা করার ক্ষমতা বিরাজ করে, বিরাজ করে প্রাকৃতিক ক্ষমতা হিশাবেই। চিন্তা নিজেকে বা তার বাইরের কোন কিছুকে ‘বিষয়’ বানাবার আগেই এই সত্য হাজির থাকে। এই সত্য চিন্তার দ্বারা নির্ণয় হওয়া ‘সত্য’ নয়। প্রদত্ত বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে থেকেই মানুষ চিন্তা করে। দার্শনিককে দর্শন চর্চার বৈষয়িক শর্ত হিসাবে আগে ইহলৌকিক জগতে ইহলোকিকভাবে হাজির থাকতে হয়, খেয়ে পরে নিজের ইহলৌকিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। প্রদত্ত ‘সত্য’ আর দর্শনের ‘সত্য’ বলতে আমরা যা বুঝি তা এক নয়। দুইয়ের পার্থক্য আছে। মানুষ চিন্তায় বা দর্শনে ‘সত্য’ নির্ণয়ের যে কারবার করে তার সঙ্গে আগেই নির্ধারিত হয়ে থাকা জাগতিক বাস্তবতা বা প্রদত্ত সত্যের ফারাক বিশাল। আমরা শারিরীক ভাবে অস্তিত্বমান বলেই চিন্তা করতে পারি, অথচ শরীর চিন্তার দ্বারা তৈয়ারি কোন ‘ধারণা’ নয়, যার অস্তিত্ব কেবল ভাষায়। চিন্তা শুরু করার আগে থেকেই চিন্তা হাজির থাকে। চিন্তার ইহলৌকিকতা, শারীরিকতা বা কোন কিছু চিন্তা করবার আগেই রক্তমাংসের শরীর সহ চিন্তাশীল মানুষের জাগতিক উপস্থিতি একটি অবিসংবাদিত সত্য।

কেউ নিশ্চয়ই এটা দাবি করতে পারবে না যে আমি চিন্তা করি, কিন্তু আমার কোন শরীর নাই বা কোন জাগতিক বাস্তবতা নাই। শারিরীকতার এই অবিসংবাদিত সত্যের দিকে মার্কস নজর ফিরিয়েছেন আমাদের। নজর ফিরিয়েছেন, ইহলৌকিক মানুষ ও তার ইহলৌকিক জগত বা জীবনের জাগতিক ও ঐতিহাসিক ‘সম্বন্ধ’ বিচার এবং তার রূপান্তর ঘটাবার ক্ষেত্রে কর্তারূপী মানুষ এবং বিষয় হিসাবে জগতের সীমা ও সম্ভাবনার দিকে।

তাহলে রক্তমাংসের মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ আগাম ‘সত্য’ হিসাবে আগেই হাজির থাকে; হাজির থাকে চিন্তার ‘বিষয়’ হিশাবে নয়, বরং চিন্তার সজীব ও সক্রিয় ‘ব্যাবহারিক’ শর্ত হিশাবে। চিন্তা ইহলৌকিক রক্তমাংসের মধ্যেই, ইহলৌকিকতায় বিরাজ করে। জগতের আগাম উপস্থিতি মানুষের চিন্তা বা ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়। এই ইহলৌকিকতার মধ্যে মানুষ পারলৌকিক বা অলৌকিক বা দেশকালপাত্রের অতীত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা করে ঠিকই, কিন্তু সেটা করে মাটিতে পা রেখে, আসমানে পা ঝুলিয়ে নয়। এই অর্থেই মার্কস দাবি করেছিলেন হেগেলের চিন্তাপদ্ধতিকে তিনি ওপরে পা তুলে না হেঁটে মাটিতে পা রেখে হাঁটতে শিখিয়েছেন। বলা যায়, ‘জর্মান ভাবাবাদর্শ’ থেকে বেরিয়ে এসে মার্কস চিন্তা বা দর্শনের সদর দরোজা খুলেছেন। মানুষ জগত সৃষ্টি করে নি, কিন্তু নিজেকে সে জগতের মধ্যে শুরু থেকে বিরাজমান দেখতে পায়। জগতের সঙ্গে মানুষের এই সম্বন্ধ চিন্তার আগেই ঘটে। দর্শনের দিক থেকে এটা নতুন ভাবনা। চিন্তার একটি নতুন সদর দরজা এতে খোলা হোল।

চিন্তার দ্বিতীয় যে সদর দরোজার কথা আমরা বলতে পারি সেটা হচ্ছে ‘কর্তা’ বা ‘আমি’ সংক্রান্ত ধারণার পর্যালোচনা। পাশ্চাত্য দর্শনে এই ‘আমি’-র আবির্ভার ঘটেছিল দেকার্তের সময় থেকে। নিশ্চয়জ্ঞান আদৌ সম্ভব কিনা সেই প্রশ্ন মীমাংসা করতে গিয়ে দেকার্তে বলেছেন সবকিছুকেই সন্দেহ করা যায় কিন্তু ‘আমি’ যে চিন্তা করছি তাকে তো আর সন্দেহ করা যায় না। অতএব ‘আমি’ যে আছি তার প্রমাণ আমি চিন্তা করছি। দেকার্তের ‘আমি’ অতি মাত্রায় আত্মসচেতন, চিন্তাশীলতাই তার সত্য নির্ণয়ের অবলম্বন। এই ‘আমি’ মুক্ত ও স্বাধীন। কিন্তু মার্কস এই ধরনের ‘আমি’-র বা চিন্তার এমন কোন ‘কর্তা’-কে স্বীকার করেন নি যে একই সঙ্গে রক্তমাংসের জীবনের অধীনস্থ নয়, যে ‘আমি’ সমাজে বা ইতিহাসে হাজির নাই। অতএব ‘আমি’ মাত্রই মুক্ত স্বাধীনভাবে চিন্তা করে বা চিন্তা করতে সক্ষম এটা ঠিক নয়। বৈষয়িক জীবনে ‘আমি’ নামক সত্তা কিভাবে হাজির থাকে, কী ধরনের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতা তাকে মোকাবিলা করতে হয় (বা হয় না), কিম্বা অন্যান্য চিন্তার সঙ্গে ‘আমি’-র সম্পর্ক কেমন ইত্যাদি ‘আমি’ নামক সত্তা কী ভাবতে সক্ষম আর কী নয়, তার শর্ত তৈরি করে। দেশকালপাত্রের বাইরে যেমন কোন মানুষ নাই, ঠিক তেমনি দেশ কাল পাত্রের বাইরে শুধু চিন্তার দ্বারা নিশ্চয়-সত্য নির্ণয়ে সক্ষম কোন ‘আমি’ নাই।

মার্কসের পরে দার্শনিকরা ‘আমি’ বা ‘কর্তা’-র পর্যালোচনা করেছেন নানান দিক থেকে। ‘মানুষ’, ‘আমি’ বা ‘কর্তা-র ধারণা মানুষের বয়ান বা ভাষা নির্মাণের বিষয় হিশাবে যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি নৃতত্ত্ববিদ ক্লদ লেভি-স্ট্রস দাবি করেছেন নৃবিজ্ঞানসহ মানবিক বিজ্ঞানের কাজ ‘মানুষ’, ‘আমি’ বা ‘কর্তা’-র বয়ান তৈরি নয়, বরং তার বিলয় ত্বরান্বিত করা। মার্কসের চিন্তার সঙ্গে এর মৌলিক কোন বিরোধ নাই, কারণ ‘মানুষ’,‘আমি’ বা কর্তার ধারণা একই সঙ্গে ভাষা, সংস্কৃতি ও দর্শনেরই বয়ান। ইতিহাসের একটা পর্যায়ে যদি ‘কর্তা’ ধারণার আবির্ভাব হয়ে থাকে ইতিহাসের ভিন্ন অবস্থায় তার বিলয়ও সম্ভব। কর্তা সংক্রান্ত যে-বয়ান তৈরি হয়েছে, সেই বয়ানের বিলয় ঘটতেই পারে। মিশেল ফুকো দেখিয়েছেন ‘কর্তা’ ধারণার ভূমিকা হচ্ছে এর দ্বারা বাস্তবতা বলে আমরা যা বুঝি, জানি বা বিশ্লেষণ করি সেটা যে আসলে মানুষেরই বয়ান সেই সত্য বুঝতে পারা। মানুষ বিভিন্ন ভাষা বা চিহ্নব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কোন একটি বয়ান যখন তৈরি করে তা সাংস্কৃতিক দিক থেকে নির্দিষ্ট, তবে মানুষ এই বিষয়ে অসচেতন থাকতে পারে। জাক দেরিদা এবং মিশেল ফুকো দুজনেই কর্তা সম্পর্কে আমাদের অনুমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তবে, আরেক ফরাসি দার্শনিক জাক লাকাঁ ‘কর্তা’-র ধারণা ত্যাগ করেন নি। হেগেলের দর্শন ও ফ্রয়েডের মনোবিকলন সংক্রান্ত চিন্তার সঙ্গে যোগসূত্রের কারণে লাকাঁ ‘কর্তা’কে বাদ দেন নি। এখানে এই সব দার্শনিকদের নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নাই। কিন্তু তাদের দার্শনিক পর্যালোচনা মার্কসকে নতুনভাবে বুঝতে যেমন আমাদের জন্য সহায়ক হয়েছে। তেমনি সেই নতুন বোঝাবুঝির জায়গা থেকে তাদের দর্শন পর্যালোচনাও আগের চেয়ে সহজ হয়েছে।

তৃতীয় যে সদর দরজার কথা আমরা বলব সেটা হচ্ছে ভাষা বা অন্য যে কোন চিহ্নব্যবস্থায় কোন কিছু প্রকাশ বা পেশ করা সংক্রান্ত। ভাষার অর্থ কিভাবে তৈরি হয় সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভাষা পর্যালোচনার একটি শক্তিশালী ধারা মার্কসের পরে গড়ে উঠেছে। ভাষা কিভাবে অর্থ তৈরি করে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই এই ধারা তৈরি হয়। ভাষা আগে থেকেই তৈরি কোন অর্থ কি প্রকাশ করে? নাকি পাঠভেদে ও পরিস্থিতি ভেদে তার অর্থের রূপান্তর ঘটে? আদম স্মিথ কিম্বা ডেভিড রিকার্ডো বা অন্য কাউকে পাঠ করে তাঁদের রচনার যে-অর্থ মার্কস করেছেন সেটা তো মার্কসেরই পাঠ। তাঁর নিজের পাঠকেই যেন একমাত্র অর্থ বা সত্য বলে ধরে নেওয়া না হয় তার জন্য এই ধরনের পাঠকে বলা হয় ‘পর্যালোচনা’। এই পর্যালোচনা লেখককে তার বৈষয়িক বাস্তবতার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত দেখতে ও দেখাতে শিখিযেছেন মার্কস। পর্যালোচনার অর্থ ভাষা থেকে পাঠ ভেদে বা পাঠক ভেদে নতুন ও বিবিধ অর্থ তৈরি নয়, বরং লেখালেখির সঙ্গে বৈষয়িক জীবনের সম্বন্ধ দেখিয়ে দেওয়া। বিশেষত দেখানো মানুষ ও জগতের সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধ চর্চার পরিপ্রেক্ষিতেই ভাষারও সুনির্দিষ্ট মানে তৈরী হয়। ভাষা ও ভাষার অর্থ সংক্রান্ত দর্শনের দিক থেকে মার্কসের ‘পর্যালোচনা’ কথাটির তাৎপর্য অনুধাবন এখন আরো সহজ হয়েছে বলেই আমাদের ধারণা।

আগেই বলেছি মার্কস ইউরোপীয় চিন্তার ভেতর থেকে বড়ো হয়েছেন, সেই চিন্তাকে ইউরোপীয় চিন্তার অন্দরমহল থেকে মোকাবিলা করতে গিয়ে চিন্তার যে নতুন দরোজা তিনি খুলেছেন মার্কসের পরে আসা ভাবুকদের জন্য তার ফল হয়েছে ইতিবাচক। আমাদের জন্য এর সুবিধা হয়েছে এই যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিন্তার ঐতিহাসিক পার্থক্য ও মিলগুলো তুলনা করবার সুযোগ তৈরি হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। মার্কসের প্রকল্প ইউরোপের ইতিহাস ও ইউরোপীর চিন্তার প্রকল্প থেকেই উদ্ভূত, আলাদা কিছু নয়, কিন্তু একই সঙ্গে তা আবার ছেদও বটে। মার্কসকে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস থেকে আলাদা করার চেষ্টা যেমন অনৈতিহাসিক, অন্যদিকে কোথায় তিনি পাশ্চাত্য চিন্তার পরিমণ্ডল থেকে বিরিয়ে এসেছেন সেটা শনাক্ত করতে না পারা পদ্ধতিগতভাবেও ভুল। ইউরোপীয় চিন্তা মাত্রই সর্বজনীন চিন্তা এই ধারণা এখন ধোপে টিকছে না, ফলে পাশ্চাত্য ইতিহাসের বাইরে --বিশেষত ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদী পরিমণ্ডলের বাইরে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর চিন্তার বৈশিষ্টের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষত পাশ্চাত্য যেখানে অক্ষম, যে-চিন্তা পাশ্চাত্য ভুলে গিয়েছে বা পাশ্চাত্যের চিন্তা কাঠামেরা মধ্যে যে প্রশ্ন অনুপস্থিত --তাকে শনাক্ত করা এখন আগের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক সহজ হয়েছে। ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসের বাইরে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও চিন্তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ রচনা ও চর্চার দেশ কাল পাত্র ভেদ আছে, কোন একটি সম্বন্ধ সর্বজনীন নয়। যে চিন্তা, সংস্কৃতি বা ইতিহাস এডওয়ার্ড সাইদের ভাষায় পাশ্চাত্যের কাছে ‘অপর’, সেই চিন্তার প্রতিভা ও সম্ভাবনা দর্শন বা ভাবচর্চার মনোযোগ কাড়ছে আগের চেয়ে বেশী। মার্কসকে এই জায়গা থেকে পাঠ করবারও একটা তাগিদ বাংলাদেশে আছে।

মার্কস পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয় চিন্তার বাইরের কেউ নন, ঠিক। কিন্তু ইউরোপের ইতিহাসের বাইরে থেকে তাঁকে দেখা, জানা ও বিচার করা আদৌ সম্ভব কিনা সেই প্রশ্ন অনেক সময় ওঠে। যেসব জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস, কিম্বা সাম্রাজ্যবাদের প্রান্ত হয়ে থাকার ইতিহাস-সেইসব দেশের চিন্তাচেতনা, সংস্কৃতি, ভাষা ভাব ইত্যাদি যা কিছু ঔপনিবেশিকতা বা সাম্রাজ্যবাদের ফলাফল হিশাবে গড়ে উঠেছে --সেই ইতিহাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে মার্কসকে পড়বার সুযোগ কতোটুকু? শুধু মার্কস কেন? পাশ্চাত্যের যে কোন চিন্তা পাঠ করা কি সম্ভব? এই প্রশ্নগুলোর কোন পরিণত জবাব দেওয়া এখনো কঠিন। কিন্তু এই প্রশ্নের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক। মার্কসকে এই জায়গা থেকে যদি আমরা দেখি তাহলে এতোটুকু অন্তত বোঝা যায় যে তিনি ইউরোপীয় চিন্তা ও তৎপরতার জগতকে গোড়াসুদ্ধ নাড়িয়ে দিয়েছেন। জর্মান ভাবাদর্শিক ধারায় মধ্যে চিন্তা ও তার বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধকে কিভাবে তিনি মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ বিচারের অধীনস্থ করেছেন সেই দিক যদি আমরা ধরতে পারি তাহলে বুঝব মার্কসের ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ সংক্রান্ত ধারণা মূলত পাশ্চাত্য দর্শনের পর্যালোচনারই ফল। তিনি দর্শনের সদর দরজা দিয়েই অর্থশাস্ত্রে এসেছেন। এখানি তাঁর প্রভূত গুরুত্ব।

পাশ্চাত্যে পর্যালোচনামূলক চিন্তার যে ধারা গড়ে উঠেছে মার্কসের ‘বিচার’ এখনো সেই ধারার মধ্যে করার নজিরই বিদ্যমান। ব্যতিক্রম খুবই কম। যদিও পাশ্চাত্য জ্ঞানকাঠামো নামক একাট্টা কিছু আছে প্রমাণ করা কঠিন। আমরা তা দাবিও করছি না। কিন্তু মার্কস নিজে যাকে ‘অধিপতি’ চিন্তার ধারা বলছেন, পাশ্চাত্য চিন্তা এখনও অধিপতি চিন্তাই বটে। সেই অধিপতি চিন্তার মধ্যে পাশ্চাত্যে পর্যালোচনার যা ধারা তার বাইরে অন্য কোন প্রাচ্য কায়দা আদৌ আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলার সময় এখনো আসে নি। পাশ্চাত্য চিন্তার দৃশ্যমান ধারাগুলোর বাইরে মার্কস ও তাঁর বিপ্লবী প্রকল্পকে ভিন্নভাবে বিচারের তাগিদটা তৈরি হয়েছে বিপ্লবী চিন্তা ও তৎপরতার মধ্যে। মানুষের ‘সর্বজনীন’ ইতিহাস বা মানবেতিহাস নামে আমরা এতোকাল ইউরোপের ইতিহাসকেই বুঝেছি। এখনো তাই বুঝি। ঔপনিবেশিকতা বা সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ থাকার উপ্লব্ধি থেকে তার বিরুদ্ধে লড়াই করবার মধ্য দিয়েই পাশ্চাত্যের বাইরে চিন্তার নতুন ধারা দানা বাঁধতে পারে। সেটা হবে, আমরা বলতে পারি, পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের লড়াই-সংগ্রাম বা ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ চর্চার মধ্য দিয়ে। কোন বিমূর্ত জায়গা থেকে নয়। তবে মার্কস পাশ্চাত্য চিন্তাকে যেখানে গোড়া সুদ্ধ নাড়িয়ে দিয়েছেন, সেই জায়গাগুলোতে তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পাতানোর সুবিধা রয়েছে।

কিন্তু সেই সুবিধা আদায় করতে হলে এতোকাল মার্কসকে যেভাবে পাঠ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে সেই ক্লিশে ধারা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

২ ডিসেম্বর ২০১৭। ১৮ অগ্রহায়ন ১৪২৪। শ্যামলী।

সূত্র

Kant, I. (1964). Critique of Pure Reason, tr. Norman Kemp Smith. London: McMillan & Company Ltd.

Marx, K. (1974). 'Early Writings' of Karl Marx. tr. Rodney Livingstone and Gregor Benton, Introduction by Lucio Coletti. New York: Vintage Books.


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।