ব্যবহারিক সম্বন্ধ ও রূহানিয়াত
এর আগের আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ বিচারই মার্কসের দার্শনিক পর্যালোচনার প্রধান ভরকেন্দ্র। বিমূর্ত দর্শনের পরিমণ্ডল বাদ দিয়ে অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা দার্শনিক জিজ্ঞাসারই অনিবার্য পরিণতি। অর্থশাস্ত্রীয় বিচার মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ বিচার, সেকারণে মার্কসের অর্থশাস্ত্র দর্শনেরই বিষয়।
দুটো শব্দ সাধারণত অদল বদল করে প্রায় একই অর্থে অনেক সময় আমরা ব্যবহার করি: জগত এবং প্রকৃতি। যেন গোলমাল না হয় তার জন্য বলে রাখা দরকার মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ কথাটাকেই আমরা আরও সংকীর্ণ অর্থে সাধারনত বলি, মানুষ ও প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার। যা কিছুই মানুষের বাইরে মানুষের ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, কল্পনা বা ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের বিষয় হিসাবে মানুষ হাজির দেখতে পায় তাকে সামগ্রিক ভাবে বলা হচ্ছে জগত। প্রকৃতি সেই জগতেরই অন্তর্গত যার সঙ্গে আমাদের ‘ব্যবহারিক’ সম্পর্ক তাৎক্ষণিক ও প্রত্যক্ষ। কিন্তু মার্কস ফয়েরবাখকে সমালোচনা করতে গিয়ে যখন বলছিলেন এই সম্বন্ধ চর্চার যে দিকটা ‘ভাববাদ’ হিসাবে হাজির হয় ‘ইন্দ্রিয়পরায়ন মানবিক ব্যবহারিক চর্চা’ -- বস্তুবাদী ফয়েরবাখ তা ধরতে পারেন না। জগতের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ শুধু বুদ্ধির বাইরে হাজির কোন বিষয় নিয়ে ধ্যানমগ্ন হওয়া নয়, এই সম্বন্ধ একই সঙ্গে একটি তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া বা সকর্মক ইন্দ্রিয়পরায়ন তৎপরতা। কিন্তু বস্তুবাদ এটা ধরতে অক্ষম।
তাহলে এটা স্পষ্ট জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ চর্চাকে মার্কস সামগ্রিক ভাবে বুঝতে চেয়েছেন। ইন্দ্রিয়োপলব্ধির দিক থেকে থেকে প্রকৃতিকে আমরা তাৎক্ষণিক ভাবে উপলব্ধি করি। তেমনি জীব জীবন রক্ষার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের যে সম্বন্ধও তাকেও আমরা তাৎক্ষণিক বলতে পারি। তুলনায় কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা তাৎক্ষণিক নয়। শুধু তাই নয়, সেই বিষয় নিয়ে আমরা চিন্তা করতে পারি, আবার নাও পারি। তাহলে যা তাৎক্ষণিক বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ নয়, তার সঙ্গেও আমাদের সজীব ও সক্রিয় সম্বন্ধ জারি থাকে। বিদ্যমান ধর্ম বা মতদর্শের সঙ্গে সম্বন্ধ চর্চাও জগতের সঙ্গে বুদ্ধি ও উপলব্ধির সম্বন্ধ যেমন, তেমনি আমাদের উপলব্ধি ও বুদ্ধির তৎপরতা হিসাবে একই সঙ্গে ইন্দ্রিয় পরায়ন সকর্ম প্রক্রিয়াও বটে।
দ্বিতীয়ত ‘সম্বন্ধ’ কথাটা কোন স্থির বা চিরায়ত সম্পর্ক নয়, বরং সক্রিয় ও সজীব সম্বন্ধ। যে কারণে স্পষ্ট থাকার জন্য ‘সম্বন্ধ চর্চা’ কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে। ‘সম্বন্ধ’ মানেই ‘সম্বন্ধ চর্চা’, স্থির বা চিরায়ত কোন বন্ধন নয়। মানুষের সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার বিচার কথাটার মানে মার্কসের কাছে দাঁড়িয়েছিল মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্বন্ধ পর্যালোচনা: সমাজের ভেতরে থেকে সমাজের জন্য উৎপাদন– অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে উৎপাদন,ভোগ, বিতরণ ও বিনিময়ের সম্পর্ক। এই সম্পর্ককে আমলে নিয়েই চিন্তার বিষয় হিসাবে জ্ঞানকর্তা মানুষ যা কিছু নিয়ে ভাবে সেটাই অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা। সেই ভাবনা বোঝার চাবি জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ চর্চার ধারণা দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায়। জগতের সঙ্গে মানুষের সামগ্রিক ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার বিচার দর্শনে বা জ্ঞাঞ্চর্চায় জ্ঞানকর্তার সঙ্গে জ্ঞানের বিষয়ের সম্পর্ক বোঝার সূত্র, আর তারই অন্তর্গত মানুশের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক – অর্থাৎ অর্থণৈতিক সম্পর্কের বিচার । মানুষের চিন্তা বা ভাবনাকে বুঝতে হলে মানুষ কিভাবে বাস্তবে প্রকৃতির সঙ্গে ব্যবহারিক সম্পর্ক চর্চার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে সেই সজীব বাস্তবতাকে আমলে নিতে হবে। শুধু বিশুদ্ধ চিন্তা বা বিশুদ্ধ দর্শনের হাওয়াই বা ভুতুড়ে জগতে বিচরণ করলে চলবে না। দর্শনের ইতিহাসে মার্কসের এই আবিষ্কার ছিল নতুন এবং যুগান্তকারী।
চিন্তা কিভাবে জাগতিক সত্য হিসাবে বিরাজ করে বা হাজির থাকবার জন্য জগতের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধ পাতায় – মার্কসের অর্থশাস্ত্রের উদ্দেশ্য সেই সম্বন্ধ পর্যালোচনা। এই দিক থেকে বিচার করলে মার্কস জর্মন ভাবাদর্শের দার্শনিক প্রশ্নেরই মীমাংসা করতে চেয়েছেন। মার্কসের অর্থশাস্ত্র সে কারণে নিছকই অর্থশাস্ত্র নয়, বরং জর্মান ভাবাদর্শের আত্ম-পর্যালোচনা মূলক ধারাবাহিকতা। এটাও মনে রাখতে হবে জর্মান ভাবাদর্শের পালটা কোন ‘তত্ত্ব’ বা ‘শাস্ত্র’ প্রণয়ন মার্কসের উদ্দেশ্য ছিল না, কোন একটা কমপ্লিট শাস্ত্র বা ‘বিজ্ঞান’ তৈয়ার করে মার্কস আমাদের হাতে ধরিয়ে দিতে চান নি। তাঁর পদ্ধতির মূলকথা হচ্ছে, তাঁরই ভাষায়, ‘ক্রিটিক’ বা বিচার। অর্থাৎ জ্ঞান চর্চা তত্ত্ব বা সত্য হিসাবে সমাজে যেসব ভাবনা-চিন্তা তৈয়ার করে তা দেশকালপাত্রের সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধ চর্চা থেকে পরিগঠিত হয়। কোন একটি বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থায় মানুষ কিভাবে তাদের বৈষয়িক জীবন উৎপাদন ও পুন্রুৎপাদন করে তার পরিপ্রেক্ষিতেই সেই সমাজের মতাদর্শ (ধর্ম, চিন্তা, দর্শন) এবং রাজনৈতিক-সামজিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতা পর্যালোচনা করতে হবে। পর্যালোচনার মানে দেখিয়ে দেওয়া কিভাবে মানুষের সেইসব উৎপাদন, ভোগ, বিনিময় ও বিতরণ প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থার ভেতর থেকে তৈয়ার হয় কিম্বা কিভাবে তারা কোন না কোন ভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। এবং কেনই বা তারা অনেক সময় বদ্ধমূল চিন্তায় পর্যবসিত হয়।
অথচ এই অনুমানই নানা কারনে প্রবল যে মার্কসের অর্থশাস্ত্র আর দর্শন যেন একদমই ভিন্ন বা আলাদা দুটো বিষয়। দর্শন বুঝি আর্থ-সামাজিক বা জাগতিক সম্পর্ক থেকে মুক্ত, চিন্তার বিশুদ্ধ পরিমণ্ডল। অন্যদিকে অর্থশাস্ত্রের মধ্যে বুঝি কোন চিন্তা বা দর্শন নাই, অর্থশাস্ত্র নিতান্তই বৈষয়িক বিষয়ের ব্যাখ্যা ও তত্ত্ব, এর সঙ্গে দর্শনচর্চার কোন সম্বন্ধ নাই। কোন আগাম অনুমান নাই। মার্কসের বিচার বা পর্যালোচনা এই ধারণাকে গোড়াতেই নস্যাৎ করে শুরু হয়।
মার্কস কিভাবে গোড়াতে এই অনুমান নস্যাৎ করেন সেটা বোঝা একদিকে কঠিন, যদি আমরা মার্কসের পদ্ধতির অতি প্রাথমিক পদক্ষেপটা ধরতে না পারি। সেটা হোল জগতকে বুঝতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে প্রত্যক্ষ তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা থেকে। যেমন, মানুষকে আমরা হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ‘চিন্তা’ হিসাবে দেখি না। মানুষ রক্তমাংসের একটি জাগতিক সত্তা, চিন্তা করা তার প্রতিভা বটে, তবে সেটা আরও নানান বৃত্তির একটি। তাহলে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিছকই চিন্তার বা ভাবনার সম্পর্ক নয়; অর্থাৎ এমন নয় যে যেখানে মানুষ শুধু চিন্তার ‘কর্তা’ আর জগত নিছকই চিন্তার ‘বিষয়’, এবং আর তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন দুটো ব্যাপারও নয় ; বরং চিন্তা করা মানে একই সঙ্গে নিত্যদিন জাগতিক ভাবে রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার তাৎক্ষণিক সম্পর্কও বটে। কারন বেঁচে থাকি বলেই আমরা চিন্তা করতে পারি।
তাহলে জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্পর্ককে বিচার করতে চাইলে শুধু চিন্তার সম্পর্ককে একমাত্র নির্ধারক গণ্য করবার কোন যুক্তি নাই। জগতের সঙ্গে তাৎক্ষণিক সম্পর্কই বরং নির্ধারক। রক্তমাংসের শরীরের কথা ভুলে গিয়ে মানুষকে চিন্তাসম্পন্ন হাওয়াই বুদবুদ ভাবলে চলবে না। দেহসম্পন্ন মানুষ জগতের সঙ্গে দৈহিক বা বৈষয়িক সম্পর্কে নিত্য যুক্ত থেকে নিজেকে জীবিত বা বর্তমান রাখে। জীবিত মানুষের পক্ষেই চিন্তা করা সম্ভব। চিন্তার কর্তা হিসাবে আমাদের জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার অর্থ বিদ্যমান চিন্তা, দর্শন বা মতাদর্শের বিচার, তার ফল হচ্ছে মানুষের নতুন চিন্তা, নতুন ভাব, নতুন দর্শন, ইত্যাদি। কিন্তু চিন্তা বা ভাব তো হাওয়ায় সৃষ্টি হয় নি। কিম্বা আসমানে বিরাজ করে না। সেকারনে তাদের সঙ্গে জাগতিক বা বৈষয়িক সম্পর্কের সম্বন্ধ বিচারের দিকেই মার্কস বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। সে কারনে জাগতিক সম্পর্ককে বিবেচনায় না নিয়ে জগত নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনা বা চিন্তাই মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ বুঝবার নিশ্চিত পথ ও পদ্ধতি এই অনুমান মার্কস অস্বীকার ও পরিহার করেছিলেন। ফলে মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ নতুন ভাবে ভাবতে মার্কস আমাদের বাধ্য করেছিলেন। এখানেই তিনি চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়ে গেছেন।
খাওয়াদাওয়া, সন্তান উৎপাদন ও জগত নিয়ে বুদ্ধির দ্বারা চিন্তা করা ছাড়াও মানুষ জগতকে তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করবার ক্ষমতাও রাখে; তদুপরি যদি চিন্তা বলতে আমরা শুধু বুদ্ধির বিচার বুঝি তাহলে মানুষ শুধু বুদ্ধিমান নয়, ইন্দ্রিয়-পরায়নও বটে; মানুষের কল্পনা-প্রতিভা আছে যার স্বভাব আর চিন্তার স্বভাব এক নয়; নানান কামনা বাসনা বৃত্তি মানুষের মধ্যে কাজ করে, যা নিছকই দৈহিক কিম্বা বুদ্ধির বৃত্তি নয়; মানুষ প্রেম করে, নারীপুরুষ পরস্পরকে ভালবাসে, নীতি বা আদর্শের জন্য মানুষ জীবন দেয় ইত্যাদিকে বুদ্ধি দিয়ে সবসময় বোঝা যায় না, বুদ্ধি দিয়ে নির্ণয়ও করা যায় না।
মার্কসকে স্রেফ দার্শনিক গণ্য করলে সেই দর্শন-চিন্তারও সীমা রয়েছে, সেটা পাশ্চাত্য চিন্তারই সীমা – অর্থাৎ পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্ব, বুদ্ধি কিম্বা গ্রিক-খ্রিস্টিয় পরিভাষায় যাকে লোজস (Logos)বলা হয়-তারই সীমা। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে মার্কসের তাৎক্ষণিক মোকাবিলার প্রক্রিয়া অনুধাবন করলে আমরা এক সকর্মক কর্তাসত্তার সঙ্গে তার সামনে হাজির দার্শনিক চিন্তার জগতের সঙ্গে সম্বন্ধ চর্চার সজীব তৎপরতা অনুধাবন করি। বুঝতে পারি মার্কস স্রেফ বুদ্ধির দ্বারা জগতকে বিচার করবার ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন, কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের ভার তার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। সেই সকল ক্ষেত্রে – যেখানে বুদ্ধির সর্দারি ধরা পড়তে শুরু করে – এবং বুদ্ধিসর্বস্ব চিন্তা মানুষের অপরাপর বৃত্তিকে গৌণ বা গ্রাস করতে শুরু করে সেখানে পাশ্চাত্য দর্শনের সীমাও দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করে। মার্কস যেহেতু জর্মান ভাবাদর্শের পরিমণ্ডলে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন সে কারণে তার প্রতিভা ও আবিষ্কারও সেই পরিমণ্ডলের মধ্যেই বিচরণ করেছে। সেই পরিমণ্ডল তার চিন্তার বৈশিহট্য যেমন নির্ধারণ করেছে তেমনি তার সীমাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
জর্মন দর্শন জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে নিছকই চিন্তার বিষয়ে পর্যবসিত করেছিল, ফয়েরবাখীয় চিন্তামগ্নতাও একই বৃত্তের মধ্যে খাবি খেয়েছে। মার্কস সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে জগতের সঙ্গে সামাজিক মানুষের তাৎক্ষণিক সম্পর্কের ওপর --অর্থাৎ মনুষ্য জীবনের বৈষয়িক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের ওপর বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছিলেন। ‘অর্থশাস্ত্র পর্যালোচনায় একটি অবদান বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখছেন: ‘নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার সামাজিক উৎপাদনে মানুষকে অনিবার্য ভাবেই সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধে প্রবেশ করতে হয়’। এই সম্বন্ধ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন নয়, ‘স্বাধীন’। অর্থাৎ মানুষ চাইলেই এই সম্বন্ধে প্রবেশ করবো না বলার সুযোগ নাই, কিম্বা নিজের পছন্দের সম্বন্ধ বেছে নেবারও সুযোগ নাই । ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষতার অর্থে এই সম্বন্ধ তাৎক্ষণিক। অর্থাৎ মানুষ মাত্রই নিজেকে এই তাৎক্ষণিক সম্বন্ধের অধীন দেখতে পায়। ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষ সম্বন্ধে যুক্ত থেকেই যে কোন সমাজে সামাজিক মানুষ ‘বর্তমান’ বা হাজির থাকে । এই সম্বন্ধকেই মার্কস বলছেন বিশেষ বিশেষ দেশে এবং কালে উৎপাদন শক্তি বিকাশের উপযোগী ‘উৎপাদন সম্পর্ক’। জগতের সঙ্গে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষ উৎপাদন সম্পর্কের এই তাৎক্ষণিকতা জগতকে সজীব ও সক্রিয় চিন্তার বিষয়ে পরিণত করারা আগেই হাজির থাকে। এই সম্বন্ধের সকল দিককে তার সামগ্রিকতা সহ এক সাথে মার্কস ‘অর্থনৈতিক কাঠামো’ বলেছেন। তাহলে বৈষয়িক উৎপাদন, জীবন যাপনের বাস্তবতা, সমাজ – ইত্যাদি যে নামেই আমরা ডাকি বা নাম দেই না কেন তা আসলে জগতের সমগে মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ তাৎক্ষণিক সম্বন্ধ। এরই নাম অর্থ নৈতিক কাঠামো। ‘অর্থনীতি’ বা ‘অর্থনৈতিক কাঠামো’ কথাটাকে আমরা যেভাবে সংকীর্ণ অর্থে বুঝি মার্কস সেই রকম সংকীর্ণ আধুনিক অর্থনীতি মার্কা ধারণা দিয়ে বোঝেন নি। জর্মান ভাবাদর্শ থেকে বা ‘দর্শন’ নামে যা মার্কসের আগে হাজির ছিলো সেই জগতের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ বর্গ হিসাবে তিনি ধারণাটিকে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই নয় একে সামগ্রিক সম্বন্ধ হিসাবে গণ্য করেছেন। অর্থনীতি হচ্ছে জগতের সঙ্গে ইচ্ছা-নিরপেক্ষ সম্বন্ধের সামগ্রিক রূপ (totalities of relations of production)।
দেখা যায় মানুষের সামাজিক অস্তিত্বকে মার্কস দুটো ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হচ্ছে মানুষের সামাজিক-বৈষয়িক অস্তিত্ব (social existenc)। যাকে মার্কস বলেছেন (১) আসল ভিত্তি; কিন্তু এমনই ভিত্তি যার ওপর মানুষের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, চিন্তা, কল্পনার কোন নিয়ন্ত্রণ নাই, অতএব (২) তারা ইচ্ছা-নিরপেক্ষ । আর অপরটি হচ্ছে আইন ও রাজনৈতিক পরিকাঠামো যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (১) সামাজিক চেতনার সুনির্দিষ্ট রূপ। অর্থাৎ চেতনা বা চিন্তা সমাজে কিভাবে বিরাজ করে তা বুঝতে হলে আইনী ও রাজনৈতিক পরিকাঠামো বুঝতে হচ্ছে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠি বা ব্যক্তির চিন্তা হাজির থাকতেই পারে, কিন্তু মানুষ তাৎক্ষণিক যে সম্বন্ধে নিজেকে যুক্ত দেখতে পায় তা হচ্ছে আইন, রাষ্ট্র ইত্যাদি (Marx, 1972, pp. ২০-২১)।
জর্মান ভাবাদর্শিক চিন্তায় দাবি করা হোত মানুষ মাত্রই স্বাধীন ও মুক্ত। জাগতিক সম্বন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত বা স্বাধীন মানুষের ধারণা মার্কস নাকচ করেছেন একথা বলে যে মানুষের সামাজিক অস্তিত্বই তার চিন্তাচেতনার নির্ধারক, উল্টাটা নয়। কিন্তু ‘সামাজিক চেতনা’কে তিনি কোন বিমূর্ত বা সর্বজনীন ধারণা হিসাবে ব্যবহার করেন নি। তার সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক রূপ আছে অর্থাৎ যার সুনির্দিষ্ট আইনী, মতাদর্শিক রাজনৈতিক রূপ আছে। সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ, আইন ও রাজনীতির সঙ্গেই সম্বন্ধযুক্ত থাকে সুনির্দিষ্ট দেশকালে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধ – অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক।
ইচ্ছা-নিরপেক্ষ জাগতিক সম্বন্ধ আর ইচ্ছাধীন কর্তাসত্তা হিসাবে মানুষ --এই দুইয়ের ভেদবিচার নিয়ে মার্কসবাদের ভেতরে এবং বাইরে বিস্তর তর্ক আছে। সেই তর্কের মধ্যে বেইজ ও সুপারস্ট্রাকচার বা ভেতর কাঠামো আর উপর কাঠামো নামক পুরানা মার্কসবাদী তর্কও অন্তর্ভূক্ত। এই তর্ক মূলত জর্মান ভাবাদর্শিক পরিমণ্ডলের তর্ক, এবং সেই পরিমণ্ডল দ্বারাই প্রশ্নের ধরণ আগাম নির্ধারিত। জর্মান ভাবাদর্শ – বিশেষত হেগেলের চিন্তা অনুযায়ী -- চিন্তাই যুগপৎ স্বয়ম্ভূ-স্বাধীন কর্তাসত্তা এবং প্রক্রিয়া হিসাবে ইতিহাস হয়ে ওঠে এবং পরমার্থিক সত্তা (absolute) হয়ে ওঠা চিন্তারই পরম পরিণতি; পূর্ণ ও পরিণত পরমার্থিক সত্তা হিসাবে চিন্তা নিজেকে নিজে কর্তা ও প্রক্রিয়া হিসাবে জানছে। মার্কস এই ধারনারই মোকাবিলা করছিলেন। চিন্তা নিজেকে নিজে কখনই জানবে না যদি জগতের সঙ্গে তার বৈষয়িক তাৎক্ষণিক সম্বন্ধের বিবর্তন সম্পর্কে চিন্তার কোন খবর না থাকে; কারণ সেই সম্বন্ধের বিচারই চিন্তা বা দার্শনিক জানাকে পূর্ণ করে তোলে; বা আরও পরিচিত বাংলায় বলা যায় প্রজ্ঞা নিজের ঐতিহাসিক রূপ – শুধু চিন্তার বিষয় হিসাবে নয়, তার বর্তমান থাকার ইচ্ছা-নিরপেক্ষ শর্ত হিসাবেও নিজেকে চিনতে ও বুঝতে পারে। সে কারণেই অর্থনৈতিক-বৈষয়িক সম্বন্ধ – অর্থাৎ জগতের সঙ্গে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিরপেক্ষ তাৎক্ষণিক সম্বন্ধের প্রক্রিয়া – যা আমাদের বেঁচে থাকা বা বর্তমান থাকার শর্ত --মানুষের সেই সামাজিক অস্তিত্বের এটাই ‘আসল ভিত্তি’। কারণ সুনির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে সামাজিক অস্তিত্বের সম্বন্ধ বিচার করা না হলে তাকে পরিপূর্ণ বা পরম প্রজ্ঞার উপলব্ধি ও জানার ক্ষেত্র থেকে পুরাপুরি বোঝা গিয়েছে বলা যাবে না।
জর্মান ভাবাদর্শিক ধারার অনুমান হচ্ছে মানুষের চিন্তা বা ভাব তার জাগতিক অস্তিত্ব থেকে আলাদা। এই অনুমানের কারণে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ বিচারও দুই ভাবে বিচার্য বলে গণ্য হতে বাধ্য। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কে কার নির্ধারক, কিম্বা কে কাকে নির্ণয় করে? কিন্তু মার্কস মানুষকে স্রেফ শরীরহীন বা জীবাস্তিত্ববিহীন চিন্তা বলে বিবেচনা করেন নি। বরং মার্কস সেই প্রশ্ন তোলারই চেষ্টা করছিলেন যে সজীব ও সক্রিয় মানুষ জগতের সঙ্গে সম্বন্ধে যুক্ত থেকে কিভাবে ‘সামাজিক অস্তিত্ব’ হিসাবে বিরাজ করে? মানুষের এই বিরাজমানতা বুঝতে হলে মতাদর্শ, আইন, রাষ্ট্র ইত্যাদি পর্যালোচনা করতে হবে। পর্যালোচনার সময় মানুষের দৃশ্যমান বিরাজমানতার এই সকল মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠনকে মানুষের আসল সম্বন্ধ – অর্থাৎ সামাজিক উৎপাদন থেকে বিযুক্ত বা বিচ্ছিন্ন করে ভাবা চলবে না। ভেতরের কাঠামো উপরি কাঠামোকে কিম্বা চেতনা জীবন নির্ণয় করে, নাকি জীবন চেতনাকে? – এই ধরণের তর্ক সে কারণে মার্কসের আগের জর্মান ভাবাদর্শিক চিন্তা পদ্ধতির ভেতর থেকে ওঠা ও প্রাক-মার্কসীয় চিন্তার তর্ক। এর জের মার্কসে রয়েছে বটে, কিন্তু এই দ্বিবিভাগ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও মার্কসে রয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তিনি কি জর্মান ভাবাদর্শিক কাঠামর মধ্যে উত্থিত প্রশ্ন থেকে বাইরে আসবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন? এর উত্তর ইতিবাচক। প্রমাণ হিসাবে আমরা ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসে ফয়েরবাখকে তিনি যে অবস্থান থেকে সমালোচনা করছেন তার উল্লেখ আবার করতে পারি। পাঁচ নম্বর থিসিসে মার্কস বলছেন:
“ফয়েরবাখ বিমূর্ত চিন্তায় সন্তুষ্ট নন বলে চিন্তামগ্নতা চান; কিন্তু তিনি ইন্দ্রিয়পরায়নতাকে ব্যবহারিক, ইন্দ্রিয় পরায়ন মানুষের তৎপরতা বলে ধরতে পারেন না”
মার্কস ফয়েরবাখীয় বস্তুবাদের সীমা নির্ণয় করছেন। সাধারণ ভাবে দর্শন এবং সেই ক্ষেত্রে তথাকথিত বস্তুবাদও স্রেফ বুদ্ধির দ্বারা জগতকে বিচার করে। বস্তুবাদী হিসাবে ফয়েরবাখের গুরুত্ব হচ্ছে তিনি ধর্মতত্ত্বের রহস্যে কিম্বা দার্শনিক বিমূর্তবাদে বন্দী থাকতে চান না। খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব ও হেগেলের দর্শনকে তার বিমূর্ততা খসিয়ে নিরেট বা পরিচ্ছন্ন করে তোলার কাজ তিনি করেছেন। মার্কস সে কারণে ফয়েরবাখকে অন্যত্র প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু বিমূর্ত দর্শনকে নিরেট (Concrete) করবার কাজটা ফয়েরবাখ করেন দর্শন দিয়েই – অর্থাৎ বুদ্ধি বা চিন্তা দিয়ে। এই অর্থেই ফয়েরবাখ ‘বিমূর্ত’ ধারণা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন না, তিনি চিন্তামগ্ন হয়ে দর্শনকে ‘বস্তুবাদী’ বা নিরেট করতে চান। আরও চিন্তামগ্ন হয়ে দর্শন দিয়ে দর্শনকে আরও নিরেট করে তোলা ফয়েরবাখীয় ‘বস্তুবাদে’র প্রধান অবদান। এটা হচ্ছে ধর্ম কিম্বা হেগেলের দর্শনকে স্রেফ দর্শন দ্বারা পর্যালোচনা করে তাকে আরও নিরেট করে তোলার প্রকল্প।
ফয়েরবাখ তাহলে কোথায় ভুল করেন? সেটা ছয় নম্বর থিসিসে মার্কস ব্যাখ্যা করছেন:
“ফয়েরবাখ ধর্মীয় সারাৎসারকে মানুষের সারাৎসারে পর্যবসিত করেন। কিন্তু মানুষের সারসত্তা কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয় যে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই তা সহজাত। বাস্তবে মানুষ সামাজিক সম্পর্কের সম্মিলন”।
কিভাবে ফয়েরবাখ ধর্মীয় সারাৎসারকে মানুষের সারাৎসারে পর্যবসিত করেন? ফয়েরবাখের দাবি ধর্ম মানুষের নিজেরই চিন্তার উৎক্ষেপ, নিজের সম্পর্কে মানুষ যা চিন্তা করে সেটাই সে ধর্মচিন্তা হিসাবে প্রক্ষিপ্ত করে। তাহলে ধর্মের মধ্যে নিহিত মানুষের এই বিমূর্ত চিন্তাভাবনাকে নিরেট করার পদ্ধতি কি? সেই পদ্ধতি হচ্ছে ধর্মের সারাৎসার মানুষের মধ্যে আবিষ্কার করা। এটাই ফয়েরবাখীয় বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্য। এর প্রধান দাবি হচ্ছে ধর্ম বা ধর্মতত্ত্ব যা বলে তা আসলে মানুষেরই নিজের কথা – অতএব ধর্মের নিজস্ব কোন সত্য নাই; যদি তাই হয় তাহলে মানুষকে বস্তুবাদী ধ্যানধারণা দিয়ে বুদ্ধির দ্বারা ব্যাখ্যা করলেই ধর্ম অন্তর্হিত হবে কিম্বা ধর্মের রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে। কিন্তু এই বস্তুবাদী দাবি মার্কসের কাছে একদমই গ্রহণযোগ্য নয়।
ধর্ম সম্পর্কে ফয়েরবাখের এই প্রক্ষেপন তত্ত্ব মার্কস নাকচ করে দিচ্ছেন, এটা বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফয়েরবাখ ধর্মীয়, ধর্মতাত্ত্বিক এবং হেগেলীয় বিমূর্ত চিন্তাকে নিরেট করতে গিয়ে ‘মানুষ’ নামক আরেক বিমূর্ত ধারণার আমদানি করেছেন। বস্তুবাদ বলি কিম্বা যে কোন প্রকার মানবতাবাদ বলি তাদের গোড়ার দুর্বলতা এখানেই। ফয়েরবাখ মানুষকে ধর্মের জায়গায় প্রতিস্থাপন করলেও মার্কসের আপত্তি হচ্ছে এই যে ‘মানুষ’ নামক প্রকৃত (?) সারসত্তার যে (বিমূর্ত) ধারণা তিনি আমদানি করেছেন তার কোন পর্যালোচনা তিনি করেন নি। মার্কস বলছেন:
“ফয়েরবাখ, যিনি এই প্রকৃত সারসত্তার পর্যালোচনা করেন নাই, ফলে বাধ্য হয়েছেন:
১.ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া থেকে একে বিমূর্ত করে দেখতে এবং ধর্মীয় আবেগ বুঝি আপনাতেই আপনি অস্তিত্বমান বলে নির্দিষ্ট করতে; তার অনুমান মানুষ বুঝি এক বিমূর্ত – বিচ্ছিন্ন – ব্যাক্তি।
২. মানুষের সারসত্তাকে অতএব, তাঁর বিচারে কেবল ‘প্রজাতি (genus’) হিসাবে অনুধাবন করা যেতে পারে – মানুষের অন্তর্গত এক ধরণের নির্বাক সামান্য বৈশিষ্ট্য যেন, যার কাজ শুধু বহু মানুষকে প্রকৃতিগত ভাবে এক জ্ঞান করা”।
দেখা যাচ্ছে মার্কস ফয়েরবাখসহ বস্তুবাদেরী যাবতকালের জমে থাকা ওজনদার ভারি বস্তা পুরাটাই নাকচ করে দিচ্ছেন। বস্তুবাদের সবচেয়ে বিকশিত রূপ ফয়েরবাখেও ধর্ম বা দর্শনকে স্রেফ বিমূর্ত চিন্তা দিয়ে বা বুদ্ধির দ্বারাই নিরেট করার চেষ্টা। অথচ, মার্কসের দাবি, মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ নিছকই বুদ্ধির সম্পর্ক নয় বরং ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’। তাহলে বুদ্ধি বা দর্শনের কাজ হচ্ছে ব্যবহারিকতার জীবন্ত ও সক্রিয় সম্পর্কের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ রাখা। তাই শুরুতেই এক নম্বর থিসিসেই ফয়েরবাখের বিরুদ্ধে মার্কসের অভিযোগ:
“এ পর্যন্ত যে সকল বস্তুবাদ দেখা যায় – যার মধ্যে ফয়েরবাখও অন্তর্ভূক্ত – তাদের মূল সমস্যা হোল , বস্তু, বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়পরায়নতাকে ধারণা করা হয়েছে কেবল বাইরে হাজির বিষয় বা ধ্যান রূপে, কিন্তু মানুষের ইন্দ্রিয়পরায়ন তৎপরতা, চর্চা হিশাবে – অর্থাৎ কর্তার সক্রিয়তার দিক থেকে নয়। ফলে বস্তুবাদিতার উল্টাদিক থেকে সক্রিয় দিকটা বিমূর্ত ভাবে বিকশিত করেছে ভাববাদ—সেটা আবার বলাই বাহুল্য, বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়শীলতা ঠিক কী জিনিস জানে না। ফয়েরবাখ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুবিষয়াদিকে সত্যসত্যই চিন্তার বিষয় থেকে আলাদা করেন কিন্তু তিনি মানুষের খোদ কর্মতৎপরতাকে [কর্তার] নৈর্ব্যক্তিক কর্মতৎপরতা হিশাবে বুঝতে পারেন না। তার ‘খ্রিস্টিয় তত্ত্বের সারকথা’ রচনায় তিনি তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গকেই মানুষের একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী বলে মেনেছেন অথচ চর্চাকে বুঝেছেন ও নির্ণয় করেছেন নোংরা ইহুদি-ধর্মাচারের অভিব্যাক্তি হিসাবে। ফলে তিনি ‘বিপ্লবী’ ব্যবহারিক-পর্যালোচনামূলক’ কাজ-কারবারের তাৎপর্য বোঝেন নাই”।
তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের ইন্দ্রিয়পরায়নতাকে স্রেফ বুদ্ধির কারবার হিসাবে পর্যবসিত করা যায় না। মানুষ বুদ্ধি ব্যবহার করে বটে, কিন্তু শুধু বুদ্ধির দ্বারা চলে না। মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ বিচারকে এ জন্যই মার্কস সক্রিয় ও সজীব ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ হিসাবেই বুঝতে চেয়েছেন। বাস্তবে জাগতিক ভাবে মানুষ কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত তাকে মানুষের তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে হবে। বুদ্ধির বিচার প্রয়োজন, কিন্তু তাকে নিছকই বুদ্ধির বিষয়ে পর্যবসিত করলে চলবে না। তদুপরি মনে রাখতে হচ্ছে এই সম্বন্ধের মধ্যে মানুষের ইচ্ছা ও অনিচ্ছার বাইরের সম্বন্ধও সমান ক্রিয়াশীল থাকে।
কিন্তু আফসোস, তরুণ বয়সের এই ধারণাগুলো নিয়ে মার্কস বিস্তৃত কিছু আর লেখেন নি। ব্যবহারিক সম্পর্ক বিচার করবার তাগিদে এবং ফয়েরবাখের পর্যালোচনার সূত্র ধরেই তিনি পরবর্তীতে ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ নামক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা নিয়ে কাজ করেছেন এবং দর্শন তার হাতে আর বিমূর্ত চিন্তার চর্চা হয়ে রইল না, বরং হয়ে উঠল বাস্তবে বেঁচে থাকার জন্য জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ বিচার এবং তার ইতিহাস: ক্রিটিক বা পর্যালোচনা। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ কথাটার যে বিস্তৃত পর্যালোচনার দরকার ছিল মার্কস সেই ব্যাখ্যা থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছেন।
একালে আমাদের প্রায় সকল জিজ্ঞাসাই মানুষের সঙ্গে জগতের ব্যবহারিক সম্বন্ধ বিচার এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তব্য নির্ণয়ের প্রশ্ন – এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। সেই ক্ষেত্রে মার্কস আমাদের সূচনা হতে পারেন। বুদ্ধির জগত থেকে বিরিয়ে এসে কর্তব্যের জগতে প্রবেশের দরজা কার্ল মাত্তকস। পরাবিদ্যা বা ‘দর্শন’ নামক যে ব্যাপারটির সঙ্গে আমরা এ যাবতকাল পরিচিত তার বোঝা বয়ে বেড়ানো হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার সূত্র তিনি। কিন্তু যে জগতটা তিনি খানিক দেখিয়েছেন তাকে পুরাপুরি উন্মোচিত করবার কাজ প্রায় পুরাটাই এখনও বাকি পড়ে আছে।
প্রক্রিয়া ও কর্তা
জগৎ কি তাহলে এক, অখণ্ড ও অবিভাজ্য? তাহলে চিন্তা আর বাস্তব জগৎ কি একই কথা? কিম্বা চিন্তা ও চিন্তার ‘বিষয়’? বস্তু ও ভাব? এই প্রশ্ন জর্মান ভাবাদর্শের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা হয়েছে। যেমন, ইম্মেনুয়েল কান্ট বলছেন চিন্তার কাছে যে-জগৎ ধরা দিচ্ছে সেই জগৎ যে শুধুই চিন্তার বাইরের জগৎ তা নয়। এই জগতকে পরিগঠিত করবার ক্ষেত্রে বা তাকে ‘জগত’ হিশাবে আমাদের চিন্তায় ধরা দেবার প্রক্রিয়ায় চিন্তা নিজেও কিছু ‘বিশুদ্ধ’ শর্ত দান করে, সেটা চিন্তার বাইরে থেকে নয়, বরং চিন্তার স্বভাবের কারণে চিন্তার ভেতর থেকেই সেটা ঘটে। এই স্বভাব কোন পারলৌকিক বা রহস্যময় কিছু নয়। খুবই জাগতিক ব্যাপার। জগতের মধ্যে জগতের সঙ্গে সম্পকিত থাকার চরিত্রের মধ্যেই চিন্তার এই স্বভাবকে বুঝতে হবে। ব্যাপারটা মোটেও আমাদের মনগড়া কিছু ভাবনা যোগ করাও নয়। যেমন ‘দেশ’, ‘কাল’, ‘আমি’, ইত্যাদি। কোন কিছু ‘আছে’ বা ‘আছি’ হয়ে ওঠার আগাম শর্ত হিশাবে তাদের উপস্থিতি ঘটে যায় চিন্তারও আগে (a priori)। এই শর্তেই আমরা কোন বিশেষ জায়গায় বা বিশেষ সময়ে ইন্দ্রিয়োপলব্ধ জগৎকে দেশকালপাত্রে উপলব্ধি করতে পারি। তেমনি, উপলব্ধির জগৎকে বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে-বা যে অর্থে আমরা জগৎকে ‘জানা’ বলি সেটাও সম্ভব হয় জানবার জন্য চিন্তার আগাম শর্ত হাজির থাকার কারণে।
হেগেল বললেন, চিন্তা মাত্রই --এমনকি সত্যিকার অর্থে চিন্তা করা শুরু করার জন্য যদি শুধু সচেতন হই জগৎ তৎক্ষণাৎ দুই ভাগে ভাগ হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়; একদিকে ‘আমি’ আর অনাদিকে তাৎক্ষণিক ‘জগৎ’। দুটি মিলেই হেগেলের ভাষা ‘আছে’ বলা বা ‘আছি’ হওয়া। হেগেলের ভাষায়দ, বিশুদ্ধ উপস্থিতি (Pure Being)। একদিকে বিশুদ্ধ চিন্তা আর অন্যদিকে স্রেফ ‘এই’ বলে যাকে চিন্তা তাৎক্ষণিক চিহ্নিত করে। দুই মিলেই জগত ধীরে ধীরে ধাপা ধাপে কিভাবে ‘হয়’, হয়ে ওঠে ওঠে বা অস্তিত্বমান হয় হেগেল তাঁর দর্শনে সেটা ব্যাখ্যা করেছেন। আমরা সেইদিকে যাব না। কিন্তু চিন্তা মাত্রই একদিকে সক্রিয় চিন্তা আর অন্যদিকে চিন্তার বিষয় – এই স্বাভাবিক বিভাজন সম্পর্কে আমরা সচেতন থাকব।
এই তাৎক্ষণিক স্তর থেকে শুরু করে চেতনার স্তরে ‘আমি’ নামক ব্যাপারটা যে আসল কী, সেটা আমরা নাও বুঝতে পারি, নাও জানতে পারি। কিভাবে আমরা জানি হেগেল সেই জানার প্রক্রিয়াটা --সেই প্রক্রিয়ার ইতিহাসটাই আমাদেদের ব্যাখ্যা করে ধাপে ধাপে দেখিয়েছেন। আমরা শুরু করি ইন্দ্রিয়-নিশ্চয়তা থেকে। যা আছে বা সামনে হাজির সেই ইহ বা ‘এই’ সম্পর্কে নিশ্চয়তাবোধ থেকে। কিন্তু ‘আমি’ তখন ‘চেতনা’ মাত্র, ‘আত্মসচেতন’ নই বা তখনো সেই ‘আমি’ নই যে নিজেকে নিজে জানে। হেগেলের প্রকল্প হচ্ছে কিভাবে এই ‘আমি’ স্তরে স্তরে তাৎক্ষণিক চেতনা থেকে আত্মসচেতন হয়ে উঠল এবং নিজেকেই জগতের পরম সত্য হিশাবে জানল, প্রজ্ঞা হয়ে উঠল তার ব্যাখ্যা দেওয়া। চেতনার তাৎক্ষণিক আরম্ভ থেকে শুরু থেকে একদিকে মানুষ (আমি) আর অন্য দিকে জগত (প্রকৃতি) এই দুইয়ের বিভাজন ও দ্বন্দ্ব থেকে আরম্ভ করে আত্মসচেতন হওয়া এবং স্তরে স্তরে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করে নিজেকে এক, অখণ্ড ও অদ্বিতীয় রূপে জেনে চিন্তা কিভাবে প্রজ্ঞা হয়ে উঠল সেই পরমের বর্ণনা ও বয়ান আমরা হেগেলের দর্শনে পাই।
কিন্তু হেগেলের ‘কর্তা’-র ধারণা না বুঝলে আবার এই দিকটা বোঝার ক্রটি ঘটে। হেগেলের কাছে চিন্তা বলি কি জগৎ বলি প্রক্রিয়ার ‘কর্তা’ কোনটিই নয়। বরং প্রক্রিয়াটাই বা প্রক্রিয়ার ইতিহাসটাই আত্মসচেতন হয়ে ওঠা মানুষের নিজেকে নিজে জানবার সারপদার্থ (Substance) এবং একই সঙ্গে ‘কর্তা’ (Subject)। পানির তিন অবস্থা বরফ, তরল এবং বাষ্প – ঠাণ্ডা বরফ থেকে বাষ্প হবার প্রক্রিয়ায় পানির তিন অবস্থার অতিক্রম করে। পানির বিশেষ একটি অবস্থা জানলে পানিকে সমগ্র ভাবে তার ইতিহাস সমেত জানা যায় না। পানিকে জানার অর্থ হচ্ছে পানির এই অবস্থান্তরের প্রক্রিয়া বা ইতিহাস জানা। ‘পানি’ নামে যাকে বিমূর্ত ভাবে আগাম ধারণা করে নিয়েছি তাকেই কর্তা হিসাবে এই প্রক্রিয়ায় ভাবতে হবে যাতে আমরা বলতে পারি পানি নিজেই একেকটি মুহূর্তের মধ্য দিয়ে নিজেকে মূর্ত করে তুলেছে। এখন যেভাবে বললাম, বলার এই ধরনটা হেগেলীয়। বিমূর্ত ভাবে আগাম যাকে ‘পানি’ বলে নাম দিয়েছি সেই পানি একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার কর্তা এবং বিভিন্ন মুহূর্ত অতিক্রমকারী প্রক্রিয়া।
চিন্তাই জানে, চিন্তাই ‘আত্মসচেতন’ হয়, কর্তা ও প্রক্রিয়ার অভিন্ন ধারনা থেকে হেগেল এই সকল উপসংহার টানেন। রক্তমাংসের মানুশ নয় তাঁর কাছে চিন্তাই এখনাএ কর্তা এবং প্রক্রিয়া। হেগেলের ভাষায় স্পিরিট, পরমার্থিক জ্ঞান। চিন্তা যুগপৎ কর্তা ও প্রক্রিয়া হিসাবে চিন্তার বিশেষ বিশেষ রূপ বা অবস্থার মধ্য দিয়ে পরম জ্ঞান (absolute) হয়ে ওঠে। চিন্তা এ কারণেই প্রজ্ঞা। জানার প্রক্রিয়াই এখানে একই সঙ্গে প্রজ্ঞা হয়ে ওঠে। চিন্তা নিজেই প্রক্রিয়া এবং নিজেই কর্তা। আর ঠিক এই অর্থেই geist, স্পিরিট বা পরম।
মার্কস এখানে সেখানে, এদিকে সেদিকে হেগেলের দর্শনের বিক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করেছেন। সেই সকল পর্যালোচনার কোন পরিণত রূপ আমরা দেখি নি। এর ফলে মার্কসকে বুঝতে মুশকিল হয়েছে অনেক। এখনও সেই বিপদ রয়ে গিয়েছে। মার্কস কোন্ অর্থে হেগেল থেকে আলাদা সেই তর্কে না গিয়েও যে প্রক্রিয়া বা ইতিহাস চেতনাসম্পন্ন মানুষের মধ্য দিয়ে আত্মসচেতন হয়ে ওঠে সেই হয়ে ওঠার বর্ণনা মার্কসেও আমরা দেখি। হেগেলীয় বয়ানের প্রতিফলন মার্কসের ইতিহাস ব্যাখ্যার মধ্যেও আছে। মানুষ ইতিহাসের কর্তা এবং প্রক্রিয়া মার্কস ঠিক এই রকম আদ্ধেক কথা বলেন নি, বরং বলেছেন মানুষ ইতিহাস তৈরি করে ঠিক, কিন্তু সেটা করে ইতিহাসের মধ্যে থেকে, ইতিহাসের মধ্যে বাস করার মধ্য দিয়ে। নিজেকে তার ইতিহাসের ‘কর্তা’ মনে হতে পারে, কিন্তু যখনই সজীব ও সক্রিয় চিন্তা বিষয়টা বিচার করে দেখে তখন বোঝে যে আসলে ইতিহাসই মানুষের মধ্য দিয়ে রূপায়িত হয়ে চলেছে। এই দেখাটা মানুষের দিক থেকে দেখা নয়, ইতিহাসের গোটা প্রক্রিয়ার দিক থেকে দেখা।
মার্কস অবশ্য ঠিকই বলেছেন, হেগেল মানুষের বিকাশটা বর্ণনা করেছে চিন্তার বিকাশ হিশাবে, আর তিনি নিজে তাকে ব্যাখ্যা করেছেন ইহলৌকিক ইতিহাস হিশাবে। গুরু হিশাবে হেগেলকে মার্কস অস্বীকার করেন নি,বরং তরুণ বযসে ইয়ং হেগেলিয়ান হিশাবে তাঁর দ্রোহি মনোভাব থাকলেও পরিণত বয়সে এসে হেগেলের অসামান্য অবদান আন্তরিকভাবে মার্কস স্বীকার করে নিয়েছেন। সেই স্বীকারের মধ্যে নতি নয়, বরং পর্যালোচনা এবং পুরোমাত্রায় বৈচারিক প্রজ্ঞা হাজির ছিল। কোথায় তিনি গুরু থেকে আলাদা সেই বিষয়ে হুঁশও ছিল ষোল আনা।
কিন্তু হেগেলের চিন্তার পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন বলে মার্কস আসলে হেগেলের মতোই মানুষ ও প্রকৃতির-অভেদ সম্পর্কে সজ্ঞান ছিলেন এবং ইতিহাসও মার্কসে শুরু হয়েছে মানুষ ও প্রকৃতির তাৎক্ষণিক বা অব্যবহিত সম্বন্ধ থেকে। যখন প্রকৃতি থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন ছিল না। বিচ্ছিন্ন হবার প্রক্রিয়া শুরু হয় উৎপাদন থেকে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল না থেকে মানুষ যখন নিজেই নিজের আহার ও অন্যান্য চাহিদা মেটতে শুরু করল, তখ থেকে মানুষের ইতিহাস আর প্রকৃতির ইতিহাস হয়ে রইল না। কিন্তু ইতিহাসকে যদি আমরা সামগ্রিক ভাবে বুঝতে চাই তাহলে মানুষ ও প্রকৃতির সম্বন্ধের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ও বিবর্তন ঘটেছে তার হদিস নিতে হবে।
চিন্তার নিজস্ব স্বভাবের কারণেই চেতনাসম্পন্ন মানুষ মাত্রই প্রকৃতিকে তার ‘অপর’ বা তার বাইরে হাজির এক জগৎ হিশাবে দেখে।এখান থেকেই চেতনার শুরু। চিন্তার আর বিকাশ না ঘটলে মানুষ ও প্রকৃতি চিরদিনই পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা থেকে যায়। চিন্তার বিকাশ না ঘটলে মানুষ আর জগত যে অভিন্ন সেই জাগ্রত চেতনার স্বাদ মানুষ লাভ করতে পারে না। কিন্তু এটা পরিষ্কার সেৎ নিছকই চিন্তার জগতে ঘটলে হবে না। জগতের সঙ্গে মানুষের ‘ইন্দ্রিয়পরায়ন ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ চর্চার ইতিহাস বুঝতে হবে।
ফয়েরবাখ সংক্রান্ত সংকল্প ও ঘোষণার মধ্যে চিন্তার স্বাভাবিক মুশকিলটা মার্কস ঠিকই এই কারণে ধরতে পেরেছিলেন। একদিকে বস্তু অন্যদিকে চিন্তা অথবা একদিকে বস্তুজগৎ আর অন্যদিকে ভাববাদ- এই দ্বিবিভাগের ভ্রান্তি সম্পর্কে তাঁর হুঁশ ছিল পাকা। ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসের প্রথম সুত্রেই তিনি বলছেন, তাঁর আগে বস্তুবাদ নামে যা কিছু জারি ছিল তাদের প্রধান মুশকিল তারা জগৎকে শুধু ‘চিন্তার বিষয়’ বলেই গণ্য করেছে। অর্থাৎ একদিকে চিন্তা বা ভাব আর অন্যদিকে জগৎ. প্রকৃতি, বস্তু ইত্যাদি। মুশকিল হোল, সেই ক্ষেত্রে চিন্তাশীল ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষের সক্রিয় কর্মকাণ্ড এই বিবেচনা থেকে বাদ থেকে গিয়েছে। অর্থাৎ চিন্তা নিজের প্রক্রিয়াকে, ইহলৌকিক বাস্তব জীবনে তার নিজের কর্মকাণ্ড বা তৎপরতাকে বস্তুসম্পন্ন গণ্য করে নি। এই ভেদবুদ্ধির কারণে বস্তুজগতের বাইরের ব্যাপার হিশাবে ইন্দ্রিয়শীল মানুষের সক্রিয় তৎপরতা গড়ে উঠেছে ‘ভাববাদ’ হিশাবে। বস্তুবাদীরা ভেবেছে বস্তুময় জগৎই সত্য, কিন্তু বস্তুময় জগৎকে চিন্তা জানছে এবং জানতে গিয়ে চিন্তার নিজের যে বস্তুময় প্রক্রিয়া -- -অর্থাৎ চিন্তা-প্রক্রিয়া -- তাকে বস্তুবাদ নজরে আনে নি। এমনকি তাকে ‘ভাববাদ’ বলে অস্বীকার করেছে। ইহলৌকিকতা বা বস্তুবাদিতার এই দিকটা -- চিন্তার দিকটা --জগতকে ইন্দ্রিয়পরায়ণভাবে উপলব্ধি ও জানার ক্ষেত্রটি অতএব গড়ে উঠেছে ‘ভাববাদ’ হিশাবে। বস্তুবাদ ও ভাববাদকে মার্কস একই বস্তুবাদী প্রক্রিয়ার দুটো দিক বলে শনাক্ত করেছেন। উভয়েরই সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা করেছেন।
ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসে এবং মার্কসের তরুন বয়সের রচনায় মার্কসের এবম্বিধ সংকল্প ও কথা মার্কসের সময়কালে যেমন নতুন ঠেকেছিল, একালে আমাদের সময়েও সদ্য ঘোষিত ঘটনার মতোই হয়ে আছে। মার্কস ঠিক কোথায় বিপ্লবটা ঘটাচ্ছিলেন সেটা তৎক্ষণাৎ যেমন ধরা পড়ে নি। এখনও আমরা বুঝে উঠতে পেরেছি কিনা সন্দেহ। ‘মার্কসবাদ’ নামে যে মতাদর্শ ও রাজনীতি গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে মার্কসের এই চিন্তার সঙ্গতি নাই বললেই চলে। মার্কসবাদের নামে বিস্তর মনগড়া আবর্জনা বেড়ে ওঠারও কারণ এখানে। মার্কসের এই সকল কথা নিছকই কথার কথা হিশাবে থেকে গিয়েছে। চিন্তা চর্চার জীবন্ত বা প্রবাহমান ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে মার্কসের চিন্তাকে আর দশটা ‘মত’ বা ‘মতাদর্শ’ ছাড়া অন্য কিছু গণ্য করা হয় নি। একে জীবন্ত চিন্তার চর্চা হিসাবে আমরা শিখি নি, আত্মস্থ করি নি। ফলে চিন্তার নিজের স্বভাবের দিকে নজর ফেরানোর অবসর হয় নি আমাদের। চিন্তার মুশকিল তার স্বভাবেরই অন্তর্গত ব্যাপার, স্বাভাবিক --সেই দিকগুলো তথাকথিত ভাববাদী দর্শন যেমন, তেমনি বস্তুবাদী, মায় মার্কসবাদী দর্শনও ধরতে পারে নি। একে বোঝার জন্য চিন্তাকে নিজের প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্তকেও আপন পর্যালোচনার অধীন করতে জানতে হবে। মার্কস নিজে কঠোর একনিষ্ঠতায় এই সূত্র অনুসরণ করেছেন।
যদি মার্কসের কাছে আমরা এই সহজ পাঠ গ্রহণ করি-যে,চিন্তা মাত্রই বিদ্যমান মত ও মতাদর্শের পর্যালোচনা - তাহলে খোদ মার্কসের নামে গড়ে গঠা ‘মত’ বা ‘মতবাদ’-কেও আমরা সজীব পর্যারোচনার অধীনে অনায়াসেই নিয়ে আসতে পারি। মার্কসের চিন্তাপদ্ধতির এখানেই অসামান্য শক্তি যে চিন্তা নিজের পর্যালোচনা নিজে করতে সক্ষম। ফলে পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে চিন্তার বিকাশ এই ক্ষেত্রে রুদ্ধ করা কঠিন। আর ঠিক এখানেই মার্কসের সঙ্গে অন্যের বা অন্য মতাদশের পার্থক্য। আবার ঠিক শুধু এই বৈপ্লবিক কারণেও তাঁকে আমাদের এখনও খুবই দরকার।
যদি এতোটুকু আমরা বুঝি তাহলে বহুদূর আমরা এগিয়ে যেতে পারি। সেই দিক থেকে লেখালিখিকে যদি আমরা চিন্তার ক্ষেত্র গণ্য করি, তাহলে ওর মধ্য দিয়ে চিন্তার পর্যালোচনা এবং বিকাশের গুরুত্ব মার্কসের কাছে ‘জগৎ বদলে দেওয়া’ থেকে আলাদা কিছু নয়। এখানে চিন্তা ও জগৎ -- কিম্বা জগৎ ও জাগতিক মানুষের চিন্তা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বা আলাদা কিছু নয়। এই অভেদ ঘোষণা করে ইতিহাসে যে- স্তরে মার্কস ঠাঁই করে নিয়েছেন, দিন দিন তা ম্লান হওয়া দুরে থাক বরং আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তাঁকে ছাড়া এখন আর আমাদের চলছে না। চলবেও না। তাঁকে আমাদের আরো বেশি দরকার এই কারণে যে চিন্তা ও জগতের অভেদজ্ঞানের পাটাতনে দাঁড়িয়ে চিন্তা ও বিপ্লবী তৎপরতার মাঝখানের দেয়াল তিনি যেভাবে ভেঙে দিয়েছেন তাতে জগতকে আমরা নতুনভাবে বুঝতে ও মোকাবিলা করতে শিখেছি। জগৎ বদলাবার সংকল্পের অর্থ এখন আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ধরা পড়ছে।
এই অতি প্রাথমিক দিকটা যদি ধরতে পারি তাহলে মার্কসের কারণে মার্কসের পর চিন্তা ও তৎপরতার ক্ষেত্রে যে-সকল নতুন দরোজা খুলেছে সেই দিকেও আমরা নির্ভয়ে নজর ফেরাতে পারি। অন্তত আমরা আমাদের আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক কয়েকটি ক্ষেত্রের উল্লেখ করে রাখতে পারি এখন।
প্রথমে কার্ল মার্কসের হাতে দর্শনের ‘ক্রিটিক’ বা পর্যালোচনার যে ধারা তৈরি হয়েছিল, তা আরো বিকশিত হয়েছে, তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছে। ‘দুনিয়াকে দার্শনিকরা খালি নানান দিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে বদলে দেওয়া’-- ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসে মার্কস এই কথা বলে দর্শনের পরিমণ্ডল থেকে ‘প্রস্থান’ করবার যে-ঘোষণা দিয়েছিলেন তার ফলে চিন্তা নিজেকে নিজে পর্যালোচনা করবার ধারায়, পদ্ধতিতে ও বিষয়বৈচিত্র্যে বিকাশ ঘটিয়েছে দারুণ। মার্কস নিজে দর্শন থেকে প্রস্থানের কথা বলে চিন্তা চর্চা বাদ দেন নি, বরং ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক দর্শনের - অর্থাৎ মানুষের বৈষয়িক জীবন ও চিন্তাকে জাগতিক সম্বন্ধের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করবার নতুন ক্ষেত্র নির্মাণ করেছেন। দেখিয়েছেন দর্শন নিজে যে চিন্তা করে তার ভিত্তি বিশুদ্ধ চিন্তা নয়। তার দেশকালপাত্র আছে এবং সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি সেখানে উপস্থিত থাকে । সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদির ইতিহাস খোদ দর্শনের ভাব, ভাষা ও প্রকরণের সীমা ও সম্ভাবনা নির্দিষ্ট করে দেয়। বিশেষ দেশকালপাত্রে যে-বিশেষ ধরনের চিন্তার আবির্ভাব ঘটে দর্শন নিজে তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। ব্যাখ্যা দেবার জন্য দরকার নতুন ধরনের চিন্তা; মানুষের চিন্তার মর্ম বুঝতে হলে যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা বা পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ বাস করে সেই জীবন বোঝা ও বিচারের জন্য ভিন্ন ধরনের পর্যালোচনা দরকার হয়ে পড়ে । ‘ফিলসফি’ নয়, দরকার ‘ক্রিটিক’। বিচার।
চিন্তার এই নতুন ধরনের চিন্তাশীলতার প্রকাশ আমরা দেখি মার্কসের অর্থশাস্ত্র পর্যালোচনার মধ্যে। মার্কসের ‘অর্থশাস্ত্র’ সেই অর্থে ‘শাস্ত্র’ নয় মোটেও। বরং পর্যালোচনা পদ্ধতি। এটা হচ্ছে চিন্তার নিজের সঙ্গে নিজের ‘ব্যবহারিক সম্পর্ক'। প্রথাগত দর্শন -- বা যে চিন্তা কেবল চিন্তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে অভ্যস্ত --তার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে চিন্তাকে বাস্তবের মধ্যে স্থাপন, জাগতিকতার মধ্যে চেনা। অর্থশান্ত্রের পরিমণ্ডলে চিন্তাকে দাঁড় করিয়ে নতুনভাবে পর্যালোচনা করবার পথ দেখালেন মার্কস। মানুষ ও প্রকৃতির ঐতিহাসিক সম্পর্কের বাইরে চিন্তার আলাদা কোন পারলৌকিক বা অলৌকিক অস্তিত্ব মানলেন না তিনি। চিন্তাকে ‘পরম’ বা পরমেশ্বরও জ্ঞান করলেন না; এই ক্ষেত্রে তাঁর গুরু হেগেলের কাছ থেকে নিজের ভিন্নতা টানলেন , পরিষ্কার ভাবে পৃথক হয়ে গেলেন। ‘দর্শন’-কে সত্য নির্ণয়ের অধিকার থেকে হটিয়ে সেখানে জীবন্ত চিন্তা বা ‘পর্যালোচনা’-কে স্থাপন করলেন। মার্কস প্রথাগত ‘দর্শন’-থেকে প্রস্থান করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই কর্ম করতে গিয়ে দর্শনের অভিমুখ, প্রকরণ ও চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে গিয়েছেন। দর্শনের কর্তব্য দার্শনিক ‘সত্য’ নির্ণয় নয় --বরং নানান ভাষা ও বয়ানে চিন্তা --বৈজ্ঞানিক কি দার্শনিক যে রূপই পরিগ্রহণ করুক --তার জগতিক পর্যালোচনা।
ফরাসি দার্শনিক ল্যুই আলথুসার মার্কসের অবদানকে শনাক্ত করতে গিয়ে দাবি করেছিলেন, মার্কসের ‘দর্শন’ আদতে ‘বিজ্ঞান’। মার্কসের চিন্তা, দর্শন বা বিচারের ধারাকে আধুনিক বিজ্ঞান--বিশেষত আঠারো শতকীয় প্রকৃতি বিজ্ঞানের আদলে পর্যবসিত করবার জের তাঁর মধ্যে রয়ে গিয়েছিল। ‘বিজ্ঞান’ ধারণা দিয়ে দর্শন ব্যাখ্যা করবার অনুমান হচ্ছে মানুষের ইচ্ছা আকাংখা সংকল্প ইত্যাদি পদার্থ বিজ্ঞানের মতো নৈর্ব্যক্তিক সূত্র মেনে চলে। ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ বা মার্কসের ইতিহাস-বিচারকে ‘ইতিহাসবিজ্ঞানে’ পরিণত করার দিক থেকে আলথুসারের মেধা ও সাহস দুটোই ছিল। মার্কসের চিন্তাকে এক, অখণ্ড এবং তরুণ বয়স থেকে শুরু করে পরিণত বয়স অবধি কোন বিকাশ বা স্ববিরোধিতাশূন্য মনে করার তিনি প্রতিবাদ জানালেন। মার্কসের চিন্তাকে এক থোকে ভাবা বা এক গোটায় ধরে নিয়ে বিকাশবিবর্জিত গণ্য করার বিপদ তিনি ঠিকই ধরেছিলেন। যে কোন চিন্তাশীলের চিন্তার মতো মার্কস তাঁর আগের ও সমসাময়িক দার্শনিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আলথুসার তরুণ মার্কসের চিন্তা আর পরিণত মার্কসের চিন্তার মধ্যে পার্থক্য করলেন। দাবি করলেন, তরুণ মার্কসের চিন্তা জর্মান ভাববাদী দার্শনিক পরিমণ্ডল, হেগেলের দার্শনিক পরিমণ্ডল এবং ব্রুপদি অর্থশাস্ত্রের ঘোরের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে, তরুন বয়সের শুরুর দিকের লেখালিখিতে মার্কস পুরাপুরি বেরিয়ে আসেন নি; আলথুসারের ভাষায়, জ্ঞানতাত্ত্বিক ছেদ (epistemological break) ঘটে নি। তাঁর দাবি, ১৮৪৫ সালে ‘জর্মান ভাবাদর্শ’ বইটির মধ্যেই আমরা পরিষ্কার এই জ্ঞানতাত্ত্বিক ছেদ বা আগের চিন্তা ভাবনা ভেঙে মার্কসের মধ্যে নতুন চিন্তার স্ফুরণ লক্ষ্য করা যায়। তরুণ মার্কস আর পরিণত মার্কস একই চিন্তার ধারক ছিলেন এই কথা তাহলে আর বলা যাচ্ছে না। পরিণত মার্কস যখন ‘পুঁজি’ গ্রন্থ লিখলেন এবং অর্থশাস্ত্রকে নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করালেন তখন তিনি নতুন একটি ‘বিজ্ঞান’ জন্ম দিয়েছেন। ‘জর্মান ভাবাদর্শ’ পাঠ করার সময় আলথুসারের এই পর্যালোচনার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। আলথুসার এই দিক থেকে ‘জর্মান ভাবাদর্শ’ পাঠের সহায়ক অবশ্যই। কিন্তু একে জ্ঞানতাত্ত্বিক ছেদ বলে তিনি যেভাবে তরুণ বয়সের অন্যান্য লেখাকে গৌণ করতে চেয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে; দেখুন, (Althusser, 1969)। আলথুসার নিজেও বলেছেন যা লিখেছেন তার সংশোধন হতে পারে, কিন্তু একজন কমিউনিস্ট হিসাবে তিনি ফরাসি বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সত্তর দশকের দিকে যে তর্কে যোগ দিয়েছিলেন বইটিকে সেই বাস্তবতার নিরিখে পড়বার জন্য যেভাবে লেখেছেন সেভাবেই তা ছাপছেন।
তবে ‘মানবতাবাদী’ প্রমাণ করে বিপ্লবী রাজনীতির বিপরীতে মার্কসকে বুর্জোয়া মতাদর্শের পক্ষে দাঁড় করানোর যেধারা পাশ্চাত্যে গড়ে উঠছিল তাকে বিরোধিতা করবার তাগিদ ছিল আলথুসারের। মার্কসের চিন্তা ও তৎপরতার কেন্দ্রীয় বিষয় যে ‘মানুষ’ নয় এই দিকটা স্পষ্ট করে তোলার দিক থেকে আলথুসারের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিজ্ঞান হিশাবে অর্থশাস্ত্র যাকে বিচারের ‘বিষয়’ গণ্য করে, আলথুসার মার্কসের ‘বিষয়’ হিশাবে নির্ণয় করলেন সেই অর্থশাস্ত্রকেই। প্রচলিত দর্শনে জ্ঞানকর্তা ও জ্ঞানের বিষয়ের সম্বন্ধ নির্ণয় থেকে বেরিয়ে এসে মার্কস দর্শনকে মানুষ আর জগতের সম্বন্ধ বিচার হিসাবে যেভাবে হাজির করেছেন আলথুসার তার তাৎপর্য ধরতে পারলেন না।
বলাবাহুল্য, মার্কসকে যারা ‘মানবতাবাদী প্রমাণ করতে চায় তাঁরা আলথুসারকে ‘মানবতা বিরোধী (anti-humanist) বলে অভিযোগ করেন। মার্কসকে ‘মানবতাবাদী’ প্রমাণের রাজনৈতিক বিপদ আলথুসার ঠিকই ধরে ছিলেন। কিন্তু চেতনাসম্পন্ন মানুষ ও জগতের সম্বন্ধের চরিত্র, গতি ও রূপান্তর সম্ভাবনা অনুধাবনের জন্য মার্কস যে বিচার বা পর্যালোচনার ধারা গড়ে তুলেছিলেন আলথুসার তাকে ঠিকভাবে ধরতে পারেন নি বলে আমাদের দাবি।
জর্মান ভাবাদর্শিক ধারার মধ্যে চেতনা ও বস্তু কিম্বা সোজা কথায় চেতনা সম্পন্ন মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ বিচার দর্শন বা জ্ঞানতাত্ত্বিক রূপ নিয়েছিল। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে নিছকই জ্ঞানচর্চার সম্পর্কের মধ্যে বিবেচনা চলছিল। সেই বিবেচনা মানুষের দিক থেকে - অর্থাৎ জ্ঞানের কর্তা হিশাবে মানুষ জগতকে যেভাবে দেখে, বোঝে, বিচার করে সেই অবস্থান থেকে বিবেচনা। মার্কস মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ চর্চার বিচারকে দর্শনের সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে বের করে এনে মানুষ আর জগতের জাগতিক সম্বন্ধ পর্যালোচনার বিষয়ে পরিণত করলেন। বিমূর্ত চিন্তার ক্ষেত্র থেকে বের করে এনে তাকে বাইরের বস্তুময় জগতে স্থাপন করলেন, জ্ঞানচর্চাকারী মানুষকে জর্মান দার্শনিকদের মতো শুধু চিন্তার ‘কর্তা’ ভাবলেন না, বরং মানুষ ও জগতের সম্বন্ধের বিবর্তনের মধ্যে থেকে কিভাবে কোন ধরণের মানুষ কখন জাগতিক ইতিহাসের কর্তা হিসাবে হাজির হয় সেই বাস্তব অবস্থা বিচারের দিকে দর্শনের নজর ফিরালেন । মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ মার্কসের কাছে নিছকই জ্ঞানতাত্ত্বিক সম্পর্ক হয়ে রইল না, হয়ে উঠল ‘উৎপাদন সম্পর্ক’: ভোগ, উৎপাদন, বিতরণ ও বিনিময়ের সম্পর্ক। মানুষ ও প্রকৃতি হয়ে উঠল উৎপাদন সম্পর্কের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। উৎপাদনের ইতিহাসই হয়ে উঠল মানুষ ও প্রকৃতির ইতিহাস। মানুষ যদি ইতিহাসের কর্তা হতে চায় তাহলে সেই কর্তারূপের আবির্ভাব ঘটতে পারে জগতের সঙ্গে মানুষের বৈষয়িক সম্বন্ধের ভেতরে থেকে। সেই সম্বন্ধের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য বিচার বা পর্যালোচনা ছাড়া মানুষ নিজের ঐতিহাসিক কর্তারূপকে শনাক্ত ও বিকশিত করতে পারে না।
জর্মান ভাবাদর্শিক ধারার বিপরীতে দাঁড়ানো বস্তুবাদী ধারার মতো মার্কস প্রকৃতিকে কর্তা সাব্যস্ত করেন নি ঠিক, কিন্তু হেগেলের একনিষ্ঠ হবার কারণে তিনি বুঝেছিলেন মানুষ যেমন নয়, তেমনি প্রকৃতি বা বস্তুজগতও ইতিহাসের কর্তা নয়, বরং উভয়ের ‘প্রাণরাসায়ণিক’ আদান প্রদানের গতিশীল সম্বন্ধ এবং তার রূপান্তরই এখানে ‘কর্তা’। এই ‘সম্পর্ক’ কোন স্থির ও অনড় কিছু নয়, বরং পরস্পর পরস্পরকে নির্ণয় করছে -- একটির মধ্যস্থতায় অন্যটি হয়ে উঠছে- কেউই স্বয়ম্ভু নয়। মানুষ ও জগতের এই গতিশীল সম্বন্ধ চর্চা বা প্রক্রিয়াকেই মার্কস ইতিহাসের ‘কর্তা’ জ্ঞান করলেন। মার্কসে ‘মানুষ’ নামক যেমন কোন বিমূর্ত ধারণা নাই, ঠিক তেমনি ‘জগত’ বা ‘প্রকৃতি’ নামক বিমূর্ত কোন অনুমানও নাই।
পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক হয়ে ওঠে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক। মার্কসের কাছে ‘পুঁজি’ হচ্ছে এই সম্পর্কের সবচেয়ে বিকশিত ঐতিহাসিক রূপ এবং জীবন্ত প্রক্রিয়া হিসাবে ইতিহাসের কর্তা। ইতিহাসে যখন থেকে পুঁজির আবির্ভাব ঘটল, পুঁজির ইতিহাসই হয়ে উঠল মানুষের ইতিহাস। মার্কসকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলথুসার মানুষ আর জগতের সম্বন্ধ সংক্রান্ত বিষয় পরিচ্ছন্ন করতে পারেন নি। আলথুসারের নজর থেকে এই সম্বন্ধ আড়ালে থেকে গিয়েছিল। ‘অর্থশাস্ত্র’ যে আসলে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিচার, জর্মান ভাবাদর্শের অভ্যন্তর থেকে প্রস্থান করার অর্থ জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরের ঐতিহাসিক সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ বিচারের বিস্তৃত পরিসরে প্রবেশ -- আলথুসার আমাদের নজর সেই দিকে ফেরাতে পারে নি। দর্শনের বিপরীতে অর্থশাস্ত্রকে খাড়া করলে জ্ঞানতাত্ত্বিক সংকীর্ণতার নিরসন ঘটে না। দর্শন বা দর্শন চর্চাও জগত থেকে উবে যায় না। শুধু দর্শনের একটি শাখা হিসাবে জ্ঞানতত্ত্ব অর্থশাস্ত্রীয় জ্ঞানতত্ত্বেপর্যবসিত হয়। তবুও আলথুসারের রচনাতেই তার চিন্তার শক্তিসহ সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিতটাও আমরা পাই। তিনি ইতিহাসকে ‘বিজ্ঞান’ বানাতে গিয়ে মার্কসের তরুন বয়সের দার্শনিক পর্যালোচনার মেধাবি দিকগুলোকে অপরিচ্ছন্ন করে ফেলে ছিলেন। ‘জমান ভাবাদর্শ’সহ মার্কসের তরুণ বয়সের রচনা পড়তে গিয়ে আলথুসারের অবদান আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার।
রূহানিয়াত: মানুষ যখন শুধু জীব মাত্র নয়
মানুষের চেতনা, ইচ্ছা, সংকল্প, কল্পনা --যাকে এক কথায় চিন্তা নামে আমরা সাধারণত বুঝি সেই চিন্তার শক্তি ও বিপুলতার প্রতি জর্মান ভাবাদর্শের নজর, এক পেশে হলেও, জারি ছিল। কান্ট থেকে শুরু করে হেগেল এবং ইয়ং হেগেলিয়ান অবধি দর্শনে একটা পর্যালোচনার ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু জর্মান ভাবাদর্শ যেহেতু চিন্তার পরিমণ্ডলের বাইরে আসে নি বা আসতে পারে নি – অর্থাৎ জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে নিছকই চিন্তা ও চিন্তার বিষয়ের সম্বন্ধ হিসাবে ভেবেছে ফলে সেটা ছিল এক পেশে। মার্কস সেই একপেশে নজরের ভুত ছাড়াতে গিয়ে চিন্তার নজর জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধ বিচারের দিকে নিবদ্ধ করলেন। মানুষ তার জীব জীবন বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে যে উৎপাদন সম্বন্ধে জড়ায় তাকে দর্শনের বিচার্য বিষয় করে তুললেন। মার্কসের এই দর্শন জর্মান ভাবাদর্শের বিপরীতে এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত সরকারী ভাষ্য অনুযায়ী ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’, ‘ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যখ্যা’ ইত্যাদি নামে আমামদের কাছে পরিচিত। পরিচিত হয়ে উঠল এবং খোদ মার্কস না পড়ে মার্ক্সের ওপর ।
অথচ আমরা দেখিয়েছি মার্কস খোদ বস্তুবাদেরই সমালোচনা করেছেন এবং বস্তুবাদী চিন্তার সীমাবদ্ধতার কারণে জগতের সঙ্গে মানুষের সজীব ও সক্রিয় ব্যবহারিক সম্বন্ধ ‘ভাববাদ’ হিসাবে গড়ে ওঠে সে সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধকে মার্কস আরও পরিপূর্ণ বা সামগ্রিক ভাবে বিচারের কথা বলছেন যেখানে ভাববাদ বনাম বস্তুবাদের বিভাজন সমস্যাসংকুল ও ভুল। এই বিভাজন মানুষ জগতে কিভাবে বিরাজ করে বা বর্তমান হয় তার কোন হদিস দিতে পারে না। মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধকে আরও পূর্ণ বা সামগ্রিক ভাবে বোঝার ক্ষেত্রেও মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে।
তাহলে মার্কসবাদ বা কমিউনিজম নামে যে ধারার আধিপত্য আমরা দেখেছি এবং এখনও যার জের রয়ে গিয়েছে তা মানুষের নিজের সম্পর্কে পূর্ণ উপলব্ধি – জগতের সঙ্গে ব্যবহারিক সম্বন্ধ বিচার এবং নিজের কর্তব্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি বিশাল বাধা। এটা আমরা সহজেই এখন বুঝতে পারি কারন বস্তুবাদের যে সংকীর্ণ চর্চার কারণে ভাববাদের অনিবার্য উৎপত্তি ঘটে বলে মার্কস বলেছেন তথাকথিত মার্কসবাদ তাকে মোকাবিলা না করে উলটা মার্কসবাদকে তার বিপরীতে এতোকাল হাজির করে এসেছে। এই বাধা অতিক্রম করে আমরা কিভাবে এগিয়ে যেতে পারি এখানে তারই সূত্র অনুসন্ধান করছি।
নিজেকে পূর্ণ ভাবে উপলব্ধি বা জগতের সঙ্গে সজীব ও সক্রিয় সম্বন্ধসমূহকে সামগ্রিক ভাবে বোঝার আকুতি মার্কসে সুস্পষ্ট ভাবে হাজির ছিল, এটা আমরা প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু থাকলেও মার্কসকে এক পেশে বস্তুবাদী ভাবে ব্যাখ্যা সেই বোঝাবুঝির প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। অন্যদিকে জগতের সঙ্গে সম্বন্ধের সামগ্রিকতাকে মার্কস উৎপাদন সম্পর্কের সামগ্রিকতা হিসাবে পর্যবসিত করায় প্রশ্ন রয়ে গিয়েছে মার্কস এই পূর্ণ ও সামগ্রিক বিচার থেকে সরে গিয়ে মানুষের পারমার্থিক প্রতিভা বা পরমের প্রতি আকুতিকে নজর থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন কিনা। এই প্রশ্ন আরও দৃঢ় হয়েছে যখন মার্কস বলেন, “মানুষের চেতনা মানুষের অস্তিত্বের নির্ধারক নয়, বরং সামাজিক অস্তিত্বই মানুষের চেতনা নির্ণয় করে’ (Marx, 1972, p. ২১)। তখন মনে হয় মার্কস ফয়েরবাখের সমালোচনার পরও ভাববাদ ও বস্তুবাদের বিভাজন কিম্বা তার জের জারি রেখে দিতে চাইছেন। মানুষের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ আরও পূর্ণ ও সামগ্রিক ভাবে বিচার ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে মার্কসের দ্বিধা কাটে নি।
মার্কস মানুষের পরমার্থিক আকুতিকে আদৌ মানুষের জাগতিক স্বভাব হিসাবে গণ্য করতেন কিনা সেটা তর্ক হিসাবে আজও রয়ে গিয়েছে। মানুষ তার সামনে যে জগতকে দেশকালে বিদ্যমান দেখে তার বিপরীতে আরও পূর্ণ জগত ও জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা করে কেন? মার্কস জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে নৈর্ব্যক্তিক সম্বন্ধ হিসাবে বিচার করতে চেয়েছেন, যা অর্থনৈতিক সম্বন্ধ দ্বারা আগাম নির্ধারিত বলে সমালোচনা করা হয়। অর্থাৎ জগতের সঙ্গে মানুষের উৎপাদন সম্পর্কই তার অন্য সকল ব্যবহারিক সম্বন্ধ নির্ণয় করে; অর্থনীতিই মানুষের ইচ্ছা, অভিপ্রায় বা আকুতির নির্ধারক। এই দাবির সমস্যা হোল, সকর্মক কর্তা হিসাবে বিদ্যমান সম্বন্ধের বাইরে দাঁড়িয়ে মানুষ আদৌ কোন ভূমিকা রাখে বা রাখতে পারে কিনা সেই সম্ভাবনা অস্বীকার। অর্থ নৈতিক সম্বন্ধের ওপর মার্কস বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাকে ‘আসল ভিত্তি’ বলেছেন, সেটা সমস্যা নয়। জীব জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য জগতের সঙ্গে মানুষের নিত্য সম্বন্ধের এই তাৎক্ষণিক ইচ্ছা-নিরপেক্ষ দিক বিবেচনা করলে আমরা মার্কসের এই দাবির তাৎপর্য বুঝি। কিন্তু এখানে আমরা যে প্রশ্ন তুলছি তা ভিন্ন।
প্রশ্ন হছে মানুষ কেন যা আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকে না, বরং যা নাই তার জন্য আকুতি বোধ করে? এই আকুতি চিন্তার প্রণোদনা তৈরি করে, গতি আনে, অভিমুখ নির্ধারণ করে, এবং জগতের সঙ্গে বিদ্যমান সম্বন্ধকে চ্যালেঞ্জ করে। দেখা যায়, সেটা করতে গিয়ে মানুষ তার নিজের জীবনকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। এই আকুতির সামাজিক-ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে। প্রথাগত চিন্তা ও বিদ্যমান ব্যবস্থাকে মানুষ অতিক্রম করে যেতে চায়, বদলাতে সক্রিয় হয়। পাশ্চাত্য দর্শন মার্কসের হাতে যেখানে এসে থেমেছে তাকে আমরা একটা নতুন সন্ধিস্থল বলতে পারি। যেখন থেকে নিজেকে আরও পূর্ণ ভাবে উপলব্ধির জন্য জগতের সঙ্গে সামাজিক মানুষের নতুন সম্বন্ধ নির্ণয়ের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে নতুন ভাবে আমরা ভাবতে পারি। ভবিষ্যৎ রচনা সব সবসময়ই কল্পনা ও অজানা সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি। সেই সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতির আশায় মানুষের জগতের সঙ্গে বিদ্যমান সম্বন্ধ ভেঙে যখনই নতুন ও আরও পূর্ণ সম্বন্ধ রচনার জন্য সক্রিয় হয় তাকে যদি আমরা বৈপ্লবিক পরিস্থিতি বলে গণ্য করি তাকে শনাক্ত করা, ব্যাখ্যা ও বোঝার উপায় কি? ইতিহাস সম্বন্ধে কোন সাধারণ বা সর্বজনীন নিয়ম দ্বারা বোঝা সম্ভব কি? নাকি প্রতিটি বিপ্লবী মুহূর্ত বা ঘটনাকে কে তার একক ও সুনির্দিষ্ট চরিত্র দ্বারাই বোঝা জরুরী।
মানুষ মাত্রই বিপ্লবী হয় না এবং জগতের সঙ্গে ব্যবহারিক সম্বন্ধ বৈপ্লবিক ভাবে রূপান্তর ঘটাবার জন্য সামাজিক মানুষ সবসময়ই তাগিদ বোধ করে না। অধিকাংশ মানুষ জাগতিক সম্বন্ধের অধীনস্থতা মেনে জীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু কোন জনগোষ্ঠি যখন এই সম্বন্ধ চ্যালেঞ্জ করে, ভাঙে, রূপান্তর ঘটায় এবং আরও বিকশিত সম্বন্ধ রচনা করতে চায় সেই মূহূর্তে মানুষের যে রাজনৈতিক দ্রোহ বা স্ফূর্তি এবং সেই সুনির্দিষ্ট জাগতিক অভিব্যাক্তি চেনার উপায় কি? সোজা কথায় বিপ্লবের চিন্তা ও বিপ্লবীর আবির্ভাব ঘটে কেন? তাদের জন্ম হয় কিভাবে?
সকর্মক কর্তা হিসাবে সমাজে বা ইতিহাসে মানুষ যে ভূমিকা রাখে মানুষের সামগ্রিক ইতিহাস বিচার করতে গিয়ে মানুষের সেই ঐতিহাসিক কর্তাসত্তার রূপ পর্যালোচনা ইতিহাসকে সামগ্রিক ভাবে বোঝার জন্য জরুরী। কিন্তু যা ঘটেছে কিম্বা ইতিহাস হিসাবে যা বিদ্যমান, তাকে দার্শনিক বা ঐতিহাসিক ভাবে বোঝা এক কথা, কিন্তু যা এখনও ঘটে নি তার স্বপ্ন দেখা, আগামির প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করা এবং তাকে বাস্তবায়িত করবার জন্য মানুষের পরমার্থিক আকুতিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? সেই আকুতি যে কর্তাসত্তা তৈরি করে বা চিন্তায় ও ইতিহাসে ব্যক্তি বা সমষ্টিকে যে ভূমিকা পালন করতে প্রণোদিত করে তাকে আমরা চিনব কি করে? ইতিহাসের কোন্ বিশেষ কালপর্বে বা কোন্ ঐতিহাসিক মুহূর্তে মানুষ আসলে কী ধরণের ভূমিকা রাখবে সেটা আগাম বলা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের পরমার্থিক আকুতি বা নিজেকে আরও পরিপূর্ণ সত্তা হিসাবে উপলব্ধির তাগিদ এবং বাস্তবে সেই উপলব্ধি মূর্ত করে তোলার জন্য যে কর্তাসত্তাকে নিজের মধ্যে জাগরিত দেখতে পায়, তাকে কি শুধু জগত আর মানুষের জাগতিক সম্বন্ধ পর্যালোচনা করে বোঝা সম্ভব? কী আছে এবং কী হওয়া উচিত এই দুইয়ের মধ্যে একটা ফারাক সবসময়ই থেকে যায়। কী আছে বা কেমন করে আছে এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য জ্ঞানতত্ত্ব বা প্রথাগত দর্শন আমাদের কাজে লাগে; কী উচিত বা কী করা কর্তব্য তাকেও নীতিশাস্ত্র একটা সীমা অবধি বিচার করতে পারে। কিন্তু সজীব ও সকর্মক কর্তাসত্তা হিসাবে মানুষ নিজেকে আরও পরিপূর্ণ ভাবে উপলব্ধির জন্য ভূমিকা রাখার নিশ্চয়তা আগাম নির্ধারিত বাঁধাধরা মলাটবন্দী শাস্ত্র বা দর্শন নির্ণয় করতে পারে না। এই দিকটি আমরা বুঝলে মার্কসের ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ সংক্রান্ত ধারণাকে আমরা জগতের সঙ্গে মানুষের সজীব ও জীবন্ত সম্পর্ক হিসাবে বুঝতে পারব, যে সম্বন্ধ চর্চায় মানুষ শুধু বিদ্যমান সম্বন্ধের অধীনস্থতা মেনে সক্রিয় থাকে তা নয়, বরং বিদ্যমান সম্বন্ধ অতিক্রম করে যাবার জন্যও যে কোন সময় সক্রিয় হতে পারে। যদি নতুন সম্ভাবনার তাগিদে সক্রিয় ও সজীব সম্বন্ধ হিসাবে বুঝি তাহলে ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ স্রেফ ‘বস্তুবাদী’ কিম্বা সংকীর্ণ অর্থে ‘বৈষয়িক’ সম্বন্ধ নয়। এই সম্বন্ধ চর্চায় বিদ্যমান চিন্তা ও ব্যবস্থার বাইরের নতুন উপাদান সব সময়ই মানুষের যুক্ত করার সম্ভাবনা নিহিত থাকে। ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ কথাটা মার্কসবাদে একটা সংকীর্ণ বস্তুবাদী ধারণায় পর্যবসিত হয়ছে। মানুষ ও জগতের সম্পর্ককে স্রেফ উৎপাদনের সম্পর্কে পর্যবসিত করে যে সংকীর্ণ বস্তুবাদী মানে আমরা দাঁড় করাই ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’কে সেই প্রকার বদ্ধ খাপে ঢোকালে মার্কসকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষ কেন বিদ্যমান সম্বন্ধ ভেঙ্গে নতুন সম্বন্ধ রচনার জন্য আকুল হয় ও বিপ্লবী ভূমিকা পালন করে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থনীতি মানুষের সকর্মক ভূমিকার নিয়ন্তা বা নির্ধারক এই প্রকার অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ থী বেরিয়ে আস জরুরী হয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে জগতের সকর্মক সত্তা হিসাবে মানুষ জগতের সঙ্গে ব্যবহারিক সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এমন কিছু যোগ করে কিনা যাকে স্রেফ বস্তু বা নিছক ইহলৌকিকতায় পর্যবসিত করে বোঝা যায় না। যদি অনুমান করি মানুষ স্বাধীন এবং সে তার ইচ্ছা ও সংকল্পকে এমন ভাবে খাটায় যার যার মধ্যে আকস্মিকতা ও ব্যাখ্যার অতীত উপাদান থাকে তাহলে ব্যবহারিক সম্বন্ধের তথাকথিত ‘বস্তুবাদী’ ব্যাখ্যা চলে না। যেমন, মানুষ আদর্শের জন্য নিজের জীবের জীবন দিতে রাজি থাকে। একে স্রেফ গোঁড়ামি, বোকামি বা অন্ধত্ব ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু মানুষ যাকে সঠিক, ন্যায্য, সত্য বা আদর্শ গণ্য করে তার জন্য জীবন দেয়, জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে। মার্কসের ‘ব্যবহারিক সম্পর্ক’ সংক্রান্ত ধারণা মানুষের এই স্বাধীন ইচ্ছা কে অস্বীকার করে না। বিদ্যমান জাগতিক সম্বন্ধ মানুষের ভূমিকাকে একদিকে নির্দিষ্ট করে দেয়, অন্যদিকে কর্তাসত্তা হিসাবে মানুষ সবসময়ই সেই সম্বন্ধের শৃংখল অস্বীকার করে স্বাধীন কর্তার ভূমিকা রাখবার সম্ভাবনা ধারণ করে।
ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিসে ‘ইন্দ্রিয়পরায়ন মানবিক ব্যবহারিক চর্চা’ হিসাবে মার্কস যাকে স্বীকার করেছেন মানুষের কর্তাসত্তার সম্ভাবনা বিচার সেই ধারণার অন্তর্ভুক্ত। ফয়েরবাখসহ প্রথাগত বস্তুবাদ ‘ইন্দ্রিয়পরায়ন মানবিক ব্যবহারিক চর্চা’ বুঝতে বা ধরতে পারে না, মার্কস সেটা পরিষ্কারই বলেছেন। মানুষের এই ইন্দ্রিয়গত ইহলৌকিক সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা ‘ভাববাদ’ হিশাবৎ বিকশিত হলেও মার্কস তাকে মানুষ ও জগতের সম্বন্ধ পর্যালোচনার অন্তর্গত করেছেন – এই দিকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাকে সাধারনত, ‘ভাববাদ’, ‘আধ্যাত্মিকতা’ কিম্বা নফসের বিপরীতে রূহানি শক্তি ইত্যাদি নানান ভাষায় আমরা আলোচনা করি তাকে মার্কসের জগতের সঙ্গে মানুষের ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ পর্যালোচনার অধীনে ব্যাখ্যা সম্ভব, সেটাই আমরা দাবি করি। এই সম্বন্ধ চর্চা যদি ভাববাদ হিসাবে বিকশিত হতে পারে, তাহলে মানুষের রূহানিয়াত বা রূহানি শক্তির ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে ইসলামের পরিভাষায় যে বিশেষ কর্তাসত্তার সঙ্গে আমরা পরিচিত তাকেও জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধ বিচারের জায়গা থেকে আমরা পর্যালোচনা করতে পারি।
তবে ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ নামক ধারণার পূর্ণ বিকাশ আমরা মার্কসে দেখি না। তাঁর চিন্তার প্রধান ধারায় আধ্যাত্মিকতা বা রূহানিয়াতের মীমাংসা তিনি অতোটুকুই করলেন যে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে এই সংবেদনশীলতার ঐহিক রূপ আমরা একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেই দেখব। অর্থাৎ বিদ্যমান সম্বন্ধ রূপান্তরের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক ভূমিকা পালন একমাত্র কারখানার শ্রমিকদের দ্বারাই সম্ভব।
কিন্তু শ্রমিক যদি উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে তৈরি সত্তা মাত্র হয় তাহলে কি করে মানুষের ঐতিহাসিক কল্পনা, ইচ্ছা, সংকল্প ধারণ করতে শ্রমিক সক্ষম? মার্কস হেগেলের পরিমণ্ডলে থেকে উত্তর দিচ্ছেন, সেটা সম্ভব কারণ শ্রমিক ইতিহাস সচেতন হয়েই শ্রমিক শ্রেণী হয়ে উঠবে। তার মধ্যে বিশেষ শ্রেণীর (particular class) স্বার্থ নয়, বরং সকল শ্রেণীর ঐতিহাসিক স্বার্থ নিহিত। এই অর্থে শ্রমিক শ্রেণী হবে সর্বজনীন শ্রেণী (universal class) এবং বিপ্লবের কর্তাশক্তি হিশাবে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু কিভাবে? পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক নিছকই রূপান্তরশীল পুঁজির রূপ (variable capital) মাত্র, সে কিভাবে তার বিপ্লবী পরমার্থিক প্রতিভা প্রদর্শন করতে সক্ষম? লেনিন শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতি করেছেন, কিন্তু স্পষ্টই বলেছেন শ্রমিকের পক্ষে বড়জোর তার অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের লড়াইয়ে ভূমিকা রাখা সম্ভব, কিন্তু রাজনৈতিক বিপ্লবে নয়, তার জন্য দরকার পেশাদার বিপ্লবী। মার্কসের চিন্তায় কিম্বা মার্কসবাদে এই প্রশ্ন মীমাংসার ইঙ্গিত ‘ইন্দ্রিয়পরায়ন মানবিক ব্যবহারিক চর্চা’-র ধারণায় নিহিত থাকলেও তা তাকে আজ অবধি পরিচ্ছন্ন ভাবে হাজির করা যায় নি। ভাববাদ/বস্তুবাদ মার্কা বাইনারি চিন্তা সেই ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। এই অভাব প্রথাগত মার্কসবাদের পতনের একটি কারন। বিপ্লবী রাজনীতির পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই অমীমাংসা এখনও প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
মার্কস ‘অর্থশাস্ত্র’ নামক নতুন এক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছেন এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই মার্কসবাদীরা একনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু দর্শনের বাইরে দাঁড়িয়ে লেনিন বা মাওজে দং যখনই জগতের সঙ্গে মানুষের বিদ্যমান সম্বন্ধ রূপান্তরের কাজে নামলেন বিপ্লবী ভূমিকাই জগতের সঙ্গে তাঁদের বিদ্যমান সম্বন্ধে বদল ঘটাল। বিদ্যমান জাগতিক সম্বন্ধ আপনা আপনি বদলায় নি। কিন্তু ততোটুকুই যতোটুকু তাঁরা নিজেরা ভাবতে সক্ষম হয়েছিলেন। জাগতিক সম্বন্ধের বাইয়ে স্বাধীন ভাবে ভাবতে পারা এবং বিদ্যমান সম্বন্ধের সঙ্গে ব্যবহারিক সম্বন্ধ রচনা – এই দিকটা দর্শন বা প্রথাগত রাজনৈতিক চর্চার তত্ত্ব আজও বুঝে উঠতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। দেখা যাচ্ছে বিপ্লবী কর্তাসত্তার ভূমিকা এবং তার বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্ন।
বিদ্যমান ব্যবহারিক সম্বন্ধ অতিক্রম করে নিজেকে আরও পরিপূর্ণ ভাবে উপলব্ধির আকুতিকে আমরা নাফসানিয়াতের বিপরীতে রূহানিয়াত বলছি। তরুণ বয়সে মার্কস ‘মানুষের ইন্দ্রিয়পরায়ন তৎপরতা’ বা ‘ব্যবহারিক চর্চা’ হিসাবে যে ধারণা গড়ে তুলেছিলেন পরবর্তীতে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর অতিরিক্ত প্রাধান্য দেবার কারণে তার তাৎপর্য হারিয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে মার্কসবাদের হাতে তার ইন্তেকাল ঘটেছে। কিন্তু আমরা এই ধারণায় বিশেষ ভাবে আগ্রহী। এর কারণ হচ্ছে পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্য চিন্তা যে সন্ধিবিন্দুতে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে পারে তার মধ্যে মার্কসের এই ধারণা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। সে কারণে কোন ইউরোপীয় পরিভাষা আমরা এখানে ব্যবহার করছি না। নাফসানিয়াত বলতে আমরা ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার সেই দিকটার কথাই বলছি য্র সঙ্গে আমামদের জীব জীবনে চাহিদা বা জীবের কামনা বাসনা পরিতৃপ্তির প্রসঙ্গ জড়িত, মার্কস যাকে উৎপাদন সম্পর্ক বলেছেন। কিন্তু যে ব্যাখ্যা গরহাজির রেখেছেন সেটা হচ্ছে রূহানিয়াতের প্রসঙ্গ। জীব জীবনকে ঝুঁকি – এমন কি মৃত্যুর হাতে জিম্মি রেখেও মানুষ নিজেকে নিজে আরও পূর্ণ ভাবে উপলব্ধির জন্য জগতে যে সকর্মক কর্তা সত্তার ভূমিকা পালন করে তাকেই আমরা রূহানিয়াত বলছি। তাহলে রূহানিয়াত দার্শনিক দিক থেকে জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ চর্চার এমনই গোড়ার বিষয় যার সঙ্গে মৃত্যুর অর্থাৎ জীব জীবনের ঝুঁকির প্রশ্নটা মুখ্য। মানুষের কাছে তার জীবের জীবন রক্ষাই যদি প্রধান বিবেচনা হয় তখন জগতের সঙ্গে তার ব্যবহারিক সম্বন্ধ বিদ্যমান সম্বন্ধের অধীনস্থতা মেনে চর্চার অধিক কিছু আর হয়ে ওঠে না, বা হয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু যেখানে মানুষ আরও নতুন ও অজানার প্রতিশ্রুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং নিজেকে আরও পূর্ণ ভাবে উপলব্ধির জন্য বিদ্যমান সম্বন্ধ ভাঙ্গে, এবং নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়, মৃত্যুওকে মোকাবিলা করতে ভয় পায় না, সামাজিক মানুষের বিপ্লবী ভূমিকা রাখবার এই সম্ভাবনাকেই আমরা রূহানিয়াত বলছি।
বলাবাহুল্য, নাফসানিয়াত ও রূহানিয়াত অতি পরিচিত পরিভাষা। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ইসলাম ধর্মের সুবাদে এই শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত। সাধারণ মানুষের পরিচিত পরিভাষার মধ্য দিয়ে মোটা দাগে জগতের সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার চরিত্র ব্যাখ্যা সহজ। দর্শনের বিমূর্ত পরিমণ্ডল থেকে দৈনন্দিন জীবনের নৈতিক ও রাজনৈতিক চর্চার দার্শনিক তাৎপর্য বিচারর জন্য পরিভাশাগুলো অমূল্য। পরিভাষাগুলো কেন্দ্র করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ইচ্ছা, আবেগ ও কর্তব্য বোধের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্র এই দুটি ধারণা আমাদের কাছে কার্যকর মনে হয়েছে। বলাবাহুল্য ইসলামি ধর্ম তত্ত্বে এবং দর্শনে এর উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাস আছে। কিন্তু একদিকে ধর্মতত্ত্ব অন্যদিকে পাশ্চাত্য চিন্তার আধিপত্যের কারনে তাদের দার্শনিক বিচার – বিশেষত রূহানিয়াতের বিপ্লবী তাৎপর্য প্রায় হারিয়ে গিয়েছে বলা যায়। । বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নাফসানিয়াত ও রূহানিয়াত নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করা সে কারনেই দরকারি। বাংলাদেশের সাধার মানুষের সঙ্গে আমাদের আত্মিক ও রাজনৈতিক সম্বন্ধ বিকাশের ক্ষেত্রেও ইসলামের দার্শনিক ও রাজনৈতিক পরিভাষা বাংলা ভাষায় আত্মস্থ করবার প্রয়োজন রয়েছে।
রূহানিয়াত জগতের সঙ্গে মানুষের সক্রিয় ও সজীব সম্বন্ধ চর্চার এমন একটি ক্ষেত্র যাকে নাফসানিয়াতের সম্বন্ধ বা আধুনিক পাশ্চাত্য পরিভাষা অনুযায়ী নিছকই উৎপাদন সম্পর্কে পর্যবসিত করা যায় না। পাশ্চাত্য দর্শনের জ্ঞানতাত্ত্বিক বা পরাবিদ্যামূলক পরিমণ্ডল থেকে মার্কস বেরিয়ে এসে নাফসানিয়াতের – অর্থাৎ জীব জীবনের চাহিদা ও কামনা বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ পর্যালোচনা বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, যার প্রতি আমাদের ঘনিষ্ট মনোযোগ জরুরী। কিন্তু তিনি উৎপাদন সম্পর্কের প্রাধান্য দিয়ে মানুষের সকর্মক সামাজিক ও ঐতিহাস কর্তাসত্তাকে ব্যাখা করতে গিয়ে মানুষকে নাফসানিয়াতের অধীনস্থ জীবের অধিক গণ্য করেন নি। মার্কসের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার ধারণার মধ্যে রূহানিয়াতের ইঙ্গিত থাকলেও তিনি সেটা স্পষ্ট বা পরিছন্ন করে যান নি। তাঁর পরে এই বিষয়ে পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের মধ্যে যিনি কাজ করেছেন তিনি মিশেল ফুকো। ফুকো ইরানের বিপ্লবের সময় ‘রাজনৈতিক রূহানিয়াত’ (Political Spirituality) নিয়ে কাজ করেছেন। ফুকোর রাজনৈতিক রূহানিয়াতের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। সে কারনে আমরা এর পর ফুকো, ইরান বিপ্লব ও রাজনৈতিক রূহানিয়াত নিয়ে আলোচনা করব।
৫ ডিসেম্বর ২০১৫।
সূত্র
Althusser, L. (1969). For Marx, tr.Ben Brewster. London: Penguin Press.
Marx, K. (1972). A Contribution to the Critique of Political Economy, tr.S.W.Ryazanskaya. New York: International Publishers.