রাজনৈতিক রূহানিয়াত ও মিশেল ফুকো


‘রাজনৈতিক রূহানিয়াত’ (spiritualite politique) ধারণাটি ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪) ব্যবহার করেছেন। মার্কসের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে ফুকোর 'রাজনৈতিক রূহানিয়াত' নিয়ে এখানে আলোচনা করব।

ইরানে গত শতাব্দির সত্তর দশকের শেষে বৈপ্লবিক উত্থান পতনের সময় ফুকো ১৯৭৮ সালে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে একবার এবং দ্বিতীয়বার নভেম্বরের শুরুতে ইরানে গিয়েছিলেন। ইটালির সংবাদপত্র ‘করিয়েলে দেরা সেরা’ (Corriere Derra Sera) আন্তর্জাতিক ঘটনা নিয়ে ফুকোকে লিখবার অনুরোধ করায় ফুকো লিখতে রাজি হন। সেই প্রতিশ্রুতির কারণে তিনি ইরানে যান। ইটালির সংবাদপত্রের সম্পাদক অবশ্য খুবই উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু এর আগে ইরানের শাহের শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিবাদ পত্রে তিনি স্বাক্ষর করেছিলেন এবং ইরানে যাবার আগে প্যারিসে বাস করা অনেক ইরানির সঙ্গে ইরান সম্পর্কে জানার জন্য তিনি কথা বলেছেন। তার মধ্যে ছিলেন ইরানে মানবাধিকার লংঘন নিয়ে সেই সময় প্যারিসে সক্রিয় আইনজীবী থিয়ের মিনন এবং তাঁর স্ত্রী সিলভি মিনন। এছাড়া ঘনিষ্ঠ ভাবে কথা বলেছেন সেই সময় প্যারিসে বসবাসকারী আবুল হাসান বনি সদরের সঙ্গে। বনি সদর বিপ্লবের পরে গঠিত ‘ইসলামিক রিপাব্লিক অব ইরানের’ প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ইরান বিপ্লবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ফুকোর চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলে এবং পরবর্তীতে তার লেখালিখির মধ্যে সেই ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।

ফুকোর রাজনৈতিক রূহানিয়াতের ধারণা ইরান বিপ্লবের (১৯৭৯) আগেই দানা বাঁধে, যদিও ইরান বিপ্লবের সময় তাঁর লেখালিখির মধ্য দিয়ে ধারণাটি পরিচিত হয়ে ওঠে। অক্টোবরে ফুকোর একটি লেখায় তিনি বলছেন:

“রাজনৈতিক রূহানিয়াত -- যে বিষয়টির সমূহ সম্ভাবনার কথা আমরা অন্যেরা রেঁনেসা এবং খ্রিস্ট ধর্মের চরম সংকটের সময় থেকে ভুলে বসে আছি এখানে (ইরানে) মানুষগুলো নিজেদের জীবন বাজি রেখে যা ধারণ করে তাদের কাছে তার মানে কী ?”।

এখানে আমরা এই জিজ্ঞাসাটিকেই অনুসরণ করব।

ফুকোর ‘ক্ষমতা’

মিশেল ফুকোর দার্শনিক অবদানের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ক্ষমতাকে নিছকই বলপ্রয়োগ হিসাবে না দেখে জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার আরও প্রত্যক্ষ ও বিস্তৃত পরিসর থেকে ব্যাখ্যা করা। রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ক্ষমতার ধারণা থেকে ফুকোর ক্ষমতার ধারণা আলাদা। ফুকো দেখাতে চেয়েছেন আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতার যে রূপ দেখে আমরা অভ্যস্ত ক্ষমতাকে সেভাবে ভাবলে চলবে না। সমাজ থেকে উদ্ভূত হয়ে সমাজের উর্ধে শোষণ ও বল প্রয়োগের হাতিয়ার হিসাবে ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত ভাবলে ক্ষমতা কিভাবে য়াধুনিক কালে বর্তমান থাকে তার কারিগরি বোঝা যাবে না। বরং, ফুকোর দাবি, ‘ক্ষমতা সর্বত্র’। এই সর্বব্যাপী ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে সেটাই মূলত তিনি দেখাতে চেয়েছেন।

কিন্তু ফুকো ক্ষমতা সম্পর্কে কোন আগাম তত্ত্ব হাজির করেন না, বরন ক্ষমতা বাস্তবে কিভাবে কাজ করছে এবং তার প্রতিক্রিয়া ও পালটা প্রতিক্রিয়ায় বিজ্ঞান, শাস্ত্র, মতাদর্শ, কারাগার, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির রূপান্তর ঘটছে সেই প্রক্রিয়াকে তিনি বর্ণনা করতে অধিক আগ্রহী। তিনি ক্ষমতার কায়কারবার ও কারিগরি বুঝতে আগ্রহী। বাস্তবে ক্ষমতা কিভাবে বর্তমান থাকে এবং ক্ষমতা চর্চার চরিত্রে ও কারিগরিতে বদল কিভাবে ঘটছে তার বাস্তব ইতিহাস বর্ণনা ফুকোর ক্ষমতা সংক্রান্ত লেখালিখির গুরুত্বপূর্ণ দিক। ফুকোর রাজনৈতিক রূহানিয়াত বুঝতে চাইলে ক্ষমতা সম্পর্কে ফুকোর ধারণা সম্বন্ধে কিছু প্রাথমিক পরিচয় থাকা দরকার।

‘শৃংখলা ও শাস্তি’ বইয়ের শুরু হয়েছে প্রাচীন কালে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডকারীকে নিষ্ঠুর ভাবে শাস্তি কার্যকর করবার বর্ণনা দিয়ে। এক রাজাকে হত্যার চেষ্টায় অভিযুক্ত দেমিয়েনকে প্রকাশ্যে ঘোড়া দিয়ে চার দিকে টেনে চার টুকরা করা হচ্ছে প্রকাশ্যে। আর সেই নিষ্ঠুর ভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবার দৃশ্য দেখবার জন্য বিপুল মানুষ জড়ো হয়েছে মৃত্যুদণ্ড চত্বরে। তার চামড়া তুলে নেওয়া এবং তার ক্ষত স্থানে গন্ধক, তেল ও সীমার একটি মিশ্রণ লাগিয়ে দেওয়া, ইত্যাদি দেখছে মানুষ। অপরাধীর আর্ত চিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। প্রকাশ্যে এই নিষ্ঠুর ও নির্মম শাস্তি দেবার পদ্ধতি কিভাবে আশি বছর পরে বদলে গেল এবং মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামী কে আধুনিক কালে কারাগারের অভ্যন্তরে লোকচক্ষুর আড়ালে শাস্তি দেওয়ার নিয়ম বা ব্যবস্থাই বা কি করে গড়ে উঠল ফুকো সেই ইতিহাস অন্বেষণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে আগাম তৈয়ারি তত্ত্ব আকারে নয়, বরং তার ব্যবহারিক চর্চার জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। শাস্তি দেওয়া ক্ষমতা চর্চার একটা প্রত্যক্ষ রূপ। বন্দীকে মৃত্যুদণ্ড দেবার সময় এখন আগেই নির্ধারণ করা হয়, নামাজ ও প্রার্থনার সুযোগ দেওয়া হয়, শেষ ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়, ইত্যাদি। প্রকাশ্যে নিষ্ঠুর ভাবে শাস্তি কার্যকর করবার পন্থা কেন এবং কিভাবে অদৃশ্য হোল সেই জিজ্ঞাসার উত্তর সন্ধানের মধ্য দিয়ে ফুকো ক্ষমতারর কারিগরি ও তার বিবর্তন বুঝতে চেয়েছেন।

লোক চক্ষুর আড়ালে কারাগারে অদৃশ্য ভাবে শাস্তি দেওয়ার অর্থ কি? এর অর্থ কি অপরাধীকে নিষ্ঠুর ভাবে শাস্তি না দেবার নীতি। আরও মানবিক হওয়া? আধুনিক শাস্তি ব্যবস্থাকে মানবিক করে তোলা? কারাগার ও মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে আধুনিক কালের ধারণা কি এখন অতীতের তুলনায় মানবিক? মৃতুদণ্ড কার্যকর করে শাস্তি দেবার পদ্ধতি বা ব্যবহারিক দিকের কি তাহলে মানবিকীকরণ ঘটেছে?

ফুকো বলছেন, না। মানবকতা নামক কোন মতাদর্শ, ‘মতবাদ’ বা বা আগাম তৈয়ারি ধারণা দিয়ে ফুকো বাস্তবতাকে বুঝতে নারাজ। বাস্তবে কী ঘটছে তার বিচার কী ঘটছে তা দেখেই ব্যাখ্যা করতে হবে। ক্ষমতার চর্চা ও শাস্তি দেবার পদ্ধতির মানিবিকীকরণ হয়েছে কথাটা ঠিক না। প্রকাশ্যে ফাঁসির মঞ্চে নিষ্ঠুর ভাবে ফাঁসি দেওয়া বন্ধ কোন মানবিক কারনে হয় নি, হয়েছে ভিন্ন কারনে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড নিষ্ঠুর ভাবে কার্যকর করে সমাজে ও রাজনীতিতে যে ফল পাবার পাবার কথা, বাস্তবে ফল হচ্ছিল ভিন্ন। যাদের মারা হচ্ছিল তারা হয়ে যাচ্ছিল লোকায়ত গল্পে, চিন্তায় এবং রাজনৈতিক ইশতেহারে মহানায়ক। এতে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিক্ষোভ তৈরি হচ্ছিলো। প্রকাশ্যে দণ্ডপ্রাপ্তের শাস্তি নিষ্ঠুর ভাবে কার্যকর করবার মূল উদ্দেশ্যই এতে বরবাদ হয়ে যাচ্ছিল। শাস্তি দেবার উদ্দেশ্য ক্ষমতার সার্বভৌম শক্তি প্রদর্শন, সার্বভৌম রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ক্ষীণতম চিন্তাকেও দমন, সমাজে শৃংখলা কায়েম, ক্ষমতা চর্চার মধ্য দিয়ে সার্বভৌম ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করা। কিন্তু দেখা গেল প্রকাশ্যে প্রদর্শনীর মতো নিষ্ঠুর ফাঁসি দেবার পদ্ধতি সেই উদ্দেশ্য অর্জন করছিল না, বরং বিপরীতই ঘটছিল। সেকারণে ফাঁসির প্রকাশ্য মঞ্চ, এবং শাস্তি নিষ্ঠুর ভাবে কার্যকর করবার ভয়ংকর প্রদর্শনীর জায়গায় জায়গা করে নিল তুলনামূলক ভাবে অদৃশ্য কিন্তু সমাজকে সুশৃংখল রাখার বিভিন্ন কারিগরী, নানাবিধ প্রক্রিয়া, তত্ত্ব ও প্রতিষ্ঠান। ক্ষমতার প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে ক্ষমতা চর্চার জায়গায় শাস্তি ও শৃংখলা চর্চার সুনির্দিষ্ট ধরণ গড়ে উঠল। ক্ষমতা নিজেকে বহাল ও সার্বভৌম রাখার বিভিন্ন কায়কারবার গড়ে উঠল, যাতে ক্ষমতা চর্চা আরও দক্ষতার সাথে নিষ্পন্ন করা যায়।

কারাগারে পাহারা দেবার চৌকি – যেখান থেকে বন্দীদের ওপর নজরদারি করা যায় – ক্ষমতা চর্চার আরেকটি বাস্তব উদাহরণ। পাহারা চৌকি থেকে বন্দীর ওপর তার অজান্তে নজর রাখা অনেক দক্ষতার সাথে করা যায়। পাহারা চৌকি বা সমাজের ওপর নজরদারি ফুকোর আলোচনায় আধুনিক ক্ষমতা চর্চার প্রতীক। ক্ষমতা এখন সর্বত্রই কাজ করে চলেছে।

“পাহারা চৌকির প্রধান ফল: বন্দীদের মধ্যে একটা সতর্কতা এবং সার্বক্ষণিক দৃশ্যমানতা জারি রাখা যে তাদের ওপর সবসময়ই নজরদারি চলছে; নজরদারি কাজ একটানা চালিয়ে না গেলেও সব ব্যবস্থা এমন ভাবে সাজানো হয় যার ফলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ক্ষমতা নিত্য জারি রাখা নিশ্চিত করা যায়, ক্ষমতার ফলফলটা পাকা হয়; ক্ষমতা নিখুঁত হয়ে ওঠার কারনে তাকে বাস্তবে খাটানোটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে; (কারাগারের) গাঠনিক স্থাপত্যটাই এমন একটা যন্ত্র হয়ে ওঠে যাতে যিনি ক্ষমতা চর্চা করছেন তার থেকে স্বাধীন থেকে ক্ষমতা উৎপাদন ও বহাল রাখার কাজ চলতে পারে; সংক্ষেপে বলা যায়, এক ধরণের ক্ষমতা পরিস্থিতির মধ্যে কারাগারের বন্দীরা এমন ভাবে জড়িয়ে যায় যাতে তারা নিজেরাই ক্ষমতার বাহক হয়ে ওঠে” (Foucault, 1979, p. ২০১)।

যার ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় সে নিজেই ক্ষমতার বাহক হয়ে পড়ে, ক্ষমতা সম্পর্কে এটা ফুকোর খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিরীক্ষণ। কারাগের উঁচু পাহারা চৌকি এবং কারাগারের স্থাপত্য বাস্তবে ক্ষমতার ব্যবহারিক চর্চা থেকে আলাদা কিছু নয়। ক্ষমতার কারিগরির মধ্যে আমরা এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছি, যাতে ক্ষমতা আমাদের বাইরের কিছু নয়, বরং আমরাই ক্ষমতার বাহক হয়ে গিয়েছি, ক্ষমতা আমাদের মধ্য দিয়েই তার নিত্য নজরদারি এবং ফলাফল জারি রাখে। ফুকোর ক্ষমতার ধারণার এই দিকটি এক দমই নতুন এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক; ক্ষমতা সম্পর্কে প্রথাগত চিন্তা থেকে একদমই আলাদা।

‘শৃংখলা ও শাস্তি: কারাগারের জন্ম’ বইতে ফুকো দেখিয়েছেন জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারিক চর্চার পরিণতি হিসাবে কিভাবে পাশ্চাত্যে কারাগার, শাস্তি দেবার কারিগরি, আইন ও দণ্ডবিধি ব্যবস্থার উদ্ভব ও রূপান্তর পরস্পরের সমান্তরালে ঘটেছে। কখনো জ্ঞানের কোন শাখা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারিক চর্চাকে প্রভাবিত করেছে, কখনো ব্যবহারিক চর্চার ফলাফল নতুন জ্ঞানতাত্ত্বিক ধ্যান ধারণার জন্ম দিয়েছে। কোন আগাম তত্ত্বের খোপে ফেলে শাস্তি, কারাগার ও আইনবিধিকে বিচার করবার প্রথাগত পাশ্চাত্য পন্থা ফুকো পরিহার করেছেন। ক্ষমতাকে তার প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক চর্চা ও সেই চর্চার ইতিহাস দিয়ে ব্যাখ্যা করার এই পদ্ধতি নতুন।

ফুকোর এই পদ্ধিতিকে কী বলা যায়! জ্ঞানতাত্ত্বিক বয়ান ও বিবিধ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারিক চর্চার কুলজি সন্ধান? ফুকো তাঁর ভাষায় বলছেন, জগতের সঙ্গে সমাজের ‘আত্মা’র সম্বন্ধের ‘ইতিহাস’ ব্যাখ্যা করা; তার এই বর্ণনা ও বয়ান পদ্ধতি হেগেল সহ জর্মান ভাবাদর্শে গড়ে ওঠা ‘ইতিহাস’- নামক ধারণা থেকে আলাদা। ফ্রিড্র্ররিখ নীৎশের প্রভাবে ফুকো এর নাম দিয়েছিলেন কুলজি খোঁজ বা নামজ্ঞাতি সন্ধান (Geneology)।

‘শৃংখলা ও শাস্তি’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৫ সালে। বইটি সম্পর্কে ফুকো লিখছেন:

“এই বই আধুনিক নফস (modern soul) ও তাকে বিচার করবার সমান্তরাল ইতিহাস, আধুনিক বৈজ্ঞানিক-ইনী ব্যবস্থার জটিল সংমিশ্রণের কুলজি সন্ধান (geneology); যার ভেতর থেকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা নিজের ভিত্তি, ন্যায্যতা ও নিয়ম তৈরি করে, যেখান থেকে সেইসবের ফলাফল ছড়াতে থাকে এবং তার অতিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যকে আড়াল করে রাখে” (Foucault, 1979, p. ২৩)।

‘জিনিওলজি’র সহজ বাংলা কঠিন। একদিকে এটা ইতিহাস বটে, কিন্তু এর প্রধান ঝোঁক হচ্ছে কিভাবে বিভিন্ন জ্ঞানশাস্ত্রে বিভিন্ন ধারণার নাম ও অর্থের রূপান্তর ভাষা ও বয়ানের মধ্যে ঘটছে তার উৎপত্তি, ব্যুৎপত্তি বা কুলজি সন্ধান এবং সমান্তরালে তার সঙ্গে, ফুকোর ভাষায়, সমাজের আত্মা বা ‘নাফস’এর ব্যবহারিক সম্বন্ধ প্রদর্শন। শাস্তি ও শৃংখলার ধারণার সঙ্গে কারাগার ও দণ্ড বিধি চর্চার সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য। ফুকো বলছেন:

“কোন বিশেষ বয়ান তৈরি হওয়া এবং তার জ্ঞানের কুলজিকে চেতনার প্রকার, উপলব্ধির ধরণ এবং মতাদর্শের রূপ হিসাবে ব্যাখ্যা করলে চলবে না, বরং দেখতে হবে ক্ষমতার কারিগরি ও কৌশলের জায়গা থেকে” (Foucault, Powe/Knowledge, ed.Colin Gordon, 1980, p. ৭৭)।

… … …

কারাগারের উৎপত্তি মানবিক উৎকন্ঠা থেকে ফুকো তার বইতে এই আধুনিক অনুমানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা – এই নীতির ভিত্তিতে অপরাধীকে প্রকাশ্যে নির্মম শাস্তি দেবার ঐতিহ্য থেকে অপরাধীও মানুষ এবং তাকে সংস্কারের সুযোগ দিয়ে সমাজে পুনর্বাসিত হওয়ার মানবিক ধারণা থেকে কারাগারের উৎপত্তি হয় নি; বরং সমাজে জ্ঞানচর্চার বয়ানের সঙ্গে কারাগার ও দণ্ডবিধির সামাজিক-ব্যবাহারিক চর্চার বাস্তব কুলজি সন্ধান করে ফুকো দেখাচ্ছেন একদিকে ক্ষমতা নানান ব্যবহারিক কায়দায় নিজেকে জারি রাখছে, অন্যদিকে তাকে ন্যায্য, তত্ত্বগত ভাবে সঠিক ইত্যাদি প্রমাণের জন্য নানান শাস্ত্র ও বিজ্ঞান গড়ে উঠছে। একটির প্রটিক্রিয়ায় আরেকটতিএবং তারা পরস্পরকে প্রভাবিত করছে, রূপ দান করছে, গড়ে উঠছে ক্ষমতা চর্চার নতুন নতুন কারিগরি। ক্ষমতা এবং জ্ঞানচর্চা পস্পরের হাত ধরাধরি করেই বিবর্তিত হয়েছে।

দেহ ও মন অবিভাজ্য – এই প্রাক-আধুনিক ধারণা থেকে আধুনিক কাল দাবি করে মানুষ শুধু দেহ নয়, মনও বটে। এই অনুমান শরীরকে দুটি সত্তায় বিভক্ত গণ্য করে এবং অন্যদিকে শাসন ও শৃংখলা বহাল রাখবার ক্ষেত্রে ক্ষমতা সংক্রান্ত ধারণায় রূপান্তর ঘটায়। আধুনিক কালে কারাগার ও আধুনিক দণ্ডবিধি ব্যবস্থার উদ্ভবের সঙ্গে বিবিধ বৈজ্ঞানিক মানবিক বিদ্যার সম্বন্ধ রয়েছে। ‘মানবিকতা’ নামক বিমূর্ত ও আদর্শিক অনুমান দিয়ে বাস্তবে জ্ঞান ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারিক সম্বন্ধ বোঝা যায় না। মার্কসের মতোই ফুকো আগাম অনুমান বা চিন্তা থেকে নয়, বরং বাস্তবে বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণার সমান্তরালে সমাজের বিভিন্ন ক্ষমতা চর্চার প্রতিষ্ঠানে কিভাবে রূপান্তর ঘটেছে সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন। কারাগার ও দণ্ডবিধির কুলজি ঘাটলে দেখা যায় ক্ষমতা চর্চাকে আরো দক্ষ এবং উচিত ফল পাবার জন্যই আধুনিক কালে লোক চক্ষুর অন্তরালে কারাগারই শাস্তি দেওয়া এবং শৃংখলা বজায় রাখার প্রধান উপায় হয়ে উঠেছে। এর পেছনে মানুষের প্রতি কোন দরদ কাজ অরে নি। সৌদি রবে প্রকাশ্যে হাত কেটে দিয়ে ক্ষমতা সমাজে যে নিয়ন্ত্রণ ও শৃংখলে কায়েম করতে চায়, আধুনিক পাশ্চাত্য একই ফল পাবার জন্য কারাগার, মানসক হাসপাতাল ও শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ক্ষমতা চর্চার এটা দুই প্রকার রূপ মাত্র, মানবিকতার মান্দণ্ড দিয়ে বিচার কুলে আধুনিক ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য বোঝা যাবে না।

নফস বা নাফসানিয়াত কথাটা বাংলায় আমরা ‘আত্মা’ কথাটার পরিবর্তে সজ্ঞানে ব্যবহার করছি, কিন্তু রূহানিয়াতের সঙ্গে কোন বাইনারি সম্বন্ধে যুক্ত রেখে কিম্বা রূহানিয়াতের বিপরীতেও নয়। এই ব্যবহার আমাদের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে ভালভাবে বুঝতে সহায়তা করবে।

ফুকো প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কোন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা বিচার সম্পর্কে আধুনিক নফসের কারিগরি সম্বন্ধে লিখব?’। হতে পারে আইনের বিবর্তন নিয়ে কেউ লিখলেন, অথবা কেউ লিখলেন দণ্ডবিধির প্রক্রিয়া নিয়ে। তাহলে সমাজের ‘সামষ্টিক উপলব্ধি’, দণ্ডবিধির মানিবিকীকরণ অথবা মানবিক বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কে গবেষক এক বিশাল জ্ঞানের স্তুপ জড়ো করতে পারবেন বটে, কিন্তু এর বিপদ হচ্ছে শাস্তি দেবার চরিত্র ও ব্যবহারিক দিকের রূপান্তরকে মনে হবে মানুষের প্রতি আরও মানবিক ও সদয় হয়ে ওঠার ইতিহাস হিসাবে। আসলে এই রূপান্তর শান্তি ও শৃংখলা সংক্রান্ত জ্ঞানতাত্ত্বিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কারিগরির ফল, ক্ষমতা চর্চারই রূপ মাত্র। সেই রূপকে তার মর্ম সহ বুঝতে হলে দণ্ডবিধির ইতিহাসকে মানবিক বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন ভাবলে চলবে না। রূপান্তর কারো ভাল লাগতে পারে কিম্বা খারাপ। ভালখারাপ বিচার দিয়ে ক্ষমতার ব্যবহারিক চর্চার চরিত্র আমরা বুঝবো না। রূপান্তর ভাল না খারাপ বিচার না করে আমাদের বরং দেখতে হবে দণ্ডবিধির চর্চা আর অপরাধ বিজ্ঞান কোথায় পরস্পরকে প্রভাবিত করছে। কখন বা কোন অবস্থায় একটি আরেকটির কারণ কিম্বা ফলাফল হচ্ছে; এ সবের মধ্যেই সন্ধান করতে হবে তাদের উভয়ের কোন সাধারণ মাত্রা বা বৈশিষ্ট্য আছে কিনা। বিশেষত খেয়াল রাখতে হবে তারা কোথাও একই ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক –আইনী পরিগঠন’ (epistemologico-juridical formation) থেকে উদ্ভূত হচ্ছে কিনা। সংক্ষেপে, ফুকো বলছেন, “ক্ষমতার ব্যবহারিক কারিগরিকে দণ্ডবিধির মানবিকীকরণ এবং মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান উভয়কেই ব্যাখ্যার পদ্ধতি-সূত্র হিসাবে গণ্য করা”।

মার্কসের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার ধারণা আমরা যতোটুকুই ব্যাখ্যা করেছি সেই আলোকে যদি ফুকোর পদ্ধতি সংক্রান্ত প্রস্তাবনাকে বিচার করি তাহলে আমরা দাবি করতে পারি নিজের শরীরের সঙ্গে সামাজিক মানুষের ব্যবহারিক চর্চাই বিশেষ দেশে এবং কালে কারাগার ও দণ্ডবিধির রূপ ধারণ করে। কারাগার ও দণ্ডবিধির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালেরও ব্যাখ্যা করা যায়, কারন সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি দেহ সংক্রান্ত মামলা। দেহকে নিয়ন্ত্রণ, শাসন, শৃংখলার অধীন ও কার্যক্ষম রাখারই ব্যাপার। চেতনা দেহ হিসাবেই বর্তমান থাকে। তাহলে ক্ষমতার কাজ মূলত দেহের নিয়ন্ত্রন। মানুষকে স্রেফ চেতনা হিসাবে গণ্য না করে শরীর বা দেহ হিসাবে গণ্য করলে আমরা বুঝব ‘দেহ’ ধারণার বিবর্তন কিভাবে ঘটেছে। আগ্রহীরা ‘শৃংখলা ও শাস্তি’ গ্রন্থে ‘ অপরাধীর দেহ’ পরিচ্ছদটি পাঠ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যাকে আমরা চেতনা, আত্মা বা ‘নফস’ বলি দেহের সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার মধ্য দিয়ে সেই নফস কিভাবে বর্তমান হয়, জারি থাকে এবং কাজ করে তাকে বাস্তবে অন্বেষণ করতে হবে। ‘নাফস’ নামক আগাম কোন ধারণা হিসাবে নয়। ফুকো বলছেন:

“আমি মার্কসবাদীদের মতো নই যারা ক্ষমতার ফলাফল মতাদর্শের স্তরে খোঁজে। বাস্তবিকই আমি ভাবি কেউ যদি ক্ষমতার প্রশ্ন তুলতেই চায় তাহলে দেহের প্রশ্ন এবং দেহে ক্ষমতার কায়কারবার কিভাবে ঘটছে সেই প্রশ্ন তোলাটাই সবচেয়ে অধিক বস্তুবাদী, নয় কি? কারণ আমার অস্বস্তি লাগে যারা ক্ষমতার বিশ্লেষণে মতাদর্শকে আগেই আগাম গুরুত্ব দিয়ে বসে, তারা আগাম কর্তাসম্পন্ন এক মানুষকে ধ্রুপদি দর্শনের মডেল অনুযায়ী অনুমান করে, যে চেতনা সম্পন্ন আর বুঝি ক্ষমতা গিয়ে তার ওপর সওয়ার হয়” (Foucault, 1980, p. ৫৮)।

শাস্তি ও শৃংখলার আধুনিক কারিগরি সমাজে ক্ষমতা চর্চার প্রধান রূপ এই ধারণা থেকে ফুকো পরবর্তীতে বেরিয়ে আসেন। সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌম ক্ষমতার আধুনিক বৈশিষ্ট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। তখন নতুন একটি ধারণা তার হাতে গড়ে ওঠে যাকে তিনি বলেছেন ‘বায়োপাওয়ার’ জীব জীবনের শাসন, নিয়ন্ত্রণ, শৃংখলাকে আরও সামগ্রিক ভাবে – তার ভালমন্দ – ইতিবাচক নেতিবাচক সকল প্রকার প্রতিক্রিয়া সহ কোন মতাদর্শিক প্রাক-অনুমান মাথায় না রেখে ব্যাখ্যা করা। এখানে তা সরাসরি প্রাসঙ্গিক নয় বলে ভবিষ্যতে অন্যত্র আলোচনার জন্য তুলে রাখছি।

তরুণ মার্কসকে যেভাবে আমরা বোঝার চেষ্টা করছি সেই জায়গা থেকে যদি ফুকোর কাজকে আমরা বোঝার চেষ্টা করি তাহলে জগতের ব্যবহারিক সম্পর্ক চর্চার দিক থেকেও আমরা ফুকোকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারি। মানুষ কী? মানুষ কাকে বলে? আত্মা কি? পরমাত্মা কী? -- ইত্যাদি পরাবিদ্যামূলক প্রশ্ন না তুলে সোজা বোঝার চেষ্টা করতে পারি কিভাবে একটি সমাজে ‘দেহ’ নামে যে জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণা বিরাজ করে তার সমান্তরালে কিভাবে দেহকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কারাগার, সুস্থ ও অসুস্থের ধারণার ভিত্তিতে দেহকে হাসপাতালে রাখা বা না রাখা, দেহের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বৃত্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং তাকে কার্যকর করবার সুনির্দিষ্ট রূপ গড়ে ওঠে। ক্ষমতাকে কোথাও কেন্দ্রীভূত বল প্রয়োগের হাতিয়ার হিসবে না দেখে কিভাবে আমামদের শরীরের মধ্য দিয়েই ক্ষমতা কার্যকর হচ্ছে এবং নিজেকে জারি রাখছে সেই খায়কারবার বোঝার প্রতি ফুকো আমামদের মনোযোগ চাইছেন। এই ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে তিনি অনন্য।

দেহ প্রসঙ্গে ফুকো মার্কসবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা করেছেন। কারখানায় দেহের ওপর ক্ষমতা চর্চার যে ফলাফল বর্তায় মার্কসবাদ সেই দিকটা উপেক্ষা করে। অথচ রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের কেন্দ্র ‘শ্রমিকের শরীর’। পুঁজি কিভাবে শ্রমিকের দেহ ব্যবহার করে ত্র দ্বারাই ক্ষমতা কিভাবে পুঁজির রূপ ধারণ করে সক্রিয় থাকে সেতা বোঝা যাবে। স্রেফ শষণ বা নিপীড়নের তত্ত্ব দিয়ে সেটা বোঝা যাবে না। কিন্তু মার্কসবাদীরা শরীর নিয়ে কথা বলে খুবই কম, বরং তাদের বিশ্লেষণের কেন্দবিন্দু হচ্ছে ‘শ্রমিক শ্রেণী’। শ্রমিক শ্রেণীর কথাটা এমন ভাবে ধর্মতাত্ত্বিক কায়দায় বলা হয়, যেন না বললে ধর্ম নাশ হবে। এরপর ফুকোর দাবি:

“অথচ মার্কসের লেখায় শরীর নিয়ে দারুন সব কথা আছে। মার্কসবা্দের এই এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা যে চেতনা ও মতাদর্শের নামে শরীরের প্রশ্নকে মুছে দেবার ভয়ানক প্রবণতা কাজ করে” (Foucault, 1980, pp. ৫৮-৫৯)

এটা তাহলে পরিষ্কার ফুকো আধুনিক কালে ক্ষমতাকে নিছকই বল প্রয়োগ গণ্য করেন নি। অথচ ক্ষমতা নিছকই বল প্রয়োগের ব্যাপার এটাই আমাদের প্রচলিত অনুমান এবং মোটামুটি বদ্ধমূল ধারণা। ক্ষমতার আমামদের মধ্য দিয়েই, আমামদের নিজস্ব শরীরের মধ্য দিয়েই নিজেকে জারি রাখে। আধুনিক কালের এই বাস্তবতার প্রতি ফুকো আমামদের নজর ফেরাতে বাধ্য করেছেন। মার্কসবাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা কথাটা বলে তখন তাদের অনুমান ক্ষমতা শোষণ ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ক্ষমতা রাষ্ট্রের কাছেই মজুদ থাকে; জালিম ও শোষক শ্রেণী সেই হাতিয়ার ব্যবহার করেই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা শ্রেণী বিভক্ত সমাজ টিকিয়ে রাখে এবং মজলুমের লড়াই সংগ্রামকে নিষ্ঠুর ভাবে দমন করে। এই অনুমান ও ধারণাকে ফুকো পালটা কোন তত্ত্ব দিয়ে প্রশ্ন করেন না; বরং ক্ষমতা কিভাবে জারি থাকে ও কাজ করে তার প্রত্যক্ষ কায়কারবার ও কারিগরি ব্যাখ্যার সঙ্গে সমান্তরালে বিবিধ জ্ঞানকাণ্ড, বিদ্যা বা তত্ত্ব গড়ে উঠবার প্রক্রিয়ার সম্বন্ধ বিচার করে ক্ষমতার কুলজি নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। আধুনিক কালে ক্ষমতা কিভাবে নিজেকে বর্তমান ও বিদ্যমান রাখে তার কারিগরি বোঝার ক্ষেত্রে ফুকোর অবদান অনস্বীকার্য।

রূহানিয়াতের জিজ্ঞাসা

ফুকোকে কেন রাজনৈতিক রূহানিয়াত নিয়ে ভাবতে হোল তার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ চর্চার সুনির্দিষ্ট রূপ হিসাবে ক্ষমতা কিভাবে বর্তমান থাকে ফুকো তা দেখিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার জারি থাকা বা বর্তমানতার বিরুদ্ধে বা পাশাপাশি প্রতিরোধের কারিগরি কিভাবে গড়ে ওঠে সেই বিষয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ফুকো প্রকট অভাব বোধ করেন। ফুকোর যেহেতু কোন সকর্মক কর্তাকে আগাম অনুমান করে না, বরং আধুনিক কালে কর্তার বিলয় ঘটেছে বলে দাবি করেন, সে কারণে আধুনিক কালে রাজনৈতিক কর্তাসত্তার কোন সকর্মক রূপ রয়েছে কিনা এবং বিদ্যমান ক্ষমতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সেই কর্তার দৃশ্যমান রূপ কী, বা কী হতে পারে সেই সকল প্রশ্ন তুলবার সুযোগ তাঁর চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে এর আগে অনুপস্থিত ছিল বলা যায়। ফুকোকে এই অভাব ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে হয়েছে।

তবে রাজনৈতিক রূহানিয়াত নামক কোন আগাম ধারণা নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন নি, বরং বিদ্যমান ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা কিভাবে সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে দানা বাঁধে এবং ক্ষমতা উৎখাত করে তাকে তিনি হাতেনাতে বুঝতে চেয়েছেন। সে কারণেই ইরানের প্রতি তার আগ্রহ এবং ইরান যাত্রা। বিদ্যমান ক্ষমতার বিরুদ্ধে জগণের আন্দোলন-সংরামকে তিনি ‘প্রতিরোধ’ বলেন না, কারন তাহলে এক প্রকার রাজনৈতিক সচেতনতা বা রাজনৈতিক কর্তার অনুমান তাকে করতে হয়। তিনি এর নাম দিয়েছেন প্রতিচর্চা বা কাউন্টার কন্ডাক্ট। এই বিশেষ পরিভাষার ব্যবহার ফুকোর পদ্ধতির দুর্বল দিক। পদ্ধতর মধ্যে যদি সকর্মক কর্তার ভূমিকা বাদ দেওয়া হয়, তাহলে বিশ্লেষণের একটা পর্যায়ে সেই অভাব মোচনের জন্য তাকে আবার অন্তর্ভূক্ত করা ছাড়া উপায় থাকে না। ফুকোর প্রতিচর্চা বা কাউন্টার কন্ডাক্ট নতুন পরিভাষা হলেও নাফসানিয়াতের বিপরীতে রূহানিয়াত – বা বিপ্লবী কর্তাসত্তার আবির্ভাব তিনি ঠেকাতে পারেন নি। তিনি এক সময় একে পলটিকাল স্পিরিচুয়ালিটি বা রাজনৈতিক রূহানিয়াত হিসাবেই নামকরণ করতে বাধ্য হয়েছেন।

দ্বিতীয় কারনও অভাববোধের সঙ্গে জড়িত, তবে একে আলাদা আলোচনার দরকার আছে। সেটা হচ্ছে পাশ্চাত্যের দুটো বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লব নিয়ে ফুকোর নতুন ভাবে ভাববার তাগিদ। বুর্জোয়া বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিণতি ও অভিজ্ঞতা ফুকোকে ক্ষমতা সম্পর্কে এবং বিদ্যমান ক্ষমতা প্রতিরোধ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হয়েছে। প্রতিরোধের জায়গা থেকেই তিনি রাজনৈতিক রূহানিয়াতের ধারণায় পৌঁছেছেন।

তৃতীয় কারন বিপ্লবে ধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে পাশ্চাত্য আধুনিক সেকুলার চিন্তা ফুকোর নাকচ করা। ধর্ম সম্পর্কে পাশ্চাত্য চিন্তার অনুমান নিয়ে ফুকোর সন্দেহ। প্রতিরোধের রাজনীতি ও বিপ্লবে ধর্মের ভূমিকা বোঝার প্রতি ফুকোর আগ্রহের এটি বড় একটি কারন। ফুকো রাজনৈতিক রূহানিয়াত হিসাবে যা বোঝাতে চেয়েছেন তা মূলত কোন আগাম মতাদর্শিক অনুমান বাদ দিয়ে বাস্তবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবে ধর্ম অতীতে এবং বর্তমানে কী ভূমিকা রাখছে তা বুঝবার আন্তরিক চেষ্টা।

চতুর্থ কারণ দার্শনিক। দর্শন যেহেতু তার প্রধান চর্চার ক্ষেত্র, তাই বলা যায় দার্শনিক কারনটাই সম্ভবত রাজনৈতিক রূহানিয়াত সম্পর্কে ফুকোর আগ্রহের প্রধান কারন। উনিশ শ আটাত্তর সালের মে মাসে একটি সাক্ষাৎকারে ফুকো বলছেন তিনি শুরু থেকেই নিজেকে একটি প্রশ্ন করছিলেন। সেটা হোল, ইতিহাস ব্যাপারটা আসলে কী? “বিশেষত যখন ইতিহাসের মধ্যে ক্রমাগত সত্য থেকে মিথ্যা আলাদা হয়ে যাবার প্রক্রিয়া ঘটতে থাকে”। সত্য থেকে মিথ্যা আলাদা হয়ে যাবার ঘটনা দার্শনিক বা নিছকই চিন্তার পরিমণ্ডলে ঘটে যাওয়া ব্যাপার না। সেটা ঐতিহাসিক ভাবে ইতিহাসের মধ্যেই ঘটে। ফুকো সত্য মিথ্যা নির্ণয়ের জন্য কোন নতুন চিন্তার ভিত্তি নির্মাণে আগ্রহী না। সত্য কী, মিথ্যা কাকে বলে সেই প্রকার বিতণ্ডায় তাঁর আগ্রহ নাই। বরং ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার নির্ণায়ক হিসাবে কিভবে তারা ইতিহাসের মধ্যে নির্ধারিত হচ্ছে এবং কিভাবে ইতিহাসকে বিশেষ অভিমুখ ও রূপ দান করছে সেই দিকেই তাঁর আগ্রহ। তাহলে সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্ব ইতিহাসকে যে রূপ বা পরিণতি দান করে সেই ইতিহাস আমরা পড়ব, কিম্বা বুঝব কিভাবে? সত্য থেকে মিথ্যা আলাদা হয়ে যাবার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস তাকে পাঠের পদ্ধতি কি হবে? যে ইতিহাস সত্য মিথ্যা থেকে আলাদা হয়ে যাবার প্রক্রিয়া ও পরিণতি বলেই ইতিহাস হিসাবে সেই ইতিহাসের প্রান্তে দাঁড়িয়েই তো ইতিহাস লেখা হয়। আসলেই। তাহলে ইতিহাস ব্যাপারটা বা আসলে কী?

ফুকোর অভাব

ক্ষমতার কুলজি নির্ণয়ের দুর্বল দিক – অর্থাৎ ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণে প্রতিরোধ বা প্রতিচর্চা কিভাবে গড়ে ওঠে সেই দিকটি বিশ্লেষণ, জানা ও বোঝার অভাব পূরণের জন্য এবং কিছুটা বৈপ্লবিক ঘটনাবলীর সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা চেয়েছেন বলেই ফুকো ইরানে ছুটে গিয়েছিলেন। ইরানের অভিজ্ঞতার আগেই নিজের পদ্ধতির মধ্যে তিনি অভাব বোধ করছিলেন, সেই অভাবের অভিজ্ঞতারই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক রূহানিয়াতের ধারণা।

বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা সামষ্টিক রাজনৈতিক কর্তাসত্তার সুনির্দিষ্ট রূপ প্রত্যক্ষ করি। ইরানের বিপ্লবকে ফুকো সেকুলারদের মতো আগেই খোপ বদ্ধ ভাবে ‘ইসলামি’ বিপ্লব নামক ট্যাগ না মেরে তাঁর নিজের চিন্তার সীমাবদ্ধতা যেমন বুঝতে চেয়েছেন, একই ভাবে তাকে চিন্তার পরিমণ্ডলে মীমাংসা না করে মার্কসের মতো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অথবা বিদ্যমান ক্ষমতার সঙ্গে বিপ্লবী গণমানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চার মধ্য দিয়ে আসলে কী ঘটছে ফুকো সেটা বুঝতে চেয়েছেন।

ইরানের ইসলামি লোকতন্ত্রের (Islamic Republic) প্রথম প্রেসিডেন্ট বনি সদরের সঙ্গে ইরানে আসার আগে ফুকোর দুইবার দেখা হয়েছিল। বনি সদরের ভাষ্য অনুযায়ী ফুকো দুটো বিষয়ে বিশেষ ভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রথমত তিনি বুঝতে চাইছিলেন প্রথাগত রাজনৈতিক দলের বাইরে কোন্‌ পরিস্থিতিতে একটি বিশাল স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন দানা বাঁধে এবং বিপ্লবী রূপ পরিগ্রহণ করে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতার অধীনস্থতা মেনে নেবার বয়ানের বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিরোধের বয়ান গড়ে ওঠে। আধুনিক ক্ষমতা যদি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত থাকে এবং বিদ্যমান ক্ষমতাকে মেনে নেবার বয়ানই যদি অধিপতি হয় তাহলে বিপ্লবের কর্তাসত্তার আবির্ভাব ঘটল কিভাবে? ইরানের বিপ্লব পাশ্চাত্য বিপ্লবের অনুকরণ নয়। আগাম নির্ধারিত মতাদর্শ ও উদ্দেশ্য মাথায় রেখে পাশ্চাত্যে বিপ্লব সম্পন্ন ও বাস্তবায়িত করবার যে অনুমান বা ধারণা রয়েছে, ইরানের বিপ্লব তার অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করে দিচ্ছে। এই অনুমান পরিহার করে আসলে ইরানের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষের যে আন্তরিক বা ‘রূহানি শক্তির প্রকাশ আমরা দেখি তাকে বুঝব কী করে?

ইরানের বিপ্লবকে ফুকো কোন আগাম উদ্দেশ্য মাথায় রেখে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসাবে গণ্য করতে চান নি, বরং ইরানী জনগণের দৈনন্দিন লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কিভাবে এই বিপ্লব দানা বেঁধেছে ও সফল হয়েছে তিনি সেটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে বুঝতে চেয়েছেন। সেই ক্ষেত্রে ইসলাম – বিশেষত শিয়া ইমান-আকিদার ভূমিকা, আলী শরিয়তির রাজনৈতিক চিন্তা এবং আয়াতুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বের ভূমিকা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। সব কিছু মিলিয়ে ইরানের সাধারন মানুষ কিভাবে নিজেদের একটি সামষ্টিক রাজনৈতিক বৈপ্লবিক ইচ্ছা (রূহানিয়াত) হিসাবে পরিগঠন করছে এবং চূড়ান্ত বিজয়ের রূপ নিচ্ছে সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

ফুকোর কাছে ইরান বিপ্লবের অনন্য তাৎপর্য হচ্ছে এই বিপ্লব ইউরোপীয় চিন্তার পরিমণ্ডলের বাইরে ঘটেছে। ফলে ইউরোপীয় চিন্তার কাঠামো দিয়ে একে বোঝা যাবে না। অন্যদিকে শিয়া ধর্ম এবং শিয়া ইমামদের আধ্যাত্মিক চর্চা এখানে ভূমিকা রেখেছে ঠিকই, কিন্তু একে পাশ্চাত্যের বিপরীতে শুধু ইসলামি বিপ্লব হিসাবে বুঝতে চাইলে বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট চরিত্র এবং নতুনত্ব ধরা যাবে না। ইসলামি বিপ্লব বলার মধ্য দিয়ে এই অনুমানও প্রস্তাব করা হয় যে পাশ্চাত্যের বিপ্লব – যেমন, ফরাসী বিপ্লব একটি সর্বজনীন বিপ্লব। আর বিপরীতে ইরানের বিপ্লব সর্বর্জনীন নয়, এটা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ঘটনা, ধর্মীয় হবার কারণে আদর্শ বিপ্লব নয় – ফুকো এই প্রকার বাচালতা মানতে রাজি হন নি। ফলে ‘রাজনৈতিক রূহানিয়াত’ শব্দবন্ধটি এ যাবতকাল ফুকোর নিজের চিন্তার অভাব পূরণ এবং আধুনিক কালে রাজনৈতিক বিপ্লব সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর দেবার তাৎপর্যপূর্ণ নামচিহ্ন হিসাবে দানা বেঁধেছে। বিপ্লব সম্পর্কে পাশ্চাত্য আধুনিকতার গজফিতা দিয়ে প্রগতিশীল/প্রতিক্রিয়াশীল মার্কা বাইনারি বা বিভাজন টানা ফুকো্র চিন্তার দিক থেকে অবান্তর। বালখিল্য বিভাজন তিনি তুচ্ছ গণ্য করেছেন। ইরানের বিপ্লবকে কোন একটা খোপে ফেলে বোঝার চেষ্টাটাই হচ্ছে চিন্তার প্রতিবন্ধিতা।

বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা

বাকির পালহামের সঙ্গে এ সাক্ষাৎকারে ফুকো বলছেন, পাশ্চাত্যের দুটো বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা আছে। প্রথমটি হচ্ছে আধুনিক পাশ্চাত্য যখন সমাজ নিয়ে ভেবেছে তখন সব সময়ই সুশাসন কিভাবে সমাজে কায়েম করা যায় সেই জায়গা থেকে ভেবেছে। এই চিন্তাই আমরা পাশ্চাত্যের বিপ্লবগুলোর মধ্যে কার্যকর এবং পরবর্তীতে ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, জর্মানির সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে প্রতিফলিত হতে দেখি। কিন্তু এটা বেদনাদায়ক কেন? ফুকো বলছেন,

“বিচ্যুতিমুক্ত, পরিষ্কার, ঝরঝরে, এবং ভারসাম্যপূর্ণ সমাজের এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গড়ে উঠল ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পুঁজিতন্ত্র; যা নিষ্ঠুর, অতিশয় বর্বর, অতিমাত্রায় স্বার্থপর, যারপনাই অসৎ এবং নির্যাতনমূলক সমাজ যা সম্ভবত কেউই কল্পনাই করেনি। আমি মনে করিনা এতে দার্শনিকদের কোন দোষ ছিল, কিন্তু তাদের চিন্তার এটাই হয়েছে পরিণতি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই দানব, যাকে আমরা রাষ্ট্র বলি, তার প্রায় পুরোটাই তাদেরই চিন্তার ফল ও পরিণতি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্রতত্ত্ব, ব্যক্তির বিপরীতে সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্র – ব্যক্তির অধিকারের বিরুদ্ধে সমষ্টির সার্বভৌম অধিকার আঠারো দশকের ফরাসি দার্শনিক, আঠারো দশকের শেষ এবং নব্বই দশকের শুরুর দিকের জর্মান দার্শনিকদের লেখাজোখায় পাওয়া যাবে” (Janet Afary, Kevin B. Anderson, 2005, pp. ১৮৪-১৮৫)। পাশ্চাত্য আধুনিক চিন্তারই ফল হচ্ছে পুঁজিতন্ত্র এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্র। এটা হোল ফুকোর চোখে পাশ্চাত্যের প্রথম বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা।

দ্বিতীয় বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা পাশ্চাত্যের দর্শন আর বুর্জোয়া সমাজের ভেতর থেকে জাত বেদনা নয়, বরং মার্কসসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তচেতনার পরণিতি। মার্কসের চিন্তার বৈশিষ্ট হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বাস্তবতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এখানে যুক্তি আছে এবং যা বলা হয়েছে তা কমবেশী সঠিক। কিন্তু তারপরও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে যে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উদ্ভব দেখা গেলো সেটাই কেউই প্রত্যাশা করে নি। এতাই হচ্ছে দ্বিতীয় বেদনাজনক অভিজ্ঞতা। রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজ গঠন এবং অর্থনৈতিক বিধি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে কাঠামো গড়ে উঠল এবং তার যে অভিজ্ঞতা তাতে তাকে বর্জন করা ছাড়া আর কোন উপায় রইল না। ফুকোর কাছে কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতাও ছিল বেদনাজনক।

এই বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ফুকো বলছেন:
“আমার মনে হয় আমরা এক চরম অন্ধকার ও চরম আলোর মধ্যে বাস করছি। চরম অন্ধকার কারন আমরা আসলেই জানি না কোনদিক থেকে আলো আসবে; বাস করছি চরম উজ্জ্বলতার মধ্যে কারন সবকিছু নতুন করে শুরু করবার সাহস আমাদের থাকা উচিত। আমাদের সকল গোঁড়া ধ্যান ধারণা বাদ দিতে হবে এবং এক এক করে নিপীড়নের উৎস প্রতিটি চিন্তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে । রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে আমরা বিশাল শূন্যের মধ্যে আছি। আমাদের আরেকটি রাজনৈতিক চিন্তা তৈরি, নতুন রাজনৈতিক স্বপ্ন দেখানো আর নতুন ভবিষ্যতের কথা শেখাতে হবে। আমি এটা বলছি যাতে বোঝা যায় পশ্চিমের কোন মানুষ, কোন সৎ বুদ্ধিজীবী ইরান সম্পর্কে যা শুনছে তার পর আর উদাসীন থাকতে পারে, বিশেষত যে দেশ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে একটা কানাগলিতে এসে ঠেকেছে।” (Janet Afary, Kevin B. Anderson, 2005, p. ১৮৫)।

বিপ্লবে ধর্মের ভূমিকা

ফুকো যখন ইরানে গিয়েছিলেন তখন ইরানিদের কাছে প্রায়ই শুনতেন যে মার্কস ধর্ম সম্পর্কে ভুল বলেছেন। ধর্ম মানুষের জন্য আফিম। ইরানিরা তাঁকে বলত, মার্কসের এই কথা ঠিক না। ধর্ম আফিম সেটা পাশ্চাত্যে খ্রিস্ট ধর্মের জন্য হতে পারে, কিন্তু ইসলামে সেটা নয়। ইসলাম শুধু পরকালের ধর্ম নয়; নিছকই বেহেশত-দোজখ বা পরকালে শাস্তি ও পুরষ্কার নির্ণয়ের জন্য ইহলোকে ঈমান ও আমলের চর্চা নয়। ইসলামী একই সঙ্গে ইহলৌকিক। দৈনন্দিনের মোনাজাতেই মোমিন আগে দুনিয়াতে ‘হাসানা’ চায় এবং তারপর আসে আখেরাতের কথা: ‘...ওয়া ফিল আখেরাতে হাসানা’। এই প্রকার ষোল আনা ইহলৌকিক ধর্ম জনগণের জন্য আফিম হতে পারে না। এটা পাশ্চাত্যের খ্রিস্ট ধর্মের সমস্যা, ইসলামের না। আর ইরানে ফুকোকে বলা হয়েছে শিয়া ইসলামের এটা একদমই সমস্যা না।

যারা ইসলামি সরকার চায় তাঁরাই ফুকোকে এই কথা বলেছেন এবং ফুকো এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি কবুল করেন, মার্কসের এই বাক্যটির পর্যালোচনা হওয়া উচিত। এখানে বলে রাখা দরকার যে মার্কসের এই বাক্যটি নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা হয়েছে, বইয়ের পর বই লেখা হয়েছে। কিন্তু ফুকোর ইঙ্গিত হচ্ছে এই বাক্যটির ব্যাপারে মার্কসের সাফাই না গেয়ে ঠিকঠাক পর্যালোচনা করা দরকার। যারা ইরানে ইসলামি সরকার চাইছিলেন এবং ফুকোকে বলছিলেন খ্রিস্ট ধর্ম আফিম হতে পারে, কিন্তু ইসলাম না – ফুকো তাদের দাবি মানেন, কবুলও করেন। তবে তিনি সতর্ক করে দিচ্ছেন পাশ্চাত্যে খ্রিস্ট ধর্মের ভূমিকা অতো সরল ভাবে দেখা ঠিক না, কারন সেখানেও ধর্ম পরিস্থিতি ভেদে ইসলামের মতো বিদ্যমান ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়েছে। ফুকো বলছেন:

“আমি ইসলাম ও শিয়াদের নিয়ে অনেক বই পড়েছি এবং আমি তাদের এই দাবির সঙ্গে পুরাপুরি একমত। কারন রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলা, সক্রিয় রাখা, উজ্জীবিত রাখা, বিপ্লবে ইন্ধন জোগানো ইত্যাদিতে শিয়া ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইরানে এর প্রভাব গভীর। এটা ঠিকই যে অনেক সময় রাষ্ট্র এবং শিয়া ইসলাম পরস্পরের কাছাকাছি এসেছে, ধর্ম ও রাষ্ট্র একই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হয়েছে, সাফাভিদের বিপরীতে আলাভিদের পুনরুত্থানের ঘটনা ঘটেছে, সবই সঠিক। কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে বিচার করলে এবং শিয়া ইসলাম ও রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা ধর্মের রূপান্তর ঘটিয়েছে মানলেও বলা যায়, ইসলাম বিদ্যমান ক্ষমতার বিরোধী ভূমিকাই রেখেছে” (Janet Afary, Kevin B. Anderson, 2005, p. ১৮৬)।

ইসলাম সম্পর্কে ফুকোর এই মূল্যায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে জগতে যেখানে খ্রিস্ট ধর্ম প্রবল সেখানে ধর্মের ভূমিকার বিষয়টি জটিল। এটা অতি মাত্রায় সরলীকরণ এবং ভুল হবে যদি বলি ধর্মের খ্রিস্টিয় রূপ জনগণের জন্য আফিম আর তার ইসলামি রূপ জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে উদ্বুব্ধ করবার উৎস। ফুকো বলছেন, “ইউরোপের মধ্য যুগে সতেরো ও আঠারো শতাব্দি পর্যন্ত যে ধর্ম আন্দোলন তার সঙ্গে শিয়া ইসলামের সম্পর্ক ও মিল দেখে আমি রীতিমতো বিস্মিত। এগুলো ছিল সামন্ত প্রভুর বিরুদ্ধে, প্রথম দিকের বুর্জোয়া সমাজ প্রতিষ্ঠার নিষ্ঠুরতা্র বিরুদ্ধে এবং সর্বময় ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশাল বিশাল গণ প্রতিরোধ। ইউরোপে আঠারো শতাব্দির শেষ এবং উনবিংশ শতাব্দির শুরুতে এই গণ আন্দোলন গুলো রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহণের আগে ধর্মীয় আন্দোলন হিসাবেই হাজির হয়েছিল” (Janet Afary, Kevin B. Anderson, 2005, p. ১৮৭)। তাহলে এটা পরিষ্কার ধর্ম আফিম এই কথাটা সাধারণ সূত্র হিসাবে যেমন খাটে না। তেমিনি খ্রিষ্ট ধর্ম সম্পর্কেও না।

এমন নয় যে ফুকো ইরানে গিয়ে শাহের বিরুদ্ধে যারা লড়ছেন এবং ইসলামি সরকার ব্যবস্থা চাইছিলেন তাঁদের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন। অগাস্ট ১৯৭৯ সালে তিনি ফারেস সাসিন (Farès Sassine) কে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সেখানে ইরান বিপ্লবের প্রতি তাঁর আগ্রহের দার্শনিক কারণ যথেষ্ট স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি সেই সময় তিনি মার্কসপন্থী আর্নস্ট ব্লক-এর একটি বিখ্যাত বই পড়ছিলেন: ‘আশার আদর্শ’ (The Principle of Hope), বইটির ইংরেজি অনুবাদ এখন পাওয়া যায়। ফুকো বইটি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। প্রভাবিত হবার মূল কারণ হচ্ছে আর্নস্ট ব্লক সময় ও ইতিহাসের বিচার করতে গিয়ে একটি নতুন ধারণার প্রস্তাব করছিলেন। সেটা হোল: সময় ও ইতিহাসের মধ্যে থেকেই বিদ্যমান অবস্থা থেকে আরও ভাল জগতের আশা মানুষ করে এবং একটা সূত্র বা খোলামুখ খোঁজে যার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের আকাংখা দানা বাঁধে। এটা বৈপ্লবিক আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই। বিপ্লবে সম্পর্কে এই ধারণার স্পষ্ট ইঙ্গিত থাকলেও ব্লক এটিকে যথেষ্ট স্পষ্ট বা পরিচ্ছন্ন ভাবে হাজির করতে পারেন নি। কিন্তু আর্নস্ট ব্লকের প্রণোদনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ফুকো এ বিষয়ে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে (Collège de France ) আরও গবেষণা করতে থাকেন। এই গবেষণা থেকেই ১৯৭৮ সালের পহেলা মার্চ থেকে ‘ধর্মযাজকদের পালটা আচরণ’ নিয়ে তিনি বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। পুরোহিত বা ধর্ম যাজকদের প্রথাগত ভূমিকার বিপরীতে পালটা যে আচরণ বাস্তবিক ইতিহাসে দেখা গিয়েছিল তাকেই বাস্তবোচিত ভাবে তিনি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। পরিভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি সতর্ক ছিলেন। বিদ্যমান ক্ষমতা ব্যবস্থার অধীনতার বিপরীতে এটা ছিল ধর্ম যাজক বা পুরোহিতদের ‘পাল্টা আচরণ’ (Counter Conduct)। এই বক্তৃতাগুলোতে ফুকো দেখান আরেকটি জগত সম্ভব এই আকাঙ্ক্ষা ও দাবি আদতে ধর্মতাত্ত্বিক ও ধর্মপ্রাণ দাবি। এই দাবি ও আকাংখা উৎপত্তির সুনির্দিষ্ট উৎস রয়েছে। ফুকো বলছেন, “মধ্য যুগের শেষে এবং রেনেসাঁর শুরুর দিকে একান্তই ধর্মীয় গ্রুপ – সর্বোপরি বিদ্রোহী ধর্মীয় গ্রুপ এই ধারণা বহন করছিলো যে এই জগতের মধ্যেই বিপ্লবের মতো কিছু একটা সম্ভব” (Thompson, 2017)।

পরবর্তীতে ইম্মেনুয়েল কান্টের এনলাইটমেন্ট বা ইউরোপের আলোকিত যুগ নিয়ে ফুকোর ভাবনাও তাঁকে ইরান বিপ্লবের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। ফুকো কান্টের এনলাইটমেন্ট সংক্রান্ত ধারণাকে ইউরোপীয় ইতিহাসের কালপর্ব হিসাবে গণ্য করেন নি। বরং দেখেছেন সমাজের নিজের গুনে অপরিণত থাকার অবস্থা পেছনে ফেলে আসার প্রক্রিয়া হিসাবে। অর্থাৎ দেখেছেন, ‘হয়ে উঠবার নিরন্তর সক্রিয় তৎপরতা’ হিসাবে। এটা এক কালীন ঘটনা বা ব্যাপার নয়। বরং বারবার ঘটবার মতো ব্যাপার, যার পুনরাবৃত্তি ঘটে বারবার। ইরানের বিপ্লবকে সাদা চোখে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখবার পরিপ্রেক্ষিতে এই সকল দার্শনিক বিচার ফুকোর মধ্যে আগেই কিছুটা তৈরি হয়ে ছিল। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ইতিহাস পাঠ ও পঠনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ফুকো বাস্তবের ঘটনাকে মেলাতে পেরেছিলেন। সমাজের ভেতর থেকে নিজের হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া হিসাবে একটি সমাজোকে দেখার অর্থ হচ্ছে ইরানের ইতিহাসকে ইউরোপের ইতিহাস দিয়ে দেখা ও বিচার করবার পুরানা ও ক্লিশে চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা। বিপ্লবকে দেখবার ধারণা ফুকোর নতুন। ইতিহাস কোন সরল রৈখিক ব্যাপার নয়, বরং নিরন্তর হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ইরানের অভিজ্ঞতা বিপ্লব সম্পর্কে ফুকোকে নতুন ভাবে ভববার সুযোগ করে দিয়েছে। সাক্ষাৎকারে ফুকো বলছেন:

“তো যদি তোমাকে বলি, আমি ওটা পড়ছিলাম যখন প্রতিদিন সংবাদপত্র আমাকে জানাচ্ছে ইরানে কিছু একটা ঘটছে যা অভ্যূত্থান, এমন একটি অভ্যুত্থান যার চরিত্র বিপ্লবের কোন পশ্চিমা মতাদর্শিক ছকের দ্বারা পরিচালিত নয়, কোন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনার অধীন নয়, এমনকি কোন রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারাও নয়; এমন একট ব্যাপার ব্যাপার ঘটছে যা গণ অভ্যূত্থান, একান্তই ক্ষমতা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের অভ্যুত্থান এবং আসল কথা হোল যেখানে ধর্মীয় উপাদান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মের প্রতিনিধিত্ব এতোই স্পষ্ট যে আমার মনে হয়েছে আমি যা পড়ছিলাম এবং যা ঘটছে উভয়ের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে, এবং আমি নিজে গিয়ে স্বচক্ষে তা দেখতে চেয়েছি; আসলেই আমি আর্নস্ট ব্লকে যা পড়ছিলাম তার একটা নজির পেলাম, তার একটা পরীক্ষা দেখলাম। তুমি চাইলে বলতে পারো, যেহেতু আমার দু জোড়া চোখ নিয়েই সেখানে গিয়েছি, হাজির ছিলাম রাজনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে ধর্মচিন্তার (eschatology) সম্বন্ধ বিচারের জিজ্ঞাসা নিয়েই”। (ফুকোর সাক্ষাৎকারের এই ইংরেজি অনুবাদ পেয়েছি ইরান বিপ্লব নিয়ে একটি গ্রন্থ নিয়ে আলোচনায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতি থেকে; দেখুন, (Thompson, 2017)। ধর্মচিন্তা কথাটা ফুকো Eschatology অর্থে ব্যবহার করেছেন।

ধর্মচিন্তার এই বিশেষ দিক মৃত্যুচিন্তা, আখেরাত এবং মানুষের পরম নিয়তি বা পরিণতি ভাবনার সঙ্গে যুক্ত। বৈপ্লবিকতা বা সকর্মক বৈপ্লবিক কর্তার বিচার সে কারণে মানুষ নিজের জীব জীবনকে মৃত্যুর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করে ভাবনার পর্যালোচনাও বটে। বিপ্লবী কর্মকাণ্ড বিদ্যমান ক্ষমতা ও ব্যবস্থার উৎখাত – যে ব্যবস্থার অধীনস্থতা আমাদের জীব জীবন টিকিয়ে রাখার সম্বন্ধও বটে। তাকে বদলাবার জন্য সক্রিয়তার অর্থ মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়া।

বিপ্লব বা বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ফুকো লিখছেন:

“বিদ্রোহ ইতিহাসের অন্তর্গত, কিন্তু কোন এক ভাবে তারা ইতিহাসের হাত থেকে ফসকেও যায়। যে প্রণোদনায় একজন ব্যক্তি, একটি গ্রুপ, কোন সংখ্যলঘু অথবা পুরা একটি জনগোষ্ঠি বলে, ‘আমর আর তোমাদের মানবো না’, আর ক্ষমতাবান যে-কর্তৃত্বকে তারা অবৈধ বলে তাদের মুখের ওপর ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের জীবন ছুঁড়ে মারে --এই অবস্থা আমি মনে করি আর অন্য কোন কিছুতেই পর্যবসিত করা যায় না। কারন দুনিয়ার কোন কর্তৃত্বই এই অবস্থাকে আর অসম্ভবে পরিণত করতে পারে না.....। যে বিদ্রোহী শেষাবধি সে সকল ব্যাখ্যার অতীত; যে নাটবল্টু দিয়ে ইতিহাসের অব্যহত ধারা এবং তার যুক্তি পরম্পরা বহাল রাখা হয় একটি লোকের কারণে তা ব্যাহত হয়ে যায়, ‘আসলেই’: যে বাধ্য থাকার নিশ্চয়তার চেয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়াকে অধিক পছন্দ করে” (Foucault, Useless to Revolt?', 2015, p. 449) ।

আসলেই। যে বিদ্যমান ক্ষমতার বাধ্য থাকার চেয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয়, যে ব্যাখায়র অতীত হয়ে পড়ে। বিপ্লব বা বিদ্রোহকে ফুকো জীবনের ঝুঁকি –অর্থাৎ জীব জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থার অবাধ্যতা, দ্রোহ বা বিপ্লব হিসাবে দেখেছেন। ফুকোর রাজনৈতিক রূহানিয়াত বুঝতে হলে তাহলে এটাও বুঝতে হবে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সঙ্গে মৃত্যুর সম্বন্ধ অন্তরঙ্গ ও অবিচ্ছেদ্য। যে কারণে একে আর ইতিহাসের কোন ছকের মধ্যে ফেলা যায় না, অন্য কিছুতে পর্যবসিত করা যায় না। একে কোন মতাদর্শ বা বা আগাম ছক বাঁধা চিন্তা দিয়ে বোঝা যায় না। একই কারণে এর সঙ্গে আখেরাত এবং মানুষের পরম নিয়তি বা পরিণতি ভাবনার সঙ্গে যুক্ত।

দ্রোহ বা বিপ্লব জীবের নাফসানিয়াত অস্বীকার করে, এই অস্বীকারের মধ্য দিয়ে দ্রোহ বা বিপ্লবে রূহানিশক্তির যে পরমার্থিক প্রকাশ ঘটে তাকে তার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছাড়া অন্য কোন কিছুতে পর্যবসিত করে যায় না, অন্য কিছুতে পর্যবসিত করে বোঝাও যায় না। ইরানি বিপ্লবের প্রতি ফুকোর আগ্রহ ধর্মচিন্তার সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ী দ্রোহ বা বিপ্লবের অন্তরঙ্গ সম্বন্ধের জন্যই। যা অনন্য।

বিপ্লব এমন একটা মুহূর্ত যখন হাজারো অত্যাচার, নির্যাতন, দমন, পীড়ন হত্যা সহিংসতার বিপরীতে জীবন তার সামগ্রিক অস্তিত্ব নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে যায়, যার পর কোন বন্দুক , মেশিন গান, গ্রেনেড, পুলিশ বাহিনী , সেনাবাহিনী বা কোন প্রকার সহিংস সামরিক শক্তি জীবনকে বাগে আনতে পারে না। জীবন শুধু জীবনের স্বার্থে – নিজের চরম পরমার্থক অভিপ্রকাশের মুহূর্তটুকুই শুধু যাঞ্চা করে, সেতা মৃত্যর বিপরীতে জীবনের সত্য প্রতিষ্ঠা। ইহলৌকিক কোন কিছুর বিনিময়ে বা জীবনের ভয়ে নিজেকে আর বিকিয়ে দিতে জীবন রাজি থকে না। জীবনের এই স্থির ও অচঞ্চল অবস্থানের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমরা প্রাণের সেই রূপকেই দেখি দেখি যা নির্ভেজাল, খাঁটি আর পরম সত্য। মৃত্যু যা মুছে ফেলতে অপারগ।

শিয়া ধর্মে কারবালা এবং মৃত্যুর উদযাপনের যে ধর্মীয় চর্চা রয়েছে তার সঙ্গে ফুকো ইরান বিপ্লবের সম্বন্ধ রয়েছে বলে বিবেচনা করেছেন। তবে যে কোন ধর্মে মৃত্যুর যে রিচুয়াল বা আচার রয়েছে দ্রোহ বা বিপ্লব মৃত্যু উদযাপনের সেই আচারকে প্রত্যক্ষ করে তোলে এবং তা সামষ্টিক আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে প্রায়ই পরিণত হয়। বাংলাদেশে আন্দোলন সংগ্রামে নিহত ব্যাক্তির জানাজা পড়া এবং তাকে শহিদ গণ্য করা নিয়মিত ঘটনা। ধর্ম রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানান ভাবেই ভূমিকা রাখে।

ফুকো মার্কসবাদের কিছু বর্গকে তাঁর ক্ষমতার কারিগরি এবং তার পালটা প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য প্রতিবন্ধক গণ্য করেছেন। যেমন ক্ষমতাকে প্রধানত রাষ্ট্রশক্তি অর্থাৎ শোষক শ্রেণীর বলপ্রয়োগের হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা। ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত গণ্য করার মুশকিল ছাড়াও ক্ষমতা বাস্তবে বল প্রয়োগ ছাড়াও কিভাবে জ্ঞানচর্চা ও মতাদর্শিক ভাবে বাস্তবে কাজ করে মার্কসবাদ তা ব্যাখ্যা করতে অপারগ। এটা এক প্রকার চিন্তার অলসতা এবং মার্কসের শিক্ষারও বিরোধী।

‘মতাদর্শ' হচ্ছে আরেকটি মার্কসবাদী চিন্তার বর্গ যা ক্ষমতার কারিগরী বোঝার প্রতিবন্ধক। চিন্তার বর্গ হিসাবে ‘মতাদর্শ’ অনুমান করে যে জগতের একটা সত্য ব্যাখ্যা আছে। সেই সত্য বিবিধ মার্কসবাদী বাক্য দিয়ে প্রকাশ করা যায় এবং তারা স্বতঃসিদ্ধ। সত্য সম্পর্কে এই অনুমান স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়ানো। কোন চিন্তা বা সিদ্ধান্ত সত্য নাকি স্রেফ ‘মতাদর্শ’ সেই বিচারের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমাজে তারা কিভাবে কাজ করছে তার কারিগরি ব্যাখ্যা করা, সমাজের বিবিধ চিন্তা বা আদর্শ বাস্তবে কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং তার পরিণতি কোথায় কিভাবে ঘটছে এবং সামগ্রিক প্রক্রিয়া হিসাবে কিভাবে বিদ্যমান ক্ষমতাকে বিশিষ্ট করে তুলছে তাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করাই কজ। ‘মতাদর্শ' সেই কাজে নিয়োজিত হবার প্রতিবন্ধক, কারণ খুবই সংকীর্ণ ও সরল ভাবে ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা এই চেষ্টা বিদ্যমান ক্ষমতাকে বরং আড়াল করে দেয়।

দর্শন ও রূহানিয়াত

ইতিহাসের অভ্যন্তরে সত্য মিথায় নির্ণয়ের প্রক্রিয়াকে ফুকো চারটি আলাদা প্রশ্নে ভাগ করে নিয়েছিলেন। ইতিহাসের মধ্যেই সত্যমিথ্যার ভেদ কিভাবে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার নির্ণায়ক হয়ে ওঠে তাকে তিনি যেভাবে বিচার করতে চেয়েছেন সেই জিজ্ঞাসা দার্শনিক হলেও মার্কসের মতো তিনি তার মীমাংসা দর্শনের ভাবাদর্শিক পরিমণ্ডলে নয়, খোদ ইতিহাসের মধ্যেই সন্ধান করেছেন। তাঁর জিজ্ঞাসাকে ফুকো চারটা প্রশ্নে ভাগ করে নিয়েছেন:

১. কোন্‌ অর্থে সত্য মিথ্যার ফারাক তৈয়ারি এবং ভেদ বিচারের বিবর্তন ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য এবং ইতিহাসের নির্ণায়ক?

২. পাশ্চাত্য সমাজে কিভাবে সেটা কাজ করেছে? সেই প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য কি?

৩. যেখানে ইতিহাস নিজেই সত্য মিথ্যা নির্ণয় করে সেই ইতিহাসকে জানার উপায় কি?

৪. এটা কি ঠিক যে রাজনীতির সাধারণ সমস্যা আসলে সত্য নির্ণয়েরই সমস্যা?

সত্য বলতে ফুকো প্রক্রিয়া বোঝেন যার সঙ্গে ক্ষমতা বা রাজনীতি বৃত্তাকার সম্বন্ধে জড়িত। আমরা সত্য বলতে মিথ্যার বিপরীত গণ্য করি, ফুকো সেটা বোঝেন না।; সত্য কী, এই প্রশ্নও তোলেন না, কারণ সেটা আধ্যাত্মিক বা পরাবিদ্যামূলক প্রশ্নে পর্যবসিত হয়। মার্কসের মতো ফুকো পাশ্চাত্য দর্শনের ভাবাদর্শিক পরিমণ্ডলে ফিরতে নারাজ; সত্য কী, সেটা ধারণা হিসাবে পর্যালোচনা তাঁর ইচ্ছা নয়। বরং একটি সমাজে যে কোন বিষয়ে সত্য মিথ্যার সিদ্ধান্ত কিভাবে তৈরি হয় এবং বর্তমান থাকে তাকে একটি প্রক্রিয়া হিসাবে ফুকো বর্ণনা করতে আগ্রহী। সেই বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি দেখান বিদ্যমান ক্ষমতার সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধ চর্চা বা প্রক্রিয়া হিসাবে সত্য হাজির থাকে। সত্য বলতে তিনি বোঝান একটি গোছানো মোটামুটি সুশৃংখল একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা কোন বাক্য উৎপাদন, নিয়ন্ত্রণ, বিতরণ, বিচলন ও কার্যকর করা হয়। সত্য ক্ষমতা ব্যবস্থার সঙ্গে বৃত্তায়িত সম্বন্ধে যুক্ত, বৃত্তায়িত কারণ ক্ষমতাই আবার সত্য পয়দা করে এবং জারি রাখে; সত্যের ফলাফল প্রতিক্রিয়া হিসাবে সমাজে যা সঞ্চার করে তার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত থেকে গড়ে ওঠে সত্যের শাসন প্রণালী (regime)।

তাহলে বোঝা দরকার ফুকো সত্য কী, কিম্বা সত্য কাকে বলে এই প্রকার প্রাচীন পরবিদ্যামূলক কিম্বা আধ্যাত্মিক প্রশ্ন তুলছেন না। তিনি সত্যের রাজনীতিটা (politics of Truth) বুঝতে আগ্রহী। সত্য ও ক্ষমতা বাস্তবে পরস্পরের সঙ্গে এক পারস্পরিক বা বৃত্ত-সম্বন্ধে যুক্ত থেকে কিভাবে বাস্তবে একটি ক্ষমতা ব্যবস্থা গড়ে তোলে সেই ব্যবস্থা ব্যাখ্যা ও বোঝানোই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। কোন বাক্য বা সিদ্ধান্ত সত্য বাক্য বা সত্য সিদ্ধান্ত হিসাবে কিভাবে সমাজে উৎপাদিত হয়, সমাজে তা কিভাবে ছড়ায়, কিভাবে সমাজ ও রাজনীতি সেই সত্য নিয়ন্ত্রণ করে, সমাজে সত্যের প্রতিক্রিয়ায় কোথায় কিভাবে কী কী ঘটনা ঘটে সব কিছুই সামগ্রিক ভাবে একটা বৃত্তাকার প্রক্রিয়া হিসাবে ফুকো ব্যাখ্যা করেন। পুরা ব্যবস্থাটি তাই ফুকোর কাছে ‘সত্যের শাসন ব্যবস্থা’ (regime of truth) বা ক্ষমতা বা ক্ষমতা ব্যবস্থা। ক্ষমতা সমাজে সত্য চর্চার ব্যবস্থা থেকে আলাদা কিছু নয়।

তাহলে ক্ষমতা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বার কৌশল কি হতে পারে? কিম্বা ফুকোর ভাষায় ক্ষমতার পালটা সক্রিয়তা কী? ‘কাউন্টার একটিভিটি’ কেমন হবে? এই ক্ষেত্রে ফুকো মনে করেন মতাদর্শিক তর্ক বিতর্ক এই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থহীন। কারন কর্তব্য হচ্ছে বিদ্যমান ক্ষমতা ব্যবস্থার বিপরীতে আরেকটি ক্ষমতা ব্যবস্থার সম্ভাবনা সন্ধান। ক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে একটি মতাদর্শের সত্য মিথ্যা নির্ণয় পরাবিদ্যামূলক চর্চা। বরং সামগ্রিক ভাবে বিদ্যমান সত্যের রাজনীতি কিভাবে একটি ক্ষমতা ব্যবস্থা বাস্তবে গড়ে তুলছে তাকে বাস্তবোচিত ভাবে বিচার এবং পালটা ক্ষমতা ব্যবস্থা হিসাবে সমাজে সত্যের নতুন রাজনীতি কিভাবে হাজির হচ্ছে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই আসল কথা। ফুকো রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা আছে সেটা অবশ্যই মানেন, কারন এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। কিন্তু রাজনৈতিক রূহানিয়াতকে আধ্যাত্মিক বা পরাবিদ্যামূলক ধারনা হিসাবে তিনি হাজিরঅকরতে চান না। করেন নি। বরং ইরানে রূহানিয়াতের বাস্তব ঐতিহাসিক আবির্ভাবকে সরে জমিন গিয়ে দেখা এবং কিভাবে তা কাজ করে সেটা তিনি বর্ণনা করতে চেয়েছেন। ইরানের বৈপ্লবিক অভিজ্ঞতা পাশ্চাত্যে ব্যাখ্য ও বর্ণনাই তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সকর্মক কর্তাসত্তার প্রশ্ন মিশেল ফুকো মীমাংসা করতে পেরেছেন সেটা এখনও তর্কের বিষয় হিসাবে রয়ে গিয়েছে। সেই তর্ক আপাপ্তত স্থগিত রেখেও আমরা বলতে পারি, রাজনৈতিক রূহানিয়াতের প্রশ্নকে আধুনিক কালে ফুকো যেভাবে ক্ষমতা ও বিপ্লবের সম্বন্ধ বিচারের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন তাঁর আগে কোন দার্শনিক এই জিজ্ঞাসাকে এতো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারেন নি।

মার্কসের ‘ব্যবহারিক সম্বন্ধ’ নিয়ে আমরা যে আলোচনা শুরু করেছি করছি তার আলোকেই এখানে ফুকোর ‘রাজনৈতিক রূহানিয়ত’ ও ইরান বিপ্লব নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেছি। বলা বাহুল্য, এই প্রসঙ্গে আমরা আবার ফিরব। তবে আলোচনা আমরা বাংলাদেসের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে করত আগ্রহী। মার্কসের ব্যভারিক সম্বন্ধ চর্চার জায়গা থেকে আমরা বাংলাদেশে রাজনৈতিক রূহানিয়াতের উদ্মব ও সম্ভাবনা বিচার করতে চাই। বাংলাদেশে ব্যভারিক রাজনীতির দিক থেকে যার গুরুত্ব মার্কস ও ইসলাম উভয় দিক থেকেই অসামান্য। এই চ্যালেঞ্জ সাহসের সঙ্গে গ্রহ ও মোকাবিলা ছাড়া আমরা বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারব না।

ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তার মধ্যে সীমিত হলেও ইসলামি পরিভাষায় জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধকে দুইভাবে বোঝার রেওয়াজ আছে। একটি হচ্ছে নাফসানিয়াত; মোটা দাগে যা ব্যক্তির কামনা, বাসনা, ভোগের চাহিদা মেটাবার জন্য জগতের সঙ্গে ব্যবহারিক সম্বন্ধ। রূহানিয়াতের তাগিদ নফসের তাগিদ থেকে আলাদা, সেটা তাৎক্ষণিক চাহিদার চেয়েও জীবন সম্পর্কে আরও গভীর, সর্বজনীন ও নিঃস্বার্থ ধর্মীয় উপলব্ধি ও কর্তব্যজ্ঞান থেকে জাত। ফুকোর ব্যাখ্যা থেকে আমরা বুঝতে পারি এর সঙ্গে মৃত্যু, শহিদের নিঃস্বার্থে জীবন দান ও জীব জীবনকে তুচ্ছ করার মতো গুরুতর রূহানিয়াতের জিজ্ঞাসা জড়িত। এই আলোচনা সেই সকল গুরুতর বিষয় নিয়ে আলোচনারই প্রাথমিক প্রস্তুতি মাত্র।

১৬ ডিসেম্বর ২০১৭। ২ পৌষ ১৪২৪। শ্যামলী।

গ্রন্থসূত্র

Foucault, M. (1979). Discipline & Punish: The Birth of the Prison. New York: Vintage Books.

Foucault, M. (1980). Powe/Knowledge, ed.Colin Gordon. New York: Pantheon Books.

Foucault, M. (2015). Useless to Revolt?'. In M. Foucault, POWER: Essentials Wok of Foucault (1954-1984) (p. 449). Penguin.

Janet Afary, Kevin B. Anderson. (2005). Foucault & the Iranin Revolution: . Chicago: University of Chicago Press.

Thompson, K. (2017, March 30). Foucault’s Folly: Iran, Political Spirituality, and Counter-Conduct. Minnesota.

 

 

 

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।