মোদী, আসাম ও মমতা ব্যানার্জি


'বঙ্গাল খেদা' থেকে 'মুসলমান বিতাড়ন'

ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেন ১৯৫১ আসামে একটি আইনী হাতিয়ার; যার দ্বারা কারা আসামের নাগরিক তা নির্ণয় করা হচ্ছে। নাগরিকপঞ্জির ভিত্তিতে কে আসামে থাকত পারবে আর কে পারবে না সেটাই নির্ণয় করা হচ্ছে। যারা নিবন্ধিত হতে ব্যর্থ হবে তাদের বিতাড়ন করা হবে। এই নিবন্ধন শুধু আসামেই, অন্য কোন রাজ্যে নয়। রাষ্ট্রের আইন মানুষের জন্মগত অধিকারও হরণ করতে পারে এবং অনায়াসে লক্ষ লক্ষ লোককে 'রাষ্ট্রহীন' বানিয়ে আইনী সুরক্ষা ও অধিকারের বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। আসামের আইনী পরীক্ষা জাতিবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ব্যারাম, পুরা দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তাপ ছড়িয়ে এই অসুখ নিজেকে জানান দিচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে শুধু বাঙালি আক্রান্ত নাও হতে পারে, অন্যান্য অধিবাসীরাও নিশ্চয়ই আক্রান্ত। কিন্তু নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে মানুষকে রাষ্ট্রহীন করবার এই প্রক্রিয়া আসাম থেকে বাঙালি মুসলমান তাড়ানোর প্রক্রিয়া হিশাবেই প্রধানত হাজির হয়েছে।

আসামে ১৯৫১ সালের আদমশুমারির পর তৈয়ারি তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি নাগরিকপঞ্জি দিয়ে নাগরিকত্ব নির্ণয় জাতিবাদের নব্য কারিগরি। আসাম কখনই ভারতের অংশ ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা ও দেশভাগের কুফল হিসাবে আসাম দিল্লীর অধীন একটি রাষ্ট্র। পাকিস্তান মুসলমানদের দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠার কারণে  আসাম হিন্দু ভারতের ভাগেই পড়েছে। অসমীয়ারা ভারতীয় পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য দীর্ঘকাল সশস্ত্র সংগ্রামও করেছে। ফলে আসামকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত রাখা দিল্লীর জন্য এখনও একটি চ্যালেঞ্জ।

বিভিন্ন ভাষা, জাতি, ধর্মের মানুষকে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের অধীন রাখতে পারা দিল্লীর সফলতাই বলতে হবে। সেটা ভারতীয় সেকুলার জাতীয়তাবাদের আঠা দিয়ে জোড়াতালি হলেও এতোকাল চলেছে। সেই আঠা দুর্বল হয়ে যাবার কারণে তার মর্মের হিন্দু জাতিবাদি দিকটা এখন উদাম হয়ে বেরিয়ে পড়ছে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ মূলত হিন্দুত্ববাদেরই নামান্তর। নরেন্দ্র মোদীর আমলে সেকুলার খোলসটুকু রাখা তাই বিজেপি দরকারী মনে করে না। রাখতে চাইছেও না। কী দরকার? হিন্দুত্ববাদ একই সঙ্গে ভারতের কর্পোরেট পুঁজির মতাদর্শ হয়ে উঠেছে।  হিন্দুত্ববাদের সফলতা  আদর্শগত কারণে নয়, অখণ্ড ভারতকে অখন্ড রাখা কর্পোরেট পুঁজির নিজেরই দায়। নইলে আভ্যন্তরীণ বাজার বড় পুঁজির অধীন রাখা যেমন কঠিন, তেমনি বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাও মেলা ঝামেলার। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আসামের জাতীয়তাবাদ রূপ নিচ্ছে হিন্দুত্ববাদে, প্রকট মুসলমান ঘৃণায় এবং আসাম থেকে মুসলমান বিতাড়নের রাজনীতিতে। আসামকে দিল্লীর পরাধীন রাখার মতাদর্শ ও রাজনীতি হিসাবে এটা অনিবার্য ছিল, বলা যায়।

নাগরিক নিবন্ধনের ছুতায় শৃংখলা ও শাস্তির মধ্য দিয়ে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের কারিগরিগুলো একমাত্র আসামে হওয়াটাও অবাক হবার মতো কিছু নয়। হিন্দুত্ববাদ অহম জাতীয়তাবাদের চরিত্র বদলে দিচ্ছে। বলা যায়, নাগরিকপঞ্জী (National Register of Citizenship) একটা অজুহাত; বলা হচ্ছে, গত শতাব্দির একাত্তর সালের ২৪ মার্চ মধ্যরাতের পরে যারা আসাম গিয়েছে তারা 'বিদেশী'। তারা আসামের নাগরিক না, অতএব তাদের আসাম থেকে বের করে দিতে হবে। 'বিদেশী মানে তারা প্রধানত 'বাংলাদেশী'; আর বাংলাদেশী মানে তারা 'মুসলমান'।

তবে আসামে বিদেশী খেদাও আন্দোলন ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু হওয়া জাতিবাদী আন্দোলনের অন্তর্গত। 'বঙ্গাল খেদা' বা 'বাঙালি খেদা' আন্দোলন পুরানা আন্দোলন, যার জের এখনও ষোল আনা আসামে আছে। এর আগে আসামীরা যে বাঙ্গালিদের বিতাড়িত করেছে তারা প্রধানত হিন্দু, মুসলমান নয়। অতএব হিন্দু বাঙালিও বিতাড়নের শিকার হবে।

বাঙালি হিন্দুর ওপর হামলা শুরু হয় গৌহাটির কটন কলেজে ১৯৬০ সালে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি বসতির ওপর অসমিয়ারা হামলা চালায়। কামরূপ জেলার হরেশ্বরের ২৫টি গ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল ভয়াবহ। বিচারক গোপাল মেহরোত্রকে নিয়ে একজনের একটি কমিশন গঠিত হয়েছিলো। তখন নয়জন বাঙালিকে হত্যা এবং একশ জনকে আহত করবার তথ্য উঠে আসে। চার হাজার উনিশটি কুঁড়েঘর ও ৫৮টি বাড়ি লুট ও ধ্বংস করা হয়। গৌহাটির জেলা মেজিস্ট্রেট ছিলেন বাঙালি। প্রায় একশ জন অসমিয়া তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। দিব্রুগড়ে বাঙালি হিন্দুদের ওপর হামলা করা হয়। একটি হিসাবমতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার প্রায় পাঁচ লক্ষ বাঙালি বাস্তুচ্যূত হয়। এদের প্রায় সবাই হিন্দু। শরণার্থীরা পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নেয়। প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাঙালি হিন্দু শরণার্থী পশ্চিম বঙ্গে দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরে আসামে বাংলাদেশী শরণার্থী প্রবেশ করেছিলো। 'বঙ্গাল খেদা' সেই সময় 'বাংলাদেশী' বিতাড়নের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। এখন নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদী ভারতে আসামের 'বিদেশী খেদাও' আন্দোলন সুস্পষ্ট ভাবে পরিণত হয়েছে 'মুসলমান' খেদানোর আন্দোলনে। দিল্লির হিন্দুত্ববাদী নীতি আসামী জাতিবাদকে বদলে দিয়েছে, তাকে ধর্মীয় হিংসা ও হানাহানির রূপ দান করছে। হিন্দুত্ববাদ এই রূপটি দিতে বদ্ধ পরিকর, কারণ জাতীয় ক্ষেত্রে এটাই বিজেপির মতাদর্শিক এবং প্রধান নির্বাচনী হাতিয়ার।

তবে 'হিন্দু' আর 'হিন্দুত্ব' সমার্থক নয়। সিন্ধু নদের এদিকে সকল অধিবাসী পারসিকদের চোখে 'হিন্দু'। 'হিন্দু' কোন ধর্মের নামও নয়। এই দেশ সনাতনী। তার পূজা, উপাসনা, ভক্তি এবং সালাত কায়েম করার নানান তরিকা আছে। ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বৈচিত্র নিয়েই একদার ভারতবর্ষ। এমনই তার শক্তি যে মার্কস বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ইংরজ আসার আগে যারাই এই ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল তারা সকলেই 'হিন্দুভূত' হয়ে গিয়েছে। ইংরেজ আধুনিক কালে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি। তাদের প্রথম সেন্সাস বা আদমশুমারিতে যারা 'মোহামেডান' নয় তারা সকলেই নিমেষে  'হিন্দু' হয়ে যায়। হিন্দুত্ববাদ 'হিন্দু'র বিচিত্র ও বিভিন্ন সনাতন ধর্ম চর্চা  ও ঐতিহ্যের বিপরীতে একটি ঔপবেশিক নির্মাণ। উবপ্নিবেশের কাল্পর্বে এই 'মোহামেডান'দের বিওরীতে 'হিন্দু' পরিচিতির পরিগঠনের মধ্যে হিন্দুত্বের বীজ তৈরি হয়েছিল। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে তার রূপান্তর ঘটেছে হিন্দুত্ববাদে। তার সখ্যতা জায়নবাদ ও আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে।

মোদীর নীতি হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারত থেকে 'মুসলমান' তাড়াও, কিন্তু 'হিন্দু'রা থাকুক। এমনকি ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে 'হিন্দু' প্রবেশ বা 'অনুপ্রবেশ' করলেও মোদীর ভারত তাদের নাগরিকত্ব দেবে। নতুন কোন হিন্দু এলেও ভারতে নাগরিকত্ব পাবে। গোলকায়নের যুগে ভারতীয় জনতা পার্টির 'হিন্দু' একটি নতুন রাজনৈতিক বর্গ, নতুন রাজনৈতিক ফেনোমেনা। এর সঙ্গে সনাতন ধর্মের  বিচিত্র ও বিভিন্ন অভিপ্রকাশ, উপাসনার বিবিধ প্রকার কিম্বা নিঃশর্ত আত্মসমর্পন বা ভক্তির ধারার কোন সম্পর্ক নাই। হিন্দুত্ববাদের লড়াই  ইহুদি জাতিবাদের মতো ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে। হিন্দুত্ববাদ  বুশ-ট্রাম্পের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক নম্বর মিত্র।

তাহলে মুসলমানদের বিতাড়িত করা এবং ভারতে মুসলমানদের 'অনুপ্রবেশ' বন্ধ করা -- একান্তই নরেন্দ্র মোদীর হিন্দু ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। সেই লক্ষ্যে আসাম বিজেপির জন্য একটি রাজনৈতিক ও আইনী পরীক্ষাগার। দক্ষিণ এশিয়ার এটা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা। এর সফলতাই ভারতের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিজেপির ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশকে আসাম থেকে মুসলমান তাড়ানোর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বহু আগেই সোচ্চার হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তা করছে না। এর ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে ভারতের হিন্দু জাতিবাদিদের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ইসলাম নির্মূলের রাজনীতির যে শুভ আঁতাত ও সখ্য গড়ে উঠছে তার পরিণতি বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক হবে। মধ্য প্রাচ্যের পর দক্ষিণ এশিয়ার পাশ্চাত্যের খারাপ নজরে পড়েছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ও রাষ্ট্রনেতাদের বুঝতে হবে। বিজেপির রাজনীতি পরিষ্কার। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের মৌনব্রত তার চেয়ে আরও ভয়ংকর।

ভারত হিন্দুদের দেশ, মুসলমানদের জায়গা নয় -- এই প্রাচীন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত বিজেপির হিন্দুত্ববাদী আদর্শের ভিত্তি। তাই বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মায়ানমার ইত্যাদি প্রতিবেশী দেশ থেকে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার হিন্দুদের স্বাগত জানাচ্ছে, নাগরিকত্ব দেবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে, কিন্তু শরণার্থী রোহিঙ্গা ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ, কারন তারা 'মুসলমান'। মুসলমানের ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ তো বটেই, এমনকি যারা আসামে ২৪ মার্চের মধ্যরাতের পরে গিয়েছে তাদেরকে এখন আসাম থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। পুশ ব্যাক কিম্বা যে কোন প্রকার বল প্রয়োগের পদ্ধতি অবলম্বন করতে ভারত দ্বিধা করবে না। ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হলেও মায়ানমারের নির্যাতীত সংখ্যালঘু ভারতে আশ্রয় পাবে না। অথচ ভারতের সঙ্গে মায়ানমারেরও সীমান্ত রয়েছে। তারা জাতিগত ভাবে 'রোহিঙ্গা' বলে নয়, ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকে 'মুসলমান' বলেই ভারতে তাদের জায়গা নাই। চরম সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী রাজনীতির কবলে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়া।

নাগরিকপঞ্জী: হিন্দুত্ববাদী এক্সপেরিমেন্ট

বলাবাহুল্য পুরা ভারত মুসলিম শূন্য করা অবাস্তব চিন্তা, তাই আসামে নাগরিকপঞ্জীর (National Register of Citizenship) নির্ণয়ের মধ্য দিয়ে কে ভারতীয় আর কে নয় নির্ণয় একটি পরীক্ষা বটে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের সঙ্গে এর সাংঘর্ষিকতা কতোটুকু হিন্দুত্ববাদীরা তা দেখতে চায়। আরাকান থেকে মায়ানমার থেকে ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে হত্যা ধর্ষণ করে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেবার সাফল্য দিল্লিকে উৎসাহিত করেছে দারুন। বাংলাদেশ একটি দুর্বল দেশ। আঞ্চলিক কিম্বা আন্তর্জাতিক ভাবে তার কিছুই করবার ক্ষমতা নাই। ভারতের সংবিধান কতোটুকু আন্তর্জাতিক মানবিক অধিকারের বিধানগুলো মানে হিন্দুত্ববাদ সেটাও পরীক্ষা করতে চায়।মুসলমান নির্মূলকরণ প্রক্রিয়ার আরম্ভ তাই পরীক্ষামূলক ভাবে আসামেই শুরু হয়েছে। খুবই ভয়াবহ বটে, কিন্তু অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ প্রাথমিক হিন্দুত্ববাদী এক্সপেরিমেন্ট। আধুনিক রাষ্ট্রের আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের জন্মগত মানবিক অধিকার অস্বীকার করবার জন্য।

এর একমাত্র তুলনা হতে পারে যুদ্ধ পূর্ব নাৎসী জর্মানিতে ইহুদিদের একের পর এক আইন করে নাগরিকত্ব হরণ প্রক্রিয়ায় সঙ্গে, যার পরিণতি ঘটেছে নির্বিচার ইহুদি নিধনে। ইতিহাসের পূর্বানিবৃত্তি রোধ করতে চাইলে নাগরিকপঞ্জী (National Register of Citizenship)-কে নাৎসী জর্মানির ইহুদি নির্মূলকরণের আগের বিবিধ আইনী পদক্ষেপ হিসাবে দেখা উচিত। এখনই মোদির হিন্দুত্ববাদী গণহত্যার প্রস্তুতি প্রতিহত করবার জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা বাড়ানো দরকার। রোহিঙ্গা ট্রাজেডির মতো আরেকটি আসাম গণহত্যা শুরু হোক, এটা কারো কাম্য হতে পারে না। মায়ানমায়ের পর দক্ষিণ এশিয়া আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে দ্রুতবেগে ধেয়ে চলেছে।

এই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়, বলাই বাহুল্য। কিন্তু আসামের বর্তমান পরিস্থিতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক ভাবে পর্যালোচনার কতোটুকু ক্ষমতাই বা আমরা রাখি? দ্বিতীয়ত আসাম পরিস্থিতির প্রতি আমাদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী কি হবে? এটা কি নিছকই হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিবাদ নাকি ঔপনিবেশিকতার ধারাবাহিকতায় পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে অনিবার্য জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতা ও হিংসার অভিপ্রকাশ? জাতিবাদ ও গণতন্ত্রেরর অনিবার্য বিরোধ যার মীমাংসা আমরা যতো সহজ মনে করি ততো সহজ নয়। তথাকথিত আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমস্যা, ভোটব্যাংক নির্ভর গণতন্ত্র এবং ধর্ম ও জাতিগত প্রশ্ন মীমাংসার জন্য উপযুক্ত রাজনীতির অভাব ইত্যাদি পর্যালোচনা না করে আধুনিক রাষ্ট্র ও জাতিবাদের দৃশ্যমান সংকট বোঝা যাবে না। ফলে মীমাংসাও জোড়াতালি দিয়ে হবে না। গোড়া থেকে ভাববার দরকার আছে। ইতিহাস পাঠ এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবার দরকার রয়েছে।

আসাম নিয়ে এটা আমাদের প্রথম লেখা। যেহেতু রোহিঙ্গা সংকটের পর আসামের ঘটনাবলী বাংলাদেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে সে কারনে এই প্রসঙ্গে আমরা আরও লিখবার আশা রাখি। শুরুতেই আমরা যে দিকটা সন্ধান করবার জন্য লিখছি সেটা হোল নরেন্দ্র মোদী আসাম থেকে মুসলমান তাড়াতে চায় ভারতের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হিন্দু ভোটের জন্য। অন্যদিকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে মোদী চাইছে একে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পর্যবসিত করে ফায়দা নিতে। ফলে এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে বাংলাদেশেও একে হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে পর্যবসিত করার অর্থ হচ্ছে মোদীর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে নীতিগত ভাবে মেনে নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক ভাবে ইসলামের প্রতি আতংক ও বিদ্বেষের যুগে বাংলাদেশকে আরও কঠিন বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া ।

নিঃসন্দেহে ইসলাম বিদ্বেষ ও ঘৃণা বিষ বাষ্পের মত সর্বত্র আমাদের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। কিন্তু এটা কি স্রেফ মুসলমানদের ঘৃণা ও বিদ্বেষের সমস্যা? হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিবাদ নিয়ে দাঁড়ানোই কি তাহলে কর্তব্য? নাকি কর্তব্য আধুনিক গণতান্ত্রিক বা তথাকথিত লিবারেল রাষ্ট্রের মিথ ভেঙে দেওয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিপ্লবী গণতান্ত্রিক রাজনীতি শক্তিশালী করা? ভোটকেন্দ্রিক ক্ষমতা তৈয়ারি ও ভোটব্যাংক নির্ভর রাজনীতি কিভাবে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। এটা জানা, নতুন কিছু নয়। ভারত কিম্বা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে সেটা নতুন করে বোঝার দরকার নাই। হিটলার আর মুসোলিনী ভাল নজির। হিটলার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়েই ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন। ইহুদিদের পুড়িয়ে মারার নৈতিক বৈধতা দিয়েছিল জাতিবাদ, তার আইনী বৈধতা দিয়েছিল নির্বাচন এবং রাষ্ট্র গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারার ফাংশানাল কাজটা করেছে। তাহলে জাতিবাদ, নির্বাচন এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন আধুনিক রাষ্ট্রের পর্যালোচনা ছাড়া ফ্যাসিবাদকে বোঝা অসম্ভব। মানবাধিকারের বুলি আউড়িয়ে তার মীমাংসা হবে না।

জাতিবাদের বিষ আমরা বুঝব যদি 'বাঙালি' হবার গৌরবে বীর বাঙালি কিভাবে পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতি সত্তার অধিকার অস্বীকার ও হরণ করেছে, করছে  এবং করে। বুঝতে হবে জাতিবাদ ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে একটি দেশের সকল মানুষকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অন্তর্ভূক্ত করতে অক্ষম। বাংলাদেশে বাঙালি জাতিবাদের বিপরীতে কিভাবে ধর্মীয় জাতিবাদ দানা বেঁধেছে তার সঙ্গে আসামের মিল কম। কিন্তু অসমিয়া জাতিবাদকে কিভাবে সর্ব ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের রূপ দেবার চেষ্টা চলছে তা বোঝার জন্য আসামের ঘটনাবলী গুরুত্বপূর্ণ।

আসামের ঘটনাকে শুধু হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দ্ব হিসাবে নয়, বরং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের দিক থেকেও পর্যালোচনা করা দরকার। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফাঁদে না পড়ে পুরা দক্ষিণ এশিয়ায় জনগণের সঙ্গে আরও বৃহত্তর গণ ঐক্যের ক্ষেত্রগুলো তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। শুধু তখনই ধর্ম, জাতি, জাত, বর্ণ নির্বিশেষে দক্ষিণ এশিয়াকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা অবদান রাখতে পারবে।

'আগুন নিয়ে খেলবেন না': মমতা ব্যানার্জি

নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদ ভারত থেকে মুসলমানদের তাড়াতে চায়, যদিও এটা একান্তই উৎকট ও অসম্ভব বাসনা, কিন্তু বিজেপি ভারতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী ভিত্তি দৃঢ়মূল করার জন্য বড়সড় দাঙ্গা ও রক্তপাত ঘটাতে দ্বিধা করবে না।

বিশ্বজুড়ে ইসলাম আতংক, মুসলমানদের 'দানব' ও 'বর্বর' ভাবা, মধ্য প্রাচ্যে পাশ্চাত্য পরাশক্তির অন্যায় যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ নির্বিচারে চালিয়ে যেতে পারা, বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে বিদেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে ভারতের গণমাধ্যমে এই মিথ্যা সফল ভাবে জারি রাখতে পারা এবং মায়ানমার থেকে বিশ্ববাসীর চোখের সামনে গণহত্যা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার তাণ্ডবের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার সাফল্য -- ইত্যাদি এটাই প্রমাণ করে মুসলমানদের বিতাড়ন, নির্মূল ও হত্যা আন্তর্জতিক রাজনীতি, নৈতিকতা এবং শত্রুমিত্র ভেদের দিক থেকে সঙ্গতিপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি এই সুযোগ পুরাপুরি নিত আগ্রহী এবং প্রবল ভাবে উৎসাহী। লিবারেল বা উদার রাজনীতির সঙ্গে ভারতের গরু ও গোমাংসের রাজনীতি সাংঘর্ষিক , কারন তা নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করে কিন্তু ভারতে সেটা সম্ভব হয়েছে; ধর্মীয় স্বাধীনতা ভারতে রাজনৈতিক ও আইনী উভয় দিক থেকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। এর বার্তা হচ্ছে চৌদ্দ পুরুষ ভারতীয় হলেও ভারত আর মুসলমানদের জন্য নয়। নাগরিকপঞ্জী অনুযায়ী ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও বাবা বা মা ভারতীয় কিনা সেটা দলিল, পাসপোর্ট ইত্যাদি আইনী কাগজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তা না হলে নাগরিকত্ব মিলবে না। এটা নাগরিকপঞ্জির ছুতায় আসামের অধিবাসীদের আইনী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রহীন করার পরিকল্পনা।

আসামের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে বাংলাদেশে জোর করে পাঠিয়ে দিলে মায়ানমারের পর বাংলাদেশ নতুন যে বিপর্যয়ের মধ্যে নিপতিত হবে সেটা একটি গুরুতর প্রশ্ন। কিন্তু আরও গুরুতর হচ্ছে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভাবে এই বিপর্যয় মোকাবিলা করতে সক্ষম কিনা। না, সক্ষম নয়। সেটা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি। ষোল কোটি মানুষের দেশ হলেও বাংলাদেশ যারপরনাই দুর্বল, আভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ীর রাজনীতির কারণে চরম ভাবে বিভক্ত। তাছাড়া বাংলাদেশ দিল্লীর আগ্রাসন নীতির অধীন একটি রাষ্ট্র। ফলে কুটনৈতিক ভাবে ভারত থেকে মুসলমান বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিরোধ অসম্ভবই বটে। মুসলমানদের অনৈক্য এবং মধ্য প্রাচ্যে শিয়া সুন্নির বিভক্তির কারনে বিশ্ব রাজনীতির নতুন যে মেরুকরণ ঘটেছে তার ফলে আন্তর্জাতিক সুবিধা নেবার কোন অবলম্বনও বাংলাদেশের নাই।

তাহলে উপায় কি? একমাত্র পথ হিন্দুত্ববাদ-মনুবাদ বিরোধী ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণের সঙ্গে মৈত্রীর রাজনীতি শক্তিশালী করা। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উচ্ছেদ ঘটাবার জন্য যে নীতি ও কৌশল জরুরী, বাংলাদেশের জনগণকে সেই মৈত্রী, ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে হবে।

সম্ভবত সেই দায় ঐতিহাসিক ভাবে হিন্দুত্ববাদী বাঙালির বিপরীতে 'নতুন বাঙালি'র ঘাড়ে এসে পড়তে যাচ্ছে। যে বাঙালির কাছে বাংলা হচ্ছে সেই উর্বর পলিমাটি যেখানে সনাতন, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলাম সহ নানান ধর্ম ও ধর্মীয় আন্দোলন মহাসাগর হয়ে উঠতে চায়।

পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিপদ টের পেতে ভুল করেন নি। আসামের উগ্র অহম জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাঙালির বিরোধ নতুন নয়। মমতা বলেছেন, “অসমে বাঙালি হঠানো শুরু হয়েছে। ইচ্ছে করে মানুষের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে৷অসমে, গণ্ডগোল হলে বাংলাতেও প্রভাব পড়বে। অসমে কোনও বাঙালির বঞ্চনা মানব না। আমাদের কারও সঙ্গে এ রকম করবেন না। আগুন নিয়ে খেলবেন না। মানুষের গায়ে হাত পড়লে ছেড়ে দেব না। কাজের চেয়ে রাজনীতিই বেশি হচ্ছে।”

আসামে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ভরকেন্দ্র স্রেফ হিন্দু বনাম মুসলমান বিভাজন নয়, বরং পুরানা বাঙালি হঠাও আন্দোলনই নতুন সাম্প্রদায়িক মোড়কে হাজির হয়েছে -- এই জ্ঞাপনার মধ্য দিয়ে মমতা এই সত্যই সামনে আনতে চাইছেন যে দেশ বিভাগ বাঙালিকে ধর্মীয় ভাবে বিভক্ত করে যে ক্ষতি ঘটিয়েছে তার কুফল সাড়ে ষোল আনা পশ্চিম বাংলার বাঙালিকেই ভোগ করতে হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সাতচল্লিশের বিভক্তির মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক জমিদারতন্ত্রের অবসান যেমন ঘটিয়েছে, একই ভাবে বাহান্ন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতির গৌরব বাংলাদেশীরা আপন করে নিয়েছে। বাঙালি মুসলমান রক্ত দিয়ে বাঙালি হয়েছে। তাই বাংলা সীমান্তের এদিকে পুষ্ট হলেও, পশ্চিম বাংলা হিন্দী আগ্রাসন ও আধিপত্যে যারপরনাই কাবু। পশ্চিম বাংলা হিন্দী বলয়ের আগ্রাসনে নিজেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। পশ্চিম বাংলা সাম্প্রদায়িক হিন্দু থাকবে নাকি বাঙালি হবে এই দ্বিধা আজও কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

আসামের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ধর্মবাদী ও জাতিগত উভয় প্রকার সাম্প্রদায়িকতার উর্বর ক্ষেত্র। আশার কথা, মমতা ব্যানার্জি সেটা বুঝতে ভুল করেন নি। আসামের রাজনীতি বাংলাদেশকে যতোটা বিপর্যস্ত করবে, পশ্চিম বাংলাকে তার চেয়ে কোন অংশে কম হেস্তনেস্ত করবে না। আসামে বিজেপির মুসলমান বিতাড়ন ও নির্মূল পরিকল্পনা সফল হলে তার কুফল পশ্চিম বাংলাকেও সমান, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বেশী মাত্রায় ভোগ করতে হবে। মোদীর বিজেপি হিন্দুত্ববাদ, হিন্দু মুসলমান বিভাজন ও সাম্প্রদায়ীকরণের রাজনীতিই করবে, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করাই বিজেপির প্রধান আদর্শগত কর্মসূচি। হিন্দু ভারত সফল হলে বাংলা টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ।

বাংলাদেশের জন্য এই ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় কী? এক নম্বর শিক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার ফাঁদে পা দিলে চলবে না। জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে ভাবতে জানতে হবে। গোলকায়নের কাল পর্বে 'বাঙালি' হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের আরও বৃহত্তর ও সর্বজনীন স্বার্থ আছে এবং সেটা পশ্চিম বাংলার বাঙালি সহ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষীর অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত -- এটা প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। তাই চরম উস্কানি সত্ত্বেও বাংলাদেশকে 'মুসলমানী' সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নয়, বরং ইসলামকে আরো বৃহত্তর পরিসরে ভাবতে শিখতে হবে। ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকেও বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি হিসাবে 'বৃহৎ বঙ্গ' (দীনেশ চন্দ্র সেন) কিম্বা 'বড় বাংলা'কে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের ক্ষেত্র থেকে বুঝতে হবে।

'অসাম্প্রদায়িক' রাজনীতিই বাংলাদেশকে শক্তি জোগাবে। কিন্তু 'অসাম্প্রদায়িকতা' কী? বাঙালি জাতিবাদীদের ইসলাম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতাকে অসাম্প্রদায়িক বললে চলবে না, সেটা হিন্দুত্ববাদেরই বাংলাদেশী রূপ মাত্র। বরং, ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব বা ধর্ম নানান ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে যেভাবে আমাদের মধ্যে বিশেষ পরিচিতি বা আইডেন্টিটি তৈরির প্রণোদনা দেয় এবং যার কারণে আমরা আমাদের প্রতিবেশীকেও 'অপর' ভাবতে শুরু করি -- সেই প্রক্রিয়া আমাদের বুঝতে হবে। তাকে ঠিক ভাবে শনাক্ত করে এই অসুখ থেকে আমাদের মুক্ত হওয়া জরুরী। বাঙালি হিন্দুর লড়াই ইসলাম বা মুসলমানের বিরুদ্ধে নয়, তেমনি বাঙালি মুসলমানের লড়াই সনাতন ঐতিহ্য, হিন্দু বা হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়, বরং উভয়েরই লড়াই ব্রাহ্মণ্যবাদ, বর্ণাশ্রম ও সকল প্রকার ভেদবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে।

বাঙালি আর্য নয়, আরব নয়, ইরান, আফগানি, তুরানিও নয়। এমনকি ভুলে যাওয়া উচিত নয় বঙ্গে ব্রাহ্মণ বাইরে থেকে আমাদানি করা বর্ণ। বাংলাদেশের জনগণের লড়াই হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও মুনুবাদের বিরুদ্ধে শূদ্র, আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের লড়াই। নতুন দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার জন্য নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি ও সম্ভাবনার সংগ্রাম। মোদীর হিন্দুত্ববাদকে পরাস্ত করবার এটাই একমাত্র পথ।

এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের জনগণকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।