গণতন্ত্র : ধারণা, ইতিহাস ও ইসলাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া এবং আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের ফলাফল এবং সংস্কৃতি, মন ও মানসের সাম্রাজ্যিক দাস্যতায় অধীনস্ত করণের ভাষা, তৎপরতা বিশ্লেষণের জন্য বিখ্যাত মালিক বিন নাবী। দর্শন, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি এবং সমাজ তার পাঠের জায়গা হলেও ইসলাম ও মুসলিম তার পর্যালোচনার অন্যতম ক্ষেত্র। বিশেষভাবে মুসলিম সমাজের পতনের আড়ালে অনুদঘাটিত কার্যকারণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। যেকারণে পশ্চিমের একচ্ছত্র কর্তৃত্বের ফলে সবকিছুকে তারই মতো করে দেখার, ভাববার, নির্মাণ করবার যে মন ও স্বভাব গড়ে উঠেছে ইসলাম ও প্রাচ্যে, মালিক বিন নাবী ছিলেন এর ঘোরতর বিরোধী। গণতন্ত্রসহ পশ্চিমের আধুনিক নানান চিন্তা, দর্শন ও বাদ-মতবাদকে বুঝে না বুঝে বিনাবিচারে গ্রহণের প্রবণতা এবং ইসলামীকরণের ঘোর বিরোধী ছিলেন মালিক বিন নাবী।
গণতন্ত্রের প্রশ্ন নিয়ে ইসলামে বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক ও ব্যাখ্যার চল রয়েছে। এই ব্যাখ্যাগুলোর পদ্ধতিগত জায়গাটি সাধারণত ধর্মতত্ত্ব এবং ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের নিছক শাসন পরিচালনা পদ্ধতির নানান মহত দিককে উৎস বিবেচনা করার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়। যাতে মূলত গণতন্ত্রের মর্ম এবং ইসলামের হাকীকত একাকার হয়ে যায়। ফলে তাতে গণতন্ত্রের গোড়ার জায়গাটি কী? এটা যেমন বুঝা যায় না, তেমনি ইসলামের প্রাণসত্তা ও তার অভিমুখ কী? সেটা বুঝাও মুশকিল হয়ে পড়ে। তবে ইসলামে আদৌ কি গণতন্ত্র বলে কিছু আছে? এই প্রশ্ন ধরে মালিক বিন নাবী এই লেখায় গণতন্ত্রকে বুঝবার আগে ইসলামের হাকীকত ও মর্মকে বুঝার চেষ্টা করেন। ফলে গণতন্ত্র ও ইসলামের মধ্যে ভেদগত জায়গা এবং একই সঙ্গে উভয়ের মুখোমুখি হওয়ার অবস্থাও পরিস্কার করে তোলেন। এমনকি ইসলাম তার নিজের বয়ানের ভেতর কোন নীতির ভিত্তিতে মানুষের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতাকে ঐতিহাসিকভাবে অতিক্রম করে যাবার মোকাবেলা হাজির করে- সে দিকটিও এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে আলাপ-বাহাসের একটি প্রাণবন্ত সূচনা আমরা পাঠকের কাছ থেকে আশা করছি। বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় বিবেচনাগুলো যাতে সকলে মিলে সামনে এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এখানে এই লেখাটি প্রকাশ করা হলো। উল্লেখ্য, এই লেখাটি মূলত ১৯৬০ সালে মরক্কোর ছাত্র পরিষদে দেয়া তার একটি বক্তব্য। মূল ফরাসীর অনুবাদ আরবী “তা’আম্মুলাত”(নানান ভাবনা) গ্রন্থ থেকে লেখাটির সার-সংক্ষেপ তৈরি করেছেন, শাহাদাৎ তৈয়ব।
মালিক বিন নাবী:
মালিক বিন নাবীর জন্ম ১৯০৫ সালে কনস্ট্যান্টাইন নগরীর এক দরিদ্র পরিবারে। পড়লেখা করেছেন এমন এক স্কুলে-- যাকে ঠিক কারাগার বলা যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন ১৯২৫ সালে। এরপর তিনি তার এক বন্ধুর সাথে ফ্রান্স গমন করেন। সেখানে কাজ করেন এ্যাপোলো কোর্টে। ১৯৩০ সালে তিনি ভর্তি হবার চেষ্টা করেন ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ ইনস্টিটিউটে। কিন্তু তাকে অনুমতি দেয়া হয় নি। শেষ পর্যন্ত তিনি রেডিও স্টাডিজে ভর্তি হন এবং সেখানেই সহযোগী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। এরপর বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আরবীভাষী হলেও লেখালেখি করেছেন ফরাসী ভাষায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬৩ সালে তিনি নিজ ভূমি আলজেরিয়ায় ফিরে আসেন। এরপর তিনি ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবরে মৃত্যুবরণ করে।
তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ:
• Les conditions de la renaissance (1948)
• Vocation de l'islam
• Le problème des idées dans le monde musulman
• Le phénomène coranique
• La lutte idéologique
• L'Afro-asiatisme
• Islam et Démocratie
• S.O.S Algérie
• Idée d'un commenwealth islamique
• Naissance d'une société
• Perspectives Algérienne
• Mémoires d'un témoin du siècle, tome1 et tome2
• Le rôle du musulman dans le dernier tiers du 20ème siècle
• l'Orientalisme et la Democratie dans l'islam
• Contemplations
গণতন্ত্র : ধারণা, ইতিহাস ও ইসলাম
আমরা যারা মুসলিম জাতির উত্তরাধিকারী, তেমনি আফ্রিকা-এশিয়ার উত্তরাধিকারী। একই সঙ্গে যারা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রেরও আনুগত্যকারী। আর এই সাম্রাজ্যবাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতাই তাদের এখনকার জীবন কাহিনী। আবার বিজিতের উপর বিজয়ীদের প্রথা, সংস্কৃতি চর্চা ও অধিপতিপরায়ণ শাসন নীতির কর্তৃত্বও চলে সমানতালে।
পশ্চিমা বিশ্ব তার জীবনের যে মানদণ্ড, তার যে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা উপস্থিত করেছে আমরা আজ তারই উত্তরাধিকার বহন করছি। তাদের সামাজিক প্রকৃতি গ্রহণ করে তারই আলোকে আমরা আমাদের অতীতের যে মূল্যায়ন হাজির করি তাই আমাদের চক্ষুকে বিমোহিত করে। আমাদেরকে বিমুগ্ধ করে। আমরা তুষ্ট হই। মূলত তাদের জীবন চর্চা, প্রথা, ভাষা-পরিভাষা জীবন শৈলী, মূল্যবোধ আমাদের উপর চেপে বসেছে। আমাদের চিন্তা তাদের আনুগত্য করছে। আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা ও গবেষণা তাদের দ্বারা নির্দেশিত। আমাদের যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণ তাদেরই যুক্তি প্রক্রিয়ায় প্রমাণসিদ্ধ। আমাদের চিন্তাভাবনা, লেখাপড়া, লেখালেখি, আলোচনা আর নতুন নতুন বিষয় যেমন ইসলামে গণতন্ত্র-- সবকিছুতেই এর প্রভাব রয়েছে।
আমরা যখন কোনো ভূমিকা পেশ করি তখন আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই অনুধাবন করি না যে, আমরা যা করছি এটা আসলে তাল মেলানোর ব্যাপার। কোনো জিনিষকে আপনার মধ্যে প্রশ্রয় দেয়ার ব্যাপার। আমরা এমন একটা প্রথার সামনে মাথা নুইয়ে দিয়েছি যা মূলত ইওরোপ থেকে আমাদের উপর চেপে বসেছে। এমনকি আমরা যা করছি তাকে আমরা মনে করছি এটা এক মহা মূল্যবান কাজ, সভ্যতা সমৃদ্ধ কাজ। এটা করার সময় আমরা কোনোরকম যাচাই বাছাইয়ের তোয়াক্কাই করি না যে, এটার সাথে কী যুক্ত আছে, ইসলামের সাথে এর কী সম্পর্ক কিংবা ইসলাম আদৌ এর থেকে মুক্ত কিনা, পবিত্র কিনা। অথচ গণতন্ত্র ঠিক সেই উপাদান যাকে আমরা ইসলামের ঐতিহ্যের সাথে বাহির থেকে যুক্ত করেছি। এইভাবে যুক্ত করতে গিয়ে আমরা এতোটাই আত্মতুষ্ট হয়েছি যে, যা আসলে এই মিলিয়ে দেয়ার বৈধতাকেই নিশ্চিত করে। বিষয়টি এমন হয়ে উঠেছে যে, যেখানে এখন কোনো রকম প্রশ্নের দরোজাও খোলা নাই। প্রশ্নই ওঠানো যায় না যে, “আদৌ ইসলামে গণতন্ত্র আছে কি?” বরং আমরা এর সাথে তাল মিলিয়ে বলি-- “আমাদের জন্য পেশ করো এমন গণতন্ত্র যা ইসলামে বিদ্যমান আছে।”
এরপর এখানে একটা পরিভাষাগত সমস্যা রয়েছে। যেটাকে আমি মৌলিক সমস্যা মনে করি। সেজন্য আমাদের উচিত হবে এই দুই পরিভাষার মধ্যে ভেদটা কী সেটাকে পরিচ্ছন্ন করা। এবং সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়া যে-- ইসলাম কী আর গণতন্ত্র কী?
লক্ষ করার বিষয় হলো-- এই দুইয়ের প্রতিটি শব্দই যে কালেরই হোক না কেনো সেগুলো নতুন অর্থ ধারণ করে। তবে আমরা জোর দিয়ে জানবো যে, ইসলাম শব্দটি কখন আরবী ভাষায় ও তার অর্থের ভেতর সৃষ্টি হয়েছে এবং ক্রমবিকশিত হয়েছে। কারণ এই যে ইসলাম, এর অর্থ তো এসেছে নিঃসন্দেহে কুরআনের মধ্য দিয়ে। আমরা এতটুকু অন্তত জানি যে, গণতান্ত্রিক শব্দটি একটি বিশেষ পরিভাষা। কিন্তু আমরা জানি না যে, এটি কখন আরবী ভাষায় প্রবেশ করেছে। আমরা জানি না এর নিজস্ব ভাষায় এর উৎপত্তির ইতিহাস কী। কিন্তু আমরা জানি যে, এই শব্দটি বিদেশী শব্দ। এবং এটি ব্রিকলেস যুগের পূর্ববর্তী গ্রীক শব্দ। কারণ খ্রীস্টপূর্ব পাঁচ বছর আগের সীজারের ভাষা উদ্ধৃত করে টুইসডেড এ্যাথেন্সের জাতিকে সম্বোধন করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে তাই জানা যায়। আবার আমরা এর দূর ইতিহাস এবং ভূগোলের দিকে তাকালে দেখবো যে, ইসলামে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্বই নাই।
অন্যদিকে তাকালে আমরা দেখবো যে, শব্দটি মানব ইতিহাসের বাস্তব ঘটনাঘটনের গভীর শেকড়ের সাথে যতোটা সম্পর্কিত তেমনি এদুই শব্দের অবস্থাকে আমরা যেভাবে বিশ্লেষণ করি তাতে নানান অর্থের দিক থেকে শব্দটির অর্থের মধ্যে একটা মিশ্রণের সম্পর্ক ও মিলন রয়েছে। তাই আমরা চেষ্টা করবো এই দুই শব্দের নানান অর্থের সম্পর্ক ধরিয়ে দিতে।
ইসলাম একটি শব্দ। গণতন্ত্র একটি শব্দ। বহু অর্থের মধ্যে ডেমোক্রেটিক শব্দটির অর্থ কী। ফরাসী ভাষার অভিধান দেখলে দেখবো শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দের যুক্ত রূপ। যার অর্থ জনগণের ক্ষমতা। যেমন আমরা আজকে বুঝতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি “গণমানুষের ক্ষমতা” কথাটি বলতে।
অন্যদিকে বহু অর্থ সম্পন্ন ইসলাম শব্দটির প্রকৃত অর্থ কী। এইসব অর্থের মধ্য থেকে মুহাম্মদ স. থেকে আমরা যে অর্থটি পেয়েছি এর চে উত্তম জবাব এই প্রশ্নের জন্য আমরা আর পাইনি। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন- একদিন মুহাম্মদ স. জনসম্মুখ্যে উপস্থিত ছিলেন তখন একলোক এসে বললেন, ঈমান কী? এভাবে হাদিসের এক পর্যায়ে লোকটি বললেন-- ইসলাম কী। রাসূল স. বললেন- ইসলাম হলো এক আল্লাহর ইবাদত করা। তার সাথে শিরক না করা। সালাত আদায় করা। জাকাত আদায় করা। সিয়াম পালন করা।
এরই মধ্যে মূলত আমরা এই দুইয়ের অর্থ স্থির করে ফেলেছি। তাহলে এই উদারিকরণের পরও এই দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক কী। তুলনাগত সম্পর্ক কী। এই রাজনৈতিক ভাবনার ক্ষেত্রে এমন কোনো তুলনাগত রূপ আছে কি যা সুনির্দিষ্ট সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের ক্ষমতার সামগ্রিক বয়ানের ফলাফল বা সমৃদ্ধি কী হবে তা পেশ করে। কিংবা মানুষের ক্ষমতা, সামাজিক ব্যবস্থা বা বৈষয়িক নিয়ম-শৃঙ্খলার উপর আল্লাহর যে কর্তৃত্ব তার সামনে আত্মসমর্পনের বয়ানকে পরাবিদ্যার ভাবনা কতটুকু সমৃদ্ধ করে।
সবশেষে এইসব আলোচনা ও চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ তর্ক-বিতর্কে রূপান্তরিত হয়। তার প্রকাশ অনেকটা ফরাসী বিপ্লবের মতো যা শেষ পর্যন্ত গির্জা বিরোধী (আমরা চাই না পাদ্রি, রাব্বাই) লড়াইয়ের রূপ নেয়। দৃশ্যমান এই বিরোধের বহুদূর প্রভাব পড়ে এই দুই পরিভাষার উপর। একইভাবে এই বিরোধ এর তুলনাগত জটিলতার মধ্যেও যে তুলনাকে আমরা আসলেই উভয়ের মধ্যে প্রয়োগ করতে চাই।
কিন্তু এই পরিভাষা দুটি যে বাস্তব প্রেক্ষাপটকে প্রকাশ করে এই জটিলতা কিন্তু সে বাস্তবতার ফলাফল নয়। বরং এই বাস্তব পরিস্থিতিকে আমরা কীভাবে প্রকাশ করি তার পথ পদ্ধতির ফলাফলই এই জটিলতা।
ফরাসী বিপ্লবের নানান অবস্থা ও প্রথার সাথে এই ডেমোক্রেটিক শব্দের সম্পর্ক আছে। কিন্তু আসলে আমাদের উচিত হলো ডেমোক্রেসির সংজ্ঞা নির্ধারণে পুনপর্যালোচনা করা। এবং আমাদেরকে ইসলামের ক্ষেত্রেও এর পূর্ববৎ নানা তত্ত্ব ভাবনার সাথে সম্পর্ক না রেখে ডেমোক্রেসির সংজ্ঞা নির্ণয় করা উচিত। অতপর আমাদেরকে নজর দিতে হবে এর ব্যাপক আকারের প্রতি। অর্থাৎ যে কোনো পূর্বানুমানের সাথে এই বিষয়টিকে যুক্ত করার আগেই এর সাধারণ স্বভাবের প্রতি খেয়াল রাখা আমাদের জন্য জরুরি। কারণ, প্রথমত এবং প্রধানত ডেমোক্রেসির প্রকৃতির মধ্যে “আমি”র প্রকৃতি কর্তৃত্বশীল। দ্বিতীয়ত, একইসঙ্গে ডেমোক্রেসির প্রকৃতির মধ্যে অপরের ভাবনাও সম্পর্কিত, কিন্তু এই ভাবনা অবশ্যই ব্যক্তির চিন্তার কেন্দ্র থেকে। তৃতীয়ত, ডেমোক্রেসির স্বভাবের মধ্যে নিহিত রয়েছে অনিবার্য সামাজিক ও রাজনৈতিক সামগ্রিক শর্ত-পরিস্থিতি। যাতে করে এই “আমি”র উপলব্ধিকে ব্যক্তির মধ্যে যথার্থ অর্থে নির্মাণ ও বিকশিত করা যায়।
তৃতীয় এই রূপটি, যেটি বাস্তব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্রের নিজের এবং বস্তুগত জীবনের যাবতীয় চাহিদা ও আকাক্সক্ষা ধারণ করে। কারণ আমিত্বের সমস্ত আয়োজন ও প্রস্তুতির উপরই গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক ইচ্ছা। আর এর যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এটাই সমাজে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ফলে সত্যিকার রাজনৈতিক অর্থে গণতন্ত্রকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় যদি তার শর্তগুলো পরিপূর্ণ ব্যক্তি গঠনের মধ্যে এবং একটি দেশের যাবতীয় প্রথা, সংস্কৃতি এবং পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যমান না থাকে।
গণতান্ত্রিক চিন্তা কতগুলো শর্তের সাথে সম্পর্কিত যা ছাড়া গণতান্ত্রিক চিন্তা সম্ভব নয়। এই শর্তগুলো প্রকৃতির ভেতর থেকে নয় এমনকি প্রাকৃতিক নিয়মের দাবি থেকেও নয় এই শর্তগুলো।
রুশোর যুগে রোমান্টিক দর্শন যে চিন্তা করেছে তারও বিপরীত এই গণতান্ত্রিক চিন্তা। বরং এই চিন্তা একটি বিশেষ সংস্কৃতির এবং ইওরোপের মানবতাবাদী আন্দোলনের নির্যাস মাত্র। ফরাসী ঐতিহাসিক জিযু তার “রোমান সাম্রাজ্য থেকে ফরাসী বিপ্লব-- ইওরোপের ইতিহাস” গ্রন্থে এটি আরো পরিস্কার করে তুলেছেন।
পশ্চিমা গণতন্ত্রের প্রকাশ ঘটেছে ব্যক্তির অভিব্যক্তি আকারে। ইওরোপের বড় দুটি আন্দোলন-- সংস্কার আন্দোলন ও রেনেসাঁ আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে সকল জটিলতা উদ্ভুত হয়েছে সেগুলো থেকে গণতান্ত্রিক চিন্তা মুক্ত নয়। মূলত এই দুই আন্দোলনই আত্মা, ভাব ও বুদ্ধির দিক থেকে ইওরোপীয় মানসের প্রাথমিক মূল্যায়ন ও অনুধাবন। সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের পরিভাষার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো যখন আমরা ব্যক্ত করবো এবং রাজনীতি ও ইতিহাসের বন্ধন থেকে এই আলোচনা মুক্ত করবো তখন এর ছাপ আর প্রভাব আরো স্পষ্টভাবে উঠে আসবে।
গণতান্ত্রিক চিন্তা ইউরোপে হোক অথবা অন্য কোনো দেশে হোক এটি অবশ্যই তাদের নিজেদের একটি বিশেষ সামাজিক অবস্থার ফল। এর মধ্যে আছে দুটি অবস্থা। একটি ব্যক্তির অভিব্যক্তি আর অন্যটি দাস হয়ে থাকা এবং দাস বানানোর প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়েই তৈরি হয়ে ওঠে মুক্ত মানুষ বা নতুন মানুষ যার মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং এর অনিবার্যতা দানা বেঁধে ওঠে। আর এই দুই নেতিবাচকতা অর্থাৎ- ব্যক্তির অবস্থা এবং দাস প্রক্রিয়ার মধ্যে মুক্ত মানুষ- একটি ইতিবাচক দিক। এর সাধারণ বাস্তবতা পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে মুক্ত এবং এই চিন্তার মধ্যে প্রতিটি মানুষের সংহতি ছিলো একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি। এই ঐতিহাসিক অবস্থা-- দাস প্রথা থেকে গণতন্ত্রের দিকে উন্নীত হবার একটি ঐতিহাসিক রূপ। যেটি আমরা সাহিত্যেও দেখতে পাবো, যেমন- ভিক্টোর হুগোর সাহিত্য কর্মে। তেমনি আরবী সাহিত্যও তা থেকে মুক্ত নয় যেমন, আলফু লায়লা ওয়া লায়লা। যেখানে আমির হুকুম করছে আর তার প্রজা-দাসরা বলছে হ্যাঁ, জাহাঁপনা! হুকুম করুন। আমরা শুনবো আর তামিল করবো।
কিন্তু অন্য একটি ভিন্ন চিত্র আমরা দেখতে পাই যেটি গণতান্ত্রিক চিন্তাকে নাকচ করে দেয়। যেমন ফেরআউন এবং মুসার মধ্যে কথোপকথন চলছে। ফেরআউন বললো-- “মুসা! তোমার প্রতিপালক কে? মুসা বললেন-- আমার রব ও প্রতিপালক তিনিই, যিনি প্রতিটি বস্তুকে সৃষ্টি করেন এবং তার পথ পদ্ধতিও বাতলিয়ে দেন।” ত্বহা-৫০। এখানে প্রতিপালকের প্রতিপালনের প্রতি যে বিশ্বাস রাসূল মুসা থেকে এটি উঠে আসে।
আমাদের এখানে আর বেশি কোনো প্রমাণের প্রয়োজন দেয়ার দরকার নেই। কারণ, আমরা এখানে ফেরআউনের চরিত্রের মধ্য দিয়ে স্বৈর বা আমি’র সর্বোচ্চ চিত্র তুলে ধরেছি। যেখানে ফেরআউনের ক্ষোভ ও রাগের তীব্রতা রাসূলের প্রতি এতোবেশি ছিলো যে, সেখানে “আমি” যেভাবে ফুঠে উঠেছে তার চে বেশি বরং ডেমোক্রেটিক অনভূতিই নাকচ হয়ে গেছে। কারণ ব্যক্তির আমির মধ্য দিয়ে এখানে ফেরআউনের যে অভিব্যক্তি আর মুসার অভিব্যক্তি, অভিব্যক্তির উদ্দেশ্য, নিজের আমির সমর্পন এসব কিছুর মধ্য দিয়ে বরং আমি বা গণতন্ত্রের শাঁস নাকচ হয়ে যায়। অর্থাৎ এখানে আমি এবং আমি কেন্দ্রীক অপরও নাকচ হয়ে যায় যা গণতন্ত্রের ভেতর দিয়ে অনুভব করা হয়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক চিন্তার দুটি দিক আমি এবং অপর। আরো পরিস্কার করে বলা যায় গণতন্ত্রের মধ্যে দুটি চিন্তা রয়েছে, একটি হলো-- গোলামের মনোভাব, আরেকটি হলো গোলাম বানাবার মনোভাব। এদুটিই তার নাকচ হবার দিক। আসলে আমরা আলোচনা কর ছিলাম ইসলামে গণতন্ত্র নিয়ে। গণতন্ত্র কিছু সাধারণ বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। যেকোনো পরিবেশে গণতান্ত্রিক চিন্তার অস্তিত্বের জন্য এই সাধারণ শর্তগুলোর উপর নির্ভর করে গণতন্ত্র।
তাহলে প্রশ্ন হলো ইসলাম এই শর্তগুলো ধারণ করে কিনা। অর্থাৎ আমি এবং অপরের প্রতি যে অনুভূতি সে অনুভূতিই গণতন্ত্রের প্রাণ। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো ইসলাম কি এই অনুভূতির বিকাশের উপযোগী কোনো ধরনের সামাজিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে? ব্যবহারিক দিক থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আমাদের উচিত হতো এই প্রশ্ন তোলা যে, ইসলাম কি আদৌ গণতান্ত্রিক চিন্তা সৃষ্টি করে? আমাদের পরস্পর আরো জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, পরিমাপ, নেতিবাচক কারণগুলোর মূল এবং গোলাম ও গোলাম বানাবার তরীকায় প্রভাব রাখনেওয়ালা গণতান্ত্রিক চিন্তার নেতিবাচক প্রবণতাগুলোর হাকীকতকে কি ইসলাম হালকা করে দেখে? তবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি প্রকল্পকেই শুরুতেই আমাদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। গণতন্ত্রের ব্যাপক অর্থ রয়েছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও মনোগাঠনিক দিক নিয়ে তা পরিব্যাপ্ত। গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এই ক্ষমতা প্রেরণ করতে হয় দুটি সুনির্দিষ্ট দিকে। একটি হলো রাষ্ট্র আরেকটি হলো জনগণ। তার আছে একটি সংবিধান। এ সংবিধান কেবল গণতান্ত্রিকতার ব্যাপার নয় শুধু। এর সাথে আছে ধর্ম, প্রথা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
কিন্তু এই আলোচনায় উত্থাপিত প্রশ্ন-- ইসলামে কি গণতন্ত্র আছে? এর জবাব অনিবার্যভাবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উদ্ভাবিত ফিকহি ভাষ্যের সাথে সম্পর্কিত নয়। বরং খুব সাধারণভাবে ইসলামের উপাদানের সাথেই এর সম্পর্ক আছে। তবে বিশেষ দিক হলো এটি আমাদেরকে বৈধতা দেয় না যে, আমরা ইসলামকে একটি সংবিধান আকারে গণ্য করবো। যা একটি বিশেষ জাতিরই নেতৃত্বের কথা ঘোষণা দেবে এবং সেই জাতির স্বাধীনতা ও অধিকারকে স্পষ্ট করবে।
গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার সাথে সম্পর্কিত সকল প্রকল্পকে আমাদের মূল্যায়ন করা উচিৎ। কারণ এর প্রকল্প জনগণ ও জাতিকে ঘিরে। অর্থাৎ তার ভরকেন্দ্র জনগণ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক চিন্তা ব্যাপকভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও মনোস্তাত্ত্বিকতা পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত।
যেকারণে আমরা যেভাবে গণতন্ত্রকে বুঝে থাকি, গণতন্ত্রকে সেভাবে বুঝলে তা বুঝা হবে না। কারণ গণতন্ত্র ঠিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বুঝায় না। বরং গণতন্ত্র বুঝা যায় ক্ষমতাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাবার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ রাজনৈতিক চর্চাকে জনগণের ক্ষমতায় রূপান্তরিত করার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকতা বুঝা সম্ভব। কারণ এর সাথে সাথে সংবিধান দৃশ্যমান হয়ে ওঠার সম্পর্ক গভীরভাবে যুক্ত।
আর গণতন্ত্র যখন বাস্তব রাজনৈতিক চর্চা আকারে হাজির থাকে, সেখানে তখন সংবিধান সেই গণতান্ত্রিক প্রকল্পেরই মূর্তরূপ হয়ে ওঠে। এমনকি গণতন্ত্রের ভাষ্য যে সংবিধান এটি নিছক কোনো জনগোষ্ঠীর কিছু বিমূর্ত ধারণা আর ভাষার নাম নয়। এটি বরং সেই জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ, ইচ্ছা, স্বভাব, সংস্কৃতি, প্রথা-ঐতিহ্য তথা অনিবার্য ঐতিহাসিকতারই ফলাফল। অর্থাৎ ঐতিহাসিক বৈধতার একটি বয়ান যা কিনা তার অপরিহার্যতাকে নির্দেশ করে। এবং যা শুধু প্রাকৃতিকতা ভিন্নই নয় বরং অবশ্যই তা অর্জন সাপেক্ষ। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে যে প্রশ্নটা সামনে চলে আসে তাহলো, আসলে ইসলামে আদৌ কি গণতন্ত্র রয়েছে?
আমরা আমাদের আলোচনায় ইসলামকে গণতান্ত্রিক প্রকল্পের জায়গা থেকে দেখতে পারি। কারণ তার ব্যবহারিক (গণতান্ত্রিক) চর্চা এতোটাই আলাদা যে, যা বিবদমান গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে যাবার অবস্থা গড়ে তোলে। সমাজের দিকে তাকালে মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের যে অবস্থা তাতে গণতন্ত্রকে একটি বিমূর্ত বিষয় হিসেবে না দেখে বরং ব্যবহারগত দিক থেকে বুঝলে এর একটি স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধি টের করা যায়, যার সাথে ঐতিহাসিকতার সম্পর্ক যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ এর মর্মের দিকটিই ঐতিহাসিক রূপ আকারে জারি থাকে। এর কিছু সাধারণ কিংবা স্বাভাবিক দিক আছে। ইসলাম এই সাধারণ বা সার্বজনীন প্রাকৃতিক নীতির সাথে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তৎপরতাকে স্বীকার করে। আর এই তৎপরতার সাথেই অস্তিত্বময় আছে গণতান্ত্রিক স্বভাব। ইতিহাসের বিশেষ রূপের উর্ধ্বে বা নানা সময়ের বিশেষ বিশেষ অবস্থার বাইরের এই প্রকৃতি যা কিনা মানুষের সাধারণ ও নির্বেশেষ গুণ। এটি আসলে ঠিক কোনো গণতন্ত্র নয় কিন্তু গণতন্ত্রপূর্ব অতি প্রাথমিক শর্ত ও অবস্থা। গণতন্ত্র বলে ইসলাম যদি কোনো কিছু স্বীকার করে তাহলে এটাকেই স্বীকার করে। কিন্তু এটাকে এখন ঐতিহাসিকভাবে মূর্ত করা খুবই কঠিন। অথবা বিবদমান গণতন্ত্র দিয়ে এই অবস্থা বুঝা যাবে না। কারণ গণতন্ত্র আর এখন একাট্টা কোনো বিষয় নয়। এর নানা রূপ হাজির রয়েছে। ফরাসী, রাশিয়া ও চীনের নয়া গণতান্ত্রিকতা। এমনকি পশ্চিমের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যেও গণতন্ত্রের রকমফের রয়েছে।
তবে এর মধ্য দিয়ে একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ গড়ে তোলার নতুন তরিকা। আদি থেকেই মানুষের মনোগঠনের ভেতর জুড়ে প্রাকৃতিকভাবে এই গড়ে তোলার শক্তি কার্যকর রয়েছে নেতিবাচক কার্যকারণগুলোর বিপরীতে যা একই মুহূর্তে গোলাম আর গোলাম বানানোর নফসের মধ্যে নিহিত গণতন্ত্রের কাঠামোগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটি একটি মাপকাঠি যার দ্বারা ইতিহাসের নির্দিষ্ট বা বিশেষ গণতন্ত্র যেমন তিন হাজার বছর আগের এ্যাথেন্স থেকে বর্তমান চীনের নয়া-গণতন্ত্র পর্যন্ত ফর্মগুলোকে ভেদ করা যায়।
ইসলামের রূপকে বাদ দিয়ে এই নমুনাগুলো যদি আমরা পরখ করে দেখি তবে আমরা দেখবো যে, এটি হয় মানুষকে কিছু মৌলিক অধিকার দিয়েছে যেটা পশ্চিমা নাগরিকরা ভোগ করে। আবার হয়ত কিছু সামাজিক নিরাপত্তা দিয়েছে যেটা এখন প্রাচ্যের নাগরিকরা গ্রহণ করছে। কিন্তু ইসলাম মানুষকে দেয় এমন সব বিষয় যা এর মধ্যে নেই। ইসলাম মানব জাতিকে যা দিয়েছে সেটা তথাকথিত এই সামাজিক ও রাজনৈতিকতার সমস্ত মূল্যের অনেক উর্ধ্বে। ফলে অধিকার বলেন আর নিরাপত্তা বলেন সবচেয়ে গোড়ার কথা হলো ইসলাম মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব আকারে ঘোষণা দিয়েছে। কুরআন বলেছে-- “আমি অবশ্যই মানব সন্তানকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” বনী ইসরাইল-৭০। এইভাবে সমস্ত প্রকৃতি ও জীবজগতের মধ্যে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়া একেবারেই আলাদা। একেবারেই নতুন। আইন, বৈধতা, অধিকার ও নিরাপত্তার সাথে এর তুলনা চলে না। এগুলো থেকে এটি অনেক অনেক উর্ধ্বে। এগুলো দিয়ে মানুষকে এই শ্রেষ্ঠত্বের ভাবকে বুঝা যাবে না। পশ্চিমে “আমি” এবং “অপর”র সম্পর্র্ক যেমন গণতান্ত্রিক চিন্তার মধ্যে অন্তর্গত বিষয় তেমনি মানুষের আত্ম-প্রকৃতির মধ্যে নিহিত অনিবার্য অভিব্যক্তির মৌলিক শর্ত এই শ্রেষ্ঠত্ব। এর মধ্য দিয়ে যে গণতান্ত্রিক নমুনার অভিপ্রকাশ ঘটে তা পশ্চিমসহ অপরাপর গণতান্ত্রিক নমুনাগুলো থেকে আলাদা। স্বতন্ত্র ও নতুন। ধর্মতত্ত্ব, মানবচিন্তা ও সামাজিক দিক সহ সকল দিক থেকেই এটি পরিগঠিত।
এখানে গণতান্ত্রিকতার মধ্যে ইসলামের চিন্তার সাথে ব্যক্তিকে নিয়ে কোনো বিরোধ নেই, ভেদ নেই। মূলত ভেদটা হলো ব্যক্তির ভাবের সাথে অর্থাৎ আমি এবং অপর নিয়ে যে মানুষের চিন্তা সেই বাস্তবতার মধ্যে। এই দুই অবস্থার মধ্যে ইসলামের মানুষ তার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নয় বরং আল্লাহর প্রতি সম্মান বহন করে। অর্থাৎ আমি বা নফস এবং অপর’র ভেদাভেদের মধ্য দিয়ে ইসলামের মানুষ এই সম্মানের তুল্যমূল্যকে উপলব্ধি করে। কারণ নেতিবাচক প্রবণতা ও কার্যকারণগুলো ঐ গণতান্ত্রিক চিন্তার জন্য নির্ধারিত যা ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফলে এই প্রাকৃতিকতা একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলাম এই সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিকেই মানুষের মধ্যে পরিগঠন করে। এই পরিগঠন কার্যকর থাকে ডান-বাম উভয় দিক থেকে। যাতে সে গোলাম হওয়া এবং গোলাম বানানোর এই দুই নরকের মধ্যে পড়তে না পারে। এই দুই দিকের প্রতিই কুরআন সচেতন করেছে। কুরআন বলেছে-- “এই পরকাল আমি তাদের জন্য নির্ধারণ করি যার যাকে আমরা নির্ধারণ করেছি ঐ সকল লোকদের জন্য যারা পৃথিবীতে চায় না উদ্ধত্য প্রকাশ করতে এবং ফাসাদ সৃষ্টি করতে। আর শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীনদের জন্যই।” কাসাস-৮৩।
তাহলে এর দুটি কিনারা আছে-- একটি গোলাম হওয়ার কিনারা আরেকটি হলো গোলাম বানানোর কিনারা। এই দুই কিনারা থেকেই ইসলাম নিজেকে রক্ষা করে। যেমন কুরআনে রয়েছে--
মোটকথা, একজন মুসলিম গণতান্ত্রিক চিন্তার নেতিবাচক প্রবণতাগুলো থেকে সংরক্ষিত। এই প্রবণতাগুলো মানুষের দেহ মনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে নিহিত রয়েছে। আল্লাহ মানুষের মধ্যে যে পবিত্র মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অস্তিত্বমান করে দিয়েছেন তার ডান ও বাম দিক থেকে চিহ্নসমস্ত তিনি জারিত রেখেছেন। এর মধ্য দিয়েই তার পথ প্রক্রিয়া পরিস্কার হয়ে ওঠে। যাতে করে এই দুই কিনারা অর্থাৎ গোলাম ও গোলাম বানাবার মুশকিলের মধ্যে সে পড়তে না পারে।
ফলে গণতন্ত্রের নেতিবাচকতার উপর প্রবল হয়ে উঠতে সক্ষম ইতিবাচক চিন্তাগুলো। যেটি তার সত্তার মধ্যে মুসলিম আকারে সহজাতভাবে গড়ে উঠেছে। তাহলে যে গণতন্ত্র আদ্যকাল থেকে মুসলমানের সত্তার ভেতরে প্রাকৃতিকভাবে রোপিত আছে সেটা বুঝা অবশ্যই জরুরি।
যেমন, চীনা জাতিতে নতুন গণতন্ত্রের যে ভাষা তার তাৎপর্য নয়া আইন, নয়া প্রযুক্তি, নয়া পদ্ধতির ভাব প্রকাশ করার আগে প্রাথমিকভাবে এটি ছিলো মানুষের নতুন কাঠামো পরিগঠনের। অর্থাৎ “এর উদ্দেশ্য বস্তু জগতকে গুরুত্ব দেয়ার আগেই প্রথমেই তারা গুরুত্ব দেয় ব্যক্তি জগতকে।”
উপরের আলোচনা মতে আমরা যখন গণতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে বুঝার চেষ্টা করবো তখন দেখবো এটি প্রথমেই মানুষের জীবিকার শর্ত নিশ্চিত করে এবং একই সঙ্গে এটি মানুষকে গণতান্ত্রিক চিন্তার নেতিবাচক যাবতীয় প্রবণতা এবং মানুষের মধ্যে এই প্রবণতাগুলোর যে বয়ান তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধপরায়ন করে তোলে। ধর্মনিরপেক্ষজাত বা ইহজাগতিকতানির্ভর গণতন্ত্র প্রথমেই মানুষকে আইন, অধিকার, নিরাপত্তা ও শান্তির কথা বলে। কিন্তু এর মধ্যেই সে মানুষকে দুটি বিষয়ের সামনে রেখে দেয়। হয় মানুষ কিছু সুনির্দিষ্ট উপকারিতার জন্য ও কিছু বিশেষ ধরনের সুযোগ সুবিধার জন্য নানা কুমন্ত্রণা, প্ররোচনা বা ষড়যন্ত্রের বিসর্জনের বস্তু হয়ে ওঠে। কিংবা হয়তো একটি একনায়কতান্ত্রিক শ্রেণীর চাপ ও শাসনের অধীনে নির্ধারণ করে দেয় মানুষকে।
কারণ গোলাম ও গোলাম হওয়ার শর্ত ও উপাদানগুলো তার মধ্যে হাজির থাকতে পারে না। কারণ মননশীলতা, বিবেক বা মনোজগতের পরিবর্তন না হলে কোনো বাস্তব পরিবর্তনই চিন্তা করা যায় না। যেমন, আল্লাহ বলেন-- “আল্লাহ কোনো জাতির কোনো কিছুই পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না সে জাতি তাদের নিজেদের পরিবর্তন করে।” আর রা’আদ-- ১৩।
আমরা গণতন্ত্র এবং ইসলামের মধ্যে নানারকম সম্পর্ক খুঁজতে যেমন অভ্যস্ত কিন্তু এদুয়ের মধ্যে ফারাকটা খুঁজতেও তেমনি অনভ্যস্ত। আমরা যখন কোনো তৈরি করা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সংবিধান কোনো বিশেষ দেশ থেকে ধার করি তখন কিন্তু আমরা অধিকাংশরাই সেই ভুলটিই বারবার করি। অথচ আমাদের ধার করা বা গ্রহণ করা সেই গণতান্ত্রিক সংবিধানের সাথে সাথে এর নিজস্ব ভিত্তি বা ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাগুলো প্রকৃতপক্ষেই আমরা নিতে পারবো না যেগুলো এর জন্মভূমিতে বিকশিত হয়েছে বা লিখিত হয়েছে।
আমাদের আরো একটি প্রশ্ন করা উচিৎ-- কিভাবে আমরা প্রতিফলিত করি গণতন্ত্রের চিত্র, যেটাকে আমরা মানুষের মননে এবং অন্তর্জগতে ব্যক্ত করি। কিভাবে আমরা এটাকে আত্মীকৃত করি অনুভূতির বাস্তবতায়। ব্যক্তি এবং সাধারণ্যের মধ্যে। ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের আওতায়? আসলে এগুলোই তার গঠনগত দিক। লক্ষ করার বিষয় হলো যে, এর মেনে নেয়ার দিকগুলো দ্বীনী ভাষার দিক থেকে নয় বরং আজকের মুসলমানদের বাস্তব অবস্থার দিক থেকে উঠে আসা উচিত।
তবে এইভাবে লক্ষ করার মধ্যে একটা গঠনগত মূল্য আছে। কারণ আমরা যখন এ্যাথেন্সকে পাঠ করবো তখন আমরা দেখবো-- প্লেটোর যে বৈশিষ্টসূচক গণতন্ত্র তার কোনো আওতার মধ্যেই আজকের গ্র্রীক প্রজন্ম নেই। কিন্তু এই মূল্যবোধগুলো হারিয়ে গেছে। কারণ গ্রীক জাতির উত্তরাধিকারী আজকের প্রজন্মের বাস্তবতায় এই মেনে নেয়ার দিকগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তাহলে ইসলামে গণতন্ত্রের বিবেচনা করতে কোনো সমস্যা নেই। তবে যে দেশকালে ইসলামী প্রথা-সংস্কৃতি নিষিদ্ধ সেখানে ইসলামে গণতন্ত্রের উপলব্ধি সম্ভব নয়। বিবেচনাও সম্ভব নয়। ইসলামী সংস্কৃতি বলতে এখানে নবীর যুগের কথা বলছি।
গণতন্ত্রের ইসলামী ধারণার কতগুলো আদি ও মৌলিক ভূমিকা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয় হলো দাস। এথেন্সের সামাজিক গঠন প্রক্রিয়ারই অন্তর্ভূক্ত ছিলো এই দাস প্রক্রিয়া। অথচ কোনো সমাধান নাই তার গণতন্ত্রে।
আমরা জানি এ্যাথেন্স দাস বিষয়টিকে স্বার্থ সুবিধার জায়গা থেকে গুরুত্ব দিয়েছে। এর বেশি কিছু নয়। মানে এথেন্সে এটি ছিলো একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু মানুষকে মুক্তির কোনো প্রক্রিয়া তার ব্যবস্থার মধ্যে ছিলো না। কিন্তু ইসলাম এটাকে তার একটি মৌলিক জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ইসলাম মানুষকে দাস প্রথা থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া হিশেবে এটি গ্রহণ করে। এবং তার বিবেচনা-- এটা হবে পর্যায়ক্রমিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। যেমন কুরআনের বলেছে-- প্রকৃতপক্ষে আমি তাকে দুটি পথ দেখিয়েছি। কিন্তু সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন কি সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে দাসমুক্তি। আল বালাদ-- ১০-১৩
আর এটা হলো পর্যায়ক্রমিক মুক্তির প্রক্রিয়ার ব্যাপার। কুরআনের এর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিলো এমন-- যেমন কুরআন বলেছে-- “নিশ্চয়ই যাকাত হলো, শুধু ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের হক এবং দাসমুক্তির জন্য। ঋণগ্রস্থদের জন্য।” আত তাওবাহ-- ৬০।
হযরত কিন্তু এ বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য একটি বক্তব্য তুলে ধরবো। তিনি বলেছেন-- আমার বন্ধু জিবরীল দাসের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের আদেশ দিয়েছেন। আসলে আমার বিশ্বাস হলো-- মানুষকে দাস বানানো যায় না। তাকে ব্যবহার করা যায় না।” তিনি আরো বলেছেন-- “আল্লাহ প্রত্যেক ধনী মুসলিমদের সম্পদ থেকে একটি অংশ কেটে রাখেন আর সেই অংশটি হলো গরিবদের অংশ। কারণ গরিবরা ক্ষুধার্ত এবং বস্ত্রহীন হয় ধনীদের কারণেই।”
আসলে এ পর্যন্ত আলোচনাগুলো থেকে একটি সাধারণ এবং সামগ্রিক বক্তব্য উঠে আসে। মূল কথা হলো, এটি কোনো বিশেষ সময়ের দাস প্রথা থেকে মানুষকে মুক্তি বুঝায় না। মূলত দাসত্বের যাবতীয় চর্চা এবং শর্ত থেকে মানুষকে মুক্ত করাই তার অবস্থান। আর এর মধ্যেই ইসলামের গণতান্ত্রিক বিষয়টির তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। অর্থাৎ দাসত্বের সকল ঐতিহাসিক রূপকে ক্রমাগত অতিক্রম করে মুক্ত ও স্বাধীন মানুষে পরিণত করাই হলো ইসলামের ঐতিহাসিক এবং ঈমানী কর্তব্য।
“হে মানব জাতি! তোমাদের রব এক। তোমাদের পিতা এক। তোমরা সকলেই আদমের। এবং আদম মাটি থেকে। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যে সবচে বেশি তাকওয়াবান সেই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত, শ্রেষ্ঠ। অনারবের উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার উপর কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং কালোর উপর সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতেই।”
তাহলে ইসলামে যদি কোনো গণতন্ত্র থাকে, এটাই ইসলামের গণতন্ত্র এবং এটিই ইসলামে গণতন্ত্রের দর্শন।