জম্মু গণহত্যা: স্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া ইতিহাস


কাশ্মীর সমস্যা, কাশ্মীরিদের উপর নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সময় আবশ্যিকভাবেই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা ও বিতাড়নের প্রসঙ্গ উঠে আসে। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর চলা নির্যাতন এবং কাশ্মীর থেকে তাঁদের বিতাড়ন অবশ্যই ঘৃণিত ও চরম নিন্দনীয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে সংঘটিত লক্ষ গুণ ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যার নৃশংসতা ইতিহাসের আড়ালেই রয়ে যায়, রেখে দেওয়া হয়।

পেক্টা সান্ট সারভেন্ডা (Pacta Sunt Servanda) হল আন্তর্জাতিক দেওয়ানি আইনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতি। ল্যাটিন ভাষায় লিখিত বাক্যটির মর্মার্থ হল, দুটি পক্ষ একে অপরের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হলে, উভয়পক্ষই চুক্তির শর্তাবলী শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলবে। চুক্তির শর্তাবলী ভঙ্গ করলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং উভয়পক্ষের অবস্থান চুক্তির আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।

কাশ্মীর সমস্যা, আর্টিকেল 370 এবং 35A ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা, নানা তর্কবিতর্কের পরেও একথা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও সত্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পরে ঘটনাবহুল পরিস্থিতির পর্যায়ক্রমে প্রিন্সলি স্টেট কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং শর্তসাপেক্ষে 'ইন্সট্রুমেন্ট অফ একসেশন' সাক্ষর করে কাশ্মীরকে ভারতের সাথে যুক্ত করেন। অর্থাৎ কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের চুক্তি হয় এবং কাশ্মীর শর্তসাপেক্ষে চুক্তির ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়।

বর্তমানে ধারা 35A এবং 370 বাতিলের ফলে ভারত এবং কাশ্মীরের মধ্যে চুক্তি যেহেতু লঙ্ঘিত হয়েছে, সেহেতু ল অফ কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী পরিস্থিতি ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশনের আগের মুহূর্তে ফিরে যাবে। অর্থাৎ চুক্তি লঙ্ঘনের পরে আইন অনুযায়ী কাশ্মীর স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কথা। ধারা 35A এবং 370 বাতিলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ভারতের সুপ্রিমকোর্টে একাধিক মামলা হয়েছে। রায় বেরলে বোঝা যাবে সে সব মামলার সারবত্তা।

যাই হোক, এই নিবন্ধে আলোচনার মূল বিষয় হল- জম্মুতে বীভৎস মুসলিম গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূলকরণ যা খুবই কম চর্চিত হয়েছে বা চর্চিত হয়নি। অথচ এ নিয়ে অনেক তথ্য আছে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। রয়েছে ঐতিহাসিক দলিল।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পরে 'জম্মু ছিল হিন্দু অধ্যুষিত, কাশ্মীর ছিল মুসলিম অধ্যুষিত'- নিখাদ অসত্য এই প্রোপাগাণ্ডা বহুলভাবে প্রচারিত হয়ে থাকে। জম্মু এবং কাশ্মীর কোনো প্রদেশই হিন্দু অধ্যুষিত ছিল না, দুটোই ছিল প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত। সুপ্রিমকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী এ জি নুরানি তাঁর 'The Kashmir Dispute, 1947-2012' বইতে জহরলাল নেহেরু কর্তৃক লর্ড মাউন্টব্যাটনকে লেখা একটি চিঠির সূত্র উল্লেখ করে বলেন, জম্মুর মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৬১ শতাংশ। জম্মুর তৎকালীন ৬১ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা বর্তমানে ৩৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এর কারণ আসলগুলি কী কী? ইতিহাসের আলোকে সঠিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিপুল পরিমাণে জনসংখ্যা হ্রাসের পিছনে রয়েছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংঘটিত ভয়ানক মুসলিম গণহত্যা ও বিতাড়ন । কাশ্মীর সমস্যা, কাশ্মীরিদের উপর নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সময় আবশ্যিকভাবেই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা ও বিতাড়নের প্রসঙ্গ উঠে আসে। ১৯৯০ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর চলা নির্যাতন এবং কাশ্মীর থেকে তাদের বিতাড়ন অবশ্যই ঘৃণিত ও চরম নিন্দনীয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে সংঘটিত লক্ষগুণ ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যার নৃশংসতা ইতিহাসের আড়ালেই রয়ে যায়, রেখে দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ জম্মুতে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, সে সব নিয়ে জানতে গেলে এবং নিহত মুসলমানদের পরিসংখ্যান জানতে হলে তৎকালীন ব্রিটিশ সাংবাদিক, ব্রিটিশ পত্রিকাগুলির দ্বারস্থ হতে হয়।

• ১৯৪৭ সালের ১৬ই জানুয়ারি হোরাস আলেক্সান্ডার ব্রিটিশ পত্রিকা 'The Spectator'-এ উল্লেখ করেন, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে নিহত মুসলিমের সংখ্যা ২ লক্ষেরও বেশি।

• ১৯৪৮ সালের ১০ই আগস্ট বৃটিশ দৈনিক পত্রিকা 'The London Times'-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জম্মুতে কমপক্ষে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার মুসলিমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

• ‘The Statesman’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক ইয়ান স্টেফেনস তাঁর 'Horned Moon' বইতেও জম্মুতে ২লক্ষের বেশি মুসলিম নিধনের পরিসংখ্যান উল্লেখ করেছেন।

ব্রিটিশ সাংবাদিকদের লেখালেখিতে উল্লেখিত পরিসংখ্যান থেকে একথা পরিষ্কার যে, জম্মুতে অন্ততপক্ষে ২ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজারের কাছাকাছি মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশ সাংবাদিক ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী জম্মুর সাংবাদিক বেদ ভাসিন এবং অল্পকিছু সাংবাদিক জম্মু গণহত্যা নিয়ে সোচ্চার হন, লেখালেখি করেন। অবশ্য এজন্য বেদ ভাসিনকে গ্রেপ্তারের হুমকিও দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হল, এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কারা ছিলেন?

স্বাধীনতা অর্জনের পরেপরেই অন্যান্য অধিকাংশ প্রিন্সলি স্টেটের মতো কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেয়নি বলে অনেকেই কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং-কে স্বাধীনচেতা মহান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অথচ মহারাজা হরি সিং ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী এবং জম্মু গণহত্যার অন্যতম প্রধান নায়ক। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতেই তিনি ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেননি। ক্ষমতা সুনিশ্চিত করতে তিনি তার ডোগরা সেনাদের দিয়ে নির্বিচারে মুসলিম গণহত্যা চালিয়েছিলেন। জম্মুতে সংঘটিত মুসলিম গণহত্যার জন্য মহারাজা হরি সিং-কে দায়ী করে ১৯৪৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর মহাত্মা গান্ধী বলেন,

“ জম্মু এবং জম্মুর বাইরে থেকে আসা হিন্দু ও শিখরা নির্বিচারে জম্মুর মুসলিমদের হত্যা করেছে। মুসলিম নারীদের অসম্মান করেছে। এজন্য দায়ী মূলত মহারাজা হরি সিং।”

মহারাজা হরি সিং আশঙ্কা করেছিলেন, কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় ভবিষ্যতে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হতে পারেন। সেজন্য তিনি যেনতেনপ্রকারেণ অন্ততপক্ষে জম্মুকে কুক্ষিগত রাখতেই এই নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিলেন এবং জাতিগত নির্মূলকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ‘Being the Other: The Muslim in India’ বইতে লেখক সাঈয়েদ নাকভি ১৯৪৯ সালের ১৭ই এপ্রিল বল্লভভাই প্যাটেলকে লেখা জহরলাল নেহেরুর চিঠির সূত্র উল্লেখ করে বলেন, হরি সিং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে জম্মুকে নিজেদের অধীনে রাখতে চেয়েছিলেন, নেহেরু ও বল্লভভাই প্যাটেলকে সেকথা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন।

অন্য প্রদেশের মানুষ কাশ্মীরে জমির দখল নিতে পারবেন না, এই আইন ১৯২৬ সালে মহারাজা হরি সিং নিজেই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু কাশ্মীর স্বাধীন হওয়ার পরে তারই উদ্যোগে পরিকল্পিতভাবে পাঞ্জাব এবং সীমান্তবর্তী প্রদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ও শিখরা জম্মুতে এসে বসবাস শুরু করে। সেই সঙ্গে মহারাজা হরি সিং জম্মুর মুসলমান-প্রজাদের উপর নানাবিধ কর আরোপ করেন। করের এ হেন বোঝা চাপানো ও অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে স্থানীয় মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন৷ অন্যদিকে একইসময়ে ডোগড়া সেনা অফিসার পদ থেকে মুসলিমদের অপসারণ করা হয় এবং মুসলিম সেনাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বলা হয়। এরপর হরি সিং এর ডোগড়া বাহিনী বিক্ষোভকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওই সময় জম্মুর উধমপুর, ছেনানি, রামনগর, রিয়াসি, বাদেরওয়া, ছাম্ব, দেবা বাটালা, আখনুর, কাটুয়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় আবালবৃদ্ধবনিতা বহু মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আনুমানিক ২৭০০০ মুসলিম মহিলাকে অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে জম্মুর ১১৩টি গ্রামকে জনমানবহীন করে দেওয়া হয়। যারা বাড়িঘর ছেড়ে পাকিস্তান দখলকৃত সীমান্তের দিকে রওয়া হয়েছিলেন, তাদেরও অনেককেই ধরে ধরে হত্যা করা হয়। গণহত্যা চলাকালীন কার্ফু জারি করা হয়েছিল, তবে সেগুলি ছিল মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলির জন্য, মুসলিমদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে। অন্যদিকে হত্যাকারীরা বাধাহীনভাবে খোলা অস্ত্র হাতে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে এবং হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে।

প্রখ্যাত সাংবাদিক বেদ ভাসিন-এর মতে, জম্মুর মুসলিম নিধনে ডোগরা সেনাদের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আর এস এস) কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি এই হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সঙ্গেও আর এস এস, হিন্দু মহাসভার মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যুক্ত ছিল। এছাড়া তৎকালীন বহু কংগ্রেস নেতাও এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, পরবর্তী কালে যাঁদের কেউ কেউ মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন।

জম্মুর বৃহৎ বীভৎস হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তানি পাঠানদের জম্মু কাশ্মীর আক্রমণের পাঁচদিন এবং ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন সাক্ষরের ন'দিন আগে। সাংবাদিক বেদ ভাসিন-এর মতে, হরি সিং-এর ডোগরা সেনা, আর এস এস কর্মী, হিন্দু মহাসভার কর্মী, কংগ্রেস নেতা, পাঞ্জাব ও অন্যান্য প্রদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিন্দু এবং শিখদের যোগসাজশে জম্মুতে ব্যাপক মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালানো হলেও প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাশ্মীর প্রদেশের মুসলিমরা একজন কাশ্মীরি পণ্ডিতকেও হেনস্থা করেনি, হত্যা দূরে থাক। সেই সময়ে কাশ্মীরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল সম্পূর্ণ অটুট। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ক্ষমতালোভী মহারাজা হরি সিং-কে সঙ্গে নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবার এবং হিন্দু মহাসভা ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালিয়ে, বিতাড়ন করে জম্মুর সংখ্যাগুরু মুসলিমদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করে জম্মুতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। বর্তমানে সঙ্ঘ পরিবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাশ্মীর থেকে 35A এবং 370 তুলে দিয়ে তাদের পূর্বপরিকল্পিত, পূর্বরচিত বৃত্তই সম্পন্ন করলো কিনা সেকথা সময়ই বলবে।

তথ্যসূত্র:

1) Being the Other: The Muslim in India, by Saeed Naqvi
2) The killing field of Jammu- How muslims become a minority in the region, by Saeed Naqvi , Scroll.In
3) The Kashmir Dispute, 1947-2012 by A.G Noorani
4) Why Jammu Erupts by A.G Noorani, Frontline
5) The forgotten massacre that ignited the Kashmir dispute by Rifat Fareed, ALJAZEERA
6) The forgotten Poonch uprising of 1947 by Christopher Snedden

 ........
জিম নেওয়াজের লেখাটি Sohomon পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। লেখাটির জন্য তাঁর কাছে এবং 'সহমন'-এর কাছে কৃতিজ্ঞ।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।