১৪. করোনাভাইরাস, জীবানু মারণাস্ত্র এবং বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ
একদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে জীবন বাঁচাবার জন্য এলাকা লকড ডাউন করা, মানুষকে ঘরবন্দী বা কোয়ারান্টাইন করবার চেষ্টা, পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ ঘোষণা করা, পুলিশ হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে অভ্যাসবশত নাগরিকদের লাঠিপেটা চর্চা, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের টহল নামানো, অন্যদিকে কথা নাই বার্তা নাই পোশাক ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানগুলোর আকস্মিক ঘোষণা যে ৫ এপ্রিল (রবিবার) থেকে কারখানা খুলে দেওয়া হবে! শ্রমিকদের বৃহৎ একটি অংশ বাড়ি চলে গিয়েছিল। গাড়িঘোড়া নাই, এখন ফিরবে কি করে? পথের মাঝে অল্পকিছু ট্রাক, বাস, মোটর সাইকেল পেয়ে কেউ কেউ ফিরেছে। অধিকাংশই পায়ে হেঁটে, অমানবিক ও অমানুষিক ধকল সহ্য করে শহরে ফিরতে বাধ্য হয়েছে। প্রথমত চাকুরি হারাবার ভয়, দ্বিতীয়ত বেতন পায় নি তারা, বেতন দরকার।
গাজীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে, টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে, নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে, শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরিতে হঠাৎ করে মানুষের স্রোত। পিকআপ, ট্রাক, ভ্যানগাড়িতে বোঝাই হয়ে বাদুর ঝোলা ঝুলতে ঝুলতে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ রাজধানী ঢাকায় শ্রমিকরা ফিরেছে। কিন্তু ফিরে দেখে কারখানার তালা বন্ধ। বেতন কবে পাবে তার ঠিক নাই।
রাস্তায় রাস্তায় শ্রমিকদের উপচেপড়া ভিড় এবং গণমাধ্যমে শ্রমিকদের দূর দূর থেকে হেঁটে আসা সারা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। শ্রেণি হিশাবে পোশাক কারখানার মালিকদের অমানবিকতা এবং নিষ্ঠুরতা কারুরই নজরে এড়ায় নি। সেটা একটা দিক। অন্যদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবার যে ব্যবস্থা তারা পাকা করলেন সেটা হোল চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অদূরদর্শিতা।
না, শোরগোল করা ছাড়া কিছুই হবে না। তবুও কথা উঠেছে এর তদন্ত হওয়া উচি্ত। দেখা যাক। এ নিয়ে যথেষ্ট কথা কাটাকাটি চলছে। শ্রমিকদের ভাষ্য হচ্ছে, ৫ এপ্রিল হাজির না হলে বেতন কাটা যাবে। অনেক মালিক হুমকি দিয়েছে কাজে ফিরে না এলে চাকুরি হারাবে। মালিকের অসুবিধা নাই। বাজারে শ্রমিক সস্তায় কেনা যাবে। মজার দিক হোল মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা কারখানা মালিকদের দায় এড়িয়ে যাতে চাইছেন। তাঁদের দাবি পোশাক কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত তাঁরা মালিকদের। পোশাকশ্রমিকদের বেতন–ভাতাপ্রাপ্তির বিষয়ে সরকারের নজর আছে। সে কারণেই রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থছাড় বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শুধু শ্রমিক–কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা যাবে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পরীক্ষা সাপেক্ষে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) হিসাবের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক-কর্মচারীকে এ অর্থ দেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলে পোশাকমালিকেরা বলছেন, সব শ্রমিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই। তাই তাঁদের পক্ষে সব শ্রমিককে অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না।
খেয়াল করলে দেখব, তর্ক মূলত শহরে ভদ্রলোক শ্রেণীর ভাইরাস আতংকের ভীতিজাত তর্ক। গ্রামে যাওয়া এবং গ্রাম থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের কারনে শহরে সংক্রমণ ছড়াবে – ভীতিটা এখানে। শ্রমিক দরদীরা বলছেন, শ্রমিকরা কি মানুষ না? যেখানে সংক্রমণ থেকে নিজেকে ও অন্যদের বাঁচাতে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে সেই ক্ষেত্রে শ্রমিকদের গাদাগাদি করে কারখানায় কাজ করতে হবে কেন? তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা কে করবে?’ দ্বিতীয় তর্ক, শ্রমিকদের জীবনের জন্য দরদ, ছিঁচকে মানবিকতার। নাকের সর্দি মোছার কাজে লাগে, শ্রমিকের কোন কাজে লাগে না। কেন? সেটাই আমরা আলোচনা করব।
প্রথমত, শ্রমিক পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের নাটবল্টু কেবল। স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, মানবিক অধিকার নিয়ে অনেক বড় বড় কথাবার্তা যখন আমরা বলি তখন আমরা ভুলে যাই এই অধিকারগুলো থাকতে হলে নাগরিক ও মানবিক অধিকার সাংবিধানিক ভাবে স্বীকার এবং তার ওপর ভিত্তি করে একটি গণতান্ত্রিক ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) থাকা চাই। ‘গঠনতন্ত্র‘ থাকলেই হবে না, সেই সকল অধিকার ‘বলবৎযোগ্য’ করবার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান থাকা চাই। বলবৎযোগ্য প্রতিষ্ঠান থাকলেই হবে না, সেইসকল অধিকার বলবৎযোগ্য হচ্ছে কিনা তার জন্য উপযুক্ত বিচার ব্যবস্থা চাই। বলাবাহুল্য বাংলাদেশ তেমন কোন রাষ্ট্র না। আমাদের ‘গঠনতন্ত্র’ নাই, ‘সংবিধান’ আছে। উকিলদের করা মুসাবিদার ওপর ভিত্তি করে যে ‘সংবিধান’ লেখা হয়েছে তা বিভিন্ন সময় কাঁটাছেঁড়া করা হয়েছে। কাঁটাছেঁড়া করার পর যা দাঁড়িয়েছে তার দ্বারা ‘স্বাধীন’ ব্যক্তি হিশাবে শ্রমিককে বাংলাদেশ স্বীকার করে না। শ্রমিক কারখানা মালিকদের ‘দাস’ মাত্র। কারখানা মালিক তার শ্রমিকদের সঙ্গে কেমন ব্যাক্তিগত পর্যায়ে কি আচরণ করেন সেটা আলোচ্য নয়।‘শ্রমিক’ বাংলাদেশের সংবিধানে ও আইনে কিভাবে হাজির সেটাই আগে আমাদের বুঝতে হবে।
শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করবার অধিকারের কথাই ধরুন। কারখানার মালিক তার কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করবার জন্য দরদাম করতে পারে। শুধু তাই নয়, তাদের স্বার্থ দেখভালের জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ইত্যাদি জাতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কারখানা মালিকরা এমপি হচ্ছে, মন্ত্রী হচ্ছে, মেয়র হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার জাতীয় প্রতিষ্ঠান কই? পণ্যের মালিক হিশাবে দরদামের স্বাধীনতা কারখানার মালিকের রয়েছে। তাহলে শ্রমশক্তির মালিক হিশাবে সমষ্টিগত ভাবে দলবেঁধে শ্রমশক্তির দরদাম নিয়ে দেনদরবার করবার অধিকার শ্রমিকেরও থাকা উচিত। কারখানার মালিক যে রাষ্ট্রের, শ্রমিকও সেই রাষ্ট্রের মালিক। কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তার সেই অধিকার আইন করে হরণ করে রেখেছে। পোশাক কারখানা সহ রপ্তানিমুখী খাতের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করবার অধিকার নাই। শ্রমিককে স্রেফ দাসে পরিণত করেছে। এই পরিস্থিতি যদি আমরা বদলাতে চাই তাহলে শ্রমিকের জন্য কাঁদুনে না গেয়ে নতুন গঠনতন্ত্রের কথা ভাবা দরকার।
দ্বিতীয়ত, পুঁজি ও শ্রমের সম্পর্ক আমাদের বুঝতে হবে। এই সম্পর্ক যেন আমরা ভালভাবে বুঝি তার জন্য কার্ল মার্কসের একটু গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা আছে। সেটা হোল ‘সর্বহারা’(প্রলিতারিয়েত)। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-দার্শনিক বর্গ তথাকথিত কমিউনিস্টদের হাতে এলোপাথাড়ি অপব্যবহার এবং অপচয়ের ফলে আমরা ‘সর্বহারা’ কথাটার মানে আর ধরতে পারি না। ‘সর্বহারা’র আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে যে সবকিছু হারিয়েছে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থ আমাদের বর্গটির মর্মের ঢুকতে আপনা আপনি সহায়তা করে না। একটু ভাবতে হয়। সর্বহারার ঐতিহাসিক আবির্ভাব একটি দেশে ঘটে কারণ মানুষকে জমি থেকে, তার জীব জীবন উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের উপায় থেকে উৎখাত করা হয়েছে। জীব হিশাবে জীবন রক্ষার প্রাকৃতিক শর্ত থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। শুধু বাস্তবতা বা ইতিহাস হিশাবে বিবেচনা করলেও ‘সর্বহারা’ বর্গটির মার্কসীয় তাৎপর্য আমরা ধরতে পারব না। আরেকটি দিক বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে ‘সর্বহারা’ হালকে অস্বাভাবিক কোন অবস্থা বলে গণ্য করা হয় না। বরং মানুষের এই অবস্থাকে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার গণ্য করা হয়। উৎপাদনের উপায় থেকে শ্রমের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, বিযুক্তির ফলে সর্বহারার নিজে উৎপাদন করে বেঁচে থাকার সকল শর্তের বিনাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা না বুঝলে আমরা পুঁজি কিভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের দ্বারা শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা তা বুঝব না।
প্রশ্ন তাহলে সর্বহারার জীব-জীবন বাঁচবে কিভাবে?
তখন দলে দলে শহরে কাজের খোঁজে আসা ছাড়া ‘সর্বহারা’র আর কোন উপায় থাকে না। তারা পুঁজির জন্য শহরে ‘ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রিজার্ভ আর্মি’ বনে যায়, শহরে ভীড় করে। শহরে শহরে ঘর হারা, গৃহ হারা জমি হারা সহায় সম্বল হারা সর্বহারা মানুষের বস্তি গড়ে ওঠে, সেই বস্তি আবার মাঝে মধ্যে পুড়িয়ে দিয়ে তাদের পুঁজিপতিদের কারখানার জন্য মজুদ রাখা আর্মি’কে তটস্থ রাখা হয়।
‘ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রিজার্ভ আর্মি’ও মার্কসের পরিভাষা। 'রিজার্ভ' সবসময়ই সংখ্যায় বেশী থাকে। এদের মধ্য থেকে পুঁজিপতি শ্রমিক জোগাড় করে। স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য এরা অতিশয় কম মজুরিতে পোশাক কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়। নইলে খাবে কি? বাঁচবে কি করে? বাঁচার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে।
তাহলে ‘সর্বহারা’ হচ্ছে এমন এক পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক যার দ্বারা সর্বহারা শ্রেণী, অর্থাৎ শ্রমিককে পুঁজিপতি শুধু ‘শোষণ’ করে তা নয়। ‘নিয়ন্ত্রণ’ও করে। বাংলাদেশের পোশাক তৈরি কারখানার শ্রমিকদের চাকুরি ধরে রাখার কোন আইনী সুরক্ষাও নাই। এর আগে আমরা জর্জিও আগামবেন ও মিশেল ফুকোর আলোচনার সময় ‘নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি’ কথাটার ওপর জোর দিয়েছি। ওপরের আলোচনায় বুঝতে পারছি পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক একই সঙ্গে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তিরও সম্পর্ক। ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃংখলা বাহিনীর দ্বারা দমন নির্যাতন এই 'নিয়ন্ত্রণ' থেকে আলাদা। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক একই সঙ্গে ‘শৃংখলা ও শাস্তি’রও সম্পর্ক। মিশেল ফুকো মার্কসকে এড়াতে গিয়ে এই দিকটা ধরতে পারেন নি, কিম্বা আলোচনা করেন নি। ফুকো ও গামবেনে এই ফাঁক টুকু রয়ে চেছে।
এবার বোঝা সহজ হবে কেন ‘মজুরি’ সময়মতো দেওয়া বা নাদেওয়া হচ্ছে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিসরে শাস্তি ও শৃংখলা জারি রাখার প্রধান অস্র্ । শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় নি। কিন্তু সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোল। এরপর হঠাৎ বলা হোল কারখানা খোলা হবে। তারা জীব-জীবন রক্ষার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে মাইলের পর মেইল হেঁটে শহরে ফিরেছে। চাকুরি হারাবার ভয়ে। যদি চাকুরি যায় তাহলে সে নিজে এবং তার পরিবার কি খাবে?
একটা দিক ভাল হোল, পোশাক কারখানার মালিকদের নিষ্ঠুর, নির্মম ও অমানবিক দিক খুবই নগ্ন ভাবে ধরা পড়ল। আমাদের সর্দি লাগা মানবিক বোধ উথলে ওঠাটাও মন্দ কিছু নয়। হয়তো আমরা এখনো অমানুষ হয়ে যাই নি। কিন্তু শ্রমিক হিতৈষী ফোঁপানি কোনই কাজে আসবে না যদি না আমরা পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ, শাস্তি ও শৃংখলার দিকটি না বুঝি।