স্বাধীন সাংবাদিকতা
[এক]
আজ মে মাসের ৩ তারিখ। ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা বিশ্বব্যাপী স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চা দিবস। সংবাদপত্র যেন রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে ভয় না পায় কিম্বা মাফিয়ায়দের গোলাম না হয় সেটা মনে করিয়ে দেবার দিবস।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২১ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ খালি পেছাচ্ছে তো পেছাতেই আছে। বাংলাদেশ ২০১৯ সাল থেকে এক ধাপ করে পিছিয়েছে। দুই হাজার উনিশে বাংলাদেশের অবস্থান সূচক ছিল ১৫১, দুই হাজার একুশ সালে ১৫২। পাকিস্তান উপরে, ১৪৫; অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা উত্তম। পাকিস্তানের সঙ্গে ইন্ডিয়া্র সঙ্গে বিরাট কোন গ্যাপ নাই; মাত্র তিন কাঠি উপরে, ১৪২; অর্থাৎ একটু ভাল। বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের অবস্থা আসলেই খারাপ।
তবুও বলি, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে বাংলাদেশ খারাপ করে নাই। হন্ডূরাস উপরে থাকলেও তুরস্ক নীচে। এমনকি হায় খোদা! রুয়ান্ডা, মিশর, সৌদী আরব, চিন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া নীচে – এইসব দেশের উপরে আছে বাংলাদেশ। এখনও লাস্ট হয় নাই।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ইনডেক্স দেখে অবশ্য বাস্তবতা বোঝার কোন উপায় নাই। কারন বাংলাদেশে সংবাদপত্র এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বড় একটা অংশের সঙ্গে বাংলাদেশের মাফিয়া পরিবার ও গোষ্ঠির সম্পর্ক যারপরনাই ঘনিষ্ঠ। প্রভুদের সঙ্গে অনেক সাংবাদিকের হাস্যোজ্জ্বল ছবিও দেখলাম সম্প্রতি।
এতে বিস্মিত হবার কিছু নাই। যারা এডয়ার্ড হারম্যান ও নোয়াম চমস্কি্র ‘ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট’ (Manufacturing Consent: The Political Economy of the Mass Media) কেতাবটি পড়ে বড় হয়েছেন তারা জানেন অল্প কয়েকটি কর্পোরেশান এবং জঙ্গী মিলিটারি-ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স-এর স্বার্থের পক্ষে 'সম্মতি উৎপাদন' করে গণমাধ্যম। বড় বড় সংবাদপত্রগুলো তাদের স্বার্থই দেখভাল করে। সাধারণের বা ‘গণ’-এর স্বার্থ না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার এটাই বৈশিষ্ট্য। পুঁজির প্রান্তের দেশ হবার কারণে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম না, ব্যতিক্রম হবার সুযোগ নাই। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম উৎপাদক বা বিনিয়োগে আগ্রহী শ্রেণীকে নয়, বরং বহুজাতিক কর্পোরেশান আর ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। বাংলাদেশে পুঁজিতান্ত্রিক বিনিয়োগ ও উৎপাদন সম্পর্ক বিকাশের যারা প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। পুঁজিতন্ত্র চলে খুঁড়িয়ে, তার গতি হয় মন্থর। শ্রমিক, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ ও গরিবের জন্য যা হয়ে ওঠে দীর্ঘ ও কষ্টকর। তাদেরই রমরমা হয় যারা লুটেরা, প্রতিক্রিয়াশীল এবং দ্রুত মোটা মুনাফা কামাই বাগিয়ে নিতে আগ্রহী। সমাজে বিনিয়োগ না হবার কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা তাই দেখি অল্প কয়েকটি মাফিয়া পরিবারের হাতে দেশের অর্থনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে । লুট, ব্যাংক ডাকাতি এবং বিদেশে অর্থ পাচার নিত্য নৈমিত্তিক বা স্বভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মাফিয়া পরিবারগুলোই অধিকাংশ গণমাধ্যমের মালিক হয়ে বসেছে। এইসব গণমাধ্যমের অধিকাংশ সাংবাদিককেই আমরা নির্লজ্জ ভাবে মাফিয়া গোষ্ঠির গোলামি করতে দেখি।
এই কেতাবটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তাত্ত্বিক দিক থেকে এর গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম খুবই কার্যকর ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাওয়া, সমর্থন তৈরি এবং ‘প্রপাগাণ্ডা’চালানোর ক্ষেত্রে গণমাধ্যম খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। এটা তারা পারে কারন গণমাধ্যম এমন এক ‘প্রপাগাণ্ডা মডেল’ অনুসরণ করে যা বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং তার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
‘প্রপাগান্ডা মডেল’টা কী? সেটা হোল সবার আগে কর্পোরেট মিডিয়া হচ্ছে একটি ব্যবসা যারা তাদের পণ্য (অর্থাৎ তথাকথিত সংবাদ) বাজারে বেচাবিক্রি করতে এসেছে। এই পণ্য তারা সাধারণত দুই ধরণের ভোক্তার কাছে বেচে। প্রথমত যারা তাদের ভোগজীবী পাঠক বা শ্রোতা, দ্বিতীয়ত অন্যান্য ব্যবসায়ী, যারা গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়। ফলে ব্যবসাই কর্পোরেট গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য, কোন গুণগত মানসম্পন্ন সাংবাদিকতার করার জন্য তারা বাজারে আসে নি।
কোন সংবাদ ছাপানোর আগে গণমাধ্যম পাঁচ ধরণের ‘ফিল্টার’ বা বাছবিচার পদ্ধতি ব্যবহার করে: (১) গণমাধ্যমের মালিকের স্বার্থ, (২) গণমাধ্যমের আয় হয় যাদের কাছ থেকে তাদের স্বার্থ, অর্থাৎ বিশেষ ভাবে বিজ্ঞাপন দাতাদের স্বার্থ, (৩) সংবাদের সোর্স বা সংবাদ সরবরাহকারীর স্বার্থ, (৪) তাদের হিম্মত, অর্থাৎ কেউ সংবাদ চ্যালেঞ্জ করলে তা মোকাবিলার ক্ষমতা তাদের আছে কিনা সেটা বিবেচনা করা এবং (৫) মতাদর্শিক কারণে ঘোরতর ভাবে কমিউনিজম বিরোধিতা।
কাজের ধরণ বিচার করলে তারা তিন ভাবে এই প্রপাগান্ডা সম্পন্ন করে:
১. বাজার বা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর সওয়ার হয়ে। একই সঙ্গে তারা মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠান এটা ভহুলে গেলে চলবে না। তাই তাদের চরিত্র কর্পোরেট পুঁজি থেকে আলাদা কিছু না।
২. মতাদর্শিক ভাবে তারা যে সকল অনুমান ‘ইন্টার্নালাইজ বা আত্মস্থ করে কাজ করে যা সাধারণ ভাবে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সুনির্দিষ্ট ভাবে বহুজাতিক কর্পোরেশান এবং মিলিটারি-ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থ সুরক্ষা সম্পর্কিত অনুমান।
৩. তারা নিজেদের নিজেরাই এমন ভাবে সেন্সর করে যাতে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ কখনো বিঘ্নিত না হয়।
'জনগণের সম্মতি' ধারণা তৈরির সময় নোয়াম চমস্কি এবং এডোয়ার্ড হারম্যানও ধরে নিয়েছিলেন 'জনগণ' নামক একটা ব্যাপার আছে এবং তাদের 'সম্মতি উৎপাদ'ন ছাড়া লিবারেল গণতন্ত্রে ক্ষমতা 'বৈধ' হবে না। এই বৈওঢতা ছাড়া গণতন্ত্র কাজ করবে না। আমেরিকায় দীর্ঘকাল গণতন্ত্রের সাংবিধানিক রূপ এবং চর্চার ধারাবাহিকতা আছে।। যারা ক্ষমতায় যেতে চায় তাই তাদের সাংবিধানিক ভাবে 'বৈধতা' আদায় করতে হয়। অতএব ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণীর পক্ষে 'সম্মতি' উৎপাদন ছাড়া ক্ষমতা বৈধ হতে পারে না।
কিন্তু বাংলাদেশে জনগণের তোয়াক্কা না করলেও চলে। বাংলাদেশের জনগণের সম্মতি আদায় এখানে জরুরি না, তাই ভোট চুরি করলে কোন সমস্যা নাই। বাংলাদেশের সংবিধান নৈর্ব্যাক্তিক বা নিরপেক্ষ বৈধতা নির্ময়ের ক্ষমতা রাখে না। বিচার বিভাগ, জাতীয় সংদ একজন ব্যাক্তির ক্ষ্মতাধী। সংবিধান ইচ্ছা করলে বদলে দেওয়া যায়। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন একান্তই যাদের কাছ থেকে বৈধতা দরকার তাদের একটা বুঝ দেওয়া মাত্র। দিল্লী, ওয়াশিংটন কিম্বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছ থেকে বৈঢতা পেলেই ক্ষমতায় থাকা যায়।
এইটকু আমরা বুঝি। কিন্তু আমরা অবশ্য আরও একটু গভীরে যেতে চাই।
[দুই]
ধনির পক্ষে ‘গণ’ বা সাধারণ মানুষের সম্মতি উৎপাদন কাঠামোগত। অর্থাৎ বিদ্যমান ব্যবস্থাই সেটা উৎপাদন করে। জনগণ যেন তাদের বারোটা বাজাবার সম্মতি নিজেরাই দেয় সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করে গণমাধ্যম। বহুজাতিক কর্পোরেশান এবং মুনাফাজীবীদের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতির পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করা বা জনগণের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করাই গণ মাধ্যমের কাজ। তার মানে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা শুধু পণ্য, টাকা আর পুঁজিতান্ত্রিক কারখানায় শ্রমিক শোষণ আর বাড়তি মূল্য আত্মসাৎ করে টিকে থাকে সেটা পুরাপুরি ঠিক না। এই শোষণ যেন আমরা এনজয় করি এবং শৃংখলকে অলংকার জ্ঞান করি সেটা বিদ্যমান মতাদর্শগুলো সারাক্ষণই আমাদের বোঝায়। সংবাদ সংগ্রহ যাচাই-বাছাই শ্রেণীকরণের দ্বারা গণমাধ্যম যেমন সম্মতি আদায় করে, তেমনি করে পরিবেশনার দ্বারাও। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের শৃংখলে আমরা শৃংখলিত , কিন্তু সেই অবস্থা যেন আমরা মেনে নেই তার পক্ষে পুঁজিতান্ত্রিক মতাদর্শ কাজ করে। তারই পাশাপাশি সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিত্যদিন এটাই গণমাধ্যমের মূল কাজ। পুঁজিতান্ত্রিক শোষণ যে আমাদের জন্য ভালো – মিলিটারি-ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বিগ্রহ সবার জন্য মঙ্গল -- এটা বারবারই নানাভাবে প্রমাণ করা দরকার হয়ে পড়ে। নইলে সভ্যতা টিকবে কি করে?
বাংলাদেশে দেখেন। ‘ওয়ার অন টের’র অর্থাৎ জঙ্গী দমন আমাদের জন্য কতো ভাল এটা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি গণ মাধ্যম আদর সোহাগ অভিমান তিরস্কার করে আমাদের বোঝায়। আমাদের পিঠের ছাল মাথার খুলি হাড়মাংস বরবাদ হয়ে গেলেও এই জাহান্নামই যে আমাদের বেহেশত – এই ধর্মবিশ্বাস সতত পয়দা না করে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। আমাদের প্রাণে বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় করাই গণমাধ্যমের কাজ। ‘কাঠামোগত’ কথাটা এভাবেই বুঝতে হবে। দিল্লী, ওয়াশিংটন, লণ্ডন বা ব্রাসেলে বসে কেউ ষড়যন্ত্র করছে না। ব্যবস্থাটাই এরকম।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো এই কথাটা আরও খোলাসা করে বুঝাবার জন্য বলেছেন, আমরা যাকে ‘আমি’, ‘আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা’, সেল্ফ, ‘আত্মা’ ইত্যাদি বলি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সেই রহস্যময় জগত আর নাই। কারণ ব্যবস্থার শৃংখলা ও শাসন জারি ও মজবুত করবার জন্য বিশ্ব ব্যবস্থাই আমাদের মধ্যে নাটবল্টু ফিট করে করছে, যাকে আমরা ‘মন’ বা ‘কর্তা’ বলি। ব্যবস্থাই আমাদের মধ্যে ব্যবস্থার উপযোগী ‘মন’ উৎপাদন করে যাচ্ছে। অথচ আমরা ভাবি এই মন আমার মন, কিন্তু ‘মন’ নামক যাকে আমরা ‘আমার মন’ ভাবি সেই পদার্থ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় আর দশটা পণ্যের মতো তৈরি হওয়া একটা উৎপন্ন, ফুকোর ভাষায় Technologies of the Self। এখন আপনি আঁতেলি করতে চাইলে সময় ও ধৈর্য সহকারে দার্শনিকদের পড়তে পারেন। তবে সার কথা এটাই: আমাদের নিজের মন বলে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা কিছু অবশিষ্ট রাখে না। উৎপাদন সম্পর্ক ছাড়াও শাস্তি ও শৃংখলা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের ‘মন’ নামক জিনিসও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাই তৈয়ার করে।
কিন্তু মানুষের মন বলে কি আসলে এখন আর কিছুই নাই? আসলেই? মোটেও না, আছে। বিদ্যমান বাস্তব জগত আপনার মধ্যে যে মন তৈরি করে তার একটা সুনির্দিষ্ট নাম আছে। তার জন্য আমাদের হাতড়াতে হবে না। সেই নাম ইসলামে অর্থাৎ তার তর্কবিতর্কের ঐতিহ্যের (discursive tradition) মধ্যে আলোচিত হয়। মুশকিল হচ্ছে ইসলাম নিয়ে বাংলাদেশে কোন কথা বলা ঝুঁকিপূর্ণ, তাছাড়া অনেকের সেকুলার অভ্যাসের কারনে ইস্লামের ইতিহাস থেকে কিছু ধার নেওয়া পছন্দসই নাও হতে পারে। তবু ঝুঁকি নিয়েই বলতে হচ্ছে। উপায় নাই।
চমস্কি আর ফুকো একদিক থেকে নতুন কিছু বলছেন না। বিদ্যমান জগত বা ব্যবস্থা যে 'মন' তৈরি করে ইসলামি পরিভাষায় তার নাম ‘নাফসানিয়াত’। বিদ্যমান জগতের মধ্যে উৎপন্ন মানুষের মন-মানসিকতা ইচ্ছা অনিচ্ছা কামনা বাসনাই নাফসানিয়াত। এখানে মানুষ কর্তা না, বাইরের বাস্তবিক বা বিদ্যমান জগতই কর্তা। মানুষের মধ্যে তখন জগতের লীলা বা জীবের লীলাই প্রধান। এই শেষের কথাটা -- জীব লীলা -- মজুদ আছে বাংলার ভাবান্দোলনে। বিদ্যমান ব্যবস্থার দ্বারা উৎপন্ন মানুষ ‘জীব’ মাত্র । তাহলে জিজ্ঞাসা, মানুষ কখন জীবমাত্র না থেকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে? সেটা ঘটা শুরু হয় যখন জাগতিকতা কিম্বা জীবজগতের বাইরে মানুষ নিজেকে নিয়ে শুরু করে। ভাবতে পারাটা মানুষকে শিখতে হয় না। কিম্বা জীব বা বস্তু জগতের উর্ধে উঠে ব্যক্তি উপলব্ধি করতে শুরু করে মানুষ জন্তু-জানোয়ার না, তাকে দেখতে বানর বা হনুমানের মতো মনে হলেও এবং অন্য পরিচিত প্রাণীর মতো তার জীবের চাহিদা থাকলেও তার মধ্যে আলাদা কিছু আছে যা জীবে নাই। মানুষ জীবের মতোই প্রকৃতিতে লিপ্ত অথচ চাইলে নিজেকে প্রকৃতির বিপরীতে আলাদা করে ভাবতে পারে। এভাবে ভাবতে পারা মানুষের সহজাত। মানুষ নিজেকে ‘আমি’ বলতে পারে। অন্যকে ‘তুমি’ বলতেও পারে। এরপর মানুষ বোঝে সে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন সত্তা এবং নিজের অবস্থা সে পরিবর্তন করতে সক্ষম। সামষ্টিক ভাবেও মানুষ এইসব বিষয় টের পেতে শুরু করে। তখন মানুষ এটাও টের পেতে শুরু করে আসলেই মানুষের এমন একটা ‘মন’ আছে যা জীব জগতের অধীন নয়, সেই মনের ইচ্ছা অভিপ্রায় কামনা বাসনা বিদ্যমান জগতের জাগতিক লীলার মধ্যে শেষ হয়ে যায় না। তার সম্ভাবনা একদমই আলাদা, অতএব আলাদা ভাবেই মানুষকে বিচার করতে ও বুঝতে হবে।
এই বোধে আক্রান্ত হলে মানুষ তার ‘আমি’কে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষ আকুতি বোধ করে যে নিজেকে বিদ্যমান জাগতিকতার দ্বারা শৃংখলিত হয়ে থাকা মনুষ্যজনোচিত বা তার আসল ‘আমি’র কাজ না। মানুষ ফিকির খোঁজে। সেই মনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জগত তৈরির চেষ্টা করে। যদি বাস্তবের জগতের মধ্যে তাকে খুঁজে না পায় তখন অনাগত ভবিষ্যতে নতুন এক দুনিয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। সেই দুনিয়ার আবির্ভাব ঘটবার কথা মানুষ ভাবে। শুধু তাই নয় সেই নতুন ও অনাগত জগতের আবির্ভাব ত্বরান্বিত করবার জন্য মানুষে লড়ে, নতুন জগত কায়েম করবার জন্য মানুষ নিজের জীবন ব্যয় করে দিতে কুন্ঠা বোধ করে না। যা বিদ্যমান নাই, কিন্তু আগামিতে হাজির হবে সেই আগামির জন্য মানুষ তার জীবের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে রাজি হয়ে যায়। অনাগত ইতিহাসের জন্য শহিদ হয়ে যেতে মানুষের আর কোন ভয় থাকে না। একে বলা হয় ‘রুহানিয়াত’। বাংলার ভাবান্দোলনে একই ধারণার নাম ‘পরম’ বা আমাদের পরমার্থিক ইচ্ছা অভিপ্রায় কামনা বাসনা ইত্যাদি।
ধর্ম নিরপেক্ষ ধারণা হিশাবেও নাফসানিয়াত/রুহানিয়াত ব্যবহার করার মধ্যে আপত্তির কিছু নাই । ইরানের বিপ্লব দেখে হতভম্ব হয়ে মিশেল ফূকো মিশেল ফুকোও করেছেন (La Spiritualité politique কিম্বা ইংরেজিতে Political Spirituality) । কিভাবে মিশেল ফুকো এই ধারণা ব্যবহার করেছেন সেটা আমি আমার ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’ বইয়ে কিছুটা আলোচনা করেছি।
ইসলামের ভাবের দিক বা তার দার্শনিক আবিষ্কারের গুরুত্বপূর্ণ দিক এগুলো। এই দিকটি বুঝলে ‘জিহাদ’ কথাটার মানেও বুঝবেন। নাফসানিয়াতের স্তর থেকে জীবের নিরন্তর রুহানিয়াতের স্তরে উঠবার চেষ্টা। অধিকাংশ মানেষের জীবনই জন্তু-জানোয়ারের জীবনের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা নিজের সহজ মনুষ্য স্বভাব রক্ষার জন্য নিত্যই এই নাফসানিয়াতের বিরুদ্ধে লড়াই করে যায়, নিজের ‘মন’ সে নিত্যই নতুন করে আবিষ্কার করে। কখনো কবি, কখনও ভাবুক, কখনও শিল্পী হিশাবে মানুষ এই আবিষ্কার নিত্যই করে। কিন্তু সবাই তার বিকাশে ব্রতী হয় না । যখন এই লড়াইয়ের নিষ্ঠা কারো মধ্যে এবাদতের সমতুল্য হয়ে ওঠে, তাদের আমরা মহত হিশাবে চিনি, বুঝি।
মানুষ টের পায় নিজেকে যেভাবে সে বর্তমানে বিদ্যমান দেখছে, সেটাই তার শেষ বা একমাত্র রূপ না। এই রূপ জাগতিক বা বর্তমানের শৃংখল বা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার সম্পর্কের মধ্যে তৈরি। তখন কি কারণে আল্লা তাকে সৃষ্টি করেছেন সেই জিজ্ঞাসা তাকে অধিকার করে। কিম্বা কেন মানুষ পৃথিবীতে এলো তার তাৎপর্য মানুষ অনুসন্ধান করে। মানুষ করবেই। একই কথা ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবেও বলতে পারেন। যেমন, মানুষ নিজের অর্থ সব সময়ই নতুন করে আবিষ্কার বা নতুন করে বোঝার চেষ্টা করে। রুহানি উপলব্ধির সুবিধা হচ্ছে তা বাড়তি বাড়তি একটা শক্তি দেয় যা পুঁজিতন্ত্র বা তথাকথিত আধুনিকতা দিতে পারে না।
এমনকি সাধারন মানুষও চাইলে বুঝতে পারে মানুষকে রুহানি সম্ভাবনা দ্বারা ফিট করেই আল্লা দুনিয়ায় মানুষ পাঠিয়েছেন, এই অর্থে তাঁর খলিফার মর্যাদাও মানুষকে দিয়েছেন। ধর্মপ্রাণ মানুষ যখন জ্বিন-ফেরেশতার বিপরীতে মানুষের পক্ষে কোরানকে দলিল হিশাবে বুঝে যায়, তখন সমাজে পরিবর্তনও ঘটে দ্রুত।
আসলে মানুষ এরকমই। শয়তান ঘোরতর ভাবে মানুষ সৃষ্টিতে আপত্তি করেছিল। বলেছিল তারা দুনিয়ায় গিয়ে ঝগড়া ফ্যাসাদ করবে। আল্লা উত্তর দিলেন, আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। ফেরেশতার নিষেধ সত্ত্বেও মানুষের সৃষ্টি হয়েছে।
পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা যতোই তার আদলে আমাদের একই ছাঁচে বানাতে চেষ্টা করুক সেটা সফল হবে না। কারন কিছু মানুষ থাকবে তারা জিহাদি হবেই। বিপ্লব মানুষের স্বভাবের অন্তর্গত বা সহজাত রুহানি শক্তি বা রুহানি সম্ভাবনা। বিদ্যমান জগত মানুষের পছন্দ না হলে অনাগত ভবিষ্যতের আগমন ত্বরান্বিত করবার লক্ষ্যে শাহাদাত কবুল করতে একমাত্র মানুষই রাজি থাকে।
আলহামদুলিল্লাহ!