৪. ইসলামে কোরবানি: ‘মনের পশু তত্ত্ব’ ও খ্রিস্ট ধর্ম
সোরেন আবায়া কিয়ের্কেগার্ড (Søren Aabye Kierkegaard) বা সংক্ষেপে সোরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫) আধুনিক কালের সামনের সারির দার্শনিক। পাশ্চাত্য যখন এনলাইটমেন্টের শিখরে – অর্থাৎ জীবন ও জগতের প্রচলিত অনুমান, সংস্কার, ধারণা, প্রত্যয় প্রতিজ্ঞা সবকিছুই যখন বুদ্ধির প্রবল পরাক্রমে বিধ্বস্ত, সবকিছুই যখন সার্বভৌম বুদ্ধির সঙ্গে লড়ে পরাজিত এবং বুদ্ধির অধীনস্থ, শুধু বুদ্ধি যখন মানুষের সকল বৃত্তির সর্দার হিশাবে ঘোষিত ও প্রতিষ্ঠিত -- সেই ডামাডোলের মধ্যে তাঁর আবির্ভাব। তাঁকে পাঠের সময় একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগে। মনে হয় একজন বিশ্বাসী তাঁর বিশ্বাসকে এক প্রবল ঝড় ও তুফানের মধ্যে বুকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছেন। যুক্তি, বুদ্ধি ও মানুষের সকল বৃত্তির অতীত যে আল্লাহ তাঁকে ব্যক্তির নিজস্ব উপলব্ধির জমিনে তালাশ করেছেন। আল্লায় নিরংকুশ বিশ্বাসের মধ্যে ব্যক্তির পরমার্থ অন্বেষণ করেছেন। সে কাজ করতে গিয়ে তিনি খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলে আধুনিক কালের স্বাধীন সার্বভৌম ব্যক্তি এবং আল্লাহ উভয়ের যুগল বন্ধন আবিষ্কার করলেন। সেই উপলব্ধির সাক্ষী হয়ে দর্শনের দরবারে ফিরে এলেন রাজপুত্রের মতো। নিজের খ্রিস্টিয় বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্য লড়লেন ‘চার্চ অব ডেনমার্ক’-এর বিরুদ্ধে। ধর্ম ফিরে এল আবার দর্শনের বিষয় হয়ে। নতুন উপলব্ধির বয়ান প্রচলিত অর্থে আর ধর্মতত্ত্ব (theology) রইল না। কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনও আর পুরানা জায়গায় রইল না। এই প্রত্যাবর্তন ভিন্ন। তার রূপ আলাদা।
তিনটি ঘটনা সোরেন সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের দার্শনিক জীবনের জোয়ার ঘটিয়েছে। তাঁর জীবনী যারা লিখেছেন কিম্বা যারা তার দর্শন পর্যালোচনা করেছেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই একথা বলেন। জীবনের প্রথম ঘটনা ঘটে যখন ভালবাসার মানুষ রেজিন ওলসেনের সঙ্গে তাঁর ১৮৪১ সালে বিচ্ছেদ ঘটে। রেজিনের সঙ্গে তাঁর বাগদান হয়েছিল, অর্থাৎ বিয়ের পাকাপাকি কথাবার্তা স্থির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিয়ের্কেগার্ড নিজেই বাগদান ভেঙে দিলেন। বললেন, ‘আল্লাহ ভেটো দিয়েছেন’। ভেটো দেওয়া বা অমত প্রকাশ আল্লাহ করতেই পারেন। ব্যক্তির বিপরীতে যিনি সার্বভৌম, ব্যক্তিকে নিষেধ করবার সার্বভৌম ক্ষমতা তার আছে। বিয়ে আর হোল না। বলাবাহুল্য ‘আল্লার ভেটো দেওয়া’ বলা কিয়ের্কেগার্ডের বলবার ধরণ হয়তো, এর দ্বারা দার্শনিক হিশাবে তাঁর চরিত্রও আমরা খানিক আন্দাজ করতে পারি। কিয়ের্কেগার্ড কেন এভাবে বাগদান ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দুজনের বাস্তব জীবন থেকে তার কোন ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে পাই না। তাঁর জীবনীকাররা এতোটুকুই বলেন, তিনি হয়তো কোন মানসিক উৎকন্ঠা বা বিষাদে ভুগছিলেন। রেজিনা ছিলেন কিয়ের্কেগার্ডের চেয়ে দশ বছরের ছোট। উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত ও সুন্দরী। কিয়ের্কেগার্ড হয়তো ভেবেছেন তার দার্শনিকসুলভ স্বভাব দিয়ে তিনি রেজিনাকে সুখী করতে পারবেন না। এই উচ্ছল মেয়েটির জীবন তিনি অসুখী করে ফেলবেন। অন্যটাও হতে পারে। তিনি লেখালিখির কাজের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন, ফলে দর্শনচর্চাকে রেজিনার, কিম্বা রেজিনাকে দর্শনচর্চার সতীন বানাতে চান নি।
বিচ্ছেদের পরপরই তাঁর গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক লেখালিখি প্রকাশিত হতে থাকে। বইয়ের এক বিস্ময়কর বন্যা, ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাসের কিছু দারুণ কাজ – প্রায় এক ডজন বিভিন্ন লেখা পরবর্তী চার বছরে বেরোয়। লিখলেন ছদ্মনামে। যেন তাঁর নব্জন্ম হয়েছে; তিনি ভিন্ন কেউ, ভিন্ন কোন ব্যক্তি। পাশ্চাত্যে কিয়ের্কেগার্ডের আগে সত্যকে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টাই প্রবল ছিল। যৌক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক ধারনা হিশাবে সত্যকে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে প্রতিষ্ঠার যে ধারা চলে আসছিল কিয়ার্কেগার্ড সেই ধারার রাশ টেনে ধরলেন। দাবি করলেন সত্য হচ্ছে ব্যক্তির অস্তিত্বযাপনের একটি ধরণ। সত্য হচ্ছে ব্যক্তির একাকী ও নিঃসঙ্গ উপ্লব্ধি। এই উপলব্ধি আল্লার মুখোমখি দাঁড়িয়ে ‘ভীতসন্ত্রস্ত্র ও কাঁপুনি’র অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। একে বুদ্ধির বিষয় কিম্বা কোন দর্শনের সিস্টেম বা পদ্ধতি দিয়ে লাভ করা যায় না। তিনি খ্রিস্টিয় বিশ্বাসকে পাশ্চাত্য এনলাইলাইটমেন্ট বা বুদ্ধির সার্বভৌমত্বের বিপরীতে দাঁড় করালেন। যে সত্য নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে এবং সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধা করে না কিয়ের্কেগার্ড সেই সত্যই তাঁর দর্শনে অন্বেষণ করতে চেয়েছেন। এটা সার্বজনীন বা সামাজিক সত্যের উপলব্ধি নয়। বরং আল্লার সামনে একা ও নিঃসঙ্গ ব্যক্তির ভীতি ও কাঁপুনির সত্য। শিহরণের উপলব্ধি। এখান থেকে জাঁ পল সার্তে তাঁর অস্তিত্ববাদের মালমশলা নিয়েছেন। কিন্তু সার্তে সেটা করেছেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে, মানুষকে একদমই একা ও নিঃসঙ্গ জ্ঞান করে, নাস্তিক্যবাদের পরিমণ্ডলে। মার্টিন হেইডেগারও সত্যের এই ব্যক্তিগত উপলব্ধির গুরুত্ব মানলেন। কিন্তু আল্লাহ হেইডেগারে ব্যক্তির চিন্তায় পুরাপুরি মুছে গেল না। একটা চিহ্ন বা দাগ (trace) হয়ে রইল। খোলা মুখের মতো, অধরা যে চিহ্ন দিইয়ে আসাযাওয়া করেন। চিন্তা যতোটুকু লায়েক হতে পারে ততোটুকু ধরা দেন, কিনতি অধরা বার অধরাই থেকে যান। অর্থাৎ সত্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আল্লাকে বাদ গেলেন হেইডেগার, কিন্তু অধরা চিহ্ন হয়ে চিন্তার মধ্যে ঠিকই হাজির রইল। কিয়ের্কেগার্ডের পরে পাশ্চাত্য দর্শন বড়সড় একটা বাঁকে এসে এখন দাঁড়িয়েছে।
এ এক বৈশ্বিক মুহূর্ত। আমরা খ্রিস্টীয় চিন্তার পরিমণ্ডলের বাইরে দাঁড়িয়ে কোরানুল করিমের সুরা আস সাফফাত পাঠ ও বোঝার সূত্র অন্বেষণ করছি। তার মানে খ্রিস্টিয় ধর্মতত্ত্ব শুধু নয়, খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা পাশ্চাত্য আধুনিক দর্শন মোকাবিলার উৎস কোরানুল করিমে পাই কিনা সেই চেষ্টা করছি। চিন্তার যে বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত করেছে তাকে অতিক্রম করে যাবার সূত্র কোরানুল করিমে পাই কিনা সেই চেষ্টা করছি -- পাশ্চাত্য দর্শনের বিশাল দিগন্ত মোকাবিলার তৌফিক অর্জনের চেষ্টা করছি। সে কারনে কোরানুল করিমের জায়গা থেকে আল্লার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত একা ও নিঃসঙ্গ ব্যক্তির উপলব্ধির সত্যে আমরা আগ্রহী। এই উপলব্ধি খ্রিস্টিয়। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্য বুর্জোয়া ব্যক্তি চেতনায় মধ্য দিইয়ে এর চরম উৎকর্ষ ও বিকাশ। অতএব আমরা বুঝতে ও পর্যালোচনা করতে চাই খ্রিস্টীয় চেতনা, উপলব্ধি ও দর্শনের বিচারের পাশাপাশি ইসলামে এই শিহরণের তাৎপর্য কী? স্বাতন্ত্র্য কোথায়? ইসলাম কোথায় ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্ম থেকে আলাদা? ইসলামের ‘ঈমান’ কিভাবে ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মের ‘বিশ্বাস’ বা ব্যক্তির উপলব্ধি থেকে আলাদা? তাই সোরেন কিয়ের্কেগার্ডে আমাদের বিশেষ আগ্রহ। আমরা পাশ্চাত্যের আরও কয়েকজন দার্শনিক নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা আমাদের আছে। তবে এখন ইব্রাহিম (আ)-এর কোরবানি নিয়ে সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভীতি ও কাঁপুনি’ আমাদের মুখ্য আলোচনার বিষয়। মূল গ্রন্থ পাঠের আগে সংক্ষেপে তার চিন্তার কিছু সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছি। যেন কিয়ের্কেগার্ড পাঠের আগ্রহ কেন আমাদের হোল সেটা শুরুতে বোঝাতে পারি।
কিয়ের্কগার্ড আমাদের বোঝালেন একা, নিঃসঙ্গ বা 'একক ব্যক্তি' গুরুত্বপূর্ণ। সত্যের উপলব্ধির অর্থ আল্লার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ ব্যক্তির ভীতি ও কাঁপুনির মধ্য দিয়ে উপলব্ধি। এটা বুদ্ধির বিচার নয়। কিম্বা কান্ট বা হেগেলের মতো কোন দার্শনিক সিস্টেমের মামলা নয়। কিয়ের্কেগার্ড ব্যক্তির ‘বিশ্বাস’কে পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্ট বা বুদ্ধির একচ্ছত্র খবরদারির বিপরীতে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনায় হাজির করলেন। বিশ্বাস এমনই যে এক ব্যক্তির বিশ্বাসের জায়গায় মনুষ্য প্রজাতির অন্য কোন সদস্যের বিশ্বাস প্রতিস্থাপন করা যায় না। আমার বিশ্বাস আমি অন্য কারো ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না। অন্য কোন ব্যক্তি তার বিশ্বাস বা উপলব্ধিও আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ‘বিশ্বাস’ বাজারে বেচাকেনার বস্তু না। যেটা গির্জা সচরাচর যা করে থাকে।
দেখা যাচ্ছে মুক্ত ও স্বাধীন ‘ব্যক্তি’কেই কিয়ের্কেগার্ড প্রতিষ্ঠিত করছেন, কিন্তু এই ব্যক্তি আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিতন্ত্র না। বুর্জোয়া বা আধুনিক ব্যক্তি -- পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্যে যার উৎপত্তি, বৃদ্ধি ও বিকাশ- সেই ব্যক্তি আল্লার সামনে একাকী হাজির হয়ে ভীত, কম্পিত ও শিহরিত হবার ক্ষমতা হারিয়েছে। ভীতি, কম্পন কিম্বা শিহরণের মানে সে আর ধরতে পারে না। যদি সে নাস্তিক হয়ে থাকে তবে সেই শিহরণের মর্ম বোঝা তার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। বিশ্বাসের সত্য কী বস্তু সেটা বোঝার হৃদয় সে শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। যে আল্লাহকে হারিয়ে ফেলেছে, তার পক্ষে ভীতি ও কাঁপুনির মধ্য দিয়ে সত্যের এই বিশেষ উপলব্ধি সম্ভব না। কিয়ের্কেগার্ডের দাবি এই ভীতি ও কাঁপুনি ইব্রাহিম (আ)-এর। সেই ইব্রাহিম(আ) যখন তাঁর আপন সন্তানকে কোরবানি করতে তিনদিন হেঁটে পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই ইব্রাহিম(আ) তাই তার চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছিল।
কিয়ের্কেগার্ডের ব্যক্তি নিঃসঙ্গ ও একা বটে, কিন্তু একই সঙ্গে দুইজন: ব্যক্তি নিজে এবং তার আল্লাহ। উভয়েই দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। ইব্রাহিম (আ)-এর কোরবানির ঘটনার মধ্য দিয়ে এই সম্বন্ধ উভয়ের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। ইহুদি ও খ্রিস্টিয় ধর্মীয় পরিভাষায় একে বলা ‘আকিদা’ গিঁট বা বন্ধন। ইংরেজিতে binding। বাইবেল অনুসারে ইব্রাহিম (আ) ইসহাককে দড়ি দিয়ে বেঁধে আল্লার হুকুমে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। আকিদা হচ্ছে সেই দড়ির বন্ধন আল্লার আনুগত্য প্রমাণ করতে গিয়ে ইব্রাহিম (আ) সন্তানকে যে ভাবে বাঁধে, কিন্তু আল্লাহ সেই সন্তানকে আবার পিতার কাছেই ফিরিয়ে দেন। সন্তান কোরবানি না হয়ে আল্লার হুকুমে হাজির হয় ভেড়া।
বলা বাহুল্য ইসলাম মোহাম্মদ (সা)-এর আগে আসা সকল নবী রসুল ও পথ প্রদর্শকদের মান্য করে। ফলে ‘আকিদা’ ইসলামেরও পরিভাষা। কিন্তু বাইবেলের গল্প আর কোরানের গল্প এক না। এতে পরিষ্কার প্রাক-ইসলামি আকিদার সঙ্গে ইসলামের পার্থক্য আছে। সেটা বুঝতে হলে অবশ্যই আমাদের কোরবানি সম্পর্কে বাইবেলের বয়ান এবং কোরানুল করিমের বয়ানের বিশাল ফারাক মনে রাখতে হবে। সেই পার্থক্য নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। ইসলামের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের মূল আলোচনায় আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করব ইনশাল্লাহ।
পাশ্চাত্যের চিন্তার ইতিহাসে এই যুগল উপলব্ধি -- ভীতি ও কাঁপুনির মর্ম খুঁজলে আমরা কিয়ের্কেগার্ডের আগে অগাস্টিন (৩৫৪ - ৪৩০), ব্লেইস পাস্কাল (১৬২৩ – ১৬৬২) এবং মার্টিন লুথার(১৪৮৩ -১৫৪৬)-এর কাছেও কাছে যেতে পারি। সন্তানকে ইব্রাহিম (আ) পাহাড়ে নিয়ে যাচ্ছেন তারা বিভিন্ন ভাবে সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। কিয়ের্কেগার্ড তাঁর লেখায় বারবার সেই দৃশ্যের কাছে ফিরে এসেছেন। ব্যক্তির অস্তিত্ব যাপনের সত্য হিশাবে আল্লার সামনে একাকী ও নিঃসঙ্গ ব্যক্তির ভীতি, কাঁপুনি, শিহরণের অভিজ্ঞতা ইসলামের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের মধ্যে বিপুল পরিমানে রয়েছে। সুফি ও দরবেশদের জীবন যাপন এবং আল্লার সঙ্গে নিত্যসম্বন্ধ চর্চার মধ্যে সেই শিহরণ বা সুফি পরিভাষায় ‘ফানা ফিল্লাহ’ নানাভাবে ব্যক্ত। বাংলার ভক্তি আন্দোলনের মধ্যেও তার প্রবল উপস্থিতি আমরা দেখি। কৃষ্ণ প্রেমে চৈতন্যের ঘন ঘন মূর্ছা যাওয়ার ঘটনাও আমরা জানি। বলা বাহুল্য তাদের মিল থাকলেও একই সঙ্গে তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য রয়েছে। প্রত্যেক উপলব্ধির ঐতিহাসিক রূপ আলাদা। তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য বুঝতে হলে তাদের স্থানকালপাত্র ভেদের বিচার করতে হবে। কিয়ের্কেগার্ডে আমাদের বিশেষ আগ্রহের কারণ হচ্ছে তিনি আধুনিক পাশ্চাত্যের অন্দরমহলে বসে ‘বিশ্বাস’-এর জমিন নিয়ে কথা তুলেছেন। বিশ্বাসের জায়গা থেকে পাশ্চাত্যের বৌদ্ধিক বা দার্শনিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছেন। কিয়ের্কেগার্ড আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মানুষের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের যে ‘কর্তা’ তাকে এতো পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ভাবে আমাদের সামনে কোন দার্শনিক এর আগে হাজির করতে পারেন নি।
আমরা যখন ‘মানুষ’ বলি, দর্শনের দিক থেকে ধারণা হিশাবে সেই মানুষ হচ্ছে সামান্য (universal)। অর্থাৎ আমরা বিভিন্ন নামে বা চিহ্নে বহু মানুষ আছি। কিন্তু ব্যক্তি তখন ‘বিশেষ’ (particular), অর্থাৎ সামান্যের মুহূর্ত, উদাহরণ, নজির বা প্রকাশ মাত্র। এই ক্ষেত্রে ‘বিশেষ’ সর্বদাই সামান্যের অধীন। সামান্যের অধীনে না এনে আমরা বিশেষকে ব্যক্ত বা প্রকাশ করতে পারি না। যখন বলি রহিম একজন মানুষ। তখন রহিম ‘বিশেষ’। তাকে ‘মানুষ’ নামক সামান্য ধারণার অধীনে আমরা প্রকাশ করি। সামান্য ও বিশেষের এই প্রকাশ-কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তি গৌণ, ‘মানুষ’-ই আসল। ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ব্যক্তি সবসময়ই ধর্ম যেভাবে ‘মানুষ’ নামক সামান্য ধারণাকে আগাম নির্ণয় করে তার অধীন। সেই ধারণার বাইরে যাওয়ার অর্থ পড়ে যাওয়া, পতিত হওয়া। ধর্মতত্ত্ব এই কথা মেটাফোর বা প্রতীকী কায়দায় বলে। বেহেশত থকা মানুষের পতন বা নির্ভাসন হিশাবে তার আলোচনা চলে। যখন সে আদম বা বিশেষ মানুষ, তখন সে পতিত, বেহেশত থেকে নির্বাসিত। তাকে আবার আল্লার দয়া পেয়ে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে হবে। আল্লার ক্ষমা পেয়ে বেহেশতে প্রত্যাবর্তনই মনুষ্য জীবনে তার সাধনা।
কিয়ের্কেগার্ড এই সম্পর্কটা উলটে দিলেন। তিনি যে ব্যক্তির কথা বলছেন সে বেহেশত থেকে নির্বাসিত ব্যক্তি নয়, কারণ সে সবসময়ই দোজখ ও বেহেশতের মাঝখানে কম্পমান। এই হাল ব্যক্তির শিখর বা শীর্ষ। আল্লার সম্মুখে ব্যক্তি পতিত কেউ নয়, এখানে ব্যক্তির কোন পতন নাই। কারন ব্যক্তি কখনই আল্লার প্রতি আনুগতের সম্পর্কে থেকে ছিন্ন নয়। ব্যক্তির ফয়সালা খোদ খোদাতা’লার সঙ্গে। এই ব্যক্তি অনেকের মধ্যে একজন নিঃসঙ্গ ব্যক্তি বা একাকী কেউ না। বরং আল্লার প্রতি নিরংকুশ আনুগত্যের অধীনে ভীত ও আতংকিত দিব্য পুরুষ। বিশ্বাসের চূড়ান্ত রূপ আল্লাহ ইব্রাহিম (আ)-কে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাইবেলের গল্পে জানিয়ে দিয়েছেন ‘বিশ্বাস’ বলতে আল্লাহ কি বোঝেন। যারা নিজেদের মিল্লাতে ইব্রাহিমের অন্তর্গত গণ্য করেন তাহলে অবশ্যই তাদের ইব্রাহিম (আ)-এর এই দিব্যরূপের খবর নেওয়া দরকার। ব্যক্তি একদিকে স্বাধীন, অন্যদিকে আল্লার কাছে দায়বদ্ধ। তাকে নিত্যই আল্লার কাছে আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হয়। একেই আমরা ধার্মিকতা বা ভক্তি (piety) বলে থাকি। ইব্রাহিম (আ) চূড়ান্ত ও শর্তহীন আনুগত্যের অপরিবর্তনীয় আদি রূপ (archetype)।
কিয়ের্কেগার্ডে লেখালিখির দ্বিতীয় জোয়ার এসেছিল ১৮৪৬ সালে। এর আগে তিনি লেখালিখিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন লেখালিখি বন্ধ করবার জন্য আগে আল্লাহ যে ‘ভেটো দিয়েছিলেন তা শেষ হয়েছে। লিখবার জন্য তিনি আবার ‘ডাক’ শুনছেন। লেখালিখি ছেড়ে এর আগে যাজকের চাকরি নেবেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন;ধর্মতত্ত্বে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল। কিন্তু তিনি ১৮৪৬ সালে একটি ডেনমার্কের স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘দ্য করসায়ার’-এর সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। এই পত্রিকাটি তার বিরুদ্ধে বিকট ঠাট্টা তামাশা ও বিদ্রুপ শুরু করল। হাস্যকর কার্টুন ছেপে তাঁকে নাস্তানাবুদ করল। তিনি কুঁজো ছিলেন কিছুটা। তাঁর শরীর নিয়ে পত্রিকার কার্টুন ছিল নির্দয়। তার পাজামা একটির আরেকটির দৈর্ঘে অসম, তাকে হাজির করা হোত অদ্ভূত জীব হিশাবে, ইত্যাদি।। তার মনে হোল যদি তিনি একজন লেখক হিসাবে তার লেখালিখির জীবন ছেড়ে দেন তার মানে দাঁড়াবে অভিজাত শ্রেণীর পত্রিকাটির মতো গাল-গল্প-গুজব-হাসিতামাশার চরিত্র হয়েই তিনি খ্যাত থাকবেন। তাঁর এই নিয়তি হোক তিনি চান ন। এরপর আবার লেখালিখিতে ফিরে এলেন। তাঁর মনে হোল আল্লাহ তাঁকে আবার ভিন্ন ভেটো দিচ্ছেন, লেখালিখি ছাড়া যাবে না। পরবর্তী সাত বছর ধরে তার দ্বিতীয়বারের জোয়ার থেকে নতুন লেখালিখিগুলো বেরুলো। এবার অবশ্য স্বনামে।
তৃতীয় জোয়ার ঘটেছিল ১৮৫৪ সালে। জ্যাকব মিনস্টার(Jacob Mynster) ছিলেন ডেনিশ চার্চের বিশপ, প্রাইমেট এবং পুরানো পারিবারিক বন্ধু। কিয়ের্কেগার্ড বরাবরই খ্রিস্টধর্মকে ধর্মের ভেতর থেকে ধর্মের আন্তরিক তাৎপর্যের বৈপ্লবিক মর্ম উদ্ধারে আগ্রহী ছিলেন। এর বাইরে খ্রিস্টধর্ম নামে যেটা বাজারে হাজির তাকে তিনি বলতেন ‘খ্রিস্টান রাজত্ব’ ('Christendom')। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বাজারি চরিত্র পরিগ্রহণ করা ধর্ম, যেখানে চার্চের পুরোহিতরাই দাবি করে ধর্ম সম্পর্কে যা বলার তার পুরা কতৃত্ব তাদের। এর সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান কালের পরিস্থিতির এক বিস্ময়কর মিল রয়েছে। এখানেও কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী দাবি করে ইসলাম – বিশেষত কোরান সম্পর্কে যা কিছু বলবার কিম্বা ধর্মের তাফসির ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবার একচেটিয়া অধিকার শুধু তাদের। অথচ ধর্ম চর্চা একই সঙ্গে ব্যক্তির নিজেকে আবিষ্কার কিম্বা আল্লার সঙ্গে মানুষের রুহানি সম্পর্ক উপলব্ধির, নিত্য সম্পর্ক স্থাপনের মামলা। মানুষের নিজের বিবেক বুদ্ধি বিচার প্রজ্ঞা ইত্যাদি নিয়ে কোরানুল করমের কাছে হেদায়েতের জন্য ফিরে যাবার পথ ধর্ম ব্যবসায়ীরা রুদ্ধ করে দাঁড়ায়। তারা দাবি করে তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে কোরানের উর্ধে স্থান দিতে হবে। ইসলামকে তারা স্রেফ তাদের খেয়াল খুশির আইন কানুন বিধি বিধানে পর্যবসিত করে। কিয়ের্কেগার্ড তাঁর আমলের কোন পুরোহিতের কাছে খ্রিস্টিয়ানিটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য দ্বারস্থ হন নি। তাঁর নিজের অন্তর্জ্বালা, রুহানি তাগিদ ও জিজ্ঞাসার মীমাংসার জন্য খোদ বাইবেলেই তিনি ফিরে গিয়েছেন।
কিয়ের্কেগার্ডের লড়াই ছিল তাঁর সময়ের খ্রিস্টান বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে। তিনি নিজে সেই শ্রেণীর বাইরে ছিলেন না। তিনি কোন আর্থ-সামাজিক বিপ্লবের কথা বলেন নি। সেটা তার শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা। কিন্তু তার পরও তার দর্শনের শ্রেণী- মর্ম রয়েছে। যারা ধর্ম – বিশেষভাবে পারলৌকিক উৎকন্ঠাকে সমাজের দুর্বল, মজলুম ও ধর্মশিক্ষা বঞ্চিত গরিব ও দরিদ্র শ্রেণীর ওপর আধিপত্য বহাল রাখবার হাতিয়ার হিশাবে বহাল রাখতে চায় তিনি তাদের বিরোধিতা করেছেন। এর সঙ্গে তুলনীয় বাংলাদেশের এক শ্রেণীর আলেম বা ধর্ম ব্যবসায়ী যারা বেহেশতের লোভ ও দোজখের ভয় দেখিয়ে পরলোক বেচাবিক্রি করে। বাংলাদেশে পরলোক বেচাবিক্রির এক রমরমা বাজার তৈরি হয়েছে। ইসলামকে এই বাজারের পণ্য হবার হাত থেকে রক্ষা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এই বাজার মানুষের ধর্মীয় আকুতি এবং আল্লার প্রতি ধর্ম প্রাণ মানুষের আনুগত্য প্রমাণের জন্য কাতরতা ও মানুষের উৎকন্ঠার অর্থ বুঝতে কিম্বা বোঝাতে তারা অক্ষম। ফলে মানুষ ধর্ম ব্যবসায়ীদের ছেড়ে তখন পীর, মুর্শিদ, ফকির, দরবেশের কাছে যায়। যায় তাদের আকুতি, মনের ক্ষুধা ও হাহাকার মেটাতে। তখন বাজারি আলেমরা তাদের কাফের, মুশরিক ইত্যাদি বলে ফতোয়া দেয়। ধর্ম ফতোয়াবাজি হয়ে ওঠে।
সুখের বিষয় বাংলাদেশে বাজারি আলেম ও ফতোয়াবাজদের সংখ্যা খুবই কম, যদিও তাদের আওয়াজ বেশী। এই আওয়াজ বাজে বেশী, কারন খালি কলশির আওয়াজও বেশী হয়। মানুষ তামাশা দেখতেও মজা পায়। ভিড় দেখে এরা ভাবে এদের কথা লোকে শুনতে আসে। যেটা আমামদের মনে রাখা দরকার দ্বীনি-সাধনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আলেম-ওলেমাদের শক্তিশালী ঐতিহ্য রয়েছে। অনেকে আন্তর্জাতিক ভাবে অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। ধর্মতাত্ত্বিক এলেমের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তাঁদের কাজকে শক্তিশালী করাই চিন্তার বা দর্শনের কাজ। কিন্তু দর্শনের কাজ আর ধর্মতত্ত্বের কাজ এক না। দুই কাজের পদ্ধতি ও রূপ আলাদা। অতএব বাংলাদেশের যে কোন প্রজ্ঞাবান আলেম ও আধ্যাত্মিক পুরুষ বুঝবেন সজীব ও সক্রিয় চিন্তার চর্চার বিকাশ বাংলাদেশে যতো দ্রুত গড়ে উঠবে বাংলাদেশের সামনের সারির আলেম-ওলেমাদের কাজ ও অবদান ব্যাপক তরুণদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। মৌলিক দার্শিনিক চিন্তার জন্য তরুণদের সব সময় পাশ্চাত্যের কাছে হাত পাতবার দরকার পড়বে না। এই কাজ আরও সংঘবদ্ধ ভাবে করা দরকার। পাশ্চাত্য নানান ভাবে ইসলাম ও কোরানুল করিমকে হেয় করবার, মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চতাদপদ ও বর্বর প্রমাণ করে চলেছে। বাংলাদেশ থেকে অবশ্যই সেই সকল প্রপাগাণ্ডার জবাব দেবার সময় এসেছে।
সমাজে ‘বুর্জোয়া’ বা ব্যক্তির আবির্ভাবের ফলে ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামাজিক-ঐতিহাসিক ভাবে হাজির ‘ব্যক্তিসত্তা’র দ্বন্দ্ব অনিবার্য। ধর্ম ব্যবসায়ীদের পক্ষে এই দ্বন্দ্ব অনুধাবন অসম্ভন। তারা এই দ্বন্দ্ব মীমাংসা দূরে থাকুক, তাকে গভীর ক্ষতে পরিণত করে। অনেকে এই দ্বন্দ্বকে মীমাংসার অতীত গণ্য করে বিষমণ্ণ হয়ে পড়ে। বাজারি প্রতিযোগিতায় নেমে ধর্ম ব্যবসায়ীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায় এবং ফতোয়াবাজি করে। এর ফলে সমাজে গভীর অনৈক্য রাজনৈতিক রূপ নেয় এবং পুরা জনগোষ্ঠির অস্তিত্বের হুমকি হয়ে ওঠে । কিয়ের্কেগার্ডের সময় খ্রিস্টিয় পুরোহিতদের অবস্থা বর্তমান বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন ছিল না। তাই কিয়ের্কেগার্ড ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে গেলেন না। তিনি ভিন্ন কাজ করলেন। দ্বন্দ্বের স্বরূপ চিহ্নিত করবার, কিম্বা মীমাংসার জন্য তিনি গির্জার পরোহিতের কাছে না গিয়ে ধর্না দিলেন তাঁর সজীব ও সক্রিয় চিন্তা ও বিবেকের কাছে, যা তিনি খোদ আল্লার কাছ থেকেই পেয়েছেন। মানুষের চিন্তা, বিবেক, বুদ্ধি এবং আল্লার প্রতি আনুগত্যই মানুষকে পথ দেখায় । আল্লার প্রতি আনুগত্যের যে চূড়ান্ত রূপ ইব্রাহিম (আ) দেখিয়েছেন কিয়ের্কেগার্ড সেই নিঃশর্ত আনুগত্যের মধ্যে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিসত্তাকে তাঁর চিন্তায় নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। আল্লার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধে জড়িত ব্যক্তির এই দিব্য রূপ এর আগে আধুনিক পাশ্চাত্য আমরা দেখি নি। পাশ্চাত্য এনলাইটমেন্ট জীবনের জাগতিক সমস্যার বৌদ্ধিক মীমাংসা বা সমাধানের চর্চা করেছে। সেটা করতে গিয়ে ধর্মের বিরোধিতা করেছে। ব্যক্তি তার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নিত্যদিন যে দ্বন্দ্ব, সংকট , বেদনা ও বিষাদের মধ্যে অতিবাহিত করছে তার মর্ম বোঝার কোন দার্শনিক ধারা গড়ে ওঠে নি। হয়তো বুদ্ধির পরিমণ্ডলে সেটা সম্ভবও ছিল না। কিয়ের্কগার্ড খ্রিস্ট ধর্মের তাঁর আপন উপলব্ধির স্বরূপ সন্ধান করেছেন। কোন ফাদার বা পুরোহিতের কাছে যান নি। ইব্রাহিম (আ)-এর কোরবানির গল্পে একাকী ও নিঃসঙ্গ ব্যক্তির ভয়ে ও আতংকে আল্লার মুখোমুখি হবার মধ্যে ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে তিনি যে দার্শনিক ধারা তৈরি করেছেন তার প্রতি আমাদের আগ্রহের এটাই প্রধান কারন।
আমরা ‘ভয় ও কাঁপুনি: একটি দ্বন্দ্বাত্মক গীতিকবিতা’ (Fear & Trembling: A Dialectical Lyric) গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করব। শিরোনাম দেখে আমরা বুঝতে পারি এটি প্রথাগত অর্থে যুক্তিতর্ক দিয়ে কোন মত প্রতিষ্ঠা এর উদ্দেশ্য না। এটি একটি গীতিকবিতা। উপলব্ধির বয়ান। কিয়ের্কেগার্ডের তাঁর ধর্মকাব্য। এই বইটি তিনি স্বনামে লেখেন নি। ছদ্মনাম ছিল ইয়ুহানস দ্য সাইলেন্টিও (Johannes de Siention) । স্বনামে না লিখে ছদ্মনামে নিজস্ব উপলব্ধিকে গীতিপদ্যে হাজির করার কোন মানে আছে কি?
সেটা আগামি কোন কিস্তিতে আলোচনা করা যাবে।