জাহাঙ্গিরপুরী, হিন্দু জাতিবাদ এবং বাংলা বিদ্বেষ
আবারও ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী দিল্লিতে বাঙালি মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ চালানো হোল। এবার হামলা ঘটেছে জাহাঙ্গিরপুরি এলাকায়। এর আগে দিল্লির শাহীনবাগে এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে ‘দাঙ্গা’র নাটক সাজিয়ে পরিকল্পিতভাবে একতরফা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং বিজেপির কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সুবাদে ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্র, সংগঠিত হয়েছিল গণহত্যা। তারই চুড়ান্ত পরিণতিতে বুল ডোজার দিয়ে বাঙালি মুসলমানের মসজিদ আর বস্তি গুঁড়িয়ে দিল ভারতের গেরুয়া শাসকবর্গ। বাঙালি মুসলমানের রুটিরুজি-আশ্রয় আর ঈমানের ওপর হামলা চালালো গেরুয়া দিল্লী! সেটা তারা করেছে পবিত্র রমযান মাসে। প্যালাস্টাইনের জনগণকে তাদের বস্তি থেকে উৎখাত করবার জন্য ইসরাইল বুলডোজার ব্যবহার করে। বুলডোজার তাই বসতি উৎখাতের জায়নবাদী প্রতীক। এবার ভারতে বুলডোজার হিংস্র হিন্দুত্ববাদের প্রতীকে রূপ নিল।
এই হামলার চরিত্র কী? এটা কি শুধুই হিন্দুত্ববাদীদের কব্জায় চলে যাওয়া ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর দ্বারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর হামলা? নাকি আরও অন্য কিছু? আজ্ঞে না। এই হামলা, এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চরিত্রকে কেবল হিন্দু-মুসলিম বাইনারি, সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর রাজনৈতিক বিরোধ কিম্বা রাজনৈতিক হামলা বলে চিহ্নিত করা যাবে না। এর মধ্যে জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্ন নিহিত রয়েছে। কারন যাদের ওপর হামলা হয়েছে তারা শুধু মুসলমান নয়, তারা একই সঙ্গে বাংলাভাষী বা বাঙালি। ধর্মীয় প্রশ্নের পাশাপাশি ভূগোল, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। কারন ভারত নিজেকে ফেডারেল রাষ্ট্র দাবি করলেও এই গোড়ার বিষয়গুলোর মীমাংসা হয় নি।
বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের রাজনীতির প্রধান দিক হচ্ছে ভারতের সংবিধানের ‘ফেডারেল’ বা যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রস্তাবকে নষ্ট ও নস্যাৎ করা। ভারতকে একটি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করছে বিজেপি। অথচ ভারত কোন জাতির নাম নয়, ভারত কোন জাতি-রাষ্ট্র নয়। ভারত বিভিন্ন ভৌগলিক পরিবেশে গড়ে ওঠা বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু ভাষার দেশ। দ্বিতীয়ত কেতাবি ধর্মের মতো ‘হিন্দু’ কোন একাট্টা ধর্ম নয়। দীর্ঘদিন ধরে, এই বৈচিত্র, বিভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করে ও নিরাকরণ ঘটিয়ে ভারতকে একটি হিন্দুত্ববাদী জাতিরাষ্ট্র বানাবার চেষ্টা চলছে। এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সমগ্র ভারতের বাজারের ওপর ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা, পশ্চিম বাংলা সহ সাম্রাজ্যবাদী গ্লোবাল ক্যাপিটালের সহযোগী ভারতীয় পুঁজি ভারতের পূর্ব ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশের প্রধান দুষমণ হয়ে রয়েছে। তদুপরি প্রস্তাবিত আগাগোড়া বাংলা ও বাঙালি বিরোধী এনআরসি-সিএএ প্রকল্প কায়েম করে বাংলা বিদ্বেষ, বাঙালি বিদ্বেষ, বাংলাদেশ বিদ্বেষ ও বড় বাংলা বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছে। অসমে ১৮ লাখ বাঙালিকে ডি-ভোটার করে লাখ লাখ বাংলাভাষীকে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়েছে— যার মধ্যে রয়েছে নিম্নবর্ণের বাঙালি ও বাঙালি মুসলিম— সেই কর্মসূচীরই অভিন্ন অংশ এই হামলা। বুলডোজার কর্মসূচী আসলেই বাঙালি নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন করার পাঁয়তারা। এটা করতে গিয়ে ‘বিদেশী’, ‘বাংলাদেশী’ এমনকি ‘রোহিঙ্গা’ তকমা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ‘হিন্দু’দের উস্কানি চলছের। এমনকি উর্দুভাষী মুসলিমদেরও তাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর মতো নানান কার্যকলাপ চালাচ্ছে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক পক্ষ এবং তাদের প্রধান স্টেইক হোল্ডার আরএসএস। এক্ষেত্রে একমাত্র বিজেপিই যে এই কাজ একা সামলাচ্ছে, এমন ভাবনা মোটেও ঠিক নয়। আরো কারবারি আছে।
‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর গ্রান্ড ন্যারেটিভ ও তার অন্দরের বিভিন্ন মাইক্রো অ্যাক্টিভিটির অংশীদার বিজেপির পাশাপাশি আরো অনেক রাজনৈতিক পক্ষ রয়েছে, যারা অনেকেই ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে বাহ্যত বিজেপি বিরোধী এবং ‘সেক্যুলার’। জানা যাচ্ছে, শাহীনবাগকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে যে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল এবং সেই গণহত্যাকে আড়াল করতে সেই ঘটনাকে ‘দাঙ্গা’ হিসাবে তুলে ধরার যে চেষ্টা চলেছিল, সেই কাজে বিজেপির পাশাপাশি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল ‘আম-আদমি পার্টি’ বা ‘আপ’ যুক্ত ছিল। সরাসরি। এখন দিল্লিতে বাঙালি মুসলিমের ওপর হামলার পিছনেও যে বিজেপির আন্ডার-টেবিল দোসর ‘আপ’ যুক্ত রয়েছে, বলে অভিযোগ রয়েছে। দিল্লিতে বাঙালি মুসলমানের বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়ার এই ঘটনায় যথারীতি আক্রান্ত বাঙালিদের কখনো ‘বাংলাদেশী’ কখনো বা ‘রোহিঙ্গা’ বলে চিহ্নিত করবার চেষ্টা চলেছে। সেই ক্ষেত্রে হিন্দি/উর্দুভাষী হিন্দুস্তানি মুসলমানদের কাউকে কাউকে বিজেপির ন্যারেটিভে সুর মিলিয়ে একই কথা বলতে শোনা গেছে। তাই সারকথা দাঁড়ায় এই হামলা একান্তই বাঙালি মুসলমানের ওপর হামলা।
মনে রাখা দরকার শাহীনবাগের লড়াইটা মুসলিম মহিলাদের রাজনৈতিক স্ট্রাগল ছিল এবং সেটা ছিল এনআরসি, সিএএ বিরোধী আন্দোলনের অংশ। এনআরসি-সিএএ এমন দুটি বিষয়, যা জন্ম সূত্রের প্রাকৃতিক অধিকার এবং মানুষের জীবিকার অধিকার অস্বীকার করে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র আইনের দ্বারা নাগরিকের একাংশকে ‘অপর’ করে। এটা মূলত অধিকার হরণ আইন। অন্যদিকে অন্দরে আসলে তা গ্লোবাল ক্যাপিটালের পানপাত্রে ধর্মীয় জাতিবাদ ও জাতিরাষ্ট্রবাদের ককটেল, যা এক লহমায় সমাজের প্রতিটি ‘অপরায়ণ’-এর ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করে দেয় সার্চলাইট ফেলে ফেলে। এনআরসি-সিএএ একান্তভাবেই যে বাংলাবিদ্বেষী রাষ্ট্রীয় লিগ্যাল প্রোজেক্ট তা অসমের এনআরসি তালিকাই আমাদের পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছিল। কেননা, এনআরসিতে নাগরিকত্ব থেকে বাদ যাওয়া সিংহভাগ মানুষই বাংলাভাষী। এবং এদের মধ্যে প্রায় সকলেই হয় বাঙালি নমঃশূদ্র নতুবা বাঙালি মুসলিম। এনআরসি-সিএএ ৪৭-এর ক্ষতকে আবার নতুন করে খুঁচিয়ে নতুন রক্তক্ষরণের এজেন্ডা, এই এজেন্ডায় হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান এই তিন উপাদানের যা কিছু পরিপন্থী, তার চোখে যা কিছু ‘অপর’- তাকেই আক্রমণের নিশানায় রাখতে চায় রাষ্ট্র। তাই বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা- এই সকল ক্ষেত্রেই ভারত রাষ্ট্র আগ্রাসি ও আধিপত্য হয়ে ওঠে। দলিত, আদিবাসী, মুসলিম, মহিলা, প্রান্তিক লৈঙ্গিক মানুষেরা এবং সাংস্কৃতিকভাবে অবৈদিক পরিসরে ক্ষেত্রগুলি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় দিল্লির। এই মর্মে সাতচল্লিশকেন্দ্রিক নয়া-জেনোফোবিক গেরুয়া প্রকল্পে হিন্দুত্ববাদের নামে মূলত বাংলাবিদ্বেষকেই প্রবল করে তোলে।হিন্দু হতে হলে বাঙালিকে বাংলা ভাষা ছেড়ে হিন্দিতে কথা বলতে হবে। কৃষ্ণ ছেড়ে রামকেই শুধু মানতে হবে। ভুলতে হবে বাংলার শিব, উমা, কালি, সরস্বতী ও অন্যান্য দেবদেবিদের। উত্তর-পশ্চিম-মধ্য ভারতের বৈদিক রণ-রক্ত ঐতিহ্যের সমান্তরালে উপস্থিত ভূমিনিবিড় অনার্য মানুষের ভূমি বৃহৎ বঙ্গকে বেছে নেওয়া হয়েছে গ্লোবাল ইম্পিরিয়ালিস্ট ক্যাপিটালের স্বার্থবাহী জাতিবাদী ভেদ-বিভাজন ও জাতিঘৃণার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে মোক্ষম করে তোলার উপায় হিসাবে। তাই হামলা হচ্ছে বাংলার অবিচ্ছেদ্য পরিচিতি বাঙালি মুসলমানের ওপর। ইসলামবিদ্বেষ ও আগ্রাসী হিন্দুকরণের ভ্রমে রাখা হয় বাঙালি নমঃশূদ্রকে, যাতে বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি নমঃশূদ্রের ঐক্য গড়ে উঠতে না পারে। ক্রমে এই ভ্রমের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করে রেখে বাঙালি মুসলমানের মতোই বাঙালি নমঃশূদ্রেরও জান-মাল, জল-জমি-জঙ্গল দখল করার পাঁয়তারাকে সর্বব্যাপ্ত করে তোলে দিল্লি। শুধু পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরার সাধারণ খেটে খাওয়া বাঙালি মুসলিম ও নমঃশূদ্রের উপর হামলা-নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়, তাই নয়। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে যারা রাজনৈতিকভাবে রাজ্যের ক্ষমতায় বিজেপিকে জায়গা দেয় না, সেইসব রাজ্যের যুক্তরাষ্ট্রীয় সকল সাংবিধানিক অধিকারগুলোকে খর্ব করে অর্থনৈতিক নিপীড়ন নামিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ৪৭ পরবর্তী সময় থেকে দলমত নির্বিশেষে দিল্লি কীভাবে পশ্চিমবঙ্গকে মাশুল সমীকরণ নীতি-সহ নানা উপায়ে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে তার বিবরণী দুয়েক কথায় বলা সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গকে কীভাবে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে দিল্লির (দলমত নির্বিশেষে) কেন্দ্রীয় শাসন, তা নিয়ে এক সময়কার অমৃতবাজার পত্রিকার সাংবাদিক রণজিৎ রায় বই লিখে রেখেছেন একটি। আর পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে অর্থনৈতিক প্রগতীর গতিকে অবরুদ্ধ করে রাখার জন্যে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিম, বাঙালি নমঃশূদ্রকে অর্থনৈতিকভাবে পরিযায়ী হয়ে সস্তা ও অসংগঠিত শ্রমিক হিসাবে দৌড়াতে হয় ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। সেখানে বসতি (‘বস্তি’) গড়ে তুলে তারা কোনোরকনে দিনগুজরান করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। এবার এইসব বাঙলাভাষী প্রান্তিক ও নিম্নবর্গের শ্রমিকদের ‘বাংলাদেশী’/ ‘রোহিঙ্গা’ আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর হামলার নয়া ট্রেন্ড শুরু হয়েছে বিজেপির শাসনামলেই।
হ্যাঁ দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে এই হামলা বাঙালি মুসলমানের ওপর হামলা। শুধু মুসল্মানের ওপর নয়, বাঙালির ওপরও এই হামলা। এই হামলাকে, এই নিপীড়নকে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর হামলা, নিপীড়ন বলে চিহ্নিত করা ভুল। যারা সেটা করেন তারা হামলার অভিমুখটাকে প্রতি মূহূর্তে অস্পষ্ট করে দ্যান। হামলার অভিমুখ অস্পষ্ট করে দেওয়ার এই অজ্ঞান রাজনীতি মূলত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। যা প্যান-ইন্ডিয়ান বা কল্পিত হিন্দু ভারতের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ধারণার তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে ভারত হিন্দুদেরই দেশ। অতএব বিভিন্ন জনগোষ্ঠির ভূগোল ভাষা ও সংস্কৃতি গৌণ বিষয়, তার ধর্মীয় পরিচয়টাই মুখ্য। যেমন, হিন্দু অথবা মুসলমান, ইত্যাদি। ঠিক তেমনি প্যান ইন্ডিয়ান লিবারেল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীও ভিন্ন কিছু নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে যাদের বসত বা বস্তি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে সহিংস হামলা চালানো হয়েছে তারা স্রেফ ধর্মীয় সংখ্যালঘু। তাদের ভূগোল, ভাষা ও সংস্কৃতি তাদের ধর্মের তুলনায় এবং ধর্মের বিপরীতে গৌণ। অতএব তা আমলে নেবার দরকার নাই। তাদেরকে শুধুই মুসলমান বলে চিহ্নিত করতে হবে। সেকুলার প্যান ইন্ডিয়ানদের দাবি হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারত রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করা দরকার। প্যান ইন্ডিয়ানিজমের প্রগতিবাদী, লিবারেল ও বিমূর্ত বয়ান বাঙালির ভূগোল, ভাষা ও সাংস্কৃতিক সত্তাকে অস্বীকার করে। সেটা করা হয় বাঙালির বাস্তব, কংক্রিট, সহজ ও ঐতিহাসিক সত্তাকে বিমূর্ত ও কাল্পনিক অখণ্ড ভারতের ধারণার দ্বারা নস্যাৎ বা মুছে ফেলার চেষ্টায়। তাকে হিন্দুত্ববাদী বয়ানের অধীনস্থ করবার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায়। তাই বাঙালি মুসলমানকে শুধু ‘মুসলমান’ গণ্য করে ঠেলে দেওয়া হয় হিন্দু জাতিবাদের অপর পৃষ্ঠা আধুনিক ইসলামি জাতিবাদের দিকে। যা হিন্দুত্ববাদীদের মতোই বাঙালির ভূগোল, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ও সত্তা স্বীকার করে না। বাঙালি মুসলমান তাই দ্বিগুণ হামলার শিকার। সংখ্যালঘু মুসলমান হিসাবে একবার, বাঙালি হবার কারণে দ্বিতীয়বার।
এর জন্য বাঙালি বিশেষ ভাবে দায়ী। সাতচল্লিশে হিন্দু বাবু বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে দেশভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাঙালি ধর্মের প্রশ্নকে ভূগোল, ভাষা ও সংস্কৃত্র অভ্যন্তর থেকে মীমাংসদা করতে পারে নি। সনাতন ধর্মকে সেমিটিক ইব্রাহিমি ধর্মের মতো কেতাবি ধর্ম বানিয়ে তাকে খ্রিস্টীয় মিশনারি এবং পরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এই দেশে কোন ব্রাহ্মণ ছিল না। বাঙালি ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণাশ্রম প্রথাকে তার ধর্ম গণ্য করে শূদ্র ও নমঃশূদ্র সহ সকল প্রান্তিক জনগোষ্ঠি ও আদিবাসীদের ওপর জুলুম করেছে। বেদ ও শাস্ত্র নির্যাতনের হাতিয়ার হয়েছে। ইসলাম যখন এদেশে আসে তখন শূদ্র বা সমাজের নিপড়ীত জনগোষ্ঠি তার আরবদের পাগান ও ট্রাইবাল ইসলাম গ্রহণ করে নি। বরং নিপীড়িতের পক্ষাবলম্বনের ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তার নিজস্ব বয়ান তৈরি করেছে। যা দরবেশ, ফকির, বয়াতি, ভাণ্ডারি ও নানা লৌকিক চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। এ সবের মর্ম বাবু বাঙালি বোঝে নি, বুঝতেও চায় নি। বাংলার ভক্তি আন্দোলন সুলতান হোসেন শাহের আমল থেকেই ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত। হিন্দু বা মুসলমান উভয়েই নিজেদের রাজ্যে বহিরাগত বৈদিক-সাংস্কৃতিকসত্তা দ্বারা যুগ যুগ ধরে নিপীড়িত হয়েছে। বাঙালি বর্ণহিন্দুরাও বৈদিক সাংস্কৃতিক বর্ণবাদী পরিচিতিসত্তায় নিজেদের অস্তিত্ব সমর্পণ করে মুসলমান বাঙালিকে ‘অপর’ করে রাখা থেকে ক্ষান্ত থাকে নিজের ঘরের বাঙালি মুসলিম ভাইবোনের ওপর যুগযগান্ত ধরে নিপীড়কের ভূমিকা পালন করেছে। যেকথা বলছি সেটা হিন্দুত্ববাদী কিম্বা প্যান ইন্ডিয়াদের কানে যাবে না। বরংযুগ যুগ ধরে নিপীড়িত বঙ্গীয় মুসলমান ও শূদ্রের দল এইটা বুঝবে। তারাই বুঝবে যারা নিজের ভূমি থেকে অর্থনৈতিকভাবে উচ্ছেদ হয়ে জীবন-জীবিকার আশায় পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি জমিয়েছে ইউনিয়ন রাষ্ট্রের কেন্দ্রে এবং সেখানে হামলা, মামলা, নিপীড়নের শিকার হয়েছে এবং ক্রমে উচ্ছেদ হতে হয়েছে নিজের আশ্রয় থেকে। মাথার উপর ছাদ উড়ে গেছে যাদের, যাদের কেউ নেই তবু নাকি আছেন দ্বীন-দুনিয়ার দয়ালচাঁদ এক, পরম করুণাময় আল্লাহতালা যিনি নিঃশর্তে গায়েবে আত্মসমর্পণ যাঞ্চা করেন। সেই নিরাকার গায়েবের এবাদতের জন্যে যারা বানিয়েছিলেন উপাসনালয় হিন্দুত্ববাদীরা সেটাও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, গুঁড়িয়ে দিয়েছে রমজানের এক দুপুরে, যখন নির্জলা রোযায় রয়েছে দুনিয়ার মুসলমান।বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে মজলুমেরাও ছিলেন রোযায়, অপেক্ষায় ছিলেন আযানের, অপেক্ষায় ছিলেন বিসমিল্লাহ বলে জল পান করবার... কিন্তু রাষ্ট্র তার আগেই তার বাসা, মহল্লা, মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল, কাশ্মীর কিংবা ফিলিস্তিনের মতোই অসহায়, অশ্রু ও যন্ত্রনাকাতর হয়ে মজলুমেরা চেয়ে রইলেন আসমানে... বিড়বিড় করলেন, খোদা তুই আসমান কিংবা দিল-কাবা যেখানেই থাকিস, এর বিচার করিস, আমাদের যন্ত্রণার, আমাদের নিপীড়নের বিচার কোথাও নাই যে, তুই তাই এর বিচার করিস খোদা—কিংবা যারা এনআরসিতে নাগরিকত্ব থেকে বিযুক্ত হয়ে সনাতনী ভাইবোনদের সঙ্গেই ডিটেইনশন ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন আসামে, তারা বুঝবেন মুখের জবান বাঙলা আর নিরাকারের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঈমানের কারণেই এই রমযানে গারদের ভিতরে তারা, একই জল আর একই পানি ভাগ করে নিয়ে ইফতার সেরেছেন বাঙালি সনাতনী ভাইবোনের সাথে ডিটেইনশন ক্যাম্পে।
আপনি কখনোই বুঝবেন না ভারতের বাঙালি মুসলিম আর বাঙালি নমঃশূদ্রের কান্নার ভিতরে গুমরে গুমরে হারিয়ে যাওয়া বাক্যগুলি। রাষ্ট্র কিন্তু সবই বোঝে আর তাই রাষ্ট্র বাঙালি মুসলিম ও বাঙালি নমঃশূদ্রের ঐক্যের কোন শর্ত তৈরি হলে পরিকল্পিত ভাবে হামলা করে, বিভাজন চালায়। আবার একও করে দেয় সব, অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পে এক সাথে থাকেন রোযাদার বাঙালি আর নীলষষ্ঠির উপবাসে শুকনা বাঙালি। দিল্লির বুকে, গুজরাতে, ইউপিতে, বিহারে, মধ্যপ্রদেশে বাঙালি মুসলিম ক্ষতবিক্ষত হয় যেভাবে, সেভাবেই হামলা নেমে আসে নিম্নবর্ণের বাঙালির ওপর। প্যান ইন্ডিয়ান – অর্থাৎ বাবু বাঙ্গালির চশমায় দিল্লিওয়ালা ভারতীয় জাতিবাদীদের হিংস্র বর্ণবাদী ডিসকোর্স সহজে দেখতে পাবেন না। এই নিপীড়নের অন্দরে ঢুকে তার সন্ত্রাসী রূপটা চিনে নিতে হবে।