ভারতের বাঙালি মুসলমান ও নমঃশূদ্রের রাজনৈতিক সঙ্কট
‘ঘরে কেবা জাগে কে বা ঘুমায়, কে কারে দেখায় স্বপন’ - ফকির লালন শাহ
ভারতে বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে। এখানের জনসংখ্যায় প্রায় তিরিশ শতাংশ মানুষ বাঙালি মুসলিম। আর বাঙালি নমঃশূদ্র ও বাঙালি মুসলমান মিলিয়ে যে সংখ্যা দাঁড়ায় তা বাঙালি বর্ণহিন্দুর থেকে অনেক অনেক বেশি। একই চিত্র অসমের। সেখানে অহমিয়াদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রয়েছে বাঙালির উপস্থিতি। আর সেখানকার বাঙালির বেশিরভাগটাই হয় বাঙালি নমঃশূদ্র, নয়তো বাঙালি মুসলিম। বাঙালি বর্ণহিন্দু এদের থেকে সংখ্যায় কম। আবার পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে বাঙালি মুসলিমরা সকলেই ভূমিসন্তান। বাঙালি নমঃশূদ্রের মধ্যে একটা অংশ পূর্ববঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ থেকে সাতচল্লিশে অথবা একাত্তরের পরে চলে আসা। সাতচল্লিশে বাংলা ভাগ হওয়ার পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেভাবে লাখো বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে এসেছিল, ঠিক একইভাবে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা থেকেও উদ্বাস্তু হয়ে বাঙালি মুসলিম লাখো পরিবারকে চলে যেতে হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। এর পেছনে কারা দায়ি, কীভাবে কী হয়েছিল, সেই আলোচনার পরিসর এই লেখাটা নয়, বরং এই বিষয়ে জয়া চ্যাটার্জি থেকে শুরু করে হালফিলের জনম মুখোপাধ্যায়দের গবেষণা, আলোচনা, বিশ্লেষণ থেকে আমরা পাকিস্তান আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার পলিটিক্যাল কম্পালশন, ভারত-পাক সমান্তরালে স্বাধীন সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব এবং কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভা কর্তৃক তা বানচাল হয়ে যাওয়া বিষয়ে অবগত।
তো যা বলছিলাম, ভারতের বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি নমঃশূদ্রের রাজনৈতিক সঙ্কট বুঝতে হলে মাথায় রাখতে হবে সাতচল্লিশের ইতিহাস ও ক্রমে আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতা। ইতিহাস এটাই যে এখানকার বহু বাঙালি মুসলিমকে ভিটেমাটি ফেলে রেখে বা বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বিনিময় করে পূর্ববঙ্গে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। আর আজকের বাস্তবতা হলো এই হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিবাদী পরিচয়ে ভারতের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ভারতের শাসক পক্ষের নেকনজরে ফের ভারতের বঙ্গীয় অঞ্চলগুলি চলে এসেছে। কারণ, তারা ভালোই জানে বাংলা এমন একটি অঞ্চল যা সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে না এলে বৈদিক সাংস্কৃতিক কাঠামো তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য খাটবে না। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের রাজনৈতিক নির্মাণ হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জাতিরাষ্ট্র কায়েমও সম্পূর্ণ হবে না।
সেকারণেই এনআরসির বিষয়টাকে বিশেষ ভাবে সামনে আনা হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে এনআরসি গোটা ভারতের জন্যেই প্রযোজ্য, কিন্তু বিষয়টি সামান্য তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে যে এনআরসি তার চরিত্র অনুযায়ী কেবলমাত্র ভারতের সেইসব রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেগুলো খণ্ডিত দেশীয় ভূখণ্ড আকারে ভারত ইউনিয়নের মধ্যে অঙ্গরাজ্য হিসাবে রয়ে গেছে। বাংলাভহাষী বাঙালি বা যদি দুই তিন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তারা জাতি হিশাবে চিরকাল দুর্বল থেকে যাবে। বাংলা একাত্তরে স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে দিল্লীর পরাধীন হয়ে রয়েছে। এহেন বাংলাদেশের পক্ষেও কোন সমৃদ্ধি বা সাফল্য দেখানো কঠিন হবে। ভারতে এই ধরণের রাজ্যগুলো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও পঞ্জাব। ত্রিপুরাকেও এমন একটি রাজ্য বলা যায়। ৪৭-এর বাংলা ভাগের ফলে মূলত অখণ্ড বাংলা বা বেঙ্গল প্রভিন্স এবং অখণ্ড পঞ্জাব বিভক্ত হয়ে যায়। ধর্মের ভিত্তিতেই মূলত। কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাক দুই রাষ্ট্রে পঞ্জাবকে কেন্দ্র করে জনবন্টন ( শিখ পঞ্জাবি, হিন্দু পঞ্জাবি ও মুসলিম পঞ্জাবিদের মধ্যে) যথাযথভাবে হওয়ায় এবং আরও কিছু সমাজতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক কারণে সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে নাগরিকত্ব, রাষ্ট্রীয় পরিচিতি ইত্যাদি সংক্রান্ত ফ্যাসাদ ও জটিলতা তৈরি হয়নি— যেটা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের ক্ষেত্রে ঘটে নি। ফলে যত দিন গেছে বিভক্তি ও নানান কিসিমের সাম্প্রাদায়িক বিষবাষ্প মাথাচাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট চিহ্নিত করার পরেও দিল্লি থেকে ক্রমান্বয়ে ভারতের বঙ্গীয় অঞ্চলগুলির জনমানসে বাংলাদেশ বিদ্বেষ (ইসলামবিদ্বেষের ছুপা হিন্দুত্ববাদী ভার্সান) ও বাঙালি বিদ্বেষ যেমন ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও জাতিবাদী মুসলমানদের দ্বারা হিন্দু ও নির্বিচার ভারতীয় বিদ্বেষের চাষাবাদ চলেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরবর্তী সময় থেকে উপমহাদেশে নয়া উদার অর্থনীতি বা বাজার অর্থনীতি কায়েম হয়েছে (বিশেষত ভারত ইউনিয়নে)। বাংলাদেশ ও বাঙালি বিদ্বেষ এসেছে তারই হাত ধরে। কারণ নিউ লিবারাল ইকনমিক পলিসির কারণে মানুষ দ্রুত উদ্বাস্তু ও সর্বহারা হয়েছে। জীবন জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন দিকে ছুটেছে। কিন্তু গরিব, সর্বহারা শ্রেণী বিএসেফের গুলিতে সীমান্তে মরে। ফেলানির লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারের বেড়ায়। অন্যদিকে ভারতীয় পুঁজির সেবক ও নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সুবিধাভোগীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে বিপুল পরিমাণ আয়ও করছে। সেই সকল অর্থকরী পদে বাঙালি হিন্দু পাওয়া যায়না বললেই চলে। হিন্দিভাষী রাজ্যগুলো নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসির সুবিধা ভোগ করে। একদিকে খোলা বাজারের ভোগবাদী অর্থনীতি যেমন হয়েছে, তেমনই আরএসএস প্রবর্তিত হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি জেনোফোবিক জাতিবাদের উত্থান ঘটেছে প্রবলভাবে। আর সেই সূত্রেই ৪৭ চল্লিশের ক্ষতকে নতুনভাবে উসকিয়ে দিয়ে ভারত ব্যাপী বাঙালি মুসলমানের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ উগরে দেওয়া হয়, তার লক্ষ্য স্রেফ মুসলমান নয়, মূল লক্ষ্য বাঙালি। কারণ হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিকে বিভাজিত রাখার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশসহ পূর্বাঞ্চলে হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী করা যায়। সেই ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী যেমন, ঠিক একই ভাবে এক শ্রেণীর জাতিবাদী মুসলমানের হিন্দু বিদ্বেষ -- উভয়ই হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পকেই বাস্তবায়িত করে। এই ফাঁদে পশ্চিম বাংলার হিন্দু এবং বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মুসলমানও কখনও বুঝে, কিম্বা কখনও না বুঝে পা দেয়। বাংলাবিদ্বেষ, বাঙালিবিদ্বেষ, মুসলমান বিদ্বেষ এবং বাংলাদেশে হিন্দু বিদ্বেষ একই সূত্রে গাঁথা। হিন্দুত্ববাদই এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। যতদিন গেছে ততই বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতি উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
লক্ষ্যনীয়, দিল্লির ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ নির্ণয়ের জায়গা গুলোও পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর একটা নিরপেক্ষ থাকার ভান থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তামূলক চুক্তি রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে ্দিল্লি-ওয়াশিংটনের আরও গভীর সম্পর্কেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। দিল্লীর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। দিল্লি পশ্চিমা-মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদের বৈশ্বিক অনুগত শক্তি হিসাবেই চিনকে ঠেকাবার জন্য নীতি গ্রহণ করেছে। দিল্লীর পরাশক্তি হয়ে ওঠার খায়েশ তাকে চিনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। পাল্লা তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার দিকেই ঝুঁকে আছে। নিজের ক্ষমতা প্রশ্নাতীত করে তুলতে হিন্দুত্ববাদী শক্তি এনআরসির মাধ্যমে ভারতের বঙ্গীয় অঞ্চলগুলির অধিবাসীদের রাষ্ট্রের ক্রীতদাস বানাতে চায়, কেড়ে নিতে চায় নাগরিক অধিকার, নাগরিক পরিচিতি, নিজভূমে পরবাসী করে রাখতে চায় তাদের। পাশাপাশি পূর্বাঞ্চলকে চিনের সম্ভাব্য আগ্রাসনের কথা ভেবে একটি ওয়ারজোনে রূপান্তরিত করাও সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি হতে পারে। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এনআরসির মূল লক্ষ্য যদি বাঙালি তথা বাঙলাভাষীদের সমূলে উচ্ছেদই হয়, তাহলে আলাদা করে বাঙালি মুসলমানের কথা হচ্ছে কেন? কারন ভারতে ইসলামফোবিয়ার অন্যতম নামই এখন বাংলাদেশ-ফোবিয়া, বাংলা-ফোবিয়া। এটা সংখ্যার রাজনীতি হিশাবেও হাজির করা হয়। যার ফলে তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ ফোর্সও এটা প্রমাণ করতে চায় যে ভারতের সমস্যার মূল কারণ হলো মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি। আর এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, বাংলাদেশ থেকে ‘অনুপ্রবেশ’। এই অনুপ্রবেশককারীরা নাকি অনেকাংশেই মুসলমান। এই কথা বলে হিন্দুত্ববাদীরা পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরার ভূমিসন্তান,বাঙালি মুসলিম, রাজবংশী মুসলিম প্রভৃতিদের হয় ‘বাংলাদেশী’ নয়তো ‘রোহিঙ্গা’ প্রমাণ করতে মরিয়া। আর এই ন্যারেটিভ এমনভাবে সক্রিয় যাতে দেখা যাচ্ছে উত্তর ভারতীয় হিন্দুস্তানি মুসলিম ও পূর্বাঞ্চলের বিহারী মুসলিমের একাংশও বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে ‘বাঙ্গালি কাঙ্গালি’, বাংলাদেশী মোসলমান তো সহি মোসলমান নেহি’, ‘বাঙ্গালি সব বাংলাদেশী হ্যায়, ‘ও লোগ সব রোহিঙ্গা’ হ্যায়— ইত্যাদি তোতাপাখীর বুলি আউড়াচ্ছে অবলীলায়। শাহীনবাগের যে আন্দোলনে এনআরসি-সিএএ’র বিরুদ্ধে অনেক অনেক উর্দুভাষী মুসলিম মা-বোনেরা রাস্তায় নেমে গণঅবস্থান করেছেন, সেই শাহীনবাগেই এখন আম আদমি পার্টির মদতে কিছু উর্দুভাষী মুসলিমকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, দিল্লি দাঙ্গায় অশান্তি ছড়িয়েছে বাঙালি মুসলমানেরা। বাঙালিরা আসলে বাংলাদেশী, ওদের দিল্লি থেকে হটাও!
কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, বিপ্লবী বামপন্থার স্লোগান দেয় যারা, তারা কিংবা বাঙালি মুসলিম ছোটছোট পলিটিক্যাল গ্রুপগুলিও এই ব্যাপারে সজাগ নয়। তারা আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু তারাও বিজেপি যেভাবে চায় যে নিপীড়নের ন্যারেটিভকে হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে ভাগ করে ভাবেন। তারাও মনে করেন, তাদের ওপর আক্রমণটা কেবল মুসলিম হওয়ার কারণে হামলা-নিপীড়ন। আসলে যে এই হামলা বাঙালি মুসলমানের ওপর, সেটা তারা বুঝেও বুঝছে না, দেখেও দেখছে না।
বহু ধর্ম, বহু ভাষা বহু সংস্কৃতির দেশে 'ভারতীয়' বলে কোনো সাংস্কৃতিক কিংবা জাতীয় সত্তা হয় না। বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা, বা সংস্কৃতির একসঙ্গে থাকবার একটা রাজনৈতিক সংস্থা হতে পারে।। কিন্তু রাষত্র মানেই জাতি না, আর জাতি মানেই রাষত্র না। প্রকৃতপ্রস্তাবে সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র, তাই ভারতীয় মুসলিম বলেও কিছু হয় না। ভারতের মুসলিমদের (সুন্নি) বিশ্বের সকল মুসলমানের (সুন্নি) মতোই ইসলামোফোবিক রাষ্ট্রবাদের ফলাফল ভোগ করতে হয়, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সাতচল্লিশকে কেন্দ্র করে এনআরসি-সিএএ সামনে রেখে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি রণধ্বণি মূলত বাঙালিকে ধর্মীয় ভাবে বিভক্ত করবার রাজনীতিকেই পুষ্ট করে। অথচ দরকার বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের সঙ্গে সৌহার্দ্য ও বোঝাপড়ার ক্ষেত্রগুলো পরিচ্ছন্ন করে তোলা। রাজ্য ও জাতিসত্তা ভেদে ভারতের মুসলমানদের সমস্যার মধ্যেও বৈচিত্র্য ও ফারাক আছে। কারণ ভারতের মুসলমান ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে একাট্টা মুসলমান নন। তাই এটা বুঝতে হবে, এনআরসি-সিএএ তৈরিই হয়েছে বাংলাভাগের রাজনীতিকে ইতিহাসের পাতা থেকে নতুন করে বর্তমানে হাজির করবার জন্য। বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রাদ্যিক ভেদবুদ্ধি তীব্র করে একটি ভাষিক ও সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠিকে চিরকালের জন্য পঙ্গু করে দেওয়া। একে রুখে দেবার পথ একটাই বাঙালি মুসলিম, বাঙালি নমঃশূদ্র ও বঙ্গীয় নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও গভীর করা, বিভেদের ক্ষেত্রগুলো সরাবার কাজ হাতে নেওয়া। এই ক্ষেত্রে জাতীয় গণতান্ত্রিক ঐক্য তথা নিপীড়িত জাতিসত্তাসমূহের গণতান্ত্রিক ঐক্য নিশ্চিত করা একটি পথ হতে পারে। আমাদের বিভিন্ন দিক থেকে আরও ভাবতে হবে।
কিন্তু তেমন কোনো গণতান্ত্রিক ঐক্য গড়ে তোলার তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি বাঙালি নমঃশূদ্রেরও নেই। যে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুর ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, জঙ্গি আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন, বৈদিক বর্ণাশ্রম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বঙ্গের নমঃশূদ্রদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘মতুয়া ধর্ম বিপ্লব’, সেই মতুয়ারা আজ বিজেপির ক্রীড়নক। ব্রাহ্মণ্যবাদী আরএসএস মতুয়াদের নিয়ে যেভাবে খুশি পরিচালনা করছে আর মতুয়ারাও তাতে নাচছে। তাদের আশা, বোধহয় সিএএ’র মাধ্যমে তাদের সবাইকে বিজেপি নিঃশর্তভাবে নাগরিকত্ব প্রদান করবে। তারা একবারও ভাবছে না, ইতোমধ্যেই তারা যে বছরের পর বছর ধরে ভারতের নানাবিধ সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে ভোটার হিসাবে, এমনকি তাঁদের প্রতিনিধিরা বিধায়ক-সাংসদ হিসাবে নির্বচিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন, এগুলো তো তাঁদের নাগরিকত্ব রয়েছে বলেই সম্ভব। কিন্তু এটা তারা বুঝছেন না। বিজেপি বলছে, এই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্ট ইত্যাদির মূল্য নেই। তারা এনআরসি করে নতুন তালিকা বানাবে অথবা সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে নতুনভাবে নাগরিকত্ব নিতে হবে।
এই নতুনভাবে নাগরিকত্বের অর্থ কী? এটাই অর্থ যে, ইতিপূর্বেকার বলবৎ নাগরিকত্বকে অস্বীকার করে আমাকে-আপনাকে ঘোষণা করতে হবে যে আমরা ‘বহিরাগত’। তারপর নতুন করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে অমুসলিমদের। অর্থাৎ ঘুরিয়ে সিএএ মতুয়াদের, যাদের অনেকেই সাতচল্লিশে এবং তার পরের বেশ কয়েক বছর ধরে পূর্ব বঙ্গ থেকে আধুনিক ভারতে এসেছিলেন, তাদের এনআরসির বিবেচনায় নিয়ে আসবে। কীভাবে? আপনি যদি প্রথমেই স্বীকার করেন যে আপনি ‘বহিরাগত’ এবং আপনি যদি আপনার এতদিনকার ভারতীয় নাগরিকত্বের দলিলদস্তাব্জকে রাষ্ট্রের এজেন্টদের কথায় অস্বীকার করেন এবং তারপর স্যারেন্ডার করে নয়া নাগরিকত্ব চান, তখন রাষ্ট্র যে আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে তার গ্যারেন্টি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ’র মধ্যে নেই। বরং একটি সংখ্যা উল্লেখ আছে, যে কত সংখ্যক অমুসলিম ‘বহিরাগত’ মানুষকে সিএএ’র মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকত্ব দেবে! রাষ্ট্র যেহেতু বিবেচনা করবে কাকে নাগরিকত্ব দেবে আর কাকে দেবে না, সেক্ষেত্রে প্রথমেই যারা ব্রাহ্মণ্যবাদী আরএসএস-এর প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে নিজেই নিজেকে ‘বহিরাগত’ ঘোষণা দেবেন, এনআরসি তালিকা থেকে তাদের বাদ দিতে রাষ্ট্রকে আর ন্যুনতম বেগ পেতে হবে না।
এই সামান্য বিষয়গুলি অনেকে বুঝছে না। তারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন পাকিস্তান আমলের কিছু বিহারী-পঞ্জাবি মুসলমানের অপকর্মের ইতিহাসের সামনে নতুন ভাবে মুখোমুখি হয়ে। একই সাথে তারা অনেকাংশেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন বাংলাদেশকেন্দ্রিক মিথ্যা, ভুয়া, জাতিবাদী প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পড়ে। যেগুলোর সাথে তাদের বর্তমানতা, তাদের ভবিষ্যৎ এগুলোর সম্পর্ক নেই। তারা মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে যেভাবে ইসলামবিদ্বেষী, বাংলাবিদ্বেষী, বাংলাদেশবিদ্বেষী রাজনীতির ফাঁদে পা দিচ্ছেন, তাতে করে তাদের জীবনেও যে অসমের ১২ লক্ষ সনাতনী বাঙালির মতো অন্ধকার নেমে আসবে না, তার কোনো গ্যারেন্টি নেই। মনে রাখা দরকার, অসমে বিজেপি জাতিবাদী রাজনীতির মেশিনারি হিসাবেও যেসকল বাঙালি সনাতনী নমঃশূদ্র কাজ করেছিল, এনআরসির কবলে তাদের অনেকেই আজ ডিটেনশন ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন, এমনকি কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের নমঃশূদ্র মতুয়ারা এটা যদি আজ বুঝতে না পারে, তাহলে হয়তো তাদের চরমমূল্য দিতে হবে সংঘ পরিবারের জাতিবাদী রাজনীতির কাছে। বাংলাবিদ্বেষী রাজনীতির কাছে। তাদের মনে রাখা উচিত দিল্লির জাতিবাদী রাজনীতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তসমূহের ফাঁদে পা দিলে বাঙালি মুসলিমের থেকে তাদের কপালই বেশি পুড়বে—কেননা, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানের একজনও কেউ একসময়কার পূর্ববঙ্গ থেকে যে আসেনি তার তথ্যপ্রমাণ-নথি কিছু লোকজনের কাছে হলেও আছে, কিন্তু তাদের কারো কাছেই তেমন নথি থাকা অসম্ভব, তাই দিনশেষে এমন বেআইনি রাষ্ট্রীয় প্রস্তাবকে মতুয়ারা যদি জনমান্যতাতা দিয়ে কায়েম রাখে তাহলে বেআইনি আইনি হিসাবে খাড়া হয়ে প্রথমেই গিলে খাবে তাদের। ভারতের বাঙালি মুসলিমের ওপর রাষ্ট্র হামলা চালাতে পারে, তাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে জেলে ঢোকাতে পারে, কিন্তু যেহেতু তারা ভারতের বঙ্গীয় অঞ্চলসমূহের অধিবাসী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর ধরে— তাই তাদের সবাইকে একত্রে আইনের মাধ্যমে ‘বিদেশী’ ঘোষণা করাটা অতটাও সহজ নয় যতটা সহজ মতুয়াদের ক্ষেত্রে।
ভারতের বাঙালি মুসলমানকে যেমন বুঝতে হবে সে ইরানের-আরবের-তুর্কির-উত্তরপ্রদেশের-বিহারের মুসলমান নয়। সে বাঙালি মুসলমান, সাতচল্লিশ তার ইতিহাসের সঙ্গেই সম্পৃক্ত এবং তার সমস্যা আর বাঙালি নমঃশূদ্রের সমস্যা অনেকাংশেই এক, কেননা উভয়েই বর্ণবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিন্দুত্ববাদ দ্বারা আক্রান্ত ও নিপীড়িত, ঠিক তেমনই মতুয়া-সহ ভারতের বঙ্গীয় অঞ্চলসমূহের নমঃশূদ্রদেরও বুঝতে হবে তাদের উপর চলে আসা নিপীড়নকে আড়াল করে কারা বন্ধুর মুখোস পরে জানমালপ্রাণ কেড়ে নিতে চায়, আর সত্যিকারের বন্ধুই বা হতে পারে কারা! তাদের মনে রাখতে হবে আরএসএস-বিজেপি এবং আরও যতেক মুখোশধারীরা (সোকল্ড সেক্যুলার ফোর্স) নেহাত বন্ধুবেশী গণশত্রু। বন্ধু তারাই হতে পারে যারা একইভাবে মার খেয়েছে এবং খাচ্ছে এই ভারত রাষ্ট্রে, এই বাংলায়। যাদের মুখের জবান বাংলা, যারা ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা নিপীড়িত এবং যারা শ্রেণীতে দরিদ্র কৃষক কিংবা ক্ষেতমজুর, সেইসব বাঙালি মুসলমান ভাইবোনেরা, তারাই হতে পারে প্রকৃত বন্ধু। শুধু তাই নয় ভারত ইউনিয়নের মধ্যেকার বঙ্গীয় অঞ্চলসমূহের সকল বঙ্গীয় জনতাকেও বুঝতে হবে দিল্লির প্যান ইন্ডিয়ান রাজনীতির বিপরীতে, জাতিবাদী রাজনীতির বিপরীতে যদি তারা বড় বাংলার বা বৃহৎ বঙ্গে্র মানুষের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে না তুলতে পারে তাহলে অচিরেই ভারতের বাংলা অঞ্চলগুলো ক্রমশই লুপ্ত হয়ে যাবে। পড়বে প্যান ইন্ডিয়ান হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি রাজনীতির করালগ্রাসে। আর তাই এইবেলা নিজের হালহকিকত, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও আগামী সম্পর্কে হতে হবে সচেতন। নিজের ঘরের ঐক্যের মাধ্যমেই বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্বের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আর তাই – ‘ঘরে কেবা জাগে কেবা ঘুমায় / কে কারে দেখায় স্বপন’— এটা জেনে নেওয়া জরুরি। ‘এই বেলা তোর ঘরের খবর জেনে নে রে মন’।