কোপেনহেগেন: কার্বন দূষণ বা কাকে আমরা 'শিল্প', 'উন্নয়ন' ও 'সভ্যতা' বলে বুঝব?
এক.
দুনিয়া যখন ধ্বংসের পথে সম্মেলনে তখন বাঁশি বাজাতে দেখছি
জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্হিতির মোকাবিলা নিয়ে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বিশ্বসম্মেলন ৭-১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ চলার পর বলা চলে গতকাল তা শুন্য হাতে নিষ্ফলা হয়ে শেষ হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য ১৯২টি সব দেশ এই সম্মেলনে গ্রীণহাউস গ্যাস বা মূলত কার্বন নিঃসরণ (carbon emissions) উদ্গীরণে দুষণের ভয়াবহতার মধ্যে দুনিয়াকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল; যদিও সম্মেলনের কার্যকর কোন সিদ্ধান্তে তা পরিণত হতে পারেনি। ওদিকে, উন্নত দেশগুলোর "শিল্পে" অগ্রসরতার বড়াই আমরা শুনে আসছি বহুদিন থেকে যার আসল মানে, কার্বন দুষণের বড়াই। কিন্তু "শিল্পে" অগ্রসরতার বড়াই ও এর সুবিধা নিতে এতদিন তাদের আমরা যতটা আগ্রহী দেখেছি আজ বিপরীতক্রমে ঠিক ততটাই কার্বন দুষণের বড়াই ও দুনিয়া ধ্বংসের দায়দায়িত্ত্ব নিতে তারা দায়িত্ত্বহীনভাবে অনাগ্রহী ও পিছু হটে পালানোর অজুহাত খুঁজছে; শুধু তাই নয় একই ষ্টাইলে "শিল্পে"র নামে দুনিয়া ধংসের কারবার চলুক এটাই চাইছে।
প্রকৃতিতে সাময়িক আবহাওয়ায় পরিবর্তন নয়, জলবায়ু পর্যায়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত দুষণ বিষয়টা এমন যে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর গড় গ্লোবাল তাপমাত্রা যদি দুই ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বেড়ে যায় তবে সম্ভবত দুনিয়ায় আমাদের জানা প্রজাতিকুলের ৩০-৪০ পার্সেন্ট এর বিলুপ্তি ঘটবে। গত পনেরই ডিসেম্বরে জাতিসংঘের এক কনফিডেন্সিয়াল ডকুমেন্টের একটা মন্তব্যে জানা যাচ্ছে, সম্মেলনের এপর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কাট করা সম্পর্কে ১.৫-২.০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড গড় তাপমাত্রা কমানো নিয়ে যে সব প্রস্তাব খুচরা আলোচনা চলছে তা আসলে প্রায় ৩.০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড গ্লোবাল তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে রোধ করার জন্য যথেষ্ট নয়।
দুনিয়ার সব পশু পাখি গাছপালা মানুষ জীব পানি আর জড় - এসব মিলিয়ে দুনিয়ায় একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে বলেই দুনিয়া টিকে আছে; দুনিয়ায় এই জড় ও প্রাণের বৈচিত্রে এক ভারসাম্যে আছে বলেই একে আমাদের মত করে বা মানুষের দিক থেকে এটাকে ঠাউরে বলি - দুনিয়া মানুষের বসবাসের যোগ্য জায়গা। অথচ এখন গ্লোবাল তাপমাত্রা বাড়ার কারণে কেবল শুধু প্রজাতিকুল নয় ভয়ঙ্কর রকমের সব তাপদহ হল্কা, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, সমুদ্রের উচ্চতা - ঘর, পেশা চ্যুত মানুষ - ক্ষতির এসবই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে; কোথাও কোথাও সেসব ভয়ংকর ক্ষতির আলামতও দেখা দিতে শুরু করেছে।
এতদিন মনে করা হত, এখনও অনেকেই তা ভাবেন, মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক হলো যেন জবরদস্তি করে প্রকৃতির জানু চেপে নিজের আহার সংস্হান বের করাই মানুষের কাজ; আর যথেষ্ট উদার নয় এমন প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিজের শ্রেষ্ঠত্ত্ব কায়েম করাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম। এটাকেই আমরা অনেকের মুখে বলতে শুনি মানুষ তার পরিচয় দিচ্ছে - "প্রকৃতি জয়ী মানুষ" - বলে, আর এর ভিতরই মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে কী ভাবা হয় তা জাহির হতে দেখেছি।
তার মানে প্রকৃতির জানু চেপে ফসল বা মানুষের আহার সংস্হান বের করাই কী মানুষের কাজ, মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক ? নাকি মানুষ প্রকৃতির এক প্রজাতি মাত্র; জড় প্রাণের বৈচিত্রের এক ভারসাম্য এই প্রজাতির বসবাস বেঁচে থাকার শর্ত তৈরি আছে তাই এই মানুষ-প্রজাতি প্রকৃতিতে, দুনিয়ায় আছে?
তবে, মানুষ প্রকৃতির এক প্রজাতি মাত্র - এই বয়ান একটু কম-করে-বলা বয়ান, আন্ডার-ষ্টেটমেন্ট। মানুষ এমনই এক প্রজাতি যে বোঝাবুঝির ক্ষমতা রাখে, জ্ঞান বলে যাকে চিনি - এমন এক শারীরীক ফ্যাকাল্টি ও যোগ্যতা তাঁর আছে। ফলে মানুষ নিজে কেবল প্রকৃতির এক প্রজাতি-মাত্র হলেও সারা প্রকৃতির নিয়ম কানুন, ছন্দ, বৈপরিত্য, বৈচিত্র ভারসাম্য - অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে বসে থাকা নিজেকেসহ সব কিছু সে জানতে বুঝতে পারে। ওদিকে জানা বুঝা মানেই আবার সমস্যা - কারণ মানুষের জানাবুঝা মানে একইসাথে নিজের কর্তব্য করণকর্ম বোধ জাগা; জেনে বুঝে তো কেবল জ্ঞানের পাথর বা ডিব্বা হয়ে বসে থাকা যায় না কারণ, মানুষ মানেই তো একশন - সক্রিয়, তৎপর মানুষ। ফলে কথা কোথায় দাঁড়াল - মানুষ তার কর্তব্য-ধর্ম পালনে কেবল নিজেকে নয়, সারা প্রকৃতির জীব জগৎ প্রাণ সবাই একটা প্রাণবৈচিত্রের মধ্যে ভারসাম্যে যেন থাকে - একে রক্ষা করা, দেখেশুনে রাখা - সেই কর্তব্য। আমরা মৌলবি হলে বলা যেত - মানুষ নূহ নবীর মত দুনিয়াতে আল্লার প্রতিনিধি বা খলিফা হয়ে এই কর্তব্য পালন করে; অথবা, এটা মানুষ আশরাফুল মুখলুকাত হিসাবে তাঁর কর্তব্য; অথবা, প্রজাতি-মানুষ প্রকৃতিতে তাঁর সীমা-কর্তব্য জানে আর আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না - ইত্যাদি এইসব বয়ান।
পাঠক কারও খটকা লাগতে পারে এই ভেবে যে, তাহলে মানুষ আর প্রকৃতি - এদুইয়ের মধ্যে একে অপরের উপর বিজয় ঘোষণার করার সম্পর্কের ব্যাপার নাই তা হয়ত বুঝলাম কিন্তু, দুটোকে আলাদা সত্ত্বা ভাবতে পারি কী? না, আলাদা সত্ত্বা ভাবার প্রশ্নই উঠে না। আগেই বলেছি মানুষ প্রকৃতির এক প্রজাতি মাত্র - অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতিরই এক হিস্যা বা অংশ। সেই অর্থে মানুষও প্রকৃতি তো বটেই। আবার কেবল মানুষের দিকে তাকালে ওর চিন্তা ফ্যাকাল্টি আছে - এই বিশেষ বৈশিষ্টটুকু বাদ দিলে সে তো প্রকৃতির আর পাঁচটা প্রজাতির থেকে আলাদা কিছু নয়। এছাড়া আরও কথা আছে, মানুষ জন্য যা কিছুই তাঁর আহার ভরণপোষণ, জীবনযাপন, সংস্হানের উপায় - এসব কিছুই তো সে সংগ্রহ করে, করা সম্ভব হচ্ছে প্রকৃতির বাকী অংশ থেকে, বাকী অংশের জন্যই তা সম্ভব হচ্ছে; প্রকৃতিকে ভোগ (appropriation) করেই মানুষের জীবনধারণ, জীবন পুণরুৎপাদন ঘটছে, ঘটতে পারছে। ফলে কাকে মানুষ আর কাকে প্রকৃতি বলে ভাগ করব, না এটা অসম্ভব।
তবে ভাব প্রকাশে কথা বলার সময় মনে হয় আমরা মানুষ ও প্রকৃতি বলে একটা ভাগ করে ফেলি। আসলে এটা ঠিক ভাগ করা নয়; বলা উচিত হবে দুই দিক থেকে দেখার, দেখে বলার কারণে একটা পার্থ্ক্য। একই জিনিষকে বিভিন্ন দিকথেকে দেখে কথা বলা যায়, ফলে একটা আপাত পার্থক্য হচ্ছে মনে হতে পারে - এটা সেরকম।
সারকথায়, মানুষ প্রকৃতি যা তাই হয়ে উঠছে অথবা প্রকৃতিই মানুষ হয়ে উঠছে; এভাবে দুটোই বলা যায়।
কথা শুরু করেছিলাম পরিবেশ, জলবায়ু, দূষণ এগুলো নিয়ে - এখন পাঠক চিন্তা করে দেখতে পারেন কার পরিবেশ, জলবায়ু, দূষণ? মানুষের না প্রকৃতির?
দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি, পরিবেশ ব্যাপারগুলো বুঝার ক্ষেত্রে একটা ঘোরতর মৌলিক ও গভীর ফিলসফিক্যাল বা ভাবদর্শনের ব্যাপার আছে আমরা যার কিছুটা ভিতরে ঢুকে পরেছিলাম। এখন আপাতত ফিরব।
তাপমাত্রা দুষণের কথা বলছিলাম। দুষণ নিয়ে কাজ করতে যেয়ে একে কোয়ানটিফাই করে অর্থাৎ একটা পরিমাণগত ধারণা তৈরি করতে হয়েছে। এক্ষেত্রে একধরণের গ্রাউন্ড জিরো বা বেঞ্চমার্ক ধরা হয়েছে ১৯৯০ সালকে। ১৯৯০ সালের সময়ে গ্রীণহাউস গ্যাসের দূষণ যা ছিল দুষণের মাত্রা সে জায়গায় ফিরিয়ে আনতে কত কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে বা পাল্টা পদক্ষেপ নিতে হবে - এই নিয়েই ২৫% বা ৪০% দূষণ কাট করার কথার মানে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সাথে আগামি কত বছরের মধ্যে এই ২৫% বা ৪০% দূষণ কাট করা হবে এটাও গুরুত্ত্বপূর্ণ; কারণ কত বছরের মধ্যে এটা সহ পার্সেন্টের কথা না বললে বছরে কত হারে কাট করা হবে সে কথা বুঝা যাবে না বা কোন মানে দাঁড়ায় না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা ২০২০ সালের মধ্যে ২০% নিঃসরণ দূষণ কাট করা হবে - এটা ধরে নিয়ে এমন একটা ধারণা নিয়ে কার কী দায়, করণীয় তা নিয়ে আলোচনা আগাতে বলছেন। কিন্তু কোপেনহেগেন সম্মেলনে আমরা দেখলাম কিছুই আগাচ্ছে না।
কেন?
দুনিয়া, প্রকৃতি ধ্বংসের ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা বলে যদি দেখি, তার মানে এটা গ্রীণহাউস গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ উদ্গীরণের সমস্যা। ফলে কার্বন নিঃসরণ হার কমানো, ক্ষতিপূরণ - এসবের দায়দায়িত্ত্বের ভাগ নিয়ে ঠেলাঠেলি, কোন আইনী বাধ্যবাধকতার দলিল তৈরির বা না-তৈরির দরকষাকষি - এই হলো কোপেনহেগেন সম্মেলনের বিষয়।
দুই.
আমরা অনেকে মনে করছি, জলবায়ুর ক্ষতির একটা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারলে এই বিশ্বকে ধ্বংস এর হাত থেকে রক্ষা কর যাবে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ আদায় করেই কী এই বিশ্ব প্রকৃতিকে ধ্বংস হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব - এই প্রশ্নকে যাচাই করে দেখবার দরকার আছে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াকে গ্রীনহাউস গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ উদ্গীরণে দূষণের সমস্যা বলে মেনে নেয়ার মানে আসলে "শিল্প" - "industry" ‘civilization’, ‘growth’ and ‘development’ - এসব কথাবার্তা চিন্তাভাবনাগুলোও যে সমস্যার তা মেনে নেয়া; ফালতু বলে প্রমাণ করা; কারণ শব্দগুলো আলাদা মনে হলেও এক সাথে জোড় লাগানো একই উৎসের ধারণা এবং তা চিন্তা তৎপরতার সঙ্কটও বটে। যদিও "শিল্পে" বিশ্বাসীরা কার্বন নিঃসরণ উদ্গীরণের দূষণকে সমস্যা বলে মানলেও এনিয়ে কোন পদক্ষেপ ও তা বাস্তবায়িত করতে আজ পর্যন্ত কখনও কাউকে দেখা যায়নি - না "শিল্পে" উন্নত (developed) পশ্চিমা দেশ না "শিল্পে" উন্নতির-দিকে-ধাবমান (developing) চীন, ভারত ব্রাজিল বা অন্য কেউ - কারও পক্ষেই তা সম্ভব হয়নি। কারণ, কার্বন দুষণ ব্যাপারটাকে "শিল্পে" বিশ্বাসীরা আসলে উটকো দায়, বাগড়া হিসাবে দেখে থাকে, কিন্তু বুঝে মুখে মুখে মেনে নেবার লিপসার্ভিস না দেয়াটা হবে বিপদের। কেউ যদি সত্যি সত্যিই মিন করে থাকেন কার্বন দুষণ মোকাবিলা নিয়ে তিনি ভাবতে চান তবে তাকে অবশ্যই কাকে আমরা এতদিন "industry" ‘civilization’, ‘growth’ and ‘development’ বলে মেনে এসেছি সেই চিন্তা ও তার বাস্তব রূপকে প্রশ্ন করতে পারতে হবে। এমনকি ধরা যাক, কার্বন দূষণ মোকাবিলা নিয়ে ভাবছি বলে সব developed এবং developing "শিল্পের" দেশগুলো যদি কোন চেরাগ বলে ভালমানুষ হয়ে একজোটও হয়, কিন্তু একই "শিল্প" ভাবনা তাড়িত হয়ে উন্নতি, গ্রোথ রেট মাপার পুরনো পথে খাড়িয়ে যায় তবে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি - এই বকোয়াজি একটা অশ্বডিম্ব প্রসব করবে। এর মূল কারণ, ফসিল ফুয়েল ও রিসাইকেলযোগ্য নয় এমন জ্বালানীর উপর দাঁড়ানো "সভ্যতা" "উন্নয়ন" "অর্থনৈতিক গ্রোথ রেট" ইত্যাদিতে উন্নতি মাপা সমাজ-উৎপাদন ধারণার একেবারে উল্টা হলো "কার্বন নিঃসরণ কাট" করার ভাবনা। মনে রাখতে হবে, "শিল্প" বা "industry" ধারণার উপর ভর দিয়েই গেল কয়েক শ বছর ধরে যথেচ্ছাচারে "কার্বন নিঃসরণ ঘটিয়ে এই "সভ্যতা" এখনও দাড়িয়ে আছে। আবার কার্বন নিঃসরণ কমাবে বলে হম্বতম্বি করলেও সেই একই "শিল্প" বা "industry" ধারণা আগলে সবাই বসে আছে, কোন বদল কেউই ঘটায়নি। "শিল্পে"র নামে এই যথেচ্ছাচার ঘটানো হয়েছে প্রকৃতির উপর; প্রকৃতি-মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে কোন বিবেচনা খেয়াল রাখার অবস্হায় "শিল্প" বা "industry" ধারণার নাই, বরং "প্রকৃতির উপর মানুষ বিজয়ী" এই ধরণের ধারণার উপরে ভরসা করে যতখুশি অত্যাচার ঘটানো হয়েছে। মুল কারণ, এটাই মুনাফা-লিপ্সা সর্বস্ব পুঁজির স্বভাবের সাথে খাপ খায়। ফলে মুখে "কার্বন নিঃসরণ কাট" স্বীকার করে নেবার এই বৈপরিত্যের নীট পরিণতি হলো, developed এবং developing সবাই তাল খুঁজেছে একে অন্যের উপর "কার্বন নিঃসরণ কাটের" দায়দায়িত্ত্ব চাপিয়ে দিয়ে যদি এযাত্রায় নিজেকে রক্ষা করা যায়; তাই ভাবা হয়েছে অন্যেরা "কার্বন নিঃসরণ কাট" নিয়ে ব্যস্ত হোক, তখন নিজের "কার্বন নিঃসরণ কাট" এর কাজ নানা অজুহাতে শিকেয় তুলে রেখে বরং ঐ ব্যস্তদের (যদি পাওয়া যায়) ঘাড়ে চড়ে এর বিনিময়ে নিজের "শিল্প", "সভ্যতা"কে অন্যের চেয়ে আগিয়ে রাখতে বাজার সুবিধা নেয়া যাবে। ফলে সবাই একজন "অন্য কাউকে" খুঁজছে; কিন্তু সবাই "অন্য কাউকে" খুঁজতে বের হলে কারোরই কাউকে খুজে পাবার কোন কারণ নাই। ফল হয়েছে এই যে পুঁজির মায়ায় তা আগলে বসে থাকা কেউ আর ভাববার অবস্হায় নাই যে কার্বন নিঃসরণ সমস্যাটা গ্লোবাল। কেউ দুষণ করে থাকুক আর না থাকুক, এটা কাউকে ছাড়বে না। এই পরিস্হিতিই, ১৯৯৭ সালে গৃহিত কিয়োটো প্রটোকলকে স্রেফ কাগুজে টুকরা বানিয়ে ছেড়েছে। সংক্ষেপে কিয়োটো প্রটোকল সম্পর্কে পাঠককে একটু ধারণা দেই।
জাতিসংঘের অধীনে ১৯৯৪ মার্চে এর সদস্য দেশ নিয়ে গঠিত হয় The UN Framework Convention of Climate Change (UNFCCC)। এই UNFCCC Convention এর ম্যন্ডেট ও উদ্দেশ্য হলো, দুনিয়াতে গ্রীনহাউস গ্যাস দূষণ মোকাবিলা নিয়ে স্ব স্ব দেশে একটা জাতীয় ষ্ট্রাটেজি ঠিক করতে সবার সাথে তথ্য শেয়ার করা আর, করণীয় নিয়ে বছরে একবার সকলে মিলে বসা - এই বার্ষিক বৈঠকের ব্যাপারটাই Cnference of Parties or COP নামে পরিচিত। সেইভাবে COP এর তৃতীয় বার্ষিক বৈঠক ১৯৯৭ সালে COP3 নামে জাপানের Kyoto শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐ বার্ষিক বৈঠকে এই প্রথম সব সদস্য দেশের জন্য আইনী বাধ্যবাধকতামূলক পালনীয় শর্ত রেখে একটা সমঝোতা-চুক্তি বা প্রটোকল গৃহীত হয়, যা "কিয়োটো প্রটোকল" নামে পরিচিতি পায়। জাতিসংঘের কোন Framework Convention বা কর্মপরিধি নির্ধারণের সম্মেলনে, গৃহিত কোন সমঝোতা-চুক্তি বা প্রটোকল সদস্যদেশের প্রতিনিধির স্বাক্ষরের সাথে সাথে তা ঐ দেশের উপর প্রযোজ্য হয় না যতক্ষণ না, ঐ সদস্য দেশের নিজের পার্লামেন্ট বা আইন পরিষদে তা পুনরায় পাস হয়ে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরসহ গৃহিত বা ratify না হয়। এত বিস্তারিত করে বলছি এজন্য যে, প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের আমেরিকা কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর করলেও তা কখনও ratify করেনি। বুশ এটা চুপে চাপে ঘটাননি। বরং অথর্ব যুক্তি খাড়া করে বলেছেন, নিজের অর্থনীতি, শিল্প এখনও এর জন্য তৈরি নয়, এতে সে ক্ষতিগ্রস্হ হবে। আরও মারাত্মকভাবে বলেছিলেন, "কার্বন নিঃসরণ কাট" ইত্যাদি যাই বলা বা করা হোক না কেন, আমেরিকান জনগণের "লাইফ ষ্টাইলে" কোন পরিবর্তনে হাত দেয়া যাবে না। ২০০১ সালের COP6 এ জর্জ বুশ এসেছিলেন নতুন বায়না নিয়ে; বলেছিলেন এটা বহুত খরচের ব্যাপার তাই এর বোঝা কেবল "শিল্পে" উন্নত (developed) পশ্চিমা দেশ নয়, বরং "শিল্পে" উন্নতির-দিকে-ধাবমান (developing) যেমন চীন বা ভারত এদেরকেও নিতে হবে। তাঁর এভাবে নতুন বায়না ধরার কারণ হলো, কিয়োটো প্রটোকলে সকলে একমত হয়েছিল, ৩৭টা "শিল্পে" উন্নত দেশ যাদের "শিল্প" ৯০ ভাগ দূষণের জন্য দায়ী তাদেরকে একটা আইনী বাধ্যতামূলক টার্গেট দিয়ে তা ২০১২ সালের মধ্যে শেষ করার দায়িত্ত্বের কথা ওখানে বলা ছিল।
তার মানে কিয়োটো প্রটোকলের পরিণতি হলো, গ্রীণহাউস গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ উদ্গীরণে দুষণের সমস্যা বলে মানলেও স্বীকৃত এই সমস্যাকে হাল করতে কাউকেই এক কদম আগে বাড়তে হয়নি। এর প্রথম আট বছর অর্থাৎ ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল লেগে যায় প্রটোকল কার্যকর হতে; কারণ মোট সদস্যের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক দেশ রেটিফাই না করলে প্রটোকল কার্যকর হয়েছে বলে ধরা হয় না। ওদিকে প্রতিবছর COP এর সভা - ডেডলক আর পুনরায় এক ঠুনকো সমঝোতা - এভাবেই চলেছিল। আর সবচেয়ে বেশি দূষণের মাত্রা যার সেই আমেরিকা বারবার নতুন নতুন বাহানা নিয়ে হাজির হয়েছিল; যেমন গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেয় (carbon sinks), কিন্তু কোন "শিল্প" উন্নত দুষণকারী দেশের ঘাড়ে গণনা হিসাব কষে কার্বন নিঃসরণ কাট করার দায়ভার যা পড়েছিল তা গাছ থেকে যা সুবিধা পাওয়া যায় তার বাইরে বা উপরের দায়; কিন্তু আমেরিকা প্রস্তাব রাখতে চেয়েছিল তার গাছ-বনাঞ্চলকে এই দায়ের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতে। এর কারণ, এক হিসাব অনুযায়ী আমেরিকার গাছ বনাঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত ধরে নিলে এক ঝটকায় সে দুষণের সব দায় থেকে নিজেকে মুক্ত বলে দাবি করতে পারে।
একইভাবেই আরও নানান ক্যাচালে পড়ে কিয়োটো প্রটোকল; এমন একটা হলো, বাস্তবায়নের প্রযুক্তিগত দিক ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা; এতে স্হবিরতা, স্হবিরতা ভাঙতে আবার সমঝোতা ইত্যাদি করতে করতে হঠাৎ সবার দৃষ্টি পড়ে ২০১২ সালে কিয়োটো প্রটোকলের আয়ু শেষ হয়ে যাবে, এক্সপায়ার হবে। ফলে সব বিতর্ক আলোচনা ছাপিয়ে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে আর একটা নতুন প্রটোকল নিয়ে কী করা যায় সেই ভাবনা; তখনই ২০০৯ সালের COP15 কে নতুন প্রটোকল বানানোর টার্গেট ঠিক করে আগানো শুরু হয়; এটাই এবারের ২০০৯ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলন।
আসলে জর্জ বুশের সেই নিত্যনতুন বায়না - "বহুত খরচের ব্যাপার তাই এর বোঝা কেবল "শিল্পে" উন্নত (developed) পশ্চিমা দেশ নয়, বরং "শিল্পে" উন্নতির-দিকে-ধাবমান (developing) যেমন চীন বা ভারত এদেরকেও নিতে হবে" - এটাকে বিবেচনায় নিয়ে পশ্চিমাদেশগুলো কিয়োটো প্রটোকলে তাদের একক দায় স্বীকার করে নেয়া কমিটমেন্ট থেকে বেরোবার পথ খুজে নিতে চাইছিল। কারণ, আমাদের নিশ্চয় মনর আছে, কিয়োটো প্রটোকলে সকলে একমত হয়েছিল যে, ৩৭টা "শিল্পে" উন্নত দেশ দূষণের একক দায় স্বীকার করছে ও কমিটমেন্ট রাখছে যে ২০১২ সালের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্হ দেশের জন্য ক্ষতিপূরণ মূলক পদক্ষেপ নিবে।
কোপেহেগেন ব্যর্থ সম্মেলনের ফলাফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এতে যার যা সুবিধা নেবার দরকার ছিল পেয়ে গেছে; আর মারা পড়েছে এজমালি প্রকৃতি আর আমাদের মত গরীব দেশ। পশ্চিমাদেশগুলো কিয়োটো প্রটোকলের কমিটমেন্ট থেকে সফল ভাবে সরে যেতে পেরেছে। ওটা এখন কাগুজে তেনা। আবার নতুন কোন কমিটমেন্ট বা দায় তার কাঁধে নাই। দায় খরচের বিতর্ক তুলতে সফল হয়ে সে দায় এখন যেন এজমালি প্রকৃতির - আর কারও নয়।
ওদিকে লক্ষণীয় হলো, কিয়োটো প্রটোকলের কারণে আমরা - ইউরোপ ও আমেরিকায় - এভাবে "শিল্পে" উন্নত দেশের ক্যাম্পে বিভক্তি দেখেছিলাম। কারণ দূষণের একক দায় সেখানে "শিল্পে" উন্নত দেশের বলে স্বীকৃতি ছিল, ফলে দায় ঠেলাঠেলি, বিভক্তি ছিল ওদের মধ্যে।
এবার আমরা দেখছি ইউরোপ ও আমেরিকা এক জোট হয়ে খাঁড়া হয়েছে, "শিল্পে" উন্নতির-দিকে-ধাবমান (developing) যেমন চীন বা ভারত এদের বিরুদ্ধে। ভাগের এজমালি মা গঙ্গা পায়না দশা; দায়ভাগের ঠেলাঠেলি এখানে developed আর developing "শিল্পে"র দেশের মধ্যে। তবে ওদের সবার মাঝে কমন জিনিষটা হলো, সকলেই আকড়ে পড়ে আছে - "শিল্প" তাদের করতেই হবে। যেন এককথার মানুষ সকলে। "শিল্প": অর্থাৎ "industry" ‘civilization’, ‘growth’ and ‘development’ এর পিছনে থাকতেই হবে, তাতে প্রকৃতি, দুনিয়া মানুষ সব জাহান্নামে যায় যাক। চীন বা ভারত চেয়েছে, আমরা আর একটু দুনিয়াকে নরক বানিয়ে হলেও "শিল্পে" উন্নতি করে নেই অর্থাৎ "industry" ‘civilization’, ‘growth’ and ‘development’ করে নেই। পশ্চিমের সমান প্রকৃতি খুনী হয়ে নেই। আমরা "শিল্পে" উন্নতির-দিকে-ধাবমান (developing) দেশ, আমাদেরকে বাগড়া দিয়েন না। এরপর ক্ষতিপূরণ দিতে হলে সে দেখা যাবে। অথচ বাস্তবতা সবাই জানে; আমরা কেউই নিশ্চিত জানি না ততদিনে "শিল্পে"র এই উন্নতি দেখা বা কনজুমার হওয়ার মত কেউ অবশিষ্ট থাকবে কিনা, খোদ প্রকৃতিই বসবাসের যোগ্য রইবে কিনা!
এই সম্মেলনে চীন ও ভারত চেয়েছে কোন politically binding document বা আইনী বাধ্যবাধকতার কমিটমেন্টে না যেতে, সব কিছু voluntary measures এর হাতে ছেড়ে দিতে। অথচ সবাই জানে ক্যাপিটালিজমের মুনাফার প্রতিযোগিতায়, বাজার দখলে একে অন্যের উপর সুবিধা নিতে উদ্যত পরিস্হিতিতে voluntary measures বলে কোন সোনার পাথরের বাটির জায়গা নাই।
একটা হিসাব দিয়ে বলা হচ্ছে, ৭০০ বিলিয়ন ডলার খরচে নাকি দুনিয়াকে সাফসুতারা করে ফেলা যায়। আচ্ছা, এই ৭০০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে আমরা কী কী কিনব? intellectual property rights এ আগাপাশতলা বাধা কোন উচ্চ মার্গীয় টেকনোলজি? কর্পোরেট তেল ও গ্যাস কোম্পানীর বিপুল স্বার্থের নতুন টেকনোলজি?
আমেরিকার কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালান এমন একজন climatologist, James White বলছেন, "This is a collision between science and politics, frankly," অর্থাৎ তিনি, রাজনীতি ও বিজ্ঞানের একটা বিবাদ শুরু হয়ে গেছে বলে দেখছেন। তিনি আরও বলছেন, "আজকের অনেক জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ কর্পোরেট তেল ও গ্যাস কোম্পানীর বিপুল স্বার্থের হয়ে লড়তে শুরু করেছেন; এটা ১৯৬০ এর দশকের কিছু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মত যারা সিগারেট কোম্পানীর হয়ে লড়তে বিজ্ঞানকে কাঁথার তলে লুকিয়ে রাখত"।
তার মানে বুঝা যাচ্ছে, ইতোমধ্যেই অনেক জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ কর্পোরেট তেল ও গ্যাস কোম্পানীর বিপুল স্বার্থের পক্ষের কর্পোরেট "শিল্পের" রাজনীতিকে "বিজ্ঞান" হিসাবে খাঁড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন; তাই James White জবানের আমরা কিছু জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ(?) কর্পোরেট তেল ও গ্যাস কোম্পানীর বিপুল স্বার্থের হয়ে লড়তে শুরু করেছেন বলে জানছি। এরা নিশ্চয় এতদিনে কর্পোরেট তেল ও গ্যাস কোম্পানীর টেকনোলজি(?) হাজির করতে সক্ষম হয়ে গেছেন। নইলে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের গল্প তো আকাশ থেকে পড়েনি, আমরা অনুমান করতে পারি।
এবার ওবামা কথাই একটু ধরি; সম্মেলনে তিনি এসে আমাদেরকে দয়া দেখিয়ে কমিটমেন্ট করে বলেছেন, ১০০ বিলিয়ন ডলার তারা দুষণে ক্ষতিগ্রস্হ গরীব দেশের পিছনে ক্ষতিপূরণের খয়রাত হিসাবে দান করতে চান? কিন্তু ঐ ১০০ বিলিয়ন ডলার কি সে খরচ হবে? intellectual property rights এ আগাপাশতলা বাধা কোন উচ্চ মার্গীয় টেকনোলজি কিনতে নিশ্চয়। তাহলে কার টাকায় কে কী কিনল?
এরপর সেখানে কী হবে? ঐ ১০০ বিলিয়ন ডলারের টেকনোলজি যে effective demand তৈরি করবে তাতে আবার ১:১০ অনুপাতের হিসাবে ধরলে, ১০০০ বিলিয়ন ডলারের টেকনোলজি, পণ্য, ক্লিন(?) জ্বালানির মত নতুন ব্যবসার লাইন হাজির হবে, কনজুমার হয়ে উঠব আমরা? নতুন ব্যবসার লাইন জমে উঠবে নিশ্চয়।
এটা খুবই জবরদস্ত আঁটঘাট মারা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ বটে! আর সেই "ক্ষতিপূরণ" ভিক্ষাকে টার্গেট করে বাংলাদেশ সরকার সম্মেলনে তাঁর অবস্হান ঠিক করেছে; বিরাট কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের জন্য সরকারি কোষাগার খালি করে সরকার প্রধান সদলবলে ছুটেছে! সত্যিই এটা চমৎকার!
ওদিকে কোপেনহেগেনে কিছু না হওয়া বা করার জন্য দোষারোপ করার অজুহাত সবাই যার যার হাতে পেয়ে গিয়েছে। developed আর developing সবার রাস্তা একই - "শিল্প"। তারা দুজনেই একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে এমন অজুহাতও রেডি পেয়েছে। অথচ ফ্যাক্টস হলো, গ্রীণহাউস গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ উদ্গীরণ দুষণের সমস্যা বলে একে মানা না মানায় নয়, আসল গলদ হলো, "industry" ‘civilization’, ‘growth’, ‘development’ - এই ধারণাগুলোর সাথে কার্বন নিঃসরণ উদ্গীরণ দুষণকে সমস্যা বলে মানা, এই ধারণা - দুটো পরস্পর ঘোরতর স্ববিরোধী; এর একটাকে সিনসিয়ারলি মানলে অপরটার সেখানে জায়গা নাই। বরং এক ধারণা অপরকে উৎখাত করে তবেই কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এমন। তবু তারা ভাব করে যাবে তারা "শিল্পও" চায় আবার "কার্বন নিঃসরণ কাট" করতে চায়, এবং এতে ‘civilization’, ‘growth’, ‘development’ দুনিয়ায় আমাদের প্রকৃতি নাকি মানুষ বসবাসের জায়গা হয়ে অটুটও থাকবে!