২. সাত থেকে দশ ডিসেম্বর


সাত তারিখের ঘটনার মধ্য দিয়ে আরও পরিষ্কার হোল বিএনপি আসলে কী চায় সেটা পরিষ্কার ভাবে বিএনপি এখনও বলে নি, বলাবাহুল্য বলার দরকার রয়েছে। আমরা চাই বা না চাই তুফান তো ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। এর আগে ‘গণমুখী রাজনৈতিক ধারার নীতি ও কৌশল প্রসঙ্গে’ নিবন্ধে আমি বলেছি নীতি হিশাবে বিজয়ী গণভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার কথা জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে। এটাই গণরাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে নতুন করে ‘গঠন’ করার নীতি বা পথ।

তবে বিএনপিকে ‘গণমুখী’ রাজনৈতিক দল গণ্য করে তাদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলি নি। বিএনপি এর আগে ক্ষমতায় ছিল, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি সম্পর্কে নির্মোহ ধারণা আমাদের থাকা দরকার। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলা দূরের কথা শক্তিশালী গণমুখী চিন্তার ধারাও আমরা বাংলাদেশের গড়ে তুলতে পারিনি। কিন্তু তারপরও গণমুখী রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতার কথা আমাদের বলতে হবে। উপায় নাই। জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করা ছাড়া সমাজের কোন গুণগত পরিবর্তন সম্ভব না, কোন শর্টকাট রাস্তা নাই। তাই অনেক কথা দূরবর্তী মনে হলেও তা এখনই বলতে হবে এবং সেই সকল কথা সমাজে হাজির রাখতে হবে। ঝোড়ো বাতাসে উড়ে যেতে না চাইলে, যে কথা বলা দরকার সেটা অবশ্যই বলতে হবে।

তবে ‘নীতি’ এক কথা আর বাস্তবে তা অর্জনের কৌশল নির্ণয় সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আমরা নীতি আর কৌশলের ফারাক এখনও বুঝি না, এই দিকটা বাংলাদেশে খুবই অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন। এর ফলে রাজনীতির অনেক সঠিক অবস্থান সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয়। এই অভাব দ্রুত কাটিয়ে ওঠা দরকার। বিএনপিকে সভা সমাবেশ করতে না দেওয়া, নেতাকর্মীদের খুন করা, গুম করা, আইন বহির্ভূত ভাবে হত্যা ইত্যাদির বিরুদ্ধে স্রেফ নীতিগত কারণে অবশ্যই প্রতিবাদ জানাতে হবে। এটা কৌশল নয়, নীতি। অন্যদিকে বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের ওপর অন্যায় জুলুমেরও আমরা প্রতিবাদ করেছি। আগামিতেও করব।

এটাও মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদ শুধু আওয়ামী লীগে নাই, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলেই আছে। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে যখন চিন্তার বিকাশ ঘটে না এবং জনগণকে যখন তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন ‘জনগণ’ (People) নামক কোন সচেতন রাজনৈতিক কর্তাসত্তা সমাজে হাজির থাকে না। যারা হাজির থাকে তাদের রাজনৈতিক পরিভাষায় বলা হয় ‘ভিড়’ বা 'গণভিড়’ (Mob) । বাংলায় ‘মব’ কথাটার ভালো বাংলা নাই, কিন্তু 'গণভিড়' বা ‘মব’ই হচ্ছে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। রাজনোইতিক দলগুলো মুলত নিজেদের জনগণের প্রতিনিধি বললেও তারা ভিড় বা সংখ্যা ম্যানিপুলেট করাকে ‘রাজনীতি’ বলে থাকে। এ ব্যাপারে অবশ্যই আমাদের সচেতন ও সাবধান হতে হবে।

তাহলে সাধারণ ভাবে সমাজের ফ্যাসিস্ট প্রবণতা চিহ্নিত করা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা গণতন্ত্র চর্চা করে না, এটা আমরা বলি, কিন্তু একে গুরুত্ব দেই কি? দল, ধর্ম বা মতাদর্শ নির্বেশেষে মানুষের মর্যাদা রক্ষা ও মানবাধিকার লংঘনের প্রশ্নে বাংলাদেশের সমাজ কতোটা সচেতন? আইনী দিক থেকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার লংঘনকে আমরা কিভাবে দেখি? যে দল আমরা সমর্থন করি সেই দল মানবাধিকার লংঘন করলে সে দলের প্রতি সমর্থন ও আনুগত্য আমাদের থাকা উচিত কি? আজ যারা বলছে বিএনপির আমলেও নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘন হয়েছে, তারা মিথ্যা বলছেন না, কিন্তু বর্তমান আওয়ামী আমলে তা যে মাত্রায় এবং যে হিংস্রতায় পৌঁছছে তা বহাল রাখলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিশাবে টিকবে না। ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ তাই এখন বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

কারও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে দল, ধর্ম, মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রে গড়িমসি করাটাই ফ্যাসিস্ট প্রবণতার দৃশ্যমান লক্ষণ। বহু ভাবে বিভক্ত অবিকশিত বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনী পরিসরে এটা এখনও মারাত্মক সমস্যা।

তাহলে বিএনপিকে এটা পরিষ্কার বুঝতে হবে সমাজের বৃহৎ একটি অংশের বিএনপির প্রতি সমর্থন নিঃশর্ত নয়, কারন বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের সেই শাসনামলের তক্ত অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা সদাসর্বদা সহনীয় ছিল বলা যাবে না। কিন্তু ক্ষমতা চ্যূত হবার পর থেকেএবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে দলটি ভয়াবহ রাজনৈতিক অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার বা ভিকটিম। এর কারনে অনেকে বিএনপিকে সমর্থন দিচ্ছেন। এই সমর্থন বিএনপির নেতৃত্বের ওপর কিম্বা বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শের ওপর আস্থা নয়। বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ আসলে কী সেটা এখনও অস্পষ্ট ও অপরিচ্ছন্ন। এই দিকটি নিয়ে বিএনপিকে দ্রুত ভাবতে হবে। ইতোমধ্যে পৃথিবী নিজের অক্ষরেখায় বহুবার ঘুরে এসেছে, সুর্য ডুবেছে আর উঠেছে, ইত্যাদি। ২০২২ সালে দেশের নেতৃত্ব দিতে হলে বিএনপিকে আগের চেয়ে আরও পরিণত ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হবে। নিদেন পক্ষে বিএনপি যে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী সংস্করণ নয় তার কিছু নমুনা বা ইশারা থকা দরকার।

ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের ক্ষেত্রে বিএনপির প্রতি জনগণের বর্তমান সমর্থন দল হিশাবে কিম্বা আদর্শের দিক থেকে বিএনপিকে সমর্থন ভাবলে বিএনপি মারাত্মক ভুল করবে। জনগণ শুধু রাষ্ট্রের রূপান্তর নয়, বিএনপিরও গুণগত রূপান্তর চায় -- বিনেপি যতো দ্রুত এটা বুঝবে ততোই তা দেশের জন্য মঙ্গল। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে তরুণ নেতৃত্ব বিএনপির মধ্যে গড়ে উঠেছে – এই কঠিন লড়াইয়ে যাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ঘটছে, তাদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটবে এটা আশা করা দুরাশা নয়, কারন সমাজের রাজনোইতিক চিন্তাচেতনার বিবর্তন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ঘটে। আন্দোলন-সংগ্রামের চেয়ে রাজনীতির উন্নত ও কার্যকর পাঠশালা আর কোত্থাও নাই।

এই বিবেচনা সত্ত্বও জনগণ বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। আমি নিজেও মনে করি বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ও আইন ব্যবস্থার যে ধরণ তার কারণে বিএনপির লক্ষ লক্ষ কর্মীদের ওপর ঝুলে থাকা মামলা এবং তাদের হত্যা ও গুমের বিচার করতে হলে বিএনপির অবশ্যই ক্ষমতায় যাওয়া দরকার। বাংলাদেশের বিপুল তরুণ সমাজের অপচয় ও জীবন বরবাদ করে দেবার এই প্রক্রিয়ার অবসান হওয়া দরকার। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্য নয়, নিদেন পক্ষে একটা স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনবার জন্যই দরকার। শুভবুদ্ধি থাকলে ব্যাপক প্রতিহিংসা এড়াবার বাস্তব অনেক পথ এখনও খোলা রয়েছে। এমনকি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর চালু রাখা গেলে বহু তরুণের জীবন অপচয় থেকে রক্ষা পেত।

আফসোস, বাংলাদেশের রাজনীতি ঘোরতর তারুণ্য বিরোধী। পৃথিবীর আর কোথাও তারুণ্যের শক্তির অবিশ্বাস্য বিপুল অপচয় দেখা যায় কিনা সন্দেহ। একে অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

#বিএনপি, #বাংলাদেশ

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।