৪. সাত থেকে দশ ডিসেম্বর


বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে আট তারিখ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। শুরুতে গোয়েন্দারা জানিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দারা তাদের আটক করেছেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের প্রতি ককটেল মারার মামলা দেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া প্রধান বিরোধী দলের মহা সচিব এবং স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যকে আটক করতে পেরেছে পুলিশ। কোন আইনী বাধার মুখোমুখি হয় নি। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট রূপ বারবার সাধারণের মানুষের চোখে ধরা পড়ছে। এই ধরণের ঘটনায় জনগণের মধ্যে ক্রোধ সঞ্চারিত হয়েছে তীব্র ভাবে। কিন্তু একে রাজনৈতিক ভাবে প্রকাশ করবার পথ ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তুষে যখন একবার আগুন লাগে তাকে ছাই মেরে নেভানো যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতি সহিংসতার পথে আরেক কদম অগ্রসর হোল। নিশ্চয়ই জনগণের ক্ষোভের কোন না কোন প্রকাশ ঘটবে।

স্রেফ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গোয়েন্দা পুলিশ কোন নাগরিককে শেষ রাতে ঘর থেকে তুলে গোয়েন্দা অফিসে নিতে পারা কিনা সেটা গুরুতর আইনী ও রাজনৈতিক প্রশ্ন শুধু নয়, রাষ্ট্রগঠনের গোড়ার প্রশ্নও বটে। কারন আমরা এমন কোন রাষ্ট্র গঠন করিনি যার দ্বারা নাগরিকদের তাদের নিজের ঘরে নরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। এই সকল ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার মারাত্মক অভাব রয়েছে। গণরাজনীতির প্রথম কাজ হচ্ছে জনগণের মধ্যে সেই সচেতনতা তৈরি করা। এই বিষময় অবস্থা বিএনপিকেও বুঝতে হবে। এই বিষাক্ত বাস্তবতা স্রেফ নির্বাচন দিয়ে সমাধান করা যাবে না। রাষ্ট্রের গঠন মানবিক মর্যাদা ও নাগরিক অধিকা্রের ভিত্তিতে না হলে আমরা ক্রমশ আরও গভীর খাদের দিকে নামতে থাকব। চল্মান গৃহযুদ্ধ ক্রমশ আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।

আমি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি যে একাত্তরের পর থেকে আওয়ামী লীগ ‘বাঙালি জাতিবাদ’, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ মিলিয়ে যে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ তৈরি করেছে তার দ্বারা তারা আজ অবধি কার্যত দিল্লীর পক্ষে বাংলাদেশে একটি গৃহযুদ্ধই চালিয়ে আসছে। এর দুটো লক্ষ্য ছিল, প্রথমত, কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশে কোন স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও আর্থ-সামজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে না দেওয়া। দ্বিতীয়ত দিল্লীর তরফে বাংলাদেশে ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতি শক্তিশালী করা।

যদি ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয় তাহলে ভারতের সংবিধানে যাই থাকুক, ভারত পাকিস্তানের বিপরীতে একটি ‘সফট” হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হিশাবেই জন্ম লাভ করেছে। শুধু পাকিস্তান ইসলামকে রাষ্ট্রের ভিত্তি বানিয়েছে তা না। ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তিও শুরু থেকেই হিন্দুত্ব, যার হিংস্র রূপ আমরা ক্রমে ক্রমে প্রত্যক্ষ করেছি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের সময় ভারতীয় রাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী চরিত্র ও সন্ত্রাসী চেহারা আরও পরিস্ফূট হয়েছে।

বাঙালি জাতিবাদীদের বয়ান হচ্ছে বাঙালি ও পাঞ্জাবির জাতিবাদী দ্বন্দের কারণে এবং বাংলাদেশে বাঙালি জাতিবাদের বিকাশের ফলেই পাকিস্তান ভেঙেছে এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। এটা অবশ্যই ভুল বয়ান। মূলত সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতা্র জন্যই পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছে। 'লিগাল ফ্রেইম ওয়ার্ক অর্ডার’-এর অধীনে সত্তরের নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে নতুন ভাবে গঠন, যাতে বিভিন্ন প্রদেশের জনগণের স্বার্থের ভারসাম্য অর্জন করা যায়, এক সঙ্গে সবাই মিলে এক রাষ্ট্রে যুক্ত থাকবার জন্য দরকার ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসন। পাকিস্তানী শাসকরা রাজনৈতিক সংকট সমাধান দূরে থাক, উলটা নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে ও গণহত্যা ঘটিয়ে পাকিস্তানকেই শুধু কবর দেয় নি, ইসলামের ইতিহাসে একটি কলংকজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে, যার মূল্য মুসলিম উম্মাহকে দিতে হচ্ছে। আগামি দিনেও দিতে হবে। কারন পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী গণহত্যার ঘৃণ্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ধর্মের নামে, ইসলামের নামে। ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতি বাংলাদেশে দীর্ঘকাল টিকে থাকবার এটাই প্রধান কারণ।

কিন্তু সময় এসেছে বাঙালি জাতিবাদী বয়ানকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার। সেটা ঘটছেও বটে এখন। কিন্তু সেটা তখনই রাজনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হবে যদি বাংলাদেশ এখন নতুন ভাবে রাষ্ট্র গঠনের মর্ম বোঝে। জনগণকে সচেতন হতে শুরু করে। অতীতের ক্ষত ও বিভাজনের উর্ধে উঠে বাংলাদেশ নতুন ভাবে ‘গঠন’ করাই এখনকার প্রধান রাজনীতি। বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা উৎখাত করে নতুন ভাবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাব বাংলাদেশ ‘গঠন’ করা ছাড়া মানুষের মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং নাগরিক ও মানবিক অধিকার আমরা কায়েম করতে পারব না। যে কোন সময় গোয়েন্দা পুলিশ বাসা থেকে যে কাউকেই তুলে নিয়ে যেতে পারবে।

এটা ভাল যে জনগণ আওয়ামি-ফ্যাসিস্টদের রূপ সচক্ষে দেখছে।

কিন্তু ইতিহাস বিস্মৃত হবার অসুখ যেন আমাদের আবার পেয়ে না বসে। আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা কোথা থেকে কোথায় এসেছি। হাজার সমালোচনা থাকলেও উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা এবং উপনিবেশোত্তর স্বাধীন পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য শেখ মুজিবর রহমানের অসামান্য ঐতিহাসিক অবদান ভুলে গেলে চলবে না। ফ্যাসিজমের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে ইতিহাস মুছে ফেলা। দ্বিতীয়ত সকল মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ এবং বীরদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে ভুলে যাওয়া। সমালোচনা করুন, সেটা চিন্তাশীল জনগোষ্ঠির লক্ষণ। কিন্তু সাধারণ মানুষ ও সৈনিকদের বিপ্লবী মৈত্রীর প্রতীক সৈনিক জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির প্রশংসা করাও জরুরি। তিনি বাংলাদেশের জনগণের জাতিবাদী পরিচয় নয় – কে বাঙালি আর কে বাঙালি নয় সেই জাতিবাদী সংকীর্ণতা থেকে তিনি বের হয়ে আসতে চেষ্টা করেছেন। জাতিবাদী পরিচয়কে তিনি সামনে আনতে চান নি। বরং ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও সকল নৃগোষ্ঠি প্রত্যকেই বাংলাদেশী। যে রাষ্ট্রের ধারণা তিনি দিতে চেয়েছে সেটা সকল ‘বাংলাদেশী জনগণের রাষ্ট্র, শুধু বাঙালিদের না । তবে আফসোস বিএনপি সেই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বাস্তবায়ন করতে পারে নি। যার মূল্য বিএনপিকে এখন দিতে হচ্ছে।

দিল্লী কেন ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা রাখার কাজ অনিবার্য ভাবেই করবে সেটা বাহাত্তরের পর আমাদের অনেকের কাছে পরিষ্কার ছিল। আহমদ ছফা যেমন। আমাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল ভূ-রাজনৈতিক। কারন আমরা পরিষ্কার বুঝেছিলাম রাজনৈতিক ভাবে স্থিতিশীল,অর্থনৈতিক ভাবে সফল বাংলাদেশ ভারতের তথাকথিত অখণ্ডতার সব চেয়ে বড় হুমকি। দিল্লীর শাসকরাও -- বিশেষত শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং’ – এই সহজ বাস্তবতা সহজেই বুঝেছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ যদি রাজনৈতিক ভাবে স্থিতিশীল, সামাজিক ভাবে অগ্রসর এবং অর্থনৈতিক ভাবে উন্নতি করতে পারে তাহলে ভারতের অন্যান্য জাতিরাও নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশাবে কায়েম করতে অনুপ্রাণিত হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেককে অনুপ্রাণিত করেছিল আসামসহ যেসব রাজ্য ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ আমরা লক্ষ্য করি। উলফা তাদের দেশ আসাম স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামও করেছে। তেমনি অন্যান্য রাজ্যেও বিদ্রোহ হয়েছে। ভারতে নিপীড়িত রাজ্যগুলোর স্বাধীনিতার দাবি হ্রাস পেয়েছে সেটা ঠিক নয়। ফলে বাংলাদেশকে সবসময়ই অস্থিতিশীল রাখাই দিল্লীর প্রধান রাজনীতি।

ভারত বহু জাতি, বহু ধর্ম ও বহুভাষাভাষীর দেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বলাবাহুল্য, উপমহাদেশ প্রতিটি নিপীড়িত জাতির মুক্তির আকাংখার প্রতীক, সেই আকাঙ্ক্ষা তীব্র হওয়া সফল ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশ গড়ে তোলার ওপর নির্ভর। দিল্লী তা ঘটতে দিতে চায় না। বাংলাদেশের সফলতার বা ব্যর্থতার ওপর আঞ্চলিক রাজনীতির গতি ও অভিমুখ নির্ধারিত হতে বাধ্য।

ইংরেজ যেভাবে অগ্রপশ্চাত বিবেচনে না করে উপমহাদেশের মানচিত্র ছেঁটেছে তাতে বহু দেশ ও জাতিগোষ্ঠি ঐতিহাসিক ভাবে ভারতের অন্তর্গত না হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে ভারতের অধীনস্থ করা হয়েছে। ইংরেজ ইতিহাস, ধর্ম বা ভাষাকে বিবেচনায় নেয় নি, বরং দুই বৃহৎ জাতিবাদী ধর্মগোষ্ঠি – হিন্দু ও মুসলমানের দাবিদাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছে।

জাতিবাদের যুগে মুসলিম জাতিবাদী ধারাকে হেয় ও নাকচ করবার জন্য হিন্দুত্ববাদী ও অখণ্ড ভারততত্ত্ববাদীদের প্রধান প্রপাগান্ডা ছিল মুসলমানরাই দ্বিজাতিতত্ত্ব বানিয়েছে, তার ভিত্তিতে ভারত ভাগ করেছে। সাম্প্রতিক গপবেষণায় সেইসব মিথ্য প্রমাণিত হয়েছে।

এটা পরিষ্কার বাংলাদেশ নিজেকে বদলে নেবার নতুন রাজনৈতিক বৃত্তে প্রবেশ করেছে। ের পরিণতি ইতিবাচক হবে। কারণ পরিস্থিতি বাংলাদেশের জনগণে অনুকুলে।

#বিএনপি, #বাংলাদেশ


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।