দারিদ্র ও ইনসাফ
এক
জাতীয় ইনসাফ কমিটি গত ১৬ মার্চে তাদের প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। বাংলাদেশে চিন্তার দুর্ভিক্ষ এতোই প্রবল যে দৈনিক পত্রিকাগুলো গণরাজনৈতিক সত্তা হিশাবে রাষ্ট্রের ‘গঠন’-কে স্রেফ আইনী ব্যাপার ধরে নিয়েছে। তাদের রিপোর্টে সকলেই লিখেছে আমরা নাকি নতুন সংবিধান চাইছি। অথচ আমরা বলেছি রাষ্ট্র স্রেফ ‘আইনী’ প্রতিষ্ঠান নয় যে উকিল-ব্যারিস্টারদের ধরে এনে একটি টুকলিফাই সংবিধান লিখে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশ হিশাবে আমরা এখনও এই সকল কলোনিয়াল হ্যাঙ্গওভার কাটিয়ে উঠতে পারি নি। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিভাবে ‘গঠিত’ হয়, কিভাবে জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে ধারন করে এবং সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে জনগণ কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক ও আইনী সম্পর্ক রাষ্ট্র গঠন সভায় (Constituent Assembly) সকলে মিলে তর্কবিতর্ক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্ণয় করে –সে সম্পর্কে কোন ধারণা গড়ে ওঠে নি। ‘গঠন’ করবার ধারণা অনেক বড়, ব্যাপক ও গভীর। তদুপরি স্বাধীনতা অর্জন যে যথেষ্ট না, রাষ্ট্র যে ‘গঠন’ করতে হয় এবং নির্বাচনের আগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও যে সবার আগে ‘গঠন’ করা জরুরি- এই সকল সহজ সাধারণ সত্য সম্পর্কে আমাদের সমাজে সচেতনতার মাত্রা খুবই কম। ফলে আমরা নির্বাচনকেই ‘গণতন্ত্র’ মনে করি। এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিকৃত এতোই প্রবল যে এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে গণতন্ত্র কিভাবে ‘গঠন’ করতে হয় সেটা জনগণকে বোঝানো বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে গোড়ার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এই অজ্ঞতা ও রাজনৈতিক অসচেতনতার কারনে গণতন্ত্রকে স্রেফ এক লুটেরা শ্রেণি বা গোষ্ঠির পরিবর্তে আরেক লুটেরা শ্রেণি বা গোষ্ঠিকে চার পাঁচ বছর পর পর নির্বাচিত করে আমাদের নতুন করে লুট ও শোষণ করবার ব্যবস্থা জারি রাখায় পরিণত করেছি। দারুন এক ব্যবস্থা! এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। গণতন্ত্রে নির্বাচন লাগবে, সেটা তর্কের বিষয় নয়। কিন্তু আগে গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। রাজনৈতিক অর্থে জনগণের প্রতি ইনসাফ কায়েমের এটাই সরল পথ।
তাই আমরা বলেছি, “জনগণের বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী একটি নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ণে কাজে হাত দেওয়া। ‘গঠন’ থেকে ‘গঠনতন্ত্র’। অর্থাৎ গণতন্ত্র গঠন করবার কাজ। সেই কাজ সবার আগে, তারপর নির্বাচন। গণতন্ত্র কায়েম করা গেলেই নির্বাচন তাকে সচল রাখতে পারে। কিন্তু গঠনের কাজ বাদ দিয়ে নির্বাচনকেই গণতন্ত্র হিশাবেহাজির করবার যে ধারা বাংলাদেশে জারি রয়েছে তার বিপদ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠা সবচেয়ে জরুরি কাজ।
গণতন্ত্র কায়েম একটি গাঠনিক (Constitutive) প্রক্রিয়া। কিছু উকিল-ব্যারিস্টার ধরে নিয়ে এসে ‘সংবিধান’ লিখিয়ে নেবার কাজ না। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় জনগণকেই প্রকাশ করবার সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ তৈরি করতে হবে সবার আগে। কি ধরণের রাষ্ট্র বর্তমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতায় জনগণ গড়তে চায় সেটা জনগণই পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে নির্ণয় করবে। জনগণের বিজয়ী গণভ্যূত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হবে এই প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করা। কোন আজগবি বা মনগড়া সিদ্ধান্ত নয়, জনগণ তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কি ধরণের রাষ্ট্র ‘গঠন’ করতে চায় সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে আন্তরিক ভাবে জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনার কাজটাই এখন সবচেয়ে বেশী জরুরি।
‘গঠন’ করবার কাজ, পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া থেকে তৈরি দলিলকেই ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) বলা হয়। গঠনতন্ত্রে জাতীয় সংসদ কিভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে, কিভাবে বিচার ও প্রতিরক্ষা বিভাগ ‘গঠনতন্ত্র’ রক্ষা করে, কিভাবে নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রের দৈনন্দিনের কাজ পরিচালনা করে ইত্যাদি বিষয়ে জনগণের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকে। কিন্তু সংবিধানকে এখন যেভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তির বানানো ‘সর্বোচ্চ’ আইন বলে দাবি করা হয় সেটা না। যেমন,জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট’ পাশ করলেই সেটা ‘আইন’ হয়ে যায় না। অর্থাৎ জাতীয় সংসদ চাইলেই চাইলেই তাদের সিদ্ধান্তকে ‘আইন’ বলে ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ফ্যাসিস্ট শক্তির আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে বলেই সেটা আইন হতে পারে না,কারন তা জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গঠনতন্ত্র হোল জনগণ যে ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ‘গঠন’ করেছে কোন আইন দ্বারা সেই ‘গঠন’-কে নস্যাৎ করা যাবে না। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে নস্যাৎ করবার যে কোন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জনগণের বিদ্রোহ, প্রতিরোধ বা গণঅভ্যূত্থান সে কারণেই আইন ও রাষ্ট্রতত্ত্বে বৈধ বলে গৃহীত। তাই জনগণের বিজয়ী গণভ্যূত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হচ্ছে এই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের গঠনের প্রক্রিয়াকে সবল ও গতিশীল করে তোলা। ত্বরান্বিত করা। জনগণ যেন তাদের বাস্তব সমস্যার সমাধান বাস্তবোচিত ভাবে হাজির করতে পারে তার প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিশ্চিত করা। বিজয়ী গণঅভ্যূত্থান সফল হলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ তাই প্রতিটি ইউনিয়নে, প্রতিটি উপজেলায় প্রতিটি জেলায় জনগণ কিভাবে নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চায় তার পরামর্শ আন্তরিকতা ও মনোযোগের সঙ্গে শোনা। রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিইয়ায় সমাজের সকল স্তরে জনগণকে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবে।
তাই আমরা বলেছি নতুন ভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ একটি সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। স্রেফ আইনি বা সাংবিধানিক ব্যাপার না। অতীতে উকিল-ব্যারিস্টারদের মুসাবিদাকে বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ হিশাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।এই ধরণের কাজ কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিক শক্তি করে। কারন তারা তাদের তৈরি আইন বা সংবিধান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। তাই ‘গঠন’ মানে যে এক খানা সংবিধান লিখে দেওয়া নয়, এটা সংবাদ মাধ্যমগুলো বোঝে নি। অসুবিধান নাই। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। কারন এর জন্য তারা একা দায়ী নয়, বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতই প্রধানত দায়ী।
তাহলেই একটা কথা পরিষ্কার থাকা ভাল। না, আমরা স্রেফ পুরানা সংবিধানের জায়গা আরেকটি নতুন ‘সংবিধান’-এর কথা বলছি না, আমরা আরও গোড়ায় গিয়ে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার (Constitute) কথা বলছি।
মনে রাখা দরকার জনগণ বলতে সুনির্দিষ্ট ভাবে আমরা বুঝিয়েছি যারা ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়ছে,রক্ত দিচ্ছে,শহিদ হয়েছে। বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উৎখাত করাই যাদের ইচ্ছা। তাহলে জনগণ নামক কোন আলুর বস্তা আমরা অনুমান করি নি, কিম্বা প্রচলিত রাজনীতিতে জনগণকে যেভাবে স্রেফ ভোটের সংখ্যা বানানো হয় এবং কেনাবেচা চলে, জনগণকে আমরা এরকম হীন গণ্য করি না। গণতন্ত্র এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে ফারাক পরিষ্কার দেখিয়ে দেওয়ার ওপর বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। জনগণের বিজয়ী অভ্যূত্থানকে অবশ্যই ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গোড়াসুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে, যেন কোন প্রকার ছল চাতুরি, প্রতারণা বা অন্তঃসারশূন্য গণতন্ত্রের নামে আবার ফিরে আসতে না পারে।
এই আলোকেই বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ কথাটা বুঝতে হবে। ধরুন আপনি একই ঘরে সকলে মিলে বাস করবেন, তাহলে একসঙ্গে বাস করতে হলে সকলে মিলে অবশ্যই সকল মৌলিক ও আদর্শিক বিষয়ে সামাজিক বা সামষ্টিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশ্যই সমাজের বৈষয়িক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক, আত্মিক ও আইনী বিষয়ে একমত হতে হবে, সেই গণ-মতাদর্শই নিজেদের রাজনৈতিক ভাবে ‘গঠন’ করবার পূর্বশর্ত।
দুই
এই আলোকে তাহলে দারিদ্য ও ইনসাফ নিয়ে ভাবা যাক। যেমন ধরুন আমরা যে নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চাইছি সেখানে গরিব, অনাহারি, ভুখানাঙা, দরিদ্র, অসহায়, অবহেলিত কোন মানুষ থাকবে কিনা? এটা কি রাষ্ট্রের দ্বারা বলবৎযোগ্য কোন আইন? এই ক্ষেত্রে দেখা যায় শোষক শ্রেণী সংবিধানের মৌলিক অংশে জনগণকে প্রতারিত করবার জন্য অনেক বড় বড় কথা লিখে রাখে। কিন্তু সবই যে স্রেফ বকোয়াজি । এইগুলো কথার কথা হিশাবে সংবিধানের পৃষ্ঠা বাড়ায়। সেটা ধরা পড়ে যখন তারা এক লাইনে বলে যে “এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎ হইবে না”। প্রশ্ন হোল বলবৎ হবে না কেন? এই গোড়ার জিজ্ঞাসাই আগামি দিনে রাষ্ট্র গঠন করবার প্রক্রিয়ায় আমাদের তুলতে হবে। যেমন রাষ্ট্র কি এমন কোন নীতি গ্রহণ করতে পারে যা জনগণের বৃহৎ অংশকে ভূমিহীন, সর্বহারা, ভুখা, নাঙা, আশ্রয়হীনে পরিণত করে? ধরা যাক রাষ্ট্র এখন যে কাছাখোলা অবাধ বাজার ব্যবস্থা নীতি হিশাবে গ্রহণ করেছে যার ফলে অল্প কিছু পরিবার কোটি কোটি সম্পত্তির মালিক হচ্ছে, অবাধে টাকা পাচার করছে, আমাদের নদি, জমি, প্রকৃতি ও পরবেশ দূষিত করছে জনগণ যে রাষ্ট্র ‘গঠন’ করবে সেখানে কি জনগণ এই অবস্থা চলতে দেবে? তাহলে প্রতিকার কি হবে? আমরা একদিকে লুটেরা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা কাছাখোলা বাজারব্যবস্থা কায়েম করব এবং বাংলাদেশকে কাঁটাতারে ঘিরে রাখা সস্তা শ্রমিক বানাবার কারাগার বানাবো তারপর বলব আসো উৎসব করে করে আমাদের ভোট দাও – এটা কি চলতে দেওয়া উচিত? এখানে দারিদ্য ও ইন্সাফের প্রশ্ন সাদাসরল প্রশ্ন হিশাবে আমাদের সামনে চলে আসে। আমরা কি এমন একটি আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করতে দেব যেখান একদিকে সর্ভারা, ভখা, নাঙা মানুষ তৈরি হচ্ছে আর অপরদিকে এক শ্রেণীর মানুষের হাতে কোটি কোটি টাকা জমা হচ্ছে। অল্প কিছু লোক অতিশয় ধনি আর বিশাল অংশ সর্বহারা, গরিব ও অনাহারি। তখন কি আমরা বিদ্যানন্দ বা ‘এক টাকার আহার’ জাতীয় লঙ্গরখানা খুলে অনাহারিদের খাওয়াবো? এখন যেমন দেখছি? নাকি রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি এমন হবে যে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক নীতির কারনে কেউ দরিদ্র থাকবে না। অনাহারি থাকার তো প্রশ্নই আসে না। তাহলে রাষ্ট্র ‘গঠন’ করবার গোড়ায় এই ধরনের গোড়ার প্রশ্ন নিয়ে আমাদের অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যারা অনাহারির প্রতি দরদি,তাঁদের প্রতি আমাদের ভালবাসা আছে,নৈতিক দায় থেকে কার্যক্রম গ্রহণ করা তাঁদের কাজ আমরা সমর্থন করি। কিন্তু এটা অনাহার বা দারিদ্রের সমাধান না। দারিদ্র নিয়ে কথা রাষ্ট্রের পর্যায়ে বা রাষ্ট্রের নীতির পর্যায়ে – ইন্সায়েফ কায়েমের প্রশ হিশাবে তুলতে হবে। রাষ্ট্র গঠন করবার প্রক্রিয়াতেই আমামদের স্পষ্ট করে বলতে হবে রাষ্ট্র কি পারে, আর কি পারে না। তাই সবার আগে ‘ইনসাফ’ নিয়ে কথা বলা জরুরি। প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে হবে কেন সমাজে বিশাল সংখ্যক মানুষ অনাহারি থাকে? অপুষ্টিতে ভোগে? এই ধরনের সমাজ আমরা টিকিয়ে রাখছি কেন? যদি বিদ্যানন্দ লঙ্গরখানা খুলতে পারে রাষ্ট্র কেন মোড়ে মোড়ে তাহলে লঙ্গরখানা খোলে না?
রাষ্ট্র কি লঙ্গরখানা? রাষ্ট্রের কাজ কি বিদ্যানন্দ হওয়া? নাকি কাউকে যেন লঙ্গরখানা খুলতে না হয় সেই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, বাজেট ও কর্মসূচি গ্রহণ করা। কিম্বা রাষ্ট্র যেন লঙ্গরখানা খুলতে হয় এমন কোন নীতি যেন সরকার গ্রহণ করতে না পারে তার জন্য সঠিক ‘গঠনতন্ত্র’ (Constitution) প্রণয়ন ও বলবৎযোগ্য করা। তার মানে রাষ্ট্র গঠন করবার শুরুতেই রাষ্ট্রের গাঠনিক চরিত্র হিশাবে তাকে এমন ভাবে তৈয়ার করতে হবে যেন কাউওকে লঙ্গরখানা খুলতে না হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র যেন এমন কোন নীতি গ্রহণ বা বা আইন প্রণয়ন করতে না পারে যাতে দারিদ্য, আনাহার, অভাব ইত্যাদি তৈতি হয়। সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি – বিশেষয় জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রগুলোর সর্বনাশ ঘটাবার কোন ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্রকে সেই সকল কাজে বিরত রাখবার জন্য যথাযথ গঠনতন্ত্র (Constition) প্রণয়ন জরুরু। এখানেই রাষ্ট্রের সঙ্গে লঙ্গরখানার পার্থক্য। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণে বা গঠনপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা বা গাঠনিক প্রক্রিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করার ফলে আজ আমরা ঘোর আর্থ-সামাজিক সংকটের মধ্যে পড়েছি। গাঠনিক প্রক্রিইয়ার গোড়াতেই এই প্রশ্নগুলো তোলা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাষ্ট্রের নামে সমাজকে যেমন অবাধ বাজার ব্যবস্থা বা নিউ লিবারেল ইকনমিক পলিসির যূপকাষ্ঠে বলি দেওয়া যাবে না, বরং বাজার ব্যস্থার গতিশীল ও ইতিবাচক দিক উৎসাহিত করতে হবে, অন্যদিকে অল্প কিছু ব্যক্তির হাতে দেশের সম্পদ পুঞ্জিবভূত হবার নীতি, আইন ও প্রক্রিয়াকেও রোধ করতে। রাষ্ট্র গণস্বার্থ বিরোধী কো আইন পাশ করতে পারবে না। সেটা রাষ্ট্র অনায়াসেই ব্যবসা বা কোম্পানি আইন, ব্যাংক আইন, মুদ্রা ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইন এবং ট্যাক্স বা খাজনা বা আয়কর আইন দিয়ে সমাধান করতে পারে। রাষ্ট্র অবশ্যই তা আইনের দ্বারা বলবৎ করতে পারে। ক্ষ্মতাসীনরা যদি জনগণের আর্থ-সামাজিক স্বার্থ বিরোধী আইন করে তাহলে অবশ্যই আদালতে নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে নালিশ করবার ব্যবস্থা থাকতে হবে।তা নিয়ে শনানি হবে, তর্ক বিতর্ক হবে এবং সুলের জন্য যা মঙ্গল রাষ্ট্রকে সেই সিদ্ধান্তই নিতে হবে। কিন্তু আমরা তা করব না তখন সমাজও বিদ্যানন্দ হয়ে যাবে। লঙ্গরখ্না ছাড়া মানুষ বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।আমরা এমন এক রাষ্ট্র গঠন করতে চাই যেখানে বিদ্যানন্দের লঙ্গরখানায় এক টাকায় আহারের জন্য ভুখা, দরিদ্র, অসহায় মানুষ ভিড় জমাবে না।
এটা কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। তাহলে কিভাবে সম্ভব সে বিষয়ে এখনই আমাদের পরস্পরের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক আলাপ আলোচনা শুরু করে দিতে হবে। অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বে দারিদ্র বিমোচনের সঠিক পদক্ষেপ কি হতে পারে আমাদের তরুণদের মধ্যে সেই তর্কবিতর্ককে উৎসাহিত করতে হবে। অনাহার ও ক্ষুধা থেকে জনগণকে মুক্ত করতে হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখনই অর্থশাস্ত্র বা সমাজতত্ত্বের যে সকল বিষয় পড়ানো হচ্ছে বা যাদের আমরা পড়ছি তা আদৌ আমাদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন তুলতে হবে। অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে আইনের সম্বন্ধ যেম বুঝতে হবে, তেমই সমাজের সঙ্গে আইনের সম্বন্ধও ভাল্ভাবে বুঝতে হবে।তরুণদের লড়াই শুরু করতে হবে পাঠ্যবই থেকে। যে বই পড়লে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমস্যার সমাধান হয় না, বরং সংকট আরও বাড়ে, সেই সকল পাঠ্যবই পড়বো কেন আমরা ? বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল চিন্তাবিদ বা শিরোমণিদের পড়ানো হচ্ছে তারা কি জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য লিখেছেন নাকি কর্পোরেট জগত বা শোষক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য লিখেছেন? – এ ধরণের গোড়ার প্রশ্ন আমাদের তুলতে হবে। আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রের বিভাগ এতো দুর্বল। কেন অর্থশাস্ত্র এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় দক্ষ তরুণ প্রজন্ম গড়ে না তুলে আমরা তরুণদের মাস্টার অব বিজিনেস এডমিনিস্ট্রেশান পড়াই? কেন পড়াচ্ছি? কারন আমাদের সস্তায় বহুজাতিক কোম্পানি বা ব্যবসায়ীদের জন্য গোলাম সাপ্লাই দিতে হবে। আমরা গোলাম তৈরির কারখানা বসিয়েছি। গণরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি পাকাপোক্ত করবার কারিগর আমরা বানাচ্ছি না। এটা চলতে পারে না।
তিন
দারিদ্র ও ইনসাফের প্রশ্ন শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া থেকে আলাদা কিছু না। তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণকে নেতৃত্ব দিতে পারে সেই ধরণের নেতৃত্ব বিকাশের জন্য আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তৈরি করি নি। ফলে আমরা একদিকে হাতুড়ি লীগ ও হেলমেটধারি পাচ্ছি, বিপরীতে পাচ্ছি তরুণদের বিশাল একটি অংশ যারা বিসিএস দিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের আমলা হতে চায়। যারা রাজনীতিতে আসে তাদের পরিণতি হয় অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনে জিতে বড় জোর সংসদ সদস্য হওয়া। রাজনীতির জগতে টাউট তৈরির পরিবেশ এতোই প্রবল যে তারাও নব্য টাউট হওয়া শেখে। তারপরও আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি দুনিয়া কাঁপানো নেতৃত্ব বিকাশের শর্ত বাংলাদেশে হাজির। এই ধরনের সঠিক প্রশ্ন তোলাই গণমুখি রাজনীতি শক্তিশালী করবার বুদ্ধিবৃত্তিক শর্ত তৈরি করে। আমরা একেই গাঠনিক তৎপরতা অর্থাৎ আগামি বাংলাদেশ ‘গঠন’ করবার রাজনৈতিক তৎপরতা গণ্য করি। জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটির প্রধান কাজ এইসব।এ কারনেই আমরা বলি আমরা রাজনৈতিক দল না। বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের আলোকে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার শর্ত জোরদার করাই আমাদের কাজ। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার যদি আমাদের গঠনের গোড়ায় থাকে তাহলে অনাহার ও দারিদ্রের মতো সমস্যা বা সংকট মোকাবিলার সূত্রগুলো আমরা সহজে পাব বলে বিশ্বাস করি।
তাহলে সবার আগে আমরা যারা নতুন ভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ করতে চাই আমাদের অবশ্যই পরস্পরের সঙ্গে এখনই কথা বলতে হবে। কথা বলার মধ্য দিয়েই শক্তিশালী রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলা মানে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার শক্তিশালী পরিসর গড়ে তোলা। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বিপরীতে জনগণের মধ্যে মতাদর্শিক তর্কবিতর্কগুলোর মীমাংসা করা। প্রাচীন কালে বড় বড় দার্শনিকরা বলে গিয়েছেন মানুষের সঙ্গে জীবজন্তুর প্রধান পার্থক্য হচ্ছে মানুষ কথা বলতে পারে এবং কথা বলার মধ্য দিয়েই তাদের সমস্যা, সংকট ও দ্বন্দ্বের সমাধানও মানুষ করতে সক্ষম। আমরা এই ক্ষেত্রে এরিস্টটলের নাম জানি বটে, কিন্তু কথাসম্পন্ন মানুষের ধারণা ইসলামেরও গোড়ার কথা। কারন আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করার পর তাকে প্রথম যে রুহানি শক্তি দান করেছে্ন সেটা হোল ভাষা। তেমনি সনাতন বলি, বৌদ্ধ জৈন বা যে কোন ধর্ম বলি কথার শক্তি সম্পর্কে নানান ভাবে সকল ধর্মই নানা ভাবে আমাদের নিশ্চিত করেছে। যেমন, আদি ‘ওঁ’বা ওংকার থেকেই সৃষ্টির উৎপত্তি। কিম্বা আদিতে বাক্য ঈশ্বরের কাছে ছিলেন, ইত্যাদি। সামাজিক মানুষের জন্য ভাষা ও পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথন কতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার পক্ষে ভূরি ভূরি দার্শনিক কথা বলে গিয়েছেন। যদি আমরা শক্তিশালী গণমুখি রাজনৈতিক ধারার জন্ম দিতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের পরস্পরের মধ্যে কথা বলতে হবে।
কথা বলার গুরুত্বের কথা বলা সহজ, কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থতিতে বাস্তবায়ন কঠিন। আমরা তা জানি। তাই আমরা যখন বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ করার কথা বলি, আর গণমাধ্যমসহ অনেকে যখন তাকে স্রেফ নতুন ‘সংবিধান’ বানানো বোঝে – তখন আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারি কতো বিশাল পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। গঠন করবার প্রক্রিয়াকে আমরা কোন ইউটোপিয়া বা কাল্পনিক বাসনার জায়গায় রাখি নি। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো লম্বা দাবিনামার বাজারি ফর্দ যেভাবে হাজির করে, আমরা তা করছি না। আমরা বলেছি জাতিসংঘে গৃহীত সকল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সনদ,ঘোষণা,চুক্তি,কর্মসূচি ইত্যাদিকেই বাংলাদেশে বাস্তবায়নের আলোকে হাজির, পর্যালোচনা এবং প্রাসঙ্গিক করে তোলা আমাদের এখনকার প্রধান কাজ। বাংলাদেশের জনগণ জানে না যে বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কিভাবে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সার্বজনীন মানবাধিকার ক্রমাগত লংঘন করে যাচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক ভাবে আমাদের প্রাপ্য জনগণের জন্য আমরা তা অবিলম্বে আদায় করে নিতে চাই। সেই দিক থেকে বাংলাদেশ নতুন ভাবে ‘গঠন’ করার প্রাক্টিকাল অর্থ হচ্ছে যে সকল সার্বজনীন মানবাধিকার ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক ভাবে জাতিসংঘে গৃহীত এবং আন্তর্জাতিক আইন হিশাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে তাকে বাংলাদেশে বাস্তবায়নের জন্য তীব্র ও শক্তিশালী মানবাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলা। এই আন্দোলন শুধু শহরে করলে হবে না। সমাজের সকল স্তরে সর্বব্যাপী আন্দোলন হিশাবে গড়ে তুলতে হবে।
মানবাধিকার আন্দোলনকে আমরা অনেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবি। কিন্তু সেটা ঠিক না। বিচ্ছিন্ন ভাবার কারন হচ্ছে মানবাধিকার এবং দেশে দেশে মানবাধিকার অর্জনের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কিছুই বিশেষ খবর রাখি না। আমাদের স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাগরিক ও মানবিক অধিকারের সঙ্গে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সম্পর্ক একদমই পড়ানো হয় না। ফলে শিশু-কিশোর বয়স থেকেই আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি যে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে যেভাবে আমরা দেখি বা দেখছি সেটাই বুঝি স্বাভাবিক ব্যাপার। বুঝি, মানবাধিকারের সঙ্গে রাজনীতি বা রাষ্ট্রের কোন সম্পর্ক নাই। অস্বাভাবিক অবস্থাকেই আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া শুরু করেছি। রাজনীতি এখন হয়ে গিয়েছে মানবিক ও নাগরিক অধিকারের প্রতি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে কয়েকটি সংঘবদ্ধ বাহিনীর রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার প্রতিযোগিতা। যে যতোবেশী সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধ সেই দলের ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনাও ততো বেশী। কে জনগণকে প্রতি পাঁচ বছর পরপর লুট, ডাকাতি, জুলুম করবে, শাসন ও শাস্তি দেবে -- ‘নির্বাচন’ মানে তারই প্রতিযোগিতা। আমাদের বোঝানো হয় এটাই নাকি গণতন্ত্র!
ইতিহাস নিষ্ঠার সঙ্গে পড়লেই আমরা বুঝতাম ইউরোপে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেছে নাগরিক ও মানবিক অধিকার আদায়ের দাবি হিশাবে। ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণাই ছিল নাগরিক ও মানবিক অধিকারের ঘোষণা (The Declaration of the Rights of Man and of the Citizen (1789)। এই ঘোষণা গৃহীত হয়েছে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনসভায় (National Constituent Assembly)। অতএব মানবাধিকার বাস্তবায়ন বা ইনসাফ কায়েম অবশ্যই রাজনৈতিক বিষয়। মানুষ খেতে পাচ্ছে না, মেয়েরা আকছার ধর্ষিত হচ্ছে, অপুষ্টি ও অনাহারে শিশুরা মরছে ,ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে, লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী আমাদের গুলি করে মারছে, মায়ানমারে গণহত্যার পরিণতিতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আজ বাংলাদেশে – আমাদের মানধিকার পরিস্থিতির দুঃসহ অবস্থার তালিকা অনেক দীর্ঘ। তালিকার কোন শেষ নাই। এটাই হবার কথা। বিশেষত যেখানে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম রেখে অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির শাসনকে বৈধ প্রমাণ করবার পদ্ধতিকে আমরা গণতন্ত্র বলি, তাহলে আর কি প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা পরিষ্কার দেখি যে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভবই ঘটেছে নাগরিক ও মানবিক অধিকার কায়েমের জন্য নিপীড়িত,লাঞ্ছিত,বঞ্চিত জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য জালিম রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে। মানবাধিকার, রাজনীতি বা রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদের সমাজে চরম অজ্ঞতা রয়েছে। সেই অজ্ঞতা ও অসচেতনতা টিকিয়ে রেখে শাসক ও শোষক শ্রেণীর নানান কিসিমের রাজনৈতিক দল ক্রমাগত জনগণকে প্রতারিত করে যাচ্ছে। কাজের মাধ্যমেই এই বাধাগুলো আমরা অতিক্রম করতে পারব আশা করি। রাজনৈতিক তৎপরতাকে বাংলাদেশে মানবাধিকার, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে অনুমান করবার যে আত্মঘাতী ধারা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে আমরা তা আর চলতে দিতে পারি না।
চার
বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনকে সুনির্দিষ্ট মানবাধিকার কায়েমের প্রশ্ন হিশাবে হাজির করা এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কাজ। এর প্রধান দিক হচ্ছে দারিদ্র্যকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে স্বীকার করে নেওয়া এবং সেভাবে তাকে সমাধানের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করা। জাতিসংঘের মানবাধিকা সংক্রান্ত নতুন বিশেষ র্যা পর্টিয়ার মিজ হিলাল এলভার (Hilal Elver,) ঠিক এই কথাটাই খাদ্যের অধিকার (Right to Food) সংক্রান্ত আলোচনায় সম্প্রতি তুলেছিলেন।জাতিসংঘের উনসত্তরতম সাধারন সভায় প্রথম প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, “পেটভরে খাবার অধিকার বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হলে, নতুন করে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি অপরিহার্য”। তিনি বলেছেন যারা এই দিকে নজর রাখেন তাদের অবশ্যই সেইসব দেশগুলোর প্রতি নজর দিতে হবে যারা এই বিষয়ে নীতি ও আইন গ্রহণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
তাঁর এই বক্তব্য শুধু ক্ষমতাসীনদের জন্য নয়, ক্ষমতার বাইরে থেকে যারা ক্ষমতায় যাবার জন্য প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, তাদের জন্যও বটে। তাই আমরা বিনয়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করতে চাই বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষুধা ও দারিদ্য থেকে মুক্তি দেবার ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাবনা ও চিন্তাভাবনাটা আসলে কি? কিভাবে তারা বাংলাদেশের জনগণকে অভাব, দারিদ্য ও অনাহার থেকে মুক্তি দেবেন? তাঁরা ভোটের অধিকার চাইছেন, আমরা তা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করি, কিন্তু পর্যাপ্ত খাদ্য ও পুষ্টির অধিকার, অভাব ও দারিদ্য থেকে মুক্তির অধিকারসহ অন্য সকল আন্তর্জাতিক ভাবে গৃহীত অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাটা আসলে কি? হিলাল এলভার যেভাবে বলছেন যে খাদ্য ও পুষ্টির অধিকারকে মানবাধিকার হিশাবে গণ্য করতে হবে। ফলে তা অবশ্যই রাজনৈতিক ইস্যু, বিদ্যানন্দের লঙ্গরখানা খোলার দয়া দাক্ষিণ্যের ব্যাপার না। সার্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের দায় এবং নৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গে এখানে বিরাট রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক ফারাক আছে। আমরা তা রাষ্ট্রকে যেমন, তেমনি সকল রাজনৈতিক দলকে বলতে চাই, জনগণের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করা যুগপৎ মানবাধিকার ও রাজনৈতিক ইস্যু। কিভাবে আমরা তার সমাধান করতে পারি, আসুন তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলি।
এই ক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট দল, সরকার বা রাষ্ট্রশক্তিকে দায়মুক্তি দেবার কোন সুযোগ নাই। ফ্যাসিস্ট শক্তি কত ভয়াবহ হতে পারে তার প্রমাণ আমরা হাতে নাতেই সম্প্রতি পেয়েছি। গরিব, দরিদ্র ও অনাহারি মানুষের কাছে স্বাধীনতার তাৎপর্য মাছ, মাংস খাওয়ার স্বাধীনতা’ – এই সংবাদের জন্য প্রথম আলোর সাংবাদিক ও সম্পাদকের ওপর হিংস্র ভাবে ফ্যাসিস্ট শক্তি যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছে তা রীতিমতো নজির বিহীন।
যদি হিলাল এলভারের কথা ধরি,তাহলে খাদ্যের অধিকারকে মানবাধিকার হিশাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সমস্ত মানুষের জন্য,বিশেষ করে সবচেয়ে প্রান্তিক এবং দুর্বলদের জন্য এ অধিকার নিশ্চিত করা ইন্সাফ কায়েমের প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি দারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কারণগুলি মোকাবিলা জরুরি। এই ভাবে মানবাধিকারের প্রশ্নকে আমাদের কংক্রিট সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে দৈনন্দিনের প্রশ্ন হিশাবে সামনে আনতে হবে। যারা নির্বাচনে ভোট চাইবে, তাদের জিজ্ঞাসা করুন তারা কিভাবে আপনার খাদ্য সমস্যার সমাধান করবে, তার জন্য তাদের আদৌ কোন প্রস্তুতি আছে কিনা। কিম্বা সমাধানের যোগ্যতা তারা কিভাবে অর্জন করবে? জিজ্ঞাসা করুন দারিদ্র মোকাবিলার জন্য তারা কি ধরণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আদর্শ গণ্য করে? বাংলাদেশের বাস্তবতায় সেই আদর্শ বাস্তবায়নের কৌশল কি হবে? আমরা চাই রাষ্ট্রকে যেমন জনগনের কাছে জবাবদিহি করা জরুরি, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোকেও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা জরুরি।
দারিদ্র্য শুধু একটি অর্থনৈতিক বা সামাজিক সমস্যা নয় দারিদ্র মানবাধিকার লঙ্ঘন।। দারিদ্র মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। পর্যাপ্ত খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং একটি শালীন জীবনযাত্রার অধিকার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। ।
দারিদ্র্য সরাসরি সমাজ ও অর্থনীতির কাঠামোগত অসমতা এবং বৈষম্যের ফলাফল। তার জন্য পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকে কিভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের অভিমুখে পরিচালিত করা যায় তার জন্য সামাজিক তর্কবিতর্কের দরকার আছে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কিম্বা আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল আমাদের কাঠামগত সমস্যা নিরসন করতে পারবে না। কিন্তু দারিদ্য বিমোচনের নামে আমরা ক্রমাগত বাংলাদেশকে ঋণি এবং পরমুখাপেক্ষি করে তুলেছি। তাছাড়া আমাদের মধ্যে নারী-পুরুষ ভেদ রয়েছে, গরিব ও দারিদ্রের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে শ্রেণি, ধর্ম ও জাতিগত বৈষম্য এবং সম্পদ ও ক্ষমতার অসম বণ্টন। তাহলে দারিদ্র্যের প্রতি ইনসাফের জন্য দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতেহলে মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমলে নিতে হবে। দারিদ্রের মূল কারণগুলির দিকে তাকাতে হবে এবং গোড়ার সমস্যাগুলোকে সবার আগে সমাধান করবার জন্য জনগণকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করবার নীতি ও কৌশল গ্রহণ করাই এই মূহূর্তের সবচেয়ে দরকারি কাজ।
১০ মার্চ ২০২২।। শ্যামলী।