মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ: রণক্ষেত্র ও আর্থ-সামাজিক যুদ্ধ
জাফর ভাইকে ডায়ালাইসিস নিতে হবে, এটা আমি কখনও ভাবি নি। কিন্তু তিনি নির্বিকার। কোন কাজের কথা থাকলে ফোন দিলেই চলে যেতাম। কাজের গতিতে কোন খামতি নাই। যখন অসুস্থতা তাঁকে কাবু করে ফেলছে, তারপরও তাঁর টেলিভিশান টক শোতে সুযোগ পেলেই হাজির থাকতেন। ডায়ালাইসিস নিতে নিতে নিজের বেডে বসে কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচিতে হুইল চেয়ারে বসে ছুটে গিয়েছেন। মৃত্যুর আগে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের বিছানায় জোর করে তাঁকে ধরে বেঁধে রাখতে হয়েছে। একদমই অসুস্থ হয়ে পড়ার পর একদিন তাঁকে দেখে মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে যাই। ঠিক করেছিলাম আর যাব না। এই শীর্ণকায় অসুস্থ জাফর ভাইকে আমি চিনি না। মৃত্যুর দুইদিন আগে ফরিদা আখতার আর আমি আবার গিয়েছিলাম। বসতে চেয়েছিলেন, ধরে ডাক্তার নার্সদের চেষ্টায় বসানো হোল কিছুক্ষণ। একটু পানি খেতে চেয়েছিলেন সে সময়। তাঁকে বহুকষ্টে বসা অবস্থায় এই শেষ দেখা। এরপর সেই অমোঘ রাত্রি এল। সাদাপোশাকে যখন তিনি শেষবারের মতো যাবার প্রস্তুতি নিয়েছেন, তখন আরেকবার দেখলাম।
বলাবাহুল্য তাঁর প্রিয় মানুষদের কাছে তিনি নানান ভাবে স্মৃতি হয়ে থাকবেন, নানান রূপে নানান অর্থ নিয়ে স্মৃতি আমাদের বারবার তাড়া করবে। বন্ধুদের মধ্যে গল্পে গল্পে ফিরে আসবেন। তবে সত্য এই যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটা কালপর্ব শেষ হোল। এখন মূল্যায়নও করতে হবে আমাদের সেই ইতিহাসের গোড়া থেকে। দেশের মানুষ তাঁকে গভীর ভালবাসা থেকে যে সম্মান দিয়েছে সেটা তাঁর প্রাপ্য। আমাদের এখন যে কাজটা করতে হবে সেটা হোল বাংলাদেশের আগামি ইতিহাসের ক্ষেত্রে জাফর ভাইয়ের তাৎপর্য কি হতে পারে সেই পর্যালোচনা আস্তে আস্তে তরুণদের কাছে তুলে ধরা। জাফরুল্লাহ চৌধুরি যে জীবন যাপন করে গেলেন তার তাৎপর্য নিজেরা বোঝা এবং তার সারকথাগুলো কি হতে পারে ভেবে দেখা। কিভাবে সহজ ভাবে আমরা সেটা আগামির দূরদর্শী তরুণদের কাছে তুলে ধরতে পারি সেটা নিজেদের কাছে পরিচ্ছন্ন করে তোলা। সর্বোপরি সাধারণ মানুষদের কাছে সহজ ভাষায় সহজ কথায় আমাদের কর্তব্য যেন তুলে ধরতে পারি সেই চেষ্টা করা।
কিভাবে সেটা করব? জাফরুল্লাহ চৌধুরি একই শার্ট ত্রিশ বছর ধরে পড়েছেন। এটা কি বলব? হ্যাঁ বলব, এটা মিথ্যা না, কিন্তু তিনি নতুন জামাও পরেছেন। তিনি সাধারণত হাফ হাতার হাওয়াই শার্ট পরতে পছন্দ করতেন। সম্ভবত ছাত্রাবস্থা থেকেই এক ধরণের বেপরোয়া মাস্তানি ভাব ফুটিয়ে রাখতে আনন্দ পেতেন। একটা বটিক প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট অনেক দিন ধরে পড়েছেন। এসব মেলা গল্প বলাই যায়। আর তো তাঁর ছেড়া প্যান্টের গল্প আছেই। তাঁর ছেড়া স্যান্ডেলও আমরা দেখেছি। ক্ষয় হয়ে গেছে কিন্তু তিনি সেটা পরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু শুরুতেই এটা বুঝতে হবে, এহ বাহ্য! এগুলো বাইরের ব্যাপার।
বাইরের গালগল্প বাদ দিলে মোদ্দা কথা কোথা থেকে শুরু হতে পারে? সেটা নানান দিক থেকেই হতে পারে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা এবং তর্কের পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন থেকে আমরা শুরু করতে পারি সেটা হোল জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে বুঝেছেন? এটা খুবই ভাল যে তাঁর সম্পর্কে কথা উঠলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ চলে আসে। মুক্তিযুদ্ধকে তাঁর জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিম্বা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বোঝা প্রাসঙ্গিক হয়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নামক কথাটিকে যে ভাবে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন দলীয় রাজনৈতিক চিন্তার হাতিয়ার বানানো হয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সূত্র হিশাবে তিনি আগামি দিনে তরুণদের কাছে পরিচ্ছন্ন প্রতীক হয়ে উঠবেন, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। মুক্তিযোদ্ধার সংগ্রাম বললে তরুণরা জাফরুল্লাহকে বুঝুক – তিনি নিজের কাজের মধ্য দিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।
সমর নীতি ও কৌশলের দিক থেকে তিনি বাস্তবের রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে বুঝেছেন? সেইসকল খুঁটিনাটির জায়গা থেকেও আমরা আলোচনা করতে পারি। বলাবাহুল্য মুক্তিযুদ্ধ একটি সামরিক ব্যাপার। এই সামরিক দিকটা তিনি কি সেনা অফিসারদের মতো বুঝেছেন, নাকি তার বোঝাবুঝির ক্ষেত্র ভিন্ন ছিল। এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে শুনে এবং রণক্ষেত্রের ঘটনাবলী সম্পর্কে অন্যদের লেখালিখি ও গল্প থেকে যা বুঝেছি তাঁর একটা দূরদর্শী অবস্থান ছিল। সামরিকতার দিক থেকেও মুক্তিযুদ্ধকে তিনি শুরু থেকেই গভীর ভাবে বুঝেছেন। কিভাবে আমরা তা জানি? ছোট উদাহরণেই বুঝি। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের জন্য অবশ্যই ফিল্ড হাসপাতাল আর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা যুদ্ধের নীতি ও কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ এটা তিনি বুঝেছিলেন শুরু থেকেই। তিনি পাক্কা বুঝেছিলেন। এটা নিজে বোঝা এবং অপরকে বোঝানো খুব সহজ ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা: মবিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য ফিল্ড হাসপাতালের মাধ্যমে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদানের জন্য বিলাত থেকে চলে আসেন। মেলাঘরে মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে যখন তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়, খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, আমাদের ডাক্তারের প্রয়োজন নাই, গেরিলা প্রশিক্ষণ নিন এবং অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিন। এই গল্প আমি জাফর ভাইয়ের মুখে অনেকবার শুনেছি। তাঁরা ট্রেইন্ড সার্জন বুঝিয়ে বলার পরও তৎক্ষণাৎ বোঝানো যায় নি। এখানে খালেদ মোশাররফকে ভিন্ন ভাবার কোন কারন নাই। এই অসম সাহসী সৈনিকের অবদান আমাদের মনে রাখতে হবে। রাজনৈতিক ডামাডোলে এঁদের আমরা অবমূল্যায়ন করি। এই গল্প বলার উদ্দেশ্য খালেদ মোশাররফকে সমালোচনার জন্য না। জাফরুল্লাহকে বোঝার জন্য। তিনি শুরুতে খালেদ মোশাররফকে বোঝাতে পারেন নি। এটাও সত্য কথা যে যুদ্ধে যখন আহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকল তখন খালেদ মোশাররফ নিজেই ফিল্ড হাস্পাতালের গুরুত্ব বুঝলেন। বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে উঠল।
জাফর ভাই সম্পর্কে এ কালের তরুণদের যে দিকটা শেখার সেটা হোল যুদ্ধ নিছকই গোলাবারুদ বন্দুক কামান না। এর নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক আছে। মুক্তিযুদ্ধ সমাজ বিচ্ছিন্ন সামরিকতা বা সৈনিকতা না। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি ফিল্ড হাসপাতাল থাকার মানে মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক বলকে দৃঢ় করা, যার অভাব যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জয়পরাজয়ে তার ভূমিকা থাকে। সমরনীতি ও কৌশলের দিক থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরি ও ডা: মবিনের এই দূরদর্শিতা আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। আমরা সকল দিক থেকেই এখন শত্রু দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন বাংলাদেশের জনগণের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। ফলে জাফর ভাইয়ের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাগুলোর প্রতি আমাদের আজ হোক কাল হোক আরও নিবিড় ভাবে মনোযোগ দিতে হবে।
কিন্তু জাফর ভাই মুক্তিযুদ্ধকে আরেকটি তাৎপর্য দিয়েছেন বা আরেকটি স্তরে উন্নীত করেছেন। যা বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। সেটা হোল গরিব, বঞ্চিত হতদরিদ্র ও লাঞ্ছিতদের জন্য স্বাস্থ্য, খাদ্য, পুষ্টি, আবাস, বস্ত্র ইত্যাদি আদায়ের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়াই মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ তাঁর মুক্তিযুদ্ধ দেশ স্বাধীন হবার পর শেষ হয় নি। বিশ্রামগঞ্জের ফিল্ড হাস্পাতালের ধারাবাহিকতা পুরা দমে চলছে। বিশ্রামগঞ্জের ফিল্ড হাসপাতাল বাংলাদেশের সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে গড়ে উঠল। বাকিটা ইতিহাস। এখন সাধারন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কি করা যেতে পারে সেটা আমরা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজ থেকে বুঝি, কাজের সাফল্য থেকে নিশ্চিত হই মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে গণমানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার আন্দোলনে পরিণত করতে হয়। কেন সেটা জরুরি। রণক্ষত্র পালটিয়ে গিয়েছে। যারা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের লড়াইয়ে নাই তারা মুক্তিযুদ্ধেও নাই। ঠিক। জাফর ভাই বুঝতেন মুক্তিযুদ্ধকে রূপ দিতে হবে বীজ ও খাদ্যের সার্বভৌমত্ব অর্জনের লড়াই হিশাবে। মেয়েদের অধিকার হিশাবে। লিঙ্গভিত্তিক যে শ্রমবিভাগ গড়ে উঠেছে তাকে ভেঙে দিতে হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষার লড়াই একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধেরই ধারাবাহিকতা। কারণ জনগণকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। হেলমেট আর হাতুড়ি মাথায় হাতুড়ি লীগ হওয়াকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে না। কিম্বা মুক্তিযুদ্ধের কাল্পনিক কেচ্ছা ও গালগল্প নিরর্থক। কারণ মুক্তিযুদ্ধ কোন অতীতের ব্যাপার নয়। যুদ্ধ চলছে। চলবে।
দ্বিতীয়ত জাফর ভাই সবসময় বুঝিয়েছেন কোন যুদ্ধই একা করা যায় না। ফলে বাংলাদেশে তাঁর একটা সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিল যারা মুক্তিযুদ্ধের লড়াই তাদের কাজের নানান ক্ষেত্রে চালিয়ে গিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা জাফর ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে যার কথা না বললেই নয় তিনি হচ্ছেন শাহাদাত চৌধুরি, সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক। শাচৌ নামে বিখ্যাত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা দেশে সাংবাদিকতা ও বুদ্ধিজীবিতার ক্ষেত্রে মৌলিক অবদান নিয়ে যদি কথা হয় তাহলে শাহাদাত চৌধুরির কথা উঠবেই। তিনি জাফর ভাইকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা করেছিলেন এবং তার মাধ্যমে মানুষ জাফরুল্লাহ চৌধুরিকে মানুষ ভিন্নভাবে চিনেছিল। শুধু সেই জন্য নয়। শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমানের উত্থান সহ বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ে শাহদাতের অবদান ভোলার নয়। শাহাদাত চৌধুরিও আজ বেঁচে নাই। জাফর ভাইকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তার কথা বলে রাখা জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে জাফর ভাইয়ের চিন্তায় কোন অস্পষ্টতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই না, মুক্তিযুদ্ধ মানে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার লড়াই। তাই তিনি যখন গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেল প্রতিষ্ঠা করলেন তখন তার বিজ্ঞাপন দিলেন ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি’। আসলেই সাধারণ মানুষের জন্য কম দামে জরুরি ঔষধ উৎপাদন করা মুনাফাখোর বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে শুরুতে তাঁর এই কাজের সাথে আমি যুক্ত হতে পেরেছিলাম। আমি পেশায় ফার্মাসিস্ট বলে তিনিই আমাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ধরে এনেছিলেন। তিনি ওষুধ বানানোর জন্যে পেশাদার মানুষ যেমন এনেছিলেন তেমনি গ্রামের অল্প লেখা পড়া জানা মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ওষুধ তৈরি করা শিখিয়েছিলেন। এদের অনেককে লন্ডন, ফ্রান্সে পাঠিয়ে আরো উচ্চতর প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন। তাঁকে সবাই বড় ভাই ডাকতেন। এর মধ্যে সম্মান ছিল আর ছিল অগাধ ভালবাসা। বদরাগী ছিলেন। তাঁর সামনে কেউ কথা বলতে সাহস পেতো না ‘এই কাজ আমি কি করতে পারবো?’ – জাফর ভাইয়ের রাগ সপ্তমে চড়ত। মানুষ পারে না এটা কিভাবে সম্ভব? পারার জন্য যা দরকার তা সরবরাহ করতে কুন্ঠা ছিল না। কর্মীরা পেরেছে। জাফর ভাইয়ের অগাধ বিশ্বাস ছিল তাঁর কর্মীদের ওপর।
তাঁর কাছে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেলস ছিল সাম্রাজবাদের বিরুদ্ধে লড়বার হাতিয়ার। কারন আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগে ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শক্তিশালী অবস্থান অর্জন অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই থেকে ভিন্ন কিছু না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই মানে হাওয়ায়া তলোয়ার ঘোরানো না। বাংলাদেশের দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে উঠতে পেরেছে জাফরুল্লাহ চৌধুরির জাতীয় ওষুধ নীতির জন্য। জাতীয় ওষুধ নীতি গড়ে উঠত না যদি গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিকেল প্রতিষ্ঠা করা না যেত। একদিকে বহুজাতিক বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশকে স্রেফ তাদের পণ্যের বাজার বানাবে , আমাদের কোন শক্তিশালী উৎপাদন ক্ষেত্র গড়ে উঠবে না, আমাদের টেকনলজি ট্রান্সফার হবে না, তদুপরি তারা ওষুধের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেশী রেখে মুনাফা কামাবে, জরুরি ওষুধ মানুষের কাছে সহজ লভ্য করার কোন চেষ্টা করবে না , --তাতো হবে না। একই ওষুধ বিভিন্ন দামে বিভিন্ন কোম্পানি বিক্রি করে যাচ্ছে সেটাই বা কেন?। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়া মানে এই অসাম্যের অবসান ঘটানো। অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলোও ওষুধ উৎপাদনে নিয়ম নীতি মানছে না। গুণগত মান বজায় রাখছে না। সেটা কেন হবে? মুক্তিযুদ্ধকে তিনি নিয়ে এলেন এই শোষণ ও অন্যায় উৎপাটনের লড়াই হিশাবে। জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে তাঁর সংকল্প প্রমাণ করে ছাড়লেন।
নয়াকৃষি আন্দোলন নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। কৃষিকে তিনি কিম্বা আমি দুজনের কেউই স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করবার সংগ্রাম থেকে আলাদা ভাবি নি। দেশীয় বীজ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে তাঁর প্রবল উৎসাহ ছিল। খোঁজ খবর রাখতেন সবসময়ই। একালে লর্ড ক্লাইভের দরকার হয় না। জমি দখল হয়ে যাওয়ার যে ফল, তার চেয়ে অধিক ভয়ংকর দেশীয় বীজ হারানো। সাম্রাজ্যবাদের রণক্ষেত্র তিনটি পানি, বীজ ও জ্বালানি।
আজ বেশী মনে পড়ছে তার মুখের “ফরহাদ” ডাক। খুবই কানে ভাসছে। ঐ কন্ঠস্বর আমি আর শুনবো না ভেবে কাতর হয়ে পড়ি। সেই ডাকে গভীর বন্ধুত্বের বন্ধন যেমন, তেমনি ছিল অফুরন্ত স্নেহ। অস্থির হয়ে বলতেন, আপনি লেখেন,আরও লেখেন। আপনি তো বিশ্লেষণ করতে পারেন। আরও লেখেন।
লিখবো জাফর ভাই। আপনার জন্যেই লিখব।
১৮ এপ্রিল ২০২৩।
[ লেখাটি জাফর ভাইকে নিয়ে 'দেশ রূপান্তর' পত্রিকার জন্য লিখেছিলাম]