একুশ শতকে বাঙালি


বাঙালির জীবনে দুবার জাগরণ এসেছিল; বাংলার ইতিহাস থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়‌। বর্তমানে বাঙালি তৃতীয় জাগরণের ধাপ অতিক্রম করছে। অন্যভাবে বলা যায়, বাঙালি তৃতীয় জাগরণের পর্যায়ে রয়েছে।

বিশ্বের কোন দেশ আজ আলাদা বা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। আবার কোনো দেশ নিজস্ব ভিত্তি বা শেকড়হীন হয়েও চলতে পারে না।

প্রতিটি দেশ, প্রতিটি জাতি আজ পরস্পর যুক্ত এবং একে অপরের উপর নির্ভরশীল। পারস্পরিক সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এই সম্প্রীতি ক্রমাগত গড়ে উঠেছে। বাঙালি জাতিও এই বাস্তবতার ভেতর দিয়ে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে তৃতীয় জাগরণের পথে‌। পূর্ববর্তী দুই জাগরণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর তৃতীয় এই জাগরণ বাঙালি জীবনে নবতর সামাজিক উপাদান সমৃদ্ধ একটি সুন্দর, দীর্ঘস্থায়ী এবং কল্যাণময় সমাজের ইঙ্গিতবহ। সুতরাং এসবের ফলাফল বাঙালী জীবনে নিশ্চিত এবং সমৃদ্ধতর জীবন ব্যবস্থার পথকে অধিকমাত্রায় সম্পৃক্ত করছে‌। অন্যান্য জাতিসত্তার পাশাপাশি বাঙালি জাতিসত্তারও উচ্চতর বিকাশ এবং সার্বিক পরিপক্কতার সমূহসম্ভাবনা প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে।

প্রথম জাগরণ

ষোড়শ শতকে একদিকে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও বৈষ্ণব ধর্ম, অপরদিকে মুসলিম সুলতানদের রাজত্বকালে ইসলামী সংস্কৃতির প্রসার, উভয়ই বাঙালি জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলো। প্রথম জাগরণের এ সময়ে মুসলিম সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ।

পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন শর্ত। সে শর্ত কিছুটা তৈরিই ছিলো। বাঙালির অচল, অনড়, নির্জীব অথচ কৌলিন্যভিত্তিক সমাজে মুসলিম শাসন ও সুফি সাধকদের সাম্যভিত্তিক ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রভাব আবেদন সৃষ্টি করল। একসময় লক্ষ লক্ষ হিন্দু জনসাধারণ মুসলমানিত্ব গ্রহণ করে। অন্যদিকে হিন্দুদের মধ্যে চাহিদা থাকার কারণে শ্রীচৈতন্যের (বিশ্বম্ভর) দর্শনের মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে একটি ঐক্যের সুর যেমন ধ্বনিত হয়েছে, ঠিক তেমনটি জাতপাত, উঁচুনিচু, ভেদাভেদ ঘুচিয়ে একটি নবচেতনার উন্মেষ ঘটে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে বাংলাদেশের একটি পুরানো সমস্যার সমাধান হয়েছিলো। শংকরাচার্য কর্তৃক হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের কারণে বৌদ্ধধর্ম হীনবল হয়ে পড়েছিলো ব্রাহ্মণ পরিচালিত কঠোর সমাজ শাসনে অবশিষ্ট অহিংস বদ্ধ বৃক্ষরা হিন্দু সমাজে মিশে যেতে পারেনি চৈতন্যের প্রচলিত দর্শনে ধর্ম বর্ণ শ্রম বিধান ছিল না অর্থাৎ হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ ভেদাভেদও ছিল না যদিও ইসলামিক প্রভাবজনিত হিন্দু মুসলমান সাম্য এবং চৈতন্যদেবের দর্শন এক ছিল না তা সত্ত্বেও বাঙালি জীবনে প্রবাহিত হল প্রাণের সুরত চৈতন্যদেব সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা। চৈতন্যদেব নাচুনে-কাঁদুনে এবং প্রেমের প্রচারক। এটি ছিল তার আচরণের দিকমাত্র। তার প্রকৃত পরিচয় হলো বিপ্লববাদী।

সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য ভাবজগতে পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়; অর্থনৈতিক জীবনেও পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। বলা ভালো অর্থনৈতিক পরিবর্তনই মৌলিক। ভাবগত ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটে তার প্রতিসঙ্গ (corresponding) ফলাফল হিসাবে।

সুতরাং মুসলিম শাসকদের দ্বারা প্রভাবিত ইসলামিক সাম্যবোধ এবং চৈতন্যদেব প্রবর্তিত জাতপাত মুক্ত হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ ঐক্য স্থায়ী হলো না। ফলে দেখা গেলো শাসকদের প্রচারিত ইসলাম এবং জনগণের বোধের গভীরে যে ইসলাম তা মোটেই এক নয়। তেমনি হিন্দুধর্মের উঁচু বর্ণের মানুষের সঙ্গে চৈতন্যদেব প্রচারিত নবধর্মের মধ্যে রয়ে গেলো দূরত্ব। উপরতলার এই ব্যবধান সত্ত্বেও নিচুতলার মানুষের মধ্যে একটি লৌকিকবোধ সৃষ্টি হলো। আবার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমাজের উপরতলার হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্বও ছিলো বিদ্যমান।

সমাজের নিচুতলার মানুষের মধ্যে এই যে অলিখিত মানসিক সম্পর্ক তা সহজ সরল গ্রামীন-লৌকিক রূপ ধারণ করে। মুসলিম শাসকদের মধ্যে এশিয়াভিত্তিক ইসলামি ভাবধারা ছিলো নগরভিত্তিক, অন্যদিকে হিন্দু-ব্রাহ্মণদের সংস্কৃত ভাষার প্রভাব ছিলো সমাজের অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাধারণ পর্যায়ের মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধরা ছিলো আদিম (primitive) গ্রাম্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি ছাড়া প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার কীর্তির স্মৃতি এখানে নেই। অপরদিকে এ অঞ্চলে আরবিতে কুরআন, হাদিসের চর্চা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা ছিলো না। এই অবস্থাকে কোনোভাবেই তৎকালীন পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় সভ্যতার সমপর্যায়ভুক্ত করা চলে না। এটি ছিলো এক ধরনের লোকসংস্কৃতির রূপ মাত্র (folk civilization) যাকে ‘কৌম সমাজ’ বলা যায়। তবে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার এই রূপায়ণ কিভাবে শুরু হলো তা অনুমান নির্ভর। বহির্মুখী বাঙালিরা যখন অন্তর্মুখী হলো এবং তার জীবন-জীবিকা, পোশাক-পরিচ্ছদ, বাসস্থান নির্মাণ প্রভৃতিতে যখন সবকিছু সহজলভ্য গ্রামীণ রূপ ধারণ করলো, তখন মুসলিম শাসকদের আধিপত্যের কারণে প্রাচীন ধারার পরিবর্তে ধর্ম, সাহিত্য, ভাষা, শিল্পকলা, আচার-ব্যবস্থার প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অপভ্রংশ সৃষ্টি করলো। জনগণের মধ্যে লৌকিক-ধর্ম, লৌকিক আচার, লৌকিক-সাহিত্য, লৌকিক- সঙ্গীত সৃষ্টির কাজ শুরু হলো। এই অবস্থা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এই সময় সত্যপীরের আবির্ভাব লক্ষণীয়। যাকে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই সীমাহীন শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো।

দ্বিতীয় জাগরণ

বাংলায় ইংরেজ আগমনের পর ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন, ইউরোপীয় ভাবধারার প্রসার এবং বিজ্ঞান চর্চার ফলে উদ্ভব হলো এক নতুন বাঙালি শ্রেণির। এভাবেই শুরু হলো বাঙালি জীবনে পাশ্চাত্য প্রভাব। ইংরেজি শিক্ষা ও সাহিত্য, ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তি-দর্শন, চিন্তাধারা এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাঙালি সমাজের উপরের স্তরের মানুষের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করে। মাত্র একশ’ বছরের মধ্যে হিন্দু কলেজ (১৮১৭, বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ, ১৮৫৫), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭), ইসলামিয়া কলেজ (১৯২৬), ঢাকা কলেজ (১৮৪১), লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ (১৯৩৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১), ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা বাঙালির মনে অভাবিত আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার ফলে গড়ে ওঠে বাঙালির এক মধ্যবিত্ত সমাজ। এভাবেই শুরু হয় বাঙালির নতুন মনস্তাত্ত্বিক জীবন। এই মানসিক জীবন বাঙালির সমস্ত অতীত থেকে ভিন্নতর এক অবস্থা। যাকে বাঙালি জীবনে পুনর্জাগরণ (Bengal renaissance) ধরা হয়। এটাই বাঙালির দ্বিতীয় জাগরণ ।

কিন্তু এই জাগরণও অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তন না এনে সীমাবদ্ধ রইলো কেবল বাঙালির মন-মানসিকতা ও ভাবজগতে। আনুপাতিকহারে বস্তুগত বা উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনলে সে পরিবর্তন স্থায়ী হয় না। সুতরাং এবারও বাঙালির পরিপূর্ণ উত্থানে দেখা দেয় ব্যর্থতা। বহু বছর পতিত রাখলে জমি যেমন উর্বরতা ফিরে পায়, বাঙালির সহজ-সরল লোকজ জীবন তেমনি উর্বরতা ফিরে পেয়েছিলো। তাই ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে বাঙালি নতুন ধরনের জীবন সৃষ্টি করতে চাইলো ।

উৎপাদনগত ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি সমাজে ভাবগত যে পরিবর্তন আসে, সে পরিবর্তনই দীর্ঘস্থায়ী। আর এই পরিবর্তন, পরবর্তী পরিবর্তনের ধাপ হিসেবে কাজ করে। কিন্তু যে পরিবর্তন উপরে উপরে অর্থাৎ কেবলই ভাবজগতে ঘটে, তার পরিণতি কল্যাণকর কিংবা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সে কারণে দ্বিতীয় জাগরণের মধ্য দিয়ে ভাবজগতে পরিবর্তন এলেও সত্যিকার অর্থে বাঙালি জীবনের সর্বত্র পরিবর্তন আসলো না। এটি এক ধরনের সামাজিক স্থবিরতা সৃষ্টি করে।

উপরোক্ত দুই জাগরণের সময়ে ইউরোপে কী ঘটেছিলো তা তুলনা করে দেখা যাক। আমাদের সহজ-সরল লোকজ জীবনের বিপরীতে সেখানে ঘটেছিলো শিল্প-বিপ্লব। আশ্চর্যের বিষয়, প্রাচীন বাংলা অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব বা অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে ( immediate after) এই অঞ্চলের লোকদের মহৎ বৈশিষ্ট্য, শৌর্য-বীর্য ও বহির্মুখিতা ছিলো; ঠিক সেই সময় ইউরোপ ছিলো অন্ধকারে।

উপরোক্ত দু'টি জাগরণের কারণে বাঙালির মনমানসিকতা ও ভাবজগত প্রচণ্ড ধাক্কার সম্মুখীন হলেও বস্তুগত বা উৎপাদন ব্যবস্থায় আনুপাতিক পরিবর্তন ঘটেনি। সেই ভাবজগতের আন্দোলন তাই ক্ষণস্থায়ী হলো। চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম এবং মুসলমান শাসকের ইসলামী সংস্কৃতি জনগণের মানসে অনেকখানি পরিবর্তন আনলেও আর্থসামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছিলো। ফলে এই জাগরণ বাঙালি জীবনকে কিছু সময়ের জন্য আন্দোলিত করেছে মাত্র। আর্থসামাজিক জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন না হওয়ার ফলে তা ধীরে ধীরে মানুষের মন থেকে মুছে যেতে থাকে ।

বৈষ্ণব ধর্ম সমাজের ছোট একটি অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মুসলমান জনগণের মধ্যে ইসলাম স্থানীয় রূপ নেয়। উপরতলার মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

এভাবেই জনগণের বৃহত্তর অংশের মধ্যে ধর্মের নিজস্ব ব্যাখ্যা খোঁজা এবং গ্রহণ-বর্জনের পথে নতুন ধর্মীয় বোধ জাগ্রত হয়। সমাজের নিচের তলার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে লৌকিক-সংস্কৃতি তাদের জীবনের মূলধারায় পরিণত হয়।

দ্বিতীয় জাগরণের শুরু ১৮’শ শতকে। যার ফলশ্রুতি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮১৭), যা পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সি কলেজে (১৮৫৫) পরিণত হয়। এই যুগের প্রতিনিধি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনবন্ধু মিত্র, কেশবচন্দ্র, কালী প্রসন্ন মিত্র, স্বামী বিবেকানন্দ, মীর মোশাররফ হোসেন, প্যারী চাঁদ মিত্র প্রমুখ। ইংরেজি ভাষার প্রভাব বাঙালির জীবনে এক মধ্যশ্রেণির সৃষ্টি করে। আবার ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধেও তখন একটি গোষ্ঠি সক্রিয় ছিলো। যদিও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তা ব্যাপক বাঙালি জনগোষ্ঠীর (প্রথম দিকে হিন্দুরাই ইংরেজি ভাষার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে, কিন্তু মুসলমানদের আগ্রহ জন্মেছে অনেক পরে) মধ্যে আর্থসামাজিক কোনো পরিববর্তন আনতে পারেনি। ফলে কিছুকাল সাড়া জাগালেও সময়ের ব্যবধানে এই জাগরণও পরবর্তীকালে তার গতি হারিয়ে ক্ষীণ একটি ধারায় পরিণত হয় ।

দুই জাগরণের পূর্বে বাংলার অবস্থা

প্রাচীনকাল

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে দুটি জাগরণের পূর্বে বাংলার সমাজচিত্র কেমন ছিলো? প্রাচীনকালে ‘বাংলা’ নামে বিস্তৃত কোনো অঞ্চল ছিলো না। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা, এই সমস্ত এলাকা নৃপতি শাসিত (principalities) ছোটো ছোটো স্বাধীন জনপদ ছিলো। বঙ্গ, গৌড়, বরেন্দ্র, সমতট, রাঢ়, তাম্রলিপ্তি, পুণ্ড্রবর্ধন, দন্ডভুক্তি, কর্ণসুবর্ণ, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, সুবর্ণবীথি, সূক্ষ, নব্যকশিকা, লক্ষ্ণৌতি বা লখনৌতি ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিলো। এই সময়ে এতদঞ্চলের শৌর্য-বীর্য ছিলো, ছিলো বহির্বাণিজ্য। বাণিজ্য সূত্রে এরা জাভা পর্যন্ত যেতো। আর ধর্ম প্রচারে তিব্বত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ছিলো। বাংলা ভাষা তখন পর্যন্ত ‘ইতর’ ভাষা বা পক্ষীভাষা (কিচিরমিচির) হিসেবে অন্যদের কাছে পরিচিত ছিলো। এসময় আদিবাসী ‘ভেড্ডিড’ নামক এক জনগোষ্ঠীর খোঁজ পাওয়া যায়। এদের সংস্কৃতি, জীবন যাপনের মান ছিলো অতি সাধারণ। এই ভেড্ডিড জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যান্য আর্য-অনার্য জনগোষ্ঠী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আগত কৃশকায় মঙ্গোলয়েড ধাঁচের মানুষের সংমিশ্রণে প্রোটো-মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এরাই বাংলার আদিম জনগোষ্ঠী। এই কারণে এখানে তিন স্তরের আদিম জনগোষ্ঠীর সন্ধান মেলে- বর্ণ শংকর, বিশুদ্ধ অনার্য (ভেড্ডিড) ও আর্য (এরিয়ান)। সূতরাং এই জনগোষ্ঠী স্বাভাবিকভাবেই উত্তরাপথ অর্থাৎ ভারতবর্ষের অন্যসব অঞ্চলের জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক।

এবার ভিন্ন এক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক-ঐতিহাসিক- নৃতাত্ত্বিক গঠনপ্রণালি দেখা যেতে পারে। ‘মাৎস্যন্যায়’ হতে পরিত্রাণ পাবার জন্য বাংলার মানুষ গোপালকে সিংহাসনে বসিয়েছিলো। সেদিন হতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের শুরু। তখনো বাংলা ভাষা জন্মায়নি, বাংলার বিশিষ্ট কোনো সংস্কৃতিও বিকশিত হয়নি। তবে বাঙালি সমাজের বিশিষ্ট রূপ তখন হতেই নির্ধারণ করা হয়। সেদিক হতে বাঙালি জাতিসত্তার উৎসমূল নিয়ে এবং বিকাশ নিয়ে ভাবারও যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে বাংলার স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণের পাশাপাশি বাঙালি জাতিত্বের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য কীভাবে এবং কোন্ পর্যায়ের জাতিগত সমন্বয়ে সৃষ্ট তারও একটি রূপরেখা পাওয়া সম্ভব।

বাঙালি আর্য না অনার্য এ নিয়েও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তর্ক হয়েছে। সব বাঙালিকে বিবেচনায় রেখে একথা বোধকরি বলা সম্ভব, বাঙালি যতটুকু অনার্য, আবার সেই অর্থে কম আর্য নয়। জাতিগত সংমিশ্রণে বাঙালিত্ব নৃতাত্ত্বিকভাবে ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বিকশিত হয়ে আসছে। তবে একথা সত্য, বাংলাদেশের জনসমষ্টির গঠন উত্তরাপথের জনসমষ্টির গঠন হতে পৃথক। তা সত্ত্বেও বাঙালির নৃতাত্ত্বিক কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

আধুনিক ভারতের (উত্তরাপথ) প্রাচীন নাম আর্যাবর্ত। এ হতে মনে করা হয়, আর্যাবর্ত বিশেষভাবে আর্যের দেশ। সেখানে আর্য-অনার্যের খুব বেশি সংমিশ্রণ ঘটেনি। কিন্তু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম ছিলো। এ অঞ্চল কখনোই আর্য উপনিবেশ হয়নি। এখানে আর্যদের বসতি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর জাতিগত বিভেদও দেখা দিয়েছিলো। তাই অনুমেয়, বহু প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হতে আগত কোনো আদিম অধিবাসী ছিলো। মালয় (বর্তমান মালয়েশিয়া) দেশের কৃষকের চেহারার সংগে পূর্ববঙ্গের বাঙালি কৃষকের একটি মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাই একথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে না। যে, এরা মধ্য-ভারতের অস্ট্রলয়েড জাতি হতে উদ্ভূত। ধারণা করা হয়, পীতবর্ণ মঙ্গোলয়েডদের প্রসারের পূর্বে সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে কোনো কৃশকায় মঙ্গোলিয়ান ছাঁচের জাতি ছিলো। এই প্রোটো- মঙ্গোলয়েডরাই বাংলার আদিম অধিবাসী (ঐতিহাসিক সূত্র অনুসন্ধান করে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী এই অভিমত প্রকাশ করেছেন)।

আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও ল্যাটিন আমেরিকার জাতিগত পার্থক্যের সঙ্গে উত্তরাপথ (ভারত) ও বাংলাদেশের একটি মিল দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের জনসমষ্টি ইউরোপীয় প্রধানত ইংরেজি। কিন্তু ল্যাটিন আমেরকিার অধিবাসীরা ত্রিধাবিভক্ত; প্রথমত: ইউরোপীয় ইংরেজ, স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ, দ্বিতীয়ত: বর্ণ শংকর বা মেস্ত্যিসো, তৃতীয়; বিশুদ্ধ আদিম বা ইন্ডিয়ান ।

তেমনিভাবে উত্তরাপথের সমাজ ছিলো বিশুদ্ধ আর্য স্তরের। অপরদিকে বিশুদ্ধ আর্য, বর্ণ শংকর ও বিশুদ্ধ অনার্য-এই তিন স্তরের বাংলার সমাজ। মুসলমানরা বাংলা জয় করার ফলেও এই ত্রিধাবিভক্তির কোনো পার্থক্য ঘটেনি। যারা মুসলামনিত্ব গ্রহণ করলো, তাদের বাঙালিত্বের কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটলো না। মুসলমান শাসকরা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এর বহু নজির ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়। যার ফলে বাংলা ভাষার প্রতি হিন্দু- মুসলমান সবারই সমান শ্রদ্ধা ও অনুরাগ বরাবরই ছিলো।

মুসলিম শাসনকর্তা কর্তৃক বাংলার সংস্কৃতি পোষণের ফলে হিন্দু- মুসলমানের মিলিতভাবে সৃষ্ট সংস্কৃতি একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতির রূপ পায় । কিন্তু হিন্দু- মুসলমানের সম্প্রদায়গত মিলন ও সহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও পুরো সমন্বয় ঘটেনি। হিন্দুর জীবন ধর্মশাস্ত্র ও পুরাণের ওপর নির্ভরশীল– যার রক্ষক ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা; অন্যদিকে মুসলমানের জীবন ইসলামের ওপর নির্ভরশীল যার রক্ষক ছিলেন মৌলভী মাওলানাগণ। দুই পক্ষের রক্ষকগণই সমান গোঁড়া ছিলেন। তবে লৌকিক-সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলামানের মধ্যে ঐক্য ছিলো অটুট। সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা দেখা গিয়েছিলো উল্লেখযোগ্যভাবে। সাধারণ হিন্দু-মুসলমান এক ধরনের কাপড় পরতো। বাঙালি মুসলমান-হিন্দুর মেয়েরা শাড়ি পরতো।

বাংলাদেশের গ্রামগুলোর গঠনও ছিলো অন্যরকম। বসতভিটা বেশ ছাড়া ছাড়া, বাড়িঘর দরজার বেড়া বা টাট্টি দিয়ে ঘেরা। মানুষের জীবন ভাতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের কৃষকরা সাধারণত পাতলা ও ছিপছিপে গড়নের ছিলো। মাঠে কাজ করার সময় পরিধানে থাকতো কেবল নেংটি এবং মাথায় পাগড়ির বদলে বাঁশের টোকা। এরকম বৈশিষ্ট্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলীয় কৃষকের মূর্তির সঙ্গে মিলে যায়। এই পার্থক্য, বাংলার ইতিহাসের সূচনা থেকেই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। বয়ন, মসলিন শিল্পের তখন প্রসিদ্ধি ঘটে। বস্ত্র, গন্ধশিল্প, দন্ড, কাষ্ঠশিল্প এবং কৃষিজাত বহু জিনিস বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতো। এসব দ্রব্য উৎপাদনে সাধারণ মানুষ জড়িত থাকার কারণে তাদের জীবনে এক ধরনের সচ্ছলতা ছিলো। নিজস্ব জমিতে উৎপন্ন ফসল, শাকসবজি, পুকুরের মাছ এসব ছিলো মানুষের প্রধান খাদ্য দ্রব্য যা উৎপাদন করতে খুব একটা কষ্ট করতে হতো না। ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগের (৬৫০-৭৫০) পূর্ব পর্যন্ত মানুষের জীবন যাপন ছিলো এরূপ স্বচ্ছলতার মধ্যেই। কিন্তু ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগের পর থেকে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে অভাব অনটন। নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ে জনজীবন। শুরু হয় বাঙালির জীবনে সমৃদ্ধির পরিবর্তে টানাপোড়েনের কাল। সমাজের এই পিছিয়ে পড়ার জের চললো ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত। শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য মারফত অভ্যন্তরীণ ও বাইরের মানুষের সংস্পর্শে না আসার কারণে জীবনের বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জনের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই এখানকার সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ, যেমন পল্লিগীতি-ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া-কীর্তন গান, হাডুডু-দাড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি-কানামাছি খেলা, যাত্রা-কবিগান এবং পুঁথি সাহিত্যের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। নদ-নদী ও কৃষি নির্ভর হয়ে পড়ে এই অঞ্চলের অর্থনেতিক ব্যবস্থা। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আন্তঃঅঞ্চল পুরাপুরি কৃষি নির্ভর বা জমি নির্ভর অচল, অনড়, গ্রাম্য-সমাজে (কৌম) পরিণত হয়। ভূমি ও কৃষি নির্ভরতার কারণে গ্রামীণ জীবন সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন জীবনে যা নেহায়েত দরকার তা গ্রামের মধ্যেই পাওয়া যেতো। এজন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না। সাধারণ মানুষের জীবনে লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, মেয়েদের জন্য শাড়ি অতি সহজলভ্য ছিলো। বাসস্থানের জন্য বাঁশ বা খড়ের ঘর তৈরি করতে কয়েক ঘন্টার বেশি লাগতো না। ভাত ছিলো প্রধান খাবার। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও প্রস্তুতি ছিলো অতি সহজ, কম পরিশ্রমের কাজ। শত শত বছরের এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সৃষ্ট ‘খনা’র বচন বাঙালি সমাজের উৎসমূলে স্থান পায়।

ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে (একশ বছর ব্যাপী) স্বাধীন নৃপতি শাসিত অঞ্চলগুলো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার ফলে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অভ্যন্তরীণভাবে এই অরাজকতার ফলে (এই সময় বহির্ভাগে সমুদ্রপথে আরব বণিকদের আবির্ভাব ঘটে) পুরানো শৌর্য-বীর্য ও বাণিজ্য লোপ পায়। এই সময়কে ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগ বলা হয়। এই ‘মাৎস্যন্যায়’ (৬৫০-৭৫০) হতে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বাংলার লোক গোপালকে (গোপালদেব) সিংহাসনে বসান। প্রকৃতিপুঞ্জ রাষ্ট্রনায়ক গোপালকে বাংলার সিংহাসনে বসানোর ফলে ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগের অবসান ঘটে। সেই থেকেই এই অঞ্চলে রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য শুরু। তখনো পর্যন্ত বাংলা ভাষা জন্মায়নি। বাংলার সংস্কৃতিরও বিকাশ ঘটেনি এবং এই অঞ্চল উত্তরাপথের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। পাল বংশজাত রাজন্যবর্গ ছিলো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। পাল রাজাদের বেশিরভাগ সৈন্য যোগান হতো দাক্ষিণাত্য থেকে, যারা ছিলো ক্ষত্রীয় সেন। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও পাল রাজাদের সৈন্য সংগ্রহ করা হতো। পাল বংশ (৭৫০-১১৬০ ) প্রায় ৪১০ বছর রাজত্ব করে। তারপর থেকে ক্ষত্রীয় যোদ্ধার জাত সেন বংশীয় রাজত্বের আরম্ভ (১০৫০-১৩০০)। সেনরা ধর্মে হিন্দু। মূলত সেনদের থেকেই এই অঞ্চলে বিদেশি শাসনের শুরু যা পরবর্তীতে বিদেশি মুসলমান আক্রমণকারীদের আগ্রাসনকে সহজ করে। ১১৬০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এই ৭৮৭ বছর এর মধ্যে এই অঞ্চল সর্বপ্রথম শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের (১৩৪২- ১৩৫৭) আমলেই 'স্বাধীন অঞ্চল' হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এই সব অঞ্চলকে ভৌগোলিকভাবে ‘প্রাচীন বাংলা’ বোঝানো হতো।

‘বাংলা’, ‘বঙ্গ’, ‘বঙ্গাল’ এসব নামের উৎপত্তির ইতিহাসও আছে। হিন্দু প্রাচীন গ্রন্থ সমূহেও এই শব্দ সমূহের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আইনি আকবরি গ্রন্থে ‘আল’ দিয়ে জমিজমা বিভক্তির কারণে প্রাচীন নাম ‘বঙ্গ’ এর সঙ্গে ‘আল’ যুক্ত (বঙ্গ+আল=বঙ্গাল) নাম ধারণ করেছে। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের আমলেই সর্বপ্রথম পৃথক পৃথক নৃপতি শাসিত এক রাজ্য গঠনের পর তাকে ‘বাংগেলা’ (Bangela) নামে অভিহিত করা হয়। পরবর্তীকালে পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজরা পঞ্চদশ, ষোড়শ, সপ্তদশ শতকে বাণিজ্যের জন্য এখানে আসে। তারা তাদের ভাষাগত উচ্চারণের কারণে ‘বাংগেলা’ কে ‘বেংগালা’ (Bengala ) নামে উচ্চারণ করতো। ইংরেজরা এদেশে আসার পর ‘বেঙ্গল’ (Bengal) উচ্চারণ করে, যা আজো প্রচলিত ।

আলেকজান্ডার (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭-২৬) যখন ভারত জয় করেন তখন তিনি বা তাঁর সৈন্যরা বাংলায় আসেননি। কথিত আছে গঙ্গারিডাই রাজা ধননন্দের অধীনে এতদঞ্চল শাসিত হতো। আলেকজান্ডার ভারত ত্যাগের পর এতদঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। তারপর অতি অল্প সময়ের জন্য শুঙ্গ ও কুশানরা রাজত্ব করেছে। এরপরই এই অঞ্চলে গুপ্ত যুগের শুরু। গুপ্তরাই প্রথম এখানে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে গুপ্তদের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে এখানকার শাসন পদ্ধতি কেমন ছিলো? অনেকের ধারণা খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে কৌমতন্ত্র (কৌম অথবা লোকায়ত সমাজ - clannish rule) বহাল ছিলো। গুপ্ত যুগের পর গৌড়ের অধিপতি রাজা শশাঙ্ককে সর্বপ্রথম সার্বভৌম রাজা হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। শশাঙ্কের রাজত্বকাল ছিলো মাত্র ২৫ বছর (৬১১-৬৩৬)। তাঁর মৃত্যুর পর একশত বছর ব্যাপী এই অঞ্চলের সর্বত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্থান ঘটেছিলো। এই সময়ে এসব অঞ্চলে অন্তর্দ্বন্দ্ব, বর্হিআক্রমণ এবং অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিলো। এই একশত বছর ধরে এ অঞ্চলের জনজীবনের দুর্বিষহ অবস্থা বোঝাতেই মাৎস্যান্যায় শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। রাষ্ট্রশক্তির দুর্বলতার সুযোগে ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রীয়-বণিক এই ধরনের নাগরিক সকলেই প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করতো। প্রাধান্য বিস্তারের পদ্ধতি বাহুবল ছিলো। বঙ্গ-বিহারের রাষ্ট্রীয়সত্তার সূচনা সপ্তম শতকেই দেখা গিয়েছিলো। শশাঙ্ক ছিলেন তার প্রতীক। কিন্তু তার পরের একশত বছরের ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগে সে সত্তা প্রায় ধুয়ে মুছে গিয়েছিলো। পাল রাজারা আবার তা জাগিয়ে তুললেন কিছুটা। পাল রাজত্বের (৭৫০-১১৫০) সময়েই গড়ে উঠেছিলো বাঙালির স্বদেশ, স্বজাত্যবোধ এবং জাতীয়ত্বের ভিত্তি। পাল রাজত্বের এই চার’শ বছর বাঙালির ইতিহাসে এক স্মরণীয় যুগ। এই যুগেই তার ভিত তৈরি হয়ে যায়। বাংলার ভৌগোলিক সত্ত্বাও এই যুগেই গড়ে উঠেছিলো। বাংলা লিপি ও ভাষার গোড়া চর্যাপদ খুঁজতে গেলেও এই চারশত বছরের মধ্যেই খুঁজতে হবে। জয়দেব এই সময়কার কবি। পাল বংশকে কেন্দ্র ও আশ্রয় করে বাংলাদেশে প্রথম সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমন্বয় সম্ভব হয়েছিলো। যদিও গুপ্ত আমলেই এর সূত্রপাত, পাল আমলে তা পূর্ণতা পেয়েছিলো। পাল আমলের এই সমন্বিত ও স্বীকৃত সংস্কৃতিই হলো বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তি। পাল বংশের পর থেকে সেন বংশের রাজত্ব শুরু। সেনরা ধর্মে হিন্দু। মূলত সেনদের থেকেই এই অঞ্চলে বিদেশি শাসনের শুরু; যা পরবর্তী বিদেশি মুসলমান আক্রমণকারীদের আগমনকে সহজ করে। অবাঙালি তুর্কি, আরব, আফগান, উজবেক, হাবশী, মুঘল এদের দ্বারা এতদঞ্চল আরো ৫০০ বছর শাসিত হয়। বাংলার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রশ্নে বারো ভূঁইয়াদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

কবি জয়দেব (১১৭৯-১২০৫)- চর্যাগীতি যেমন পরবর্তীকালের বাংলাভাষা ও ভাব সম্পদকে প্রভাবিত করেছিলো ঠিক তেমনি সেই ভাষা ও ভাবকে প্রভাবিত করেছিলো লক্ষণ সেনের রাজসভার পঞ্চরত্নের শ্রেষ্ঠ কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ' গ্রন্থ। জয়দেব ছিলেন সংস্কৃত ভাষার কবি। কিন্তু তাঁর ‘গীতগোবিন্দ' রচিত হয়েছিলো বাংলা ঘেঁষা সংস্কৃতিতে বাংলার মন-মেজাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কাব্য রীতিতে। বারো ভূঁইয়া (১৫০০ শতক)- ঈশা খাঁ, কেদার রায়, অনন্ত মানিকা, ভুলুয়া জমিদার প্রমুখ বারো ভূঁইয়া বাংলার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার্থে বিভিন্ন সময়ে মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো।

এই অঞ্চলে বখতিয়ার খলজি (১২০২-৬) মুসলমান শাসন প্রবর্তন করেন। বখতিয়ার খলজি একেবারে বিনা বাধায় বিহার ও বাংলাদেশ জয় করেছিলেন তার কয়েকটি কারণ ছিলো। প্রধানত ইসলাম ধর্মী আরব, তুর্কি, খলজি প্রভৃতি বিদেশি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে উত্তর ভারতের হিন্দু রাজশক্তির প্রতিরোধ ভেঙে পড়ায় দুর্ধর্ষ মুসলমান অভিযাত্রীদের ঠেকিয়ে রাখার মতো মনোবল বা শক্তি সেন রাষ্ট্রযন্ত্রের ছিলো না। বখতিয়ারের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেন নবদ্বীপ থেকে পালিয়ে পূর্ববঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে অল্প কিছুকাল রাজত্ব করার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর বখতিয়ারের নবদ্বীপ জয় এবং একশত বছরের মধ্যে সারা বাংলাদেশ জুড়ে মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা মোটেই আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি সেন আমলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধোগতিরই অনিবার্য পরিণাম।

তৎপরবর্তীকালে এতদঞ্চলে মুসলমান সুলতানি আমলের ৫০০ বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা দুটি। প্রথম ঘটনা শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ’র সময়ে পৃথক পৃথক অঞ্চলকে একীভূত করে বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার নাম ‘বাংগেলা’। দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনা হোসেন শাহ’র (১৪৯৩- ১৫১১) আমলে অত্র অঞ্চলে বাংলা রাজকীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এখানেই বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতিত্ব, জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির সংস্কৃতির শুরু। ইলিয়াস শাহ’র আমলেই বিদ্যাপতি, কীর্তিবাস, চণ্ডীদাস-এর সাহিত্যকর্ম এবং অপভ্রংশ ভাষার যে সূচনা হয়েছিলো, তা হোসেন শাহ’র আমলে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। হোসেন শাহ’র আমলে সর্বপ্রথম মহাভারত ও শ্রীমদ্ভাগবৎগীতা বাংলায় অনুবাদ হয়। তাঁর আমলেই বিপ্রদাস, পিপিলাই, মালাধর বসু, বিজয় গুপ্ত, যশোরাজ খাঁ, কিংকর মিশ্র, কবিন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী বাংলা ভাষার আরো উৎকর্ষ সাধন করেন। হোসেন শাহ'র আমলেই মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগির খ্যাতি অর্জন করেন।

আদিনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা এরূপ স্থাপত্যকর্ম তাঁর আমলেরই। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে হোসেন শাহ’র আমলেই। সত্যপীরের আবির্ভাবও হোসেন শাহ’র আমলে। বাংলা ভাষাকে অভিজাত ও সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে কবি আবদুল হাকিমের অবদান আজো সবাই স্মরণ করে। আবার উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বাংলার লোকসংগীত সৃষ্টিতে লালন ফকিরের সমতুল্য নেই।

তৃতীয় জাগরণের পর্যায়

এই অঞ্চল প্রাকৃতিকভাবেও অনন্য। নদী-নালা-বিল বাহিত এখানকার জনপদ। বাংলার সমভূমির প্রায় তিন দিকে পাহাড় ঘেরা। পাহাড়-পর্বতে যেসব জাতি বা উপজাতি বাস করে এরা সকলেই অস্ট্রালয়েড বা মঙ্গোলয়েড আদিম জাতি। অর্থাৎ ওঁরা, কোল, সাঁওতাল, নেপটা, ভুটিয়া, তিব্বতি, গারো, হাজং, খাসিয়া, সিন্তেং, কুকি, চাকমা, মগ ইত্যাদি। এরা বাঙালি নয়। এ কারণেই বাঙালি উত্তর ভারতের দিকে সম্মুখীন না হয়ে দক্ষিণে সাগরমুখী হয়েছিলো। বহির্ভাগে বঙ্গোপসাগর, অভ্যন্তরে নদী-নালা, খাল-বিল দিয়ে সৃষ্ট অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই দেশ, যা বিশ্বের যেকোনো অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের বিশিষ্টতা সূচিত করেছে। একদিকে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে এর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, অপরদিকে ষড়ঋতুর দেশ হিসেবেও এর আলাদা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ঋতুগুলো হচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। বাংলাদেশের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে হিমালয়ের পর্বতপুঞ্জের থেকে উৎসারিত হয়ে অসংখ্যা ঝরনাধারা, যা উত্তরাপথ এবং এই অঞ্চলের সমভূতিতে এসে নদ-নদীতে পরিণত হয়েছে। হিমালয় থেকে বেরিয়ে এসে উত্তরাপথে (ভারত) গঙ্গা নামে প্রবাহিত হয়ে এখানে পদ্মা-যমুনা নাম ধারণ করেছে। আবার উত্তরাপথে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র এখানে এসে মেঘনা নামধারণ করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হলো বুড়িগঙ্গা, গড়াই, তিতাস, শীতলক্ষ্যা, ইছামতি, করতোয়া, গোমতী, সুরমা, কংস, ধলেশ্বরী, আড়িয়াল খাঁ, ভৈরব নদী, ফেনী নদী, মধুমতি, তিস্তা, কীর্তনখোলা, কর্ণফুলী প্রভৃতি ।

বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তনের শেকড়ে। এই স্বাতন্ত্র্য বাঙালিসত্তা থেকে কোনোভাবেই বাদ দেয়ার উপায় নেই। এই স্বাতন্ত্র্য এবং স্বকীয়তা বিদ্যামান থাকার কারণেই ১৯৭১-এ বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরপূর্বে চারবার রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন হয়েছে। এভাবে লক্ষণীয় যে বাঙালির জীবনে এই নিয়ে পাঁচবার বাংলার সীমারেখার অদল বদল ঘটেছে। অতীতে যে চারবার এর রূপ পরিবর্তন ঘটেছে তার মধ্যে ১৯০৫-এর পূর্বেকার ‘সুবেবাংলা’; তা হলো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসাম-মেঘালয়-ত্রিপুরা নিয়ে বাংলা বা মুঘল সম্রাটদের সবার ইংরেজি রূপ। লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গ বিভাগের ফলে দ্বিতীয় বাংলার উদ্ভব। এভাবে প্রথম দ্বিখণ্ডিত বাংলা দেখা দিলো। লর্ড কার্জন ১৯০৫-এ পূর্ববঙ্গকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন প্রদেশ গঠন করেন এবং সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে পূর্বের ন্যায় বিহার-উড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত রাখেন। কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের ফলে ১৯১১-তে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলো। ফলে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে নতুন একটি বাংলার সৃষ্টি হলো। উল্লেখ্য যে, এই স্বদেশি আন্দোলনই ভারতবর্ষের প্রথম প্রকাশ্য জাতীয় আন্দোলন। এরূপ বাংলা গঠিত হওয়ার ফলে বাংলা ভাষাভাষী সমস্ত বাঙালির জন্য এটাই ছিলো প্রথম স্বাতন্ত্র্যিক বাঙালির বাংলা। অবশ্য ১৯৪০- এ ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে বাঙালির আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তা ১৯৪৭-এ বাংলা বিভক্তি (পশ্চিম বাংলা ও পূর্ব বাংলা) নস্যাৎ করে দেয়।

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন, তা বাস্তব রূপ লাভ করে ১৯৭১-এ।

বাঙালি এখন তৃতীয় জাগরণের পর্যায় অতিক্রম করছে। এই জাগরণ পূর্ববর্তী দুটি জাগরণ থেকে ভিন্ন ধরনের। চৈতন্যদেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম, ইসলামের সাম্যবাদী মূল্যবোধ এসব ছিলো প্রথম জাগরণের (ষোড়শ শতাব্দী) মূলে। কিন্তু সেই অনুপাতে সমাজের ভিত্তিমূলে অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় ও জীবন প্রণালিতে পরিবর্তন না আসার ফলে অথবা সামাজিক পটপরিবর্তনে যেসব উপাদান অপরিহার্য ছিলো, এই জাগরণ তা দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে নতুন সমাজ বিনির্মাণ হলো না। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন হলো না। পুরানো ও নতুনের সমন্বয় সামাজিক জীবনে কোনো নতুন রূপ দিতে না পারার ফলে এই জাগরণ মূলত ব্যর্থ হলো।

দ্বিতীয় জাগরণের সময়কাল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকে। ইংরেজি শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তি-দর্শন, ভাষা-সংস্কৃতির প্রভাব, বাঙালি জীবনে নিয়ে এলো আরেক নতুনত্ব। মানসিক জীবন গড়ে উঠলো অতি উচ্চমানের, একেই বলে বেঙ্গল রেনেসাঁ (Bengal renaissance)। এই পরিবর্তন এলো সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের ভাব জগতে। কিন্তু আনুপাতিক হারে সমাজের ভিত্তিমূল অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় এবং জীবন প্রণালিতে সাড়া জাগাতে পারলো না।

ব্যক্তি বিশেষের পুনর্জন্ম আজকের বিজ্ঞান স্বীকার করে না। কিন্তু জাতির বেলায় পুনর্জাগরণ বারবার হতে পারে। বাঙালির জীবনে যে দুবার জাগরণ এসেছিলো তা ছিলো ক্ষণস্থায়ী।

তৃতীয় জাগরণের যে পর্যায়কাল এখন চলছে, তা বাঙালির জীবন ও সমাজের ভিত্তিমূলে অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন আনছে। তৃতীয় জাগরণের এই প্রতিনিধিরা হলেন- বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে: জগদীশ চন্দ্ৰ বসু, স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বসু, ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, জামাল নজরুল ইসলাম প্রমুখ; পাণ্ডিত্যে: অক্ষয় কুমার দত্ত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায়, ড. সুকুমার সেন, ক্ষিতিমোহন সেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ড. আহমদ শরীফ প্রমুখ; দর্শনে: সুরেন্দ্র নাথ দাসগুপ্ত, বিমল কৃষ্ণ মতিলাল প্রমুখ; সাহিত্যে: কাজী নজরুল ইসলাম, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্র নাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন, হুমায়ুন কবির, এস. ওয়াজেদ আলী, কাজী আবদুল ওদুদ, অন্নদা শঙ্কর রায়, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, জসীমউদ্দীন, মুহম্মদ বরকত উল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সৈয়দ মুজতবা আলী, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখ; ইতিহাস চর্চায়: অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধায়, নীহাররঞ্জন রায়, ড. আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তরফদার প্রমুখ; নাটক, চিত্রকলা ও চলচ্চিত্রে: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুল প্রসাদ, ডি.এল. রায়, হিরালাল সেন, রজনী কান্ত সেন, শিশির ভাদুড়ি, নন্দলাল বসু, সত্যজিৎ রায়, জয়নুল আবেদীন, এস.এম সুলতান, কামরুল হাসান, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্ত, মুনীর চৌধুরী, ওবায়দুল হক, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান, বনানী চৌধুরী, উত্তম কুমার, সূচিত্রা সেন প্রমুখ; নৃত্যকলা ও সংগীতে: উদয় শংকর, বুলবুল চৌধুরী, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, পণ্ডিত রবি শঙ্কর প্রমুখ; লোকসংগীতে: লালন ফকির, হাসন রাজা, আব্বাস উদ্দীন, আবদুল আলীম, শাহ্ আবদুল করিম, পূর্ণদাস বাউল প্রমুখ; শিক্ষা ক্ষেত্রে: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, মওলানা মনিরুজ্জমান ইসলামবাদী, নবাব ফয়জুন নেছা চৌধুরানী, মওলানা আকরম খাঁ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, শামসুন্নাহার মাহমুদ, অম্লান দত্ত প্রমুখ: কৃষক ও গণবিদ্রোহ: তিতুমীর, টিপু পাগলা প্রমুখ; সমাজ সংস্কারে: হাজী শরীয়ত উল্লাহ, দুদু মিয়া প্রমুখ; অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস; স্থাপত্য বিদ্যায় ড. এফ. আর. খান ।

বাঙালিকে তার সত্যিকার মর্যাদায় আসীন করতে যিনি ঐতিহাসিক ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি হলেন শ্রী নীরদ চন্দ্র চৌধুরী। আর বাঙালি প্রতিভার শীর্ষ আসনে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালি নেতৃত্বের মান ছিলো সর্বভারতীয়। এঁদের মধ্যে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শ্রী অরবিন্দ, বিপিন পাল, কমরেড মুজাফ্ফার আহমদ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাসিম প্রমুখ। শুধুমাত্র শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ছিলো অবাঙালিদের হাতে। এর ঐতিহাসিক কারণও ছিলো। পাল বংশের পর (যারা বাঙালি ছিলেন) সেন বংশ, তুর্কি, আফগান, আরবি, হাবশী, মোঘল, সর্বশেষ ব্রিটিশ শাসক, এদের প্রত্যেকে অবাঙালি হওয়ার কারণে অবাঙালিরাই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলো। পরবর্তীতে ১৯১১-তে কলকাতার পরিবর্তে দিল্লি ভারতের রাজধানী হওয়ায় কেবল অর্থনীতির ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বও উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতে চলে যায়। আর বাঙালি উচ্ছিষ্ট ভাগাভাগিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারই ফল হিন্দু-মুসলমান বিভেদ। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সামাজিক গতিশীলতা (dynamism) বাঙালির জীবনকে পরিচালিত করলো তার অমোঘ নিয়মে। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘ফকির বিদ্রোহ’, ‘ফরায়েজি আন্দোলন’, ‘সন্ন্যাস বিদ্রোহ’, কৃষক বিদ্রোহ এবং তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতার বিরোচিত আত্মত্যাগ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টি বাঙালির অগ্রযাত্রাকে সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬-দফা, ১৯৬৯-’৭০-এ ছাত্র সমাজের ১১-দফা, সর্বোপরি ১৯৭১-এর সশস্ত্র যুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টি করলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস' এর ভূমিকাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে এক মৌলিক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনা বাঙালির তৃতীয় জাগরণকে অতিদ্রুত সামনে নিয়ে আসে।

এই শতাব্দীর ২০২৫ নাগাদ বাঙালি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৪৫ কোটি। এই ৪৫ কোটি জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে থাকবে পৃথিবীর নিম্নলিখিত অঞ্চলসমূহে - বাংলাদেশ, পশ্চিমবাংলা, আসাম, মেঘালয়, বিহার, উড়িষ্যা, মনিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড মিজোরাম, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, রাজস্থান, কর্ণাটক, কেরালা, মুম্বাই, আন্দামান-নিকোবর, পণ্ডিচেরী, আরাকান, নেপাল, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, জাপান, কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মান, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে। জাতিগতভাবে সংখ্যার দিক থেকে বাঙালি এই জনগোষ্ঠী হবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। তৃতীয় জাগরণের এই পর্যায়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীর থাকবে এক শক্তিশালী সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়। চীনা, ইংরেজ, ফরাসি, আরবিভাষাভাষীদের সমতুল্য হবে এই বাঙালি জনগোষ্ঠী। শুধুমাত্র ভাষা, অঞ্চল অথবা ধর্ম-বর্ণভিত্তিক পরিচয়ই নয়, এই পরিচয় হবে প্রতিটি বাঙালির পেশা ও কর্মভিত্তিক। যেমন বাঙালি দক্ষ কারিগর, বাঙালি খামার চাষি, বাঙালি প্রকৌশলী, বাঙালি ব্যবসায়ী, বাঙালি ডাক্তার, বাঙালি কূটনৈতিক, বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক, বাঙালি আইনবিদ, বাঙালি সাংবাদিক, বাঙালি সৈনিক ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত হবে। এক কথায় বলা যায়, আজকের পৃথিবীতে অন্যান্য রাষ্ট্রের নাগরিকগণ যেভাবে পেশা ও বৃত্তির দ্বারা পরিচিত, বাঙালিরাও অনুরূপভাবে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখেই তার পরিচয় বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরবে। আগামী শতাব্দীর শুরুতে পেশা-কর্মভিত্তিক এই নতুন পরিচয় নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতিত্বের নতুন সংজ্ঞা উপস্থাপন করবে। বাঙালির যাত্রা এখন সেই পথে। তৃতীয় জাগরণের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাঙালির জীবনে আমূল পরিবর্তিত অবস্থার বাস্তব রূপ।

আগের দুই জাগরণ থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। সেই দুই জাগরণ অভ্যন্তরীণভাবে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এনেছিলো। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে তেমন কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি। শ্রী চৈতন্য, রাজা রামমোহন রায়, স্বামী বিবেকানন্দ, স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বসু, লালন ফকির, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর তেমন কোনো ব্যক্তিত্বই বিদেশে পরিচিত-আলোচিত নন। কিন্তু আজ বাঙালির অবস্থান পৃথিবীর সর্বত্র। আজকের বাঙালিরা পৃথিবীর যে যেখানে দাঁড়িয়ে গেছে, সেখানে তার পেশাগত যোগ্যতা নিয়েই অবস্থান করছে। তার উপরে রয়েছে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালিদের পরবর্তী প্রজন্মের বিদেশের মাটিতে সুদৃঢ় অবস্থান। আজকের পৃথিবীতে তথ্য-প্রযুক্তির কারণে (information technology) বাইরে গড়ে উঠা বাঙালির পেশাগত দক্ষতা-প্রাজ্ঞতা, প্রযুক্তি-সম্পদ ইত্যাদি নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক যোগসূত্রের কারণে চক্রাকারে ফিরে আসতে হবে তার শেকড়ে। সব জাতির বেলায়ই একথা প্রযোজ্য। পঞ্চাশ, ষাট বছর আগেও বাঙালির জনজীবন ছিলো ভিন্ন প্রকৃতির। সেই নির্ভীক, সহজ-সরল বাঙালি নর-নারী আজ কোনো না কোনো কৰ্ম-পেশার সঙ্গে যুক্ত। যে কারণে বাঙালির পরিচয় আজ আর কেবল বাংলা ভাষাভাষী বা কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বী অথবা কোনো দেশের নাগরিক হিসেবেই যথেষ্ট নয়। প্রযুক্তির কারণে বাঙালিরা তাদের পেশাগত জীবনে আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এক সময় বাঙালির পরিচয় ছিলো কেবল নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী হিসেবে, পরে তা বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে। আজ এবং আগামীতে বাঙালির পরিচয় হবে তার কর্ম ও পেশাভিত্তিক। অর্থাৎ, আমরা যেমন বলে থাকি রাশিয়ান বিজ্ঞানী, আমেরিকার শিল্প-উদ্যোক্তা, জাপানি প্রযুক্তিবিদ, গ্রিসের স্থপতি, চীনা শ্রমিক-কৃষক, ব্রিটিশ কূটনৈতিক, ব্রাজিলিয়ান ক্রীড়াবিদ, জার্মান অর্থনীতিবিদ, স্কটিশ শিক্ষাবিদ, আফ্রিকান শ্রমিক, স্পেনীয় নাবিক, নেপালি মূর্খা সৈনিক, ইতালীয় ব্যবসায়ী, ইরানি কবি-সাহিত্যিক ইত্যাদি। ঠিক তেমনি বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রত্যেককে কোনো না কোনো পেশাভুক্ত করা যাবে। অন্যকথায় বলা যায়, বাঙালির ভবিষ্যৎ দক্ষ কারিগর, বাঙালি খামার চাষি, বাঙালি ডাক্তার, বাঙালি প্রকৌশলী, বাঙালি বিজ্ঞানী, বাঙালি সৈনিক, বাঙালি ব্যবসায়ী, বাঙালি প্রযুক্তিবিদ, বাঙালি শিল্পী-সাহিত্যিক, বাঙালি আইনবিদ, বাঙালি সাংবাদিক ইত্যাদি। সমগ্র পৃথিবীতে আজ চলছে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা। ফলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে বদলে যাচ্ছে জীবন-জীবিকার ধরন।

সারা পৃথিবীতে আজ জ্ঞানভিত্তিক তথ্য-প্রযুক্তি, কম্পিউটার-বিজ্ঞান, জৈব-প্রযুক্তি, বংশগত-প্রকৌশল, পারমাণবিক-বিজ্ঞান, মহাশূন্য-প্রযুক্তি, পরিবেশ- বিজ্ঞান, সামরিক-বিজ্ঞান, যন্ত্র-মানব ইত্যাদি জ্ঞানের প্রসার উন্নত, উন্নয়নকামী দেশ নির্বিশেষে জনজীবনকে প্রবাহিত করছে। জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়নের এই পর্যায়কে থার্ড ওয়েভ (third wave) বলা হয়। এর ফলে মাত্র পঞ্চাশ বছরের পূর্বকার শিল্প-কারখানাভিত্তিক কর্মজীবন মানুষের জীবনপ্রণালি, চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ এমনকি ধর্মবিশ্বাসেও পরিবর্তন ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই শিল্প কারখানাভিত্তিক সভ্যতার বয়স ধরা হয় মাত্র তিনশ বছর। অর্থাৎ যেদিন থেকে বাষ্প ইঞ্জিন (steam engine) ও বিদ্যুৎ ব্যবহার শুরু হয়েছে। এই পর্যায়কে সেকেন্ড ওয়েভ (second wave) বলা হয়। এর পূর্বে দশ হাজার বছর ব্যাপী কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নরূপে । তখনকার মানুষের ধ্যানধারণা, কর্মজীবন, জীবন পদ্ধতি, ধর্মবিশ্বাস এমনকি পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ছিলো পরবর্তী দু’ধরনের সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একে বলা হয় ফার্স্ট ওয়েভ (first wave)। এর পূর্বে গোত্র-উপজাতি, পশুপালন (nomadic) পর্যায়ে যে সমাজব্যবস্থা ছিলো তাকে কোনো সভ্যতার ওয়েভ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাহলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতে অগ্রগতির প্রভাব মানুষের জীবনযাপন, ধর্মবিশ্বাস, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার পদ্ধতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সবকিছুতেই যুক্ত করছে নতুন নতুন মাত্রা ।

অন্যদিক থেকে বর্তমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। সেক্ষেত্রেও তিন ক্যাটাগরির উন্নয়ন ব্যবস্থার দৃশ্য দেখা যায়। প্রথমোক্ত ক্যাটাগরিতে থাকছে উন্নত পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশসমূহ (আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, ব্রাজিল, আসিয়ান ইত্যাদি) যারা তথ্য-প্রযুক্তি, কম্পিউটার বিজ্ঞানসহ অন্যসব উন্নত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখছে। এসব দেশে রাষ্ট্র ও সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন ইত্যাদি রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সীমিত করে দিচ্ছে। আত্মনির্ভরশীল ও আত্মসম্পর্কিত কর্মকাণ্ড প্রায় একক সংস্কৃতির সৃষ্টি করছে। সরকার থাকছে ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা হিসেবে। জাতীয় স্বার্থ, ভৌগোলিক সীমারেখা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এসব বিষয় অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক আসরে পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়াদি আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে। সরকারের মূল দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের নিরাপত্তা প্রদান। গণতন্ত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নাগরিক সমাজে (state and civil society)। ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’র (participatory democracy) এই ধাপ অত্যন্ত উন্নত স্তরের।

দ্বিতীয় ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ছে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা এবং আধুনিক কৃষি কাজ নির্ভর দেশ সমূহ-ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, বাংলাদেশ এই দ্বিতীয় ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত। প্রথম ক্যাটাগরির দেশসমূহ থেকে প্রযুক্তি নিয়েই তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এ দুইয়ের মধ্যে থাকছে অতি নিকট সম্পর্ক। কখনো রাষ্ট্র শিল্প- ব্যবস্থাকে আবার কখনো শিল্পব্যবস্থা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করছে। জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে তার ক্ষমতা থাকছে অনেক বেশি। প্রথম ক্যাটাগরি থেকে প্রাপ্ত প্রযুক্তি কলাকৌশল আয়ত্ত করে সেই প্রথম ক্যাটাগরির প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতিযোগী হয়ে উঠছে দ্বিতীয় ক্যাটাগরির দেশসমূহ। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে থাকছে এক ধরনের মিশ্রতা। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ধারণা থাকছে প্রখর। জাত্যাভিমানের কারণে দ্বিতীয় কাট্যাগরির মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধাত্মক সম্পর্কটিও প্রাধান্য পায়। অভ্যন্তরীণভাবে সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রায়ই মাথা চাড়া দেয়। রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা হচ্ছে জনগণের সাধারণ প্রতিনিধিত্ব’র এবং কর্ম-পেশাভিত্তিক বিশেষ প্রতিনিধিত্ব'র সংমিশ্রণে অর্থাৎ ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’।

তৃতীয় ক্যাটাগরির মধ্যে আছে মূলত এশিয়া আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার পিছিয়ে পড়ে থাকা দেশসমূহ। গোত্রীয়-উপজাতীয়-আধা-সামন্ত প্রভুত্ব করার প্রবণতা দেখা যায়। এরা কখনো কখনো গণতন্ত্রের কথা বলে এবং কখনো কখনো প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রবর্তনও করে। কিন্তু সবকিছুর মূলে থাকে একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা। এসব দেশে সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশে উন্নয়ন ঘটছে। জনগণের বেশিরভাগ থাকছে অতি গরিব। প্রথম ও দ্বিতীয় ক্যাটাগরির দেশ থেকে আমদানিনির্ভর এদের অর্থনীতি। এদের কৃষি ও খনিজ সম্পদ কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্যাটাগরির দেশসমূহ। এসব দেশ থেকে দক্ষজনগোষ্ঠী (brain-drain) প্রবাসী হিসেবে চলে যাচ্ছে প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্যাটাগরির দেশসমূহে। জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব প্রথম ও দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ধারণা থেকে ভিন্ন এসব দেশে। যদিও গোটা বিশ্ব আজ একই প্রযুক্তিগত বলয়ে অবস্থান করছে। তা সত্ত্বেও উপরোক্ত তিনটি বিভক্তিও থাকছে। গোটা পৃথিবী একটি কাঠামোর নির্দিষ্ট রূপ নিচ্ছে। এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত কখনো কখনো দানা বাঁধছে আবার পারস্পরিক ঐক্যের চিত্রও পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই দ্বন্দ্বসমূহ বৈরিতার নয়, বরং মিলনের।

এরূপ দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীতে বাঙালির অবস্থান নিঃসন্দেহে খুবই সম্ভাবনাময়। আজকের পৃথিবীর জাতিসমূহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে গতি প্রবাহের সূচনা করেছে, তাতে বাঙালি জাতি তার সমস্ত শক্তি নিয়েই যুক্ত হবে। সমগ্র মানবজাতি শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সহযোগিতামূলক কর্মপন্থার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের যে পথ সৃষ্টি করেছে, বাঙালির যাত্রাও সেই লক্ষ্যের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। একদিকে পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সুদৃঢ় অবস্থান, অন্যদিকে বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পৃথিবীর সমস্ত 'বাঙালির কেন্দ্র' হিসেবে বিবেচিত হবে। পৃথিবীতে এমনি ধরনের রূপচিত্র আমরা দেখি চীনা, ইংরেজ, আরব, ফরাসি, স্প্যানীশ ভাষাভাষীজনগোষ্ঠীর মধ্যে। আর এভাবেই পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালি থাকবে তার স্বকীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এটা হবে বাঙালির তৃতীয় জাগরণের রূপ ।

সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকেও একই ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ঐক্য বিদ্যামান। যেমন, চীনা ভাষাভাষী, ইংরেজ ভাষাভাষী, আরবি ভাষাভাষী, ফরাসি-স্পেনীয় ভাষাভাষী তেমনি অন্যদিক থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা মনে করে ইসরাইল তাদের কেন্দ্রভূমি ।

সুতরাং, ২০২৫ নাগাদ সারা পৃথিবীতে যে ৪৫০ মিলিয়ন (৪৫ কোটি) বাঙালি বসবাস করবে তারা বাংলাদেশকেই তাদের কেন্দ্র হিসেবে মনে করবে। তাদের মধ্যে গড়ে উঠবে সাংস্কৃতিক ঐক্য। সুতরাং সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশ কেন্দ্রিক’ হতে হবে। তাদেরকে জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার পর্যায়ে উন্নীত করণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে।

এই লক্ষ্যে তিনটি প্রধান করণীয়–

এক. রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বপর্যায়ে দলীয় শাসনের প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রমজীবী-পেশাজীবী জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক অংশীদারিত্বের সুযোগ দিতে হবে ।

দুই. জাতিত্ব ও জাতীয়তাবোধকে নিছক ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পেশাভিত্তিক জাতিত্ব পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে।

তিন. সার্ক অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহকে ভৌগোলিক সীমারেখা অক্ষুণ্ণ রেখে ভাষা ও সাংস্কৃতিক নৈকট্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক নৈকট্য বিবেচনা করে উপ-আঞ্চলিক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে হবে।

এই লক্ষ্যে পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল, উপ-আঞ্চলিক সম্প্রীতির চারটি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে এবং তা হবে রাজনৈতিক নৈকট্য, অর্থনৈতিক, ভাষা-সংস্কৃতির সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করেই।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।