প্যালেস্টাইন নিয়ে কথা বলা বন্ধ করবেন না


আমেরিকার প্রতিটি মুসলিম নাগরিক জানে যে প্যালেস্টাইনের প্রতি ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলার অর্থ  দুই দফায় শাস্তি পাওয়া: এক দফা আপনাকে ‘ইসলামোফোবিয়া’ (বা ইসলা্মের প্রতি আতংকের) মোকাবিলা করতে হবে, এবং আরেকবার ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লংঘনের  জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করছেন বলে  ইহুদি বিদ্বেষী (antisemite) হিশাবে কুখ্যতি কুড়াতে হবে। 

রাশিদা তালাইব এবং ইলহান ওমরের মতো মুসলিম আমেরিকান আইনপ্রণেতাদের বিরুদ্ধে যে সকল প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি সেখান থেকে এই শিক্ষাটার যথেষ্ট প্রমাণ আমরা পেতে পারি। যখনই তারা ফিলিস্তিনি জনগণকে মানুষ বিবচনায় তাদের মানবিক দিক হাজির করবার চেষ্টা করেছেন,  তখন ইসলামফোবিক কটাক্ষ হেনে তাদের চরিত্রের উপর হামলা হয়েছে, যার মিথ্যা আন্দাজ হচ্ছে ইহুদিদের ঘৃণা করতেই মুসলমানদের শেখানো হয়। এই বর্ণবাদী স্টেরিওটাইপটি সম্প্রতি Center for Security Race & Rights প্রকাশিত যুগান্তকারী রিপোর্টে (‘Presumptively Antisemitic: Islamophobic Tropes in the Palestinian-Israel Discourse) স্পষ্টভাবে খণ্ডন করা হয়েছে।  এই প্রতিবেদনটি আগাম খারাপ অনুমান বা আন্দাজি বিশ্বাসের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনি, আরব এবং মুসলিমসহ বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত  তাদের কন্ঠস্বর নিস্তব্ধ করে দেবার অস্ত্র হিশাবে যেভাবে ব্যবহৃত হয় তার গোমর ফাঁস করে দেবার জন্য ভাল একটি গবেষণা-কাঠামো হিশাবে কাজ করে। 

বিগত মাসগুলোতে আমেরিকানরা দেখেছে ইসলাম সম্পর্ক বদ্ধমূল অনুমানের ভিত্তিতে যে সকল ভয়ভীতি ও আতংক কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে তার কারণে  মানুষ চাকরি হারাচ্ছে , ফিলিস্তিনি আমেরিকানদের গুলি এবং ছুরিকাঘাত করা হচ্ছে , এবং বিক্ষোভকারীদের জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে – ফিলিস্তিনিরাও মানবাধিকারের যোগ্য শুধুমাত্র এই মতামত প্রকাশের অপরাধে । যখন আমেরিকানরা সাহসের সঙ্গে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে, তখন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস তাদের চরমপন্থী হিসাবে বর্ণনা করেন, এটা লজ্জাজনক। কলম্বিয়া এবং রুটগারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ‘স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন’ সাসপেন্ড করে ফিলিস্তিন বিষয়ে ছাত্রদের বক্তৃতা দমন করেছে।

মুসলিমদের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার শাস্তি প্রায়শই কঠোর  হয়।

আমি কর্মজীবনে একজন মানবাধিকার আইনজীবী এবং প্রফেসর, অথচ ব্যক্তিগতভাবে মিথ্যা অনুমানের ভিত্তিতে আমাকে ইহুদি-বিরোধী বলে অভিযূক্ত হবার অভিজ্ঞতা রয়েছে।  অথচ আমি প্রকৃত ইহুদি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করি, সেই প্রচেষ্টা সহ আমাদের এবং বিশ্বসমাজের   সমস্ত দুর্বল সদস্যদের অধিকার রক্ষার জন্য আমি আমার সম্পূর্ণ পেশাগত কর্মজীবন উৎসর্গ করেছি। 

২০১৪ সালে, টাইমস স্কোয়ারে ফিলিস্তিনি মানবাধিকারের সমর্থনে একটি সমাবেশে যোগদান শেষে আমার স্বামী এবং সন্তানদের বিশ্রামাগার থেকে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করার সময়, একজন পুলিশ অফিসার  আমাকে রীতিমতো হামলা করে গ্রেপ্তার করে। একটু স্মরণ করে দেখুন, সময়কালটা ২০১৪ সাল। গাজায় ৫০ দিন ধরে বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল এবং সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছিল ফিলিস্তিনি শিশুদের। আমি সেই সময় ‘নিউইয়র্ক সিটি পাবলিক অ্যাডভোকেট’-এ একজন শীর্ষ আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত পদ থেকে অস্থায়ী ছুটির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, যেন ১১০০ জনেরও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পর বাংলাদেশে মানবাধিকার সংক্রান্ত গবেষণা চালানোর জন্য আমি বাংলাদেশে যেতে পারি। যখন আমি আমার গ্রেপ্তারের জন্য জনসমর্থন চেয়েছিলাম, তখন নিউইয়র্কে নির্বাচিত একজন প্রগতিশীল কর্মকর্তা লিখেছিলেন: “আমি ঘটনাটি টুইটারে দেখেছি এবং সহানুভূতি প্রকাশের ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু এখানে ফিলিস্তিন এবং পুলিশি ব্যাপারস্যাপার ওভারল্যাপিং বা জট বেঁধে রয়েছে, বিষয়গুলির জটিলতা আমি যতটা বুঝতে পারি তার চেয়েও বেশি জটিল। কিভাবে ১৪০ অক্ষরে সেটা সম্বোধন করা যায়! " সেই  নির্বাচিত কর্মকর্তা আমার বেআইনি গ্রেপ্তারের পুলিশি দিক নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক, কিন্তু ফিলিস্তিনের বিষয়ে নয়।  কারণ প্যালেস্টাইনের বিষয়ে কথা বললে তার নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। 

আমি ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে টাইমস স্কোয়ারে উপস্থিত ছিলাম –  এই সত্য গোপন না করে আমার গ্রেপ্তার চ্যালেঞ্জ করে একটি মামলা দায়ের করেছি এবং বলেছি আমি গ্রেপ্তারটিকে ইসলামফোবিক হিসাবে দেখেছি । মিডিয়া আমার শহরের নিয়োগকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তারা বলে আমি নাকি সেখানে কাজ করি না । বার্তাটি পরিষ্কার আমি বুঝে যাই। তাই, আমি আমার মানবাধিকার গবেষণা ফেলোশিপ শেষ করে কোন চাকুরি ছাড়াই নিউইয়র্কে প্রত্যাবর্তন করি, অথচ আমাকে শহরের " শীর্ষ কাউন্সিল" হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। 

যেসকল ছাত্রছাত্রী আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার সমর্থন করবার পক্ষে কথা বলে তাদের চাকুরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অভিজাত ল’ ফার্মগুলো  সেই সকল আইনের ছাত্রছাত্রীদের অতীব গর্বের সাথে তাদেরই দেওয়া চাকুরির অফারগুলি প্রত্যাহার করে, আমি তাদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ ভেবে আতংকিত হই— এবং বুঝতে পারি যে এই ধরনের দমন-পীড়ন খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আমার স্বেচ্ছাসেবক কাজ থেকে জানি যারা প্যালেস্টাইনের জন্য বক্তৃতার কারণে জীবিকা হারিয়েছেন আর তাদের আইনি পরামর্শ এবং সহায়তা প্রদান করেন যেসব শিক্ষাবিদ, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং অন্যান্য পেশার লোকজন – শুধু  ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করার অপরাধে তারা  হয়রানি, বৈষম্য এবং চাকরি হারানোর অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। 

সেই ভিত্তিহীন গ্রেপ্তারের চার বছর পর, আমি সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্কের (CUNY) স্কুল অফ ল’ ফ্যাকাল্টিতে যোগদান করি। ফিলিস্তিনি মানবাধিকার উত্থাপনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমার অংশগ্রহণ করার কারনে আমি ডানপন্থী জায়নবাদী গোষ্ঠীগুলির ম্যাকার্থি আমলের মতো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠি।  ডানপন্থি জায়নবাদী গোষ্ঠিগুলি জায়োনিস্ট-বিরোধী নীতি ধারণ করা আর  ইহুদি-বিরোধী ধর্মান্ধতাকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্যে ফারাক ভেঙে দেয়। প্রতিবার যখন আমি ফিলিস্তিনি অধিকার সংক্রান্ত কোন একটি পিটিশনে সই করি, তখনই আমি ইমেল পাই যেখানে  আমাকে কোন ভিত্তি ছাড়াই ‘এন্টি-সেমাইট’ (ইহুদি বিদ্বেষী) হিশাবে  লেবেল দেওয়া হয়।

গাজায় ইসরায়েলের বর্তমান অবরোধের কয়েক মাস আগে, ডানপন্থী সংগঠন এবং মিডিয়া আউটলেটগুলি CUNY-এর জন্য তহবিল কেটে দেবার আহ্বান জানিয়েছিল। কারণ আমাদের একজন মুসলিম স্নাতক ছাত্র স্পিকার, যে তার সমবয়সীদের দ্বারাই নির্বাচিত – সে  পুলিশি বর্বরতা এবং ইসরায়েলের মানবাধিকার লংঘনের  বিষয়ে কথা বলেছেন৷ অথচ তার মন্তব্য জাতিসংঘের রিপোর্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ইসরায়েলের দখল করে রাখা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বেআইনি। প্রতিটি বড় মানবাধিকার সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই একই ধরনের বিবৃতি জারি করেছে।

নিছক Presumptively Antisemitic বা অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে এন্টিসেমিটিক  হিশাবে   হাইলাইট চিহ্নিত করা এটাই বিশেষ ভাবে আমাদের দেখায় যে কিভাবে শিক্ষার্থীরা একটি প্রতিকূল একাডেমিক পরিবেশ অনুভব করে চলেছে যা তাদের শেখার ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত করে তুলছে এবং শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিসর বৃদ্ধি এবং বোঝাবুঝির বৃহত্তর ক্ষেত্রগুলো বোঝার সমস্ত সুযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে। আমরা এই মুহূর্তে ইসলামের প্রতি আতংকজনিত প বিদ্বেষ লক্ষ্য করছি, যখন সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের (CUNY ) সমস্ত ধর্ম ও জাতিসত্তার ছাত্রছাত্রী  ফিলিস্তিনি জনগণের মানবাধিকার ঘিরে সংগঠিত হচ্ছে। কিন্তু ফিলিস্তিনি, আরব এবং মুসলিম ছাত্রছাত্রীরাই  বেশি  টার্গেট এবং অপবাদের শিকার। অনুমানমূলকভাবে কাউকে অ্যান্টিসেমিটিক  অভিযোগ আনা সংক্রান্ত রিপোর্ট যথার্থই বলেছে, "ইস্রায়েলের পক্ষে মার্কিন নীতির ধারাবাহিক পক্ষপাতিত্ব বজায় রেখে ফিলিস্তিনিদের নাগরিক, মানবিক এবং জাতীয় অধিকারের স্বীকৃতি অস্বীকার করার জন্য ইসলামফোবিয়াকে অস্ত্র বানানো হয়েছে।"

আপনি যদি মুসলিম হন তখন ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য কঠোর শাস্তি প্রায়শই বেশি হয়। অনুমানে কাউকে এন্টিসেমিটিক  বলার এই বাস্তবতাকে Presumptively Antisemitic-এর রিপোর্ট ব্যাখায় করেছে  “বর্ণবাদী ডবল স্টান্ডার্ড’ (racialized double standard) হিশাবে। মানবাধিকারের পদ্ধতিগত লঙ্ঘনের জন্য ইসরায়েলকে দায়বদ্ধ রাখতে মার্কিন সরকারের ক্রমাগত ব্যর্থতার সমালোচনা করার জন্য মুসলিম আমেরিকানরা যখন তাদের সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত "বাকস্বাধীনতা"-র অধিকার প্রয়োগ করে, তখন তারা প্রায়শই " নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক হুমকি হিসাবে বিবেচিত হয়, যাদের নিদেন পক্ষে সামাজিক ভাবে কলংকিত করা আর সবচেয়ে খারাপভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়।"

সম্প্রতি আমি আমার সোশ্যাল মিডিয়া ফিডে একটি ‘মিম’‘পপ আপ দেখেছি যাতে লেখা ছিল: "ফিলিস্তিন সম্পর্কে কথা বলা বন্ধ করবেন না।" এটি আমাদের মনে করিয়ে দেবার জন্য খুবই দরকারি স্মারক যে সেন্সরশিপ ফিলিস্তিনিদের জন্য মারাত্মক। যখন লিখছি তখনকার গণনা অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা 20,000 ছাড়িয়েছে , এর কোন শেষ দেখা যাচ্ছে না। আমরা ব্যক্তিগতভাবে যে চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করি না কেন , এমনকি একজন পেশাদার অবস্থানে একজন দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম পেশাজীবী –  ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের লাগামহীন বোমাবর্ষণ এবং তাদের অনাহারের তুলনায় আমাদের নিপীড়ন নিতান্তই ফ্যাকাশে।।

 (এ লেখাটি commondreams.org ওয়েব পত্রিকায় ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে আমরা তার বাংলা অনুবাদ পেশ করছি।)

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।