বিজয় দিবস 


।। ১।।

আজ বাংলাদেশের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করবার দিন। যারা জীবনপণ লড়েছেন এবং বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করবার জন্য জীবন দিয়েছেন। আজ আমরা আমাদের সেই সকল যোদ্ধাদের স্মরণ করব, যাদের ঋণ কখনই শোধ হবার নয়। আজ ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ও চেতনাবাজদের মুখোশ খুলে ফেলার দিন।

এটাও স্মরণে রাখতে হবে সেই সকল অকুতোভয় সৈনিকদের আত্মত্যাগের সঙ্গে আমরা প্রতিদিনই বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছি। কারন আমরা ধরে নিয়েছি যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে বাংলাদেশে ধর্ম বনাম ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতিবাদ বনাম ইসলাম ইত্যাদি নানান কিসিমের বিরোধ ও দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে আমরা বাংলাদেশে নিরন্তর একটা গৃহযুদ্ধ জারি রেখেছি। আমরা বাংলাদেশে কেউ সজ্ঞানে আর কেউ না জেনে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছি। আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা নাই, স্বাধীন ভাবে সভা-সমাবেশ, মিছিল বিক্ষোভ করবার অধিকার নাই। ভোটের অধিকারসহ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সকল মানবাধিকার বাংলাদেশে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। আমরা ভেড়ার পালে পরিণত হয়েছি। 

যাদের ধারণা বাংলাদেশকে নতুন করে গঠন করবার আসল লড়াই বাদ দিয়ে শুধু ভোট দিতে পারলেই আমাদের সকল সমস্যার সমাধান হবে -- আজ তাদের নিন্দা করবার দিন। না, ভোটাভুটির ব্যবসা আর গণতন্ত্র এক কথা নয়। ভোট বেচাকেনার ব্যবসা ভোটের রাজনীতি বরং আরও শক্তিশালী করে। মাফিয়া ও লুটেরাদের রাষ্ট্র আরও বৈধতা পায়। আমাদের চোখের সামনেই বিশাল ভোটের বাজার বসেছে। রমরমা ব্যবসা চলছে। আমরা কতোটা মূর্খ ও অজ্ঞ হয়েছি সেটা বর্তমান বাংলাদেশ দেখলে খুব সহজে যে কেউই বুঝতে পারবে। পাকিস্তানের পরাধীন থাকার সময়ের চেয়েও আরও ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দুর্দশার মধ্যে আমরা পড়ে গিয়েছি। আমাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে।

আজ মনে করবার দিন যে একাত্তরের যুদ্ধ ছিল অসম্পূর্ণ। কারন আজকের এই দিনটি ইসলামাবাদের অধীনস্থতা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে দিল্লির উপনিবেশ এবং দিল্লি সমর্থিত একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়েছে। অথচ গ্লানিবোধটুকুও আমাদের নাই। আজ ইসলামাবাদের অধীনস্থতা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে দিল্লির পরাধীন করবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আজ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম বিকাশ রুদ্ধ করবার দিন।

অতএব আজ বাংলাদেশকে সত্যকার অর্থে স্বাধীন করবার লক্ষ্যে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কায়েম করবার জন্য অঙ্গীকার গ্রহনের দিন।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

মনে রাখুন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে এই আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে উপস্থিত রাখা হয় নি। তাই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে এই দিন পাকিস্তানের পরাজয়ের দিন।

নদী প্লাবিত বাংলাদেশের স্মৃতি নাই। এই প্লাবন ভূমিতে কেবলই মেরুদণ্ড ফাঁপা হোগলার পাতা জন্মে। নদী রক্তের দাগ মুছে ফেলে। লাশ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাই জলাভূমিতে মাছ শিকার করে হার্মাদরা যারযার জায়গায় ফিয়ে যায়।

কিন্তু বাংলাদেশ রক্তাক্ত পড়ে থাকে। আর কত?

।। ২।।

দিল্লি আমাদের দেশ স্বাধীন করে দিয়েছে। উইকিপিডিয়ায় দেখুন দখলদার পাকিস্তান বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্ম সমর্পনের দলিল রয়েছে। নিজে পড়ুন এবং বাংলাদেশের জনগণের পরাধীনতার ইতিহাস নিজে বোঝার চেষ্টা করুন। 

“পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।

এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।

লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন।

লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে”।

পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর দিবসকে আমরা ‘বিজয় দিবস’ হিশাবে পালন করি। দিল্লির কাছে এই দিন পাকিস্তানকে পরাজিত করে পাকিস্তানী সৈন্যদের বন্দি করে ভারতে নিয়ে যাওয়া এবং পাকিস্তানের সঙ্গে নেগোশিয়ান্সের দিন। জয় হিন্দ!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব বা চিহ্ন মুছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ১৬ ডিসেম্বরে। তাই ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা দিবস। মুক্তিযোদ্ধাদের কুর্নিশ জানাবার এবং তাদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ঋণ স্বীকারের দিন।

এই দিন নিজেদের অযোগ্যতা উপলব্ধিরও দিন। কারন আমরা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ কথাটাকে আবেগী আক্ষরিকতার অধিক কোন মর্যাদা দেই না। লজ্জা যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধকেও আমরা সম্পূর্ণ করতে পারি নি, ‘মানুষের মুক্তি’ বহুত দূর কা বাত। আরও লজ্জার, যে আমরা কার্যত পরাধীন এই বোধটুকুওও আমাদের নাই। আমরা যারপরনাই অসচেতন ও অজ্ঞ। রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে বিশ্বে ও উপমহাদেশে আমাদের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক ভূমিকা কি হতে পারে সেটা আলোচনা দূরে থাকুক, জিজ্ঞাসা হিশাবেও সেটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে গরহাজির। অথচ আমাদের সামষ্টিক কর্তাসত্তার রূপ উপমহাদেশে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে কেমন হওয়া উচিত সেই জিজ্ঞাসা ছাড়া কোন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি নিজের শিরদাঁড়া নিয়ে বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকতা পারে না। থাকতে পারে না, সেই বাস্তববুদ্ধিও আমাদের নাই। 

টিক টক টিক টক টিক টক..................

অতএব ফ্যাসিস্ট শক্তিকেই আমরা আমাদের শাসক হিশাবে পেয়েছি। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাই আমাদের জন্য আদর্শ রাজনৈতিক ব্যবস্থা। 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।