ফিলিস্তিন, সাম্রাজ্যবাদ ও গণপ্রতিরোধের তাৎপর্য


এর আগে ভাববৈঠকি-১০-এ আমরা “ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম: ইতিহাস, ভূ-রাজনীতি ও জায়নবাদ” নিয়ে একদফা আলোচনা করেছি। অনেকের সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে প্যালেস্টাইনের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে শহিদ মিনারে অনুষ্ঠান করেছি। এবার আমরা ঘটনাঘটনের আরও একটু গভীরে যেতে চাইছি।

সাতই অক্টোবর হামাসের প্রতিরোধের পর বর্ণবাদী ও জায়নিস্ট রাষ্ট্র ইজরায়েলের হিংস্র পালটা হামলা, নির্বিচার বোমা মেরে গাজাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা, প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়া ইত্যাদির জন্য সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য ইজরাইলের নেতাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি উঠেছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন গাজার স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সর্বশেষ হতাহতের সংখ্যা হচ্ছে গাজায় কমপক্ষে ২০,৯০০। এর মধ্যে ৭০ ভাগই শিশু এবং নারী। আহত ও পঙ্গু হয়েছে প্রায় অর্ধ লক্ষেরও বেশী মানুষ।

এই যুদ্ধ আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইজরাইলের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার যে গ্রন্থি শক্ত করবার চেষ্টা চলছিল সেটা ছিঁড়ে গিয়েছে। তবে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ওসামা হামাদান বলেছেন, "কিছু লোক বিশ্বাস করে যে হামলাগুলি মূলত সৌদি আরব এবং ইজরায়েলি সরকারের সম্পর্ক স্বাভাবিক করণের প্রচেষ্টাকে পঙ্গু করার জন্য করা হয়েছি্ল। এটা অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা”। ওসামা হামাদান লেবাননে হামাসের একজন উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি। তাঁর একটি সাক্ষাৎকার থেকে আমরা একটি পরিচ্ছন্ন বার্তা পাই।

তাহলে হামাসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কারণটা কি ছিল? হামাদান বলছেন, "কারণটি ছিল ইসরায়েলেএকটি চরম ডানপন্থী ধর্মীয় ইহুদিবাদী (জায়নিস্ট) সরকারের উত্থান যারা ফিলিস্তিনি জনগণের (আত্মনিয়ন্ত্রণের) প্রতিটি ইস্যু মুছে ফেলা্র একটি ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি সমস্যাটিকে কার্যকরভাবে শেষ করে দেবার চেষ্টা করেছে। হামাদান সোদি আরবের সঙ্গে হামাসের সম্পর্কের অবনতি যেন না ঘটে তার জন্য পরিষ্কার বলতে চেয়েছেন হামাসের আক্রমণ সৌদি আরবের আঞ্চলিক রাজনীতিকে নস্যাৎ করবার জন্য নয়, বরং প্যালেস্টাইনের জনগণকে রাজনৈতিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ করবার একটা প্রচেষ্টা।

হামাস লড়াইটা শুরু করলো কেন? হামাদানের বক্তব্য হচ্ছে, “শুধুমাত্র ফিলিস্তিনি ইস্যুটিকে স্পটলাইটে ফিরিয়ে আনার জন্য না, বরং এই লড়াই হচ্ছে লড়াইয়ের মর্মবস্তুতে প্রত্যাবর্তন, ফিলিস্তিনী জনগণের নিজেদের মুক্তি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করবার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের প্রয়োজন ছিল। ফিলিস্তিন ইস্যুকে আবার( ভূ-রাজনৈতিক) আলাপ-আলোচনায় তার ন্যায্য ও স্বাভাবিক জায়গায় প্রতিস্থাপনের জন্য এই ধরণের ব্যাপক পদক্ষেপের দরকার ছিল”

এ কারনে এবারের ভাববৈঠকিতে আমরা ইজরাইল-গাজার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনায় গণ প্রতিরোধের তাৎপর্য নিয়ে বিশেষ ভাবে আলোচনা করব।

এটা পরিষ্কার সাতই অক্টোবরের পর মধ্য প্রাচ্য আর আগের মতো নাই। অন্যদিকে সারা দুনিয়ায় প্যালেস্টাইনের জনগণের পক্ষে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করছেন। এছাড়া আরও যেসব বিষয় আমরা আলোচনা করব সেসব হচ্ছে:

১. অনেকের দাবি, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসলে শুরু হয়ে গিয়েছে। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার সংকট যেমন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে একই সঙ্গে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সামরিক প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। শুধু তাই নয় টেকনলজির বৈপ্লবিক অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুদ্ধের চরিত্রও বদলাচ্ছে। তার প্রতিফলন ঘটছে প্রতিরোধের চরিত্রের মধ্যেও। এই দিকগুলো আমাদের বোঝা দরকার।

২. জায়নবাদী রাষ্ট্র ইজরাইলকে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের আলোকে বোঝা খুবই জরুরি। বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে লেনিনের প্রাসঙ্গিকতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে যে সকল তর্ক রয়েছে সেটলার কলোনিয়াল স্টেইট ইজরায়েলকে বোঝার মধ্য দিয়ে লেনিনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান নতুন করে উপলব্ধি করা জরুরি। এই দিকটি আমরা ব্যবহারিক রাজনীতির আলোকে সামনে নিয়ে আসা দরকার। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সংকট যতোই ঘনীভুত হচ্ছে দেশে দেশে গণরাজনৈতিক ধারা শক্তিশালী হয়ে ওঠার শর্তও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩. ধর্মতত্ত্ব ও জাতিবাদের সঙ্গে জায়নবাদের সম্পর্ক বিচার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জন্মসূত্রে ইহুদি হওয়া এবং আধুনিক জাতিবাদী মতাদর্শের প্রভাবে ইহুদি ধর্মালম্বিদের ‘জাতি’ হিশাবে শনাক্ত করার পার্থক্য বোঝা জরুরী।

৪. বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে যাঁরা জায়নবাদের বিরোধিতা করেন এবং প্যালেস্টাইনের জনগণের পক্ষে লড়ছেন তাদের বড় একটি অংশই জন্মসূত্রে ইহুদি। অতএব জায়নবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনের জনগণের লড়াই ইহুদি বনাম মুসলমানদের লড়াই না। ইহুদি হওয়া আর জায়নবাদি হওয়া এক কথা না। কি পার্থক্য বাংলাদেশের জনগণকে সেই দিকটি বোঝানো অত্যন্ত জরুরি। ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বব্যাপী গণমানুষের অধিকারের যাঁরা পক্ষে এই লড়াই তাদের লড়াই। জায়নবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। তাহলে বাংলাদেশে আমরা কিভাবে বৈশ্বিক গণরাজনৈতিক ধারার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করব সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক প্রশ্ন। আমরা তা আলোচনা করব।

৫. কোরান শরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে ‘ইহুদি-নাসারা’র বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিশাবে অনেকে হাজির করেন। সেই ক্ষেত্রে কোরানের দৃষ্টিতে আসলে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে কি বলা রয়েছে তা আমাদের ভালভাবে বোঝা দরকার। একই সাথে তার ব্যাখ্যা নিয়েও আলাপ-আলোচনা জরুরি। ইসলাম সকল নবী রসুলদের মানে এবং অন্যান্য জাতির মধ্যেও আল্লাহ পথ প্রদর্শক পাঠিয়েছেন দাবি করে। তাহলে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বোঝা দরকার। তার জন্য তুলনামূলক ও পর্যালোচনামূলক ধর্মতত্বের রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে আমরা কথা বলব।

যারা অংশগ্রহণ করতে চান দয়া করে গুগল ফর্মটি পূরণ করুন। (কমেন্টে)

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।