চিন্তা ও পর্যালোচনার শক্তি ছাড়া গণরাজনৈতক ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব না


এবার ভাববৈঠকি-১২ তে আলোচনা-পর্যালোচনার বিষয় ছিল ‘ফিলিস্তিন, সাম্রাজ্যবাদ এবং গণপ্রতিরোধের তাৎপর্য’। গণহত্যা, জাতিবৈষম্য এবং সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ বিরতির প্রবল দাবির পরও ইজরায়েল নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। যারা শত ব্যস্ততার মধ্যেও ভাববৈঠকিতে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের ধন্যবাদ। যারা ভাববৈঠকি চালিয়ে যাবার জন্য আমাদের নানা ভাবে সহায়তা করেছেন তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

খেয়াল করলেই আমরা বুঝব আমাদের সবগুলো বৈঠকই ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে সক্রিয় রাজনীতি এবং গণচেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রতি আমাদের প্রধান আগ্রহ। কাজটা মোটেও সহজ নয়। দ্বিতীয়ত আরও কঠিন কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন, তাদের উপলব্ধি, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে ভাবতে পারার সামর্থ অর্জন করা। ভাববৈঠিকির ভরকেন্দ্র ঠিক এখানেই। চিন্তার সঙ্গে রাজনীতির সুতা যেখানে ছিঁড়ে গিয়েছে সেখানে নতুন করে গিঁট দেওয়ার চেষ্টা। বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারা শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভিমুখ ও ধরণ নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জীবন, জগত, সমাজ, সংস্কৃতি কিম্বা রাজনৈতিক বিষয়াশয় সম্বন্ধে জনগণের জিজ্ঞাসাগুলো সহজ ভাবে বোঝা এবং তার উত্তর খুঁজবার ছহি পথ কি হতে পারে সেটা শুরু থেকেই আমাদের আরাধ্য হয়ে আছে। এ যাবতকাল যে সকল ভাববৈঠকির আমরা আয়োজন করেছি সবগুলোর ক্ষেত্রেই গণমুখিতার স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য অর্জনের প্রতি আমরা বিশেষ নজর রেখেছি। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে ভাববৈঠকির প্রভাব চিন্তাশীল তরুণদের মধ্যে পড়তে শুরু করেছে।

প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে আলোচনা আমাদের জন্য আরেক দিক থেকে তুলনামূলক ভাবে অধিক চ্যালেঞ্জিং ছিল। বাংলাদেশের একটা শক্তিশালী অংশের দাবি হচ্ছে যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তির ওপর নানাবিধ স্যাংকশান দিয়ে চাপ দিচ্ছে, অতএব আমাদের উচিত হবে না এমন কিছু করা যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ওপর গোস্বা করে। অনেকের কথাবার্তায় মনে হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝি বিরোধী দলকে অচিরেই ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে। তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা যেন বিরোধী দলকে ক্ষমতার বসানোর জন্য। ঘটে যাচ্ছে কিছু একটা। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রত করা অনুচিত। অর্থাৎ আমাদের চিন্তা, রাজনীতির নীতি ও কৌশল কিম্বা মানবাধিকার ও ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্নে অবস্থান নেওয়া বা না নেওয়ার প্রশ্ন কোন না কোন পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারণ করতে হবে। এর দ্বারা আমরা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা এবং জাতীয় রাজনীতির চরম দুর্দশার ইঙ্গিতই পেয়েছি।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে। মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। অথচ ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও জায়নিস্ট প্রকল্পের অংশ। তারা জায়নিস্ট ইজরাইলের সার্ভেইল্যন্স বা নজরদারির প্রযুক্তি ব্যবহার করেই এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালাচ্ছে, তারাই ভারত-ইসরাইলের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশে তামাশাপূর্ণ নির্বাচন করছে।

আমরা ভুলে যাই যে ভারত ইজরাইলের খুবই বড় দোসর। জায়নিস্ট-হিন্দুত্ববাদী চিন্তা, দিল্লির আধিপত্য এবং ক্ষমতা বলয় থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের অবশ্যই প্যালেস্টাইন প্রশ্নকে ভালভাবে মোকাবিলা করতে হবে। চিন্তার স্বচ্ছতা ছাড়া কখনই রাজনৈতিক স্বচ্ছতা আমরা অর্জন করতে পারব না।

এর আগে ১০ নভেম্বর শুক্রবার শহিদ মিনারে ফিলিস্তিন জনগণের স্বাধীনতার পক্ষে আরও অনেকের সঙ্গে যৌথ ভাবে আমরা সংহতি প্রকাশ করেছি; ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের জন্য সেটা ছিল অতিশয় জরুরি কাজ। এই প্রশ্নে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নিশ্চুপ থাকার বিপদ সম্পর্কে আমরা সকলকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। ফিলিস্তিন জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো শুধু নৈতিক ও আদর্শগত প্রশ্ন নয়, এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দুনিয়াব্যাপী যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে তাকে সঠিক ভাবে বোঝা এবং সঠিক রণকৌশল নির্ণয়ের গুরুতর প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। জায়নবাদী ও জাতিবৈষম্যবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েল এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত করাকে অনেকে বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় সহজে ক্ষমতায় যাবার পরিকল্পনায় বাধা হিশাবে দেখেছেন। ভোটবাদ, দলবাজিতা, দলীয় সংকীর্ণতা আমাদের রাজনৈতিক চেতনার চরম দুর্দশা ঘটিয়ে রেখেছে। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হবে। ভাববৈঠকির শুরু থেকেই আমরা ক্রমাগত দাবি করে এসেছি ভু-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে রাজনৈতিক সত্যাসত্যের বিচার আলাদা কোন ক্ষেত্র হতে পারে না। ভু-রাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিকে আলাদা জ্ঞান করে কোন মতাদর্শ – কোন নীতি কিম্বা কৌশলের আদৌ কোন পর্যালোচনা সম্ভব না। যেমন, লিবারেল গণতন্ত্র। আদতে লিবারেল গণতন্ত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার এবং এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা জারি রাখার মতাদর্শ। শুধু তত্ত্ব বিচার করে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এর ফাংশন, কার্যকর দিক বা কায়কারবার আমরা ধরতে পারব না। মর্মোদ্ধার সম্ভব না। এই তর্কগুলোর সঙ্গে আমাদের এখনও প্রাথমিক পরিচিতিও নাই। আমরা ভোটবাদ, ‘ভোটের অধিকার’ ইত্যাদির দ্বারা কিভাবে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বৈধ করা যায় সেই জঙ্গলে পড়ে রয়েছি। ভোটাভুটি বাজার ব্যবস্থার তৈরি রাজনীতির শপিং মল মাত্র। লড়াই ও প্রতিরোধের রাজনীতিকে নস্যাৎ করবার জন্য ভোটের বাজারকে আমরা রাজনীতি বানিয়েছি।

ভূ-রাজনীতি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বা জাতীয় রাজনীতি থেকে আলাদা কিছু না – এই হুঁশে তাহলে আমাদের দ্রুত ফিরে আসতে হবে। আমাদের অবশ্যই ফিলিস্তিনের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের তাৎপর্য বুঝতে হবে। বুঝতে হবে আমাদের সংগ্রাম কিভাবে ফিলিস্তিনী জনগণের লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। কিন্তু কোথা থেকে? কিভাবে? – সেইসব আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে জায়নবাদ আধুনিক জাতিবাদেরই একটি বিশেষ ধরণ; এই ধরণ বাঙালি জাতিবাদ, বাংলাদেশী জাতিবাদ ও ধর্মীয় জাতিবাদসহ নানান কিসিমের জাতিবাদেরই প্রকারভেদ্ মাত্র। তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। জাতিবাদের ফ্যাসিস্ট ফাঁদ এড়াতে হলে আমাদের করণীয় কি? সেটা বুঝতে হলে বিভিন্ন জাতিবাদী মতাদর্শের মিল ও ফারাক আমাদের বোঝা দরকার।

আমাদের সৌভাগ্য যে এবারের ভাববৈঠকিতে আমরা এইসকল অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পেরেছি। আলোচনাকে যেন আমরা আরও কয়েক কদম এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি তার জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি দ্রুত আলোচনাগুলোকে আমরা লিখিত রূপে হাজির করব। সেখানে সম্ভাব্য বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা আগামি কোন পোস্টে কিছু আগাম ধারণা দেবার চেষ্টা করব, যেন অন্যেরাও তাদের জিজ্ঞাসাগুলো হাজির করতে পারেন। তাছাড়া যারা আলোচনার গভীরে যেতে চান তাদের সুবিধার জন্য কিছু পাঠ্য বইয়ের তালিকা ও পরিচয় আমরা পেশ করবার চেষ্টা করব।

এই ফাঁকে ফিলিস্তিন প্রশ্নে আপনাদের প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা কমেন্টে জানাবেন।

 

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।