মৃতরা মুর্দা কবর দিতে থাকুক, নবজীবনের রাজপথে প্রবেশ করতে পারা ঈর্ষণীয় ব্যাপার, আর সেটাই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ


দুর্ভাগ্য আমাদের যে ‘কমরেড’ সম্বোধনকে বাংলাদেশে আমরা অতিশয় হীন ও তামাশাপূর্ণ করে তুলেছি। কারন আমরা সহযোগিতা, বন্ধুত্ব এবং একসঙ্গে কাজ করবার রীতি থেকে বহু আগে ভ্রষ্ট হয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক দুর্দশা থেকেই সেটা স্পষ্ট।

দুঃখজনক যে বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারা আমরা গড়ে তুলতে পারি নি। সবচেয়ে বিশাল ক্ষতি হয়েছে যখন বাংলাদেশের বামপন্থা গণবিপ্লবী মতাদর্শকে ধর্ম বিশেষত ইসলামের বিপরীতে হাজির করতে শুরু করে। এটা ছিল হিন্দুত্ববাদী দিল্লীর ইসলাম নির্মূল রাজনীতির অংশ। এর ফলে কমিউনিজমসহ সকল গণবিপ্লবী ধারার প্রতি জনগণ সন্দিহান ও অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

এর ফল হয়েছে মারাত্মক। এই দুর্দশা বাংলাদেশের বামপন্থাকে পর্যালোচনা না করলে বোঝা যায় না। জনগণ ‘কমিউনিজম’ কিম্বা শ্রমিক-কৃষক-মজলুমের রাজনীতিকে নাস্তিকদের রাজনীতি বোঝে। এই অজ্ঞতা কত ভয়ংকর হয়েছে ভাবুন। এর ফলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানিকে কতো সহজে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভবপর হয়েছে ভাবলে এই ভয়াবহতা অনায়াসেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু বোঝার ক্ষমতাও আমরা হারিয়েছি।

মওলানা নিজেও মনে করতেন পরকালবাদী মওলানা-মৌলভিদের মতো নাস্তিক্যবাদী কমিউনিস্টরাও বাংলাদেশের জনগণের দুষমন। তিনি ভুল বলেন নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা ‘কমিউনিজম’-এর কথা বলব না। অবশ্যই বলব। বলব বাংলাদেশের তথাকথিত কমিউনিস্টরা যেভাবে বলেন সেভাবে নয়, বরং মার্কস যেভাবে বলেন সেভাবে।

কমিউনিজম নামক লোকদেখানো কোন মতাদর্শিক ঝাণ্ডা তুলে ধরার বিরোধী ছিলেন মার্কস। কারণ কমিউনিজম হচ্ছে ইতিহাসের অভিমুখ, মানুষ জেনে বা না জেনে সেই ঐতিহাসিক অভিমুখই অনুসরণ করে। আমাদের বলা বা নাবলার অপেক্ষা করে ইতিহাস বসে থাকবে না। সেই দিকেই যাবে। মার্কস তার ইতিহাস ও অর্থশাস্ত্র বিচার দ্বারা সেটাই আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।

আজ বিশ্বব্যাপী পাশ্চাত্য বনাম এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের যে বিরোধ (মূলত যুদ্ধ) চোখের সামনে দানা বেঁধে উঠতে আমরা দেখছি সেটা যে অনিবার্য ছিল, মার্কসের লেখালিখির খবর রাখলে আমরা তা অনায়াসেই বুঝতে পারতাম।তরুণদের বলি, পড়, জান, মূর্খ থাকবে না। ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী না হয়ে তবুও কমিউনিজমের কথা কেন বলতে হবে তা নিয়ে আমার একটি লেখা কমেন্টে দিচ্ছি।

‘কমিউনিজম’ মানে নাস্তিক্যবাদ' – এই উদ্ভট চিন্তা বাংলাদেশে খুবই গভীর ভাবে প্রোথিত। বহু আগেই এই ভুল ভাঙবার জন্য আমি আমার ‘মোকাবিলা’ বইতে চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করে যেতে হবে। এই ভুল ভাঙানো জরুরি।

আসলেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় আরও একটি উদ্ভট ব্যাপার ও বিস্ময়ের দিক হচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্নায়ুযুদ্ধের প্রপাগান্ডা অনুসরণ করে কমিউনিজমকে ‘নাস্তিক’ বা ধর্ম বিদ্বেষীদের মতাদর্শ গণ্য করা। এই প্রপাগান্ডা শুধু সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহকরা করে নি, ইসলামপন্থি ও কমিউনিস্ট নামধারী উভয়েই এই ভূয়া চিন্তা আত্মস্থ করেছে, প্রচারে অংশ নিয়েছে। মুশকিল হচ্ছে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালীন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডা এখনও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগত দখল করে রেখেছে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও রাজনৈতিক বিকাশের ঘোর বাধা হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের তথাকথিত কমিউনিস্ট নামধারীদের উচিত ছিল এই ফাঁদে পা না দেওয়া। কিন্তু তারা সেই যে খাদে পড়া শুরু করলেন, আজ অবধি খাবি খেয়ে চলেছে্ন। এই ভুল যতো দ্রুত আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব এবং জনগণের আস্থাভাজন হতে শিখব ততো দ্রুত আমরা বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। । ইহ/পর ভেদ জ্ঞান এবং ইহকাল/পরকালের সম্পর্ক বিচারের ক্ষেত্রগুলো আরও স্বচ্ছ ভাবে যুগপৎ আমাদের উপলব্ধি ও বুদ্ধির জগতে ধরা পড়তে শুরু করবে।

ব্যর্থতার কাফফারা আমাদের আর কতদিন দিতে হবে কে জানে! ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আমরা আরও শক্তিশালী করেছি। ঠিক। তাহলে আত্মসমালোচনা ও পর্যালোচনা জরুরি। তবে সাতই জানুয়ারির আমি-ডামি নির্বাচনের পর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সেটা সাময়িক ইলিউশান মাত্র। কারন লড়াই শুধু মাঠে নয়, চিন্তার জগতেও তীব্র হচ্ছে।

ইতিহাস জবাব দিতে জানে। লড়াই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্বব্যাপী তরুণদের ক্ষোভবিক্ষোভ দেখুন। জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মাত্রা আরও অগ্রসর ও প্রখর হয়েছে।

তরুণ বয়সে কার্ল তাঁর বন্ধুকে লিখছেন: ‘মৃতরা মুর্দা কবর দিক, নবজীবনের সদর রাস্তায় প্রবেশ করতে পারা ঈর্ষণীয় ব্যাপার আর সেটাই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ’।

কমরেড, সকল জালিম শাহীর পতন হবে ইনশাল্লাহ! বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়।

(Early Writings, Intro. Lucio Coletti, tr. Rodney Livingstone, Gregor Benton (1992)

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।