হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র আছে কিন্তু ‘ভারত’ নামে কোন ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নাই


আমি লিখেছিলাম, “বাঙালি ভারতীয় না, হতে পারে না। 'ভারত' নামে কোন ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নাই। এই সকল হিন্দুত্ববাদি বকোয়াজির বিরুদ্ধে সাহিত্য ও সংস্কৃতির লড়াই চলবে। যেন হিন্দুত্ববাদি ও মুসলমানবাদিদের দ্বারা তৈরি বিভাজন কিম্বা দেয়াল স্বাধীন ও সার্বজনীন সহজ মানুষের আবির্ভাব বাংলাদেশে কেউ রুদ্ধ করতে না পারে।

Nilanjan Saha প্রশ্ন করেছেন, "বাঙালী ভারতীয় হতে পারে না!? তাহলে তামিলরাও ভারতীয় হতে পারে না, পাঞ্জাবীরাও না। মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমীয়া, বিহারী, সিকিমি, কাশ্মীরি কেউই তাহলে ভারতীয় হতে পারে না। কি সব কথা! আপনার ভারতের জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই"।

নীলাঞ্জন সাহার জবাব আমার লেখার মধ্যেই ছিল। উত্তর হচ্ছে, “'ভারত' নামে কোন ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নাই”। কিন্তু নীলাঞ্জন সেই তর্কে গেলেন না। বললেন, ভারতের জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা নাই”। বেশ।

জাতীয় পরিচয় আর রাষ্ট্রীয় পরিচয় এক না। ভারতের তথাকথিত জাতীয়তা বোধের রাজনৈতিক অভিপ্রকাশের নাম 'হিন্দুত্ববাদ'। জানিয়ে রাখি, আমি জাতিবাদি না, জাতিবাদের ঘোর বিরোধী। সেটা ভিন্ন তর্ক। নীলাঞ্জন সাহা নিশ্চিত থাকতে পারেন, জাতিবাদের ব্যাপারে আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। মনে করিয়ে দিচ্ছি আমার পোস্টে আমি সাহিত্য নিয়েই প্রধানত আলোচনা করছিলাম। এখন জাতিবাদ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ এলো।

'ভারত' কোন জাতি বা ভাষার নাম না। বাঙালি, তামিল, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমিয়া, বিহারি, সিকিমি, কাশ্মিরি যখন ভারতীয় হয় তখন সেটা তাদের রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক পরিচয়। তাদের ভাষিক, সাংস্কৃতিক কিম্বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় না। এই রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় তাদের আবাসিক -- অর্থাৎ ভূগোল ও জীবন ব্যবস্থার পরিচয়ও নয়, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জীবন যাপন ও খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যেও ফারাক আছে। তাই তারা নিজ নিজ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে একই রাষ্ট্রে বাস করেও বাঙালি, তামিল, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমিয়া, বিহারি, সিকিমি, কাশ্মিরি থাকতে পারে। এতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠির প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক, সহজ এবং ঐতিহাসিক সত্তার বিলোপ ঘটে না।

ভারত জাতিবাদি বর্গ নয়, একটি ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্ত ঐতিহাসিক কারনে মেনে নিয়েছে বলে বাঙালি, তামিল, পাঞ্জাবি, মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালি, অসমিয়া, বিহারি, সিকিমি, কাশ্মিরি তাদের জাতিসত্তা বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় জাতি হয় না। তাই বাঞালি বাঞালি না, ভারতীয় জাতি –এটা মেনে নেবার কোন যুক্তি নাই। কেউ নিজেকে ভারতীয় বললে সেটা ভারতীয় সংবিধানের অধীনস্থতা বোঝায়, ‘ভারত’ নামক কোন জাতির অন্তর্ভূক্ত হওয়া বোঝায় না। নীলাঞ্জন সাহা রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের সঙ্গে জাতিবাদি পরিচয়ের গোলমাল পাকিয়ে ফেলেছেন। মণিপুর সহ উত্তরপূর্ব ভারতের ইতিহাসের দিকে খেয়াল করুন। ভারতের হিন্দুত্ববাদি শক্তি তাদের আধিপত্য কায়েম এবং ভারতের জাতিগোষ্ঠিগুলোর আভ্যন্তরীণ বিরোধ মীমাংসার উপায় হিশাবে জাতিবাদি পরিচয় হিশাবে ‘ভারত’ নাম খাড়া করেছে। আগে ‘হিন্দুস্তান’ বলত, কিন্তু হিন্দুস্তান মোগল বা মুসলমান্দের দেওয়া নাম বলে এখন তারা নিজেদের ‘ভারত’ বলা শুরু করেছে। হিন্দুত্ববাদ তৈয়ারির অন্যতম কারন হচ্ছে রাজনোইতিক আধিপত্য লাভের আকাঙ্ক্ষা এবং আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করা।

আরেক দিক আছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পর তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবোধ বা ‘ভারতীয়’ হওয়ার অর্থ অতি সংকীর্ণ, সাম্প্রদায়িক ও হীনমন্য 'হিন্দু' হওয়া। যে 'হিন্দু' তার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিপুল সম্ভাবনা ভুলে গিয়ে নিজের বৈচিত্র্য ও শক্তি নিজেই ধ্বংস করতে উদ্যত। এই হিন্দুত্ববাদ সবাইকে একই মাপের 'হিন্দু 'বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ধর্মীয় সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুবিধা নিয়ে উপমহাদেশকে উদার ও মহিমান্বিত না করে ভারতীয় জাতিবাদ (হিন্দুত্ববাদ) পরিচালিত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক হিংসা, দাঙ্গাএবং উপমহাদেশব্যাপী অস্থিরতার সৃষ্টির দিকে। বিভিন্ন মসজিদের তলায় শিবলিঙ্গ খুঁজে বেড়ানোর প্রবল উৎসাহ ও তাগিদ দেখে এই হীনমন্যতার রূপ ধরা পড়ে।

আফসোস, 'হিন্দু' নামও হিন্দুর নিজের না, পারসিকদের -- যারা 'স' উচ্চারণ করতে পারেনা। সিন্ধু নদীর এপারে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিপুল বৈচিত্র নিয়ে যে ভূগোল হিন্দুত্ববাদ তাকে নতুন বিশ্বসভ্যতার রূপ না দিয়ে, তৈরি করছে জায়নবাদের চেয়েও আরও হিংস্র ধর্মীয় জাতিবাদে। হিন্দুত্ববাদী ভারত বড় জোর ইজরায়েলের দ্বিতীয় ও নিম্ন স্তরের সংস্করণ হবে, কিন্তু উপমহাদেশে বিভাজন, বিভক্তি ও অশান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া নিজেকে ও আগামি বিশ্বকে নতুন ভাবে গড়বার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদ আদৌ কোন অবদান রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। নির্বিচার ‘ভারতীয়’ হওয়ার এটাই অর্থ।

মোদি ও অমিত শাহ নিশ্চিত করতে চাইছে বাঙালি তার স্বভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের ইচ্ছা ও সাধনা বাদ দিক। 'ভারতীয়’ হওয়া মানে মুসলমানের বিপরীতে হিন্দু হওয়া, হিন্দুত্ববাদী হওয়া। এতে মুসলমান্দেরই জয় হোল। হিন্দুত্ববাদ ভারতের বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার বিকাশের জন্য বিপদ। ভারতকে ‘জাতি’ বানালে ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হবে। আটলান্টিক, ইউরোপ বা চিনের বিপরীতে নতুন এশিয়া ( বা ইউরেশিয়া) গড়ে তলতে পারবে না। হিন্দুত্ববাদী হয়ে ভারতের ইতিহাস ও ঐতিহ্যও ধারণ করাও সম্ভব নয়, বরং ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে ফেলার ব্যবস্থা দ্রুততর করা -- পৌরাণিক জগতকে বাস্তবের জগত গণ্য করা। পৃথিবীতে হেন কোন দেশ নাই যেখানে রাজ্য জয় নাই আগ্রাসন নাই, হিংসা ও রক্তপাত নাই। কিন্তু অতীতকে বর্তমান বানিয়ে হিংসার রাজনীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভারত তার মুঘল ও সুলতানদের অতীত মুছে ফেলতে চাইছে।

ইসলাম ভারতের ইতিহাসের অংশ, সেই ইসলামকে ভারত নির্বংশ ও নির্মূল করতে চাইছে। এই বোধ চরম অনৈতিহাসিক, এই বিকৃত চেতনা হীনমন্যতা থেকে তৈরি হয়। তখন ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনার চেয়ে ধর্মই রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণের একমাত্র মানদণ্ড হয়ে ওঠে। ধর্মের যূপকাষ্ঠে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বলী দেওয়া হয়।

পাকিস্তান বাঙালির ক্ষেত্রে সেই চেষ্টা করেছিল,কিন্তু বাঙালির কাছে জবাব পেয়ে গিয়েছে। দিল্লিও পাবে, ইনশাল্লাহ!


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।