যে তর্কের মীমাংসা হয় নি


বেশীদিনের কথা নয়, ২০১৯ সালে সামাজিক ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের ১১ই অক্টোবর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজির কর্তৃপক্ষ একটি 'জরুরি বিজ্ঞপ্তি' জারি করেন। বুয়েটের সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে “সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে নিষিদ্ধ করা হলো”। এরপর থেকে বুয়েটে রাজনৈতিক সংঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল।

যে ভাষায় এই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে সেখানে সমস্যা রয়েছে। সেই সমস্যা কাকে রাজনীতি, রাজনৈতিক তৎপরতা বা রাজনৈতিক সংগঠন বলব সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক এবং আইনী ভাবে একটি সমাজের বোঝার অক্ষমতা। এই সমস্যা একটি সমাজের গভীর কিন্তু সামগ্রিক সমস্যার প্রতিফলন, লক্ষণ বা উপসর্গ। সমাজের চেতনায় এবং আইন ব্যবস্থায় এই বোঝাবুঝির ঘাটতি থাকলে একটি জনগোষ্ঠি রাজনৈতিক সত্তা হিশাবে বেশীদিন টিকে থাকতে পারে না। রাষ্ট্র , আইন, আদালত এবং শিক্ষা ব্যবস্থা তখন গুণ্ডাপাণ্ডা এবং সন্ত্রাসীদের কুক্ষিগত হয়।

সমাজে কোকাজ রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার সঙ্গে যুক্ত এবং বিপরীতে কোন্‌ কাজ স্রেফ রাষ্ট্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে লুটপাটের জন্য সংঘবদ্ধ গুণ্ডামি, সহিংসতা এবং প্রতিযোগী প্রতিপক্ষকে নির্মূল করা এই ফারাক উপলব্ধি করার মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিহিত রয়েছে। অন্তত এই বোধটুকু যেন আমরা হারিয়া না ফেলি।

এই সচেতনতা এবং দূরদর্শিতা ছিল বলে বুয়েট অর্ডিন্যান্স ১৯৬১তে বুয়েট কতৃপক্ষকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেটা হোল, “অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের সংসর্গে বা ফাঁদে পড়ে ছাত্রদের সংগঠন ব্যবহৃত হওয়া”, কিম্বা “ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা রোধ করবার ক্ষমতা। বুয়েট অর্ডিন্যান্স ১৯৬১ পড়ে দেখতে পারেন। এই আইনী ক্ষমতার ভিত্তিতেই খুনি সংগঠনের হাতে নিরীহ সাধারণ ছাত্রদের প্রাণ রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বুয়েট অর্ডিন্যান্স ১৯৬১ অনুযায়ি তাদের ওপর দেওয়া ক্ষমতা ২০১৯ সালের বিজ্ঞপ্তিতে ব্যবহার করেছে।

বুয়েট অর্ডিন্যান্স ১৯৬১ অনুসারে Bangladesh University of Engineering and Technology-কে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেখানে বলা আছে:

5. The University shall have the following powers, namely:-

............

(j) to supervise and control the residence and discipline of the students of the University, to regulate their extra-curricular activities, to make arrangements for promoting their health, and to ensure that they do not, in anyway, associate with undesirable persons, who, in the opinion of the University, exploit or are likely to exploit any association of students, whether in respect of extra-curricular or in respect of curricular activities;।।

কয়েকটি বিষয় খোলাসা করা যাক

১. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ক্ষমতা থাকা জরুরি, যেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের কারিকুলামের বাইরের কর্মকাণ্ডে শৃংখলা জারি এবং কতৃপক্ষ তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সবস্ময় পরিস্থিতি তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদি আমরা আবরার হত্যাকাণ্ডের কথা মনে রাখি, তবে বুয়েট আইনে ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। আবরা হত্যাকাণ্ডের পর আমরা কি আবার হত্যাকাণ্ড চাই?

২. তাহলে বুয়েট কর্তৃপক্ষের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ এবং ছাত্রদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রদত্ত বুয়েট কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা হ্রাস করবার কোন আইনী অধিকার আদালতের নাই। সেটা জাতীয় সংসদের আছে। সেটা করতে হলে জাতীয় সংসদে ৬১ সালের আইন বাতিল করে দিয়ে নতুন আইন পাশ করতে হবে। বলাবাহুল্য, ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ট শক্তি সেটা করতেই পারে, কিন্তু এখন গুলি ছোঁড়া হোল আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে। এটাই হোল ন্যক্কারজনক কিন্তু ইন্টারেস্টিং দিক।

৩. বুয়েট একটি স্বাধীন সংস্থা বা কর্পোরেশান, আইনের চোখে ‘ব্যক্তি’ ( legal person) অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ব-শাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আদালত কেড়ে নিতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ক্ষমতা দরকার “যেন কোন ভাবেই এমন সব অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের সংসর্গে বা ফাঁদে পড়ে ছাত্রদের সংগঠন ব্যবহৃত হয় কিম্বা ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা থাকে, সেটা তাদের পড়াশুনার পাঠ্যক্রমের মধ্যেই ঘটুক কিম্বা ঘটুক বাইরে”। তার মানে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের সংশ্রব বা সংসর্গ দ্বারা ছাত্রদের যেন কোন শারিরীক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা জ্ঞানচর্চার কোন ক্ষতি না হয়। এই সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে ছাত্রদের সুরক্ষার করবার দায় ও ক্ষমতা বুয়েট কর্তৃপক্ষের রয়েছে। আবরার হত্যাকাণ্ড সেটা পরিষ্কার প্রমাণ করেছে।

ছাত্র লীগের পক্ষে আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেছেন, “রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা আইনগতভাবে বুয়েটের নেই”। প্রশ্ন যারা পিটিয়ে বুয়েটের ছাত্র হত্যা করতে পারে, তারা আদৌ কি ‘রাজনৈতিক সংগঠন’ ?

আবরার ফাহাদের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তর্ক সমাজে হাজির করেছিল, আফসোস, তার কোন মীমাংসা হয় নি। সেটা হোল খুনি, হত্যাকারী এবং পরিকল্পনা করে দলগত ভাবে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করবার সামর্থ্য যেসব সংগঠনের রয়েছে তারা কি আদৌ রাজনৈতিক সংগঠন নাকি ক্রিমিনাল সিন্ডিকেট? একটি সমাজ যখন রাজনীতি এবং খুন, রাহাজানির মতো ভয়াবহ ক্রিমিনাল কার্যক্রমের মধ্যে ফারাক করতে অক্ষম হয় এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে যখন উভয়ের ফারাক লুপ্ত হয়ে যায় তখন বুঝতে হবে আমরা শুধু হিংস্র ক্ষমতার অধীনে বাস করছি না, আমাদের আইন ব্যবস্থাও হিংসা, রাহাজানি, খুনাখুনিকে ‘রাজনীতি’ বলে গণ্য করে।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।