লালন ও হিন্দুত্ববাদ


১. লা ল ন ও হি ন্দু ত্ব বা দ

দেহের গুরু আছে কেবা
শির্ষ্য হয়ে কে দেয় সেবা
যেদিন তাই জানতে পাবা
কলির ঘোর যাবে তখন ।।

যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে 
কোনখানে সে বসে আছে
সিরাজ সাঁই কয় তাই না খুজেঁ
দিন তো রয়ে যায় লালন।। 

প্রথাগত বা বদ্ধমূল চিন্তা ভাঙা কঠিন। তবুও যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হই, তা সরল ও সৎ ভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করি। লালন নিয়ে কিছু প্রশ্ন প্রায়ই মোকাবিলা করি। কয়েক কিস্তিতে তার কিছু জবাব।

ক. লালন কি ‘ভাববাদী’ বা 'তান্ত্রিক'?

লালনকে 'ভাববাদী' বলা অজ্ঞতা, এবং ভাববাদ বনাম বস্তুবাদ মার্কা প্রাচীন বাইনারি চিন্তার প্রলাপ বা অভ্যাসের কারণে আমরা এই ভাবে প্রশ্ন করতে ও ভাবতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ একটির বিপরীতে আরেকটি দাঁড় করিয়ে একটিকে ভাল আর অন্যটিকে মন্দ বলা অলস ও সস্তা কাজ। যারা বাংলার ভাবচর্চা ও ভাবচর্চার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চান তারা আমার ‘ভাবান্দোলন’ পড়তে পারেন।

একই ভাবে লালনকে তান্ত্রিক বানাবার বিপদও ভয়ংকর। প্রথমত এর দ্বারা বাংলার ভাবুকতার ইতিহাসে তন্ত্রের যুগান্তকারী বস্তুতান্ত্রিক ইতিহাসের ধারা সম্পর্কে অজ্ঞতা বোঝায় এবং ইন্টারনেটে তন্ত্র বলতে যে সকল সেক্সুয়াল ও যৌন কায়কারবার দেখানো হয় – সেটাই ‘তন্ত্র’ বলে বোঝানো হয়। লালনকে তান্ত্রিক বলে সেটাই প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এটা কলোনিয়াল আমল থেকে শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলার সাধনার ধারাকে পাশ্চাত্য যেভাবে বাস্তবতাবিবর্জিত এক্সোটিক ব্যাপার-স্যাপার হিশাবে বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করে আসছে এবং আধুনিক বাজার ব্যবস্থায় তন্ত্র যেভাবে এখন পর্নোগ্রাফি ও আন্তর্জাতিক পণ্য তার ফলে বাংলার সাধনার ধারা সম্পর্কে কথা বলা কঠিন হয়ে পড়েছে। তন্ত্র সম্পর্কে কলোনিয়াল ধ্যানধারণা ও মনোবৃত্তি আমাদের মধ্যে প্রবল ভাবে প্রোথিত। আমরাও সহজ ও সরল ভাবে নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে আর চিন্তা করতে পারি না। লালনকেও আমরা তাই চরম অজ্ঞতা এবং যারপর নাই বিকৃত জায়গা থেকে বিচার করি।

খ. লালনের কি কোন সমালোচনা বা পর্যালোচনা হতে পারে না?

অবশ্যই হতে পারে। লালনের চিন্তা, কাজ বা নদীয়ার ভাবের পর্যালোচনা ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়াও কঠিন। কিন্তু লালনকেই তো বুঝলাম না, পর্যালোচনা করবো কিভাবে আমরা? একদিকে লালনের নামে গুপ্ত ঘেঁটু বা কাল্ট যেমন গড়ে উঠেছে তেমনি লালনের গান পরিবেশনের নামে সাদা কাপড় পড়া বাউলদের নিয়া নাচনকুদনের ব্যাপক চল রয়েছে । এইসব আবর্জনা সাফ করবে কে? সরকারি ভাবেই এই সব করা হচ্ছে। যার ফলে কাব্য বলি বা সঙ্গীত বলি লালনকে আমাদের মূল সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রে আনবার কোন চেষ্টাই হয় নি। তাই লালন নিতান্তই প্রান্তিক হয়ে আছেন এবং তাঁর গান লোকগীতি হিশাবেই রয়ে গিয়েছে। তাঁর গানের কাঠামো, অঙ্গ বা জেনর বুঝে তাঁর গান নিয়ে বিশেষ কোন পরীক্ষা নিরীক্ষাও হয় নি।

যদি আমরা প্রাচ্য কিম্বা পাশ্চাত্য উভয় ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তার ইতিহাস সম্পর্কে আগে খোঁজ খবর করি এবং বাংলায় লালন সুনির্দিষ্ট ভাবে কি জিজ্ঞাসার জবাব দেবার জন্য সাধকের জীবন বেছে নিয়েছিলেন সেটা বুঝি – তাহলে লালনের পর্যালোচনা একটা দিশা পেতে পারে। কিন্তু কিচ্ছু না জেনে না বুঝে যারা এখন সেকুলার জায়গা থেকে কিম্বা ইসলামের নামে লালনের অযৌক্তিক বিরোধিতা কিম্বা সমালোচনা করেন তাদের অধিকাংশই নিজের অজ্ঞাতে কিম্বা জেনেশুনেই হিন্দুত্ববাদী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন।

গ. হিন্দুত্ববাদি কিম্বা ইসলামি জাতিবাদিরা লালনের বিরোধিতা করে কেন ?

বাংলায় হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামি জাতিবাদ সহ নানান কিসিমের পরিচয়বাদ, বর্ণবাদ, হিন্দু-মুসলমান বিভক্তি ও বিভাজন কায়েম আছে। তাকে আরও দীর্ঘকাল কায়েমি রাখতে হলে অবশ্যই লালনকে সবার আগে বিনাশ করতে হবে। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারণার অংশ হিশাবে এবং দিল্লির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য মজবুত করবার জন্য লালনকে হেয় ও ক্ষুদ্র করবার প্রবল ও প্রকট হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা রয়েছে। সেটা নতুন কিছু নয়। ঠিক তেমনি এক দল ইসলামপন্থি রয়েছে যারা খেয়ে না খেয়ে লালন যে একটা ব্যভিচারী খারাপ লোক এটা সারাক্ষণই প্রচার করছেন। ইউটিউবে এদের ওয়াজ শুনতে পারেন। উভয়ে আসলে একই মূদ্রার দুই পিঠ।

বাংলা সংস্কৃতিকে হিন্দুত্ববাদের অন্তর্গত করে নেবার জন্য প্রধান হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা হচ্ছে লালন নাকি ‘বাউল’, তিনি ‘ব্যভিচারী’, ‘গাঁজাখোর’ ইত্যাদি। এই প্রচারণা কতোটা প্রবল বুঝতে হলে সুনীল গাঙুলির উপন্যাস পড়ুন এবং গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ দেখুন। এর দ্বারা লালনের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ প্রমুখদের ঋষি হিশাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি লালনের আগে আসা চৈতন্যকে অবতার হিশাবে মান্য করা হয়। কিন্তু লালন হাজির হন গাঁজাখোর ও ব্যভিচারি হিশাবে।

ব্রাহ্মণ ও বর্ণাশ্রমবাদিরা সন্যাসের পর চৈতন্যকে নদীয়ায় থাকতে দেয় নি, এবং বাংলার বাইরে পাণ্ডারা তাঁকে হত্যা করে বলে অভিযোগও রয়েছে । ইতোমধ্যে বৈষ্ণব হিন্দু না হলেও তাদের ‘হিন্দু’ বলে হিন্দু সমাজে আত্মীকরণ করা হয়েছে। এই সকল তৎপরতার ফলে সুলতানি আমলে বাংলার ভাষা, ভাবুকতা এবং সমাজ ব্যবস্থায় যে রূপান্তরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল তা থমকে যায়। পরে কলকাতার কলোনিয়াল মধ্যবিত্ত হিন্দুত্ববাদী শ্রেণী লালনকে ব্যভিচারী ও গাঁজাখোর হিশাবে হাজির এবং রামকৃষ্ণ বা রবীন্দ্রনাথকে ঋষি ও পরমহংস হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।। তারা সফল অবশ্যই।

লালনকে হীন করে রাখার কারণ হচ্ছে মুসলমান সমাজে কোন মহৎ মানুষের আবির্ভাব সম্ভব না এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত রাখা। হুজুররা যখন লালনের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনেন তারা সকলেই হিন্দুত্ববাদীদের ধারাই পুষ্ট করেন। তাদের লালন বিরোধিতার কোন যুক্তি নাই। এদের ইউটিউব বক্তব্য শুনলে দেখা যায়, এরা লালন সম্পর্কে কিছুই জানে না বা জানার প্রয়োজন বোধ করে না। এদের যুক্তি হচ্ছে লালন একজন বাউল, বাউলেরা ব্যভিচারী এবং গাঁজা খায়, অতএব লালনও ব্যভিচারি ও গাঁজা খোর। 'ফকির’ আর ‘বাউল’যে এক কথা নয় এই সাধারণ জ্ঞানও হুজুরদের নাই।

কিন্তু তাই বলে বাংলার কাউকেই হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তুলে দেবার যুক্তি নাই। বাংলার, ভাষা, সংস্কৃতি ও ভাবের ধারার মধ্যে সকলেই অন্তর্ভূক্ত এবং সকলকেই ঐতিহাসিক পর্যালোচনার অধীনে আনতে হবে। এটাই আমাদের এখনকার প্রধান কাজ। হিন্দুত্ববাদীদের কৌশল ও প্রচারণা এবং তাদের দোসর লালন বিরোধী হুজুরদের সম্পর্কে সাবধান থাকা এবং তাদের রুখে দেওয়া সীমান্তের দুই দিকের বাংলাভাষীদের প্রধান কর্তব্য।

ঘ. হিন্দুত্ববাদ অনিবার্য ভাবেই লালন বিরোধী কেন?

কারন বাংলার দার্শনিক বা ভাবচর্চার ধারায় লালন হিন্দুত্ববাদীদের গলার কাঁটা হয়ে আছে। হিন্দুত্ববাদীরা রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দসহ সবাইকে হিন্দুত্ববাদী স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু লালনকে পারে না। এর প্রধান কারণ লালন জাতপাত নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী। শুধু তাই নয় লালন বেদ ও শাস্ত্র বিরোধী। লালন কোন ধর্মগ্রন্থের ধারক বা বাহক নন। তিনি ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের মতো কোন বিমূর্ত ব্রহ্মের পূজা করেন না। রক্তমাংসের দেহসম্পন্ন সাধারণ মানুষের ভজনার কথাই লালন প্রচার করেন।

মনে রাখতে হবে দেহ-প্রধান চিন্তা বা তথাকথিত দেহাত্মবাদী চিন্তা একান্তই শূদ্র বা নিম্ন বর্ণের মানুষের হাজার বছরেই লড়াই, তাদেরই ভাবাদর্শ, তাদেরই রাজনীতি, ইত্যাদি। বুদ্ধিকে প্রধান গণ্য করে দেহকে লোপাট করে দেবার তত্ত্ব ও আদর্শ জীবের জীবাবস্থার উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের বৈষয়িক প্রয়োজনকে অস্বীকার করে। তাই সাধারণ ভাবে বলা যায় দেহ, খাদ্য, পুষ্টি ও জীবিকার প্রশ্ন বাদ দিয়ে বা জীবের জীবাবস্থার শর্ত টিকিয়ে রাখার কথা বাদ দিয়ে শাস্ত্র, বিজ্ঞান, নীতি সবই ব্রাহ্মণ্যবাদেরই ধারাবাহিকতা। এর সার কথা হচ্ছে দেহের কাজ বুদ্ধির সেবা করা। অন্যদিকে দাবি করা হয় বুদ্ধি, চিন্তা্‌ প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের কাজ যেন দেহ বাদ দিয়ে শুধু ব্রহ্মচিন্তা। অথচ মানুষের চিন্তা চেতনা বুদ্ধি ইত্যাদি দেহের বাইরে বাস করে না।

ব্রাহ্মণ্যবাদকে তার আধুনিক দার্শনিক বা দেহবিযুক্ত চিন্তা বিজ্ঞান ও টেকনলজি হিশাবে চিনতে শিখতে হবে। তাই একালে ব্রাহ্মণ্যবাদের অপর নাম এলিটিজম। অচিরেই তা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নামে মানুষের ওপর প্রভূত্ব কায়েম করবে। ইতোমধ্যেই মানুষ সারভেইলেন্স বা নজরদারির অধীনে সাত পাঁকে জড়িয়ে যাচ্ছে।

ব্রাহ্মণ এখন শুধু পৈতাধারী না। বিজ্ঞান কিম্বা জ্ঞানের পৈতাধারীদের চেনা বা মোকাবিলা করতে হলে নদীয়ার জাতপাত ও নারীপুরুষ ভেদ বিরোধী লড়াইয়ের মর্ম ও রাজনীতি বুঝতে হবে। এটা জরুরি কাজ। নিম্ন বর্ণ বা নীচু জাতের ছোটলোকদের দেহ ছাড়া কোন বুদ্ধি কিম্বা ইজ্জত আছে সেটা ব্রাহ্মণ্যবাদ/এলিটিজম কখনই স্বীকার করে নি বা করে না। তাই ব্রাহ্মণের জন্ম ব্রহ্মার মুখ থেকে আর শূদ্র শরীরের নিম্নাংশ থেকে জাত।

শাস্ত্রের নামে নিম্ন জাতের ওপর বর্ণাশ্রম প্রথার যাঁতাকলে হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের জনগণকে পিষ্ট করা হয়েছে। লালন তথাকথিত শাস্ত্রকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চা -- অর্থাৎ রক্তমাংসের মানুষ ও সমাজ বাদ দিয়ে বিমূর্ত বুদ্ধি বা তথাকথিত বিমূর্ত ধর্মতত্ত্ব বা জ্ঞানচর্চার বিরোধী। একই কারণে লালন কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিক আধাখেঁচড়া ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীরও বিরোধী।

২. লা ল ন ও হি ন্দু ত্ব বা দ

ক. লালনের কি কোন পর্যালোচনা করা যাবে না?

অবশ্যই করা যাবে এবং যতোই প্রজ্ঞা ও হেকমতের জায়গা থেকে আমরা তা করতে শিখব ততোই বাংলাদেশে লালনের নামে যে সকল কাল্ট, কুপ্রথা ও বিকৃতি চালু হয়েছে ও চালু রয়েছে তা সঠিক ভাবে মোকাবিলা সহজ হবে। ইসলামের দিক থেকে বেশ কিছু আপত্তিকর মীমাংসাও আপনাতেই হয়ে যাবে।

যেমন আমরা অধিকাংশই জানি না যে লালনের সাধনার ধারায় কবর বা মাজার মোটেও কেন্দ্রীয় বিষয় নয়। নদীয়া মানুষ ভজনা করে, জীবিত মানুষের বিপরীতে মৃতদের প্রতিস্থাপন করে না। বর্তমানের বিপরীতে অতীতকে প্রতিস্থাপন বর্তমানের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক এবং কর্তব্য অস্বীকার করা। এটা নদীয়ার ভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা।

নদীয়া গুরুবাদী ধারা, ‘লালনপন্থা’ নামক কোন ধর্ম বা ধারা নাই। আবার, লালন কিম্বা গৌরাঙ্গের পক্ষে এখন আর কোন জীবিতের গুরু হওয়ার সম্ভাবনা নাই। গুরু জীবন্ত ও বর্তমান। গুরু ছাড়া বা সুনির্দিষ্ট গুরুপাট ছাড়া নদীয়ায় সাধনা কথাটা অর্থহীন। নদীয়ার ভাষায় ‘গুরু থুয়ে গৌর ভজনা করা’ জায়েজ না।

বেদ-বৈদিকের ভোলে ভুলি
গুরু ছেড়ে গৌর বলি
মনের ভ্রম এ সকলি
শেষে যাবে রে জানা।।

গৌরাঙ্গ যা করবার নদীয়ায় তার জীব লীলা সাঙ্গ করে চলে গিয়েছেন, এখন মানুষ হিশাবে আমাদের যা করবার আমাদেরই করতে হবে কারণ শচির নন্দন আর ফিরে আসবেন না। কিম্বা:

আর কি গৌর আসবে ফিরে
মানুষ ভজে যে যা কর গৌরচাঁদ গিয়েছে সরে ।।

একবার প্রভু এই নদিয়ায়
মানুষ রূপে হইয়ে উদয়
প্রেম বিলায়ে যথা তথায়
গেলেন প্রভু নিজপুরে।। ইত্যাদি। লালনের এরকম বিস্তর কালাম রয়েছে।

গৌর আর ফিরে আসবেন না। তিনি মানুষ রূপে এসেছিলেন বটে, কিন্তু প্রেমের স্রোতে বাংলা ভাসিয়ে দিয়ে তিনি তাঁর জায়গায় ফিরে গিয়েছেন। এখন যা করবার মানুষকেই করতে হবে। মানুষেরই ভজনা করতে হবে। কারন: 'কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার' -- কলিযুগে আর কোন অবতারের সম্ভাবনা নাই। এখন মানুষ স্বয়ং অবতার।

লালনও তাই। তিনি নদীয়ায় তাঁর জীব লীলা সাঙ্গ করে চলে গিয়েছেন, এখন তাই কবর বা মাজার কেন্দ্রিক যে সকল তৎপরতা ও আচার আমরা লালনপন্থা বলে ভুল করি ও প্রচার করি তা একান্তই লালন বা নদীয়ার ভাবের বিরোধী কাজ। অতএব লালনের নামে বাংলাদেশে যে সকল কাল্ট, কুপ্রথা ও বিকৃতি চালু হয়েছে ও চালু রয়েছে লালনকে সঠিক ভাবে তুলে ধরা গেলে সেই সবের অপসারণ সহজ হবে। ইসলাম বা বৈদিক ধর্ম গুলোর জায়গা থেকে লালনকে মোকাবিলা ও বোঝার ক্ষেত্রগুলিও পরিষ্কার হবে। মানুষ পার্থক্য বুঝতে শিখবে। মাজার কেন্দ্রিক সংস্কৃতি বা মাজার ‘পুজা’ থেকে লালনকে বিযুক্ত করার কাজও সহজ হবে।

লালন যে ঘরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেখানেই তাঁর শিষ্যশাবকরা তাঁকে কবর দিয়েছিলেন। মলম শাহের বাড়ি তাই লালন ভক্তদের স্মৃতিধাম, ‘লালনের মাজার’ নয় -- ভক্তদের আবেগের আদরের, প্রেমের, ভক্তির ও ভালবাসার ক্ষেত্র।

কিন্তু ফকিরদের লালনের ধাম থেকে কার্যত বিতাড়িত করে একে একটি সরকারি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে, অন্যদিকে সরাকারি তত্ত্বাবধানেই লালনের ধামকে নদীয়ার ভাবের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিহীন ও বিসদৃশ ভাবে মাজার সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পর্যবসিত করা হয়েছে। একসময় লালনকে ‘হিন্দু’ প্রমাণ করবার চেষ্টা হয়েছে, এরপর পাকিস্তানী আমল থেকে লালনকে ‘মুসলমান’ বানানো, পকিস্তানিকরণ এবং ‘সুফি’ হিশাবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। একের পর এক এসব চলছেই। মাজারের স্থাপত্যের অনুকরণও করা হয়েছে দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারের অনুকরণে। কবর বা মাজার সংস্কৃতি এবং লালনের ‘ধাম’-কে ‘লালনের মাজার’ বানানো আমরা দিল্লী থেকে আমদানি করেছি। এটা নদীয়া কিম্বা বাংলার স্থাপত্য বা সংস্কৃতি নয়। লালনের ভাব তো নয়ই।

লালনে মানুষ ভজনা আছে। অর্থাৎ জীবন্ত বা জ্যান্ত মানুষের মধ্যেই মানুষের সম্ভাবনা ও বিকাশের শর্ত তৈরি ও আবিষ্কার করার নির্দেশ আছে। লালনের স্মৃতিধাম ভক্তি নিবেদন, ভক্তের ভালবাসা, চিত্তের প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তির বিষয়। কিন্তু একে কবর ‘পূজা’ বা মাজার ‘পূজা’ কিম্বা মাজারি সংস্কৃতিতে পর্যবসিত করবার কোন যুক্তি নাই। কবর বা মাজার পূজার কোন নির্দেশ বা বিধান লালনে নাই।

বিষয়টা স্রেফ আবেগ বা ভক্তির বিষয়ও নয়। মানুষ নশ্বর ও স্বল্পায়ু বিশিষ্ট। এই মানুষ তার আয়ু কতোটা সাশ্রয়ী ভাবে এবং জগতের উপকারে ব্যয় করতে পারল বাংলার সাধকরা সবসময়ই সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। যিনি মৃত, তাঁর যা করবার তিনি তাঁর জীবদ্দশায় করে গিয়েছেন। তিনি যা অর্জন করেছেন সেই স্বীকৃতি তখনই অর্জিত হবে যখন আমরা তাঁর চিন্তা, চেতনা ও অর্জনের ভালমন্দ বিচার এবং যাচাই বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সামষ্টিক ঐতিহ্য, চেতনা ও প্রজ্ঞা গড়ে তুলতে পারব। লালন তখনই বাংলাদেশের জনগোষ্ঠির চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কিম্বা প্রজ্ঞার দরবারে স্থান করে নিতে পারবেন।

এটা মনে রাখতে হবে লালনপন্থা বা লালনের ‘মানব ধর্ম’ নামে কোন ধর্ম নাই। যা অনেক সময় দাবি করা হয়। লালন কোন ধর্মীয় কাল্ট নন। কিন্তু লালন গুরুবাদী। নদীয়ার গুরুপম্পরার যে সাধনা সেটা জীবিত বা জ্যান্ত মানুষদের পরম্পরা। জীবিতদের চর্চা। মৃত কবর বা মাজারের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নাই।

কত কোটি লক্ষ যোনি
ভ্রমণ করেছো তুমি
মানব জন্মে এসে তুমি কী করিলে কী করলে কী করিলে
আর কি হবে এমন জনম বসব সাধুর মেলে!!

এই হৃদয় বিদীর্ণ করা হাহাকারই সাধকের জীবনের উপজীব্য। আমরা কতো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের রূপ নিয়ে হাজির হয়েছি। তাও অতি স্বল্পকালের জন্য, এই স্বল্প সময়টুকু আমরা কিভাবে দুনিয়ায় ব্যয় করলাম সেটা প্রতি নিমেষে প্রতি মূহূর্তে নিজের কাছে নিজে জবাবদিহি করতে শেখা এবং জবাবদিহি করতে পারা বাংলার সাধনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষ যখন কোন পরকালীন লোভ কিম্বা শাস্তির ভয় থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে, নিঃসংশয় হয়ে নিজের কাছে নিজে জবাবদিহি করবার হিম্মত অর্জন করে তখন মানুষের অন্তর্নিহিত সহজ স্বাভাবিক দিব্য গুণাবলীর স্ফূরণ আমরা লক্ষ্য করি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা লালন সম্পর্কে কিছুই প্রায় জানি না, তাই লালনের নামে যে ভুল চর্চাগুলো চলছে সেটা নদীয়ার ভাব সম্পর্কে সঠিক ভাবে জেনে এবং বিচার করে আমরা বন্ধ করতে পারি। ইসলামের আলোকে লালনের পর্যালোচনা তার পরের কথা। শুরুতে লালনকে মনোযোগ দিয়ে বোঝা এবং কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।

ধরুন, আমরা তো প্রশ্ন করতে পারি যিনি সারা জীবন মানুষ ভজনার কথা বলে গেলেন, তাঁর কবর কেন্দ্র করে ‘মাজার’ গড়ে উঠল কিভাবে? কেন পুরা কুমারখালি লালনের ধাম হিশাবে বিশ্বের প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিশাবে আমরা গড়ে তুলতে পারলাম না? আমরা কুমারখালিকে সারা দুনিয়ার জ্ঞানী গুণী শিল্পী দার্শনিক ভাবের মানুষের সাধনার ক্ষেত্র হিশাবে গড়ে তুলতে কেন ব্যর্থ হলাম?। বিশ্বে বিশাল ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য আমরা লালনকে আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হলাম কেন?

তারপরও ইসলামের দিক থেকে লালনের পর্যালোচনার দরকার আছে। সেই পর্যালোচনার গুরুত্ব আলাদা। তবে ‘ইসলাম’ নামক একাট্টা একপ্রকার বা অভিন্ন মতাদর্শ নাই। ইসলামের বিভিন্ন ধারা, মজহাব ও ফেরকা রয়েছে। আকিদাগত ফারাকও রয়েছে। যারা ইসলামের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে লালনের সমালোচনা করেন তাঁরা তাই তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে করেন। যা পক্ষপাত দুষ্ট এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা বা স্বাধীন ভাবে চিন্তা করবার অক্ষমতার অধিক কিছু না।

যেমন, লালন কোন ধর্মের সংস্কার কিম্বা নতুন কোন ধর্ম প্রচার করছেন দাবি করেন নি। তাই ধর্মপন্থিরা তাঁকে অনায়াসেই উপেক্ষা করতে পারেন। অসুবিধা নাই। লালনের বিরোধিতারও কোন যুক্তি নাই। বাংলার সাধনা ও ভাবচর্চার ধারা বা সিলসিলার যাঁরা চর্চাকারী তাঁরা কখনই প্রথাগত বা প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস বা সামাজিকতার বিপরীতে নিজেদের হাজির করেন না। এটা তাঁদের নীতি বা কৌশল কোনটির মধ্যেই পড়ে না। সমাজকে নিজেদের আচরণের দোষে অস্বস্তিতে ফেলাকে কেউই সাধুসুলভ আচরণ বলে মনে করেন না।

মনে রাখতে হবে লালন সংসার ত্যাগী বা সন্যাসপন্থি কোন ধারা না। লালনের সাধনার ক্ষেত্র সংসার ও সমাজ। তাই সাধক সংসার ও সমাজের মধ্যে সাধনার পরিবেশ সুরক্ষিত রাখবার চেষ্টা করেন। তাঁরা নানান সময়ে নিপীড়ন ও জুলুমের শিকার হয়েছেন, কিন্তু সমাজ ত্যাগ করে কেউ বনে চলে যান নি।

খ. তাহলে কিভাবে পর্যালোচনা সম্ভব?

বাংলার সাধনার ধারার যে ইতিহাস এবং ভাবচর্চা বা জ্ঞানতত্ত্বের যে শিখর দেশে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি সেটা ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্র নয়। সেটা নির্জন, নিঃসঙ্গ ও অন্তরঙ্গ অন্বেষণ। সেটা বুদ্ধি দিয়ে বুদ্ধিকে মোকাবিলার জগত, প্রজ্ঞার সঙ্গে প্রজ্ঞার মোকাবিলা, সাধকের সঙ্গে সাধকের সঙ্গ, বাহাস, কাটান বা নিরন্তর জিজ্ঞাসাকে উন্মুক্ত রাখার লড়াই। এই পথ সকলের জন্য না। নিজের অনুমান, সিদ্ধান্ত ও অভ্যাসকে কঠোর পর্যালোচনার অধীনস্থ করবার চর্চা বদ্ধমূল ধর্মবিশ্বাস দিয়ে মোকাবিলা করা অসম্ভব। বাংলার ভাবুকতার শিখর স্পর্শ করতে চাইলে সেই ভাবুকতার ইতিহাসও ভাল করে বুঝতে ও জানতে হবে। যেমন প্রাথমিক আলোচনা করতে চাইলেও তন্ত্রের সঙ্গে চৈতন্যের রসতত্ত্ব কিম্বা অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদের তর্ক ও পার্থক্য কি?-- জানা দরকার। বাংলার ভাবচর্চার দীর্ঘ ইতিহাসের ভেতর থেকে লালন উঠে এসেছেন। হাওয়া থেকে আসেন নি। দেখা যাচ্ছে তন্ত্র, রসতত্ত্ব ও ভাব – মোটা দাগে বাংলার ভাবান্দোলনের একটা সিলসিলা পরিচ্ছন্ন ভাবে উদ্ধারের কর্তব্য আছে আমাদের। সেই সকল গোড়ার কাজে আমামদের মনোনিবেশ করতে হবে।

সাহিত্য ও দর্শনের দিক থেকে জিজ্ঞাসা হচ্ছে রাধা কেন বেদে নাই কিম্বা কোন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে নাই অথচ বাংলার লোককাহিনীর জগত থেকে রাধারাণী কিভাবে বাংলার ভাবচর্চার কেন্দ্রে এসে আসন নিলেন? তিনি তো দেবি নন। এটা কি করে সম্ভব হোল? এই বিবর্তন বা ইতিহাসটা কিভাবে বুঝব? একালে – বিশেষত প্রাচ্য কিম্বা পাশ্চাত্য উভয় দর্শনের বিপরীতে বাংলার এই অভূতপূর্ব স্বাতন্ত্র্য, ভাব বা দর্শনের তাৎপর্য কি? এগুলো খুবই গোড়ার এবং নদীয়ার ভাবচর্চার অতি সাধারণ ও অতি প্রাথমিক জিজ্ঞাসা। অথচ আমরা বহু পিছিয়ে রয়েছি।

ঘ. ইসলামের দিক থেকে চ্যালেঞ্জটা কেমন?

বলা বাহুল্য ইসলাম আরবের তিনটি প্রধান সেমিটিক ধর্মের শেষ পরিণতি। বাংলার সঙ্গে একদিকে তার ফারাক দুস্তর ও বিশাল মনে হয়, অন্যদিকে মানুষের সার্বজনীন ইতিহাস ও চিন্তার বিবর্তনের আলোকে বিচার করলে মিল ও পার্থক্যের ক্ষেত্রগুলো আবিষ্কার করা মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু যে গবেষণা, শিক্ষা ও প্রজ্ঞা অর্জন করলে ইসলামের জায়গা থেকে নদীয়ার ভাবের ইতিবাচক পর্যালোচনা সম্ভব তার কোন সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক শর্ত বা গবেষণার তাগিদ বাংলাদেশে এখনও গড়ে ওঠে নি। বাংলাদেশে সেই পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয় নি। আমাদের এই অক্ষমতা চিন্তা ও রাজনীতি উভয় পরিসরে প্রকট ও প্রবল।

তারপরও বলতে হবে ইসলামের দিক থেকে লালনের পর্যালোচনা সম্ভব এবং দরকারও রয়েছে, কিন্তু সেটা একই সঙ্গে ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা ছাড়া সম্ভব না। কারণ 'ইসলাম' নামক ঝাণ্ডা তুলে ধরে ইসলামের নামে যে রক্তবাদ, গোত্রবাদ ও গোষ্ঠবাদ কায়েম করবার তীব্র চেষ্টা বাংলাদেশে এবং উপমহাদেশব্যাপী চলছে তার ফলে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবমূর্তি সহজেই গড়ে উঠতে পেরেছে। ইসলামের এই নেতিবাচক রূপ একই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের প্রসার ও আধিপত্য কায়েমের ক্ষেত্রও তৈরি করে দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করবার উর্বর ক্ষেত্র রক্তবাদী, গোত্রবাদী ও গোষ্ঠবাদীরাই করে দেয়। বাংলাদেশের জনগণকে সৌদি, ইরানি, তুরানি আফগানি বানাবার চেষ্টা হিন্দুত্ববাদসহ ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলাম বিরোধী ধারাগুলোকে আরও গভীর ভাবে শেকড় গাঁড়বার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী চিন্তাচেতনা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজ এতে সুগম হয়। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ ও স্বার্থ মজবুত হয়।

গ. এই জন্যই কি এক শ্রেণীর ইসলামপন্থি জেনে বা না জেনে লালনের বি্রোধিতা করতে গিয়ে মূলত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক এবং হিন্দুত্ববাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে?

জ্বি। অবশ্যই। বাংলাদেশে এক শ্রেণীর ইসলামপন্থার লালন বিরোধিতা একান্তই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বাস্তবায়ন। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটা আরও জটিল জায়গায় আটকে রয়েছে। সেই জটিলতার কারণ হচ্ছে জাতিবাদের উত্থান এবং জাতিবাদী মানসিকতা ও মতাদর্শের কুফল। সেটা আমরা সহজেই বুঝব যদি খেয়াল রাখি ইসলাম আর মুসলমান সমার্থক নয়। মুসলমান একটা পরিচয়ের নাম। সেকুলার কিম্বা ধর্মীয় জাতিবাদের যুগে এই পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে এবং ধর্মও নিছকই ‘বিধর্মী’-দের বিপরীতে পরিচয় সর্বস্ব সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক রূপ ধারণ করে। ইসলাম বলতে বাংলাদেশে আমরা যার যার নিজেদের বিশ্বাস, তরিকা, মজহাব বা সম্প্রদায় অনুযায়ী পরিচয় বুঝি।

জাতিবাদ বা পরিচয়বাদের পর্যালোচনা আর ধর্মের পর্যালোচনা এক নয়। বিভিন্ন ধর্ম দেশকালপাত্র ভেদে – অর্থাৎ বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাস্তবতায় যে (ধর্ম)তত্ত্ব বা সার্বজনীন আদর্শ হাজির করবার মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসে স্থান করে নিয়েছে জাতিবাদ বা পরিচয়বাদ তাকে আড়াল করে দেয়। জাতিবাদ বা পরিচয়বাদের যুগে হিন্দু হিন্দুধর্মকে ব্যাখ্যা করে মুসলমানদের বিপরীতে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য। ইসলাম ও মুসলমানদের দুষমণ বানাবার প্রচার ও প্রপাগাণ্ডার স্বার্থে এই পরিচয় প্রতিষ্ঠার কারবার হিন্দুত্ববাদের রূপ পরিগ্রহণ করে।

বিপরীতে মুসলমানও একই কাজ করে। হিন্দু বা বিধর্মীর প্রতি তার সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উদ্গীরণের জন্য মুসলমান নীতি বা আদর্শকে নয়, তার পরিচয়কে প্রধান করে তোলে এবং ইসলামকে একটি জাতিবাদী আদর্শে পর্যবসিত করে। পরিচয়বাদ কার্যত মতাদর্শিক পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া। অর্থাৎ এই অক্ষমতা স্বীকার করে নেওয়া যে ইসলামের কোন সার্বজনীন আদর্শ নাই যা মানব্জাতিকে নতুন ভাবে ভাবতে এবং জাগতিক সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে পারে। অথচ ইসলামের মতাদর্শিক জায়গা থেকেই সকল প্রকার পরিচয়বাদ ও জাতিবাদ নস্যাৎ করে দেওয়া সম্ভব। কারণ ইসলাম কোন প্রকার রক্তবাদ, গোত্রবাদ, গোষ্ঠবাদ বা জাতিবাদ বরদাশত করে না।

তাহলে দুই ভাবে জাতিবাদি ইসলাম হিন্দুত্ববাদকে শক্তিশালি করে। প্রথমত জাতি হিশাবে ‘মুসলমান’-কে হাজির করবার মধ্য দিয়ে ইসলামকে জাতিবাদি মতাদর্শ বানানো। ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করা যে ইসলামের নিজের জায়গা থেকে গোত্রবাদ, গোষ্ঠবাদ, রক্তবাদ, বর্ণবাদ ইত্যাদি মোকাবিলার কোন রসদ মজুদ নাই। দ্বিতীয়ত হিন্দুত্ববাদি যেভাবে ‘হিন্দু’নামক জাতি কল্পনা করে, একই প্রকার পরিচয়বাদী প্রক্রিয়ায় মুসলমানও হিন্দুত্ববাদের মতো হিন্দুর বিপরীতে নিজেদের ‘মুসলমান’ জাতি হিশাবে হাজির করে। দুইটাই আধুনিক জাতিবাদী প্রকল্প। হিন্দুকে ‘জাতি’ হিশাবে প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমানকে ‘জাতি’ হিশাবে কায়েমের মধ্যে কোন ফারাক নাই। অথচ ইসলামে জাতিবাদের স্থান নাই

ঘ. তাহলে উপায় কি?

এইটুকু যদি আমরা বুঝি তাহলে পরিষ্কার বুঝব ইসলামের নামে লালনের বিরোধিতা একান্তই জাতিবাদী মুসলমানদের জাতিবাদি আশংকা ও অস্বস্তির অধিক কিছু না। এর সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। এখানে সমস্যা ধর্মের নয়, সমস্যা পরিচয়বাদ বা জাতিবাদের। যা একান্তই আধুনিক ফেনোমেনা বা সাম্প্রতিক ব্যাপার। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই পথ: সেকুলার হোক কিম্বা ধর্মীয় – সকল প্রকার জাতিবাদ বা পরিচয়বাদের কঠোর ও নির্ভীক পর্যালোচনা। জাতিবাদি ইসলাম ইসলামের সার্বজনীন আবেদন ও প্রস্তাব আড়াল করে ফেলে, ক্ষেত্র বিশেষে খারিজ করে দেয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ইসলাম এক প্রকার গোত্রবাদি কাল্টে পরিণত হয় এবং মানুষের চিন্তা ও চেতনা বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে।

লালন কোন ধর্ম সংস্কারক ছিলেন না। তিনি কোন ধর্মেরই সংস্কার বা আরেকটি ইসলামি মজহাব বা ধারা প্রতিষ্ঠা করতে আসেন নি। লালন কোন বিকল্প হিন্দু ধর্মও নয়। ফলে বাংলাদেশে যারা ‘ইসলাম’-এর নামে লালনের বিরোধিতা করেন তারা ধর্মীয় জাতিবাদি অস্বস্তি থেকে বিরোধিতা করেন। তাদের মূল আশংকা ‘মুসলমান’ নামে যে পরিচয়ের জোব্বা পরে তারা ঘুরে বেড়ায় সেখানে লালন তাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। তাদের অস্বস্তি তাদের জাতিবাদিও মুসলমানিত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া, ইত্যাদি।

এই পরিচয়সর্বস্ব মুসলমানিত্বের সঙ্গে ইসলামের আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কিনা সন্দেহ। তবে কে ছহি মুসলমান আর কে নকল এই সকল বালখিল্য তর্ক থেকে লালন বহু দূরের ও বহু উর্ধের বিষয়। মুসলমানদের ভীত হওয়ার কিছু নাই।

লালন অবশ্যই সকল প্রকার সেকুলার ও ধর্মীয় জাতিবাদ এবং পরিচয়বাদ ধূলিসাৎ করে দিয়ে ‘মানুষ’-কে নতুন ভাবে ভাবতে এবং মানুষের ইতিহাসকে মানুষের জীবাবস্থার আলোকে বোঝার কথা বলেছেন। মানুষকে জীবাবস্থার আলোকে বোঝার অর্থ মানুষ সম্পর্কে কোন ‘অনুমান’ না করে মানুষ জগতে কিভাবে ‘বর্তমান’ রয়েছে বা থাকে সেই দিকে নজর বা মন নিবিষ্ট করা। মানুষ জগতে বর্তমান থাকে দেহধারী হয়ে। অতএব লালনের ধারায় জীবদেহ, প্রকৃতি বা জগতের ‘বর্তমান’ থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই রহস্য মীমাংসার জন্যই লালন ‘সহজ মানুষ’-এর কথা বলেছেন। মানুষের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার জীব শরীর 'সহ' যার জন্ম – সেই ‘সহ-জ’-এর গতি প্রকৃতি জানা ও বোঝার প্রতি তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন।

এইটুকু ধরতে না পারলে আমরা মারাত্মক ভাবে পিছিয়ে পড়ব।

৩. লা ল ন ও হি ন্দু ত্ব বা দ

ক. তাহলে কি জাতিবাদি ইসলাম ও হিন্দুত্ববাদ পরস্পরের পরিপূরক?

অবশ্যই। একটি অপরটিকে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক বৈধতা দান করে। তবে বিষয়টিকে আমাদের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে ভাবতে হবে। ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলে প্রবল জাতিবাদী চিন্তা ও শক্তির উত্থান এবং নানান আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কারণে হিন্দুমুসলমান বিভেদ তৈরি হয়। এই বিভেদ জাতিবাদী চিন্তার উর্বর ভূমি পেয়ে দুই বিরোধী ধর্মীয় জাতিবাদি রাজনৈতিক ধারা হিশাবে দুই ধর্মের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পুষ্টি লাভ করে। পাশাপাশি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমির অধিকার বঞ্চিত কৃষকরা জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে দেখে যে অধিকাংশ জমদার মহাজনই হিন্দু, ফলে মুসলিম জাতিবাদী চিন্তা দ্বারা তারা আকৃষ্ট হয়। অন্যদিকে বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভয়ে শ্যামাপ্রসাদ গং ও বাংলার বাবুরা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে। দোষ চাপায় মুসলমানদের ওপর। ধর্মীয় জাতিবাদীরাই দেশ ভাগ করে।

কিন্তু বাংলার ভক্তি ও ভাবুকতার ভিত্তি এবং ঐতিহ্য হিন্দু কিম্বা মুসলমান জাতিবাদিরা কখনই ধ্বংস বা নষ্ট করতে পারে নি। স্বাধীনতার পর লালনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বছর বছর বৃদ্ধি তার প্রমাণ। আগে লালন এবং বাংলার সাধকদের গান পল্লীগীতি হিশাবে প্রচার করা হোত। এখন লালনের গান বা কালাম হিশাবে প্রচার করা হয়। এটা বেশ বড়সড় পরিবর্তন। গণসংস্কৃতির জনপ্রিয়তা এবং ভাবুক হিশাবে লালন ও নদীয়ার স্বীকৃতি বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলন নদীয়ার ভাবের উপাদান তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ষড় গোস্বামিদের হাতে শাস্ত্রীয় রূপ দিতে গিয়ে চৈতন্যের শিক্ষা আগেই উচ্চকোটির ধর্মে লীন হতে শুরু করেছিল। ঔপনিবেশিক আমলে সেই প্রবণতা আরও প্রবল ও গভীর হয় এবং জাতিবাদি হিন্দুত্ববাদের বৃত্তের বাইরে নিজের কোন স্বকীয়তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। যে কারণে বাংলার ভক্তি আন্দোলনের আরেকটি শক্তিশালী ধারা বৈষ্ণব আন্দোলন হিন্দু ধর্মীয় ও জাতিবাদি ধারা থেকে এখন আলাদা করা কঠিন। চৈতন্যের জাতপাত বিরোধী লড়াইয়ের মর্ম থেকে বৈষ্ণব আন্দোলন দূরে সরে গিয়েছে।

একই পরিণতি আমরা মতুয়াদের ক্ষেত্রেও দেখি। পশ্চিম বাংলায় বিজেপির প্রতি মতুয়াদের সমর্থন স্রেফ রাজনৈতিক সুবিধাবাদ কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, কিন্তু মতুয়াদের ভক্তি আন্দোলনও শেষাবধি জাতিবাদি হিন্দুত্ববাদের পতাকায় নিজেদের বিসর্জন বটে।

বিপরীতে নদীয়ার ভাবান্দোলন বড় বাংলার অভূতপূর্ব শক্তি। নদীয়া বাংলার সকল ভক্তি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে সচেতন এবং তাদের ঋণ স্বীকার করে। যাঁরা নদীয়ার ফকিরদের সাধুসঙ্গে গিয়েছেন তাঁরা দেখেছেন যে বৈষ্ণবদের প্রতি ভক্তি দেওয়া এবং তাদের অবদান স্বীকার করা নদীয়ার রীতি। বড় বাংলার এই অভূতপূর্ব শক্তিকে ঔপনিবেশিক আমল থেকেই মুছে দেওয়া, প্রান্তিক করে ফেলা এবং নানান ভাবে বিকৃত করবার বিরামহীন চেষ্টা চলে আসছে। উল্লেখ থাকা দরকার নদীয়ার অসামান্য ভাবচর্চার ধারা ছাড়াও বাংলার বয়াতি, ভাণ্ডারি, চিশতিয়া এবং জনগণের আশ্রিত অপরাপর ভক্তির ধারা জাতিবাদের যূপকাষ্ঠে নিজেদের বিসর্জন দেয় নি। ফলে তারা আমাদের নজরে বাইরে থাকলেও বাংলার সাধারণ মানুষের সংস্কৃতি ও ভাবের জগত বিভিন্ন ধারা যারপরনাই সপ্রাণ এবং হাজির। অনেক ব্যর্থতা এবং ভুলত্রুটি থাকলেও বড় বাংলা অসামান্য ভক্তির ধারাটিকে ধরে রেখেছে এবং সাধারণ মানুষের ভাবজগতে জীবিত রেখেছে।

কিভাবে তারা আজ অবধি টিকে থাকতে পেরেছে সেটা ইতিহাসের অবিশ্বাস্য, ও গৌরবজনক অধ্যায়, সেই ইতিহাস নিয়ে আমরা কোন কাজই করি নি বলা যায়। আমাদের সহজ ও স্বতঃস্ফুর্ত আত্মিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশের ওপর জাতিবাদি মোড়ক পরিয়ে দেবার ফলে আমরা মানুষকে তার সহজ সাধারণ স্বাভাবিক রূপে আর চিনতে পারি না। ধর্মীয় বা সেকুলার জাতিবাদী পোশাক না পরিয়ে মানুষকে আমরা সার্বজনীন সত্তা ও কর্তা হিশাবে কল্পনাও করতে পারি না। তবুও বাংলার ভক্তির ধারা বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ বা ধর্মীয় ভেদাভেদের উর্ধে ‘মানুষ’ নামক ধারণাকে চিন্তার বিষয় হিশাবে জাগ্রত রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে এবং প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

কিন্তু মানুষের সার্বজনীন সত্তা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের বিকাশ -- অর্থাৎ বিভিন্ন ও বিচিত্র মানুষকে নিয়ে এক সঙ্গে বসবাসের পক্ষে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই উপমহাদেশে ব্যর্থ হতে পারে যদি আমরা দ্রুত সচেতন না হই এবং নদীয়ার ভাবান্দোলন সহ বাংলার ভক্তির ধারাকে বুঝতে না শিখি। একে দুর্বল ও প্রান্তিক করবার হাজারো চেষ্টা চলছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বয়াতিদের বিরুদ্ধে মামলা করা, বিভিন্ন জায়গায় তাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করা সহ নানান জুলুম নিয়মিত চলে।

এই সব দিক ছাড়াও বাংলার ভাবান্দোলন দুর্বল ও প্রান্তিক হয়ে থাকার বিবিধ কারণ রয়েছে। প্রধান একটি কারন হচ্ছে বাংলার ভক্তি ও ভাবান্দোলনের তাত্ত্বিক কিম্বা রাজনৈতিক তাৎপর্যের কিছুই আমরা বোঝার চেষ্টা করি নি এবং করি না; কিছুই আজ অবধি আমরা বুঝে উঠতে পারি নি বা বুঝি না। কারন ভাবুকতা ও সজীব চিন্তার প্রতি আমাদের আগ্রহ নাই। নিজেদের আধুনিক বানাবার তাগিদে নিজেদের অর্জনকেই আমরা প্রান্তিক করে রেখেছি এবং ধর্মীয় জাতিবাদের প্রবল আধিপত্যে তাদের অবক্ষয় এবং ক্রমশ বলহীন হওয়া আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ভাব ও ভক্তির সবগুলো ধারাই তাই একধরণের অসামাজিক কার্কলাপ, গোপন রহস্য, গুপ্ত কাল্ট, ও নানান প্রান্তিক চর্চা ও বিকৃতির ফাঁদে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই অবক্ষয় ও বিকৃতির ফলে সাধারণ ভাবে ভাবচর্চার শক্তি এবং আমাদের চিন্তা করবার ক্ষমতা ভয়াবহ ভাবে কমেছে এবং পরিচয়বাদ ও জাতিবাদ আরও বলবান হয়েছে। পাশ্চাত্যের আদলে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ভাবে সংকীর্ণ জাতিবাদ আরও প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে।

জাতিবাদি ইসলাম যেমন উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের পক্ষে উসিলা বা শর্ত তৈরি করে দেয়, ঠিক তেমনি হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া মুসলমান এবং ইসলাম রক্ষা করবার জন্য তাগিদ তীব্র করে, জাতিবাদি ইসলামি মতাদর্শকে শক্তিশালী করে তোলে। ইসলামের ধর্মীয় বা আকিদাগত মর্ম, দার্শনিক প্রস্তাবনা কিংবা ঐতিহাসিক সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ তখন কঠিন এবং অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে। জাতিবাদি ইসলাম সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে পর্যবসিত হয়। জাতিবাদি ইসলাম বা পরিচয়বাদকেই আমরা তখন ‘ইসলাম’ বলে ভুল করতে শুরু করি। উপমহাদেশ ব্যাপী হিন্দুত্ববাদের শক্তিশালী উত্থানের বিপরীতে নিজেদের ‘সাচ্চা মুসলমান’ বানানো তখন প্রধান কিম্বা একমাত্র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তব্য গণ্য করি। কার্যত আমরা হিন্দুত্ববাদের ফাঁদে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলি।

খ. তাহলে এখন আমাদের কাজ কি?

কোন শর্টকাট পথ নাই। এখনকার প্রধান কাজ হচ্ছে ইতিহাস জানা এবং নির্মোহ ভাবে বিশ্লেষণ করতে শেখা। চোরে বাসন নিয়ে গিয়েছে বলে মাটিতে ভাত খাওয়া যাবে না। ধর্ম বাদ দিলে মানুষের ইতিহাস হিশাবে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। সেটা জীবজন্তুর বা মানুষ নামক জীবের বায়লজিকাল ইতিহাস হতে পারে। কিন্তু মানুষের ইতিহাস মাত্রই মানুষের ধর্ম, চিন্তা, ভাব, ভাষা, সংস্কৃতি , আর্থ-সামাজিক জীবন ব্যবস্থা এবং রাজনীতির ইতিহাস, ইত্যাদি। এই গোড়ার সত্য উপলব্ধি করতে শেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে আমাদের কাজ হচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসের আলোকে জনগণের সুনির্দিষ্ট ইতিহাস নতুন ভাবে গবেষণা করা। জানা এবং বোঝা। এ যাবত কাল ধর্ম ও চিন্তার ইতিহাস বাদ দিয়ে জীবজন্তুর ইতিহাস হিশাবে যে ভাবে মানুষের ইতিহাস লেখা হয়েছে সেটা শোধরানো । দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস এবং তাদের অন্তর্নিহিত ভাব বা চিন্তাকে পর্যালোচনার অধীনে আনা, যেন আমরা দ্রুত পরিচয়বাদ ও জাতিবাদের কাল অতিক্রম করে যেতে পারি, এবং অতীতের অভিজ্ঞতা এবং মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার আলোকে নিজেদের বিকশিত করবার দিশা পাই। এটা সহজ কাজ নয়। কিন্তু পদক্ষেপ তো নিতে হবে। এটা কিভাবে সম্ভব? লালনের পরামর্শ হচ্ছে:

‘সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্য জ্ঞানে
পাবিয়ে অমূল্য নিধি বর্তমানে’

যদি আমরা আমাদের অন্তর্নিহত সহজ স্বভাবের প্রতি নিবিষ্ট হই এবং নিজ নিজ মনের যত্ন করি, আমরা অবশ্যই পথ খুঁজে পাব। নদীয়ার সাধনার ধারা এই উপলব্ধির ওপর দাঁড়ানো। এই সাধনায় ধারায় এমন কোন গুহ্য বা গোপন চর্চা নাই যার ভালমন্দ আমরা নির্ণয় করতে পারব না।

গ. নানান গুহ্যবিদ্যা বা গোপন চর্চার প্রচলন কিভাবে ঘটল?

আমরা এখন যেভাবে জীবন ব্যবস্থাকে উৎপাদন, বিতরণ, বিনিময় ও ভোগ ব্যবস্থা বুঝি পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের আগে মানুষের চিন্তা ততো বিকশিত ছিল না। মানুষ তার নিজের রহস্য তার প্রজনন প্রক্রিয়ার মধ্যেই অন্বেষণ করেছে এবং মানুষের সম্ভাবনাকে তার প্রজাতি পুনরুৎপাদনের বিস্ময়কর প্রক্রিয়ার মধ্যেই খুঁজেছে। ফলে প্রজনন প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষের রহস্য অন্বেষণ করা অস্বাভাবিক কিছু না।

কিন্তু সেটা করতে গিয়েও মানুষ বুঝেছে কাম এবং প্রেম সমার্থক নয়। জীবের প্রজনন ক্ষেত্র আর প্রেমের ক্ষেত্র এক না। প্রজননের জৈবিক সম্পর্ক আর প্রেমের সম্পর্ক ভিন্ন। এটা না বোঝার ফলে রধা কেন তাঁর সংসার বন্ধনের বাইরে কৃষ্ণের বাঁশী শুনে পাগল হয়ে যায় তার অর্থ আমরা ধরতে পারি না। স্বকীয়া/পরকীয়ার তর্ক যে আসলে ভাবের বা দর্শনের তর্ক তার কোন হদিস পাই না।

প্রেম জীবাবস্থা অতিক্রম করে যাবার সাধনা যেন জীব হিশাবেই যে সকল বৃত্তি আমামদের মধ্যে সুপ্ত তার বিকাশ ঘটতে পারে। প্রেমের অর্থ কাম থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা । নদীয়ায় একে বলা হয় 'নিহেতু প্রেম'। য এপ্রেমের কোন হেতু নাই সেই প্রেমের সাধনা কঠিন। প্রেমের আস্বাদনের মধ্য দিয়ে মানুষ যেন স্বয়ং নিজেকে নিজে ‘আস্বাদন’ করতে বা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় সেই শক্তি অর্জন করাই নদীয়ার সাধনার মূলকথা।

বাংলা পাশ্চাত্য না, কোন দেকার্তে বা কান্ট এসে বুদ্ধিকে দেহ বিযুক্ত ভাবতে হবে এমন শিক্ষা দেয় নি। বাংলা তা মানেও না। দেহ বিযুক্ত চিন্তা বা বুদ্ধি বাংলার ভাবুকতার দিক থেকে অবাস্তব চিন্তা। তাই নিজেকে আস্বাদনের সূত্র হিশাবে তন্ত্র শরীরকে উপায় গণ্য করে তুরীয়ানন্দ অর্জনের কথা বলেছে। দেহাত্মবাদ শুনলেই এখনকার মধ্যবিত্ত যেভাবে পর্নোগ্রাফি বোঝে বাংলার দেহাত্মবাদ সেটা নয়। চেতনা বা চিন্তা মাত্রই দেহধারী, দেহের বাইরে কোন বিমূর্ত ‘মানুষ’ নাই। সেকারণে দেহাত্মবাদ বাংলার অতিশয় শক্তিশালী চিন্তার ধারা। কিন্তু সেটা তন্ত্রের একটা দিক মাত্র। তন্ত্রের ইতিহাস চিন্তা ও ভাবের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। যার ভিন্ন পর্যালোচনার দরকার আছে।

চৈতন্যের কাছে তন্ত্র গ্রহণীয় হয় নি, কারন চৈতন্য দাবি করেছিলেন ঈশ্বর বা আল্লা মানুষের মধ্যেই – অর্থাৎ দেহেই রয়েছেন। আমরা সকলেই প্রকৃতি, আর আল্লাহ বা ঈশ্বর একমাত্র ‘পুরুষ’ যিনি প্রকৃতির মধ্যে নিত্য বর্তমান থাকেন, আমরা সকলেই তাঁর ‘বান্দা’ কিম্বা দাস বা দাসী। এই অর্থেই আমরা ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান বা আল্লাহ আছেন বলি। বলা বাহুল্য, এই উপলব্ধিগুলো তিনি তাঁর ভাষায় বলেছেন: অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ বহিরঙ্গে রাধা – নামক ধারণায়। যদি ঈশ্বরকে আমরা নিজের মধ্যে পেতে চাই তাহলে রাধা যেভাবে কৃষ্ণকে ভালবেসেছে, সেই ভালবাসা বা প্রেম আমাদের আয়ত্ব করতে হবে। সুলতানি আমলে ইসলাম কিভাবে বাংলার ভাব ও চিন্তার পরিবর্তম ঘটিয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের কোন গবেষণাই নাই। অথচ এই কালপর্ব – অর্থাৎ চৈতন্যের আবির্ভাব কাল আমাদের ভাল করে বোঝা দরকার। এই ছোট্ট উদাহরণে আমরা বুঝতে পারি বড় বাংলা কিভাবে নজের অতীত সম্পূর্ণ ভুলে বসে আছে। মানুষের ইতিহাস উল্লম্ফনের ইতিহাস নয়, তার মধ্যে বাস্তব জগতের যেমন বিবর্তন আছে আছে তেমনি ধর্ম, চিন্তা বা ভাবেরও বিবর্তন ও ইতিহাস আছে।

ঘ. ইসলামের দিক থেকে আমরা আমাদের কিভাবে বুঝব?

কোরেশ বংশের আভিজাত্য চূর্ণবিচূর্ণ করে মক্কা বিজয়ী রাসুলে করিম (সা) রক্তবাদ গোত্রবাদ ও গোষ্ঠবাদ সহ সকল প্রকার ইহলৌকিক সম্পর্কের বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষ রুহানি ভালবাসা প্রেম ও মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব তার নজির স্থাপন করেছেন। মানবেতিহাসের নতুন সম্ভাবনার বীজ মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি বপন করে রেখে গেছেন। মদিনায় নদীয়াকে বুঝতে হলে মদিনা নয়, মক্কা বিজয়ের তাৎপর্য বুঝতে হবে। মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসীদের রাসুল ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ওফাতের পর মক্কায় আবার পুরানা কোরেশি অভিজাততন্ত্র এবং তার ধারাবাহিকতায় রাজতন্ত্র চালু হয়। ফলে হানাহানি, রক্তপাত, রাজতন্ত্র ও হাজারো ফেরকা, ফ্যাসাদ ও মতবাদে মানুষ বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। রাসুলে করিমের সহজ সরল পথ 'ঈমান' বা 'আত্মসমর্পণ'-এর তাৎপর্য মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। ধর্মকে যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে পরিণত করেছে। লালনকে তাই বলতে হয়েছে”

“নবীর সঙ্গে ছিলেন ইয়ার চারজন
চারকে দিলেন নবী চারমতো যাজন
নবি বিনে পথে গোল হোলো চার মতে
ফকির লালন বলে যেন গোলে পড়িস নে
আয় গো যাই নবীর দ্বীনে ।

আমাদের অধিকাংশের ধারণা ইসলাম চরম ভাববাদী, ইতিহাসবর্জিত, গোত্রবাদী ও রাজতান্ত্রিক চিন্তায় আচ্ছন্ন এবং প্রতিক্রিশীল। এরই পাশাপাশি রয়েছে চরম ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ। ফলে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে লালন ও ইসলামের মধ্যে যে একটা কৃত্রিম বিরোধ ও শত্রুতা হিন্দুত্ববাদী ও জাতিবাদি মুসলমান সজ্ঞানে জারি রাখে সেটা আমরা সহজে ধরতে পারি না। এর কারন ধর্মের মর্ম, ভাবুকতার বিকাশ, জ্ঞানচর্চা, সাধুসঙ্গ ও মনের যত্ন করবার পথ, কৌশল, উপায় ইত্যাদি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এই সকল বিষয় নতুন ভাবে পর্যালোচনা জরুরি তার তাগিদ আমরা বোধ করি না। আমরা মনের দিক থেকে ভয়ংকর দরিদ্র হয়ে পড়েছি। লৌকিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আমরা ভুলে গিয়েছি ইসলাম উপমহাদেশের ইতিহাসের অংশ এবং সুলতানি বাংলা আমাদের ইতিহাস বা বেড়ে ওঠার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। আলাদা কিছু নয়।

একদিকে ইসলামকে খারিজ করে দেওয়া অর্থাৎ বাংলার মনোগঠন ও চিন্তার বিকাশে ইসলামের ভূমিকা অস্বীকার করা আর অন্যদিকে সীমান্তের ওপার থেকে রাঢ়ীয় বাউলিপনা বাংলাদেশে আমদানি করে লালনকে 'বাউল' বানানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে যে তন্ত্র চর্চার নামে যে নষ্টামি ও ব্যভিচারিতার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে চৈতন্য স্মার্ত ব্রাম্মণদের দ্বারা নদীয়া থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন সেই তান্ত্রিক বাউলেপনাকে লালনের সাধনার ধারা হিশাবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অথচ 'তন্ত্র' বাংলার প্রাচীন জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাধনার ধারা। একে পর্নোগ্রাফি বা মধ্যবিত্ত এলিটদের বিকৃত বিকার চর্চার ধারা হিশাবে যেভাবে বাজারজাত (commodify) করা হয়েছে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। শুধু সাধনা বা লালনপন্থার নামে বিভিন্ন 'কাল্ট' বা সাধুদের আখড়া বাংলাদেশে ইস্কনের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়, লালন একাডেমিও লালনকে ''বাউল সম্রাট' বানিয়ে লালন বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

এটা ঠিক যে আমরা যেভাবে বিশ্বাসের জায়গা থেকে ইসলাম ধর্ম বুঝি কিম্বা ‘আল্লা’ নামক চিহ্নের ব্যাখ্যা করি লালন তার সমালোচক। লালনের গান গাওয়া এবং গান ভালবাসা সহজ, কিন্তু বাংলার ভাবচর্চার ইতিহাস না জানলে তাঁকে বোঝা সহজ না। লালনের দাবি ‘আল্লাহ’ ‘হরি’ ‘কৃষ্ণ ইত্যাদি মানুষের রচিত ভাষা, বর্ণ বা চিহ্ন। চিহ্ন হচ্ছে যা নাই বা যে সত্তা স্বয়ং অনুপস্থিত ভাষা, বর্ণ বা চিহ্ন তার উপস্থিতির নির্দেশক। তাই লালনের দাবি, আল্লাহকে তাই স্রেফ অক্ষর, বর্ণ কিম্বা উচ্চারণে পর্যবসিত করা যায় না। লিখিত ‘আল্লা’ বা উচ্চারিত ‘আল্লা’ খোদ আল্লা হতে পারেন না। আল্লাহকে তাই কোন ‘নাম’ অক্ষর, বা ‘চিহ্ন’ দ্বারা পাওয়া যায় না। জিকির কপ্রে বা নামকীর্তন করেও আল্লাকে পাওয়া যায় না। লালনের ঘরে কোন জিকির বা কীর্তন নাই।

“আল্লা হরি ভজ পূজন
সকলি মানুষের সৃজন
অনামক অচিনায় বচন
বাগেন্দ্রিয় না সম্ভবে!”

‘আল্লা’, ‘হরি’ সবই মানুষের তৈরি ভাষা। কিন্তু যিনি ‘অনামক’ অর্থাৎ যাঁর কোন নাম নাই, যিনি ‘অচিনা’ – অর্থাৎ সকল চিহ্ন ব্যবস্থার বাইরে থাকেন – তাঁকে তো মানুষের বাকযন্ত্র দ্বারা উচ্চারণ সম্ভব নয়। অথচ তিনি আছেন, জগতে মানুষের মধ্যেই ‘বর্তমান’ বা হাজির রয়েছেন। তাঁর এই ‘আছে’ হয়ে থাকা বা বর্তমান হয়ে হাজির থাকা আমরা বুঝব কি করে? তার জন্য মানুষ কেন ‘আল্লা’, ‘হরি’ ইত্যাদি নামে যাকে ডাকে তিনি কে তাঁকে বোঝা বা জানার উপায় হচ্ছে মানুষকে আগে জানা বা বোঝা।

একটি কারখানা থেকে তৈরি জিনিস দেখে কিভাবে সেটা তৈরি হোল বোঝা অসম্ভব। তার জন্য পুরা কারখানা এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা ও বোঝা দরকার এই অর্থেই লালন ‘মানুষ ভজনা’ কথাটা বলেন। কারন মানুষের শরীর কাঁটাছেঁড়া করে যে মানুষ কথা বলে , আল্লাকে ডাকে, সেই মানুষকে আমরা আবিষ্কার করতে পারি না, মানুষকে কাঁটাছেঁড়া করে খুঁজে পাওয়া যায় না। চেনা যায় না। এই মানুষকে জানবার বা বুঝবার জন্য যে চর্চা সেটাই নদীয়ার সাধনা। তার জন্য যেসব সহজ সরল কাজের নির্দেশনা তাকে নদীয়ার ভাবানুযায়ী বলা হয় ‘করণ’। ‘করণ’ আর ‘তন্ত্র’ তাই এক নয়, কিন্তু বস্তুতান্ত্রিক চিন্তার ধারাবাহিকতায় নদীয়া নতুন চর্চা গড়ে উঠেছে। প্রধান এবং মৌকিজ পার্থক্য হচ্ছে লালন ভাবচর্চার ওপর বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছেন: “ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়’ । অর্থাৎ বিভিন্ন কর্তব্যকর্ম করলাম বটে, কিন্তু কেন করলাম সেটা বুঝলাম না সেটা হবে না। কিম্বা ভাব নাই , সাধুগিরি ফলালাম, তাতেও কাজ হবে না। তাই আমাদের খাদ্য ব্যবস্থায়, চলেফেরায়, জীবন যাপনে , নারী-পুরুষ সম্পর্ক রচনায় – অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে কি ধরনের সতর্ক চর্চা আমাদের মধ্যে ভাবের উদয় ঘটাবে এবং ভাবের বিকাশে অব্দান রাখবে সেই ব্যবহারিক চর্চাই লাওন তাঁর শিষ্যশাবকদের সবক দিয়ে গিয়েছেন । গুরু পরম্পরায় সেটা চলে আসছে। কিন্তু এটা কোন ‘ধর্ম’ বা ‘কাল্ট’ নয়। যারা নিজের গভীরে নিজেরা ডুবতে চান, নিজের স্বরূপে – অর্থাৎ নিজের সম্ভাবনাকে রূপ দান করতে চান – এটা তাদের পথ।

দেখা যাচ্ছে ‘মানুষ ভজনা’-র ধারণা অনেক বড়, গভীর এবং ব্যাপক ধারণা। ইসলামের দিক থেকে এটা বোঝা খুবই সহজ, কারনের লালনের এই ধারা আসলে ইসলামের ভাবগত মর্ম ষোল আনা ধারণ করে। আল্লা কেন ফেরেশতাদের মানুষকে সেজদা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার মর্ম যদি আমরা বোঝার চেষ্টা করি তাহলে ইসলাম বোঝা আমাদের জন্য সহজ । একই সঙ্গে লালনের সঙ্গে ইসলামের ভাবগত সম্বন্ধ নির্ণয়ও সহজ হয়।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।