সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে পাবি রে অমূল্য নিধি বর্তমানে


আমার প্রিয় বন্ধুদের অনেকে মনে করেন বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যেন ফকির লালনকে ভুল না বোঝেন তার জন্য আমাদের উচিত প্রচলিত 'ইসলাম'-এর সঙ্গে লালনের 'মিল' ধরিয়ে দেওয়া। তাঁরা যে উৎকন্ঠা থেকে কথাটা বলেন সেটা আমি বুঝি। এবং তাঁদের উৎকন্ঠার সঙ্গে আমি একাত্ম। কিন্তু আমি মিল না, বরং অমিল ধরিয়ে দেবার পক্ষপাতি। ফলে লালন ও প্রচলিত ইসলাম বা ইসলাম সম্পর্কে আমাদের সমাজে যে সকল বদ্ধমূল ধ্যানধারণা রয়েছে তার সঙ্গে লালনের মিল দেখানোর সুযোগ খুবই কম। এক শ্রেণীর ইসলামপন্থির লালন বিরোধিতা হাস্যকর হলেও, তাদের সঙ্গে লালনের মিল দেখানোর অর্থ বাংলাদেশে ইসলামের নামে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি চর্চার কাতারে বেচারা লালনকে নামিয়ে আনা।

'প্রচলিত' ইসলাম বলতে বুঝিয়েছি ইসলামের অনেক বিভক্তি, ধারা, মজহাব, ফেরকা ইত্যাদি রয়েছে, একাট্টা ইসলাম বলে কিছু নাই। তবে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধারাকে 'ছহি' দাবি করে। তাদের আবেগ এবং তাদের নিজ নিজ জায়গা, নিজ নিজ মজহাব, ফেরকা বা ধারার আলোকে ইসলামের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি নদীয়া উপেক্ষা করে না। নদীয়া ধর্মীয় ভেদাভেদ কিম্বা উপলব্ধি বা বিশ্বাসের পার্থক্যকে দেশকালপাত্র বিচারের মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। তাই ফারাক বা চিন্তার স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নদীয়াকে সেই দিকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

কোন উপলব্ধি, তত্ত্ব বা চিন্তাকে নাকচ করলেই সেটা সঙ্গে সঙ্গে নাকচ হয়ে যায় না। বাস্তবে সেই চিন্তা টিকে থাকার শর্ত থাকলে তা ভিন্ন রূপে আবার হাজির হয়। এটা সাপের খোলস ত্যাগের মতো, নতুন চামড়া বা নতুন চেহারা নিয়ে পুরানা সরিসৃপ আঁকাবাঁকা চলনে আবার হাজির হয়ে যায়। এটা বন্ধ করতে চাইলে সমাজে সামগ্রিক ভাবে চিন্তার বিকাশ যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি বাস্তব অবস্থার বদলও জরুরি। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে, 'সহজ মানুষ ভজে দেখ নারে মন...' -- ইত্যাদি গেয়ে যেমন ফায়দা নাই। তেমনি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ম ও ধর্মের দুর্দশা পর্যালোচনা ছাড়া সামনে অগ্রসর হবার আর কোন তরিকা নাই।

তাই নদীয়ার পথ মিল দেখানো না, বরং পার্থক্য পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন চিন্তার ফারাক এবং সম্ভাব্য জাগতিক পরিণতি সম্পর্কে যথাসাধ্য সকলকে সতর্ক করা। পাশাপাশি বর্তমানে আমরা যে বাস্তবতায় বাস করি তাকে মোকাবিলা করতে হলে লালনকে 'কাল্ট' কিম্বা গুপ্তবিদ্যার গুরু বানানো চলবে না। কাল্টগিরি বা গুহ্য কারবারের দূষিত চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

একটু ভাবলেই আমরা দেখব জগতের সঙ্গে মানুষের ব্যবহারিক সম্বন্ধের যে ধারণা কার্ল মার্কস আলোচনা করে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে নদীয়ার ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডের অভেদ তত্ত্ব আলাদা কিছু না। এই অস্পষ্ট জায়গা গুলো পরিচ্ছন্ন করে তোলা খুবই জরুরি। তবে প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের পরিমণ্ডলে লালনের আবির্ভাব ঘটেছে, আর মার্কস এসেছেন যখন জগতের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ উৎপাদন সম্পর্কের রূপ নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক বাস্তব সত্য হিশাবে হাজির হয়ে গিয়েছে। এটাই বিরাট পার্থক্য। কিন্তু নদীয়ার ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডের অভিন্ন সত্তা হিশাবে 'দেহ' আর মার্কসের উৎপাদনের সম্পর্কের বিশেষ মুহূর্ত হিশাবে দেহ সম্পন্ন 'মানুষ' নামক জীবসত্তার ধারণা্র পার্থক্য সামান্যই। তাহলে দেশকালপাত্র জনিত পার্থক্য বিচার করতে না শিখলে আমরা লালনকে যেমন গুপ্ত কাল্টগুরু বানিয়ে ছাড়ব, ঠিক তেমনি মার্কসকেও ভাবশূন্য বস্তুবাদি ভেবে আহাজারি করে যাব। কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। এর জন্য 'ব্যবহারিক সম্বন্ধ' নিয়ে আমি 'মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত' -- বইতে কিছুটা আলোচনা করেছি।

নদীয়ার গুরুত্বপূর্ণ বর্গ হচ্ছে 'ভেদ বিচার' -- অর্থাৎ ভেদ বিচার করতে না জানলে কার সঙ্গে কোথায় মিল বা ঐক্য কিম্বা কোথায় পার্থক্য বা ফারাক আমরা কিচ্ছু বুঝব না। এটা ঠিক যে অনেক সরল সহজ ধর্ম প্রাণ মানুষের সঙ্গে চিন্তার অমিল আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এই অস্বস্তি অনর্থক। নদীয়ায় সাধনার পথ একান্তই ভাববিচার বা চিন্তাশীলতার পথ। এই পথ নিঃসঙ্গ ও একাকি অন্বেষণের রাস্তা। অন্যকে যখন আমরা আমাদের মতে আনবার চেষ্টা করি সেটা আসলে রাজনীতির কাজ -- সোজা বাংলায় দলে ভেড়ানো। সাধনা ও রাজনীতির পরিসর আলাদা। কাউকে দলে ভেড়ানো চিন্তাশীলতা বা ভাবচর্চার কাজ না। সেটা রাজনীতির কারবার। চিন্তা ভোটাভুটির অপেক্ষা করে না। ভোট দিয়ে যদি ঠিক হোত সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে -- এটাই সত্য -- তাহলে বিজ্ঞানের দরকার হোত না। মানুষের ঐতিহাসিক বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ত। মানুষের অন্বেষণ এবং নিজ নিজ মনের যত্ন সে কারণে আলাদা জীবন চর্চার ক্ষেত্র। নদীয়ার ভাষায় সেটাই ভাবচর্চার পরিসর, ভাবুকদের পরিমণ্ডল।যাদের কানে সীসা আর বুকে মোহর মারা হয়ে গিয়েছে এই পথ তাদের জন্য নয়।

তাহলে এটা বোঝা দরকার সাধকের কাজ রাজনীতির কাজ নয়, এই অর্থে যে মানুষকে দলে ভেড়ানো সাধনার কিম্বা সাধকের তরিকা হতে পারে না। নিজে নিঃসঙ্গ ও একাকি অন্বেষণের ফল নির্ভয়ে ও নিঃসংকোচে হাজির করাই সাধকের কাজ। যেন প্রচলিত চিন্তার সঙ্গে সজীব চিন্তার ফারাক মানুষ সহজে বুঝতে পারে, যেন প্রচলিত চিন্তার ফাঁদে বন্দী হয়ে থাকা মানুষ চিন্তার দিব্য শক্তি টের পায়, ইত্যাদি। সর্বোপরি মানুষ যে আদতে রুহানি বা দিব্য সত্তা, স্রেফ জন্তু জানোয়ার না এবং জীবজন্তুর জীবন মানুষের জীবন হতে পারে না -- এই বোধ শক্তি সমাজে জাগ্রত রাখাই নদীয়ার সাধকদের কাজ। সাধকদের প্রতি সাধারণ সরল মানুষের আকর্ষণও এই কারণেই ঘটে। বাংলার শক্তিশালী সাধনার ধারা এ কারনেই টিকে আছে, টিকে থাকবে।

তাই বাংলার সাধনার ধারা নিজ নিজ জায়গা থেকে যারা আমল করছেন আমি আমার সেই সকল বন্ধুদের বলি, মানুষকে তার নিজের শক্তি সম্পর্কে সজ্ঞান করা আমাদের কাজ। প্রচলিত ইসলামের কিম্বা প্রচলিত ধর্ম, সমাজনীতি কিম্বা রাজনীতির সঙ্গে মিল/অমিল মানুষকে খুঁজতে দিন।

নদীয়ায় প্রেম বা মহব্বতের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলা হয় নদীয়ায় পাঁচ ঘর। সব ঘর এক রকম নয়, তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাদের মিলের চেয়ে পার্থক্য মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। পার্থক্য আছে বলেই তারা আলাদা ঘর, কিন্তু 'গদিমান্য'। এই পার্থক্যকে পাশ্চাত্য দর্শনে 'ডিস্কোর্স" বা তর্কাতর্কির ঐতিহ্য বলা হয়। আমরা বলি, 'কাটান'। অর্থাৎ কেউ একজন একটি পদ পেশ করলেন তো পরের জন তার 'কাটান' গাইলেন। চিন্তা এভাবে নিজের সঙ্গে নিজের তর্কাতর্কির মধ্য দিয়েই এগোয়। তাই পার্থক্য মোটেও দোষের কিছু না। আমরা গতকাল যা ছিলাম, আজ আর গতকালের মতো নাই। নিজের সঙ্গে সততই আমাদের বোঝাপড়া চলছে। এই সজীব বোঝাপড়ার ধারা চর্চাই নদীয়ার শক্তি।

তাই "অমিল না খুঁজে মিল খোঁজাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ" মনে করলে আমরা ভুল করব। মিল খোঁজা "রাজনৈতিকভাবেও খুবই কার্যকর" বলে সাময়িক মনে হতে পারে -- কিন্তু শেষমেষ সেটা গলার কাঁটা বা মগজে পেরেক বিঁধে যাবার দুর্দশায় পরিণত হতে পারে। বরং ফকিরি, বয়াতি, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া ভাণ্ডারি, সুফি, বৈষ্ণব, শাক্ত, মতুয়া বা যে কোন সাধনার ধারাই আমরা বলি না কেন -তাদের মধ্যে সামাজিকতা বৃদ্ধি এবং পরস্পরকে জানবার বাস্তব শর্ত তৈরি করাই এখন প্রধান কাজ। এই কাজ হয় নি, হচ্ছে না। বয়াতিদের ওপর যে জুলুম চলছে আমরা যথেষ্ট তার প্রতিবাদ করতে পারি নি। পার্থক্য বা ফারাক বজায় রেখেও সাধনার ক্ষেত্রগুলো সুরক্ষার জন্য যে ঐক্যের দরকার, আমি তার পক্ষপাতি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে নদীয়ার ভাব সম্পর্কে সমাজে ব্যাপক অজ্ঞতা রয়েছে। তার মীমাংসা না হলে অন্যদেরসঙ্গে মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে।

তাহলে সারকথা এই যে সাধকের কাজ পার্থক্যগুলো মনে রাখা, সুযোগ ও পরিবেশ অনুকুল হলে ধরিয়ে দেওয়া এবং পরস্পরকে চিন্তা করতে সহায়তা করা। মানুষের মধ্যে সার্বজনীন যে বৃত্তি রয়েছে তাকে জাগ্রত করা। মানুষ যখনই চিন্তা করতে শিখবে, তখন চিন্তাশীল মানুষের গুরুত্ব ও মর্মও মানুষ বুঝতে শিখবে। চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে ঐক্যও গড়ে উঠবে। চিন্তাহীনতার অর্থ জীবাবস্থায় ডুবে থাকা। এদের ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা সময়ের অপচয়।

নদীয়ার ভাবুকতার ধারায় আমি স্বস্তি বোধ করি। নদীয়ার ফকিরদের কাজ মানুষকে তথাকথিত 'লালনপন্থি' করা না। লালন আর ফিরে আসবেন না। তাঁর যা করার করে গিয়েছেন। আমাদের কাজ সামনে এগিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ গুরুর কাছে যা পেয়েছি তাকে জীবনে বাস্তবায়িত করে দেখানো যে নদীয়ার 'গুরু' ধারণা একদমই নতুন চিন্তা এবং চর্চা। এখানে কাল্টগিরি ফলানো বা কোন ধর্মমত প্রতিষ্ঠার কোন সুযোগ নাই।

আশা করি আমরা এগিয়ে যাব এবং জয়ী হব।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।