বিতর্কিত গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুন



"গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের চেষ্টা অনেক দিন থেকেই চলে আসছে। গোল্ডেন রাইস একটি জেনেটিকালি মডিফাইড অর্থাৎ ধান বীজের স্বাভাবিক প্রকৃতি বিকৃত করে বানানো ফসল। বিকৃত বীজের ফসল হিশেবে গোল্ডেন রাইসের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকি রয়েছে। এই সকল বিকৃত বীজের কার্যকারিতা বিতর্কিত। যেখানে রাতকানা রোগ প্রতিরোধের জন্য আমাদের শাকসবজি ফলমূল খাবার কথা, সেখানে হলুদ বিকৃত ধানের ভাত খাবার আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি? তাছাড়া গোল্ডেন রাইস সারা বিশ্বে বিতর্কিত। ফিলিপাইনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলা হলেও এখন তা আবার বাতিল করা হয়েছে। ফিলিপাইনে গোল্ডেন রাইসের বিরুদ্ধে ফিলিপিনে কৃষকরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন"। বলেছেন নারী আন্দোলনের নেত্রী ফরিদা আখতার। তিনি উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার এবং বাংলাদেশে প্রাণবৈচিত্র্য ভিত্তিক কৃষি নয়াকৃষি আন্দোলনের একজন প্রধান সংগঠক। ৬ মে ২০২৪ তারিখে ঢাকা প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া অডিটোরিয়ামে উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা), নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ, এবং জিএম বিরোধী মোর্চার উদ্যোগে সাংবাদিক, পরিবেশ ও কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সাথে 'জিএম শস্য গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুন: বাংলাদেশে প্রবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের নিরসন জরুরি' শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ফরিদা আখতার সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এছাড়াও সভায় বক্তব্য রাখেনঃ ড. এম.এ. সোবহান, প্রেসিডেন্ট, বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশন; জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ; ইবনুল সাইদ রানা, চেয়ারম্যান, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন; ও বদরুল আলম, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন (বিকেএফ)।

সভায় সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জিএম শস্যের সাথে জড়িত সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তুলে ধরেন। তিনি প্রাণবৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্যের উপর জিএম শস্যের প্রভাব এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এর সম্ভাব্য ক্ষতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশে জিএম শস্য চালুর আগে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা এবং গণসচেতনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।



ধান বীজের স্বাভাবিক জিন বা গঠন সঙ্কেতে কারিগরি বিকৃতি ঘটিয়ে জেনেটিকালি মডিফাইড বীজ বা 'বিকৃত বীজ' বানানো হয়। যারা বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইসের মতো বিকৃত বীজের বাজার সম্প্রসারণ করতে চান  তারা দাবি করছেন এবং জোর প্রচারনা চালাচ্ছেন যে গোল্ডেন রাইস ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ। বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশান  গোল্ডেন রাইসকে পুষ্টির একটি মাধ্যম হিশেবে উল্লেখ করে দাবি করছে এই বিকৃত ধান ভিটামিন-এ ঘাটতি এবং রাতকানা রোগের জন্য। অথচ রাতকানা রোগের জন্য বিকৃত ধানের বীজ না, দরকার সবুজ শাকসবজি। বাংলাদেশ শাকসবজিরই দেশ, আমাদের দরকার শাকসবজির উৎপাদন বাড়ানো, কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার নতুন বিন্যাস, যেন একাট্টা ফসল করতে গিয়ে আমরা শাক সবজি উৎপাদনের জায়গা নষ্ট করে না ফেলি। তাহলে  আধুনিক কৃষির নামে একাট্টা ফসল উৎপাদনের নীতি থেকে বের হয়ে আসাটাই এখন দরকার, কারন রাতকানা রোগ আধুনিক কৃষির কুফল বা প্রতিক্রিয়া।  আধুনিক কৃষির কুফল আমরা ভোগ করছি। 

কিন্তু কৃষক যদি শাকসবজি উৎপাদন করে তাহলে কোম্পানির লাভ নাই। তাই দরকার এমন টেকনলজি যা কৃষকদের কাছে বেচা যায়। কৃষি ধ্বংস করে খাদ্য ব্যবস্থাকে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল প্রডাকশানে রূপান্তর করলে ব্যবসায়ী ও কর্পোরেশানের সুবিধা।  এই জন্যই গোল্ডেন রাইসের অনুমোদন ও বাজারজাত করার মহা তোড়জোর চলছে।  বহুজাতিক বিশ্ব ব্যবসায়ীরা আমাদের বোঝাচ্ছে রাতকানা রোগের জন্য আমাদের শাকসবজি খাবার দরকার নাই, তাদের তৈয়ারি বিকৃত ধানের হলুদ চাল খেতে হবে। 

আমাদের জানা দরকার যে ইরি ছাড়াও গোল্ডেন রাইস প্রকল্পে কাজ করছে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশান। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন-এ পাওয়ার উৎস আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। বাংলাদেশ পুষ্টিবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যায় নানা রকম কুড়িয়ে পাওয়া শাক যেমন কাঁটানটে, কলমি, সাজনা পাতা এবং নানান আবাদী ফসল -- যেমন মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, পুঁইশাক, সীম, ঢেঁড়শ, ডাটার -- ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর ভিটামিন-এ আছে। ফলের মধ্যে পাকা পেপে, বাংগি, কাঁঠাল, আম, কলা, আনারস সহ হলুদ রংয়ের ফল গুলোতে ভিটামিন-এর কোন অভাব নাই। ঢেঁকি ছাটা চালে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়। তাহলে কেন আমরা অহেতুক ধানের মধ্যে অস্বাভাবিক বিকৃতি ঘটিয়ে গোল্ডেন রাইস খাব? শুধু তাই নয়,  প্রচলিত ধান ব্রি ২৯ কে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেব এবং পুষ্টির ভার দিয়ে দেবো বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশানকে?

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে ১৭ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে ফিলিপাইনের কোর্ট অব আপিল (Court of Appeal) সুনির্দিষ্টভাবে গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুন এর বাণিজ্যিক চাষের বিরুদ্ধে একটি নির্দেশ (cease-and-desist order) দিয়েছেন কারণ এ দুটি জিএম ফসলের প্রবক্তারা বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা দিতে পারেন নি। এই মামলায় বাদী ছিল ফিলিপাইনের Magsasaka at Siyentipiko para sa Pag-unlad Agrikultura (MASIPAG) এবং Greenpeace Southeast Asia। আদালত এর আগে বিবাদী University of the Philippines Los Baños (UPLB) এবং the Philippine Rice Research Institute (PhilRice) কে সরকারের দেয়া বায়োসেফটি অনুমোদন বাতিল করে দেয়।



অথচ বাংলাদেশে গত ৪ঠা মার্চ ২০২৪ তারিখে গোল্ডেন রাইসের কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) কর্তা ব্যক্তিরা বর্তমান সরকারের নতুন কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদ এর সাথে দেখা করে জিএমও গোল্ডেন রাইস জাত অবমুক্তির বিষয়ে তাঁর সহযোগিতা কামনা করেছেন। কৃষি মন্ত্রীও এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা আশা করব তিনি গোল্ডেন রাইস নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে বৈজ্ঞানিক ও আইনী তর্ক চলছে সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেবেন এবং ফিলিপাইনের আদালতের রাইয়ের মর্ম বোঝার চেষ্টা করবেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করারা সময় ইরি’র পক্ষ থেকে ইরি’র হেলদিয়ার রাইস প্রোগ্রামের প্রজেক্ট লিডার রাসেল রেইনকে (Russel Reinke) প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশে আরেকটি বিপজ্জনক ঘটনা ঘটে রয়েছে। সকল শ্রেণীর মানুষের অতি প্রিয় এবং জরুরী সবজি বেগুনেও জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং করা হয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে বিটি বেগুন। ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (বিটি) ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিসটাল জিন বেগুনে সংযোজন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হিশেবে বলা হয়েছে বেগুনের ফল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি মাহিকো বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর সহায়তায় বেগুনের জিন বিকৃতির এ কাজটি সম্পন্ন করে ২০০৫ সালে। উল্লেখ্য একই সময় বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইনে বিটি বেগুন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এ কাজের সাথে যুক্ত হয়। প্রবর্তনের পর থেকে বারি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের Agriculture Biotechnology Support Project (ABSP) এবং কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায়।

বিটি বেগুন গবেষণা একই সাথে ভারত ও ফিলিপাইনে করা হলেও, এসব দেশে কোন ছাড়পত্র দেয়া হয় নি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর স্থানীয় সহায়ক মাহিকো উদ্ভাবিত বিটি বেগুন ছাড়ের উপর মরেটোরিয়াম জারি করেছে ২০১০ সালে। এমনকি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্যানেল অনির্দিষ্টকালের জন্য জিএম ফসলের সব রকম মাঠ পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে ফিলিপাইনের কোর্টে গ্রীনপিস দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা বন্ধের জন্যে ২০১৩ সালে আদেশ দেয়া হয়েছিল। জানা গেছে যে ভারতে ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়ে তারা প্রথম ফিলিপাইনে চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সেখানেও সফল না হয়ে তাদের শেষ চেষ্টা ছিল বাংলাদেশ। তাই গবেষণা কাজ সম্পুর্ণ হবার আগে, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে নিশ্চিত না হয়েই,  এবং বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও তারা কৃষক পর্যায়ে উন্মুক্ত চাষের অনুমতি নিয়েছে ২০১৩ সালে। তড়িঘড়ি ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর পরই জানুয়ারি মাসে বিটি বেগুনের বীজ প্রথমে সীমিত আকারে কৃষকদের মাঝে বিতরন করে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটি ৭টি শর্ত সাপেক্ষে বিটি বেগুনের অনুমোদন দিয়েছিল।

বাংলাদেশে ৯টি স্থানীয় জাতের বেগুনে বিটি বেগুন উদ্ভাবনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি জাত -- উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা এবং বারি বেগুন ঈশ্বরদী ০০৬ বিটি বেগুন ১, ২, ৩, এবং ৪ নামে বিভিন্ন এলাকায় চাষ করানোর জন্যে কৃষকদের বীজ দেয়া চলছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতি বছর বিকৃত বেগুনের বীজ বিতরণ অব্যাহত রেখেও মাঠ পর্যায়ে চাষ সফল হয় নি। শুধু তাই নয়, অনুমোদনের সাতটি শর্ত মেনে চলতে বিটিবেফুন প্রবর্তঙ্কারিরা ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে লেবেল। বিটি বেগুন বাজারজাত করতে হলে লেবেল দিতে হবে। দ্বিতীয় দিক হচ্ছে পরিবেশের ওপর কোন প্রভাব পড়ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

বিটি বেগুন শুধু ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করবে বলে দাবি করা হয় অথচ স্থানীয় জাতের বেগুনে পোকা লাগার পরিমাণ খুবই কম। পোকা লাগে হাইব্রিড বেগুনে। যে সকল স্থানীয় জাতে এই জিএমও কারিগরি করা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটিরই মধ্যে প্রাকৃতিক ভাবেই  পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। এই জাতের বেগুন আমামদের কৃষকরাই আবিষ্কার করেছেন। স্বাদ, ফলন ও পোকা প্রতিরোধী হবার কারনে কৃষকদের মধ্যে এই জাতগুলোর জনপ্রিয়তাও বেশি। কৃষকের আবিষ্কারের ওপর তথাকথিত বিজ্ঞানিরা এখন খোদকারি করছেন। এই জাতগুলো্র গঠন সংকেতে (জিন)  বিকৃতি ঘটাবার টেকনলজি মনসান্তো কোম্পানির। বেগুনে মন্সান্তো কোম্পানির টেকনলজি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কার্যত বেগুনের জাতগুলোকে মনসান্টো কোম্পানির পেটেন্টের অধীনে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা জাতীয় স্বার্থের বিরোধী।

জিএম ফসল প্রবর্তনের ঝুঁকি যে বিশাল ও মারাত্মক হতে পারে সেটা আন্তর্জাতিক ক্ষে্ত্রে বিজ্ঞানী ও নীতি নির্ধারক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত। বিটি বেগুনের অনুমোদন না দেয়ার জন্যে বিশ্বের সেরা ১০ জন স্বাধীন বিজ্ঞানী চিঠি দিয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে সাবধানী হবার (Precautionary Principle) যে ন্যূনতম নীতি আন্তর্জাতিক রীতি ও বিধিবিধান আছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা মানা হয় নি।



সভায় ড.এম.এ. সোবহান, প্রেসিডেন্ট, বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের ওপর জিএম শস্যের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে জিএম শস্য বীজ সেক্টরের ওপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে ক্ষুদ্র চাষীদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ, বাংলাদেশে জিএম শস্য চালুর আগে একটি খোলামেলা আলোচনা এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে একটি স্বাধীন মূল্যায়নের আহ্বান জানান। স্বার্থান্বেষী মহলের প্রচারনায় বিভ্রান্ত না হয়ে সরকার স্বচ্ছ ভাবে এবং ভাল ভাবে জেনেশুনে সিদ্ধান্ত  নিক। সরকারকে অবশ্যই  কৃষক, পরিবেশবাদী, এবং সুশীল সমাজের সংগঠনসহ সকল অংশীদারদের সাথে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।

ইবনুল সাইদ রানা, চেয়ারম্যান, নিরাপদ ডেভেলাপমেন্ট ফাউন্ডেশন, জিএম শস্যের সাথে সম্পর্কিত সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার দাবী জানান। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র চাষীদের উপর জিএম শস্যের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে একটি স্বাধীন তদন্ত করা হোক এবং বাংলাদেশে জিএম শস্য চালুর বিষয়ে সকল স্তরের মানুষের সাথে ব্যাপক আলোচনা করা হোক।

বদরুল আলম, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন (বিকেএফ), বাংলাদেশে চালু করার আগে জিএম শস্য গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুনের দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত প্রভাবের জন্য পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করার দাবী জানান।

সভার শেষে উবিনীগ, বেলা, নয়াকৃষি আন্দোলন, নাগরিক উদ্যোগ, জিএম বিরোধী মোর্চা এর পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রশ্নের নিরসন দাবী করেন। প্রশ্নগুলো হচ্ছে:

১. বাংলাদেশের মতো কৃষি ও প্রাণ বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ দেশে গোল্ডেন রাইস ধান এবং বিটি বেগুন প্রভৃতি বিকৃত বীজ প্রবর্তনের আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি? অথচ এই দুটো ফসল যে কারণে করা হচ্ছে তার সমাধান আমাদের কৃষি ব্যবস্থাতেই রয়েছে ।

২. জিএম ফসলের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে এ ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাপী বিজ্ঞানীরা একমত। বিজ্ঞানিরা এ নিয়ে গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানিদের আপত্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) আদৌ অভিত কিনা। আদৌ তাদের কাছে কোন তথ্য আছে কি? তারা কিভাবে নিশ্চিত হয়েছেন যে এই দুটি বিকৃত বীজ বা জিএমও ফসল নিরাপদ? সে রকম কোন গবেষণা প্রতিবেদন আছে কি?

৩. ভিটামিন এ ঘাটতির অজুহাতে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তন না করে দেশে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ্ব সবজি, ফল, শাক, ইত্যাদি উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে না কেন?

৪.  ব্রি -২৯ বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি। কিন্তু কোম্পানির টেকনলজি ব্যবহারের ফাঁদে ফেলে পেটেন্ট সিনজেন্টা কোম্পানীকে দিয়ে দেয়ার কোন আইনী অধিকার কারো আছে কিনা।  শুধু তাই নয় দেশের কোটি কোটি কৃষকের ধানের এই জাত চাষ করার অধিকার কি ক্ষুন্ন হবে না? এই ধান বহুজাতিক কোম্পানিকে দেয়া হোল কেন?

৫. কীটনাশক ব্যবহার কমাবার কথা বলে বিটি বেগুন প্রবর্তন করা হচ্ছে অথচ ধান থেকে শুরু করে সব ধরণের হাইব্রিড ফসলে ব্যাপকভাবে কীটনাশক ও আগাছানাশক ব্যবহার করা হচ্ছে? এগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না কেন?

 পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বায়োসেফটি কমিটি এই সব বিষয়গুলো ভাল ভাবে পরখ করবেন এটা বাংলাদেশের নাগরিকরা আশা করেন।  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় সহ সকল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থ যেমন দেখতে হবে তেমনি স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও কৃষি ব্যবস্থার ক্ষতি রোধ করবার ক্ষেত্রে হুঁশিয়ার হতে হবে।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।