'আনুষঙ্গিক' পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার
ফরহাদ মজহার (জন্ম: ৯ আগস্ট ১৯৪৭) । বাংলাদেশের কবি, ‘ভাবচর্চা’ তাঁর লেখালিখির প্রধান ক্ষেত্র। বাংলা যেভাবে ‘ভাব’ কথটা বোঝে এবং তাকে ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করে ভাবে পাশ্চাত্য দর্শন বা বা বৈদিক চিন্তায় সেটা নাই। তবে মার্কস যে অর্থে ‘ক্রিটিক’ কথাটা ব্যবহার করেন সেই প্রকারে বুদ্ধিকে ব্যবহারের গুরুত্ব তিনি মানেন; নইলে দলিত, ছোটলোক, খেটে খাওয়া গরিব ও মেহনতজীবী শ্রেণী্র জায়গা থেকে জগতকে দেখা, বিচার করা এবং মজলুমের পক্ষে লড়বার তরিকা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একই তরিকা লালনের ঘরে ‘ভেদবিচার’ নামেও পরিচিত। তাই চিন্তার পর্যালোচনা (বা দর্শন) তাঁর বিশডেষ আগ্রহের বিষয়। সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব সবই তাঁর পর্যালোচনার বিষয়।
ওষুধশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র নিয়ে ফরহাদ দেশে বিদেশে পড়েছেন। পেশায় ঔষধশাস্ত্রবিদ এবং উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। সামাজিক ও মানবাধিকার কর্মী, পরিবেশবাদী। প্রাণবৈচিত্রভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নয়াকৃষি আন্দোলনের তিনি নেতৃস্থানীয় সংগঠক। নয়াকৃষি বা প্রাণের আবাদ নদীয়ার ভাবান্দোলনের অন্তর থেকেই গড়ে উঠেছে। নদীয়ার ভাবের সিলসিলার সঙ্গে নয়াকৃষির সম্পর্ক আন্তরিক। ইত্যাদি নানান কারনে বড় বাংলার ভক্তির ধারায় দাঁড়িয়ে তিনি দেশবিদেশের জ্ঞানকাণ্ড ও রাজনীতি পর্যালোচনার জন্য পরিচিত। গুরু ফকির লবান শাহের অনুপ্রেরণায় ফরিদা আখতার ও সহকর্মীদের নিয়ে নবপ্রাণ আন্দোলন ও ছেঁউড়িয়ায় নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ‘লালনপন্থী’ সাধক, তবে গুরুবাদী ধারায় ‘লালনপন্থা’ নামে কোন ‘কাল্ট’ বা পন্থা আছে মনে করেন না। ‘লালনপন্থা’ নামে কিছু নাই, কারণ নদীয়ার ফকির ‘গুরু থুয়ে গৌর ভজনা’ করে না। নদীয়ার ভাবানুযায়ী তিনি ‘বর্তমানবাদী’, অনুমানকে অনুমানই মনে করেন। নদীয়ার ভাবান্দোলনের উত্তরসূরী, বাংলাদেশের নয়াকৃষি ব্যবস্থার অন্যতম কারিগর হিশাবে দীর্ঘদিনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই মানুষটির সাথে আনুষঙ্গিক-এর কথা হয় গত ৬ই আগষ্ট, ২০২২। সেই কথোপকথন আমাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্তকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে, এ-কথা বলতে দ্বিধা নেই। দীর্ঘ সেই আলোচনার বাঁকে বাঁকে আমরাও মুখোমুখি হচ্ছিলাম নতুনের সাথে, যেমন এই সাক্ষাৎকারের প্রথম প্রশ্ন আসে তাঁর দিক থেকে:
ফরহাদ মজহার: আপনারা হঠাৎ আমার ব্যাপারে উৎসাহী হলেন কেন?
আনুষঙ্গিক: বোধিচিত্ত-তে আপনার ফিলোজফি নিয়ে কিছু লেকচার শুনি এবং শুনে আপনাকে নিয়ে রিসার্চ করা শুরু। তারপর মনে হয় এই সংখ্যাটা করতে গেলে আপনার সাথে কথা বলতেই হবে, সেখান থেকেই এই সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতি। আমরা আলোচনাটা সাহিত্যের দিক থেকেই শুরু করি, যেহেতু আমরা মূলত সাহিত্য পত্রিকা। আপনি এখন সাহিত্য-সংক্রান্ত কি কাজ করছেন এবং তার সাথে তথাকথিত ভাববাদী, ভক্তিবাদী আন্দোলনের সম্পর্ক কি?
ফরহাদ মজহার: ভারতবর্ষের কবি অতনু সিংহের সাথে আমি একটা পত্রিকা করি, নাম: 'প্রতিপক্ষ: বড় বাংলার সাহিত্য'। আমরা একটি সপ্রাণ ও সুনির্দিষ্ট ভূগোলে বড় হয়েছি এবং নানান বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্যসহ শিথিল অর্থে 'বড় বাংলা'-য় বাস করি। 'বড় বাংলা' সকলের আবাস, যারা কমবেশী পরস্পরের ভাষা বোঝে এবং নানান প্রকার সামাজিক আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে সবার বোধগম্য একটা ভাষা তৈরিতে অংশগ্রহণ করে। সেই ক্ষেত্রে পুঁজিতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থা এবং গুটেনবার্গ টেকনলজির ভূমিকা আছে যেন আমরা দেশকালনির্দিষ্ট মানচিত্র এবং রাষ্ট্রের বাইরে নিজেদের আরো বৃহৎ সম্পর্ক কল্পনা করতে এবং নতুন ভাবে ভাবতে ও পর্যালোচনা করতে পারি। ‘‘প্রতিপক্ষ’ বাংলা ভাষায় সকলের সহিত সম্বন্ধ পর্যালোচনা এবং নতুন সম্বন্ধ স্থাপনের সম্ভাবনা বিচারের পত্রিকা। এই ‘বাস’ বা ‘আবাস’ তথাকথিত রাজনৈতিক মানচিত্র কিম্বা নিষ্প্রাণ ভূগোলের ধারণা থেকে আলাদা। প্রথাগত রাজনীতির ধারণা থেকেও আলাদা। ‘বড়বাংলা’ এমন এক আবাসে বাস করবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ ও চর্চা যেখানে ভূগোল, প্রাকৃতিকতা, জীবন যাপন, ভাব এবং ভাষার স্বাভাবিক সম্বন্ধকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ভূগোল ও আবাসের সম্বন্ধ বিচারের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। নিজেদের মধ্যে সম্বন্ধ দৃঢ় করা এবং নতুন করে নিজেদের কল্পনা করতে পারা সম্ভব কিনা সেটা পর্যালোচনা করে। মানুষ শুধু ভূগোলে নয়, ভাষার মধ্যেও বাস করে। বড় বাংলা আবাস ও ভাষা এই দুয়ের সম্বন্ধ পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে নিজেদের বৈষয়িক ও আত্মিক বিকাশের শক্ত ভিত্তি সন্ধানে আগ্রহী।
পুঁজি এবং আধুনিক জীবন ব্যবস্থা আমাদের প্রথাগত সম্বন্ধ নিত্যদিন ভাঙছে, সমাজকে বিভিন ভাবে চুরমার করে দিচ্ছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভক্তি ও শত্রুতাও বাড়াচ্ছে। বড়বাংলার ধারণা এবং নতুন ভাবে সম্বন্ধ তৈরির আকুতি এই ক্রম বিভাজিত প্রক্রিয়া, বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদের বিরুদ্ধে সাহিত্যিক প্রতিরোধ বলতে পারেন। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বিপরীতে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের ক্ষত অতিক্রম করে সকলের সঙ্গে সহজ সরল স্বাভাবিক ও সপ্রাণ সম্পর্ক বিকাশের বীজ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা আমরা তার চেষ্টা করছি।
নতুন সম্বন্ধ আবিষ্কার ও বসবাসের উপাদান বড়বাংলার ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে আমরা বিশেষ ভাবে খুঁজি । জাতপাত বর্ণ পরিচয় ও সামাজিক বিভাজনের বিরুদ্ধে বাংলার ভক্তি আন্দোলন শক্তিশালী একটি ধারা। সাধকদের জীবন যাপন ও ভাবচর্চার মধ্যে আমরা নতুন করে সামাজিক ও পরমার্থিক আকুতি সম্পন্ন মানুষ হিশাবে নিজেদের নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে পারি। নতুন করে বুঝতে পারি। এই আবাসের লোকেশান বা দেশকালপাত্র আছে, ‘বড় বাংলা’ কথাটা আমরা আমরা কোঠায় আছি সেই দিকচিহের অবস্থান আবিষ্কারের চেষ্টা বলা যায়। 'বড়বাংলা' কথটা আমরা নিজেদের লোকেশান চিহিত করবার চিহ্ন হিশাবে ব্যবহার করি। বড় বাংলার কোন জাতিবোধ, জাতিবাদ, বর্ণ, শ্রেণী, লিঙ্গ কিম্বা সাম্প্রদায়িক পরিচয় নাই। কিন্তু ধর্ম,ঐতিহ্য,ইতিহাস, ভাষা, ভক্তি ও ভাব ইত্যাদি রয়েছে। কিন্তু কোন চিরায়ত পরিচয় বা জাতিবাদ নাই। ভেদ বিচার আছে, কিন্তু ভেদ নাই।
সে কারণে ‘সাহিত্য’ আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের চর্চার বিষয় হয়ে হাজির হয়েছে। সাহিত্যের কাজ হচ্ছে সম্বন্ধ তৈরি, সম্বন্ধ পাতানো -- বিভেদ তৈরি বা শত্রুমিত্র ভাগ করা নয়। শত্রুমিত্র ভেদের রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যের বিরোধ মৌলিক। এই দিক থকাএ সাহিত্য রাজনীতি নয়, কিন্তু শত্রুমিত্রভেদের বিপরীতে মানুষের সার্বজনীন আকুতি আবিষ্কার ও মূর্ত করে তোলাই সাহিত্যের কাজ। সাহিত্য শত্রুমিত্রের ভেদরেখা মুছে দিতে সক্ষম। সাহিত্য এমনই একটা ধারণা যেখানে সকলের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন এবং সকলের সঙ্গে বাস করবার আকুতি তৈরি করে।
কার্ল মার্কস এই আকুতির উৎপত্তি মানুষের প্রজাতিগত সত্তার (Species Being) মধ্যে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। এরিস্টটলের ‘পলিস’ (Polis) ধারণার মধ্যেও এই মর্ম নিহিত রয়েছে। এই ধারণাগুলোর গভীরে আমরা প্রবেশ করবার চেষ্টা করি। এর সঙ্গে বড় বাংলার জীব-পরমে সম্বন্ধ নির্ণয়ের দীর্ঘ বাহাস বা তর্কাতর্কির ঐতিহ্যও আমরা মনে রাখি। এই জন্য ‘সাহিত্য, 'বড়বাংলা’ ইত্যাদি বর্গ বাংলার ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। ওর মধ্যে যে বাংলার রূপ আমরা আবিষ্কার করবার চেষ্টা করি সেটা কোন জাতিবাদী বাংলা না, সহজ মানুষের বাংলা। বড় বাংলার বীজ এই প্রকার শক্তিশালী ভাবচর্চার ক্ক্ষেত্রগুলোতে আমরা সন্ধান করি। বীজ আছে, জমি আছে, বীছন আছে -- যা আছে তাকে চাষ করবার কথা আমরা বলি। যেমন সাধকেরা বাস করেন,তাঁদের যার যার অঞ্চলের সাহিত্যে, কাব্যে, গানে, নানান জীবন যাপন চর্চায় , ইত্যাদি। নিজ নিজ অবস্থান থেকেই তাঁরা সকলের সঙ্গে নিজ নিজ সম্পর্ক মজবুত করেন, সার্বুনীন বা সকলের হয়ে ওঠেন। বড় বাংলাও সকলের বাংলা হয়ে ওঠার সাধনা।
'সহিত’ থেকে এসেছে ‘সাহিত্য’। তাই সাহিত্যের আসল কথা সম্বন্ধ রচনা করা। তাই ’সাহিত্য’ কথাটা বড় বাংলায় ‘লিটারেচার’ হিশাবে আমরা অনুবাদ করি না। পাশ্চাত্যের লিটারেচারের ধারণা আমরা গ্রহণ করি না। 'লিটারেচার' থেকে 'সাহিত্য' অনুবাদ করি না। 'সাহিত্য' মানে সকলের সহিত বাস করতে শেখা, বাস করতে পারা, সম্বন্ধ পাতানো। আমরা পাশ্চাত্য অনুকরণ করি না। আমরা ঔপনিবেশিক আমলে ছাপাখানা ও বইকেন্দ্রিক যে সাহিত্যের ধারণা গড়ে উঠেছে সেই লিটারেচারে সায় দেই না। আমরা সাহিত্যের পাশ্চাত্য ধারণার বিরোধী, সেটা বাইরে থেকে নকল করা। আমরা পাশ্চাত্য নকল করি না।
এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি এটাই সাহিত্য। এখন কথোপকথন ছাড়াও সেটা লেখালেখি হতে পারে, নাচ হতে পারে, গান হতে পারে, শিল্পকলা হতে পারে, অন্য আরও অনেক কিছুই হতে পারে। কথোপকথন যেমন আরেকটি সচেতন জীবের সাথে সম্বন্ধ তৈরিতে সহায়ক, তেমনি অন্য যে কোন চিহ্ন ব্যবস্থা ও মাধ্যমও একই কাজ করতে পারে। কথোপকথনে যে পরিসর ও ভাব আদানপ্রদানের ক্ষেত্র তৈরি করে তার প্রেরণায় আমরা পরস্পরের কথোপকথনের মধ্যে বাস করা শুরু করি- আপনি আমার কথা শুনছেন,আমি আপনার কথা শুনছি, ঘাড় নাড়ছেন,ঘাড় নাড়ছি -- এই যে পারস্পরিকতা -- এটাকেই বলে ‘সাহিত্য’। এখানে দুজনের ‘সহিত’ বা সাহিত্য হোল।
সাহিত্যের এই ধারণা আমাদের আধুনিক বাংলা সাহিত্য থেকে হারিয়ে গিয়েছে, ফলে ভক্তির ধারণাও চলে গেছে। এখন সাহিত্য ছাপাখানার বই বোঝায়। সকলে বই পুজা করে। কিন্তু গ্রন্থ সম্বন্ধ তৈরির একটা উপায়। মুখের কথা, কথোপকথনের একটা মূল্য আছে,বিশেষত আমাদের সাধকদের ধারার মধ্যে তার একটা পরিমণ্ডল আছে, একটা লম্বা ইতিহাস আছে- তার খুব একটা খবর এখন আর আমাদের কাছে নেই, না থাকার জন্য আমাদের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে, আপনাদের ওখানে যেমন ক্ষতি হচ্ছে আমাদের এখানেও হচ্ছে।
ভাবুন, লালনকে যেভাবে হাজির করে এখানকার শিক্ষিতরা- লালন যেন একটা theatrical ব্যাপার -- সাদা কাপড় পরিয়ে ছেলেমেয়েদের নাচানো, ইত্যাদি। লালন একেডেমি’ ও ছেঁউড়িয়ার অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে সরকার, এটা প্রচণ্ড ক্ষতি করছে আমাদের। লালন সম্পর্কে,বাংলার ভক্তিধারার ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে এই সব উপদ্রব মারাত্মক ক্ষতি করেছে। শুধু তাই নয় বাংলার যে দুটো ধর্ম সম্প্রদায় -- সনাতন হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম -- এই দুই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত যারা -- তাদের নিজেদের মধ্যেকার বোঝাবুঝির জায়গায় মারাত্মক ফাঁক তৈরি হচ্ছে, ক্রমশ পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে, গহ্বর বড় হচ্ছে ।
আপনাদের ওখানে শাক্তদের যে ভক্তির ধারা এসেছিল সেটা খুবই শক্তিশালী। রামপ্রসাদ ফার্সি জানতেন আরবি জানতেন। যেমন কমলাকান্তও জানতেন। বিদ্যাসাগরের হাত ধরে সংস্কৃতায়ন শুরু হয়, তারপর সাহেব-পণ্ডিতের বাংলা। রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত কি অপূর্ব সব গান লিখেছেন, দর্শনের গোড়া ধরে টান দিয়েছেন, ধর্মতত্ত্বের থাম গুলো ভেঙেছেন। এখন তো শাক্তদের সেই ধারা আপনাদের ওখান থেকে হারিয়ে গেছে বলেই মনে হয়। গান হয় খুব সুন্দর। পারফেক্ট। কিন্তু ভক্তি নাই। সেটা পর্যবসিত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী পরিচয় নির্মাণে। এখন দেখা যাচ্ছে এই পরিস্থিতিতে আপনাদের ওখানে ইস্কন গড়ে উঠেছে। কলকাতায় যারা শিক্ষিত -- যাদের এই ভক্তির ধারা -- অর্থাৎ চিন্তা, দর্শন বা ভাব পর্যালোচনার ধারা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকার কথা ছিল, তারা সজ্ঞান থাকেন নি। যাদের প্রশ্ন করার কথা ছিল বা জানবার কথা ছিল তারা সেই বিষয়ে অবগত নন। ফলে একটা ক্ষতি হচ্ছে। তাদের তো প্রশ্ন করার কথা ছিল বা জানার কথা ছিল যে ইস্কন যেটা করছে সেটা কি আদৌ চৈতন্যদেবের ধারা, না অন্য কিছু? তাঁরা কিন্তু সেই কাজ করছেন না।
ভক্তিধারা মাত্রই মানুষকে আকৃষ্ট করে, ভক্তির ধারা মানুষকে পরস্পর থেকে আলাদা করে না। এর প্রথম পর্যায়ে আসে মৈত্রী তারপর আসে সঙ্গ। আমি আপনার সঙ্গে একই অনুমান ও একই চিন্তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যখন কথা বলি তাকেই বলে সঙ্গ। পরস্পরকে জানার এই প্রয়াসকে আরও গভীরে নেবার নাম, 'সাধুসঙ্গ'। যেখানে আমাদের বাইরের আবরণ খসে পড়ে, আমাদের সার্বজনীন সহজ মানুষের রূপ্টা প্রকাশিত হয়। কথা বলার আগের পর্যায়ে এই যে আপনি আমার সম্পর্কে আগ্রহ বোধ করেছেন এবং আমিও আগ্রহ দেখিয়েছি অর্থাৎ আমাদের দুজনের মধ্যে একটা মিত্রতা স্থাপন হয়েছে -- সেটাই ‘সাহিত্য’। অর্থাৎ আমার লেখা পড়েছেন, মৈত্রী স্থাপন হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন সাধুসঙ্গ করছি না। সাধুসঙ্গ করতে গেলে আমাদের অনেক আলোচনা করতে হবে, আমাদের জানতে হবে্একে অপরের অনুমান গুলি কি কি, একে অপরের চিন্তা সম্পর্কেও একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। ‘সাধুসঙ্গ’ তখনই ফল্প্রসূ হয় যখন আমরা পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারি। আমরা একই ভাষা ও চিন্তার বর্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠি।
সাধুসঙ্গ বলতে আমরা যেভাবে এখন একটি অতীন্দ্রিয় ব্যাপার বুঝি, যেখানে কিছু লোক একত্র হয়েছে, একজন হয়তো একতারা বাজিয়ে গান করছে, এগুলো লালনের ঘরের বিষয় নয় এগুলো বাইরে থেকে এসেছে। গান থাকবে আগেও ছিল। কিন্তু যা হারিয়ে গিয়েছে তা হচ্ছে কথোপকথন। কথা বেচা কেনা, পরস্পরকে চেনার সঙ্গ আর নাই। তাই এখন সবই এক প্রকার বিকৃত বিনোদনে পরিণত হয়েছে।
আনুষঙ্গিক: বেশ,তাহলে মৈত্রীর এই পথ ধরেই আমরা একটু একটু এগোই,আপনি নিজের বিষয়ে একটু বলুন।
ফরহাদ মজহার: আমি অতিশয় ক্ষুদ্র মানুষ। নদীয়ার যে ভাবের ঘর গুলো হচ্ছে তার মধ্যে একটি ঘর লালনের ঘর। আমি সেই ঘরের মানুষ। আমরা গুরুবাদী। আমার গুরুর নাম লবান শাহ। তাঁর যে গুরু অর্থাৎ আমার দাদাগুরু কোকিল শাহ। এঁরা খুবই স্বনামধন্য মানুষ। যখনই কেউ ভক্তির ধারা নিয়ে আলোচনা করবে খুব স্বাভাবিক নিয়মে এঁদের নাম এসে যাবে। ফকির লবান শাহের যিনি দাদাগুরু তিনি ভোলাই শাহ। ভোলাই শাহ,ফকির লালন সাঁইয়ের পালিত পুত্র এবং সরাসরি শিষ্য।
লালনের ঘর ছাড়াও নদীয়ার ভাবের আরো চারটি ঘর আছে, এদেরকে আমরা বলি 'গদিমান্য'। অর্থাৎ তাঁরা যে আসন বা গদিতে বসছেন সেই অধিষ্ঠানকে আমরা সম্মান করি। তাঁদের আসনটা আমরা স্বীকার করি, কারন তাঁদের কাছে আমরা ভাব ও চর্চা উভহয় দিক থেকে ঋণী। 'আসন' মানে তাঁরা যে ঐতিহ্য, জ্ঞান ও চর্চা ধারণ করে সাধকদের ইতিহাসে নিজেদের জন্য বিশেষ স্থান আদায় করে নিয়েছেন, সেই চর্চার কাছে আমরা ঋণী। তাঁদের ঘরের কেউ যদি আমাদের কাছে আসেন আমরা তাঁকে যেখানে সেখানে বসতে দিতে পারি না, তাঁকে ‘আসন’ দিতে হয়। মানে স্রেফ ভাল বসার জায়গা বা চেয়ার-টেবিল-সোফা- সিংহাসন নয়, তাঁকে যথাযোগ্য সাধকের মর্যাদা দিতে হয়। কারণ ভাবগতভাবে আমরা তাঁদের কাছে ঋণী।
এই ঘরগুলির মধ্যে প্রথম ঘরটি আছে কল্যাণীতে, আপনাদের ওখানে; যাদের বলে কর্তাভজা। সরস্বতী বা সতী মা’র ঘর। তারপরের ঘর হল পাঞ্জু শাহ, তিনি এই দিককার। তারপর হল দেলবার শাহের ঘর। ফকির লালন শাহের অধিকাংশ গান তিনি সুর করেছিলেন,আবার এভাবেও বলা যায় যে একমাত্র দেলবার শাহের ঘর থেকে গানের যে সুর করা হয় তাকেই আমরা প্রামাণ্য বলে মেনে নিই। সকলেরটা মানি না। আমাদের গানের মধ্যে যদি কোনো ভুল হয় আমরা এই ঘরের মানুষদের থেকে তার গায়ন পদ্ধতি বা বিভিন্ন রাগপদ্ধতি জেনে নেই। সেই রাগ ভূপালি হতে পারে আবার জয়জয়ন্তী হতে পারে কিম্বা অন্য কিছু। লালন লোকগীতিকার ছিলেন না।
আর শেষে যাঁর ঘরের নাম করছি, তাঁর নাম হয়তো আপনারা কম শুনেছেন কিন্তু জ্ঞানের দিক থেকে তিনি প্রায় লালনের সমপর্যায়ের, তাঁকে আমরা বলি চৌধুরীর ঘর। উজল চৌধুরী থেকে চৌধুরি। তিনি ইসলামের সকল শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। তিনি যখন নদীয়ায় এলেন এবং তাঁর সাথে লালনের যে বাহাস বা তর্কবিতর্ক হল তার মধ্যে দিয়ে তিনি লালনকেই অন্য সকলের মতো নদীয়ার ভাবের গুরু হিসেবে মেনে নিলেন। চৌধুরীদের ঘরের প্রচুর ভালো ভালো গান আছে। আমরা ওদের ঘরের গানও করি,ওদের ঘরের গান প্রায়ই ‘কাটান’ গান ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ। অর্থাৎ যে গানের মধ্যে দিয়ে বিপরীত চিন্তা প্রকাশ পাবে। কাটান মানে আপনি কাটছেন অর্থাৎ তর্ক করছেন, একটা ডিসকোর্স তৈরি হচ্ছে। এই ঘরগুলি শ্রুতি এবং কন্ঠনির্ভর। শ্রুতি ও কন্ঠ নির্ভর ভাব বা দর্শন চর্চার যে ধারা তাই এখানে ধারাবাহিকভাবে বয়ে গেছে। বয়ে যাচ্ছে।
যদি কেউ কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত না পড়ে তাহলে আমাদের ঘর থেকে আমরা তাকে কবি হিসাবেই স্বীকার করি না। কাব্যের সব থেকে বড় নিদর্শন হল শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। কারণ এটি একই সঙ্গে কবিতা, দর্শন আবার বায়োগ্রাফি। কৃষ্ণদাস শ্রীচৈতন্যের জীবন ব্যাখ্যা করছে ভাব ও দর্শনের জায়গায় দাঁড়িয়ে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যদেবকে যেভাবে কাব্য, অলংকার ও কলনা সমেত হাজির করেছেন সেটাকে বাংলাদেশের ফকিররা গ্রহণ করেন। সেই কারণে আমরা বলি, চৈতন্যদেব হলেন প্রথম ফকির। তবে বৈষ্ণবদের সাথে আমাদের পার্থক্য আছে। বৈষ্ণবরা যেভাবে চৈতন্য সম্পর্কে বলেন বা বোঝেন, আমরা সেই ভাবে বলি না। তারা মূলত যেটা করেন সেটা আমরা করি না। তারা চৈতন্যকে আবার ব্রাহ্মণ্যের স্থানে বসিয়েছেন এবং ভক্তির ধারা থেকে মুসলমানদের বাদ দিয়ে তাকে হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত করে ফেলেছেন। আমরা তা মানি না। শুধু তাই না ভক্তির ধারা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানকে বাদ দেওয়া হয়। অথচ সত্য হোল ইসলামের সংস্পর্শ ছাড়া ভক্তির ধারা নদীয়ায় বিকশিত হওয়া অসম্ভব ছিল। ফলত প্রথাগত বর্ণাশ্রম ভিত্তিক যে হিন্দু সম্প্রদায় ছিল তারা চৈতন্যকে আবার ব্রাহ্মণ বানিয়ে ফেললেন। তারা এমন এক চৈতন্যকে হাজির করলেন যার গলায় পৈতা ঝুলছে। তার চৈতন্যকে আবার উচ্চবর্ণের পরিসরে মধ্যে ঢুকিয়ে গেলেন।
আমরা যখন নাম নেই বা ভক্তি দিয়ে থাকি, তখন তার মধ্যে বৈষ্ণবদের ইনক্লুড করি। তেমনি দুনিয়ার সকল প্রজ্ঞাবান, সমস্ত জ্ঞানী মানুষ বা বিদ্বানদেরও ইনক্লুড করি। বৈষ্ণবরা আমাদের ভক্তি পান শ্রীচৈতন্যের জন্য, কারণ তিনি নদীয়ার প্রথম ফকির। কিন্তু তিনি বাংলার প্রথম গুরু নন। নদীয়া গুরু মানে নিত্যানন্দকে। চৈতন্যকে নয়। এটা বোঝা খুবই জরুরী।
নদীয়ার ভাব চৈতন্যের হাতে তৈরি হয়েছে। সন্যাসের পর তিনি কিন্তু নদীয়ায় মাত্র ছয় মাস ছিলেন। ফলে নদীয়ার একটা অভিমান আছে তাঁর বিরুদ্ধে। অভিমান হচ্ছে তিনি নদীয়া ছেড়ে চলে গেছেন পুরীতে এবং সেখানে তিনি ছিলেন। চৈতন্যের ধারণা ছিল যে ব্রাহ্মণরা তাঁর তত্ত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি নিজে যেহেতু ব্রাহ্মণ ছিলেন, ভেবেছিলেন তিনি ব্রাহ্মণদের বদলাতে পারবেন, শাস্ত্রীয় ধর্মের মধ্যে রূপান্তর আনতে পারবেন। কিন্তু তিনি ভুল প্রমাণিত হলেন। তাঁকে পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণরা (পুরীর পান্ডারা) হত্যা করেছিল- এটা আমরা বিশ্বাস করি।
যেহেতু আমরা নিত্যানন্দকে গুরু মনে করি তাই আমরা যখন সন্ধ্যাবেলায় গান গাইতে বসি এবং যদি গুরু আসনে না থাকেন, অর্থাৎ উপস্থিত না থাকেন না তাহলে প্রথমে গাই "দয়াল নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না"। গৌরাঙ্গ ফেলে যেতে পারেনে, বা নদীয়া ত্যাগ করে যেতে পারেন, কিন্তু নিতাই কাউকে ফেলে যাবে না। নিত্যানন্দ ব্রাহ্মণ ছিলেন না, (যদিও এ নিয়ে বৈষ্ণব মহলে তর্ক আছে) তিনি ছিলেন হাড়িয়া ওঝার সন্তান। যদিও তাঁকে অনেকে ব্রাহ্মণ হিসাবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে কিন্তু পারেন না। পরবর্তীকালে নিত্যানন্দকে দমন বা গৌণ করারও চেষ্টা করা হয়। গৌর-নিতাই অনেক বৈষ্ণব একসঙ্গে বলেন, কিন্তু তার মর্ম স্পষ্ট করে বলেন না। চৈতন্য নিজেই বলেছেন আমি নদীয়ায় যা কিছু লীলা করেছি তা নিত্যানন্দ যা বলেছেন তাই। সত্য মিথ্যার বিচারটা পরে, কিন্তু এই দাবি গুরুত্বপূর্ণ। চৈতন্য নিজে কিভাবে নিত্যানন্দের সঙ্গে পার্থক্য বিচার করেছেন সেটা বুঝতে হবে। পার্থক্য মানে এই নয় যে কথাবার্তা বন্ধ, মুখ দেখা বন্ধ, চিন্তার পার্থক্য বা মিল। চৈতন্য যে লীলা করেছেন সেটা নিত্যানন্দের উৎসাহেই করেছেন। তাহলে আপনি যদি নিম্নবর্গের মানুষ হাড়িয়া ওঝার পুত্রকে অস্বীকার করেন তাহলে আপনি 'ব্রাহ্মণাইজড' হয়ে গেছেন। চৈতন্যকে আবার উচ্চকোটিতে ফিরিয়ে নেবার ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রয়াসের সঙ্গে আপনিও জড়িত হয়ে পড়লেন। এখন দেখুন, ইসকনে বিদেশীরাও ব্রাহ্মণ হতে চায়।
বৈষ্ণব আন্দোলন শুরু হয়েছিল নামকীর্তন দিয়ে অর্থাৎ নামাশ্রয় দিয়ে,কিন্তু চৈতন্যের রাজনীতিকে সহজে বোঝার জন্য তিনটি আদর্শ দিয়ে আমরা বুঝতে পারি। এক. নারী-পুরুষ ভেদের বিরোধিতা, নিজেক প্রকৃতি হিশাবে উপলব্ধি, আস্বাদন ও ভাবতে শেখা। দুই: জাতপাত বর্ণাশ্রমের বিরোধিতা এবং তিন: ধনী-নির্ধন ভেদের বিরোধিতা। সবার আগে চৈতন্যের সামাজিক-রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং শত্রু উভয়ই তৈরি হয়েছিল জাতপাত বিরোধিতা এবং বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বিরোধিতার জন্য। পরবর্তীতে যখন জীব গোস্বামীরা এলেন এবং সংস্কৃতে ছয় গোস্বামীরা বৈষ্ণবদের কথাকে অনুবাদ করলেন, শাস্ত্রীয় ব্যাপার বানালেন, তখন জাতপাত বিরোধী ব্যাপারগুলো দূরে সরে গেল।
তিনটি আদর্শিক আন্দোলন নদীয়াকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা পলিটিক্যাল আন্দোলন। যাকে আমরা ভক্তি আন্দোলন এখন বলি বা বলছি। ঘরে বসে ডুগডুগি বাজানো, নামকীর্তন করা বা বাউল গানের নাচনি-কুঁদনি -- সেইটা কিন্তু ভক্তি আন্দোলন নয়। প্রথম কথা, এটা জাতপাত বিরোধী আন্দোলন। অর্থাৎ নদীয়ার একটা পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট আছে। যারাই জাতপাত বিরোধী আন্দোলন করে তারাই নদীয়ার মিত্র। দ্বিতীয় যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল আপনি লিঙ্গ ভেদ করতে পারবেন না। অর্থাৎ নারীকে অবমাননা করা যাবে না। যে কারণে শ্রীরাধিকা আমাদের ধারণায় অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের চিন্তার সেন্ট্রালে তিনি আছেন। চিন্তায় যখন তিনি প্রকৃতি স্বরূপা কিন্তু ভগবানের আরাধ্য হিশাবে আছেন। এই কারনে নদীয়ার ভজনা হচ্ছে "যুগল ভজনা": অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ, বহিরঙ্গে রাধা।
নদীয়া একেশ্বরবাদী। কিন্তু দুইয়ে মিলেই ‘এক’-এ পৌঁছানো। নদীয়া মনে করে ‘এক’কে জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে নির্ণয় করা অসম্পূর্ণ চিন্তা। কারণ আল্লাহ, ঈশ্ব্র বা ভগবান একই সঙ্গে কল্পনা, আবেগ, ভালবাসারও বিষয়। এমনকি ইন্দ্রিয়বৃত্তি বা ‘আস্বাদন’-এরও বিষয়। তাই আল্লাহকে ‘আস্বাদন’ করতে পারাও ভক্তের জীবনে জরুরী।
অন্যদিকে আপনি যদি মানুষকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করেন, আপনি ‘এক’-কে এক পাবেন না। দুটো পাবেন। মানুষ একদিকে আর জগৎ আরেকদিকে। এই দ্বিবিভাগ বহাল রেখে আলোচনা করলে কি আমরা সেই দুয়ে মিলে এক হতে পারব? পারা তো যাচ্ছে না। জগৎ আমার বাইরে আর ‘আমি’ জগতের বাইরে। এই দ্বিবিভাগ অতিক্রম করবার জন্যই ‘যুগল ভজনা’।
জগত আমার বাইরে এই অনুমান ও বিশ্বাসের জন্য জগতের উপর যা কিছু অত্যাচার আমি নির্বিচারে করতে পারি। এই পৃথিবীর তার তো কোন সেন্স নেই। ফলে জগতকে আমরা নির্জীব, প্রাণহীন, কর্তাশূন্য জিনিস গণ্য করি। যেহেতু এখান থেকেই – এই বিভাজন থেকেই আমরা আমাদের চিন্তা শুরু করি তাই আমরা নারীর উপরে অত্যাচার করি, কারণ নারী প্রকৃতি বলে তাঁর কোন প্রাণ, উপলব্ধি ইত্যাদি আছে বলে মনে করি না। নারী যেন কর্তাশূন্য জপড়পদার্থ। এই সকল অনুমানই পুরুষতন্ত্রের ভিত্তি। আমরা তো পুরুষতান্ত্রিক। আমরা তো নারীকে সচেতন, সজ্ঞান কর্তাসম্পন্ন সত্তা বলে স্বীকার করি না। সে কারণেই নদীয়া ‘ যুগল ভজনা’ – যুগলের কথা বলে। এটা পুরুষতন্ত্র বিরোধী। ফলত আমাদের বিদেশ থেকে নারীবাদ বা পুরুষতন্ত্র বিরোধিতা আমদানি করতে হয় না। মানুষ এবং প্রকৃতিকে ভিন্নভাবে ভাবার জন্যেই পৃথিবীতে আমরা পরিবেশের এত ক্ষতি দেখছি,জগতের থেকে মানুষ হিশাবে আমরা ভিন্ন নই। আমরা এক। যুগল ভজনার মধ্যে দিয়ে আমরা একের উপাসনা করি।
আ: আপনি কি বলছেন এটা সমাজের একটা সাইকোলজিক্যাল ব্লক যার ফল আমরা ভুগছি?
ফ ম: না,শুধু সাইকোলজিক্যাল না। মন তো বুদ্ধি থেকে আলাদা কিছু নয়, আধুনিক কালে বুদ্ধিই আমাদের সকল বৃত্তির ওপর সর্দারি করে। সেটা মডার্নিটির সমস্যা। যা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। অতএব এটা ইন্টেলেকচুয়াল ব্লকও। এর মধ্যে তো একটা বুদ্ধিবৃত্তিরও ব্যাপার আছে। আপনি যখন লেখেন বা কথা বলেন তখন তো অবশ্যই বুদ্ধির ব্যবহার করেন। আবার বিজ্ঞানচর্চা করতে গিয়ে জগৎকে জয় করতে হয় মানুষকে। জগতকে জয় করার অর্থ কি, আপনি জগতকে দখলে নেবেন। তাকে আপনার ইচ্ছা মতো ব্যবহার করবেন। তার ওপরে অত্যাচার করবেন? আপনি তো জগতের অধীন, মানুষ তো জগতের তার বাইরের কিছু না। যুগল ভজনা তাই অতি শক্তিশালী পুরুষতন্ত্র বিরোধী ধারণা,প্রাণ প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ধারনা। শুধুমাত্র নারী-পুরুষ একসাথে ভাবা ‘যুগল ভজনা নয়, মানুষ আর প্রকৃতি একদিক থেকে আলাদা আবার অপরদিক থাকে অভিন্ন – এই ভেদাভেদ বোধকে সংকল্পে ও কাজে রূপ দেওয়াই যুগল ভজনা। স্রেফ রাধা-শ্যামের যুগল মূর্তি পূজা না।
লালনের বিভিন্ন গানের মধ্যে এই ভাব গুলি অর্থাৎ নদীয়ার ভাবগুলি পেয়ে যাবেন। লালনের একটি গান শুনুন: "শুনি তিলার্ধ নাই ব্রজ ছাড়া",অর্থাৎ বৈষ্ণবরা যে বলে থাকেন যে সমস্ত জগতই ব্রজধাম,সেটা শুনে লালন প্রশ্ন করছেন তাহলে "মথুরাতে রাজা হল কোন ব্যাটা?"। এই কৃষ্ণ তাহলে কোত্থেকে এল,যে শুধু মথুরার রাজা হল এ তো তোমাদের বৈষ্ণবদের চিন্তাকল্পে থাকার কথা নয়।"তোমরা শুধু কৃষ্ণ কৃষ্ণ কর কেন এ কৃষ্ণ কেমন কৃষ্ণ"? এই যে জিজ্ঞাসা সেটা একান্তই নদীয়ার ফকিরদের জিজ্ঞাসা। বৈষ্ণবদের হরে কৃষ্ণ থেকে আলাদা। আপনি কৃষ্ণ কৃষ্ণ করছেন প্রেমের কথা বলছেন তাহলে এই রাজা, রাষ্ট্র, মথুরা ইত্যাদি কোথা থেকে এল? ফকির লালন শাহ ও নদীয়া যে কৃষ্ণের ভজনা করেন, তিনি কোন রাজ্য বা রাষ্ট্র কায়েম করেন নি বা করেন না। নদীয়ার ফকির যে কৃষ্ণের ভজনা করে তিনি মথুরার রাজা কৃষ্ণ নয়, তিনি শ্রীরাধিকার দাস। এই হল পার্থক্য। আপনি যখন কৃষ্ণকে মথুরার রাজা বানান তখনই রাজতন্ত্রের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। বড় বাংলার বিরহ বা বিচ্ছেদ বেদনার ক্ষেত্র এটাই। আমরা প্রেম-ভালবাসাকে সমাজ গঠনের ভিত্তি বানাই না, আমরা শাওন দণ্ড বা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দ্বারা সমাজকে শৃংখলিত রাখতে পছন্দ করি। এটা গভীর ভাবগত বিরোধ।
আ: তাহলে আপনাদের সাধনার ক্ষেত্রে মূল জায়গাটি কি দাস্য ভাব?
ফ ম: ঠিক কথা। কিন্তু কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন,ওই যে কান্তামূর্তি তার দর্শন করা তার ভজনা করাটাই সাধ্যের নির্ণয়। সেইজন্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ না পড়লে নদীয়ার ফকিরদের বুঝবেন না। রামানন্দ রায়ের সঙ্গে চৈতন্যের যে তর্কবিতর্ক তা সংক্ষিপ্তভাবে বলছি তাহলে হয়তো আরেকটু পরিষ্কার হবে। এটা শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতেই আছে। সহজ করে বলি ধরুন আপনি ব্রজধনকে পেতে চান বা ঈশ্বরকে পেতে চান,এখন রামানন্দ ভক্তিমার্গের অত্যন্ত পন্ডিত ব্যক্তি কিন্তু তিনি ব্রাহ্মণ নন তো চৈতন্য তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন,তাহলে আমাকে যদি ব্রজধন পেতে হয় তা কি করে পাব, তখন তিনি বললেন ধর্মের যে সকল আচার আছে বিধি আছে সেগুলি আগে মানো। চৈতন্য খুশি হলেন না। তিনি বললেন,"এহ বাহ্য,আগে কহ"। আমি তো ভগবানকে এখনই পেতে চাই। পূজা অর্চনা করে কবে পাবো তার কোনো ঠিক আছে? এইসব বাইরের কথা পরে হবে, তুমি আগে বলো,তাকে এখনই কিভাবে পাবো, কিভাবে আমার ‘আস্বাদন’ হবে। তাঁকে এখনই আস্বাদন করতে চাই। তখন রামানন্দ রায় বললেন তাহলে ধর্ম ছাড়ো। তখন চৈতন্য বললেন না এভাবে হবে না, ধর্মে থেকেও হবে না ধর্ম ছেড়েও হবে না। এগুলো বাইরের কথা, এহ বাহ্য, গোড়ার বা আগের কথা বল। অর্থাৎ আস্তিকতা নাস্তিকতার মধ্যে এগুলো হচ্ছে না এরপর এই তর্ক অনেক দীর্ঘ আমি ছোট করে একেবারে শেষ অংশটায় গিয়ে কি হল বলি। তারপরে তর্ক জ্ঞান দ্বারা তত্ত্ব আলোচনা দ্বারা কি আল্লাহ বা ঈশ্বরকে পাওয়া যায়? চৈতন্য বললেন যে না এভাবেও হবে না এটাও বাইরের কথা। তারপর রামানন্দ বললেন যদি জ্ঞান মিশ্রিত ভক্তির চেষ্টা করি? তখন চৈতন্য বললেন, হ্যাঁ সেইটা হতে পারে। ‘এহ হয় আগে কহ আর’। এই পথে তার আস্বাদন পেতে পারি কিন্তু এটাও বাইরের কথা। এইভাবে চলতে চলতে একদম শেষ পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে ভগবানকে রসের দ্বারা সাহিত্যের দ্বারা কল্পনার দ্বারা বুদ্ধি ব্যতীত অন্যান্য বৃত্তির দ্বারা আস্বাদন করতে হবে। এই ‘আস্বাদন’ শব্দটা বোঝা খুব জরুরী এটা আমাদের ভাবের ঘরে অত্যন্ত জরুরী একটা শব্দ। অর্থাৎ আমি যদি ঈশ্বরের স্বাদ না পাই, আমার সকল বৃত্তিসহ যদি রসমূর্তি আমার মধ্যে শিহরণ না জাগায় তাহলে ইশ্বর পাওয়া কথাটা আসমানি ব্যাপার থেকে যায়। টেস্ট না করতে পারি,মানে যদি আস্বাদন করতে না পারি তাহলে বোঝা যাচ্ছে তো ভগবানকে পাচ্ছি না। ভগবানকে তাহলে বুদ্ধির দ্বারা নয় হৃদয় বৃত্তির বা রসবৃত্তির দ্বারা পেতে হবে। সেইটা আমি কি করে পাবো? ওই যে শ্রীরাধিকার যে রূপ, তার রূপের যে মহিমা তার দ্বারা যখন আমি আপ্লুত হই তখনই আমি আসলে ভগবানকে পাই।
এই কথাটার অনেক রকম ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। গোড়ায় রয়েছে বুদ্ধির সঙ্গে মানুষের অন্যান্য বৃত্তির সম্পর্ক, দ্বন্দ্ব, কিম্বা অন্যান্য বৃত্তিকে বুদ্ধির অধীনস্থ রাখবার রীতি। পাশ্চাত্যে যা ‘আধুনিকতা’ নামে কমবেশী পরিচিত। যেখানে Reason বা বুদ্ধিই সার্বভৌম। আপনি দর্শন চর্চা করতে পারেন, রাজনীতি করতে পারেন বা বুদ্ধিজীবী হতে পারেন বা অন্য কিছু। সবদিক দিয়েই এই কথাটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে। যারা দর্শন করবেন তারা বলবেন এটা একটা ফ্যাসিনেটিং ব্যাপার কারণ জগতের সৌন্দর্য -- তার যে মহিমা আপনার সামনে হাজির আছে --তার ‘স্বাদ’ যে নিতে পেরেছে সে তো আর জগৎকে নষ্ট করবে না। তাহলে রূপ আস্বাদনের এই আকুতি ও তাগিদকে সামনে আনা মানে আধুনিক ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল সিভিলাইজেশান যেভাবে প্রকৃতিকে মুনাফা কামাবার উপায় ও দাসে পরিণত করছে, তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। মানুষ শুধু বুদ্ধিমান প্রাণী নয়, মানুষ রূপ আস্বাদনে সক্ষম একটি প্রাণী। আপনি ধরুন একটি গাছের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেছেন,একটি নদীর যে গতিধারা তার শব্দে তার সৌন্দর্যে আপনি আপ্লুত হয়েছেন। অর্থাৎ তার রস আস্বাদন আপনি করতে পেরেছেন,আপনি কি তাকে নষ্ট করতে পারবেন? পারবেন না। আস্বাদন করতে পারলে এ জগতকে আপনি কোনোদিন ধ্বংস করতে পারবেন না। এটা হল নদীয়ার ভাব – একে স্রেফ ভক্তির ধারা বলে উপেক্ষা করবার বিষয় না। হাইয়েস্ট ফর্ম অফ ইকোলজিক্যাল মুভমেন্ট। ইকোলজি পশ্চিমাদের ভাষা। আমাদের কাছে ‘আবাসবিদ্যা’, ‘আস্বাদনের ক্ষমতা’ ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের ভাবান্দোলনের গোড়ায় রয়েছে vinn onuman O cintar jogotভিন্ন অনুমান ও চিন্তার জগত, এটা বড়বাংলার দর্শনেরই অংশ।
আ: এর সাথে আপনার নয়াকৃষির ধারণা কিভাবে হবে যুক্ত?
ফ ম: একদম সম্পূর্ণভাবেই যুক্ত। একই জিনিস।
আ: একটু বিস্তারিত ভাবে বললে ভালো হয়।
ফ ম: আমরা ধরে নেই যে পাশ্চাত্যের কাছে ‘সত্য’ আছে,অর্থাৎ আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতাই মানব জীবনের পরমার্থ। এটা একটা ভুল ধারণা। সত্য আমাদের কাছে নাই, সবই পাশ্চাত্যের -- এই হীনমন্যতা কাটানো জরুরী। বিশ্বায়নের কারণে এই হীনমন্যতা আরও গভীর হয়েছে। কারন দর্শনে, বিজ্ঞানে, কৃৎকৌশল আবিষ্কারে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। নয়াকৃষিতে আমরা এই হীনমন্যতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি।
তাই আমরা আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তার বাইরে বা যেসকল চিন্তা ঔপনিবেশিক আমলে চাপা পড়ে গিয়েছে তা নিয়ে কাজ করি। নয়াকৃষির প্রাথমিক অনুমানই হচ্ছে জগত আমাদের আবাস এবং জগত হল মধুর। জগত হল সুন্দর। নয়াকৃষির যে উদ্দেশ্য সেখানে লেখা আছে ‘সহজপথে আনন্দ’। জগতকে ‘আস্বাদন’ করবার, আর নিজেকে আস্বাদনের মধ্য দিয়ে জগতের মহিমা উপলব্ধি করবার পথ আমরা অন্বেষণ করি। জগতের মধ্যে আনন্দে জীবন যাপনের যে উপায় তাকেই আমরা বলি নয়াকৃষি। জগতে আনন্দে থাকবার উপায় যদি নয়াকৃষি হয় তাহলে তার চাষ পদ্ধতিও সে রকম হবে,যেটা আনন্দে আপনি করবেন শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য করবেন না। মানুষ তো দুনিয়ায় শুধু খেতে ও ভোগ করতে আসে নি। ধরুন আপনি একটি সুন্দর বাগান তৈরি করলেন সেখানকার কীট পতঙ্গ পাখি ফুল সবকিছুকেই আপনার দরকার সেটা আপনি বুঝলেন। আপনি যদি আনন্দ আকাঙ্ক্ষা করেন তাহলে আপনার আবাস ও জীবন যাপন এমন ভাবে গড়ে তুলবেন, যাতে কোন প্রাণ বা প্রাণীর ক্ষতি না হয়। ক্ষতি করে আনন্দ বোধ করবেন না। নিজের আনন্দের জন্যই জগত নষ্ট করবেন না,সকলের আবাসকে আপনি তখন রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। আপনার যে আকাঙ্ক্ষা, কামনা জগতকে ধ্বংস করে, নষ্ট করে সেই আকাঙ্ক্ষা ও কামনাকে আপনি নিজেই স্বেচ্ছায় দমন করবেন। নিজের নেতিবাচক বৃত্তি পরিহারের মধ্যে আপনি আনন্দ পাবেন। তেমনই নদীয়ার যে ভাবের ঘরে আমার আবাস, সেটা এই চিন্তারই আরেক রূপ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমার যে লড়াই সেটাও একই জিনিস, এই চিন্তারই ফল।
রাজনৈতিক লড়াইটা হল,যেহেতু বড় বাংলার ভক্তির ধারা ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গেছে কলোনিয়াল পিরিয়ডের প্রভাবে, অনেক ক্ষেত্রে এটা একটা কাল্ট বা গুহ্য সম্প্রদায়ের চর্চায় পর্যবসিত হয়েছে ফলে তার যে মূল দার্শনিক অবস্থান বা অনুমান সেইসব এখন বাংলাভাষীদের কাছে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাদের চিন্তার ধরন পদ্ধতি সবই ইংরেজদের মতন হয়ে গেছে। তারা বাদামি সাহেব ইংরেজদের মতোই চিন্তা করে। ফলে নিজের মেরুদণ্ড নিয়ে বিশ্ব সভায় দাঁড়াতে পারে না। এগোতে পারে না। এই অন্তর্বর্তী সময়ে আমাদের এগোতে হবে কাজ করতে হবে। এই হল আমার বর্তমান অবস্থান।
দার্শনিক বা ভাবের পরিমণ্ডলে যেমন কাজ করতে হবে তেমনি আবার রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও কাজ করতে হবে। কিভাবে করব সেটা? ধরুন যদি পুরুষতন্ত্রের বিরোধী সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা শক্তিশালী ভিত্তি খোঁজেন তাহলে চৈতন্যের ‘রাধা ভাবে উপাসনা’-র পর্যালোচনা থেকে এক প্রকার শুরু করা যেতে পারে। এখান থেকে বড় বাংলার ইতিহাসের মধ্যে থে্কেই আপনাকে শিক্ষা নিতে হবে; ক্রিটিক্যালি নিজের জায়গাটা বুঝতে হবে।
পাশ্চাত্যে নারীবাদের প্রধান ধারা ব্যক্তির পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মধ্যেই পর্যবসিত হয়ে যায়। অর্থাৎ ব্যক্তিতান্ত্রিক নারীকে তৈয়ার করে। সে আর নারী থাকে না, পুরুষ হয়ে যায়। ব্যক্তির বিকাশ দরকার, কিন্তু ব্যক্তিতন্ত্র ভিন্ন জিনিস। ব্যক্তিতন্ত্র দিয়ে নারীর কোনো উন্নতি হয় না,ব্যক্তিতান্ত্রিকতা বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট্য। নারীকে পুরুষ বানালে শেষাবধি উপকার হয় পুরুষের বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র ব্যক্তি মানুষে আবদ্ধ। তাই ব্যাক্তিতন্ত্র অতিক্রম করতে হলে আপনাকে স্রেফ পুরুষ হলে চলবে না। আপনাকে ‘রাধাভাবের উপাসক’ হতে হবে। অর্থাৎ আপনার জীবনের যে পদ্ধতি তার কেন্দ্রে থাকবেন রা্ধারাণী, প্রকৃতি বা নারী। ইত্যাদি। এটা একটা নজির।
আ: যখন দর্শনের কথা বলতে যাচ্ছেন তখন বারবার কল্পনার কথা আসছে। কিন্তু ফকিররা বর্তমানপন্থী বলেই জানি। তারা তো অনুমানপন্থী নন। এই জায়গাটা একটু পরিষ্কার করুন।
ফ ম: আমরা এখন বুদ্ধিগিরি করি। বুদ্ধি আমাদের প্রাইমারি অরগ্যান, কিন্তু বুদ্ধিকে অন্য সকল বৃত্তির প্রভু বানাই। সেইটা করতে গিয়ে আমরা আমাদের অন্যান্য বৃত্তিকে দমন করি। আমাদের প্রেমের বৃত্তি,কি ভালোবাসার বৃত্তি, কামনা বাসনাকে আমরা দমন করি অযথা। নদীয়া বুদ্ধিবৃত্তির বিপক্ষে না, অর্থাৎ বুদ্ধির দরকার নাই – এ কথা বলে না। বুদ্ধি দরকার, বুদ্ধি আমরা ব্যবহার করে, কিন্তু বুদ্ধির সর্দারি মানি না। অর্থাৎ অন্য সকল বৃত্তিকে দমন করে বুদ্ধিকেই অধিপতি বা একমাত্র নিয়ন্ত্রণকারী বানাই না। যেমন ধরুণ আমি এখন আপনার সাথে কথা বলছি আমি কিন্তু বুদ্ধির ব্যবহার করছি। কারণ আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য বুদ্ধি, যুক্তি মেনেই কথা বললে কথোপকথন সহজ হয়। এখন লালনের একটা গান গেয়ে দিলে কোন লাভ হবে না। সেই পরিমণ্ডলে আমরা এখন নাই। বুদ্ধি আমাদের দরকার, বুদ্ধিবৃত্তির সর্বোত্তম বিকাশও দরকার হতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিমান হওয়া নদীয়ার সাধনা না। আমরা অপরকে ভালবাসি কিনা, অপরের সঙ্গে সহজে সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারি কিনা, হৃদয়ে প্রেম আছে কিনা -- সেই সকল দিক বা সকল বৃত্তির সুষম বিকাশ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
কল্পনাকে ওইভাবে অর্থাৎ যান্ত্রিক ভাবে আলাদা করা যাবে না,আপনি যখন কথা বলছেন তখন প্রয়োজনেই আপনাকে কল্পনা করতে হবে। কল্পনাতো আমাদের সামগ্রিক বৃত্তি থেকে আলাদা কিছু না, কিন্তু কল্পনাকে আলাদা করে বুদ্ধি। ‘রাধা’ তো স্রেফ বুদ্ধির নির্মাণ না। কল্পনার তৈয়ারি জিনিস। বেদে তো এমন কোন দেবী নাই। কিন্তু বাংলা শ্রীমতি রাধাকে কল্পনা করেছে। সাহিত্য, লোক কথা, লোককল্প থেকেই রাধা এবং রাধাতত্ত্বের জন্ম। তাহলে দেখুন কল্পনা কতো গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী হতে পারে। আপনি যখন দৈনন্দিন বাঁচেন তখন কি কল্পনা আপনার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়, নাকি আপনার সঙ্গেই থাকে। আপনি কি করে জানেন যে আপনি যেখানে বাস করছেন সেটা সত্য,আপনি খাচ্ছেন এটা সত্য,ভাত খাচ্ছেন ওটা আসলে ভাতই,যাকে মা ডাকছেন সে আসলে আপনার মা,আপনি তো অনুমান কল্পনা করেই সত্য নির্ণয় করেন। কল্পনায় চলেন সারাক্ষণ। আমরা যখন বলি মানুষে মানুষে সমান, তখন সেই সাম্যের ধারণা তো কল্পনা করেই আমরা বলি। আসলে কি ধরুন, আমি আর আপনি কি সমান, কিন্তু এই সাম্যবোধ কলনাশক্তি ছাড়া আমরা অর্জন করতে পারতাম না। আমরা পরস্পরের সমান সেটা কল্পনা থেকেই বলি।
এখন বৈদিক অনুমান আর নদীয়ার অনুমান এবং অনুমান-জাত সিদ্ধান্তে ফারাক আছে। নদীয়া বেদ বিরোধী, শাস্ত্র বিরোধী, ইত্যাদি। কথাটা আরেকটু সিম্পলিফাই করে দিচ্ছি। আগে ফকির ও বৈষ্ণবদের মধ্যে পার্থক্যের জায়গাটা বলছিলাম। আপনি হয়তো আমাকে প্রশ্ন করতে পারতেন নদীয়ায় চৈতন্যদেব যদি এত ইম্পর্টেন্ট হবে তাহলে আমরা নিজেদের ‘ফকির’ কেন বলছি? এর অনেক কারন আছে। নদীয়া নিজেকে ফকির বলছে এই কারণে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী চিন্তা, বর্ণাশ্রম প্রথা বা জাতপাত বিরোধিতা ইত্যাদি ইসলাম থেকেই সুলতানী আমলে নদীয়া নিয়েছে। নদীয়ার আন্দোলন প্রথম থেকেই জাতপাত বিরোধী আন্দোলন ও সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন। ঐ দিকটা বাদ দিয়ে এখন একে যেভাবে হিন্দু ধর্মের অনুগত ও অধীনস্থ একটি ধর্মীয় ধারা হিশাবে ভাবা হয়, আদিতে চৈতন্যের আন্দোলন সেটা ছিল না। চৈতন্য নদিয়া স্মার্ট ব্রাম্মণদের কারণে নদীয়া ছেড়ে যেতে চেয়েছেন। এখন যে বৈষ্ণব ধর্মই তাকে সেভাবেই চৈতন্য গড়ে তুলতে চেয়েছেন কিনা সে বিষয়ে সেখানে তর্ক আছে। সেটা সহজও ছিল না। তবে পুরীতে পাণ্ডাদের দ্বারা চৈতন্যকে হত্যার পেছনে যে সকল কারণের কথা বলা হয় তাঁর মধ্যে একটি বড় কারন চৈতন্য বাংলার সুলতানদের মিত্র ছিলেন।
তাহলে নদীয়ার ভাবান্দোলনের একটা egalitarian বা সকল মানুষকে সমান ভাবা ও কল্যাণের একটা দিক আছে। এই দিকটার সঙ্গে ইসলামের যোগ আছে। কঠোর বর্ণাশ্রম শাসিত সমাজে সুলতানী আমলের অনুকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি না থাকত চৈতন্যের আন্দোলন নদীয়ায় সম্ভব হোত কিনা সন্দেহ। নদীয়ার ফকিরদের কাছে ইসলামের এই সকল ইতিবাচক দিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চৈতন্যের শিক্ষাকে তাঁরা হিন্দু বা ইসলাম কোন দিকেই নিতে চান নি। বরং ধর্ম নির্বিশেষে ‘মানুষ ভজনায়’ রূপ দিয়েছেন। ইসলামের ইগালেটারিয়ান বা সাম্য ও মর্যাদার দিকটা যেমন তারা গ্রহণ করেছেন, তেমনি মানুষের মহিমা কায়েমের দিকটাও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখন অন্যদিক থেকে দেখুন, লালনের যিনি গুরু ছিলেন সিরাজ সাঁই তিনি দরবেশ ছিলেন, সেই সময় দরবেশরা সারা ভারতবর্ষেই ছিলেন। বাংলাতেও ছিল। লালন কিন্তু নিজেকে দরবেশ বলছেন না। কোথাও বলেননি। কেন বলেন নি বলুন তো?
আ: এখানে কি গুরুর সাথে তাঁর কোনো ইন্টেলেকচুয়াল ডিফারেন্স তৈরি হচ্ছে?
ফ ম: না,না। বৃহত্তর ভাবের পরিমণ্ডলে সুফি, দরবেশ, বৈষ্ণব-বৌদ্ধ সহজিয়া এবং অন্যান্য ধারার সাধক পরস্পরের মিত্র। খেয়াল করবেন, এরা সকলেই যে এলাকায় গড়ে উঠেছেন সেই অঞ্চলের ভাষা, ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। এর ফলে পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে সেটা সামগ্রিক ভাবে বক্তি আন্দোলনের শক্তির দিক। তাদের আভ্যন্তরীণ – অর্থাৎ ভক্তি আন্দোলনের নিজস্ব মহলে তর্ক বিতর্ক আছে। লালন ‘ফকির’ বলতে জাতপাতবিরোধী যে ধারা গ্রহণ করেছেন তা একই সঙ্গে একত্ববাদী। একত্ববাদী ধারাকে তিনি গ্রহণ করছেন, তার পর্যালোচনাও করেছেন। অন্যাদিকে তন্ত্রের বিপরীতে রসতত্ত্বকেও ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ ও আত্মস্থ করেছেন। তাঁর উপর দীর্ঘ বৌদ্ধ সহজিয়া ঐতিহ্যের সারবস্তুও বাংলার ভাবুকতার মধ্যে হাজির। ফলে বাংলার ভাবান্দোলনের একটা চূড়ান্ত বিকাশ আমরা লালনে পাই, এবং পাশাপাশি ভাবচর্চার ইতিহাসের চিহ্নও তাঁর বিভিন্ন গানে শনাক্ত করা যায়। তিনি নিজের বেশ, কালাম ও চর্চাতেও সুফী ও বৈষ্ণব্দের থেকে পার্থক্য রচনা করছেন। এই জন্য তিনি নিজেকে ‘দরবেশ’ বলেন নি কিন্তু তাঁর গুরু দরবেশ।
সনাতন ধর্মের বিভিন্ন ধারার ভাব রয়েছে নদীয়ায়: ভক্তির ধারা বলুন,বেদ বলুন,উপনিষদ বলুন,গীতা বলুন এগুলোও গ্রহণ/বর্জনের মধ্য দিয়ে একটা স্বতন্ত্র রূপ নিয়ে নদীয়ায় দাঁড়িয়েছে। ইসলাম সেই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। মানুষের মধ্যে আল্লাহ বিরাজ করেন, একে লালন ইসলামের জায়গা থেকেই উপলব্ধি ও বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন করেছেন মানুষের মধ্যেই যদি খোদ আল্লাহ বিরাজ না করতেন বা এটাই যদি আল্লাহর ইচ্ছা না হোত তাহলে আল্লাহ ফেরেশতাদের আদমকে সেজদা দিতে বললেন কেন? কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে নদীয়ার ফকির নামে যা বর্তমান হয়েছে এবং ক্রমশ শক্তিশালী রূপ নিয়েছে তা বড় বাংলার নিজস্ব রূপ, যাকে সহজে চেনা যায়। বাংলা ভাষা ও ভাবের জগতে নদীয়ার ভাব একটা শক্তিশালী স্থান করে নিয়েছে।
নদীয়া তো ইতিহাস বিচ্যুত নয়,হঠাৎ করে আসেনি। তার একটা পরম্পরা আছে। নদীয়া অনেক বাংলা শব্দ ও ধারণা ব্যবহার করে যেটা সনাতন ধর্মের শব্দ। তারপরও নদীয়া কোন কৃষ্ণকে গ্রহণ করবে আর কোন কৃষ্ণকে করবে না এই সে সম্পর্কেও ভাবগত জায়গা থেকে পর্যালোচনা করেছে। নদীয়া খুব হুঁশিয়ার। আমি আর একটা দুটো লাইন বললে হয়তো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে:
‘অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণ নিধি তাঁর কি আছে কভু গোষ্ঠ খেলা?
ব্রহ্মরূপে সে অটলে বসে লীলাকারী তাঁর অংশ কলা ’
এটা গোষ্ঠলীলা সংক্রান্ত ফকির লালন শাহের একটি গান। এখান কৃষ্ণ মানে যার কোনো শুরু নেই বা শেষ নেই। লালন বলছেন এই সেই কৃষ্ণ যার কোন শুরু বা শেষ নাই, তার কি কোন ‘গোষ্ঠ লীলা’ আছে? – এই হচ্ছে নদীয়ার জিজ্ঞাসা। এই কৃষ্ণ ব্রহ্ম, যিনি অটল রূপে আছেন, আমরা তাঁর লীলার অংশগ্রহণকারী। যার কোনো শুরু বা শেষ নাই তিনি দেশকালে মানুষের মধ্য দিয়েই লীলা করে যাচ্ছেন।
সেই অনাদির আদি কি? তিনি ‘নিধি’ তিনি একটি ‘ধন’। আমাদের লীলা, জ্ঞান ও ভক্তির সম্পদ। এরপর ফকির লালন শাহ প্রশ্ন করছেন যদি তাই হয় তাহলে ‘তার কি আছে কভু গোষ্ঠ লীলা?’। গোষ্ঠলীলা মানে কম বয়সে শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ গোপাল তাঁর রাখাল বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন তার কথা বলা হচ্ছে। তো ফকির লালন বলছেন অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণ নিধি,তার কি করে গোষ্ঠ লীলা থাকতে পারে? তিনিতো অটল বিহারী। তিনি ব্রহ্ম, অটলে বসে আছেন। আমাদের ডাকাডাকি কিম্বা আমাদের উপলব্ধির বাইরে আমরা তার লীলার অংশ। তিনি আমাদের মধ্য দিয়ে মানুষ রূপেই লীলা করে যাচ্ছেন।
আ: তাহলে কি পুরানে আমরা যে কৃষ্ণের কথা পড়ছি তার থেকে একজন ভিন্ন কোনো কৃষ্ণের ধারণায় আমরা উপনীত হচ্ছি?
ফ ম: সে কোথায় পরে যাচ্ছি আর একটা লাইন বললে এটা পরিষ্কার হবে।
‘সত্যাসত্য সকল বেদ-আগমে কয়
সচ্চিদানন্দ রূপে পূর্ণ ব্রহ্ম হয়য়
জন্ম মৃত্যু তাঁর নাই ভবের পর
সেতো নয় স্বয়ং কভু নন্দ লালা।।
‘সত্যাসত্য সকল বেদাগমে কয়’- সমস্ত বেদ উপনিষদ ধর্মগ্রন্থ কি সত্য এবং কি অসত্য তাই নিয়েই কথা বলে। সকলেই সত্যর দাবি করে। নিজে সত্য কিন্তু অন্য ধর্ম মিথ্যা। পরের লাইনে আসছে ‘সচিদানন্দরূপে পূর্ণব্রহ্ম হয়’। সত্যের যে রূপ তার মধ্যে সৎ চিত্ত এবং আনন্দ একসাথে বর্তমান। ‘জন্ম মৃত্যু তার নাই ভবের পর’,অর্থাৎ এই যে কৃষ্ণ সচিদানন্দরূপে যিনি ব্রহ্ম এবং অটল -- তাঁর জন্ম মৃত্যু কিছু নেই। ‘সে তো নয় কভু নন্দলালা’ অর্থাৎ এই কৃষ্ণ যার জন্ম মৃত্যু নাই সেতো কখনোই নন্দের পুত্র কৃষ্ণ হতে পারে না।
অর্থাৎ নদীয়া যে কৃষ্ণকে ডাকে সে যেমন পুরাণের কৃষ্ণ তেমনি সে আবার পুরাণের কৃষ্ণ নয়। কারণ তার কোন জন্ম বা মৃত্যু নাই। আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন আমরা কি কল্পনাকে বাদ দিলাম? না কল্পনা তো মানুষের জীবনেই আছে তাকে বাদ দেবো কি করে? কল্পনা তো আমার কথা বলার একটা হাতিয়ার --গল্পের মাধ্যমে কথা বলা। এই যে কৃষ্ণের গল্প আমি আপনাকে বললাম আমি তো গল্প বলেই নতুন একটা চিন্তা আপনার মধ্যে প্রবেশ করালাম। কল্পনাতে সমস্যা নেই।
কল্পনা কেন গুরুত্বপূর্ণ তার আর একটা ব্যাখ্যা দেব তাহলে হয়তো নদীয়ার ফকিরি পরিষ্কার হবে। সেটা হল যে নদীয়ায় আমরা চৈতন্যকে ‘অবতার’ বলি। অবতারবাদ তো সনাতন ধর্মের বিষয়, তাহলে আমরা কেন বলি? অবতার বলতে তিনি আকাশ থেকে হাজির হয়েছেন এরকম অর্থে নয়। গল্প আকারে তিনি হাজির ছিলেন আমাদের কাছে, পুরাণের মাধ্যমে। কিন্তু কলিযুগে এসে তিনি চৈতন্য হয়ে ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। পার্থক্যটা কি বোঝানো গেল? পুরাণ থেকে অবতরণ করে মানুষের ইতিহাস হওয়া? এটা সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। অর্থাৎ কল্পনার দরকার আছে। আপনি যদি অবতার কল্পনা করতে না পারেন তাহলে তিনি অবতরণ করবেন কি করে? আপনি যদি সমাজতন্ত্র কল্পনা করতে না পারেন তাহলে সেই সমাজতন্ত্র কল্পনা থেকে বাস্তব ইতিহাস হবে কি করে? আসবে কি করে? আপনি যদি কমিউনিজম কল্পনা করতে না পারেন তাহলে কমিউনিজম আসবে কি করে? দেখা যাচ্ছে অবতারবাদ তো আধুনিক দর্শনেও আছে।
তাহলে কৃষ্ণ আগে পুরাণে ছিলেন সেখানে কিভাবে ছিল তার গল্পে লালন আশ্রয় করেছেন। তিনি শ্রীমতি রাধার কাছে যাচ্ছেন, তাকে প্রেমের মহাজন বলছেন। তাহলে এবার সরাসরি ব্যাখ্যা করতে হবে তাকে আবার মানুষের রূপ নিয়ে লীলা করতে আসতে হল কেন? হোল এই কারণে যে তখন তিনি শ্রীরাধিকার সঙ্গে ছেলে হয়ে প্রেম করেছিলেন পুরুষ হিসাবে। ফলে শ্রীরাধিকার হৃদয়ে যে প্রেমের উদ্ভাস হয়েছিল সেই রস তিনি আস্বাদন করতে পারেন নি। যদি নাই করতে পারেন তাহলে তিনি কিভাবে ভগবান হন? একজন মানুষের অভিজ্ঞতা আর একজন মানুষের মতো হবে না এ কথা সত্য কিন্তু যিনি ভগবান তিনি তো সব কিছুর অধিকারী, সকল অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। তাহলে রাধার প্রেম হর্ষের অভিজ্ঞতা যদি তাঁর না থাকে কৃষ্ণ কি করে ভগবান হলেন? কৃষ্ণ ভগবান হবেন এইভাবে, যদি তিনি তাঁর এই অভাব পূরণ করতে পারেন। এবার তিনি পুরাণের কৃষ্ণ হিসাবে আসবেন না আসবেন ইতিহাসের কৃষ্ণ হিসাবে। তিনি নদীয়ায় আমাদের শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
অর্থাৎ পুরাণে আমরা যা যা ভেবেছি ভালো ভালো কথা বলেছি, ভালো কল্পনা করেছি -- সেটা যে বাস্তবে করা পসিবল সেটা কৃষ্ণ আবার গৌরাঙ্গি হয়ে জন্মগ্রহণ করে দেখালেন। এই কারণেই আমরা বলি গৌরাঙ্গ আমাদের অবতার। এই কারণে আমরা ‘গৌর পূর্ণিমা’ পালন করি। গৌর পূর্ণিমায় ফকির লালন গৌরের অবতরণ মূহূর্ত স্মরণ করে যে সাধুসঙ্গ শুরু করেছিলেন আমরা তাকে উদযাপন করি। গৌরাঙ্গের জন্মতিথি অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমাকেই আমরা বলি গৌরপূর্ণিমা,সেদিন নদীয়ায় – ছেঁউড়িয়ায় বড় অনুষ্ঠান হয়।
আ: আপনার কথায় আধুনিকতার অনেক প্রসঙ্গ উঠে আসছে যেমন ফেমিনিজম, ইকোলজির কথা এই প্রসঙ্গেই জিজ্ঞেস করব মানবতাবাদের কথা,সেই ধারণা কি আপনাদের ভাবের সঙ্গে সঙ্গত।
ফ ম: নদীয়ায় ফকির ‘নিহেতু প্রেম’ – অর্থাৎ কোন কারণ বা স্বার্থ ছাড়া প্রেমের কথা বলে। এটা তারা নদীয়ার ‘তিন পাগল’ থেকেই নিয়েছে। অপরকে ভালবাসতে হবে কোন ‘হেতু’ বা কারণ ছাড়া,অর্থাৎ অপরকে ভালবাসা থেকে কিছু পাবার আশা করা যাবে না। কোন স্বার্থ থাকতে পারবে না। ঠিক তেমনি একথাও বলা যাবে না যে আমি আল্লাহকে ভালবাসব যদি তিনি আমাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন, কিম্বা যদি আমাকে বেহেশতে দাখিল করেন। আশেক-মাশুকের সম্পর্ক থেকে কোন কিছুই পাবার নাই। পাবার আশায় নয়,ভালবাসবার জন্যই ভালবাসা। প্রেমের এই ধারণা একদিকে নদীয়ার নিজস্ব, অন্যদিকে এর দিব্য বা রুহানি প্রণোদনা ইসলাম থেকে পাওয়া। নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের ধারণা থেকে তৈরি।
অনেকে একে ‘মানবতাবাদ’ বলে ভূল করে। বিমূর্ত মানবতাবাদ বা বুর্জোয়া মানবতাবাদে নদীয়া আগ্রহী না। ‘মানবতাবাদ’ বহু ব্যবহারে খুবই জীর্ণ একটি শব্দ। মূল কথা হচ্ছে যে ‘অপর’-কে ভালবাসবার কোন কারণ নাই, আপনি তাকে ভালবাসতে পারছেন না। ‘মানবতা’, ‘মানবতাবাদ’ বিমূর্ত মানুষের এক ধরণের সত্তা অনুমান করে, দর্শনে যাকে এসেনশিয়ালাইজেশান বা চিরায়তকরণ বলা হয়। ‘মানুষ’ বা ‘মানব’ সম্পর্কে কোন চিরায়ত সত্তা নদীয়া তাই অনুমান করে না। মানুষের মধ্যে ভালমন্দ আছে, মানুষের মধ্যে জীবের স্বভাব আছে। জীব পরমার্থ লাভ করতে পারে নিজের সঙ্গে নিজের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। মানুষ দিব্যসত্তা, ফলে তাঁর সম্ভাবনা অনন্ত।
মানবতাবাদ বিমূর্ত ‘মানব’-কে অনুমান করে, রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষকে না। মানবতাবাদ বুর্জোয়া চিন্তা চেতনা বহন করে। ফকিরদের ‘মানুষ ভজনা’ কিন্তু মানবতার কথা নয়। মানুষ ভজনা মানে রক্তমাংসের মানুষ ভজনা। যে মানুষ সশরীরে বর্তমান। ফকিরদের মধ্যে বুর্জোয়া মানবতাবাদ আবিষ্কার করা বুর্জোয়া সমাজে খুবই স্বাভাবিক। কিছু গবেষকদের দ্বারাও সেটা তৈরি হয়েছে। তারা এখানকার দর্শন,ভাব ও চিন্তার কথা আলোচনা করতে গিয়ে তাকে গ্রিক-খ্রিস্টিয় চিন্তা বা তথাকথিত পাশ্চাত্য চিন্তার মোড়কে ঢুকিয়ে ফেলে। দুই দিকের চিন্তার মধ্যে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু পাশ্চাত্যের চিন্তার মোড়কেই আমাদের চিন্তাকে পরিবেশন করা সঠিক নয়। নদীয়ার ফকির অবশ্যই মানুষের সেবা করে, সমাজের জন্য তারা ত্যাগী হয়। কিন্তু ‘মানবতাবাদ’ ফকিরি চিন্তার সঙ্গে মেলে না। তার মানে নদীয়া ‘মানবতাবাদী’ নয় সেটাও ঠিক নয়, কিন্তু নদীয়ার মানবতাবাদের ভিত্তি নিশর্ত প্রেমের মধ্যে। সেটা অপরের প্রতি নিহেতু প্রেমের কারনেই। ‘মানবতাবাদ’-এর পর্যালোচনা বা আপত্তিটা দর্শনের জায়গা থেকে করা। অনেকে সুফিদের ‘বেশরা’ বলছেন আমরা তো কখনো সেটা বলি না। এটা এক ধরনের মুসলিম বিদ্বেষী সম্প্রদায়িকতা। চিন্তার খাত ভুল দিকে বইছে।
মানবতাবাদ একটি বুর্জোয়া ধারণা হিশাবে পাকাপোক্ত হয়েছে ফরাসি বিপ্লবের পরে। একে বলে এসেনশিয়ালিজম অর্থাৎ মানুষের সত্তাকে এসেনশিয়াল করে তোলা। এসেনশিয়াল করাটা এসেছে ক্রিস্টিয়ানিটি থেকে,তার একটা ফিলোসফিকাল দিক আছে। কারণ প্যাগান বনাম ক্রিশ্চিয়ান যে পার্থক্য হয়,ক্রিস্টিয়ানরা হল সভ্য আর প্যাগানরা অসভ্য- এটা ক্রিস্টিয়াণ ভেদ বিচার থেকে এর উৎপত্তি। এখান থেকে যখন পরবর্তীকালে ক্রিস্টিয়ানিটিতে বুর্জোয়া রিভলিউশন হল,তখন কে মানবিক আর কে অমানবিক এই ভাবে ভাগ করা হোল,একই জিনিস প্যাগান বনাম ক্রিস্টিয়ানিটি থেকেই আধুনিককালে মানবতা বনাম অমানবিকতা এসেছে। এর মধ্য দিয়ে সভ্য বনাম বর্বর – এই বাইনারিও চালু রয়েছে।
আ: কলোনিয়ালিজমের জন্য কি এটা আমাদের দেশে এতটা প্রভাব বিস্তার করল?
ফ ম: ডেফিনেটলি। একদম ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু আর একটা কারণ, আমাদের আনক্রিটিক্যাল থাকা। কলোনিয়ালিজম তো বহুদিন চলে গেছে। এতদিনে তো আমাদের অনেক এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমরা গেলাম না কেন? ধরুন আমাদের স্কুলে কৃষ্ণদাস কবিরাজ পড়ায় না কেন? তাহলে তো চিন্তায় এই দুর্দশা আসত না। আমরা গর্ব করতাম কারণ আমাদের ভাষাতেই তো ভালো ভালো জিনিস আছে,শুধুমাত্র পাশ্চাত্য নিয়ে মেতে থাকতাম না। প্রতিটি বিখ্যাত দার্শনিক বা পাশ্চাত্য দর্শনকেই মোকাবিলা করার রসদ আছে আমাদের ভাষার কাছে। লেনাদেনা হোত। এখন শুধুই দেনা। পাশ্চাত্যকে আমরা অনুকরণ কেন করব? বরং পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমাদের কথোপকথন হবে। আলাপ আলোচনা হবে। লেনা দেনা হোক। পাশ্চাত্যের দ্বারা আমরা অনর্থক প্রভাবিত হব কেন? তার শব্দ পরিভাষা নির্বিচারে নেব কেন?
আজকে দেখুন, বৈষ্ণব দর্শনের মধ্যে ‘আস্বাদন’ একটা খুবই সুন্দর শব্দ। দর্শনের দিক থেকেও সুন্দর ও চ্যালেঞ্জিং ধারণা। তার কোনো আলোচনা আপনি কোথাও পাবেন না। লালনের একটা গান আছে: ‘জাত গেল জাত গেল বলে’, এই গানে একটি লাইন আছে, ‘ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি সকলি এক জলে সূচি’। কিন্তু গাওয়া হয় ‘ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি এক জলে সব হয় গো শুচি’। এখন এই ‘শুচি’টা কি? মানুষতো অশুচি না। মানুষকে অশুচি বা অপবিত্র তো ব্রাহ্মণ্যবাদ করে। শূদ্র বা নিম্ন বর্ণের মানুষ ‘অশুচি’। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মৃত্যুর পরে ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে গানটিকে গুলিয়ে ফেলে কিন্তু লালন তার গানে শুচি/পবিত্র ধরনের রিচুয়ালের রেফারেন্স দেবেন কেন যিনি সারাজীবন যার বিরোধিতা করেন ? এখানে শুচির আসল বানানটা হল ‘সূচি’,অর্থাৎ সূচনা। তাহলে লালন বলছেন যে ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি সকলের সূচনা হয়েছে একই জল থেকে অর্থাৎ সকলের উৎপত্তি হয়েছে জল থেকে। নারী পুরুষের জল থেকেই তারা সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকেই যদি সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে কেন ভেদাভেদ থাকবে? এটা কি মানবতাবাদ? এটা একেবারেই মানবতাবাদ নয়। বরং আরো গভীর বিষয। প্রকৃতির যে লীলা রজোবীজে তার যে অভিপ্রকাশ তাকে নতুন করে বোঝার চেষ্টা। রজোবীজের মধ্যেই সকল মানুষ জন্মাচ্ছে। মানুষ এগিয়ে চলেছে। ধারা বয়ে চলেছে। তাহলে সেই মানুষের ভজনাই লালন করতে বলেছেন। মানবতাবাদের কথা বলেননি কোথাও।
আ: পঞ্চদশ শতাব্দীতে ছাপাখানা আবিষ্কার হয়েছে,সেখান থেকে আজ মুদ্রণ শিল্প অনেক উন্নতি করেছে তবুও কিভাবে আপনাদের সাধনায় ওরাল ট্র্যাডিশন এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকায় রয়ে গেল?
ফ ম: ওরাল ট্র্যাডিশন অর্থাৎ শ্রুতি এবং কন্ঠ। এই জগতটা হল প্রত্যক্ষ একটা জগত যাকে খুব সহজেই আমরা হাজির বুঝতে পারি। এইজন্য আমরা বলি, আমরা মানুষ ভজনা করি আমরা বই পূজা করি না। আমরা গুরু পরম্পরায় বিশ্বাস করি অর্থাৎ গুরুকে মানি। কেন গুরুকে মানি? কারণ ভাষা অনেক রকম অর্থ তৈরি করে। একই কথা অনেক সময় বহু অর্থ তৈরি করে। ধরুন আমি একটা বই লিখতাম আর আপনি সেটা পড়তেন তাহলে আমি যা মানে করতে চেয়েছি, আপনি কি সেটাই বুঝবেন নাকি আপনি নিজের মতো একটা অর্থে বুঝবেন। আবার আমায় যদি প্রশ্ন করতেন আমি একটা ভিন্ন অর্থ করতাম। গ্রন্থ নিজের ব্যাখ্যা নিজে করে না, আমরা যার যার মতো বইয়ের ব্যাখ্যা করি।
তাই আমরা বইবিরোধী, আমরা বই পছন্দ করি না। তার মানে আমরা বই পড়ব না বা বই বাদ দেব তা না। নদীয়া জীবন্ত মানুষকে বই দিয়ে আড়াল করবার বিরোধী। এই অর্থে নদীয়া বেদ, গ্রন্থ ও শাস্ত্রবিরোধী। বেদ বা শাস্ত্র বিরোধী মানে এই নয় ব্রাহ্মণরা গীতা উপনিষদে যা বলছে সব মিথ্যে বা কোরআন শরীফে যা লেখা আছে সব মিথ্যা এটা বলে যারা নাস্তিক্যবাদী তারা। এটা লালন বলেন না। লালন বলেন যারাই একটা চিরায়ত সত্যের দাবী করে, শাস্ত্র, গ্রন্থ বা কেতাবের দোহাই দিয়ে এবং সেই দাবির দ্বারা জীবন্ত মানুষকে অস্বীকার করে, নদীয়া সেই দাবি গ্রহণ করে না। জীবন্ত মানুষ কেন? আপনি যখন একটা বই পড়ছেন তখন বইয়ের ব্যাখ্যা কে দেয়? আপনি নিজেই তার ব্যাখ্যা করেন। বই তো আর নিজে ব্যাখ্যা করতে পারেনা। অর্থাৎ একজন জীবন্ত মানুষই ব্যাখ্যা করতে পারে। এই জন্য নদীয়া মানুষ ভজনা করে, বই ভজনা বা বই পূজা করে না। বই পড়ে বটে, কিন্তু যে পড়ে, কিম্বা যিনি ব্যাখ্যা করেন সেই জীবন্ত মানুষটিকে ভজনা করেন। যখনই আপনি বইয়ের পথ ধরে যাবেন তখনই অনেক অর্থের মধ্যে হারিয়ে যাবেন। মহাভারতের অনেক রকম অর্থ হয় তত্ত্ব হয়। ফলে একেক অর্থ থেকে একেক গোষ্ঠির জন্ম হয়, ইসলামেও সেই একই ব্যাপার। আমরা যখন যা ব্যাখ্যা করি তা মানুষেরই ব্যাখ্যা, তখন কথোপকথনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। কেতাব বা শাস্ত্রের ভিত্তিতে সত্যের দাবি নদীয়া পরিহার করার চেষ্টা করে।
এই যে আমি আপনাকে চিনি না শুধু আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনি জ্যান্ত মানুষ, আপনি আমার কথা শুনতে চান। এটা সৌভাগ্য। কিন্তু সর্বোপরি এটা সামাজিকতা এবং এটাই মানুষ ভজনার কাজ। এটাই সম্পর্ক তৈরি করে, বন্ধুত্ব ও সমাজ তৈরির সম্ভাবনা বাড়ায়। সে কারনেই সাড়া দিয়েছি।
আ: সুফিদের সঙ্গে আপনাদের সাধন পদ্ধতিতে পার্থক্য নাকি চিন্তা জগতেও পার্থক্য?
ফ ম: দুটো আলাদা। সাধন পদ্ধতি তো সম্পূর্ণই আলাদা। সে কথায় পরে আসব,সাধন পদ্ধতি তো নদীয়ার পাঁচ ঘরেরই আলাদা। একই গুরুর শিষ্যদের মধ্যেও প্র্যাকটিস আলাদা হতে পারে তাতে কোনো সমস্যা নেই। প্রত্যেকের গুরু শিষ্য যেমন লায়েক তেমন মন্ত্রই দেন। তাকে তার মতো করে মন্ত্র দেওয়া হয়। কে কতোটা লায়েক তার ভিত্তিতে। আমার গুরু আমাকে মন্ত্র দিয়েছেন। সেটা আমার ব্যাপার। গুরু যে কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন আমি সেই গুরু কর্তব্যই পালন করি। আপনার সাথে কথা বলা মানে আমার গুরুআজ্ঞা পালন করা, হয়তো দেখবেন আমার কোনো গুরু ভাই এই নিয়ে কোনো কথা বলছে না। কারণ গুরু তাকে যে আজ্ঞা দিয়েছেন, তিনি তা করছেন। ।
প্রথম কথা সুফি এবং ফকিরি দুটি এক নয় সম্পূর্ণ আলাদা ধারা। তারা কিন্তু আমাদের মিত্র। কিন্তু সুফিরা আমাদের গদীমান্য নন। আমাদের গুরু যদি নিত্যানন্দ হয়,আমাদের প্রথম ফকির যদি শ্রীচৈতন্য হয় সেটা কি সুফিরা গ্রহণ করবে? করবে না। তাহলে পার্থক্য হয়ে গেল ট্র্যাডিশনে। তারা তাদের পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে ভক্তিবাদের চর্চা করছে আমরা তাকে সালাম জানাই। কিন্তু আমরা চাইনা তারা আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে বাংলার স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করুক। লেনাদেনা হোক। আপনাদের ওখানে এই ধারা আছে, যেমন চিশতিয়া ধারা। আপনি যদি চিশতিয়া ধারা দিয়ে নদীয়াকে চাপা দেন বলেন লালন ফকির সুফি তাহলে তো আপনি লালন ফকিরকে অস্বীকার করছেন। তাহলে আপনি কৃষ্ণদাস কবিরাজ থেকে শুরু করে শ্রীরাধিকার যে একটা ভাব কল্পনা করা হয়েছে তার যে সংস্কৃতি দর্শন চিন্তার জগত রয়েছে তাকে আপনি মাঠে মেরে ফেলতে চাইছেন। আমরা তো এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবই। কিন্তু তাঁর মানে এই নয় যে সুফি, বৈষ্ণবদের আমরা ভালবাসব না, তাঁদের কাছ থেকে কিছু আমরা নেব না। অবশ্যই নেব, কিন্তু ঘর ছেড়ে দিয়ে নদীয়া তা করতে চায় না। লালনের গানের মধ্যে যেহেতু আরবি ফারসি শব্দ আছে তর জন্য অনেকে একে সুফিদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন কিন্তু এরকম কোনো ব্যাপার নেই। এটা হল এক নম্বর।
দ্বিতীয়ত অনুমানগত বা দার্শনিকভাবেও আমরা আলাদা। নদীয়া মনে করে সুফিরা একত্ববাদী নয়। সুফিরা বলেন, আল্লাহ আছে মানুষও আছে। তারপর ফানাফিল্লাহ হয় জিকিরের মাধ্যমে। তাদের প্রথম অনুমানই হলো আল্লাহ ও মানুষ দুইজন আছে। দুটো সত্তা বিভক্ত হয়ে আছে,নদীয়া এটা মনে করেনা। আল্লাহ এক এবং তিনি মানুষের মধ্য দিয়েই বর্তমান বা হাজির থাকতে পারেন। মানুষই তাঁর আবাস।
আ: তাহলে নদীয়ার সাধনার অবজেক্টটা কোথায়? সে পৌঁছাতে চায় কোথায়?
ফ ম: সেটা একটা অন্য বিষয়,আমরা বলি নিজেকে যত্ন করা। যত্ন কেন? আপনার শরীরের যেমন যত্ন দরকার, তেমনি মনেরও যত্ন জরুরী। যে বিষয়টায় এখন আমরা ঢুকে যাচ্ছি সেখানে ঢুকতে গেলে প্রথমে প্রশ্ন আসে এখানে পৌঁছানোর জন্য আপনি নিজেঢ় মনের যত্নাত্তি করে যোগ্য করে তুলেছেন কি? আপনি কি নিজেকে ্নিজে ‘যত্ন’ করে বড় ও মহৎ কাজের যোগ্য করতে পারবেন? হ্যাঁ পারবেন। তার জন্য আপনাকে গুরু ধরতে হবে এরকম কোনো বিষয় নেই। যদি ধরেন তো ভালো কিন্তু সেটা একটা আচরণ ও সাংস্কৃতিক দিক। এই যে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন তার কিছু প্রভাব কি আপনার ওপর পড়বে না? নিশ্চয়ই পড়বে অর্থাৎ আপনি গুরু পরম্পরার সূত্র পেয়ে যাবেন। কিন্তু আপনাকে যদি কেউ বলে কারো পায়ে ধরতে হবে, ধরে গুরু সেবা করতে হবে আপনি তো যাবেন না। এই জন্য সাধুসঙ্গ ইম্পরট্যান্ট। এই যে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলছি,এই কথোপকথন আপনার মধ্যে সেই প্রণোদনা জাগাতে পাড়ে। এটা হাজারো গুরুসঙ্গ সাধুসঙ্গ থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে আমাদের লক্ষ্য মানুষকে তার নিজের মহিমা নিজে উপলব্ধি করতে সহায়তা করা।
কিন্তু যারা সেই তথাকথিত প্রথাগত চর্চা হিশাবে গুরু পরম্পরায় দীক্ষিত হচ্ছে – তাঁরা জেনে বা নাজেনে আরেকটি ধর্ম সম্প্রদায় তৈরি করছে -- তাদের তো খারাপ বলবো না। যারা নাম আশ্রয় করে বৈষ্ণবদের মতো গোঁসাইয়ের পদসেবা করে সঠিক পথে গেছেন তারাও ভালো। তাতে ক্ষতি তো কিছু নেই কিন্তু আমরা বলব এতে প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, ফও ভিন্ন হবে। কারণ সহজ বৃত্তির দ্বারা বা মনের মাধুর্য দ্বারা কেউ হয়তো ভগবানকে পাবে। একা নির্জন সাধনার যে যেমন ভগবানকে চায় সেই ভগবান পাবে। কিন্তু প্রজ্ঞা, বুদ্ধি বা ভাবের দ্বারা পাবে না। নদীয়া এই প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও ভাবের দ্বারা আল্লাহকে পেতে আগ্রহী, যেন দেশকাল্পাত্রে মানুষের পক্ষে যা অর্জন সম্ভব, তাকে ‘বর্তমান’ করে তোলা যায়। সে কারণে নদীয়ার ভাব রাজনীতি থেকে আলাদা কোন ইন্ট্রোভার্ট সাধনা না। তাঁর দ্বারা ঈশ্বরকে ‘বর্তমান’ করে তোলা যায় না। কারন বুদ্ধি, প্রজ্ঞা বা ভাবচর্চার দ্বারা যদি আপনি আল্লাহকে না পান তাহলে কিন্তু আপনি জগৎ বদলাতে পারবেন না। তাই ভাবচর্চার সাধনায় আমি যে উপলব্ধি করলাম তা তো আপনাকে বোঝাতে হবে এবং বোঝাতে গেলে তো বুদ্ধির প্রয়োজন। আমরা দুজনে দুই ভিন্ন জগতে বাস করছি এর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে গেলে বুদ্ধির তো দরকার। সাধনার যে অন্তর্মুখীন ধারাটা যা আধুনিকতার হাতে পরাস্ত হয়ে একটা বিকৃত ইন্ট্রোভার্ট রূপ ধারণ করেছে তাকে পরিবর্তন করাই এখন আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এ ছাড়া ভক্তি আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এটা রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা খুবই দরকার যে ভক্তি আন্দোলন বড় বাংলার অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-দার্শনিক ধারা,যার দ্বারা আমাদের এখনকার সমাজের অনেক সমস্যার আমরা মীমাংসা করতে পারি। এই সকল সমস্যার মধ্যে প্রধান সমস্যা হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং নানান প্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। কিভাবে তার সমাধান হতে পারে? গীতা আমাদের ধর্মগ্রন্থ, কোরআন শরীফ আমাদের ধর্মগ্রন্থ, বাইবেল, পুরাণ সবই আমাদের এই ভূগোলের মানুষের ধর্মগ্রন্থ। কিন্তু শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ নিজের ব্যাখ্যা নিজে দেয় না, তাহলে যদি আমরা সজীব ও সক্রিয় মানুষের ভজনা করি এবং মানুষের গুরুত্ব বুঝি তাহলে আমাদের ব্যখ্যা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে – ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মগ্রন্থের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যার যার জায়গা থকে মানুষের স্বরূপই উন্মোচন করব। ধর্মের কারবার মানুষ নিয়ে। সেই মানুষই নিজের স্বরূপ নিয়ে হাজির হতে পারবে, যা আমাদের সকলের মধ্যেই হাজির রয়েছে। আমাদের পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও একটা সাধারণ সূত্র বা ভাবের মাধুর্য দ্বারা আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গনে বাঁধতে সক্ষম হতে পারি। এই যে শুরুতেই ‘বড় বাংলা’ বলে একটা কথা বললাম এই যে একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল যেখানে সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে তাঁর মধ্যে এই মাধুর্যের বিকাশ ঘটাতে হবে একে কাজে লাগাতে হবে।
এই মানুষে হবে মাধুর্য্য ভজন
তাইতে মানবরূপ গঠলেন নিরঞ্জন।
এবার ঠকিলে আর না দেখি কিনার
অধীন লালন কয় কাতর ভাবে।।
আ: আপনাদের সাধন পথের সঙ্গে কি মারফতি সাধনার সম্পর্ক আছে?
ফ ম: আমরা শরীয়ত মারফত ভাগ করি না। এগুলো করতে গেলে একটা পলিটিক্যাল পজিশন তৈরি হয়ে যায়। সেটা ভুল পজিশন বা ভুল পথ বলে মনে করি। মানুষ বিভ্রান্ত হয়। প্রেম তো আইন মেনে চলে না। বিদ্যমান আইনী ব্যবস্থাকে প্রেম সবস্ময়ই অতিক্রম করতে চায়। বিভাজন ভাঙে, যাকে কোলে নেবার কথা না, তাকেও কোলে তুলে নেয়, পতিতকে আশ্রয় দেয়। এই মারফতি সাধনার কথা বলতে গিয়ে সেই পথের লোকেরা যে শরিয়া বিরোধী কথাবার্তা বলেন তা আমাদের সমাজকে কোথাও এগিয়ে নিয়ে যায় না বরং সমাজের ক্ষতি করে। সুফি বা মারফতি ধারা বিশেষ ভাবে শিয়া তরিকা থেকে বিকশিত হয়েছে। ধরুন, আপনি বললেন আমি মার্কসবাদ মানি কিন্তু শরিয়া মানি না। ধর্ম মানি না। তাহলে কি করবেন? আপনি চিশ্তিয়া তরিকার সুফি হবেন, সেটা ভাল। কিন্তু বিশ্বে সুন্নিদের তো সংখ্যা বেশি। আপনি ওদের উপর এত রাগ করলেন কেন? ওদের কি সত্যিই কোনো অবদান নেই? রসুল যখন মক্কা বিজয় করেছেন তখন তো পলিটিকালি মক্কা জয় করেছেন। তিনি তো তখন জাত পাত গোত্রবাদ কুরেশদের যা যা খারাপ তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সেটা শুধু ধর্ম তো ছিল না, যে অর্থে আমরা এখন ধর্ম বুঝি। সেটা ছিল সম্পূর্ণ পলিটিকাল বা রাজনোইতিক বিজয়। তো মারেফাত করতে গিয়ে আপনি রাজনোইতিকতা বা জগত বদলে দেবার কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্তর্মুখিন ও সমাজ বিচ্ছিন্ন হবেন কেন? চৈতন্য তো জাতপাত বিরোধী লড়াই করেছেন, তিনি কি শুধু হরে কৃষ্ণ কীর্তন করেছেন? আপনি যদি ইসলামের পলিটিক্যাল দিক বাদ দেন তাহলে তো তখন আর সেটা ইসলাম থাকে না। ইসলামের তো সব থেকে ভালো দিকই হল তার পলিটিক্যাল দিক। সেই ইসলাম তো ইনসাফের কথা বলে। লালনের গানের মধ্যে শরীয়াত বিরোধী কথাবার্তা নাই। তিনি বলছেন, নবীর কাছে যা চাইবেন, তিনি তাই দেবেন, তবে ‘গুপ্ত পথ মেলে ভক্তির সন্ধানে’ – এতোটুকুই। যে প্রজ্ঞা এখনও দেশকালে দৃশ্যমান হয় নি। যা ‘বর্তমান’ সম্ভব তার রূপ যখন মানুষের কাছে অস্পষ্ট -- অনাগত ভবিষ্যত মানুষের জন্য যেখানে অপেক্ষা করছে -- সেটা সাধনার জগতে পাওয়া যাবে, সেটা আমাদের যার যার সাধনার প্রাপ্তি। নবী তার চারজন শিষ্যকে চার রকম দীক্ষা দিয়েছেন। তারা চারজন তো নবী নন। তারপর লালন বলছেন ‘নবী বিনে পথে গোল হল চারমতে, ফকির লালন বলে যেন গোলে পড়িস নে’।
আমরা যেন গোলে না পড়ি এটাই নদীয়ার ফকিররা চায়। নবী যখন নেই তখন হানাহানি খুনাখুনি হয়েছে। চারজন খলিফার মধ্যে তিনজনকেই হত্যা করা হয়েছিল। তার মধ্যে একজনের লাশই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই সকল ঐতিহাসিক কারনেই লালন বলছেন ‘ফকির লালন বলে যেন গোলে পড়িস নে’। অর্থাৎ ঝামেলায় জড়িও না। কথা বল, কথা বলে সমস্যার সমাধান কর। নিজেকে খোঁজ, নিজের মধ্যে ডুবতে শেখ, মানুষ ভজনা কর, পথ পেয়ে যাবে।
ধরুন কেউ ভক্তির ধারায় আছে, ভাল। কিন্তু যারা ভক্তির ধারায় নাই তারা খারাপ তা তো নয়। আবার ভক্তির ধারাই ধরুন সেখানেও রকমফের আছে ঠাকুর রামকৃষ্ণ তো ভক্তির ধারারই মানুষ। কিন্তু ঠাকুর রামকৃষ্ণ তো বাউলদের পছন্দ করতেন না, তাই বলে কি আমরা বাংলার ভক্তির ধারা থেকে রামকৃষ্ণকে বাদ দেব? আমি রামকৃষ্ণ কে গালি দেব তা তো নয়।
আ: প্র্যাক্টিসগতভাবে যদি আলাদা করি তাহলে বলা হয় সহজিয়ারা মূলত রজোবীজের সাধনা করেন আর লালনের ঘর ভাবের সাধনা করে কিন্তু লালনের গানের মধ্যে রজোবীজের সাধনার যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই দিকটা নিয়ে যদি একটু বলেন।
ফ ম: বলতে গেলে একটু ইতিহাসে যেতে হবে। চৈতন্য যখন এসেছিলেন তখন তিনি প্রথম রাজনৈতিক ও ভাবগত ভাবে যে ধারার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন সেটা ছিল তান্ত্রিক ধারা। কারণ তান্ত্রিক ব্যভিচারটা খুব খারাপ একটা জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল তখন। ব্যভিচার থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বলেই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে কোনো নারী ছিলেন না। তিনি শ্রীরাধিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। রাধিকাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি রক্তমাংসের নারীকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বলতেন, তিনি নির্ঘাৎ ব্যর্থ হতেন। সেই সময়ের ব্যভিচারে সেটা কন্ট্রিবিউট করতো । এই জন্য তিনি সেই কাজ করেন নি। এর জন্য চৈতন্যের আপনি সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু নদীয়ার মনে করে তিনি ঠিক কাজ করেছেন। কিন্তু তাঁর মানে তিনি নারী বা প্রকৃতিকে ধর্মের বাইরে রাখতে চেয়েছেন তাতো নয়। বরং উল্টাটাই করেছেন। তিনি বলেছেন আমি ‘অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ বহিরঙ্গে রাধা’। তিনি নিজেই বহিরঙ্গে ‘রাধা’ হয়েছেন। রাধা ভাবে উপাসনা করেছেন। বলেছেন আমি দুই, আমই একসঙ্গে রাধা এবং কৃষ্ণ। তিনি বলতেন, আমই তো রক নই, আমিই তো ‘যুগল’। বহিরঙ্গে রাধা হওয়া তাঁর মানে নদীয়ায় নারী হওয়ার সাধনা করা। ফকির মানেই মেয়ে। তাই গুরুকে ভক্তি দিতে হলে ঘোমটা দিতে হয়। গুরুকে যার প্রতীক গণ্য করে ভক্তি দেওয়া হয় জগতে তিনিইএকমাত্র পুরুষ, আর আমরা সবাই মেয়ে।
তন্ত্র কিন্তু বাংলার অত্যন্ত ইম্পরট্যান্ট একটা ধারা কিন্তু চৈতন্য কেন তন্ত্রের বিরোধিতা করেছিলেন কারণ সমাজে তখন একটা বিকৃতির জায়গায় চলে গিয়েছিল। এখানে আপনি হয়তো বা বলবেন যে তার কি তাহলে কোনো নারী শিষ্য ছিল না? কিন্তু সহজিয়ারা বলবেন, সেটাও ঠিক না, তিনি নারীসঙ্গ করেছেন। কার সাথে করেছেন? সার্বভৌম পন্ডিতের একজন কন্যা ছিলেন তার সাথে। সহজিয়ারা এই চর্চাটা বৌদ্ধতন্ত্র থেকে পেয়েছে। এই চর্চাটা তারা খারাপভাবে প্রয়োগ করেনি। সহজিয়াদের মধ্যে অনেক ঘর আছে নদীয়া একমাত্র সরস্বতী মার ঘরকে স্বীকার করে, কারণ সেখানে ব্যভিচারের সুযোগ ছিল না। সরস্বতীর ঘরের যেসব করণ কর্ম সেসব লালনের ঘরেও আছে, নদীয়ার ফকিররা সেগুলিকে স্বীকার করেন। সতী মার ঘর নদীয়ায় গদি মান্য।
নদীয়ার পাঁচ ঘরের মধ্যে অনেকে মনে করেন সহজিয়াদের করণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে লালনের একটি গান আছে: ‘ভাব দিয়ে ভাব দিলে পরে তবেই রাঙাচরণ পায়’,আপনি যদি মনে করেন আপনার মধ্যে ভাব নেই,তাহলে পুরা পথে আপনি ব্যভিচারের মধ্যে পড়ে যাবেন। সেটা হচ্ছে না তা নয়, অবশ্যই বাউল্গিরির নামে নারীকে ব্যভার করা হয়য়, নদীয়া তাঁর ঘোর বিরোধী। আজকের সমাজ যেখানে নারীকে একটা কমোডিটির মতো দেখা হয়,সেখানে এগুলিকেই বাউলদের তত্ত্ব বলে সমাজের ব্যভিচার জাস্টিফাই করার চেষ্টা করা হয়। এইসব তো সমস্যা।কিন্তু সমস্যা তো থাকবেই।
তাই নদীয়ার ফকিররা, ‘ভাব দিয়ে ভাব নিলে পরে তবেই রাঙা চরণ পায়’ – লালনের এই কথাটার ওপর জোর দিয়ে থাকেন। আমরা বিশ্বাস করি বড় বাংলায় এখন ভাবের বিকাশ ঘটানোটাই জরুরী। গুহ্য ক্রিয়াদির নামে যে সকল কাজকে গ্লোরিফাই করা হয় তা লালনকে বোঝার ক্ষেত্রে বিশাল একটা বাধা। লালনকে ‘বর্তমান’ করে তোলার ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর বাউলদের উছৃংখলতা মারাত্মক সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এর সঙ্গে সাধনার কোন সম্পর্ক নাই। আগে ভাবের বিকাশ জরুরি। ভাবুকতার চর্চাকে এখন অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতক্ষণ যা আলোচনা করলাম তাঁর মধ্যে এই কথাটাই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের আলোচনা চলতে থাকে আরো কিছুক্ষণ,দুইদেশের রাজনীতি বা সমাজ নিয়ে চলে টুকিটাকি কথা,আমরা তাঁর চিন্তা ও বক্তব্যের স্বচ্ছতায় আবিষ্ট হয়ে থাকি।
(এই সাক্ষাৎকারটি কলকাতার 'আনুষঙ্গিক' পত্রিকার তরফ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই। এখানে দুই একটি জায়গায় কিছু উত্থাপিত বিষয় আরও বিশদ করবার চেষ্টা করেছি। 'আনুষঙ্গিক'-কে ধন্যবাদ ও ভালবাসা।)