ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকেই বুঝতে হবে

ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকেই বুঝতে হবে
কথা বলেছেন ফ্লোরা সরকার । কথাবার্তা হয় ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪।
ফ্লোরা সরকার: আমার প্রথম যে প্রশ্নটি আপনার কাছে সেটা হলো, বিগত সরকারের সময় আমরা দেখেছি যে ক্ষমতার প্রশ্নটি খুব বড় আকারে সামনে চলে এসেছিল। আপনার ‘গণপ্রতিরক্ষা’ বই যেটা ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটার ভূমিকায় আপনি খুব সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন, সেটা হলো, ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই কথাটার অর্থ কি?
ফরহাদ মজহার: এই কথাটাকে আপনি বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারেন। আমি যখন লিখছিলাম, তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আমার মাথায় ভর করেছিল। সেটা হলো, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় ‘ক্ষমতা’ যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা রাজনৈতিক বর্গ সেটা আমরা খুব একটা খেয়াল রাখিনা। ক্ষমতা কি? অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি বা রাজনীতির কোন্ পরিসরে কিভাবে ক্ষমতা তৈরি হয়? ক্ষমতা কি স্রেফ বল প্রয়োগের ক্ষমতা? নাকি চিন্তাচেতনা, আদর্শ, শিক্ষা, সামাজিক শৃংখলা এবং তার ফল এবং প্রয়োগ? -- সেখানেও কি ক্ষমতা সক্রিয়? কিভাবে সক্রিয়? এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
তাছাড়া ক্ষমতা সম্পর্কে বাংলাদেশে আমাদের ধারণাটা অত্যন্ত প্রাচীন। অতিরিক্ত পরানা এবং জীর্ণ। এই ধারণা এখন আসলে কোন ব্যবহারে লাগেনা। লাগে কি?
কেন প্রাচীন? ধরেন ষাট দশকে বামপন্থী আন্দোলনের সময় আমরা যখন গড়ে উঠছি, তখন ক্ষমতা বলতে আমরা কি বুঝতাম? ক্ষমতা বলতে আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতাই শুধু বুঝতাম। বল প্রয়োগ রাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে একচেটিয়া ক্ষমতা আকারে মজুদ থাকে। ক্ষমতা বুঝি হাতুড়ির মতো বা অস্ত্রের মতো। রাষ্ট্র একচেটিয়া তা ব্যবহার করে, রাষ্ট্র ছাড়া আর কারো সশস্ত্র বল প্রয়োগের এখতিয়ার থাকে না। ক্ষমতা যেহেতু হাতে ধরে রাখা বল্প্রয়োগের হাতিয়ার অতএব একবার হাতে পেলেই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল হয়ে গেল।
রাষ্ট্র কিম্বা ক্ষমতা কোনটাই এর দ্বারা বোঝা যায় না। কিন্তু এটাই তো আমরা বুঝতাম। এখনও অধিকাংশই তরুনরাও এটাই বোঝে। রাষ্ট্র ক্ষমতা হলো বলপ্রয়োগের হাতিয়ার মাত্র। আমাদের বিপ্লবী আকাংখা এটাই আমাদের শিখিয়েছিল। লেনিনের মাধ্যমেই আমরা জেনেছি যে রাষ্ট্র হলো স্রেফ বল প্রয়োগের হাতিয়ার।
কিন্তু মানুষ জন্তু-জানোয়ার নয়, যে স্রেফ বলপ্রয়োগ দ্বারা তাদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সামাজিক ও সামষ্টিক অভিপ্রায় যেমন আছে তেমনি নীতি-নৈতিকতা, বিশ্বাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতিও আছে। সেই নীতি-নৈতিকতার পরম নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তি (Ethical Life) রূপে রাষ্ট্র হাজির হয় – হেগেলের এই তত্ত্ব ভুল সেটা আমরা এঙ্গেলস এবং ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পড়ে মুখস্থ করেছি। আসলে কি ভুল? মানুষের কি শুধু রক্তমাংসের চাহিদা!! জীবের অতিরিক্ত তার কোন ইচ্ছা বা অভিপ্রায় কি নাই? আছে। ফলে আমরা খুবই কাঁচা অর্থে ‘ক্ষমতা; বুঝেছি। আমরা শুধু বল প্রয়োগের দিকটা দেখেছি, কিন্তু কিভাবে আমাদের ইচ্ছা, অভিপ্রায়, কামনা, বাসনা ইত্যদিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা তৈয়ার করা হয় সেটা আমরা দেখি নি বা দেখি না। তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা শুধু বল প্রয়োগের হাতিয়ার না, কিম্বা ক্ষমতা মানেই কাঁচা বল প্রয়োগ নয় – ক্ষমতার এই দিকটা আমামদের বোঝাবুঝির বাইরে থেকে গিয়েছে।
ধরুন আমরা যখন কোন সেমিনার বা কনসার্ট করি, আমরা কি বল প্রয়োগ করে মানুষকে আনি? না আনিনা। মানুষ যখন পীর ফকির দরবেশের কাছে যায় তারা কি র্যাব পাঠিয়ে তাদের আনেন? মানুষ যখন ওয়াজ শোনে তখন কেন ওয়াজিয়ানের পক্ষে অনেকে মরতে তৈরি হয়ে যায়? যদি বল প্রয়োগই ক্ষমতার প্রধান উপাদান হোত তাহলে মাস্তানি বা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য পুরা সময় ব্যয় না করে মার্কস, এঙ্গেলস কিম্বা লেনিনকে এতো গাদা গাদা বই লিখতে হোলো কেন?
আমরা তাদের লেখালিখির খবর জানতাম। মতাদর্শিক লড়াই-সংগ্রামের কথা বলতামও বটে, কিন্তু মতাদর্শিক সংগ্রাম বিদ্যমান ক্ষমতার বিপরীতে জনগণের পক্ষে ক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়া এটা আমরা পুরাপুরি বুঝতাম কি? মতাদর্শিক সংগ্রামের কথা আমাদের মুখস্থ থাকলেও মতাদর্শিক লড়াইয়ের দার্শনিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। ফলে আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় গায়ের জোর, সশস্ত্রতা কিম্বা বলপ্রয়োগ যতোটা মুখ্য বিষয় ছিল, মতাদর্শিক সংগ্রাম সেই তুলনায় মুখ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে নি।
ইডিওলজিও বা মতাদর্শ ক্ষমতার দ্বারা যেমন তৈরি হয় তেমনি মতাদর্শ ক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়াও বটে। ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মতাদর্শ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। অর্থাৎ জ্ঞান চর্চা ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। এই যে ইডিওলজি (বা মতাদর্শ ) তৈরি, বয়ান বানানো, জ্ঞান চর্চা, পর্যালোচনা ইত্যাদি যে ক্ষমতা উৎপাদন করে, এটাকে আপনি বলতে পারেন, সফ্ট পাওয়ার, বল প্রয়োগের বিপরীতে একটা সফ্ট পাওয়ার। ক্ষমতাকে এভাবে বুঝতে আমদের সময় লেগেছিল। তাই বলেছিলাম ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে, কাঁচা বল প্রয়োগ হিশাবে বুঝলে চলবে না। কিম্বা একে স্রেফ অর্থনীতি কিম্বা শ্রেণী সংগ্রামের সাংঘর্ষিক মডেল দিয়েও বোঝা যাবে না। তাই মতাদর্শিক সংগ্রামও যে শ্রেণী সংগ্রাম এটা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে।
তো সফট পাওয়ার নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন, লুই আলথুজার, ওনার "Ideology and Ideological State Apparatuses (Notes Towards an Investigation)" একটা বিখ্যাত প্রবন্ধ। তিনি সেখানে আর্গুমেন্ট করেন, শিক্ষাব্যবস্থাও রাষ্ট্র ক্ষমতা চর্চার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যেখান থেকে ইডিওলজি তৈরি হয়, সমাজের বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মতাদর্শ বানানো হয়। শিক্ষা ব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
মানে ক্ষমতাসীনরা যেভাবে শিক্ষা দেয় আপনি সেভাবেই ক্ষমতার সম্পর্ক বজায় বা পুনরুৎপাদনের জন্য আচরণ করেন। তাহলে শিক্ষা কি? শিক্ষাও বল প্রয়োগের হাতিয়ার। কেন? শিক্ষা আমাদের স্বাভাবিক বা সহজাত বৃত্তির বিকাশ ঘটতে দেয় না। বরং বাইরে থেকে জবরদস্তি করে শিক্ষার্থীর কামনা, বাসনা আকাংখাকে সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে খাপ খাইয়ে নেবার কারিগরি, ক্ষমতার সম্পর্ক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের নাম শিক্ষা ব্যবস্থা। একে বলা যায় Coercive Reconfiguration of Desire – জোরজবরদস্তি করে আমাদের সহজাত কামনা বাসনা ইচ্ছা অভিপ্রায়কে সমাজের বিদ্যমান উৎপাদন ও ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে নাটবল্টুর মতো ফিট করে নেবার কারখানা, নিয়ন্ত্রণের কারিগরি। আপনার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে, আপনাকে যদি আমি ছেড়ে দিতাম শিক্ষা ছাড়া, আপনি প্রাকৃতিকভাবে, নিজস্ব ফিতরাত অনুযায়ী, নিজস্ব স্বভাব অনুযায়ী জগতের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন, জগত সম্পর্কে জানতেন, জগতকে বুঝতেন। নাকি? কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা কি করে? আপনাকে সেটা করতে দেয় না। শিক্ষা বিদ্যমান সমাজের যে বিভিন্ন শ্রেণি আছে, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী আছে, সেই অসম শ্রেণী সম্পর্ক পুনরুৎপাদন করে, ক্ষমতাসীন শ্রেণীর ক্ষমতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে। সেই ক্ষমতা শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই শিক্ষার কারখানায় আপনাকে বানায়। আপনাকে সেভাবে তৈরি করে। নরম কাদামাটি দিয়ে যেভাবে কুমার তার ইচ্ছা মতো মৃৎপাত্র তৈরি করে, সেভাবে শিক্ষা আমাদেরকেও তৈরি করে। ঐ যে সেই গানটার মতো, ‘একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইরা জনম ভইরা ঘুরতে আছে;-র মতো। শিক্ষাও ঠিক ঐরকম। স্টেট বা সমাজ আপনাকে যেভাবে চায়, শিক্ষাও আপনাকে সেভাবে চাবি মেরে ছেড়ে দেয়। আপনি ঠিক সেভাবে ঘুরছত
তাহলে বুঝতে হবে এডুকেশন, মতাদর্শ, চিন্তা ইত্যাদি ক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্র। অথচ এগুলো সম্পূর্ণভাবে আমাদের রাজনৈতিক আলোচনায় উপেক্ষিত। এমনকি বামপন্থী আন্দোলনের সময় আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম, বামপন্থার গুরুত্বপুর্ণ এলাকা ছিল মতাদর্শিক সংগ্রাম। কিন্তু মতাদর্শিক সংগ্রামের বিষয়টা – অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে জনগণের পক্ষে ক্ষমতা তৈরির ব্যাপারটা আশির দশকের পর থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা পুরানা মাওবাদী বিপ্লবীরা কিছুটা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিশাবে এখনও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই যে আসলে জনগণের পক্ষে ক্ষমতা তৈরির লড়াই – এই প্রাথমিক বৈপ্লবিক শিক্ষাটা প্রাণপণ ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এখন আপনি খুব কমই রাজনৈতিক পরিসরে মতাদর্শিক সংগ্রাম দেখবেন।
একটা চিন্তা আছে, যেমন সেকুলারিজম বনাম ধর্ম। আমাদের সমাজে মনে করা হয়, সেকুলারিজম এবং ধর্ম বুঝি দুটো আলাদা জিনিস। একটার সঙ্গে আরেকটার বিরোধ চলছে। আসলে তো তা না। মানুষ যখন বাজরে যায় সে কি কোরআন-হাদিস পকেটে করে নিয়ে যায় ? না। তারও তো এটা সেকুলার বা ইহলৌকিক জীবন আছে। অন্যদিকে যে লোকটা নিজেকে সেকুলার মনে করে, তারও তো একটা মতাদর্শ আছে, তার মতাদর্শই তো তার ধর্ম। সেই ধর্মের আকিদাও আছে। কারন তার চিন্তা অনুযায়ী তার পারিবারিক, সামাজিক কিম্বা সাংস্কৃতিক জীবন পরিচালিত হয়। কোরআন শরীফ যে পড়ে তারও একটা মতাদর্শ আছে। দুটোই মতাদর্শ, দুটোর মধ্যেই ধর্ম আছে, চিন্তা আছে, যুক্তি আছে -- আলাদা কিছু না। প্রত্যেকেই তার অনুমান, বিশ্বাস চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি দ্বারা কাজ করে। ফলে মতাদর্শিক আন্দোলন বা সংগ্রামটা বিপ্লবী বা আর্থ-সামাজিক ও ক্ষমতার রূপান্তরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। অথচ মতাদর্শিক সংগ্রাম –অর্থাৎ ক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার রাজনৈতিক গুরুত্ব আমাদের সমাজ থেকে একদম হারিয়ে গেছে। এই উপলব্ধি থেকেই আমি ধর্মের পর্যালোচনা, মতাদর্শিক পর্যালোচনা এসব শুরু করেছি।
যারা নিজেদের বাম বলে দাবি করে, মার্ক্সিস্ট বলে দাবি করে, তারা আদৌ বাম বা মার্ক্সিস্ট কিনা সন্দেহ আছে। নইলে বামদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবক্ষয় এতো ভয়াবহ রূপ নিলো কেন?
এখন কথা হলো, ক্ষমতা মানে হাতের মোয়া না যে আপনি পাবেন আর খাবেন। মতাদর্শিক লড়াই-সংগ্রাম অর্থাৎ জ্ঞানোৎপাদন ও জ্ঞানোৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কিন্তু ক্ষমতা তৈরি হয়, ক্ষমতার রূপ বদলায়। মিশেল ফুকো এ বিষয়ে চিন্তার নতুন দিগন্ত হাজির করেছেন। ফলে আপনি যে প্রশ্নটা করেছিলেন, ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে এই চিন্তাটাও এখন অত্যন্ত প্রাচীন ধারণা। ক্ষমতা যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ সেটা আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে। মতাদর্শ, ক্ষমতা, শিক্ষাব্যবস্থা, ইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটার্স ইত্যাদি ভালো করে পর্যালোচনা করবার ক্ষমতা আমামদের বৃদ্ধি করতে হবে। মনে রাখবেন।
এবার আমরা একটু অন্য জায়গায় যাই। এবং এটা হলো ফুকোর বক্তব্য। ফুকো বলেছেন, দেখুন এই যে কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থা, নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন এসেছে এবং একইসঙ্গে আমরা যে প্রতিনিয়ত মতাদর্শিকভাবে লড়াই করছি এসব নতুন ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি করে। তার আগে কারাগারের কথা তিনি বলেছেন। কারাগারে আপনি লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। কারাগারে তাদের আপনি রাখছেন কেন ? যাতে সে সমাজ বিশেষত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ বা অপরাধ করতে না পারে। তাকে পানিশমেন্ট আপনি দিচ্ছেন প্রকাশ্যে। কিন্তু প্রকাশ্যে শান্তি দিচ্ছেন কেন ? যাতে ক্ষমতার বিরুদ্ধে কেউ বা রাজা বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ লড়াই না করে। এই শাস্তি শাসিতদের বুঝিয়ে দেয় যে রাজাকে মারলে কি দশা হবে। ফুকোর ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিসমেন্ট বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে দেখেছেন কীভাবে হাত-পা বেঁধে টেনে নিতে নিতে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এটা করছে যাতে আপনি ক্ষমতার বিরুদ্ধে কিছু না বলেন। এটা দেখাচ্ছে যে রাজাকে মারলে তোমার কি দশা হবে! ঐ নৃশংস হত্যা দৃশ্য দেখলে আপনি রাজার বিরুদ্ধে আর কিছু বলবেন না। কিন্তু মজা হচ্ছে, এটা দেখার পর দেখা গেল, আসলে যে ইফেক্টটা সমাজে ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে, সেই ইফেক্টটা হচ্ছেনা, বরং উল্টো হচ্ছে। বরং প্রকাশ্যে নৃশংস ভাবে হত্যা জনগণকে উল্টা রাজার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সেভাবে কাজ করছে না। এরপর কি করলো তারা? শাস্তি দেয়া শুরু করলো গোপনে। কারাগারের ভেতরে। আগে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হতো, এখন প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হচ্ছেনা। কারাগারের ভেতরে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। এই যে রাষ্ট্র বা রাজা নিজেকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতা চর্চার নতুন নতুন পদ্ধতি বের করলো, তার ইতিহাস বোঝাও ক্ষমতার রূপ নির্ণয়ের মধ্যে পড়ে। এটাও কিন্তু ক্ষমতার একটা আচরণ, ক্ষমতা কি করে নিজেকে সক্রিয় রাখে, বজায় রাখে, সেই সকল বোঝার পথ।
ফলে ক্ষমতা বলতে যে আমরা পুরানো ধারণা পোষণ করি যে রাষ্ট্রের মধ্যেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে --পুরানো লেনিনীয় ধারণা -- এই ধারণাটার উপযোগিতা শেষ হয়ে গেছে। কিম্বা আগের মতো নাই। ক্ষমতাকে নতুন ভাবে বিচার করতে হবে। ক্ষমতা এখন কিভাবে চর্চা করা হয়, তার রূপ কেমন ইত্যাদি আমাদের নতুন ভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। এটাই আমি বলতে চেয়েছি। আমি যখন বইটা লিখেছিলাম তখন মার্কসবাদীদের জন্যে লিখেছিলাম, যাদেরকে নিয়ে আমি ভাবতাম এবং ধরেই নিতাম এরাই বিপ্লবটা করবে। এরা বিপ্লবের কর্তা। ফলে তারা যদি ক্ষমতাটা বোঝে তাহলে মতাদর্শিক লড়াইটা তারা করবে।
এটা গেল এক নম্বর। দুই নম্বর হলো, ক্ষমতা যে আগের মতো নাই, শুধু রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত না, এটা নানাভাবে সমাজে ছড়িয়ে আছে। ফুকো বলছেন, আপনি যে কর্তা, যে কর্তাটা আপনার মধ্যে তৈরি হচ্ছে, যেমন আমি বা ফ্লোরা নামে যে কর্তা তৈরি হচ্ছে, এই কর্তাটাও তৈরি করে পুঁজি। আর পুঁজি তৈরি করে ক্ষমতা। মার্কস বলেছেন পুঁজি আর ফুকো বলেছেন ক্ষমতা। এখানেই পার্থক্য। পার্থক্যটা কিন্তু খুব বড়। তবে ফুকো কিন্তু বলেন নাই, মার্কসের আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যাটা ভুল। ফুকো বলেছেন, আমারটা সাপ্লিমেন্ট। আমারটা বুঝলে আমি ক্ষমতাকে ভালো করে বুঝবো। মানে একদিকে পলিটিকাল ইকোনমি সে তার নিজস্ব গতিতে একটা ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি করছে, যাকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা উৎপাদন সম্পর্ক হিশাবে বুঝতে হবে, অন্যদিকে তাকে ক্ষমতা তৈরি ও বহাল রাখার জন্য জ্ঞানোৎপাদনের পরিসর থেকেও বুঝতে হবে।
আমাদের সমাজের প্রত্যেকে স্বাভাবিক মনে করে যে আরেকজন লোকের কাছে আপনি নিজের শ্রম বা শ্রমশক্তি বিক্রি করছেন। এটা কিন্তু অস্বাভাবিক কেউ মনে করছে না। অথচ নিজের শ্রম অন্যের কাছে বেচে দেওয়া যে দাসত্ব, জীবনের কিছু সময়ের জন্য অন্যের দাস হওয়া – এটা আমরা বুঝি না, ধরতে পারি না। এটা দাসত্ব। ফলে, মার্কস যেটা বলেছেন, ফুকো কিন্তু সেটাই বলেছেন। মানে আপনি যেটাকে স্বাভাবিক মনে করে কারখানায় যাচ্ছেন, স্যুট-টাই পরে কম্পানির অধীনে কাজে যাচ্ছেন, আপনি ঠিকই ক্ষমতাসীনদের হুকুমের দাস বা র্যাব হয়ে গুলি করছেন, ইত্যাদি। অর্থাৎ ক্ষমতা কিন্তু এভাবেই ফাংশন করে। সে কিন্তু আপনার মধ্যে একটা কর্তা তৈরি করে যে কর্তা ক্ষমতার অসম সম্পর্ক উৎপাদন করে।
এই যে ক্ষমতার বা ক্ষমতার অসম সম্পর্ক উৎপাদন – এই ক্ষমতাকে নতুন করে পর্যালোচনা বা বিচার -- প্রশ্ন হলো, এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আমরা তাহলে কিভাবে মোকাবেলা করবো ? নতুন রাজনীতি বা মানুষের সঙ্গে মানুষের নতুন সম্পর্ক তৈরি করবার প্রধান বিবেচ্য বিষয় বা নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা এখানে নিহিত। এর আগে এই বাস্তবতা আমরা আগে কখনও বুঝি নি, তাই দেখিও নাই। আগে আমরা বুঝতামও না। তাহলে আমরা যদি নতুন ক্ষমতা তৈরি করতে পারি, যেটাকে আমি বলি, ‘গণক্ষমতা’ অর্থাৎ সামষ্টিক ক্ষমতা, কালেকটিভ উইল, যেটা রুশো থেকে আসছে, রুশোর জেনারেল উইল থেকে আসছে, তাকে নতুন করে পর্যালোচনা করতে শিখতে হবে। এমনকি আমাদের পুরানা টুকলিফাই সংবিধানে কোটেশান মার্কা বাক্য বলা হয়েছে, “জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি ” -- তো সংবিধা্নের এই প্রকার ধারণাটার মানে কি? জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিকে কিভাবে চিনবো? এটাই তো রাজনীতি। তাহলে এই রাজনীতিটা যদি আপনি করতে চান, তাহলে কিভাবে করবেন? এই ২০২৪ সালে, এটাই হচ্ছে আমাদের প্রধান ইস্যু।
আমার ‘গণপ্রতিরক্ষা’ কবে বের হয়েছিল? ২০০৬ সালে। সেই ২০০৬ সাল থেকে আমি বলে আসছি নতুন গণরাজনীতিটা আমরা কিভাবে করবো? আমরা যদি নতুন গণরাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলতে চাই, গণরাজনৈতিক ক্ষমতা বানাতে চাই তাহলে আমাদের রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল কি হবে বা পুরানো ভাষায় বলতে পারেন, আমাদের রণনীতি ও রণকৌশল কি হবে? এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘গণপ্রতিরক্ষা’ বইটা লেখা হয়েছিল। ক্ষমতা সম্পর্কে নতুন ভাবে চিন্তা করার জন্যে।
ফ্লোরা সরকার: এখান থেকে আরেকটা প্রশ্নে আমরা যেতে পারি, সেটা হলো, একদিকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে সংবিধান, আইন, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যদিকে এই শৃঙ্খলাকে যাতে বিশৃঙ্খল করা না হয়, সেটা মোকাবেলা করার জন্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের এই দুই কাজের মধ্যে দ্বন্দ্বটা কোথায় ?
ফরহাদ মজহার: আপনি বারবার বলছেন বা আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে সংবিধানকে প্রথমে আনতে হবে। তাহলে ছোট একটা প্রশ্ন করি, সংবিধানকে প্রথমে আনতে হবে কেন ? আপনি তো স্বাধীন। আপনাকে সংবিধান মানতে হবে কেন ? আপনাকে যদি প্রথমেই শেখানো হয়, সংবিধান একটা পবিত্র সংবিধান, কোরআন শরীফের মতো। তাহলে এই যে যারা পবিত্র সংবিধান বলে, তাদের সাথে তো ধর্মবাদীদের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। একই কথা। একজন বলছে কোরআন হলো সংবিধান, আরেকজন বলছে সংবিধান হলো কোরআন। এটাই পার্থক্য। এই যে ব্যাপারটা, এই যে আমরা একটা ধর্মতাত্ত্বিক স্তরে বাস করছি, এই ধর্মতাত্ত্বিক স্তরটা তো অতিক্রম করতে হবে, আমরা কি এই ধর্মতাত্ত্বিক স্তর অতিক্রম করতে পেরেছি ? আমরা মুখে বলছি, সেকুলার, কিন্তু আসলে আমাদের চিন্তা চেতনা রাজনীতি সবই ধর্মতাত্ত্বিক অর্থাৎ থিওলজিকাল।
দেখুন, এখন অনেকে বলেন, সংবিধান ছাড়া নাকি শাসন করা যায়না। তাহলে হুজুররা কি অন্যায় করেছে ? তারা বলে কোরআন দ্বারা শাসন করবে। একই তো কথা ? তাহলে কি করতে হবে ? কাজটা হচ্ছে মানুষের যে বিকশটা ঘটছে, সেই বিকাশকে যদি আপনি বিকশিত হতে দিতে চান, তাহলে স্বভাবতই আপনাকে বলতে হবে যে জনগণ তার চিন্তা-চেতনার দ্বারা যখন নতুনভাবে ভাবতে পারে, নতুনভাবে কল্পনা করতে পারে, সেই আলোকে সে নতুন করে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করবে। তাহলে জনগণই সার্বভৌম, কোন লিখিত গ্রন্থ বা কেতাব নয়। এই দাবি ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কারন কোরানুল করিম কখনই নিজেকে ‘আইন’ বা ‘বিধান’ বলে দাবি করে নি, কোরান এসেছে মুত্তাকিন্দের হেদায়েতের জন্য। অর্থাৎ জ্ঞানী ও মুত্তাকিনরা সবসময়ই কোরান পাঠ ও রুহানি প্রেরণায় পর্যালোচনা করতে পারেন এবং মানুষের কর্তব্যকর্ম নির্ণয়ের জন্য হেদায়েত লাভ করতে পারেন। তার মানে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নতুন ভাবে নির্ণয় করা যেতেই পারে। আপনার সাথে আমার সম্পর্ক নতুন হতেই পারে। আজ থেকে ১৯৭২ সালে যে সংবিধান আমরা লিখেছি, এখন ২০২৪ সালে তাতে কাজ হবে না, আমাদের নিজেদের নতুনভাবে গঠন করতে হবে। ফ্লোরার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন হবে, এটা তো আমার আলোচনার বিষয় না। ফ্লোরা আমার আপন মায়ের পেটের বোন না, কিন্তু আমি তাকে বোনের মতো দেখছি, এটা এথিকাল বা নৈতক সম্পর্ক, আমাকে এভাবেই ধর্ম শেখানো হয়েছে। ফ্লোরা তোমার বোন, সে তো রক্তের না, কিন্তু তোমার বোন। তার সঙ্গে আমার আচরণ বোনের মতোই হতে হবে। তাহলে এসব আমি শিখি কোত্থেকে ? সমাজের নীতিনৈতিকতা, শিক্ষাব্যবস্থা, আদর্শ থেকে শিখি।
আচ্ছা, আইন আমাকে কি বলে ? যদি তুমি ফ্লোরাকে খারাপ কাজ করাও বা তার প্রতি খারাপ দৃষ্টিতে তাকাও বা খারাপ আচরণ করো, তাহলে তোমাকে শাস্তি দেয়া হবে। এখন দেখেন নীতি আর আইন কিন্তু পাশাপাশি চলে। আবার ফকিররা কি বলবে? তুমি খারাপভাবে তাকাবাই বা কেন ? তোমার স্বভাবটাই হতে হবে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শের ভিত্তিতে। কেন ? কারণ, যদি তিলার্ধ নাই ব্রজ ছাড়া কে তবে মথুরাতে রাজা হোল? ব্রজধামের বাইরে বা ব্রজধামের অতরিক্তি মথুরা এলো কোত্থকে? অর্থাৎ বৈষ্ণবরা যদি প্রেমের দ্বারা বা প্রেমের ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয় সম্ভব বলে মানে তাহলে কৃষ্ণকে আবার মথুরার রাজা ভাবতে হবে কেন? মথুরাতে কৃষ্ণের আবার রাজা হবার দরকার কি? অর্থাৎ রাজার দরকার নাই, আমার রাষ্ট্রের দরকার নাই, আমাদের দরকার সমাজ। এটাই হোল ফকিরি রাষ্টতত্ত্ব। কারন মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালবাসা ও প্রীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব।
রাষ্ট্র মানেই তো একটা পরজীবী, একটা প্যারাসিটিক প্রতিষ্ঠান। তাহলে এই প্যারাসিটিক প্রতিষ্ঠানকে আমরা ফেলে দিয়ে সত্যিকার একটা সমাজে ফিরে আসবো। এটাই এইকালের প্রধান রাজনীতি। আমরা তো প্যারাসাইট নিয়ে সমাজ চালাতে পারবোনা। তাহলে আমরা কিভাবে পারবো ? যদি আমরা আইনকে ধীরে ধীরে নীতি-নৈতিকতার জায়গায় নিয়ে এসে নিজিদের স্বভাবরে অর্ন্তগত করতে পারি। আপনার মনের মধ্যে যদি পুলিশ থাকে, বাইরের পুলিশ তো আর আপনার লাগবে না।
ফ্লোরা সরকার: আপনার গণঅভ্যুত্থান ও গঠন বইতে যাকে আপনি বলেছেন প্রকৃতিক আইন ?
ফরহাদ মজহার: প্রাকৃতিক আইন তো আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। গাছে ফুল ফুটতাছে, ফল ধরতাছে, গাছ কেটে ফেলা ঠিক না, কারণ সে আমাকে ফল-ফুল দিচ্ছে -- এসব আমরা প্রাকৃতিভাবে শিখেছি। সন্তানকে ভালোবাসতে হবে, মাকে ভক্তি করতে হবে,বাবার কথা শুনতে হবে, এসব আমরা প্রকৃতিকভাবে শিখেছি।
কিন্তু আমি যখন স্বাধীন হয়ে গেলাম, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, আমি তো ব্যক্তি এখন। আমি তো এখন আর প্রাকৃতিক আইন দিয়ে চলিনা। ছেলেমেয়েদের যখন বিয়ে দেন তখন মেয়েরা তাদের স্বামীর বাবামার সংসারে থাকতে চায় না। আমাদের সময়ে কিন্তু থাকতো। এটাকে তারা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবকি বলে মেনে নিতো। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক মেয়েরা বলে, আমি তো স্বাধীন, আমি কেন স্বামীর বাবামার সাথে থাকবো। তাই অধিকাংশ সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা কিন্তু এখনো মাবাবার প্রতি অনুগত। হয়তো সম্পত্তিতে ছেলের প্রধান অধিকার সেটা কারন। কিন্তু মেয়েরা স্বাধীনভাবে তার স্বামীর সংসারে থাকতে চায়। এটা কি অন্যায় ? না অন্যায় না। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই ঘটতে বাধ্য। এটাই যদি ঘটে, তাহলে আমাকে সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। অর্থাৎ আমাদের বাবামাগুলোর প্রতি নীতিনৈতিকতার দায়টা কিভাবে আমরা মেটাবো? আগে কি করতাম? একসঙ্গে থাকতাম। একান্নবর্তি পরিবারে থাকতাম। বড় ভাই যা আয় করতো তা দিয়ে সংসার চলতো, বড় ছোট ভাইকে পড়াচ্ছে, এই যে প্রাকৃতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে পারিবারিক গার্হস্থ্য অর্থনীতি চললো, সেই গার্হস্থ্য অর্থনীতি এখন আর নেই, ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। ভেঙ্গে দেয়ার পর এখন কি লাগবে ? দুটো জিনিস লাগবে -- একটা হলো স্বাধীন ব্যাক্তির বিজাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নৈতিকিতা বা এথিক্স। নৈতিকশিক্ষাকে আমরা ধর্ম শিক্ষাও বলতে পারি।
ফ্লোরা সরকার: শুধু ধর্ম শিক্ষা কেন ? ধর্ম ছাড়াও তো সাধারণ নীতি-নৈতিকতা আছে ?
ফরহাদ মজহার: নৈতিক শিক্ষা মানেই ধর্ম শিক্ষা। আমরা যদি বিভ্রান্ত না হই, বলতে পারি ধর্ম মানেই আত্মার বিষয়। ধর্ম মানে কি ? ধর্ম মানে আত্মার যত্ন। অন্যদিকে শরীরের যত্ন করে ইকোনমি।
ফ্লোরা সরকার: দারুন ব্যাপার ! আত্মার যত্নের জন্যে ধর্ম আর শরীরের যত্নের জন্য অর্থনীতি।
ফরহাদ মজহার: এই দুটোকে মেলাতে হবে। ধরেন আপনি ধর্মকে চাইছেন না। পুরানো ধর্মের বিবর্তন ঘটছে, আগে প্রস্তাবনাগুলো ছিল ধর্মতত্ত্ব আকারে, ধর্মীয় আইন আইন আকারে, এগুলোকে আপনি ক্রিটিক করবেন। তার মর্মশাঁসটা কি? ধর্ম আসলে কি বলতে চেয়েছে? এটাকেই আমরা বলি মার্কসবাদী ক্রিটিক।
আপনি বাদাম খান ? বাদাম কিভাবে খান ? ছিলে তারপর খান। উপরে একটা খোসা আছেনা ? খোসাটা ভেঙ্গেই তো খান, তাইনা ? তো ধমর্তত্ত্বের মধ্যে দর্শনটা ঐ খোসা দ্বারা আবৃত থাকে। মার্কস বলছেন, খোসাটা ভাঙ্গো। দেখবে ভেতরে ভাবের লীলা কি চমৎকার! অর্থাৎ মানুষের এথিকাল জীবন, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবনটা ধর্ম ঐ বাদামের খোসার ভেতরে ধরে রেখেছে। এটাকে নষ্ট করা যাবেনা। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নীতি-নৈতিকতা ছাড়া আপনি চলবেন কি করে ? তাহলে পুঁজিতন্ত্রই , পুঁজির আইনইএকমাত্র আপনার উপর শাসন করবে। পুঁজিই ঠিক করবে, আপনি একটা কমোডিটি বা পণ্য হয়ে যাবেন, আপনাকে সে ব্যবহার করে কমোডিটি হিসাবে। সে যেভাবে অন্যান্য পণ্যকে ব্যবহার করে ঠিক সেভাবে পুঁজি আপনাকেও ব্যবহার করে।
কয়দিন পরে মেয়েরা বলবে সন্তান চাইনা। এটা বলার তার অধিকার আছে। ব্যক্তি অধিকার, পুঁজিতান্ত্রিক বা বুর্জোয়া সমাজে এটাই পরম ধর্ম। তাহলে সন্তান উৎপাদন কিভাবে করবেন ? টেস্টটিউবে ? আচ্ছা এটাও মেনে নিলাম। কারণ এটা নারীবাদিরা দাবি করেছে। আমি কিন্তু নারীবাদির পক্ষে বললাম। কিন্তু একটা মেয়ে যখন বলে আমি সন্তান চাইনা, তার তো এটা বলার অধিকার আছে।
ফ্লোরা সরকার: শুধু সেটাই না। আজকাল তো সেক্স পরিবর্তন করতেও চাচ্ছে।
ফরহাদ মজহার: এটাও তার ব্যক্তি অধিকার। আপনি তো তাকে ফেরাতে পারবেন না। তাহলে এই পথটাকে আপনি ফেরাতে পারবেন কি দিয়ে ? ব্যক্তিতন্ত্র প্রবল হয়ে গেছে। আমার মধ্যে ‘আমি’ এসে গেছে। আপনি কি মনে করেন অতীতে সমকামী ছিলনা ? অবশ্যই ছিল। আমাদের সমাজে কি ছিলনা ? আমাদের গ্রামে আমরা যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতাম-খেলতাম, আমাদের দাদা-নানারা কিছু কিছু ছেলের সাথে মিশতে দিতোনা। কিন্তু এটাকে তারা বিরাট কোন ব্যাপার বানিয়ে ফেলতো না। কেন বানাতো না ? প্রথম কথা হলো, প্রেম কোন ছেলের সাথে ছেলের হতেই পারে, কিম্বা মেয়ের সাথে মেয়ের। ইসলামে তাররিজি আর রুমির প্রেমের কথা আমরা জানি। আমাদের নবীজীর সাথে আল্লাহর সম্পর্ক কি ছিল ? হাবিব ছিল। প্রেম ছিল। এটা তো সমকামি না। প্রেম তো ঐশ্বরিক ব্যাপার। লাভ তো লিঙ্গ মানেনা। কিন্তু এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে সেটা হলো, আপনি প্রেম করছেন, কিন্তু আপনি আবার দাবি করছেন সন্তানও বড় করবেন। সন্তান যখন বড় করছেন, তখন বলছেন আপনি ফ্যামিলিও চান। কিন্তু আপনি প্রেমও করতে চান। এখানেই কন্ট্রাডিকশন। সমাজ চলবে কিভাবে? এর জন্যে তো আপনার শরীর তৈরি হয় নাই। আপনি কি করছেন, টেস্ট টিউবে সন্তান ধারণ করছেন বা অন্যের সন্তানকে অ্যাডপ্ট করছেন। ওটা তো তার সন্তান। তোমাকে তো আল্লাহ্ তৈরি করে নাই সন্তান করতে। এখানে খুব কঠিন প্রসঙ্গ তুলছি আমরা। ব্যক্তিতান্ত্রিক জগতে অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ব্যক্তিটা মুখ্য, সমাজটা গৌণ। সমাজটা গৌণ হলে ব্যক্তি সব সময় সমাজকে বাধা মনে করে। যেমন কাল থেকে যদি মেয়েরা দাবি করে আর সন্তান উৎপাদন করবেনা। অথবা এটা বাদ দেন, কথাটা হয়তো পুরুষতন্ত্র হয়ে যাবে। কাল থেকে যদি ছেলেরা দাবি করে এরপর থেকে তারা সিমেন বা বীর্য পতন ঘটাবেনা, বীর্য দান করবে না, তাহলে প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ ছেলেরও একটা দাবি আছে। অথবা একটা ছেলে হয়তো অসুস্থ অথবা জমিতে কীটনাশক দেয়া হচ্ছে এবং সেই জমির যে সয়াবিন তেল খাবেন, তার দ্বারা একটা অটিস্টিক বাচ্চা উৎপাদন হবে। এখন আপনি কি অটিস্টিক বাচ্চা চান নাকি সুস্থ বাচ্চা চান ? এটা যদি আপনি বুঝে থাকেন, তাহলে প্রাচীন কালে অদ্ভূত কিছু নিয়ম ছিল, যেমন কোন ব্রাহ্মণ যদি রুগ্ন থাকতো, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম থাকতো তাহলে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করাটা বৈধ ছিল। অর্থাৎ তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষকে দিয়ে সন্তান উৎপাদন করাতো। নিৎসের যে কনসেপ্ট ভালো প্রজাতি তৈরি করা, সেখানেও তো এটা আছে।
এগুলো হলো আইডিয়া। এগুলোকে তো আপনার ফেলে দিলে চলবেনা। এথিকেলি শুনতে খারাপ লাগে। তোমার স্ত্রী অন্যের কাছে যাবে কেন ? কিন্তু একটু খেয়াল করলে বুঝবেন, বিষয়টা সমগ্র মানুষের জন্য। স্বভাবতই আপনাকে চিন্তা করতে হবে, আপনি কীভাবে সুস্থ, হেলদি বাচ্চা তৈরি করবেন। যদি সুস্থ বাচ্চা তৈরি করতে না পারেন, তাহলে একটা প্রজাতি তো কিছুদিন পরে ধ্বংস হয়ে যাবে। তার বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক বিকাশ কিছুই ঘটবেনা। তারা দুর্বল জাতিতে পরিণত হবে। তাহলে দেখতে পারছেন, এথিক্স এবং ইকোনমিক্স ও এথিক্স এবং বায়োলজি হাত ধরাধরি করে চলে। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটাকে নিয়ে চলতে পারবেন না। ব্যক্তি ও সমষ্টি এই দুটো হাত ধরাধরি করে চলে। ব্যক্তি কতটুকু স্বাধীন এটা যেমন সমষ্টি দ্বারা নির্ধারিত হয় তেমনি সামষ্টিকতা কতটুকু সত্যিকার অর্থে সামষ্টিক এটা নির্ভর করে সে (সমাজ) কতটুকু ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়েছে। কারণ আগের মতো প্রাকৃতিক দৃষ্টিতে আপনি কিন্তু সমাজকে দেখতে পারছেন না। কাজেই স্বাধীন ব্যক্তিকে নিয়েই আগামী দিনের সমাজ গঠিত হবে। আপনি ব্যক্তিকে দমন করতে পারবেন না।
ফ্লোরা সরকার: না। ব্যক্তিকে দমন করা যাবেনা। কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা যখন দেয়া হচ্ছে একই সাথে এটাও ভাবতে হবে এই স্বাধীনতাকে কতটুকু পর্যন্ত আমি নিতে পারবো ?
ফরহাদ মজহার: রাইট। এটা কিন্তু আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন, তাইনা? তাহলে ব্যক্তি আর সমাজের যে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব এটাই রাজনীতিতে এখন প্রধান বিষয়। এটার সমাধান করতে হবে আগে। ব্যক্তি কতটা স্বাধীন এবং সমষ্টি কতটা ব্যক্তির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে। আইন বলতে তো এটাই বোঝায় এবং আইন সমষ্টির পক্ষে। ব্যক্তি তো আর আইন না। কিন্তু সমাজে বাস করতে হলে তো আইন লাগবে। আইন ছাড়া সে কিভাবে চলবে ? তখনই ব্যক্তিকে আইনের কথা বলতে হবে।
ফ্লোরা সরকার: হ্যা। কনফ্লিক্টটা এখানে। পরে আপনি বলছেন রাষ্ট্রের এই শৃঙ্খলাকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করার জন্যে প্রতিরক্ষা করারও ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে।
ফরহাদ মজহার: এখনকার আধুনিক রাষ্ট্র যাকে আমরা মর্ডান স্টেট বলি, সেটা নিরাপত্তা সর্বস্ব রাষ্ট্র। এই কনসেপ্টটা বুঝতে হবে আগে। নিরাপত্তা সর্বস্ব রাষ্ট্র গড়ে উঠলো কেন ? রাষ্ট্র কেন দাবি করে, নিরাপত্তা বা সিকিউরিটি দেয়াই আমার একমাত্র কাজ ? এটা করে এই কারণে যে, অবাধ বাজার ব্যবস্থার নীতিটা যখন গ্রহণ করা হবে বা নিউলিবারেল ইকোনমিক পলিসি যখন গ্রহণ করা হলো তখন তার অনিবার্য পরিণতিতেই নিরাপত্তা সর্বস্ব রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। কেন গড়ে ওঠে ? কারণ রাষ্ট্র দাবি করছে, আমার আর আগের মতো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান অর্থাৎ মৌলিক অধিকারগুলো দেবার আর দরকার নাই। এটা আমার দায় না। আমি তোমার থাকার জায়গা, চিকিৎসা বা খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারবো না। এসব তোমাদের অর্থাৎ জনগণের নিজ দায়িত্বে করতে হবে। কিভাবে? তুমি বাজারে প্রতিযোগিতা করো, সেখানে টিকলে টিকবে না টিকলে নাই। এটাকে বলে অবাধ বাজার ব্যবস্থা বা ইংরেজিতে নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসি। তাহলে আশির দশকের পর থেকে আমরা নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসির অধীনে আছি।
কই? আমরা যখন রাজনীতি করছি আপনি তখন কোন রাজনীতিবিদকে কি বলতে শুনেছেন যে নিউ লিবারেল ইকোনমির বিরুদ্ধে আমাদের কাজ করতে হবে? বলছে কি যে আমাদের একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা লাগবে যার শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব ব্যপারে তার দায় আছে ? আমি যদি বাজারের দ্বারাই ঠিক হই, আমি তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম সব বাজারের দ্বারা নির্ধারিত হবে, তাহলে আর রাষ্ট্রের দরকার কি? রাষ্ট্র বলে হ্যা হ্যা দরকার আছে। দরকারটা হলো তোমাদের নিরাপত্তার জন্যে দরকার। এখন রাষ্ট্র যে আমাকে নিরাপত্তা দেয় সেটা প্রমাণ করার জন্যে কয়দিন পরপর সে (রাষ্ট্র) সন্ত্রাসী আবিষ্কার করে। বলে এই যে দেখেন সন্ত্রসী ধরেছি, এই ধরছি ঐ ধরছি ইত্যাদি। কেন সন্ত্রাসী ধরছে ? রাষ্ট্র বলে, এই সন্ত্রাসী না ধরলে তুমি নিরাপদ থাকতে পারতা না। কিছুদিন পরপর সমাজে মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি করে। এই যে একটা আতঙ্ক তৈরি করা এবং সন্ত্রাসী ধরা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই -- এর সবই কিন্তু নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসির সঙ্গে যুক্ত। এটা কিন্তু ভালো করে বুঝতে হবে। তাহলে আপনি নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসির দ্বারা তৈরি রাষ্ট্রকে যদি মোকাবেলা করতে চান, তাহলে রাজনীতিতে প্রথমে আপনাকে কি কাজ করতে হবে ? নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বাজার যে সব ঠিক করে দিবে -- এই নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু আপনি এখন কি করছেন ? এই যে জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল এখন কি করছেন আপনি ?
ফ্লোরা সরকার: সরকারের সমালোচনা করছি।
ফরহাদ মজহার: না না। সমালোচনা করা ভালো। আমাদের এখনকার রাজনীতির মূল যে জায়গাটা অর্থাৎ অবাধ বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। অবাধ বাজারের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে আমি এই সিকিউরিটি স্টেটটাকে দমন করতে পারবো না। তাহলে সিকিউরিটি স্টেটের বদলে আমার কি স্টেট লাগবে ? দরদি রাষ্ট্র লাগবে। বাজারের প্রতিযোগিতায় যে লোকটা পারছেনা তার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রের কাজ হবে মানুষের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করা। ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করে সে যেন বাজারে অংশগ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। বাজারটা কিরকম হবে ?
ফ্লোরা সরকার: একদিকে বলা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক বাজার। আবার অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে বাজারে সবাই প্রতিযোগিতা করতে পারছেনা।
ফরহাদ মজহার: খুব ভালো। দেখেন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কিন্তু দোষ নাই। কিন্তু আপনি যখন প্রতিযোগিতায় নামছেন, আপনি কিন্তু প্রতিযোগিতা করতে দিচ্ছেন না। কেন ? আপনি সার্পোট করছেন বিগ বিগ কম্পানি --সামিট বা অন্য বড় সব কম্পানি। বাজার তো খারাপ না। আমাদের ভাগ করতে হবে কি ? বাজার বনাম পুঁজিতান্ত্রিক বাজার, বাজার বনাম মনোপলি, বাজার বনাম অল্প কয়েকটা কম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাজার, ইত্যাদি। তাহলে আমাদের রাজনীতির মূল দাবিটা কি এখন ? জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পরে প্রধান ইস্যুটা কি ?
ফ্লোরা সরকার: সঠিক বাজার ব্যবস্থা।
ফরহাদ মজহার: অবাধ বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং আমাদের এমন বাজারের কল্পনা করা দরকার যেখানে মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারবে। এখন আপনি যদি বলেন, এটা রাষ্ট্র করে দিবে, সেটা করা যাবেনা। কেন ? ঐ যে পুরানো সমাজতন্ত্র করেছিল। ব্যক্তির উদয় যখন হলো, ব্যক্তির মধ্যে যে উদ্যোগটা তৈরি হলো, তার নিজের স্বার্থে যে প্রণোদনাটা এই প্রণোদনা নষ্ট করলে কিন্তু আপনি অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারবেন না। যেটা আমরা অতীতে দেখেছি।
ফ্লোরা সরকার: বিষয়টা আরেকবার বুঝিয়ে বলেন।
ফরহাদ মজহার: ব্যক্তি যদি নিজে তার স্বার্থটা না দেখে বা দেখতে না পায় এবং তার জন্যে নিজে প্রণোদিত বোধ না করে, তখন ব্যক্তি তো রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে যাবে। তাহলে তাকে তো অবশ্যই প্রতিযোগিতায় থাকতে হবে। তাকে তার প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে তারও ডেভেলপমেন্ট লাগবে। তাকে তো আপনি ভেজিটেবল বানাতে পারেন না। পুরানো সমাজতন্ত্র আমাদেরকে ভেজিটেবল বানিয়ে দিচ্ছিলো। উল্টোদিকে নতুন ইকোনমি বলছে সবকিছুকে বাজার করে দাও। দুটোই এক্সট্রিম। এই দুই এক্সট্রিম থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। দুটোই খারাপ। এটাই এখন আমাদের এক নম্বর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এটা কিন্তু ইকোনমি না। আমরা মনে করি ইকোনমি। একদম না। এটাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এইজন্যই অর্থনৈতিক দিক থেকে ‘গঠন’ কথাটা আমি বলি। গঠন কথাটার অর্থ হলো এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ নতুন করে গঠন। আপনি বলবেন ইকোনমি আমি বলবো না। এটাই পলিটিকাল। আমি ফুকো, মার্কস, আগামবেন পড়ে আসার পর বলবো এটাই মূল জায়গা। তাহলে গঠন কথাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ ? এই গঠন থেকে সব বেরিয়ে আসবে। আমাদেরকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে বের করতে হবে। এবং শুধু তাই না, অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে একটু আগে যে আলোচনাটা করেছিলাম, এই নারী-পুরুষ সম্পর্কও নতুন করে বের করতে হবে। প্রেমও নতুন করে বের করতে হবে। প্রেম বলতে আমরা কি বুঝি ? প্রেম থাকবে বলে কি আমি সন্তান নিবনা ? সন্তান লাগবেনা? তাহলে প্রজাতি পুনরুৎপাদনের চিন্তাটাও নতুন করে করতে হবে। আমি সমাজকে ভালো সন্তান উপহার দিবো। ভালো সন্তান উপহার যদি দেই তাহলে আমি আগাবো ? কিন্তু কিভাবে ভালো সন্তান উপহার দিবো ? আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু সেই শিক্ষা কি স্কুল দিতে পারবে ? মায়ের চেয়ে একটা মাস্টার কি বেশি শিক্ষা দিতে পারে ? তাহলে আমাদেরকে মায়ের রোলও ( ভূমিকা ) নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হবে। কিন্তু মায়ের রোলের কথা বললে দেখবেন প্রচলিত নারীবাদ বিরোধিতা করবে। তাহলে মায়ের রোল বাদ দেন। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারের যে একটা ভূমিকা, এটাকে তো শক্তিশালী করতে হবে। অর্থাৎ প্রত্যেকটা পরিবারকে একটা করে শিক্ষা নিকেতন করে গড়ে তুলতে হবে।
বাচ্চারা স্কুলে কেন যায় ? যাবার দরকারটা কি ? স্কুলে যাবে দশজনের সাথে মিশতে। সামাজিক হতে। আর এখন তো তার সব ঘরেই আছে। কম্পিউটার-টম্পিউটার সব টিপতে পারে। ফলে পুরা শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে আমাদের। খেলার মধ্যেই তো সব শিখতে পারে। আজকে যে বিলগেটস, জুকারবার্গকে দেখছেন, এরা তো সব ড্রপ আউট। তাহলে আর এডুকেশন দিয়ে আপনি কি করবেন ? হ্যা লাগবে। যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শেখাবেন। প্রত্যেকটা কারখানা একটা করে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। আমাদের দরকার কি আলাদা করার ? এডুকেশন এবং প্রডাকশনকে আমরা আলাদা করবো কোন্ দুঃখে? কারখানায় সে তার স্কিল ডেভেলপ করছে। আর লাগবে একটা পাওয়ারফুল কালচারাল এথিক্স।
এটার কথা কেন বলছি? ঐ যে নীতি-নৈতিকতার কারণে। এই নীতি-নৈতিকতার বিকাশের জন্যে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব লাগবে। এবং একালের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বিপ্লব মানেই ধর্মীয় বিপ্লব, যার লক্ষ্য আত্মিক বিকাশ। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য ক্যাপিটালিজমের বিপরীতে বিনোদন দেয়া না। নতুন নতুন নীতি-নৈতিকতা তৈরি করা। আর ক্যাপিটালিজম কি করে ? অ্যাডভারটাইজমেন্ট। ক্যাপিটালিজম আমাদের কালচার দিতে পারেনা, ক্যাপিটালিজম আমাদের শুধু অ্যাডভারটাইজমেন্ট দেয়। কম্পানির পক্ষে অ্যাডভেটাইজ করে। যা কিছু ক্যাপিটালিজম করে সেটা পণ্য তৈরি এবং পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন। তাই বিজ্ঞাপনকে সংস্কৃতি বলা যায়না। কাজেই বিজ্ঞাপনের বিপরীতে আমাদের একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন লাগবে, নতুন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র আমাদের তৈরি করতে হবে।
ফ্লোরা সরকার: খুব ভালো। কিন্তু আপনি যখন বললেন, একালের সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো, ধর্মীয় আন্দোলন।
ফরহাদ মজহার: একালের ধর্ম এবং সংস্কৃতির মধ্যে কোন তফাৎ নাই। কারণ ধর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আত্মার যত্ন। সংস্কৃতির উদ্দেশ্যও হবে আত্মার যত্ন নেয়া। একই কথা। সংস্কৃতি কমোডিটি বা বিনোদনের পণ্য হয়ে উঠেছে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে। ফলে ধর্ম কথাটা ঐ যে শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ,কালাম পড়া না। আমি কি নামাজকালাম বাদ দিতে বলছি ? না বলছিনা। এর দ্বারাও আপনি আত্মার যত্ন করতে পারেন। কিন্তু এর দ্বারা যদি আপনি আত্মার যত্ন না করে কয়দিন পরপর এসে ওয়াজ করেন যে, দাসীর সাথে সহবাস করা বৈধ নাকি ইসলামে? এটা তো ধর্ম না। এটা দিয়ে তো ওয়াজিয়ান ট্রাইবাল সমাজে, বহু দূরের অতীতে চলে গেছে, এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। তাহলে ইসলাম বলতে যারা দাবি করে, আমি ইসলামি, আসলেই কি ইসলামে এটা বলেছে ? এটা তো প্রশ্ন করতে হবে। এই প্রশ্নটা কারা করবে? কারা তোলে। সেটা তোলে দর্শন।
ফ্লোরা সরকার: এই পয়েন্টে আগেই আমি একটা প্রশ্ন তৈরি করে রেখেছিলাম, ধর্মের সাথে দর্শনের পার্থক্য তাহলো কোথায় ?
ফরহাদ মজহার: ঐ যে চিনাবাদাম। ধর্মের সাথে দর্শনের পার্থক্য হলো, ধর্ম হলো চিনাবাদাম আর দর্শন হলো শাঁস।
ফ্লোরা সরকার: মানে দর্শন আরও ভেতরের জায়গা ?
ফরহাদ মজহার: ভেতরের না। বের করে আনতে হবে। দর্শনের কাজ ক্রিটিক করা। ধর্ম কি করে? ধর্মের মধ্য দিয়েও আমরা চিন্তা করি, কিন্তু চিন্তার একটা রূপ আছে। তাহলে চিন্তার ধর্মতাত্ব্বিক রূপখসিয়ে তাকে চিন্তার স্বরূপে হাজির করে দর্শন। তাছাড়া আমাদের ভেতরে সহজাত নানান রকম বৃত্তি আছে, এই বৃত্তির বিকাশটা আমাদের দরকার। এই বৃত্তিকে ধরিয়ে দেওয়া এবং তাদের বিকাশ নিশ্চিত করবার কাজ করে দর্শন।
ফ্লোরা সরকার: কিন্তু এতে করে কি আমরা ধর্মকে খাটো করছিনা ?
ফরহাদ মজহার: না। আমি আসছি এই বিষয়ে। আপনি যখন মায়ের পেট থেকে বের হয়েছেন তখন আল্লাহর কাছ থেকে কি কি নিয়ে আসছেন ?
ফ্লোরা সরকর: আল্লাহর কাছ থেকে আমি কথা নিয়ে আসছি, শরীর নিয়ে আসছি।
ফরহাদ মজহার: কল্পনা নিয়ে এসেছেন বুদ্ধি নিয়ে আসছেন। আরও নানান বৃত্তি, আরপ অনেক কিছু নিয়ে আসছেন। কিন্তু কোরআন শরীফ নিয়ে কি এসেওছেন? না। আল্লাহ কেন কোরআন শরীফ আপ্নার জন্মের সময় আপ্নার জাতে ধরিয়ে দিয়া পাঠান নাই?
ফ্লোরা সরকার: পাঠায় নাই কারণ, আমাদের বিবেক, বুদ্ধিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
ফরহাদ মজহার: এই যে ঢুকলাম। এই তো ঢুকলাম আমরা দার্শনিক আলোচনায়। দর্শনের কাজ বুদ্ধি সহ আমাদের সহজাত বৃত্তির বিকাশ। একে আপনি রুহানি বিকাশ বলতে পারেন, অর্থাৎ জীবমাত্র না থেকে জীবের অতিরিক্ত কিছু হবার চেষ্টা করা।
কোরআন নিজেকে কি বলে ? এটাকে কি আইনের বই বলে ?
ফ্লোরা সরকার: না।
ফরহাদ মজহার: হুদালিন মুত্তাকিন অর্থাৎ যারা আত্মসমর্পণকারী, তাদের জন্যে এটা উপদেশের বই। হেদায়েতের বই। আইনের বই না। এখন আপনি যে হেদায়েত নিবেন বা পরামর্শ নিবেন, এটা নিতে গেলে কি লাগবে আপনার? কোরআন পড়ে আপনি হেদায়েত পেতে চান। কেন পেতে চান ? পেতে চাই এই কারণে যে আপনার ভেতরে যে বিবেক, বুদ্ধি অর্থাৎ আপনার ভেতরে যে বৃত্তিটা আল্লাহ দিয়েছে, সেটার বিকাশ করতে আপনি চান। এই বৃত্তিটা কিন্তু গিভেন। আপনাকে কিন্তু এসব দিয়েই দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে। আপনাকে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি করা হয়েছে এই কারণে যে, আল্লাহ বলছেন সব বৃত্তি দিয়েছি তো আমি। এখন কোরআন পড়ে, কখন কি করতে হবে সেটা বুঝে যাবেন।
তো আপনি বৃত্তি-টিত্তি কোনকিছুর ব্যবহার করেন না। শুধু এটাকে বই আকারে পাঠ করেন। তাহলে আপনি কি ইসলাম বুঝবেন? না। এবং ইসলামের পতনটা হয়েছে ঠিক এভাবে। ইসলাম পড়ে গেছে এভাবে পাশ্চাত্য থেকে, পাশ্চাত্যের পেছনে। আপনি তো শোনেন নাই। আপনি খেয়ালই করেন নাই যে আপনাকে খলিফা আকারে দুনিয়তে পাঠানো হয়েছে। ‘খলিফা’ কথাটার মর্মও বোঝেন নাই। আর আপনি কোরআন পড়তে শুরু করছেন। আপনার ধারণা, আল্লহর বোধহয় একটা প্রিন্টিং প্রেস আছে, ওখানে কোরআন ছাপায়ে ছাপায়ে পাঠায়ে দিছে।
ফ্লোরা সরকার: খুব ভালো লাগলো। এখন আলাদা একটা প্রশ্ন করি, সেটা হলো, আপনি বোধহয় প্রথম বলেছিলেন বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার খুব দরকার। কেন দরকার ?
ফরহাদ মজহার: আমাদের বড় দুটো শত্রু দেশ আছে। ভারত আর মায়ানমার। আপনি শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। আপনার কি মনে হয় বর্তমান সেনাবাহিনী দিয়ে আপনি দেশকে রক্ষা করতে পারবেন? তাহলে আমাদেরকে প্রতিরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই প্রতিরক্ষা নতুন করে ভাববার জায়গা থেকে আমি বলেছি যে আমাদের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা লাগবে। কিন্তু তার সাথে এটাও যোগ করেছি, জানিনা আগের বইটাতে পরিষ্কার করে আছে কিনা। সেটা হলো, যখন একটা গরীব ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাস করবে অথবা যারা ইন্টারমিডিয়েট পাস করবে তারা দুইটা বছর বৃত্তি পাবে। রাষ্ট্রীয় বৃত্তি। এই দুই বছরের বৃত্তিতে সে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা নেবে। সেনাবাহিনীতেই তার চাকরি হবে। এবং সেনাবাহিনীতেই সে পড়বে। সেনাবাহিনীতে যে দক্ষতা লাগে, তার টেকনিকাল স্কিল, যা যা দরকার সেই শিক্ষা সে সেই সময়েই নেবে। অর্থাৎ ইন্টারমিডিয়েটের পরে ইউনিভার্সিটিতে যাবার যে দুটো বছর লাগে। আপনি যদি দেশের নাগরিক হতে চান তাহলে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা লাগবে। এতে যে সুবিধা হবে সেটা হলো আপনি এর মধ্যে দিয়ে একটা ডিসিপ্লিন মানব সম্পদ তৈরি করছেন, যা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দরকার শিক্ষাকে যদি সঠিকভাবে হাজির করতে পারেন, সত্যিকারের শিক্ষা – তাহলে সেটা সম্ভব।
সামরিক শিক্ষা বলতে শুধু অস্ত্র চালনা না, আমি যে আত্মার যত্ন কথাটা বলছিলাম, সামরিক শিক্ষার সাথে তার যোগ করতে পারলে আপনি অত্যন্ত উন্নত একটা নাগরিক তৈরি করতে পারছেন। ঐ শিক্ষার পরে তার আর তথাকথিত উচ্চ শিক্ষার দরকার নাই। এরমধ্যে তার একুশ/বাইশ বছর হয়ে গেছে, সে তখন কিছু একটা করে খেতে পারবে। আর যারা একাডেমিক লেভেলে যেতে চায় তখন তারা হাইয়ার এডুকেশনে চলে যাবে। তাহলে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়গুলোকে মিলিটারি ডিভিশনের লেভেলে আনতে হবে। আলাদা করে ক্যান্টনমেন্টে বানাবার দরকার নাই। বলতে পারেন ক্যান্টন্মেন্টকেই বিশ্ববিধ্যালয়ে পরিণত করুন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ছিল তেমন থাকবে কিন্তু পাশাপাশি সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আপনি যখন নতুন ভাবে বাংলাদেশ গঠন করবেন তখন প্রত্যেকটাকে ক্ষেত্রে নতুন করে গঠন করতে হবে। ‘গঠন; কথাটা অনেক বিস্তৃত ও গভীর ধারণা।
ফ্লোরা সরকার: এই কারণেই আপনার শেষ বই গণঅভ্যুত্থান ও গঠনে গঠনের উপর এতো গুরুত্ব দিয়েছেন ?
ফরহাদ মজহার: একদম তাই।
ফ্লোরা সরকার: তাহলে আপনার সেই বই ধরে আরেকটা প্রশ্ন করি, আপনি যে গঠনের উপর বারবার এতো জোর দিচ্ছেন, তাহলে কি আমরা ধরে নিবো যে বাহাত্তর সাল থেকে যদি ধরি, তখন থেকে এই ২০২৪ সাল পর্যন্ত -- বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা কখনও গঠিত হয় নাই ?
ফরহাদ মজহার: বাংলাদেশ রাষ্ট্র কখনই গঠিত হয় নাই। আমাদের এখানে রাষ্ট্রের কোন ধারণাই নাই। গঠন হবে কিভাবে ? আমাদের সমাজই তো নাই, রাষ্ট্র হবে কিভাবে ? সবাই শুধু রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে। আমাদের এখানে সবাই সরকার বোঝে, রাষ্ট্র বোঝে না।
ফ্লোরা সরকার: আপনি বলেছেন বাইরের শত্রু থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে এবং এই জন্য সামরিক শিক্ষা দরকার। আমার প্রশ্ন ভারত আমাদের শত্রু না মিত্র ?
ফরহাদ মজহার: উত্তর খুব সহজ। আপনি যদি নিজেকে রাষ্ট্র বলে দাবি করেন, তার মানে হলো সব রাষ্ট্র আপনার সম্ভাব্য শত্রু -- এটাই হলো রাষ্ট্রের সংজ্ঞা। রাষ্ট্র মানেই সম্ভাব্য শত্রু দ্বারা আপনি বেষ্টিত। যদি আপনি রাষ্ট্র না হন, তাহলে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে যান না কেন ?
ফ্লো্রা সরকার: ধর্মের কথায় একটু যেতে চাই। এখানে যখনই ধর্মের কথা ওঠে, সব সময় কেন শুধু ইসলাম ধর্মের কথা উঠে। কেন অন্যান্য ধর্মের কথা ওঠেনা? আমাদের এখানে কি অন্য ধর্ম নাই ? অন্য ধর্ম নিয়ে কি আমরা কথা বলতে পারিনা ?
ফরহাদ মজহার: হ্যাঁ। আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমরা ইসলাম নিয়ে কথা বলি তার প্রধান কারণ আমাদের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। কিন্তু অন্য ধর্ম নিয়ে তো আমি সারাক্ষণ কথা বলছি। শুধু হিন্দু বা খ্রিস্টান নয়, রাম মোহন রায়ের দিকে তাকান, ব্রাহ্মদের ইতিহাসের দিকে তাকান। তারা পৌত্তলিক ছিল না। ব্রাহ্মণরা ছিল মনোথেয়িস্টিক বা একত্ববাদী। বেদ, উপনিষদ ছিল একত্ববাদী। একত্ববাদ তো ইসলামের একচেটিয়া না। আপনি একত্ববাদ নিয়ে আলোচনা করলে তো সবাইকে নিয়ে, সকল প্রকার একত্ববাদ নিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একত্ববাদ, মানে তৌহিদি জনতা নিয়ে কথা বললেও তো সব প্রকার একত্ববাদির প্রসঙ্গ আসবে। ঔপনিবেশিক হিন্দু তো একত্ববাদী। একত্ববাদের আলোচনায় ওকে বাদ দিবেন কেমনে ? আরবি শব্দ ‘তৌহিদ’ ব্যবহার করলেও তো সব হিন্দু বাদ পড়ছে না। একত্ববাদ চলে যাচ্ছেনা। আহাদ বা এক থেকে তৌহিদ। দার্শনিক হিসাবে তাহলে আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে, বেদের যে একত্ববাদ আর ইসলামের যে একত্ববাদ এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? এটা দর্শনের তর্কের বিষয়। ইসলামের একত্ববাদের যে আলাদা গুরুত্ব আছে, বা আদৌ আছে কনা – এ তর্ক তো তো আপনাকে জারি রাখতে হবে। এই তর্ক আমি লরি, আমি ছাড়া কেউ জারি রাখেনা। কারন দর্শন তাদের বিষয়না। আমরা পরিচয় দিয়ে ধর্ম ভাগ অরি, এটা পরিচয়বাদিতার পরিণতি।
বা জ্ঞানতাত্ত্বিক না। ইসলামের একত্ববাদের তর্ক নির্ভর করছে, গায়েবি আত্মসমপর্নের জায়গায়। ইসলাম একত্ববাদী ঠিকই, কিন্তু এই একত্ববাদ এপিস্টোমলজিক্যালি না, অর্থাৎ জ্ঞানতাত্ব্বিক না। বেদ, উপনিষদেও একত্ববাদ, কিন্তু সেটা জ্ঞানতাত্ত্বিক, অর্থাৎ বুদ্ধির দ্বারা তা নির্ণয় সম্মভব। জিন্তি যা ‘হায়েব’ , নাই বা নিত্য অনুপস্থিত তাকে বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করা যায় না। সেই জন্য যা নাই বা গায়েব সেই নিত্য অনুপস্থিতির প্রতি ‘আত্মসমর্পনের তর্ক আসে।
আর, অন্যদিক থেকে ইসলামের একত্ববাদ হচ্ছে পলিটিক্যাল। আপনি যদি ‘এক’ কে না মানেন, তাহলে তো আপনি রাষ্ট্রই গঠন করতে পারবেন না। কারণ এককে মানলে, একের অধীনে আমরা সবাই নিজেদের দাখিল করতে পারি, সকলকে নিয়ে একটা বিশ্বসমাজ বা উম্মাহ গঠন করতে পারি। এভাবে ‘এক’-এর ধারণা বা ‘এক’-এর কাছে আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়েই আমরা সকলে মিলে বিশ্বসমাজ বা উম্মাহ গড়ে তুলতে পারব। এই জন্যই ইসলামের একত্ববাদের বৈশিষ্ট্য বা অপরাপর একত্ববাদ থেকে পার্থক্য হোল পার্থক্য ইসলামের একত্ববাদ জ্ঞানতাত্ত্বিক না। আল্লাহ দেশকালপাত্রে ‘আছে’ – এটা ইসলামের দাব না। ইসলাম বলে যে, আল্লহ এক হতে পারে, কিন্তু তিনি ‘গায়েব’ কিন্তু মানুষের উচিত এই গায়েবেরই উপাসনা করা।
ঠিক করে শোনেন, মানুষের উচিৎ এমন এক ‘এক’-এর উপাসনা করা যিনি নিত্য অনুপস্থিত, যিনি ‘নাই’ – অর্থাৎ জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবে ‘নাই’, কিন্তু মানুষের উপলব্ধির মধ্যে, মানুষের মধ্যে বিরাজ করেন। তিনি যা আছেন তার প্রমাণ স্বয়ং মানুষ। তাই মানুষ আল্লার ‘খলিফা’ বা আল্লার ‘চিহ্ন’ – প্রতিনিধি। তাই ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন তারা আদমকে সেজদা করে। তাই আল্লাহ ‘এক; এভাবে বলা ইসলামের তরিকা না। এখানে ইসলাম থেমে থাকেনা। বেদ, উপনিষদ ব্রহ্মকে ‘এক’ বলে, কিন্তু ইসলাম বলে, মানুষের উচিৎ একের উপাসনা করা। অর্থাৎ এখানে ঐচিত্যের তর্কও এসে যায়। উচিত কেন? কারন এ ছাড়া বিশ্ব সমাজ বা উম্মাহ গড়া যাবে না। এই কারণেই ইসলাম পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করে। প্রত্যকে যদি পৃথক পৃথক প্যুল্পূজা করে তাহলে ট্রাইবাল সমাজের মতো মানুষ সবসময় ভাগ হয়ে থাকবে, বিভক্ত থাকবে। তার মানে আপনি যদি সরস্বতী পূজা করেন, দুর্গা পূজা করেন আর কেউ যদি মক্কায় কাবা প্রদক্ষিণ করে ০০ তাহলে তো মানুষ ভাগ হয়ে গেল। এভাবে ভাগ হয়ে গেলে তো পৃথিবীর মানুষকে আমরা আর এক করতে পার না। তাই যদি বলেন, মানুষের উচিৎ শুধি একের উপাসনা করা, অথচ যিনি গায়েব বা নিত্য অনুপস্থিত -- তাহলেই মানুষ নিজের মধ্যে আল্লাহকে খুঁজে পাবে, অপরের সঙ্গে এক হবার, সকলে মিলে বিশ্ব সমাজ গড়বার প্রণোদনা খুঁজে পাবে। ইসলামকে আমরা এখনও পুরাপুরি বুঝে উঠতে পারি নি।
ফ্লোরা সরকার: আপনার মোকাবেলা বইয়ে আপনি ধর্মের পর্যালোচনা বলতে বলেছেন, ধর্মের মধ্যে চিন্তা যেভাবে নাজিল হয়। কি বুঝিয়েছেন এটা বলে ?
ফরহাদ মজহার: ঐ যে চিনাবাদামের কথা বলেছিলাম। চিন্তা সব সময় দর্শন। চিন্তা সব সময় বুদ্ধি বা যুক্তির জায়গায় দাঁড়িয়ে যা নেসেসারি এবং ইউনিভার্সাল সেটা আবিষ্কার বা প্রতিষ্ঠিত করে। চিন্তা সেটাই আবিষ্কার করে যা সার্বজনীন এং অনিবার্য। চিন্তার যুক্তি দ্বারা যে সিদ্ধান্ত অনিবর্যরূপে হাজির হয় এবং যা সার্বজনীন সেটাই দর্শনের আরাধ্য। চিন্তার এই চরিত্রকেই বলে দর্শন। ধর্মও দর্শন। কিন্তু ধর্ম দর্শনের আকারে হাজির থাকেনা।
মানেটা কি ? বুদ্ধির রূপে, বুদ্ধি যেভাবে যুক্তি দেখায় বুঝায়ে বুঝিয়ে বক্তব্য হাজির করে, দর্শন এই বুদ্ধির যুক্তির দ্বারা বুঝায়ে বুঝিয়ে দেখায় যে সে একটা সিদ্ধান্ত থেকে আরেকটা সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্তভাবে নিষ্পন্ন করেছে। ধর্মতত্ত্বে এটার দরকার পড়েনা। ধর্ম বলে হাদিসে যা আছে সেটা সত্য, কোরআন বলছে তাই সত্য। ধর্ম কিন্তু বুদ্ধির কাছে সব সময় যায়না। অর্থাৎ বুদ্ধির দ্বারা সব তর্ক নিষ্পন্ন করা বুদ্ধির কাজ না। তাহলে পর্যালোচনার অর্থ হলো আপনি বুদ্ধির দ্বারা ধর্মের উপলব্ধি, বক্তব্য বা সত্য -- যা ধর্ম বলছে -- সেই সত্যটা ব্যাখায় করবেন, তার কোন সার্বজনী ও অনিভার্য সত্য থাকলে তাকে বুদ্ধিরস্বরূপে হাজির করবেন। ধর্মের সত্য আপনি বুদ্ধির দ্বারা প্রমাণ করবেন। এটাই তফাৎ।
ফ্লোরা সরকার: তাহলে তো হেগেল ঠিকই করেছিলেন। উনি চিন্তার জায়গা থেকে ধর্মের পর্যালোচনা করেছিলেন। আর ফয়েরবাখ করেছিলেন মানুষের জায়গা থেকে। তাহলে আমি বলবো হেগেলই ঠিক করেছিলেন।
ফরহাদ মজহার: না। দুজনই ভুল করেছিলেন। দুরকম ভুল করেছিলেন। হেগেলের ভুলটা হলো, উনি যখন ইতিহাস চিন্তা করেছিলেন তখন তিনি মানুষের ইতিহাসের কথাই বলছেন। কিন্তু রক্তমাংসের মানুষকে বাদ দিয়ে গেছেন। তিনি চিন্তার ইতিহাস বয়ান করতে নেমেছিলেন। কারণ চিন্তা তো হাওয়ায় ভাসেনা। কোন না কোন জীবিত মানুষের কাছ থেকে চিন্তা আসে, চিন্তা উৎপাদিত হয়।
আমি যদি কালকে মরে যাই, তাহলে আমার লাশটা পড়ে থাকবে, আমি তো আর কথা বলতে পারবোনা। তাহলে চিন্তা মাত্রই জীবিত মানুষের চিন্তা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে সেই জীবিত মানুষ কি করে বর্তমান থাকে ? অর্থাৎ জীবিত মানুষ কি করে ইহলৌকিকভাবে বর্তমান থাকে। এর রহস্য তো আগে বের করতে হবে। তাহলে সে কি করে বর্তমান থাকে তার এই বর্তমান থাকার পদ্ধতি এবং প্রকরণটা বুঝলে মার্কস বলছেন তার চিন্তার ধরণও বোঝা যাবে। ফলে হেগেলে থেকে ফয়েরবাখ, ফয়েরবাখ থেকে মার্কস -- এই ধারায় শক্তিশালী বিপবী চিন্তা ও বা জগত বচারের পদ্ধতি বিকশিত হয়েছে। খুব সহজ ব্যাপার।
আপনাকে আগে এই সমাজকে বুঝতে হবে, সমাজের বৈষয়িক ভিত্তি বুঝতে হবে, সমাজের ইহলৌকিক যে বৈশিষ্ট সেটা বুঝতে হবে -- বুঝতে পারলে এই সমাজে ‘ আমি ’ বলে যে সত্তাটা নিজেকে চিহ্নিত করে তাকেও বোঝা যাবে। সে যে কথাটা বলে সেই কথাটার মানেটা কি সেই মানে বুঝতে পারবেন।
ফ্লোরা সরকার: শেষ প্রশ্ন-- অন্তবর্তীকালীন এই সরকারকে অনেকে শিবির বা জামাত অর্থাৎ ইসলামিস্ট সরকার বলছে। কেন ?
ফরহাদ মজহার: এটা একটা প্রপাগান্ডা। শোনেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ না থাকলে মনে করা হয় বাকি সবাই ইসলামিস্ট। আওয়ামী লীগ থাকলে মনে করে ইসলাম নাই, ইসলাম অদৃশ্য হয়ে যায়। সেকুলার আর আওয়ামী লীগ না থাকলে তাই সবাই মনে করে বাংলাদেশ ইস্লামিস্টে সয়লাব হয়ে গিয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো এমন নৃশংস ফ্যাসিস্ট সরকার এই সমাজে কখনও আসে নাই। এবং এখন আবার ইসলামি জাতিবাদ, অর্থাৎ জাতিবাদী মুসলমানদের হুংকার আমরা দেখছি, যেহেতু তারা একটা শিথিল সরকার পেয়েছে। কিন্তু মানুষ গণ অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ইসলাম বনাম সেকুলারিজমের বিভাজনের দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার কথা শুনে বুঝতাছেন বাংলাদেশ এগিয়ে চলে গেছে। তরুণরা আর পেছনে ফিরে তাকাবেনা। জুলাই অভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশ আর কখনও ফিরে যাবেনা।
ফ্লোরা সরকার: তার মানে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে আপনি আশাবাদি ?
ফরহাদ মজহার: আশার কথাটা ভিন্ন। আমি তো ক্রিটিক করবো। আমি যেমন সরকার চেয়েছি, সেটা পাইনি। সেটা ভিন্ন আলাপ। আমি তো একটা পূর্ণ বিজয় চেয়েছি। পূর্ণ বিজয় পাইনি। আমার এখনকার কাজ হলো, একটা পূর্ণ বিজয়ের দিকে জনগণকে নিয়ে যাওয়া। যে জনগণের অবির্ভাবটা ঘটেছে ৫ আগস্টে, এই জনগণকে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া আমার রাজনীতি। আগামী দিনে আমি এই রাজনীতিই করবো।
এই লেখাটি সাম্প্রতিক দেশকাল-এ প্রকাশিত হয়: এই শিরোনামে: ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে: ফরহাদ মজহার#mce_temp_url#