গণঅভ্যুত্থান, সেনাবিহিনী এবং আমাদের এখনকার বাস্তবতা

১.
হাসনাত আব্দুল্লাহ’র ফেইসবুক স্ট্যাটাস (২১ মার্চ রাত ১: ৪৪টা) নিয়ে তুলকালাম চলছে কয়েকদিন ধরে। এই স্ট্যাটাস এমন সময় এসেছে যখন প্রধান উপদেষ্টার চিন যাবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও ভূরাজনৈতিক ইস্যু হিশাবে সামনে রয়েছে এবং প্রবল প্রকট উলঙ্গ ভাবে ভারতীয় গণমাধ্যম সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃংখলা ও সেনা অভ্যুত্থান ঘটাবার জন্য তৎপর রয়েছে। এমনই একটা সময়ে হাসনাত জানিয়েছেন সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন, তাপসকে (বা সোহেল তাজকে) সামনে রেখে “রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ” বানানো ও পুনর্বাসনের পরিকল্পনা চলছে এবং সেটা করছে সেনাবাহিনী। হাসনাত জানিয়েছেন তাদেরকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একথা বলা হয়।
পরে সারজিস তার পোস্টে “স্পষ্ট করে” জানিয়েছেন, “সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি বরং সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইজারের সাথে যখন প্রয়োজন হতো তখন ম্যাসেজের মাধ্যমে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ও উত্তর আদান-প্রদান হতো”।
সারজিস আরও লিখেছেন, “আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের বক্তব্যকে সরাসরি ‘প্রস্তাব’ দেয়ার আঙ্গিকে দেখিনা বরং ‘সরাসরি অভিমত প্রকাশের’ মতো করে দেখি। ‘অভিমত প্রকাশ’ এবং ‘প্রস্তাব দেওয়া’ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে”।
তবে এর আগে হাসনাত জানিয়েছিলেন, ১১ই মার্চ, সময় দুপুর ২: ৩০ টার সময় তিনি সহ আরও দুইজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করে বলা হয়, আসন সমঝোতার বিনিময়ে যেন ছাত্র-তরুণদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP) এই প্রস্তাব মেনে নেয়। নিশ্চিত করা হয় ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দল শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো। রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।
সারজিস আলমের পোস্ট ছাড়াও নেত্র নিউজকে দেয়া সেনাসদরের এক বিবৃতিতে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেই ১১ই মার্চ বৈঠকটি হয়েছিল। তবে হাসনাত আব্দুল্লাহকে সেনাপ্রধান বা সেনাবাহিনী ডেকে নিয়ে যায় নি। “আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগে”র অভিযোগও আসলে ঠিক নয়। হাসনাত আব্দুল্লাহ ও তার দলের আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল বলে সঠিক ভাবেই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। আশা করি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-তরুণদের বিরোধ ও দূরত্ব এখানেই শেষ হবে।
আগাম সতর্কতা হিশাবে চিন সফরের কথা মনে রেখে এবং ভারতীয় গণমাধ্যম এবং দিল্লীর প্ররোচনা নস্যাৎ করার জন্য আমরা এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে দূরত্ব কমাবার কথা বলেছি। এখন ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দূরত্ব বাড়াবার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীতে উচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং সেনা অভ্যুত্থানের উসকানি দেবার চেষ্টায় যারা ঘি ঢালছেন তাঁরা দেশ ও দশের কথা ঠাণ্ডা মাথায় ভাববেন আশা করি।
আমার এ লেখাটি কয়েক কিস্তিতে পেশ করব। আশা করি গঠনমূলক আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এখনকার কর্তব্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিচক্ষণ হব।
২.
ওদিকে আসিফ মাহমুদ জানিয়েছেনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ডক্টর ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা হিশাবে সেনাপ্রধান চান নি, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা এবং শাস্তির রায় ছিল। আসিফ একথা এখন বলছেন কেন? এটা পুরাপুরি ঠিক কিনা সেটা সেনাপ্রধান নিজে মুখ না খুললে আমরা জানবো না।
মনে করিয়ে দিচ্ছি, ৫ থেকে ৮ তারিখের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু ডক্টর ইউনূস ছিলেন না, সেটা ছিল ছাত্র-তরুণরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার গঠন করবে নাকি শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে আধা-খেঁচড়া অবৈধ সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করবে? শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান সুরক্ষার শপথ নিয়ে, প্রেসিডেন্ট হিশাবে সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে রেখে এবং শেখ হাসিনার নিযুক্ত তিন বাহিনীর প্রধানকে স্ব স্ব পদে রেখে সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠনের আইডিয়াটা আসলে কার? এই আইডিয়ার সঙ্গে কি মাহফুজ, নাহিদ বা আসিফ জড়িত? যদি না থাকেন তাহলে তারা এ ধরনের সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকারে যোগ দিলেন কেন?
এখন আবারও বলি, পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুযোগ তখনও ছিল, এখনও রয়েছে, যদি সেনাবাহিনীকে আমরা আস্থায় আনতে চেষ্টা করি এবং বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার গুরুত্ব বোঝাতে পারি। কিন্তু মাহফুজ, নাহিদ, আসিফ এবং ছাত্র-তরুণদের সামনের সারির কোন নেতাই আজ অবধি এই বিষয়টা আমাদের ব্যাখ্যা করে বলেন নি, কেন আমাদের বিপজ্জনক আধাখেঁচড়া সেনা সমর্থিত অবৈধ সরকার এখনও মেনে নিতে হচ্ছে?
শুধু তাই নয় আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করলে শেখ হাসিনার সংবিধান বহাল রাখলাম, অথচ একটি সাংবিধানিক অবৈধ সেনাসমর্থিত সরকার গঠন করলাম — এই পরিস্থিতির অর্থ ভয়ানক বিপদের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণকে ফেলে রাখা। এর দায় কার? কে নেবে? এখন কি আমরা নির্বাচনবাদি রাজনৈতিক দল গঠন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়ার সমস্যা সমাধান করতে পারব? সেনাপ্রধান যদি ‘অবৈধ’ উপদেষ্টা সরকারের মতো বিপজ্জনক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নির্বাচনের কথা বলে থাকেন, তাহলে তাঁকে আমি দোষারোপ করব কোন যুক্তিতে? তাঁকে কি আমরা কোন বিকল্প দিয়েছি?
৩.
শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও বংশের লোকজন বাদ দিয়ে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ বানানো আদৌ সম্ভব কি? সেটা আরেক গুরুতর প্রশ্ন। ফলে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের চিন্তা অবাস্তব বলেই আমাদের বাদ দেওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সমাজের চিন্তাচেতনা এবং ক্ষমতার সমীকরণে বিপুল পরিবর্তন ঘটেছে। সেনাবাহিনীর এবং সেনা নেতৃত্বের মধ্যে ইতিবাচক রূপান্তরের অভিব্যক্তি জনগণকে পরিষ্কার বুঝতে দিতে হবে। আওয়ামী লীগ গণশত্রু হিশাবে চিহ্নিত। মনে রাখতে হবে, গণঅভ্যুত্থানকে সম্পূর্ণ করতে দেওয়া হয় নি, তার দায় ছাত্রজনতার নেতৃত্বকে যেমন, তেমনি আংশিক দায় সেনাবাহিনীকেও নিতে হবে। ছাত্র-তরুণদের ক্রমাগত একের পর এক আপোষ করতে বাধ্য করা হয়েছে – তার কুফল নানাভাবে রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের যে কোন আলামত বা চিন্তাই জনগণের কাছে অতিশয় সংবেদনশীল ইস্যু। তাছাড়া ৫ই অগাস্টের আগের ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগ আর ৫ই অগাস্টের পরে উৎখাত হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ এক নয়। তাদের পুরানা দাপটের কথা ভেবে তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করবার চিন্তাও সঠিক নয়। ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী গণচেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগকে আগামি নির্বাচনে পুনর্বাসনের চিন্তা তাই অবশ্যই বাদ দিতে হবে। হাসনাত আব্দুল্লাহর পোস্ট আমি সেভাবেই পড়েছি। তাছাড়া দেখেছি আমাদের আরেক তরুণ নেতা নাসিরুদ্দিন পাটয়ারি বলেছেন, ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনাকে প্রকাশ্যে আনা ঠিক হয় নি। এই বক্তব্যের মধ্যে নাসিরের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় রয়েছে। আমরা ভুল-ত্রুটি থেকেই শিখব, মাথা গরম করে নয়।
৪.
বাংলাদেশের রাজনীতির সংকট আমরা ধরতে ও মীমাংসা করতে পারব না, যদি রাজনৈতিক দল আর জনগণকে আমরা একই কাতারে ভাবি। এই সাধারণীকরন যেমন সেনাপ্রধানের চিন্তার মধ্যে আছে, তেমনি সেটা প্রধান উপদেষ্টার ‘জাতীয় ঐক্যমত’ নামক ধারণা এবং সমাজের এলিট বা অভিজাত শ্রেণীর নেতৃত্বে বিবিধ কমিশন গঠন করে একটা সংস্কারের ফর্মুলা পেশ করার মধ্যেও প্রকট ভাবে বিদ্যমান। এর মানে কি? ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেই ঐক্য ধরে রাখবার কোন আন্তরিক প্রচেষ্টা আমরা কোত্থাও দেখছি না। আমরা সকলেই শুধু নির্বাচনের কথাই ভাবছি। গণঅভ্যুত্থানকে ইতোমধ্যেই কবর দিয়ে ফেলেছি। জনগণের দিক থেকে এই হাল বুমেরাং হতে পারে। জনগণ উপদেষ্টা সরকার ও সেনাবাহিনী উভয়ের প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের আস্থা আগেও ছিল না, এখনও নাই। যদি থাকত, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বেই গণঅভ্যুত্থান হোত। কিন্তু ছাত্র-তরুণরা প্রচলিত নির্বাচনবাদি রাজনৈতিক দলের আদলেই তাদের নতুন দল বানিয়েছে – তাদের রাজনীতির প্রতিও জনগণ খুব আশাবাদী হতে পারছে না। তারা ক্রমশ আস্থা হারাচ্ছে। কথার ফুলঝুরি ও জুলাই অভ্যুত্থানের আগের আবেগ দিয়ে নতুন পরিস্থিতিতে জনগণের মন জয় করা যাবে না।
ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী জনগণের ঐক্যের বিপরীতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ড. ইউনূসের লক্ষ্য হতে পারে না, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়িত করাই তাঁর দায়িত্ব। লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে ঐক্য মজবুত না রেখে রাজনৈতিক বিভক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া সঠিক কৌশল নয়। গণঅভ্যুত্থানকে যদি রাজনৈতিক দলগুলো স্বীকার করে তাহলে সবার আগে দরকার তাদের নিজেদের সংস্কার। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংস্কার করছে না এবং করবে না। অন্যদিকে ড. ইউনূস তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা এখনও বুঝেছেন বলে মনে হয় না। নিজেদের সংস্কার করতে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক দলগুলোকে তুষ্ট করে তড়িঘড়ি নির্বাচন দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার নীতি হিশাবে তিনি গ্রহণ করেছেন। জনগণ এটাই বুঝতে শুরু করেছে। তিনি বুঝতে পারছেন না রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়ে ঐক্য আর ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্য এক কথা নয়। এই দুইয়ের মধ্যে তিনি পার্থক্য করছেন না। এটা বিপজ্জনক এবং জনগণকে হতাশ করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
এই হতাশার মধ্যেই ফ্যাসিস্ট শক্তি পুনর্বাসিত হওয়া শুরু করেছে এবং উপদেষ্টা সরকারের প্রতি জনগণ আস্থা হারাতে আরম্ভ করেছে। এতো আত্মত্যাগের পরও আমরা এখনও এই মৌলিক পার্থক্য করতে শিখি নি। অথচ এই পার্থক্য করবার ক্ষমতাই গণসার্বভৌমত্বের নীতির ভিত্তিতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার সর্ব প্রথম – অর্থাৎ এক নম্বর শর্ত। জনগণ আর রাজনৈতিক দল সমার্থক নয়। একও নয়। ড. ইউনূসকে জনগণই ক্ষমতায় বসিয়েছে, কোন রাজনৈতিক দল নয়। কিন্তু তিনি ইতোমধ্যেই জনগণকে ভুলে গিয়েছেন। অথচ গণঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোন অন্যথা হলে আমরা কখনই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারব না। দিল্লী সেই সুযোগের জন্যই ওৎ পেতে আছে। হাসনাতের পোস্ট ভাইরাল হওয়া জনগণের হতাশার অনুরণন হিশাবে পড়তে জানতে হবে। হাসনাতকে শাসন করা উচিত, সেটা তার কমরেডরাই করছেন, কিন্তু সেনাবাহিনীসহ আমাদের সকলের ভুলগুলো আমাদের নিজেদেরই বুঝতে ও শোধরাতে হবে।
৬.
গুজবের সমুদ্রে সাঁতার কাটবার পুলক বাদ দিয়ে এবার আমরা বাস্তবে ফিরি, সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গে আসি। জনগোষ্ঠি হিশাবে আমরা কতোটা ভঙ্গুর ও ভারনারেবল, সেটা গত কয়দিনের গুজবেই প্রমাণিত। আফসোস, আমাদের সমাজের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা, চমকপ্রদ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও গুজবের গোবর দিয়ে ভর্তি। বাস্তবে আমরা সৈনিক ও সেনাবাহিনীকে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর পাহারাদা্রে পর্যবসিত করে ফেলেছি। এই অবস্থার বদল ছাড়া একতরফা সেনাবাহিনীকে দোষারোপ করার অর্থ নিজেদের কর্তব্য অস্বীকার করা। কই, জুলাই গণভ্যুত্থানের পরে সেনাবাহিনীর সংস্কার ও শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কোন কমিশন তো আমরা গঠন করলাম না? কেন? জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার শক্তি ও অংশীদার হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক এবং পরাশক্তির অধীনস্থ বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে ইতিবাচক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারে। নইলে নয়। সেনাবাহিনীর শত সদিচ্ছা থাকলেও জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিভাজন ও পরস্পরের বিপরীত অবস্থান বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারন হতে বাধ্য। আওয়ামী শাসনামল থেকে এই শিক্ষা সেনাবাহিনী ও জনগণ উভয়েরই ইতোমধ্যে হওয়া উচিত। সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই উপলব্ধি করে জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কখনই রক্ষা করা যাবে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান সেনাবাহিনীর মধ্যে নতুন গণমুখি ও গণতান্ত্রিক উপলব্ধির শর্ত তৈরি করেছে, এইটুকু যদি আমরা অনুমান করতে না পারি তার অর্থ গণঅভ্যুত্থান কাকে বলে সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নাই। আমরা কেউই আর ৫ অগাস্টের আগের সেই ব্যক্তি নই। সেনাপ্রধানও নন। বিশেষত যখন তিনি অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা সরকার, বিশেষত প্রধান উপদেষ্টার প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ্যে জ্ঞাপন করেছেন। নেহায়েত বেকুব ও চোখকান বন্ধ না রাখলে গণঅভ্যুত্থান কোথায় কিভাবে নতুন ইতিহাস তৈরির উপাদান ও সম্ভাবনা তৈরি করে তা আমাদের চোখে পড়বে না। সেনাবাহিনী দেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার বাইরে বাস করে না, ফলে ৫ অগাস্টের আগের সেনাবাহিনী আর তার পরের সেনাবাহিনী এক নয়। কিন্তু সত্য এই যে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের চেতনাগত ঐক্য এবং অভিপ্রায়ের মিল রয়েছে সেটা আমরা কোন পক্ষই প্রমাণ করা জরুরি মনে করি না। উল্টা বিভেদ ও বিভাজন তৈরিতে অতি উৎসাহী হয়ে পড়ি। সেনাপ্রধান এই জন্যই “কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি” বন্ধের জন্য কাতর আহ্বান জানিয়েছেন। সেনাবাহিনীর প্রতি ক্রমাগত সন্দেহ সৃষ্টি এবং বিবিধ ষড়যন্ত্রের গল্প তৈরি খুবই সহজ কাজ। আমাদের এই প্রতিভা সম্পর্কে দিল্লী পাক্কা অবহিত। নইলে সেনা অভ্যুত্থানের গল্প এত কনফিডেন্টলি তারা কিভাবে প্রচার করে? এই অবস্থার নিরসন দরকার। সৈনিকেরাও দেশের নাগরিক, সৈনিকদেরও দেশপ্রেম আছে এবং সম্ভাব্য গণমুখি ভূমিকা গ্রহণে সৈনিকও আগ্রহী। এই বোঝাবুঝির অভাবের কারনে আমরা সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকাকে সবসময়ই ষড়যন্ত্রের আজগবি অনুমান এবং প্রচার প্রপাগান্ডা দিয়ে বুঝি। এর বাইরে সৈনিকতা ও সেনাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমাদের সমাজে কোন ইতিবাচক বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কবিতর্ক নাই। জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে মেলানো এবং তার ভিত্তিতে শক্তিশালী গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্তব্য হিশাবে হাজির রয়েছে। আমাদের নিজেদের সদিচ্ছা না থাকলে সেনাবাহিনীর গণবিচ্ছিন্নতা আমরা বাইরে থেকে দূর করতে পারব না। অন্যদিকে দ্রুত দূর না হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট মিটবে না, বাড়বে। এই আশংকাতেই বাংলাদেশে আরেকটি এক/এগারো আসছে এই প্রচারণা প্রবল রয়েছে। জনগণ সেনাবাহিনীকে বোঝে না, অন্যদিকে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দল বোঝে বটে, কিন্তু যাদের সার্বভৌম রাজনৈতিক অস্তিত্বের সুরক্ষা সেনাবাহিনীরই দায়, সেই জনগণকে সেনাবাহিনী বোঝে না। এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা যেন হেলায় না হারাই।
৭.
ওপরের কথাগুলো যদি আমরা মানি তাহলে সেনাপ্রধানের উদ্বেগ এবং উৎকন্ঠাকে আমাদের আন্তরিক ভাবে বুঝতে হবে। সেনাবাহিনীকে দীর্ঘকাল ক্যান্টনমেন্টের বাইরে রাখার বিপদ সম্পর্কে সেনাপ্রধান নানান সময়ে কথা বলেছেন। সেনাবাহিনীর স্বার্থেই তিনি ডিসেম্বরের মধ্যেই ‘রিফাইন্ড আওয়ামীলীগ’কে অন্তর্ভূক্ত করে একটি জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার মধ্যে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান খুঁজতেই পারেন এর জন্য তাঁকে কোনভাবেই দোষারোপ করা যায় না। আমরা যদি তাঁর সঙ্গে একমত না হই তাহলে সেনাবাহিনীকে দ্রুত সেনা নিবাসে ফিরিয়ে নেবার বাস্তবসম্মত প্রস্তাব জনগণের তরফ যেমন দিতে হবে, তেমনি সেই বাস্তবতা আমাদেরকেই তৈরি করতে হবে। আমরা কি তা করছি? আমরা তো পুলিশবাহিনীকে কার্যকর করতে পারছি না, বিচার ব্যবস্থা ও বৈচারিক প্রক্রিয়ায় সমস্যা আছে, আর আমরা নিজেরা কাদা ছোঁড়াছুড়ি ও হানাহানি করে বেড়াচ্ছি।
দেশেবিদেশের পরিস্থিতি এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা সেনাপ্রধানের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠাকে সমর্থন করবেন। বাংলাদেশকে আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য হবার হাত থেকে রক্ষা করা কি আমাদের সকলের কর্তব্য নয়? যুক্তি ও প্রজ্ঞার চেয়েও সেনাপ্রধানের ভাষায় ‘কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে’-ই তো আমাদের বিপুল পুলক! তাই না? সেনাপ্রধানের উৎকন্ঠা খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া গণঅভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ বাস্তবতার প্রতি প্রতিটি নাগরিকেরই সংবেদনশীল থাকা দরকার। আমরা যেন কোন পিচ্ছিল ও অর্থহীন অস্থিতিশীলতার দিকে কদম না বাড়াই, সকলকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। বাংলাদেশের অতীতের ইতিহাস এবং নতুন রাজনৈতিক জমিনে দাঁড়িয়ে আমাদের আরও দায় ও দূরদর্শিতা নিয়ে ভাবতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হবে।
আশা করি সেনাপ্রধানও বুঝবেন আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের কোন প্রশ্নই আসে না, শুধু আওয়ামী লীগ কেন, জনগণের স্বার্থের বাইরে কোন দলের প্রতি সেনাবাহিনীর কোন পক্ষপাত থাকা উচিত নয়। সকল কিসিমের ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিলোপ সেনাবাহিনীর সামরিক ও কৌশলগত লক্ষ্য হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে ‘জনগণ’কে বাদ দিয়ে বা উহ্য রেখে শুধু রাজনৈতিক দল কেন্দ্রিক সমাধানের চিন্তা ব্যাকফায়ার করতে বাধ্য। নির্বাচনকেন্দ্রিক চিন্তা বনাম গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা বিকাশের রাজনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে দুর্বল রাষ্ট্র হিশাবে বাংলাদেশকে ভূরাজনীতির নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতায় টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন।
অতএব কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত নয়, জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার জমিনে সঠিক ভাবে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই সেনাবাহিনী জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার স্থান অর্জন করবে। তাই ‘দল’ কেন্দ্রিক চিন্তা বাদ দিয়ে কিভাবে আমরা সবার ওপরে জনগণ এবং জনগণের সামষ্টিক স্বার্থের কথা ভাবব সেই দিকে মনোযোগী হতে হবে। বর্তমান সংকটের সময় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে জনগণ আরও বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব আশা করে। দলীয় স্বার্থ কিম্বা রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্বে সেনাবাহিনীর জড়ানো উচিত নয়। রাজনৈতিক দলের পুনর্বাসন কিম্বা সমর্থন সেনাবাহিনীর কাজ নয়।
৮.
হাসনাত আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের প্রস্তাব দেওয়া হলে তাঁরা তৎক্ষণাত তার বিরোধিতা করেন। কিন্তু কেন? ছাত্র-তরুণরা তো ইতোমধ্যেই নির্বাচনী রাজনীতির ডামাডলের মধ্যেই ঢুকে পড়েছেন। তাঁদের রাজনৈতিক দল গঠনও সমাপ্ত। হাসনাতের পুরা পোস্ট এই বছরের শেষে কিংবা আগামি বছরের শুরুতে নির্বাচন সম্পন্ন করার লক্ষ্য নির্ণয়ের মধ্যেই আবর্তিত। জাতীয় নাগরিক পার্টির সকল কার্যক্রম এখন নির্বাচনের জন্য। নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই সেনাপ্রধান এখন ছাত্র-তরুণদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। তাছাড়া ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ মানে তো আসলে আওয়ামী লীগও না। নাম-কা-ওয়াস্তে আওয়ামী লীগও আদৌ সম্ভব না। সেনাপ্রধান আশা করি উপলব্ধি করেন যে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার কাজ নির্বাচনী রাজনীতির দ্বারা সম্ভব নয়। যদি হোত তা হলে গণঅভ্যুত্থান এবং জনগণের এতো আত্মত্যাগের দরকার হোত না। সেনাবাহিনী যদি ইতিবাচক গণমুখি ভূমিকা পালন করতে চায় তাহলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির গভীরতর দ্বন্দ্ব ও সংকট নিরসনের ক্ষমতা অর্জন করার কঠিন কাজকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের অধিকার সৈনিকদেরও আছে, কারণ তারাও এ দেশের নাগরিক।
গণতন্ত্রকে যারা জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ভাবে না, বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখে বা নিজের সুবিধা মতো সংস্কার করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে যারা লুটতরাজ করতে চায় তাদের সম্পর্কে ছাত্র-তরুণদের পরিষ্কার অবস্থান রয়েছে। মনে রাখতে হবে ছাত্র-তরুণরা দেশের স্থিতিশীলতা এবং বৃহত্তর স্বার্থে যথেষ্ট আপোষ করেছে। শুধু ভাবুন, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এখন অবধি জুলাই ঘোষণাপত্র আমরা পাই নি। এটা কি ঠিক হয়েছে? ফলে ক্ষোভের পাহাড় স্ফীত হয়েই চলেছে। নির্বাচন দরকার অবশ্যই। জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় নির্ণয়, নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন, কিংবা নতুন গঠনতন্ত্র প্রণীত ও গৃহীত হবার পর সরকার নির্বাচন – অর্থাৎ নির্বাচনও তো নানান প্রকার! নির্বাচন রাষ্ট্র গঠন ও সরকার গঠন সহ সমাজ ও রাজনীতির সকল ক্ষেত্রেই একটি দরকারি প্রক্রিয়া।
কিন্তু নির্বাচন সর্বস্ব চিন্তা ভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক অসুখ, এই অসুখে ছাত্র-তরুণরাও আক্রান্ত। এই অসুখ থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। নির্বাচনবাদিতা বা নির্বাচনই গণতন্ত্র — বাংলাদেশের বাস্তবতায় চরম গণবিরোধী এবং ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ। সেনা প্রধান এবং সেনাবাহিনীকেও জনগণের কাতারে থাকতে হলে এই অমোঘ সত্য বুঝতে হবে। নির্বাচনবাদিতার অর্থ হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেমন আছে তেমনই থাকুক, আমাদের দরকার শুধু রাজনৈতিক দলগুলিকে সরকারে যাবার জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। যেন তারা আবার গত দুই দশকের চেয়ে আরও অধিক সময়ের জন্য বাংলাদেশ লুটেপুটে খেতে পারে। নির্বাচনের প্রতি অতি মাত্রায় আগ্রহী হওয়ার মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনী যেমন জনগণকে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে, ছাত্র-তরুণরাও নির্বাচনমুখি প্রচলিত রাজনৈতিক দলের অনুকরণে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে বাধ্য হয়েছে এবং গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ দরকার ছিল জনগণের স্বার্থে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-তরুণদের মৈত্রী গড়ে তোলা, কীন ভাবেই বৈরি সম্পর্ক নয়। সেই ক্ষজেত্রে আমরা ব্যর্থ। ফলে জনগণের উৎকন্ঠা এবং উদ্বিগ্নতা বেড়েই চলেছে। এ বিষয়ে উভয় পক্ষকেই হুঁশিয়ার হতে হবে।
৯.
বাংলাদেশের জনগণ লড়েছে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। একদিকে রয়েছে সেকুলার বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ, যার বিরুদ্ধে জনগণ গত পাঁচ দশক ধরে লড়ে আসছে। অন্যদিকে এর উল্টা পৃষ্ঠায় আছে ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তি। এই ফ্যাসিস্ট শক্তির দাবি হচ্ছে যেহেতু এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান অতএব তারা যেভাবে ইসলাম ব্যাখ্যা করে সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র চলবে। ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যসিবাদ রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিশাবে কায়েম হয় নি বটে, কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট শক্তি হিশাবে এখন তারা হাজির। ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির পেছনে পতিত আওয়ামি ফ্যাসিস্টদেরও বিপুল ইন্ধন আছে। ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনা ‘কওমি জননী’ উপাধি পেয়েছিলেন। হাসিনার ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট জারি থাকলেও ওয়াজের নামে ধর্মীয় উগ্রবাদের ভিত্তি আওয়ামী লীগই গেঁড়ে দিয়ে গিয়েছে। বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিবাদের পতনের পর ধর্মীয় জাতিবাদীদের আস্ফালন এখন চোখের সামনে আরও স্পষ্ট।
এই লড়াইয়ে জিততে হলে দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই। কারণ এর গোড়ায় রয়েছে আধুনিক সেকুলার জাতিবাদের আলোকে ধর্মকেও ‘জাতি’ পরিচয় হিশাবে হাজির করা এবং বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য গণতন্ত্র নয়, শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র বা তার আদলে ইসলামি খেলাফত কায়েম করবার দাবি। অথচ ইসলামে জাতিবাদের কোন স্থান নাই। সেকুলার জাতিবাদের পরিচয় সর্বস্ব মডেল অনুকরণ ইসলামের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জাতিবাদ ও ইসলাম এক পাত্রে যায় না। অবাক হওয়ার কিছু নাই, এই নব্য ফ্যাসিবাদের পেছনে আওয়ামী লীগ ও দিল্লির বিপুল ইন্ধন রয়েছে। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে চলবে না। নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সকলকেই ভূমিকা রাখতে হবে।
১০.
নতুন লড়াই এখন সামনে এসে গিয়েছে। ছাত্র-তরুণ কিংবা সেনাবাহিনী উভয়ের কেউই এ লড়াই থেকে নিস্তার পাবে না। গ্রিক-খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যে গড়ে ওঠা আধুনিক রাষ্ট্রের আদলে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ নামক রাষ্ট্র কায়েমের দাবি যে ঘোর ইসলাম বিরোধী ধারণা সেই তর্ক সম্বন্ধে জাতীয় নাগরিক পার্টির কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য আমাদের চোখে পড়ে নাই। অথচ এই তর্ক আমরা বহু আগে থেকেই তুলেছি এবং বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছি এর একটা ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক মীমাংসা জরুরী। অথচ দেখুন, আমাদের চোখের সামনেই ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট শক্তি মাজারের পর মাজার ভেঙে চলেছে। মেয়েদের ওপর হামলা চালাচ্ছে, সমাজে ও রাজনীতিতে মেয়েদের ভূমিকা ও নেতৃত্ব শক্তিশালী করার পরিবর্তে তাদের ঘরে বন্দী করে ফেলতে চাইছে। কিন্তু আমরা ছাত্র-তরুণদের শক্ত ভাবে এই দেশের মেয়েদের এবং খেটে খাওয়া মজলুম জনগণের পাশে পাই নি। ছাত্র-তরুণদের উচিত ছিল এ লড়াইয়ে বেসামরিক বা সামরিক সকল নাগরিককে সচেতন করা। আফসোস। জনপ্রিয়তা বা আগামি নির্বাচনে ধর্মীয় ভোট হারাবার ভয়ে কি আমরা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি না। ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক এ ধরণের রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে। ভোট, বডী কাউন্ট বা নির্বাচন সর্বস্ব রাজনীতি ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির বাহন, আমরা সেই ফাঁপড়ে পড়ে যাচ্ছি। জাতীয় নাগরিক পার্টিও এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার বলে মনে হয় না। তারা ভোটের রাজনীতি করবেন বলেই লিবারেল মডেলের দল বানিয়েছেন। জনগণকে এতো বোকা ভাবা ঠিক না।
এটা প্রমাণিত আদর্শহীন অন্ধ নির্বাচন ফ্যাসিবাদকেই বারবার জন্ম দেয় ও শক্তিশালী করে, কারণ চেষ্টা থাকে পপুলিজম চর্চার মধ্য দিয়ে ভোট আদায়। হিটলার ও হাসিনা উভয়েই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ফ্যাসিস্ট শক্তি হয়েছে এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছে। এখন মেয়েদের পোশাকের দিকে আঙুল তুলে ধর্মীয় জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তি তাদের নির্ধারিত কাপড়ে মেয়েদের আবৃত করতে চাইছে; নিজের নজরের পর্দা না করে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে তাদের ওড়না ঠিক করতে বলছে। কই, নিন্দা ও ‘মব’ তৈরির বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া ছাড়া এই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে তো আমরা ছাত্রতরুণদের শক্ত ভাবে দাঁড়াতে দেখি নি। বিপরীতে আমরা দেখেছি যে সকল বীর ও সাহসী মেয়েরা আওয়ামি ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে মাঠে লড়েছে, তারা হঠাৎ যাদুবলে বাংলাদেশ থেকে উধাও। আশ্চর্য। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বেও তুলনামূলকভাবে তাদের উপস্থিতি কম। ব্যাটাদের পুরুষালি রাজনীতির বাইরে ছাত্র-তরুণরা আমাদের নতুন কোন সমাজ নির্মাণের বার্তা আজও দিতে পারেন নি। এই উদাহরণে আমরা বুঝি বিপজ্জনক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্ব কিভাবে মোকাবিলা করব, সেই কথা না ভেবে আমরা জনগণ বনাম সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটতে আগ্রহী।
এটা ঠিক নয়।
১১.
সেনাপ্রধান এবং সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতা মেনেই ভূমিকা নির্ণয় করতে হয়, হচ্ছে এবং হবে। আমি বারবারই বলেছি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমরা পূর্ণ বিজয় লাভ করতে পারি নি। আমাদের কাজ তাহলে পূর্ণ বিজয় – অর্থাৎ বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক-ব্যবহারিক কর্তব্যকে নতুন ভাবে ঢেলে সাজানো। শেখ হাসিনার পলায়নের নতুন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে জনগনের বিপরীতে দাঁড় করানো আত্মঘাতী পথ। বিশেষত যখন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে। বাংলাদেশকে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ বিধ্বস্ত পরিস্থিতির দিকে কোন ভাবেই ঠেলে দেওয়া যাবে না।
আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত এবং মায়ানমার এবং ভারত বাংলাদেশের বন্ধু নয়, উভয় সীমান্তেই সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমরা রোহিঙ্গা ও আরাকান সমস্যার বারুদের ওপর বসে আছি। বাঙালি জাতিবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির পতনের পর উগ্র ধর্মীয় ফ্যাসিস্ট শক্তি বাংলাদেশকে আরও নাজুক করে তুলছে। আরও নাজুক ও বিপন্ন করে তুলবে। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব পুরানা ফ্যাসিস্ট আইন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রেখেছে। গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা গণক্ষমতাকে আমরা গাঠনিক ক্ষমতায় (Constituting Power) রূপ দিতে পারি নি। এই ব্যার্থতাকে কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠির ষড়যন্ত্রের মধ্যে শুধু তালাশ করলে হবে না, সামগ্রিক ভাবে গণঅভ্যুত্থান ও গঠন প্রশ্নে আমাদের রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার অভাবকেই সবার আগে শনাক্ত করতে হবে। এর মীমাংসা সম্ভব গণঅভ্যুত্থানের সকল অংশীজনদের মধ্যে আন্তরিক তর্কবিতর্ক, সিদ্ধান্ত এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য রণকৌশল নির্ণয়। সেই দিক থেকে সেনাবাহিনীকে শত্রু গণ্য করে শত্রুর কাতারে যেন আমরা ঠেলে না দেই। বর্তমান পরিস্থিতে সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে অভ্যুত্থানের আগের রণকৌশল এবং সাংবিধানিক প্রবিপ্লবের পর্যায়ের রণকৌশল তো এক হবে না।
আমরা কেন ব্যর্থ হয়েছি সেটা সস্তা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু সেটা হবে অলস মস্তিষ্কের ফল। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে সমালোচনাও করা যায় এবং করা উচিতও বটে। কিন্তু ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ষড়যন্ত্র কেন সফল হোল তার ব্যাখ্যা সমাজের মধ্যে – বিশেষ ভাবে আমাদের বুদ্ধি ও চেতনার স্তরের মধ্যেই সবার আগে খুঁজতে হবে। আমাদেরকেই আগে শোধরাতে ও শিখতে হবে এবং জনগণ আমাদের দেখেই শিখবে। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পর নিজদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব কাজ। ছাত্র-তরুণরা ইতোমধ্যেই এই প্রায়-অসম্ভবের পায়ে বলি হতে চলেছে। তারা মারাত্মক অপপ্রচার ও বিভক্তির শিকার হয়েছে। আমাদের কাজ সবার আগে ছাত্র-তরুণদের রক্ষা করা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও রণকৌশলগত ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তাদের জন্য অনুসরণযোগ্য আদর্শ স্থাপন করা। গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের লড়াইয়ে দ্বিতীয়বার আমরা যেন ভুল না করি।
ষড়যন্ত্র আছে, থাকে, চলবে এবং তথাকথিত ষড়যন্ত্র যথাসম্ভব উন্মোচনও করতে হবে। কিন্তু ষড়যন্ত্র কেন সফল হোল সেটা বুঝতে হলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতাকে সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে। আমরা কি আসলে গণভ্যুত্থানের মর্ম বুঝি? গণসার্বভৌমত্বের (Popular Sovereignty) তাৎপর্য বুঝি? গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে আইন বা সংবিধানের সম্পর্ক বিচার করতে জানি? গণঅভ্যুত্থান বিদ্যমান আইন বা সংবিধান মেনে ঘটে না অতএব গণঅভ্যুত্থানের পরের সরকার পুরানা ফ্যাসিস্ট আইন বা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে শুরু হতে পারে না — এই কাণ্ডজ্ঞান নাই সেটা তো ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত।
আমরা এখনও কন্সটিটিউশানকে আইনের অধিক কিছু ভাবতে পারি না। সংবিধান – অর্থাৎ জনগণকে শাসন ও ডান্ডাপেটা করবার আইনী দলিল আর গঠনতন্ত্র (Constitution) – অর্থাৎ নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের গঠন এবং বিশ্বে গণসার্বভৌমত্বের শক্তি ও রাজনৈতিক সত্তা হিশাবে হাজির থাকবার ঘোষণা — এই দুইয়ের ফারাকও আমরা বুঝি না। ইত্যাদি। তালিকা বিশাল। সেই ক্ষেত্রে দোষারোপের বোঝা শুধু একজনের শিখণ্ডির কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে খালাস ভাবা চলবে না। নিজেদের ভুলের দিকেও সকলকে তাকাতে হবে। ব্যক্তি হিশাবে আমাদের প্রত্যেকের ভালমন্দ ভুমিকার সমালোচনা ও পর্যালোচনা হতে পারে। কিন্তু একজনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের আমরা ধোয়া তুলসি পাতা ভাবতে পারি না।
১২.
গণঅভ্যুত্থানের মতো এতো বিশাল ঘটনা ঘটে যাবার পর সেনাবাহিনী আরও রক্তপাত ও প্রতিহিংসা এড়াতে চেয়েছে। সেনাবাহিনীর এই চেষ্টা, বিশেষত সেনাপ্রধানের এই ভূমিকা আমরা সমর্থন করি। এত বড় গণঅভ্যুত্থান ঘটে যাবার পর রক্তপাত ও প্রতিহিংসা এড়ানোর জন্য সেনা প্রধান ও সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নাই। রাজনীতি, রাষ্ট্র, মানবাধিকার ও বৈচারিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তাশীল নাগরিকদের মধ্যে তত্ত্বগত ও কৌশলগত পার্থক্য রয়েছে। সেই কারণে আমাদের মধ্যে সেনানিবাসে আওয়ামি নেতাদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে বিতর্ক থাকবে। সেটাই স্বভাবিক। হোক সেই তর্ক। কিন্তু মনে রাখতে হবে অভ্যুত্থান পরবর্তী পর্বে পুলিশের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল না। প্রতিহিংসা ও রক্তপাতের সম্ভাবনা ছিল বিপুল। তাই সমালোচনা হোক, কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনাঘটনের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে আমাদের আরও বৃহৎ প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ ও বিচার করতে শিখতে হবে।
দ্বিতীয়ত সেনাপ্রধানের প্রধান দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র প্রতিষ্ঠান এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রধান ঢাল হিশাবে অক্ষত রাখা, রক্ষা করা। সেনানিবাসের শৃংখলার বাইরে সৈনিকদের দীর্ঘদিন বাইরে রাখা ভয়ংকর বিপজ্জনক। দুর্নীতি ও উশৃংখলতার অবধারিত বিপদ সম্পর্কে সেনাপ্রধান বারবার প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি পরিষ্কার বলেছেন, তিনি দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীকে সেনানিবাসের বাইরে রাখতে চান না। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেলেও না। সেনা প্রধানের এই নীতি সমর্থন করা ও না করা নিয়েও সমাজে মত পার্থক্য ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে। কারন আমরা সকলে জনগণের কিম্বা দেশের সামষ্টিক স্বার্থের কথা ভাবি না বা ভাবতে পারি না।
সেনাবাহিনীর কাজ বাংলাদেশের জনগণকে বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। সেনাবাহিনীকে আইনশৃংখলা রক্ষার জন্য পুলিশ বা আনসার বাহিনীতে পরিণত করা নয়। এটা পুলিশকে ছোট করা নয়, উভয়ের ভূমিকার পার্থক্য আমাদের বিবেচনায় থাকতে হবে। যদি আমরা সেনাবাহিনীকে আভ্যন্তরীণ আইনশৃংখলা রক্ষার বাহিনীতে পর্যবসিত করি তার অর্থ দাঁড়ায় বৈশ্বিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিজেদের বিলুপ্তকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। ব্যর্থ রাষ্ট্র হিশাবে নিজেরাই নিজেদের প্রমাণ করা। ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রধান প্রপাগান্ডা হচ্ছে সারাক্ষণ বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ও পালটা অভ্যুত্থান হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রশ্নে দিল্লীর নীতি পরিষ্কার। যেভাবেই হোক বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেওয়া। বাংলাদেশে নিজেদের নাগরিকদের — বিশেষত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করতে পারছে না এই অজুহাতে তথাকথিত Right to Protect – নামক আন্তর্জাতিক বিধান কার্যকর করাও দিল্লীর নীতির অংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের আন্তর্জাতিক অধিকার দিল্লি হাসিল করতে চায়।
সম্ভবত এই ভয়াবহ সংকট থেকে নিস্তার পাবার জন্য সেনাপ্রধান ডিসেম্বর/জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন চাইছেন। দেশের স্বার্থে এবং সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ শৃংখলা বজায় রাখবার প্রয়োজনে সেনাপ্রধান দ্রুত সেনাবাহিনীকে সেনানিবাসে ফিরিয়ে নিতে চান। তাঁর যুক্তি আর রাজনৈতিক দলের যুক্তিকে এক কাতারে বিবেচনা করা ঠিক না। এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু আমাদের থাকা দরকার। সেনাপ্রধান অন্যায় কিছু আবদার করেন নি। তৃতীয়ত সেনাপ্রধান বারবার প্রকাশ্যে বলেছেন হত্যাসহ সকল অপরাধীদের বিচার হবে, কেউ বিচারের উর্ধে নয়। কিন্তু বিচারের প্রক্রিয়া ও পদক্ষেপ নিয়ে তর্ক আছে। সেনাপ্রধান হিশাবে সেই তর্ক তিনি তুলেছেন, প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনীকে সুসংহত রাখবার জন্য একই কথা যে কোন সেনাপ্রধানই তুলতেন ও বলতেন। তাঁর কথা আমরা এক কান দিয়ে শুনেছি, কিন্তু অন্য কান দিয়ে বের করে দিয়েছি, জাতীয় নিরাপত্তার গুরুতর তর্কের কোন মীমাংসা আমরা করি নি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং আইনী সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর বক্তব্য শোনার আগ্রহ বা ধৈর্য আমাদের সমাজে প্রকট ভাবে অনুপস্থিত।
১৩.
স্বীকার করতে হবে আমরা গণঅভ্যুত্থানকে বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানে রূপ দিতে পারি নি, তাই পুরোনা সংবিধান, আইন ও ব্যবস্থা আগের মতোই আছে – এই অবস্থায় সার্ভিং কোন জেনারেলের বিচার ১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এর অধীনে হওয়া সঠিক কিনা, সেটা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। সেনা অফিসার ও সৈনিকদের বিচার সেনা আইনেও হতে পারে। কিন্তু সেই তর্ক আমরা করি নি। সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ শৃংখলা বজায় রাখা বিষয়ও বৈচারিক প্রক্রিয়া সংক্রান্ত তর্কের অন্তর্গত আমরা সেভাবে ভাবি নি। গুম, খুন, গণহত্যা ও মানিবাধিকার জাতীয় সংকট মীমাংসার অধীন আমরা সেভাবে ভাবতে অভ্যস্ত নই। এই বিবেচনা সেনাবাহিনীর ইন্টিগ্রিটি রক্ষার জন্য শুধু নয়, ভারত ও মায়ানমারসহ আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার – অর্থাৎ শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করবার জন্যও দরকার। গুম, গুমখুন ও আয়নাঘর সহ সেনাপ্রধান বারবারই সকল অপরাধীদের বিচারের পক্ষে বলেছেন।
আমরা যেন বাস্তবসম্মত ভাবে সামগ্রিক জাতীয় নিরাপত্তার আলোকে আদালত নির্বাচন ও অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবি – এই চাওয়া তো অন্যায় কিছু না। কিন্তু আমরা সেনাপ্রধানের বিপদ সংকেতে সাড়া দেই নি। আমরা ব্রিজের নীচে ডাইনামাইট পুঁতে দিয়ে আসতে অধিক আগ্রহী। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পর জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিশাবে সেনাবাহিনীকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে কিভাবে আমরা অপরাধীদের দ্রুত বিচার করতে পারি সে ব্যাপারে আমাদের কোন গঠনমূলক আলোচনা নাই। ফলে বিচার প্রক্রিয়াও খুবই ধীর গতিতে চলছে। আমরাও ক্রমশ মহা বিপদের দিকে ধেয়ে চলেছি। যদি আমরা গণঅভ্যুত্থানের পরে সেনাবাহিনীকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শৃংখলা ও বিধিবিধানের অধীনে কাজ করতে দিতে মনস্থ করি, তাহলে অপরাধী অফিসার ও সৈনিকদের বিচার সেনা আইনের অধীনে দ্রুত সম্পন্ন করা যায় কিনা তাকে জাতীয় এজেন্ডা হিশাবে আমরা সামনে আনতাম। কিন্তু আমরা তাতে রাজি না।
সেনাপ্রধান বারবার বলেছেন যারা অতি উৎসাহে গণহত্যায় অংশ নিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিচার হবে, হতেই হবে। কিন্তু আমরা সেনাপ্রধানকে আস্থায় নিতে চাই না। এর ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের বিপজ্জনক দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। সেটা সামাল দিতে হলে বিপ্লবী সরকার গঠন করে বিপ্লবী আদালতে অপরাধীদের দ্রুত বিচার করা দরকার ছিল। সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের পরে সেটা কি আর সম্ভব? এখন সব দোষ নন্দ ঘোষ নীতিতে সকল দোষ আমরা সেনাপ্রধানের ঘাড়ে চাপাতে চাই। এটা কি ঠিক? যদি আমরা সার্ভিং অফিসার ও সৈন্যদের বিচার বেসামরিক আদালতে (যেমন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল) করবার চেষ্টা করি, তবে সেটা হবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সেনাঅভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের শর্ত তৈরি করে দেওয়া। এর অর্থ সেনাঅভ্যুত্থান ঘটাবার ভারতীয় পরিকল্পনা জেনে বা না জেনে সফল করে দেওয়া, দিল্লির সহযোগী হওয়া।
আমরা ভুলে যাচ্ছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নাম হলেও এই আদালত আসলে আন্তর্জাতিক নয়, জাতীয় আদালত। এই আদালতে অপরাধীদের দ্রুত বিচার আদৌ সম্ভব কি? দ্বিতীয়ত এই আদালতে কি অভিযুক্তরা অতীতে আদৌ ন্যায় বিচার পেয়েছেন? আমরা গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণ বিজয়ে রূপ দিতে না পেরে এখন টালবাহানার কৌশল ও আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছি। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। অতএব আমাদের স্বীকার করতে হবে, আমরা গণঅভ্যুত্থানকে তার স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরণতির দিকে নিতে দেই নি, তার আগেই সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব দ্বারা নস্যাৎ করে দিয়েছি। শেখ হাসিনার সংবিধান বাতিল দূরে থাকুক, শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলার কাউকেই ক্ষমতা থেকে কার্যত সরাই নি। এখন নিজেদের মাংস নিজেরা খাবার জন্য ছুরি হাতে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি। এটা হতে পারে না। অতি দ্রুত গুমখুন, আয়নাঘর ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সকল অপরাধীদের বিচার হতেই হবে। এখানে ছাড় দেবার কোন সুযোগ নাই।
কিন্তু কিভাবে,কোন আদালতে এবং কোন প্রক্রিয়ায় সেটা সম্পন্ন করা হবে সে ব্যাপারে সেনাবাহিনীর বক্তব্য শোনার দরকার আছে। এই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি, মর্যাদা এবং এখতিয়ার ক্ষুণ্ণ করা বাংলাদেশের বিশাল ক্ষতির কারণ হতে পারে। দিল্লি বাংলাদেশের এই দুর্দশা সহজেই আঁচ করতে পারে এবং আঁচ করেছে। তাই ভারতীয় গণমাধ্যম সেনাঅভ্যুত্থানের প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অস্থিরতা তৈরির প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এটা বোঝার জন্য বিরাট বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার নাই। এতো বড় অভ্যুত্থানের পর সমাজের দ্বন্দ্ব সেনাবাহিনীতেও প্রতিফলিত হয়েছে। তাই অস্বীকার করবার জো নাই যে সেনাবাহিনী যেহেতু বিচ্ছিন দ্বীপ নয় অতএব সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব সেনাবাহিনীর মধ্যেও রয়েছে। যদি সেই অন্তর্দ্বন্দ্বে আমরা বাইরে থেকে আরও ধোঁয়া দিতে থাকি, তার ফল দিল্লির পক্ষে বিস্ফোরকের ভূমিকা পালন করবে।
শত্রু পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সকল অপরাধ দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা আমরা করি নি। তার দায় একা সেনাবাহিনীর নয়, যারা সেনাসমর্থিত উপদেষ্টা সরকার বানিয়েছেন, সেই দায় তাদের। আওয়ামী রেজিমের সকল অপরাধ বিচারের জন্য আলাদা আদালত করতে না পারা এবং শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বহাল রাখার মারাত্মক ভুল থেকে নিষ্কৃতির কথা তাই আমাদের ভাবতে হবে। সকল পক্ষের উচিত “জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়’ কথাটার আইনী ও সামরিক মর্ম উপলব্ধি করা।
মিনতি যে আমরা সবাই হুঁশে থাকব। এলোমেলো হয়ে গিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনবো না।
১৪.
আমরা সেনাপ্রধানের কঠিন দায় ও দায়িত্ব বোঝার জন্য আন্তরিক থাকব। নিজেদের ব্যর্থতার ক্ষোভ সেনাবাহিনী কিংবা সেনাপ্রধানের ওপর চাপিয়ে দেব না। আমরা আশা করব সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীও জনগণের কথা বুঝবেন। তাঁরা বুঝেছেন কিনা সেটা আমরা উপলব্ধি করব যদি সাংবিধানিক ভাবে ‘অবৈধ’ উপদেষ্টা সরকারকে পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈধ সরকার হিশাবে পূর্ণতা দেবার জন্য বর্তমান সংবিধান বাতিল করবার দাবির রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব তাঁরা বোঝেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীকে জনগণের অভিপ্রায়ের পক্ষেই থাকতে হবে। আমরা যেন দ্রুত শক্তিশালী বাংলাদেশ গঠনের কাজ শুরু করতে পারি। তাই সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের ফলে তৈরি হওয়া বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়া সবার আগে জরুরি। তার জন্য সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। বিপরীতে গণভ্যুঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত গণঅভিপ্রায়কে মূল্য দিতে হবে, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তির বাইরে বা সামষ্টিক স্বার্থের বিপরীতে কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠি কিম্বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষা করা সেনাবাহিনীর দায় নয়।
রাজনৈতিক দল আর জনগণ এক নয় বা সমার্থক তো নয়ই। গণসাসার্বভৌমত্ব (popular Sovereignty) প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের সামষ্টিক স্বার্থ রক্ষার আলোকে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিশাবে যেন আমরা গড়ে তুলতে পারি সেটা সকলেরই অঙ্গীকার হওয়া উচিত। গণসার্বভৌমত্ব কায়েম করবার রাজনৈতিক ও আইনী তাগিদই জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মৈত্রীর জায়গা – অর্থাৎ বৈরী বিশ্বে বাংলাদেশের শক্তির জায়গা। জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর এই বোঝাপড়ার জায়গা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারলেই গণপ্রতিরক্ষার আলোকে শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারব, ইনশাল্লাহ। এই কাজে সফল হবার প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের দূরত্ব দ্রুত কমিয়ে আনা। তাঁর চিন সফরের আগে তিনি যেন এই বার্তা পেয়ে নিজেকে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি হিশাবে শক্তিশালী ভাবতে পারেন সেটাই আমাদের এখনকার কর্তব্য।
আমরা বিশ্বাস করি ড. ইউনূসও জনগণের মনের কথা বা গণঅভিপ্রায়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝেন কিম্বা বুঝবেন। আশা করব গণবিচ্ছিন ব্যক্তিদের বেষ্টনী ও বৃত্তের বাইরে জনগণের কথা শুনবার প্রতি তিনি আরো আগ্রহী ও আন্তরিক হবেন।
২৫ মার্চ ২০২৫