ধর্ম যার যার, উৎসব কি আসলেই সবার?


ধর্ম যার যার উৎসব সবার— এটা খুবই বিভ্রান্তিকর প্রচার। ধর্মীয় উৎসবকে ধর্ম থেকে আলাদা করে দেখা কি আদৌ সম্ভব? ‘সার্বজনীন” দুর্গা পূজা বললেও সেটা পূজাই, একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের উৎসব। কিম্বা ঈদ। আর কলোনিয়াল শহর কলকাতায় দুর্গা পূজা বিশেষ ভাবে গড়ে উঠেছিল বাংলার নবাবদের ক্ষমতাচ্যুত করার পর। ধর্মীয় উৎসবকে সেকুলেরাইজ করবার একটা কলোনিয়াল প্রেক্ষাপটও আছে।

‘উৎসব’ বলতে ধর্ম থেকে আলাদা কিছু নাই। প্রতিটি ধর্মের উৎসব সেই ধর্মের অনুমান, ভিত্তি, আকিদা, দর্শন, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। যেমন ইসলামের সঙ্গে পৌত্তলিকতা যায় না। তাই এমনকি সরস্বতীর ক্ষেত্রেও আপনি বলতে পারবেন না যে, সরস্বতী পূজা সাংস্কৃতিক, সরস্বতীর পূজা কেন্দ্র করে কোন উৎসব গড়ে উঠলে সেটা ধর্মীয় উৎসব থেকে আলাদা কিছু নয়। সরস্বতী পূজায় উৎসবে অংশ নেওয়ার অর্থ হলো সেই ধর্মের পরিমণ্ডলে প্রবেশ করা।

কিন্তু রাজহাঁস, পদ্ম আর প্রবাহমান নদীর জল সহ সরস্বতীর রূপকল্পকে আমাদের কল্পনা শক্তি বিকাশ এবং আবহমান ভাবচর্চার অন্তর্গত করে নেবার ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। সেটা ইসলামসহ যে কোন ধর্মের অনুমান, তত্ত্ব বা রূপকল্পের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেটা ভিন্ন তর্ক, ভিন্ন কাজ। তার জন্য সমাজকে বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে প্রস্তুত করবার কঠিন কাজ আগে সম্পন্ন করতে হবে। যদি আমরা সেই কঠিন কাজ না করে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ মার্কা বাচাল ও অপরিপক্ক শ্লোগান তুলি, তাতে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তৈরি হয় না, বরং বাড়ে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সেটাই প্রমাণ করেছে।

 

কথা হোল, ধর্মের বাহ্যিক পরিমণ্ডল অতিক্রম করে তার মর্মকে সকলের ঐতিহ্য ও সম্পদে তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই দুরূহ কাজ সম্পন্ন করারা মধ্য দিয়েই একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি ধর্মবাদী, জাতিবাদী এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্তর অতিক্রম করে নিজের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যসহ মানবেতিহাসের সার্বজনীন পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে। মানবেতিহাসে নিজ নিজ ধর্মের অবদান নিশ্চিত করবার মধ্য দিয়ে একটি ‘বিশ্বসমাজ’ গড়ে তোলার শর্ত তৈরি করে। বিশেষ আর সামান্যের ফারাক মুছে ফেলা কঠিন কাজ, যেকোন সচেতন নাগরিকই সমাজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সেই দুঃসাধ্য কাজের ভার টের পায়, বোঝে। ধর্মকে উৎসব গণ্য করে মুসলমান হয়ে দুর্গা পূজার প্রসাদ খাওয়া কিম্বা হিন্দু হয়ে কোরবানিতে গরুর মাংস খাওয়া হয়তো ধর্মের সংকীর্ণ বৃত্ত ভেঙে বৃহত্তর সমাজ গড়বার আকুতি। হতে পারে। কিন্তু যদি নিজ নিজ ধর্মের ধর্মতাত্ত্বিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ আমরা ঘটাতে ব্যার্থ হই তাহলে ধর্ম যার যার উৎসব সবার বুমেরাং হয়ে সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বিষ আরও বাড়াবে। এই কাণ্ডজ্ঞান সচেতন নাগরিক মাত্রেরই থাকা উচিত। নিদেনপক্ষে আমাদের যা অর্জন হওয়া উচিত – সেটা হোল নিজ নিজ ধর্মকে যেমন তেমনি সমাজের অপরাপর সদস্যদের ধর্ম ও ধর্মের চর্চা সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানা, পস্পরের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান করতে শেখা, আন্তরিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করা, ইত্যাদি।

তবে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রকল্প হিশাবে সমাজের অন্তর্গত প্রতিটি ধর্মের সার্বজনীন মর্মশাঁস উপলব্ধি ও বৈচিত্র্য বিচার জরুরি। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের উপলদ্ধি ছাড়া একই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সকলের বাস আমরা নিশ্চিন্ত করতে পারব না। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ সেই ক্ষেত্রে ফাঁপা বুলি ছাড়া কিছু না। দরকার ঐক্য উপলব্ধি ও আত্মস্থ করবার মধ্য দিয়ে ধর্ম বনাম সেকুলারিজম কিম্বা পরকাল/ইহকালের বাইনারি অতিক্রম করে যাওয়া। আর কোন বিকল্প নাই। ‘ইহ’/‘পর’ ভেদবিচার করবার বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক হিম্মত অর্জন ছাড়া বুদ্ধি বিবেকের বাল্যাবস্থা কাটবে না। আমরা বেঁটে বামন হয়ে থাকব। ক্রমাগত দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেই বেড়াব।

 

বাকদেবী সরস্বতীর কথাই আবার ধরুন। সরস্বতীর দার্শনিক তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। ফলে প্রজ্ঞা মাত্রই এই রূপকল্পের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। সরস্বতীর বাহন রাজহংস, দেবী পদ্মফুলের ওপর আসীন। এই অক্ষরমূর্তি প্রজ্ঞারই ভাবমূর্তি, প্রজ্ঞারই ভাষা। এই প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় যে যিনি জ্ঞানী তাঁকে কোন ময়লা স্পর্শ করে না। তাঁর ডানার ঝাপটায় সকল ক্লেদ ও আবর্জনা সাফ হয়ে যায়। সরস্বতীর ইতিহাসও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এককালে নদী ছিলেন, পরে বাগদেবী হয়েছেন। এই রূপান্তর আমাদের ফিলোসফিক্যালি ও এনথ্রোপলজিক্যালিও বুঝতে হবে। সরস্বতীসহ যে কোন রূপকল্পনাই বাংলার সংস্কৃতির অংশ। কিভাবে নিজেদের সম্পদ আমরা আত্মস্থ করব সেটা নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষমতা ছাড়াও প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা অর্জনের বিষয়।

 

ঠিক একইভাবে ইসলামের প্রস্তাবনা, সংস্কৃতি, ভাবুকতা বা দর্শনকেও বুঝতে হবে। ইসলাম উপমহাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরোপিত কিছু নয়, আমাদের বেড়ে ওঠার ইতিহাস। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস মানে একইসঙ্গে ইসলামের ইতিহাস। আবার সনাতন ধর্মের ইতিহাসও এই ভূগোল ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা সবাই এই এই ভূগোলের অধিবাসী। সিন্ধু নদীর এপারের সবাইকে একসময় ‘হিন্দু’ বলা হতো। ভৌগোলিকভাবে আমরা সকলেই ‘হিন্দু’। নামটা হিন্দুরা দেয় নি, পারসিক ও মুসলমানদেরই দেওয়া নাম। কিন্তু ‘হিন্দুত্ববাদ’ নামের সাম্প্রদায়িকতাও তো আমরা মানি না। তেমনি ‘ইসলামবাদ’-কে মানবারও তো যুক্তি নাই। ইসলামকে ধর্মীয় জাতিবাদী পরিচয়সর্স্ব ধর্ম বানালে আমরা মানব কেন? যে কারণে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হয়েছে। এই ভূগোলের সব ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর আমাদের সকলেরই উত্তরাধিকার ও হিস্যা আছে। কিভাবে তা আদায় করব সেটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে কিভাবে নিজেদের গঠন করতে চাই, সেই তর্কের সঙ্গে যুক্ত।

 

আমি একজন মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। ইসলাম আমার খুবই আপন জিনিস। ইসলামের একত্ববাদ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই একত্ববাদ তো বেদ, উপনিষদ ও শংকরাচার্যের দর্শনেও রয়েছে। তাহলে ইসলামের একত্ববাদ আর বেদ-উপনিষদের একত্ববাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এই বিভাজনগুলো বুঝতে হলে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা জরুরি। সমাজে যদি এই চর্চা না হয়, তাহলে ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়বে, হানাহানি হবে, সমাজ এগোবে না।

 

উৎসবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। উৎসব আজ একরকম, কাল আরেকরকম। বহু আগে আমরা ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করতাম না। এখন করি। এটি খ্রিস্টানদের উৎসব, খ্রিস্টিয় ক্যালেন্ডার মেনে করা হোত, আমরা এখন কলোনিয়াল মাস্টারদের নকল করে করি।

সময়ের সঙ্গে নতুন উৎসব যুক্ত হবে, সংস্কৃতি বদলাবে। কিন্তু ধর্ম এবং তার উৎসবের সংস্কৃতি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই আপনি একজন হিন্দুকে ইসলামিক অনুষ্ঠানে গরুর মাংস খেতে বলতে পারবেন না। কিম্বা গরুর মাংস খেয়ে নিজেকে সেকুলার প্রমাণ করা অযথা। যার ভাল লাগে হোক। সেক্যুলারিজমের নামে এ ধরনের ননসেন্স নাটকীয় হতে পারে, তবে কাজের কাজ কিছু হয় না। বরং ভাবা দরকার কোন ঐতিহাসিক ও বাস্তব কারণে হিন্দু ও মুসলমান একসঙ্গে বাংলায় একই রাষ্ট্রে থাকতে পারল না; কিভাবে আমরা পুরনা ক্ষত সারিয়ে তুলব, আদৌ তা সম্ভব কিনা, ইত্যাদি। ঠিক তেমনই একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বিকে পূজার উৎসবে যোগ দেওয়া বা পূজার প্রসাদ খাওয়াবার জন্য ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ বলার কোন যুক্তি নাই। এতে বিভাজন ও দ্বন্দ্ব বাড়বে, কমবে না।

 

পবিত্র রমজান ও ঈদ ইসলামের সংস্কৃতির অংশ, যা আরব সংস্কৃতি ও রসূলের জীবনাচারের সঙ্গে যুক্ত। এক মাস রোজা রাখার পরই ঈদের আনন্দ। এই আনন্দ একজন মুসলিমের জন্য যতটা অর্থবহ, অন্য ধর্মের মানুষের জন্য ততোটা নয় । তাই ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়।

 

বিভিন্ন ধর্মের সার্বজনীন মর্মশাঁসটা কীভাবে গ্রহণ করলে একটি বৃহত্তর শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি আমরা গড়তে পারি, সেটাই আমাদের চিন্তা ও তৎপরতার মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত। আমাদের মধ্যে ভিন্নতা থাকবে, ধর্মের পার্থক্য থাকবে, সাস্কৃতির পার্থক্য থাকবে— কিন্তু এই বৈচিত্র্য নিয়েই গড়ে উঠবে শক্তিশালী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি। বৈচিত্র্যের নিরাকরণ ঘটানো খুবই বোরিং ও অনর্থক কাজ। বরং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের আবিষ্কারই জীবজীবনের সাধনা হওয়া উচিত।

 

বিভিন্ন ধর্মের মর্মশাঁস বুঝে, ভিন্নতাকে সম্মান করে, আমরা একটি শক্তিশালী সমাজ গড়তে চাই। সেখানে কোন প্রকার; ‘সাম্প্রদায়িকতা’ থাকবে না, পরধর্মকে ঘৃণা, হিংসা, কিম্বা হেয় করা যাবে না। কিন্তু সেটা তথাকথিত ‘অসাম্প্রদায়িক’ সমাজ হবে না। কারন সেই সমাজই শক্তিশালী যে সমাজে বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্রসহ সমাজের অন্য সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে আমরা নিশ্চিন্তে বাস করতে পারি। ধর্মের পার্থক্য থাকবে, সংস্কৃতির পার্থক্য থাকবে– কিন্তু তারপরও আমরা এক, একই রাষ্ট্রে সমান অধিকার নিয়ে বাস করি।

আমরা যেন সৌন্দর্য ও বৈচিত্র‍্যকে নতুন ভাবে ভাবতে শিখি। ভিন্নতার সৌন্দর্য্যকে সম্মান দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে- তাহলেই গড়ে উঠবে বিভাজনহীন বৃহত্তর শক্তিশালী সমাজ; বাড়াবাড়ি, হিংসা, প্রতিঘাত অতিক্রম করে একদিন আমরা ইহলৌকিক বড়য়তে পৌঁছে যাব, ইনশাল্লাহ।

 


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।