জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারার সূচনা


বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস খুব‌ই পুরাতন। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯-এ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও ৯০-এর এরশাদবিরোধী আন্দোলন– সবগুলো পর্বই ‘গণঅভ্যুত্থান’ হিসাবে অভিহিত করা হয়। কোনো দাবি বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্মিলিত আন্দোলন এবং আন্দলোনের প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে জনগণের যে সামষ্টিক উত্থান ঘটে তাকেই গণঅভ্যুত্থান বলে। জনগণের এই সামষ্টিক রাজনৈতিক সত্তার জীবন্ত ও মূর্ত রূপই গণতন্ত্র। জনগণই সার্বভৌম – গণঅভ্যুত্থান গণতন্ত্রের এই মৌলিক সত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং জনগণের গাঠনিক শক্তি (Constituent Power)  হিসাবে হাজির হয়। এই গাঠনিক ক্ষমতাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে উৎখাত হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের জায়গায় নতুন রাষ্ট্র গঠনের গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পরিচালনার বৈধ শক্তি। নতুন রাষ্ট্র গঠনের পর জনগণের গাঠনিক শক্তির ভূমিকা শেষ হয়ে যায় না। বরং সবসময়ই হাজির রাখাই গণতন্ত্র। তাই গণতন্ত্র মানে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতাকে আইন প্রণয়ণ,  প্রশাসন ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের সকল স্তরে কার্যকই রাখাও বটে। গাঠনিক ক্ষমতা সব সময়ই জনগণের মধ্যে নিহিত থাকে। গণসার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হবার উপক্রম হলে গাঠনিক ক্ষমতা হাজির হয়। জনগণ যতদিন জীবিত আছে, এই গাঠনিক ক্ষমতাও সজীব ও সক্রিয় রূপ নিয়ে বারবারই ফিরে আসবে।

 

প্রতিটা গণ‌অভ্যুত্থানের‌ই কোনো না কোনো ফল রয়েছে। গণ‌অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে আমরা ঐতিহাসিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক কোনো না কোনো প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই। যার মীমাংসার মধ্য দিয়েই আমরা গণ‌অভ্যুত্থানের মর্ম বুঝি। তা হয়তো পুরাপুরি কখনোই মীমাংসা হয় না। যতটুকু পরিস্ফুটিত হতে পারতো উল্টা তাকে আইনের নামে, সংবিধানের নামে কিম্বা রাষ্ট্রের নামে বাধাগ্রস্ত করা হয়। কিন্তু গণ‌অভ্যুত্থান থেকে যায়, থেকে যায় মানুষের স্মৃতিতে, তাজকেরায় এবং গায়েবে‌। তাই স্মৃতি ও ইতিহাস চর্চা রাজনৈতিক পরিসর ও রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর, যুগ থেকে যুগান্তরের স্মৃতি, গল্প ও ইতিহাস গণ‌অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নিজের ঐতিওগাসিক সত্তা প্রদর্শন করে। অমীমাংসিত  প্রশ্ন ও তলব জারি রাখে। আমাদের চোখ-কান তার শানমান বুঝতে অপারগ হতে পারে। কিন্তু মানুষের সামষ্টিক চেতনা থেকে স্মৃতি, গল্প ও ইতিহাস সহজে মুছে ফেলা সম্ভব না। ব্যক্তি বিভ্রান্ত হতে পারে কিন্তু সামষ্টিকতার মধ্য দিয়ে জনগণের  রাজনৈতিক কর্তাসত্তার সম্ভাব্য রূপ হাজির থাকে।

গণরাজনৈতিক ধার এই ‘সামষ্টিকতা’ বা জনগণের কর্তারূপ নির্ণয়ের ধারা, গণশক্তি বিকাশের প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানে সর্বদাই জনগণের লড়াই ও গণরাজনৈতিক ধারার প্রশ্নটা আড়ালে থেকে গিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জনগণ ঔপনিবেশিক আমল থেকে এখন পর্যন্ত কীভাবে জুলুম ও মাহরুমিয়াতের নিরন্তর চক্রবৃত্ত থেকে বের হয়ে ঐতিহাসিক কর্তা হিসাবে নিজেরা নিজেদের গঠন করবে সেই বাস্তব প্রশ্নকে মোকাবিলা করতে  পারে নি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাই গণরাজনৈতিক ধারার প্রশ্ন ও গণসার্বভৌমত্ব কায়েমের  লড়াইকে সামনে হাজির করতে পেরেছে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের  অভিজ্ঞতার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পর্যালোচনা তাই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিশাবে সামনে হাজির হয়েছে।

 

দুই.

২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় জুন মাসের শুরুর দিকে। জুন মাসের ৫ তারিখ হাইকোর্টে ২০১৮ সালের কোটাসংস্কার আন্দোলনের ফলে শতশত ছাত্রজনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্য কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন হয়েছিল, তা করেছিলেন মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা খুবই নিরীহভাবে সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে নিয়োগ পেতে চেষ্টা করেন। ফলে তাদের দাবিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরিতে কোটা সংস্কারের বিষয়টি এসেছিল। সরকার তখন ওই সব পদে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে। এই অর্জন যদিও ছাত্র-জনতার ওপর যে জুলুম ও নির্যাতন চালানো হয়, সেই তুলনায় কিছুই ছিল না। কিন্তু এটা ছাত্র-জনতার মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক উৎকর্ষ সাধন করেছিল।

২০১৮-এর কোটাসংস্কার আন্দোলন ছিল পুরাতন ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র আর লুটেরা-মাফিয়া অর্থনীতির মধ্যে নিজের যথাযোগ্য স্থান তৈরি করার আন্দোলন। ফ্যাসিস্ট জালেম শাহি হাসিনা সরকার তাদের গুম-খুন ও নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন করে। কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতা তারপরও নিজেদের দাবি আদায়ে রাস্তায় অটল ও অবিচল থাকে। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে (যেসব পদ আগে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরি বলে পরিচিত ছিল) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০১৮-র কোটাসংস্কার আন্দোলন জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে চলতে থাকে। ফলে এই অন্দোলনের সময়কাল আঠারোর শুরুর দিকে চিহ্নিত করা যায়।

এক‌ই বছরের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বাইরে প্রথম স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। যা ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ নামে পরিচিত। শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবিতে সড়কে অবস্থান নেয়। পাশাপাশি মানববন্ধন ও অবরোধের মাধ্যমে তাদের বিক্ষোভ জানান দিতে থাকে। ২ আগস্ট সরকার সব স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করলেও সেদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটসহ দেশের ৪২টি জেলায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনী কেন বাহিরে’ প্রভৃতি স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে তারা সড়ক মুখরিত করে রাখে।

 

২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান এই সকল অভিজ্ঞতা ধারণ করেই গড়ে উঠেছে। স্কুল পড়ুয়া  শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈচিত্র্যময় ও কঠিন রাজনৈতিক পরিবেশে নতুনভাবে নিজেদের ইতিহাস বিনির্মাণ করার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ২০১৮ সালের দুই অভূতপূর্ব আন্দোলনের  বিপুল পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের শর্ত এভাবেই তৈরি হয়।

 

তিন.

কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন উভয়েই দিক থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাঠামোগত ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সংগঠিত প্রথম সফল আন্দোলন। এই দুই আন্দোলনে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যে ব্যর্থতা তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একইসঙ্গেীই আন্দোলগুলো পুঁজিবাদি বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তিক দেশ হিসাবে বাংলাদেশে গড়ে ওঠা লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণীর অর্থনীতির প্রতি জনগণের ক্ষোভের প্রকাশও বটে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মেগাপ্রোজেক্টের নামে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি, আধুনিকতার নামে লোহালক্করের শহর তৈরি, পরিবেশ-প্রকৃতি-প্রাণবৈচিত্রের ক্ষয় ইত্যাদি বাংলাদেশকে অর্থনীতিসহ সামগ্রিক ভাবে এক বিরাট সংকটে পতিত করে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শহর, রাস্তাঘাট, গ্রামবিধ্বংসী কল-কারখানা, প্রাণবৈচিত্র্য ও কৃষি ধ্বংসের সকল কিছুই মানুষসহ সকল জীব-অণুজীবের প্রাণ  বিপন্ন করে তোলার এন্তেজাম। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ধংসকারী বাংলাদেশের মতো টেকনোক্র্যাট স্ট্যাটের বিরুদ্ধে একটি প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষণা ছিল।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চরিত্র বুঝতে গেলে ইউরোপের পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের ইতিহাস থেকে আলাদাভাবে বোঝা খুবই জরুরি। বিভিন্ন কোম্পানির মালিক, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং মিলিটারি স্টাবলিশমেন্টের যৌথ প্রযোজনায় একধরনের লুটেরা-মাফিয়া শ্রেণী এই অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলে , যাএ মধ্যে  জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ অসম্ভব। কোটা সংসজার ও নিরাপস সড়ক আন্দোলন বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার ভিত্তিতে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে। পুলিশবাহিনী ও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শক্তি একযোগে শত শত নীরিহ বাচ্চাদের ওপর হামলা করে। সাংবাদিকদের মারধর এবং হেনস্তা করে। কিন্তু এই বিপ্লবী তারুণ্যের সংবেদনশীল স্বাধীন প্রাণের স্ফূর্তি কি আর এসব দিয়ে ঠেকানো সম্ভব!

তরুণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের পাশাপাশি শহরের ট্রাফিকও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে গাড়ি আটকে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা তা নিজেরাই পরীক্ষা করা শুরু করে। লাইসেন্সহীন চালক ও চলার অনুপযোগী গাড়ি ধরে ট্রাফিক পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে ও তাদের মামলা নিতে বাধ্য করে। আওয়ামীলীগের বাণিজ্যমন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিচারক, পুলিশের ডিআইজিদেরও তারা লাইসেন্স দেখাতে জোর করে। কেউ হঠকারিতা করলে শিক্ষার্থীরা তাদের রাস্তার নায়ক কে, সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তারা সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি আটকে দেয়। পথচারীদের ট্রাফিক নিয়ম বুঝানো এবং স্থানবিশেষে তারা রাস্তা পরিষ্কার ও সংস্কারেরও দায়িত্ব নেন। এই প্রথম বাংলাদেশের স্কুল পড়ুয়া তরুণ প্রজন্ম  আইন ও বিধিবিধান মেনে চলার বাধ্যবাধকতার ওপর জোর দিয়ে রাজনৈতিক কর্তা হিশাবে নিজেদের হাজির করতে পেরেছিল। বাংলাদেশের উপনিবেশায়িত ও উদারনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তরুণদের এই শক্তিতে ভীত হয়েছিল।  শিক্ষা ব্যবস্থা বানানোই হয়েছে  শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজবিচ্ছিন্ন করে তোলার জন্য, যেন কখনো মানুষের সামষ্টিক শক্তি, তথা তার রাজনৈতিক কর্তাসত্তা জেগে না উঠতে পারে। কিন্তু উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার সকল প্রকার শয়তানি এন্তেজাম মানুষের এলাহি কারবার বা মানুষের সামাজিক ও সামষ্টিক সত্তাকে দমন করতে পারে না। মানুষ সামাজিক জীব, সামাজিকতা তার ফিতরাত। ব্যক্তিতান্ত্রিক লিবারেল বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সচেতন হয়ে ওঠা তাই মানুষের রুহানি স্বভাবেরই অভিপ্রকাশ। শুধু প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বর্গ দিয়ে মানুষের এই অন্তর্নিহিত দিব্য স্বভাব বোঝা যায় না।

সরকার আগেকার কোটাসংস্কার আন্দোলনের মতো তাদেরও হাইকোর্ট দেখিয়ে আন্দোলন স্থিমিত করার চেষ্টা করতে থাকে। দ্রুত আইন বিভাগ দিয়ে আইন সংশোধন করা হয়। এটা বাহ্যত তাদের সাফল্য ছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে থাকা অবস্থায় আইন-আদালত-প্রশাসন আসলে জনগণের পক্ষে কখনো কাজ করতে পারে না।

কোটার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনে নিজের শিকড় তৈরি করতে পেরেছিল। আওয়ামী লীগের কাছে কোটার মধ্য দিয়ে একটা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ যেমন বজায় রাখা সহজ ছিল, তেমনই বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেতর থেকে আওয়ামীকরণ ঘটানোর উপায় ছিল। ফলে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রকারন্তরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের রাজত্বে কম্পন তৈরি করে। কিন্তু কোটার নামে চেতনাবাজ বাইনারি রাজনীতির অবসান ঘটাতে হলে ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর ছাড়া সম্ভব ছিল না। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদ যতই গাঢ় হতে থাকে, ততই তার বিরুদ্ধে পাল্টা ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রজন্ম তৈরি হতে থাকে। পুঁজির গোলকায়নের ফলে গড়ে ওঠা উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও নতুন রাজনৈতিক কর্তাবোধের উন্মোচন ঘটতে থাকে। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে নতুন রূপান্তরের সংগ্রামের জন্য তৈরি হয়ে যায়।

 

‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’-এর প্রধান রাজনৈতিক তাৎপর্য হচ্ছে বাংলাদেশের সংকট একান্তই রাষ্ট্র গঠনের এই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসতে পারা। তারাই  রাষ্ট্র ‘মেরামত’ বা রাষ্ট্রের ‘সংস্কার’ দরকার এই প্রশ্ননকে সামনে নিয়ে আসতে পেরেছিল। 

 

চার.

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের রক্তাক্ত অর্জনের ওপরে প্রথম আঘাত আসে ২০২১ সালে। পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলসংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ পাতানো নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর একে একে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থকে শুরু করে আবরার ফাহাদকে বুয়েটে ছাত্রলীগ কর্তৃক নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করায় বুয়েটে যে ছাত্ররাজনীতি তখন নিষিদ্ধ করা হয় সেসব হাইকোর্টের আদেশের মাধ্যমে বাতিল করতে থাকে। এই খবর ছড়ানোর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা আলোড়ন তৈরি হওয়া শুরু করে। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাবির লাইব্রেরির সামনে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি ঘোষণা করে। লাইব্রেরির সামনে থেকে এধরনের আন্দোলন শুরু করাটা কৌশলগতভাবে বিচক্ষণ কাজ ছিল। কোটা নিয়ে বিগত আন্দোলনগুলির কারণে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে যে লাইব্রেরিতে যারা বিসিএস পড়াশোনা করে তারা এসব কর্মসূচিতে বেশি জমায়েত হয়। ফলে তারা প্রথমদিনেই ব্যাপক সাড়া পায়। এই পর্যায়ে তারা শুধু ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। ফলে এটা পুরানা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতোই চলতে থাকে। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে চলতে থাকা নানারকম রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্নের মীমাংসাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যার মীমাংসা ছাড়া এই আন্দোলন বেগবান হতে পারত না। ক্যাম্পাসের পুরাতন ছাত্রসংগঠনগুলো প্রাচীন মতবাদী রাজনীতি এবং সেকুলারবাদ বনাম ধর্মবাদের বাইনারি অনুমানের বাইরে যেতে সক্ষম ছিল  না। বাস্তব গণরাজনৈতিক ধারার প্রশ্ন ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং মতবাদি ও দলীয় সংকীর্ণতা বাদ দিয়ে  ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইকে মুখ্য করে তোলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণরাজনৈতিক ধারা বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। তবে ক্যাম্পাসে এই ধরনের সংবেদনশীল ও সচেতন শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রস্তুতির জন্য আরও সময় দরকার ছিল। সেটা তারা পেয়েও যায়।

৮ জুন হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৪ জুলাই দিন নির্ধারণ করা হয়। ফলে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায় স্বাভাবিকভাবেই ওই সময় পর্যন্ত বহাল থাকছে বলে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী। তখন রাষ্ট্রপক্ষের এ ধরনের নাটকের ব্যাপারে আন্দোলনের আচরণ ও নীতি-কৌশল কি হবে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রপক্ষ যাই করুক, আদতে ফ্যাসিবাদের পরিগঠনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে নির্বাহী প্রধানই সমস্ত কিছুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকাঠামো মোকাবিলা করতে হলে বিচার বিভাগ নয়; বরং নির্বাহী বিভাগকেই আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে হতো।

এই বুদ্ধিবৃত্তিক স্পষ্টতা না থাকার দরুণ ২০১৮ সালের দুটি প্রচণ্ড সম্ভাবনাময় আন্দোলন ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে পরাস্ত হয়। ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নির্বাহী আদেশের প্রতি আন্দোলনের নীতি ও কৌশলই সবকিছু ঠিক করে দিবে। এই আন্দোলন কি শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যাবে নাকি ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব পুরাপুরি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্বাহী আদেশকেই উলটে দিবে? এটাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে প্রধান নীতিগত প্রশ্ন হিসাবে হাজির হয়।

জুন শেষ হয়ে জুলাই শুরু আসে। মূলত জুন-জুলাইয়ের সন্ধিক্ষণেই পুরাতন কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নতুন আন্দোলন নিজের রাজনৈতিক রূপ নিয়ে আলাদা ভাবে হাজির হয়। শিক্ষার্থীরা সরাসরি তখন বলতে শুরু করেন তারা নির্বাহী বিভাগের কাছে সব চাকরির কোটার সংস্কার চাইছেন, আদালতের কাছে নয়। এর মীমাংসা শেখ হসিনাকেই করতে হবে। তাই তাদের আন্দোলন চলবে। বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট সংবিধানে বিধিবদ্ধ সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করবার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলনকে ‘কোটা সংস্কার’ না বলে ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলন হিশাবে হাজির করে। বৈষম্য বিরোধিতার প্রশ্ন রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরে বৈষম্য বিরোধিতার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। আন্দোলন আর শিক্ষার্থীদের কোটার বৈষম্য দূর করবার আন্দোলন রইল না। বৈষম্যবিরোধী সার্বজনীন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিল। মতবাদি ও দলীয় সংকীর্ণতার বাইরে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য গণরাজনৈতিক ধারার রূপ কি হতে পারে তার একটি সম্যক অভিজ্ঞতা আমরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেখলাম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান গণরাজনৈতিক ধারার যে বীজমন্ত্র বপন করে দিয়ে গেছে তাকে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিকশিত করাই আমাদের এখনকার কাজ।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।