'সেনাঅফিসারদের প্রতি বিডিআর জাওয়ানদের একটা ক্ষোভ কিন্তু রয়েছে'
চিন্তা : আপনার নামটা বলুন?
রউফ : আব্দুর রউফ।
চিন্তা : আপনি বিডিআর-এর কত নাম্বার ব্যাটালিয়ানে চাকুরি করতেন?
রউফ : ৩৮ রাইফেল ব্যাটালিয়ানে চাকুরি করতাম।
চিন্তা : আপনি কত সালে চাকুরিতে জয়েন করেছিলেন। আর কত সালে চাকুরি থেকে অবসর নেন?
রউফ : চাকুরিতে ঢুকেছিলাম ১৯৮৮ সালে। আর চাকুরি ছেড়ে চলে এসেছি ২০০৮ সালে। প্রায় ২০ বছর।
চিন্তা : আপনার এই চাকুরি জীবনের কত বছর পিলখানায় কাটিয়েছেন?
রউফ : পিলখানায় আমি প্রায় ১৫ বছর ছিলাম। এছাড়া সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামেও থেকেছি।
চিন্তা : তো, পিলখানায় সাম্প্রতিক সময়ে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এটা একদিকে যেমন মর্মান্তিক, অন্যদিকে তেমনি অনাকাক্সিক্ষত। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা কেউই প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে তেমন ওয়াকেবহাল নই। আপনি কি গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা দিতে পারবেন?
রউফ : আসলে অনেকগুলো সমস্যা থেকে এঘটনা ঘটেছে। তবে আসল কথা হলো বিডিআর সৈনিক হিসাবে আমরা কারো কাছেই ভাল না। সাধারণ চলাফেরায় আমরা হয়ত ভাল। কিন্তু আমরা যখন বিওপিতে যাই, তখন আর ভাল থাকি না। তখন দুই পয়সা কামাইয়ের জন্য আমাদের নিজেদেরই সমস্যা হয়।
চিন্তা : বিওপি মানে?
রউফ : বর্ডার এলাকার ক্যাম্প। ক্যাম্প তো দেখেছেন, সীমান্ত এলাকার ক্যাম্পগুলো। ওই ক্যাম্প এলাকা থেকে আমাদের সমস্যা শুরু। নিজেদের মধ্যে অনেক সমস্যা দেখা দেয়।
চিন্তা : সমস্যা মানে কি ধরণের সেটা?
রউফ : সমস্যা মানে প্রথমে ঘুষ খাওয়া নিয়ে সমস্যা।
চিন্তা : এটা কি সাধারণ সৈনিকদের মধ্যেই ঘটে নাকি অফিসাররাও এর সাথে যুক্ত?
রউফ : সবাই কমবেশি জড়িত। তবে সাধারণ সৈনিক হিসাবে আমাদের সবার মাঝে কিছু বিষয়ে অপরাধ প্রবণতা গড়ে উঠেছে। সবার মাঝে কমবেশি এটা আছে। অফিসাররা জানে বিডিআর জাওয়ানদের বিওপিতে পাঠালেই তারা কিছু কিছু বিষয়ে যুক্ত হবেই। যেমন চোরাচালানীর ক্ষেত্রে অফিসারকে ফাঁকি দিয়ে মালামাল অন্যদিকে পার করবে। হয়ত সে বলল আমি টহলে আছি। কিন্তু সে টহলে না গিয়ে ক্যাম্পেই শুয়ে রয়েছে। অথচ খাতা-কলমে দেখানো হলো টহল দেয়া হচ্ছে। এরকম অনেক বিষয় আছে। যার কারণে অফিসারা কোনো বিডিআর সৈন্যকে বিশ্বাস করে না। সবসময় আমাদেরকে অবিশ্বাস করে। মানে কোনো অফিসাররা এ যাবৎ কোনো সৈনিককে বিশ্বাস করে নি। সবসময়, সবসময়ই অবমূল্যায়ন করেছে। যদিও বিওপি এলাকায় থাকতে গেলে আমাদেরকে কিছু কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হয়। বিশেষ করে চোরাকারবারীদের। তা না হলে বিওপিতে দৈনন্দিন যেসব খরচ হয় তা আমরা চালাতে পারি না।
চিন্তা : কি ধরণের খরচ?
রউফ : খরচের ধরণটা, মনে করেন এক ব্যাটালিয়ানে ৪-৫ জন অফিসার আছে। ওই অফিসারদের মাসে একদিন করে বিওপিতে রাতে থাকার নিয়ম রয়েছে। ওই ক্যাম্পে তাদেরকে রাতে থাকতেই হবে। অবশ্য এটা নিয়ম হলেও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন ক্যাম্প যদি ভাল হয়। নিরাপদ হয় তাহলে, রাতে থাকবে। না হলে অন্য নিরাপদ ক্যাম্পে থেকে কাগজ-কলমে দেখাবে আমরা ওই ক্যাম্পে ছিলাম। তো, যে ক্যাম্পেই তারা থাকুক না কেন একটা ক্যাম্পে মাসে যদি ৪-৫ জন অফিসার আসেন, তাহলে, অফিসারদের আপ্যায়ন করার রেওয়াজ প্রতিটি ক্যাম্পেই রয়েছে। তারা আসলে প্রথমে নানা ধরণের নাস্তা দিতে হবে। তারপরে দুপুর রাতে ভাল খাওয়ার ব্যবস্থা। তারপর দিন আবার নাস্তা। এভাবে অফিসার প্রতি এক হাজার টাকা করে খরচ হয়ে যায়। এই টাকা সরকার আমাদের দেয় না। অফিসারদের দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের অনেকেই তো দেন না। অনেক ক্ষেত্রেই দেন না। তো, না দিলে একজন অফিসারের পিছনে একটা ক্যাম্প থেকে এক হাজার টাকা খরচ করলাম। কয়েকদিন পরে আরেকজন অফিসার আসবে তার পিছনেও খরচ করতে হবে। এভাবে প্রতি মাসে ৪-৫ জন অফিসারের পিছনে খরচ করার টাকা আমরা কোথায় পাব বলেন? এর বাইরে আরো অন্যান্য অতিথি রয়েছে।
তারপরে ধরেন কেরোসিন তেলের কথা। বিওপি লেভেলে কারেন্ট থাকে না। আর যেসব ক্যাম্পে কারেন্ট আছে দেখা যায় রাত ১০ টার পরে কারেন্ট আসে। কিন্তু আমাদের তো আলো দরকার সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। অথচ ওই সময়ই কারেন্ট নাই। ফলে সব ক্যাম্পেই হারিকেন জ্বালাতে হবে। এভাবে একটা ক্যাম্পে ৩-৪ হারিকেন জ্বললে দেখা যায় যে, মাসে ২ হাজার টাকা তেল লাগে। অথচ সরকারের তরফ থেকে কোনো ক্যাম্পে কেরোসিন তেলের খরচ দেওয়া হয় না। তারপর আমাদের জ্বালানী কাঠের খরচ। এই জ্বালানী কাঠের খরচ বাবদ ৪০ টাকা করে দেওয়া হয়। একটা ক্যাম্পে আমরা থাকি ১৫ থেকে ২০ জন সৈনিক। তো ২০ জনের যদি ৪০ টাকা করে হয়,তাহলে, মাসে দাঁড়ায় ৮০০ টাকা। কিন্তু ২০ জন সৈনিক কোনো ক্যাম্পে থাকলে সেখানে মাসে ৩ হাজার টাকার জ্বালানী লাগে। এই জ্বালানী খরচ বাবদ অতিরিক্ত টাকা এটাও আমাদের যোগাড় করতে হয়। অর্থাৎ এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের যে দৈনন্দিন খরচ সেটা যোগাড় করতে গিয়ে আমরা দুই নাম্বার পথ ধরতে বাধ্য হই। আর ঠিক এ কারণে আমাদের অফিসাররা ধরেই নেয় আমরা জন্মগতভাবেই খারাপ, ফলে তারা কেউই আমাদেরকে বিশ্বাস করে না। আমাদেরকে অবিশ্বাস করে।
চিন্তা : আপনার আলোচনায় বোঝা গেল কেন আপনাদেরকে অবিশ্বাস করা হয়। তো সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানীর সাথে আপনাদের অফিসাররাও কি সম্পর্কিত থাকেন?
রউফ : থাকবে না কেন? কিছু কিছু অফিসাররা তো যুক্ত থাকেন। আর বিডিআরদের চোরাকারবারী শিখায়ছে তাদের অফিসাররা। যেমন ধরেন প্রথম যখন সেনাঅফিসারা বিডিআর-এ এসেছে, তখন এসেই বিডিআর-এর যে ক্যাম্প কমান্ডার বা হাবিলদার, সেই সাথে হাবিলদাররা হলো ক্যাম্প কমান্ডার। সেই ক্যাম্প কমান্ডারের সাথে ওই অফিসাররা একটা যোগসাজশ গড়ে তুলত। এবং নির্ধারণ করে দেওয়া হতো এই ক্যাম্প থেকে এত টাকা দিবা। ওই ক্যাম্প থেকে এত টাকা দিবা। তখন হরহামেশা চোরাচালানীর টাকা খেয়েছে সবাই। সেনাঅফিসাররা নিজেরাই করিয়েছে একাজগুলো। এরপরে যখন জাতিসংঘ মিশন শুরু হলো, তখন থেকে কিছুটা বিধিনিষেধ আসে অফিসারদের মধ্যে। এখন বিডিআরে যেসব সেনাঅফিসাররা আসে, তারা কেউ ওই টাকা খায়, কেউ খায় না। এখন এ ধরণের একটা পরিস্থিতি চলছে। তারপরেও চোরাচালানীর সাথে যেসব ক্যাম্প যুক্ত, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, ব্যাটালিয়ানের যেসব সিও তারা হয়ত কেউ এর সাথে সরাসরি যুুক্ত নয়। কিন্তু সিও’র নিচে আরো কয়েকজন অফিসার থাকে। তারা এটাকে সহায়তা দিয়ে যায়। যেমন এটা করিস ওটা করিস। আর একজন অফিসার এভাবে চাপিয়ে দিলে সেটা না করেও পারা যায় না। হয়ত সিও সাহেব জানেই না তার অমুক অফিসার ঘুষ খাচ্ছে। তার টু আইসি, অথবা মেজর অথবা ক্যাপ্টেন সাহেব মিলেমিশে বিডিআরের সাথে ঘুষ খাচ্ছে। চোরাকারবারীদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয়। হয়ত সিও সাহেব এটা জানে না। আর জানলেও পরোক্ষভাবে বলেন যে, কেউ যেন কোনো কিছু করো না। আমাদের মাসিক যে দরবার হয় সেই দরবারের মাধ্যমে বলেন। সব কথাই সিও সাহেবের কানে কিন্তু যায়। অর্থাৎ মেজর বা ক্যাপ্টেন সাহেব আছে। তারা এসব কাজগুলো করছে। তো সিও সাহেব সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন না। তবে দরবার এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বিষয়গুলো বলেন। আমাদের অফিসাররা তো আর অবুঝ নন। সিও সাহেব কি বলছেন তারা বোঝেন। কিন্তু বুঝলেও তারা সংশোধন করেন না। দেখা যাচ্ছে সিও সাহেব বিওপি থেকে চেরাচালানীদের কাছ থেকে কোনো টাকা ঘুষ খায় না। কিন্তু টু আইসি আথবা মেজর অথবা ক্যাপ্টেন সাহেবরা বিওপিগুলোতে তাদের কোটা জানিয়ে রাখে। সেভাবে বিওপিগুলো থেকে কোটা অনুযায়ী টাকা দিতে হয়। আর এসব ব্যাপারে শুধু সামরিক অফিসাররা নন আমাদের বিডিআর-এর মধ্য থেকে যারা অফিসার হন--ডিএডি এরাও খারাপ। তাদের জন্যও আমরা যারা ক্যাম্পে থাকি তাদের সমস্যা হয়। তাদেরকে বিভিন্নভাবে টাকা-পয়সা যোগাড় করে দিতে হয়। আর এটা দিতে গিয়েই আমরা সাধারণ জাওয়ানরা অধঃপতনে নামি। খারাপ হয়ে পড়ি। এখন ধরেন একজন অফিসার ঘুষ খায়। আর একজন ঘুষ খায় না। পরিস্থিতি এরকম হলে চাকুরি নিয়ে আমাদের টানাটানি পড়ে যায়। আর এসব কারণে আমরা মাঝে মধ্যে বলি অমুক অফিসার ভাল, অমুক অফিসার খারাপ। তো ভালোর সংজ্ঞা যে কি, সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার না। যেমন ধরেন একজন অফিসার কোনো রকমের ঘুষ খায় না। রাত দিন আমাদের টহল করাছেন। হঠাৎ হঠাৎ ক্যাম্পে আসছেন। এটাও ভাল। কিন্তু এতে তো আমাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। আবার কোনো অফিসার এসে অবৈধ পথে আমাদের সমস্যার সমাধান করছেন। তারাও দুই টাকা পাচ্ছেন। তারাও ভাল। সেইজন্য বললাম ভালোর সংজ্ঞা যে কি সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তো এটা হলো ঘটনার একদিক। আর অন্যদিকটা হলো বিডিআর বিদ্রোহ।
এই বিদ্রোহের ব্যাপারটায় আমার যেটা মনে হয়েছে, তাহলো প্রথমে আমাদেরকে অফিসাররাই ঘুষ খাওয়া শিখায়াছে। আবার অফিসাররাই না করে। ফখরুদ্দিন’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ছিল খুব কড়াকড়ি। ওই সময়ে চোরাচালানীর ঘুষ খাওয়া-খাওয়ী বলতে গেলে হয় নি। আবার আমাদের বিওপিতে যে খরচগুলো সেটা চালাতে গেলে আমাদেরকে ঘুষ খেতে হয়। আমি নিজেও ক্যাম্প কমান্ডার ছিলাম। ফলে ক্যাম্প চলাতে গেলে কি কি সমস্যার মধ্যে আমরা পড়ি সেটা আমরাই ভাল জানি। আমি নিজে কখনো ঘুষ খাই নি। কিন্তু ক্যাম্প চালাতে গিয়ে আমার যে অধস্তন তাদেরকে বলেছি যে, যেভাবে পার সেভাবে দেখ। আমি ঘুষ খাই না এটা বলে আমি দায় এড়াতে পারি না। ক্যাম্পে অনেকগুলো খরচ আছে, সে খরচগুলো কে সরবরাহ করবে? সেগুলা যদি আমি যোগাড় করতে না পারি তাহলে তো আমার চাকুরি থাকবে না। আর থাকলেও এমন কাজে লাগান হবে যার গুরুত্ব থাকবে না। সবাই তো আর এক ধরণের না। অনেক অফিসার আছে যারা বিওপিতে অর্ডার করে আজকে মাছ পাঠাও। কালকে মিষ্টি পাঠাও। পরশু মাংস পাঠাও। এসব কিনতে গেলেও অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার থাকে।
চিন্তা : এসব কি আপনাদের অফিসাররা সরাসরি চাইত ?
রউফ : হ্যাঁ, হ্যাঁ। যেসব অফিসারের মধ্যে দুই নাম্বারী ভাব আছে সে সরাসরি চাইবে। শুধু বাজার-সদাই না। বলবে ছেলে-মেয়ের জামা-কাপড় কিনে দাও। ঈদ আসছে সামনে আমার জন্য পাঞ্জাবি দিলে আমার ছেলে-মেয়েদের জন্য কাপড় কোথায়? আমি আমার চাকুরি জীবনে এভাবে চেয়ে খাওয়া অনেক আর্মি অফিসার পেয়েছি। মানে অমুক জায়গার কৈ মাছ পাঠাও। অমুক জায়গার চিতল মাছ পাঠাও। ওই জায়গায় বড় বড় চিংড়ি মাছ পাওয়া যায় সেটা পাঠাও। আমের সময় আম পাঠাও। লিচুর সময় লিচু পাঠাও। ভাই নানান তালের কথা। যেসব অফিসারের মধ্যে দুই নাম্বারী ভাব আছে তার চাওয়ার শেষ নাই। তারা মনে করে ১৫-২০ জনের যে ক্যাম্প, ওই ক্যাম্পের জাওয়ানরা সবকিছু লুটেপুটে শেষ করে দিচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, সপ্তাহে হয়ত ১০ হাজার টাকা আমরা পাচ্ছি। তার মধ্যে থেকে অফিসাররাই ৮ হাজার টাকা খেয়ে ফেলছে।
আর যে বিদ্রোহের ব্যাপারটা, বিদ্রোহের ব্যাপারটা হলো সেনাবাহিনীর একজন সৈনিকের সাথে একজন বিডিআর জাওয়ানের বেতনের বৈষম্য রয়েছে। এখানে প্রথম মূলবেতন যেটা ২৮৫০ টাকা, সেটা ঠিক আছে। এটা ঠিক থাকার পরে ধরেন আমি বিডিআর-এর হাবিলদার। আমার মূলবেতন ৩৫০০ টাকা। আর সেনাবাহিনীর হাবিলদারের মূলবেতন ৪১শ টাকা। এই যে ৬০০ টাকার ব্যবধান। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে ৬০০ টাকা অনেকগুলো টাকা। আমি বিডিআর এর হাবিলদার হিসাবে পাই ৯ হাজার টাকা। আর সেনাবাহিনীর হাবিলদার পায় ১৪ হাজার টাকা। আমার চাকুরি বয়স ২০ বছর। আর আমার ভাগ্নের সেনাবাহিনীতে চাকুরির বয়স ৬ বছর। অথচ একই র্যাঙ্কে চকুরি করেও সে আমার থেকে ৫ হাজার টাকা বেতন বেশি পায়। এটা ধরেন বেতনের বৈষম্য।
এরপরে রয়েছে রেশন। আমাদের রেশন শতভাগ না। রেশন আমাদের হচ্ছে ষাট ভাগ। মানে আপনি যদি পরিবার নিয়েও থাকেন ভিতরে। অর্থাৎ একটা ইউনিটের মধ্যে পরিবার নিয়ে আছেন। আপনি এক বছর পেলে পরের বছর পাবেন না। মানে ১০০ জনে ৬০ জন পাবে। ফলে আপনি পরিবার নিয়ে আছেন না ব্যাচেলার আছেন তাতে সরকারের কিছু যায় আসে না। তা এই স্বল্প বেতনে যদি আবার সবকিছু কিনে খেতে হয় তাহলে আমাদের কাচ্চা-বাচ্চাদের মানুষ করব কিভাবে? বাবা-মার কথা না হয় বাদই দিলাম।
চিন্তা : আর্মির সৈনিকদেরও কি একইভাবে রেশন দেওয়া হয়?
রউফ : না। ওদের ব্যবস্থাটা আলাদা। ওরা শতভাগ রেশন পায়। সারা বছর। ওদের কোনো সমস্যা নেই। এছাড়া আর্মির সৈনিকদের ঝুঁকিভাতা অনেক বেশি। অথচ বিডিআর-এর সৈনিকদের সারা বছর বিওপিতে থেকে বিএসএফ-এর সাথে লড়াই করতে হচ্ছে। জীবন দিতে হচ্ছে। আমাদের বিডিআর-এর অনেক সৈনিকই মারা গেছে। আমি যখন সিলেট ছিলাম, সেখানে আমাদের থাকতে হয়েছে বাঙ্কারে। চিন্তা করতে পারেন টানা আড়াই বছর ধরে বাঙ্কারে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে থাকার কথা। আমরা কিন্তু তাই থেকেছি। প্রথম যখন সংঘর্ষ শুরু হয়, তখন রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-কাদামাটি মেখে সময় কাটাতে হয়েছে। সেখানে কোনো রকম থাকার জায়গাও করে দেওয়া হয় নি। আমরা এতকষ্ট করে বিএসএফ মোকাবেলা করি। অথচ আমরা কোনো ঝুঁকিভাতা পাই না। কিন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যরা কোনো রকমের যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে না থেকেও এবং ক্যান্টনমেন্টের মধ্য থেকে ঝুঁকিভাতা পাচ্ছে। এটাও একটা বৈষম্য। এছাড়া, একজন সেনাবাহিনীর সদস্য ৬ থেকে ৮ বছরের মধ্যে পদোন্নতি পায়। আর বিডিআর সৈনিকদের পদোন্নতি হচ্ছে ২০ বছর পর। এসব কিছু মিলিয়ে পিলখানার ঘটনা ঘটার আগে যাদের চাকুরির বয়স ৮ বছর তাদের পদোন্নতি পাওয়ার কথা, কিন্তু পায় নি। সেটা ২০ বছরে গিয়ে পাওয়ার কথা বলা হয়। তাদের একটা টাইম স্কেল দেওয়ার কথা ছিল। মানে ৮ বছর পরে যে দিন পদোন্নতি পেত, তাহলে, তার স্কেল কত হতো? সরকারিভাবে এটা হওয়ার কথা ছিল। এতে বিগত দিন ধরে বেতন কত হতো না হতো এর উপরে ভিত্তি করে একটা বিল দেওয়ার কথা ছিল। এই ঘোষণার পরে যাদের পদোন্নতি পাওয়ার কথা বা টইমস্কেল পাওয়ার কথা তারা সারাদিন কাজ করে। রাতে শুয়ে শুয়ে ক্যালকুলেটার টেপে আর হিসাব করে। কেউ ৪০ হাজার কেউ ৫০ হাটার টাকা কেউবা ৭০ হাজার টাকা পাবে। এরকম আশাবাদী হয়ে ওঠে। অথচ সরকারি ঘোষণা থাকার পরেও পিলখানায় চাকুরিরত কোনো আর্মি অফিসার এই ব্যাপারটা নিয়ে অগ্রসর হয় নাই। আমাদের পক্ষ থেকে একজন ডিএডি এসব কাগজপত্র নিয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ধরনা দিত। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আবার ঘুষ চেয়ে বসে। লাখ টাকা। পিলখানায় যারা ছিল, তারা টাকা-পয়সা উঠায়ে, টাকা-পয়সা উঠান তো আবার দণ্ডনীয় অপরাধ। ইতিপূর্বে এভাবে টাকা-পয়সা উঠানো নিয়ে চাকুরিও চলে গেছে। তারপরেও ওই বিল পেতে গেলে এক লাখ টাকা মন্ত্রণালয়ে ঘুষ দেওয়া লাগবে। দিতেই হবে, নইলে, ওই বিল পাশ হবে না। যেহেতু বিডিআর-এর সকল সৈনিকের স্বার্থ। তারা টাকা-পয়সা উঠিয়ে মন্ত্রণালয়ে দিয়েছে। তারপরেও বিলটা পাশ হয় নি। হলো না তো হলোই না, বিলটা একদমই বন্ধ। এতে করে সবাই আশাহত হয়। এটা হলো ঘটনার আরেকটা দিক।
এবার জাতিসংঘ মিশনের কথায় আসা যাক। মিশনে একবার বিডিআর জাওয়ানদের নিয়ে যায়। নিয়ে গিয়েছিল তাও পুলিশের কোটায়। বিডিআর-এর কোনো কোটা নেই। আবার সেনাবাহিনীর কোটায় তাদের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সেনাবাহিনীর কোটায় নিয়ে গেলে তাদের ভাগ কমে যাবে। তো যাক, একবারই পুলিশের কোটায় নিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়। পুলিশ বলে যে, সেনাঅফিসার আর বিডিআররা পুলিশের উপরে খবরদারি করে। তো আমরা কেন আমাদের কোটায় তাদের নিয়ে যাব। পারলে সেনাবাহিনী তাদের কোটায় নিয় যাক। এই বলে ওটা বন্ধ হয়ে গেল। তো সেনাঅফিসাররা আমাদের নেয় না, তাদের কোটা কমে যাবে বলে। আর বিডিআর সদস্যরা জাতিসংঘের মিশনে থাক এটা কোনো সেনাঅফিসার চায় না। একজন সেনাঅফিসার আমাদের পক্ষ থেকে ডিজি মহোদয়ের কাছে কথাটা বলবে। খারাপ নজরে পড়বে। দরকার কি তার । সে জানে যে আজকে আমি সেক্টর কমান্ডার বা ব্যাটালিয়ান কমান্ডার। এক বছর, দু’ বছর এখানে থাকব। সেখানে বিডিআর সদস্যদের সমস্যার কথা তুলে ধরে আমি আমার এসিআর নষ্ট করব কেন?
আবার ডিজি মহোদয় বারবার অজুহাত দেখিয়েছে যে, বর্ডার বেল্টগুলা খালি থাকবে। সেগুলো খালি রেখে আমি কিভাবে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বিডিআর সৈনিকদের পাঠাবো? অথচ দেখেন দুই বছর ধরে অপারেশন ডাল-ভাত চলল। সেখানে কিন্তু হাজার হাজার বিডিআর সৈনিক অপারেশন ডাল-ভাতের দোকানগুলো পরিচালনা করেছে। তখন কিন্তু বর্ডারগুলো খালি থাকার প্রশ্ন আসে নি। কোনো ধরণের সমস্যা কিন্তু হয় নি। এটা আসলে কিন্তু অজুহাত যে, বর্ডার ফাঁকা হয়ে যাবে। অথচ এই ডাল-ভাত কর্মসূচির একটা পয়সাও কিন্তু বিডিআর জাওয়ানরা পায় নি।
চিন্তা : এছাড়া অফিসারদের বাসায় ফরমায়েশ খাটার কোনো ব্যাপার আছে কিনা ?
রউফ : বিষয়টা হলো অফিসারদের রানার রয়েছে। ওই রানার অফিসে আসবে। অফিসারের সবকিছু গোছগাছ করে দেবে। এরপরে ম্যাডামের ডাক পড়বে। তখন বাজার ঘাটসহ সব কিছু করে দিতে হবে।
চিন্তা : এটা কি আপনাদের অফিশিয়াল দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?
রউফ : না, না। এটা বেআইনিভাবে করানো হয়। মানে অফিসারের বাজার করে দিতেই হবে। তারা তো অফিস বাদ দিয়ে থুয়ে বাজার করতে পারে না। যে রানার থাকে সে বাজার-ঘাট করে দেয়। এবং সে বাজার করা কষ্টসাধ্য। আপনি বাজারের সেরা জিনিষটা কিনলেও এ বাজারটা খারাপ। ওটা কেন? এটা বেশি কিনলে কেন? সে এক মহাঝামেলার ব্যাপার। আর এই যে অপারেশন ডাল-ভাতের কথা বলছিলাম। ওই অপারেশন ডাল-ভাতের প্রচুর টাকা সেনাঅফিসাররা খেয়েছে। প্রচুর টাকা। মানে কোটি কোটি টাকা। ওই ব্যাবসায় লাভ হয়েছে প্রচুর। সেই লাভ ডিজি মহোদয়ের স্ত্রী মানে শাকিল সাহেবের স্ত্রী, মানে ইনার হচ্ছে বেশি টাকা পয়সার প্রতি লোভ ছিল। তিনি যে কোনো প্রকার সমস্যার সামাধান করে দিয়েছেন। ডিজি ডিজি ছিলেন না। ডিজি’র স্ত্রীই ছিলেন ডিজি। বিডিআর-এ লোক ভর্তি করা থেকে শুরু করে বড় বড় কেস, যেখানে কোনো অফিসার হয়ত অপরাধের জন্য সাজা খেয়ে যাবে; সেখানে দেখা যাচ্ছে ডিজির স্ত্রীকে ধরলে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যেত। তাছাড়া শোনা যায়, দরবার হল, পুকুরসহ যা কিছু লিজ হওয়ার মতো সবকিছুতে ওই মহিলা রয়েছেন। সবকিছু তিনি একাই চালাতেন। উনাকে সালাম না দিলেও সমস্যা ছিল। মানে সৈনিকরা যে স্যলুট দেয়, সেই স্যলুটা তাকে না দিলে খুব সমস্যা পোহাতে হত।
চিন্তা : এটা কি নিয়মের মধ্যে পড়ে?
রউফ : না বাধ্যবাধকতা নেই। অফিসারকে স্যলুট দিব কিন্তু অফিসারের স্ত্রী যদি ‘বড়’ অফিসার হয়ে বসে, তাহলে, আমারা চাকুরির ভয়ে বাধ্য হই। তো আমরা শুনেছিলাম এক সময়ে যে, অপারেশন ডাল-ভাতের ১০ কোটি টাকা নিয়ে ডিজি মহোদয়ের স্ত্রী সিঙ্গাপুর অথবা থাইল্যান্ডে যাওয়ার পথে বিমান বন্দরের কাস্টম অফিসাররা তাকে আটক করে। তারপর সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে ওই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। আর এঘটনায় শাকিল সাহেবের শান্তনা ছিল এত বড় একটা ঘটনার পরেও ডিজি পদে বহাল থাকতে পারেন। মানে অপারেশন ডাল-ভাতের এই যে, কোটি কোটি টাকা সব অফিসাররা খেয়েছে। বিডিআর জাওয়ানরা একটা টাকাও পায়নি বরং তাদের আরো দণ্ডগুণতে হয়েছে।
চিন্তা : দণ্ড মানে?
রউফ : পিঁয়াজ মনে করেন এখানে দুইশ মন রয়েছে। এটা অফিসাররা বলে গেল। কিন্তু বেচতে বেচতে দেখা যাচ্ছে দুইশ মন হল না। কয়েক কেজি কম হলো। বলা হতো যে পাঁচ কেজি কম ধরা হবে। আমরা তো আর পেশাদার দোকানদার না । কাউকে হয়ত পাঁচ কেজি পিঁয়াজ দিয়েছি। কিন্তু টাকা নিতে ভুলে গেছি। তখন ওই দোকানের বিডিআর সোলজারদের দণ্ড দিতে হয়েছে। চাল তো অহরহ বিক্রি হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা গেল ৫০ কেজির বস্তাতে ৫০ কেজি নাই। হয়ত এক কেজি কম হয়েছে। সারাদিন ৫০-১০০ বস্তা চাল বেচলে গড়ে দেখা গেল ৫০ থেকে ১০০ কেজি চাল কম হয়েছে। যারা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে তারা সাধারণ মানুষকে কম কম দিয়ে ঘাটতি পূরণ করেছে। আবার অনেককে বেতনের টাকা দিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে হয়েছে। কিন্তু একাজে যে লাভ হয়েছে তা আবার সেনাঅফিসাররা খেয়ে বসেছে। এসব তো আছেই। তাছাড়া, সবাই ভাবছিল যে, এসব সমস্যার সামাধানসহ দরবারের দিন শতভাগ রেশন হয়ে যাবে। তাও আটকে যায়। তো সেদিন প্রধানমন্ত্রী পিলখানায় আসেন, তার আগের দিন ডিজি মহোদয় পত্রিকায় একটা মন্তব্য করেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, আরো গাড়ি দরকার, লিডারশীপ দরকার, বাড়ির দরকার। কিন্তু সাধারণ সৈনিকদের কোনো সমস্যার কথা তিনি উল্লেখ করেন নি। যে তিনটে দাবি তিনি করেছিলেন তার সবকিছুই অফিসারদের জন্য। অফিসারদের আরো সুযোগ-সুবিধার জন্য। সৈনিকদের জন্য নয়। এটাতেই সৈনিকদের মনে আঘাত লাগে। আমাদের জন্য ডিজি সাহেব কিছুই করলেন না। এরকম নানা কারণ মিলিয়ে বিদ্রোহটা হয়েছে।
চিন্তা : ঘটনাটা কিভাবে শুরু হয়েছিল এসম্পর্কে আপনি কি কিছু জানেন? যদিও পত্র-পত্রিকায় অনেক রিপোর্ট বের হয়েছে।
রউফ : আমার তো নানা মানুষের কাছে শোনা। তাতে মনে হয় পরিকল্পনাটা সফল হয় নি। বিদ্রোহীরা জিম্মি প্রক্রিয়ায়ও যায় নি। এক ধরণের এলোমেলো কাজ করেছে। তাদের একটা পরিকল্পনা মনে হয় ছিল জিম্মি প্রক্রিয়ায় গিয়ে দাবিদাওয়াগুলো আদায় করে নিবে। কিন্তু একাজে যেসব সৈনিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, অর্থাৎ কে কোথায় অস্ত্র নিয়ে থাকবে, কে এ্যাকশানে যাবে, প্রথমে কে ডিজির বুকে অস্ত্র ধরবে--যাদেরকে এ ধরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারাই হয়ত প্রথমে গুলি করে বসেছে। আমরা তো এটাও শুনেছি, যে সৈনিক ডিজির বুকে অস্ত্র ধরেছিল সে নাকি ভয়ে কাপছিল। তাকে অফিসাররা ধরে বসিয়ে ফেলে। তাকে আটকিয়ে দিয়েছে। তখন তার সাথে যারা ছিল তারাই ফায়ার শুরু করে। আর যখন ফায়ার শুরু হয়েছে দুই-একজন অফিসার মারা গেছে, তখন মনে হয় ওই জিম্মি প্রক্রিয়ার কথা এরা ভুলে গেছে। এবং সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যার যার উপরে ক্ষোভ আছে তাকে মেরে ফেলেছে। সম্ভবত এই ধরণের ঘটনাই ঘটেছে। তো এই যে কাজগুলো যারা করেছে এরা খুবই অল্পসংখ্যক সৈনিক। তারাই বাধ্য করেছে আর সবাইকে, এটাই আমার মনে হয়। আমি এটাও শুনেছি যে, তাদের কথা মতো না চললে তারা আবার হুমকিও দিচ্ছিল। একাজগুলো কর, লাশগুলো উঠাও। যাদের দিয়ে এসব কাজ করানো হয়েছে তারা একদমই নিরীহ প্রকৃতির। তাদেরকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। আর যেসব বিডিআর জাওয়ানরা একাজে বাধা দিয়েছিল তাদেরও কিন্তু মেরে ফেলা হয়েছে।
চিন্তা : কিন্তু সরকার যখন নিহত পরিবারের যথাযোগ্য মর্যাদা ও সহযোগীতা করেন, তখন নিহত বিডিআর পরিবাররা কিন্তু তা থেকে বাদ পড়ে। এঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রউফ : সেটা তো দেয় নি। তাছাড়া, যারা আটক রয়েছে তাদের অনেকের তো ফাঁসি হবে। আর ওইদিন যারা পিলখানায় ছিল, তাদের কারো মনে হয় চাকুরি থাকবে না। তাদের অনেকেরই জেল হবে। ওখানে যে অপরাধ ঘটেছে একত্রে ১৪-১৫ টা অপরাধ হবে। সেই হত্যা থেকে শুরু করে যা কিছু ঘটেছে সেটা ধর্ষণ হোক বা না হোক, হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে যেভাবে গহনা-টহনা ছিনায় নিয়েছে, তারপরে সবচেয়ে কম অপরাধ হচ্ছে পালিয়ে যাওয়া; সবাই তো পালিয়ে গিয়েছিল। পালিয়ে গেলে তো চাকুরি থাকার কথা নয়। এভাবে দেখা যাবে যে অনেকের আর চাকুরি নেই।
চিন্তা : জীবিত সেনাঅফিসারও তো পালিয়ে ছিল?
রউফ : বলবে ওরা তো প্রাণভয়ে পালিয়ে ছিল। কিন্তু সৈনিক পালিয়েছে; সে কেন পালাবে? তাদের তো আর কেউ মেরে ফেলছিল না?
চিন্তা : কেন বিদ্রোহের সময় তো কিছু সৈনিক মারা যায়। তাছাড়া, পিলখানা তো আর্মির সৈনিকরা ঘিরে রেখেছিল। সেই ভয়েও তো পালাতে পারে।
রউফ : আসলে এইসব যুক্তি এখানে খাটবে না। কথা হলো সৈনিক পালাতে পারবে না। সৈনিক পালিয়েছে তার চাকুরি থাকবে না। এবং অনেকের জেল হবে। এই ঘটনায় কতজনের যে জেল হবে, ফাঁসি হবে, সব সুযোগসুবিধা হারাবে। কারণ যারা অপরাধী বলে গণ্য হবে তারা কোনো টাকা পয়সা পাবে না। এতগুলো সৈনিককে একদম বিনা টাকা পয়সায় চাকুরিচ্যুত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এতগুলো সৈনিকের যদি পেনসন দিতে হতো তাহলে প্রচুর টাকা ব্যয় হত। সরকারের আর এই টাকাগুলো এখন এদের দেওয়া লাগবে না, এই টাকা আর্মি অফিসারদের মধ্যে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের দেবে। মানে বিডিআররা যে অবসর ভাতার টাকা পেত, সেই টাকা ওইসব পরিবারকে দিয়ে সরকার একটা নাম কামিয়ে নেবে। এটা আমার মনে হয়।
চিন্তা : আপনার কি মনে হয় সমস্যার সমাধান না হলে আবারো বিদ্রোহ হতে পারে?
রউফ : মনে হয় চট করে আর হবে না। বিদ্রোহ কিন্তু পিলখানায় ৯১ সালেও একবার হয়েছিল। সেবারও ঠিক একই ধরণের হত্যাকাণ্ড হতো। একদম এধরণের হত্যাকাণ্ড ঘটবেই, সেই অবস্থায় সেটা থামান হয়। সেনাঅফিসারদের প্রতি বিডিআর জাওয়ানদের একটা ক্ষোভ কিন্তু রয়েছে। এটা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ। মানে আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান হয় না। আবার তারাও সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়গুলো উত্থাপন করে না। এই নিয়ে গ্যাঞ্জাম সেই ৯১ সাল থেকে। ওই ৯১ সালে অনেক সৈনিকের চাকুরি চলে যায়। সেই সময় সবারই ক্ষোভ ছিল। কে প্রথমে গুলি করবে, তারপর কে নেতৃত্ব দেবে--এই লোকের অভাব ছিল। কিন্তু এবার তো সবাই একত্রিত, বরং একেবারে কার্যকারণ সবকিছু ঘটিয়ে ফেলেছে।
চিন্তা : যাক আপনার পিলখানার মধ্যে তো গরুর ফার্ম ও পুকুর রয়েছে, এগুলোর অবস্থা কি?
রউফ : হ্যাঁ, আমাদের ভিতরে ফার্ম রয়েছে। ফার্মে যে দুধ উৎপাদন হয় তার বেশিরভাগ পায় অফিসাররা। সৈনিকরাও পায় তবে পরিমাণে অল্প। আর পুকুর যেগুলো রয়েছে সেগুলো যদি লিজ দেওয়া হয় তাহলেও অফিসাররা মাছ পাবে। আর লিজ দেওয়া না হয়ে থাকলে তার সব মাছ অফিসাররা পাবে। সাধারণ সৈনিকরা মাছ মারতে পারবে না। মারলে সাজা হয়ে যাবে।
চিন্তা : সহযোগিতা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রউফ : আপনাকে আমাদের কথাগুলো তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ।