কাব্য ও কুরআনের শক্তি
আরবী কবিতার আধুনিক রূপটি কুরআন নাযিলের পর পরই বিকশিত হয়েছে, এ কথা বলাই বাহুল্য। এমনকি জাহেলি যুগের আরবরা যা কখনও চিন্তা বা কল্পনা করতে পারে নি- কুরআন তেমনই এক চিন্তাধারা তাদের কাছে প্রচার করেছে। ফলে প্রচলিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে মানবীয় চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে একপ্রকার বৈল্পবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। কাব্যচর্চাকে প্রচলিত রীতিনীতি থেকে সরিয়ে অচেনা জগতে নিয়ে যায়। ইসলাম পূর্ব আরব কবিদের শ্রুতি কাব্যচর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল ছন্দ ও অন্ত্যমিল। সে সময়ের কাব্য সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে এর কোনো বিকল্পও ছিল না। বেদুইন সংস্কৃতি ও চিন্তার অসারতা কাব্য চর্চায় ছন্দ ও অন্ত্যমিল এ দুটি উপাদানের উৎকর্ষতা অর্জনে সাহায্য করেছে। যখন পৃথিবীব্যাপী সাংস্কৃতিক প্রসার এবং অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গে আরব সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণ হচ্ছিল তখন আল খলিল ইবনে আহমদ আল ফারাহিদি এ নিয়ে গবেষণা অনুসন্ধান করেন। তিনি সঙ্গীত ও কবিতার বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। কারণ, তখন আরব সংস্কৃতিকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা দরকার হয়ে পড়ে। পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে আরব সংস্কৃতির নিজস্ব ভিন্নতা ও উৎস জানারও প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে ইসলাম পূর্ব ছন্দ ও অন্ত্যমিল সমৃদ্ধ শ্রুতি কাব্যচর্চার রীতিনীতি সবার আগে চলে আসে। আরবদের কাব্য প্রতিভা ছিল অসাধারণ বটে, কিন্তু ব্যকরণগত কোনো নিয়মাবলী তারা মানত না। তবে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শ্রুতিরীতি ও লিখিত রীতির বৈশিষ্ট্যে তেমন একটা পার্থক্য ধরা পড়ে নি বরং পরবর্তী সময়ের লেখ্যরীতিকে শ্রুতি রীতির একপ্রকার দুর্বল অনুকরণই মনে করেছেন তিনি। আল ফারাহিদি জাহেলি যুগের কাব্যচর্চার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেন নি। তিনি ওই সময়ের কবিতার উচ্চ মানতার পক্ষে এক প্রকার সাফাই গেয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেন, আরবদের পরিচয়কে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে ওই সময়ের কবিতা একটি শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। এ কথা সবাই স্বীকার করে নেয় এবং কারও পক্ষেই অস্বীকারের সামান্য সুযোগ নেই। এমনকি যদি কেউ এ সত্যটি এড়াতে চায়, তবে সে আরবদের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে একপ্রকার বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
তিনি ওই সময়ের কবিতার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, প্রাচীন আরবদের কবিতা পরবর্তী সময়ের কবিদের জন্য একটি অনুকরণীয় কাঠামো। এটি অন্যান্য ভাষার কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রাচীন আরবরা তাদের কবিতা রচনা করত একটি পূর্ণাঙ্গ চরিত্র কল্পনা করে। কখনো কখনো এই চরিত্রগুলোয় থাকত ধর্মীয় হিতোপদেশে বা সমাজের বিভিন্ন বাস্তবতার দৃশ্য।
আল ফারাহিদি শ্রুতি কাব্যচর্চাকে সর্বপ্রথম তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন, যদিও তিনি ছন্দ নিয়ে বেশি কাজ করেছেন। তবে ভাষাতাত্ত্বিক ও কবিতার গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে প্রাচীন আরব কবিতার বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেছেন আল জাহিয। তিনি উল্লেখ করেছেন, পৃথিবীর যে কোনো ভাষার চেয়ে আরবী ভাষাই শ্রেষ্ঠ। আরবরাই প্রথম বাগ্মীতার উৎকর্ষতা সাধন করেছেন। তিনি আরবদেরকে বাগ্মীতায় উৎকর্ষতার আধার বলেছেন। আল জাহিয এটাও বলেন, কাব্যিক বৈশিষ্ট্য তার উপাদানের ভিতরে থাকে না, বরং আবৃত্তি নৈপুণ্যে কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে হয়। আর আরবদের এই ক্ষমতাটি ছিল স্রষ্টা প্রদত্ত। পারস্য, ভারতীয় বা গ্রীকদের কোনো প্রভাব এতে পড়ে নি। আল জাহিয লিখেছেন, আরবী কবিতা অন্য ভাষায় হুবহু অনুবাদ করা যায় না, অন্যান্য ভাষার সঙ্গে আরব কবিতা খাপ খায় না। যদি কেউ অনুবাদের চেষ্টা করে তবে কবিতার কাঠামোটি ভেঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়, কবিতা তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। বলা যায়, আরবী কবিতার স্বাদ নিতে পারে একমাত্র আরব হলেই, বা অবিরত আরবীতে কথা বলতে পারলে।
কুরআন নাযিলের পর আরবী কবিতার পুরনো রূপটি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। কবিতার উপাদানে নতুন একটি সংস্কৃতির ছাপ পড়ে। যেটি তার অতীত সংস্কৃতি অস্বীকার করেই তার প্রচারটি শুরু করেছে। তাই কুরআন নাযিল হওয়াটা আরবী কবিতার নতুন মেরুকরণ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে কুরআনের মৌলিক কাঠামো ও কবিতার কাঠামোর খানিকটা তুলনা করা চলে। পূর্বে যেখানে কবিতার শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে কবির বাগ্মিতাই প্রাধান্য পেত কুরআন নাযিলের পর সেখানে কবিতার মৌলিক বিষয়বস্তুর প্রতি নজর দেয়া হয়। তবে এটা এমনি এমনি হয় নি। এটা হয়েছে তখনকার আরবদের মধ্যে কুরআনের প্রত্যক্ষ প্রভাবের জন্যই । আবু ওবায়দা এ নিয়ে প্রথম লেখালেখি করেন, তার মাজায আল কোরান গ্রন্থে। তার লেখাটি তিনি শুরু করেন নবম শতকে। আরবী মাজায শব্দটির বাংলা হলো, রূপকালঙ্কার, ইংরেজী প্রতিশব্দ মেটাফর। শিরোনামেই পরিস্কার যে, কুরআনের ভাষায় ব্যবহৃত রূপক বর্ণনাই ছিল তার গ্রন্থটির প্রতিপাদ্য বিষয়। গ্রন্থটিতে তিনি সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গিতে কুরআনের শৈল্পিক চিত্রকল্প ও বিচিত্র প্রকাশ ভঙ্গিমা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা করেছেন। তার সমসাময়িক আল ফাররা লিখেছেন মা’আনুল কুরআন বা কুরআনের অর্থ শিরোনামে আরো একটি গ্রন্থ। তিনি ব্যাকরণ ও কাঠামোগতভাবে কুরআনের শৈলী নিয়ে আলোচনা করেছেন। কুরআনের প্রতিটি সূরা ও আয়াতকে ভাষাতাত্ত্বিক, ব্যাকরণগত ও সাহিত্য সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। এ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক জাহেলি যুগের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন। কুরআনের ব্যবহৃত উপমা, রূপকার্থ, রূপকালঙ্কার, প্রতিশব্দ প্রতিটি বিষয়ই সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করেছেন। গ্রন্থটির এক পর্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন কুরআনের শব্দাবলীর সঙ্গিতধর্মীতা নিয়ে। কারণ, কুরআনের সাঙ্গীতিক শব্দের ব্যবহার এর আবেদনটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে দেয়। শব্দের সাদৃশ্য, আয়াতের অন্ত্যমিল এটাকে আরও মাধুর্যময় করে তোলে। আল ফাররা তার গ্রন্থটিতে অনেকটা তাত্ত্বিক ভঙ্গিতে জাহেলি যুগের কবিতার ছন্দের সঙ্গে কুরআনের আয়াত সমূহের ছন্দময়তার তুলনা করেছেন। আরব কবিতায় কুরআনের প্রভাববলয়টি তৈরি হয় ঠিক এখানেই। কুরআনের ইসলাম পূর্ব সময়ের আরবী কবিতার গীতিময়তা, সাঙ্গীতিক ঐক্য ঠিক রেখেই তার ভিতরে চিন্তার সন্নিবেশ ঘটিয়েছে। আল ফাররা’র চেয়ে একধাপ এগিয়ে আল জাহিয কুরআনের শৈল্পিক রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছেন। জাহিয তার বক্তব্যে প্রাচীন আরবী কবিতার উদাহরণ টেনে বলেছেন, কুরআনের সঙ্গে জাহেলি আরবী কবিতার ছান্দিক কোনো মিল নেই।
মুশকিল আল কোরান গ্রন্থটি লিখেছেন ইবনে কুতায়বা নবম শতকের শেষ দিকে। কুরআনের আলঙ্কারিক রূপ নিয়ে একটি প্রামাণিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন তিনি এ গ্রন্থটিতে। তিনি অনেক হিশাব-নিকাশ করে দেখিয়েছেন, কুরআনে ব্যবহৃত শব্দাবলীর বৈশিষ্ট্য প্রাচীন আরবী কবিতা থেকে স্বতন্ত্র। শব্দের সঙ্গেও তার অর্থের নিখুঁত ঐক্য রয়েছে। প্রতিটি আয়াতের ভিতরে যে ছন্দ রয়েছে তা কুরআন পড়ার সময় একধরনের সুর সৃষ্টি করে। মনে হবে কুরআনের শব্দের সঙ্গে পাঠকের কণ্ঠের কোনো সাঙ্গীতিক চুক্তি রয়েছে, সুরটি যেন পাঠকের অজান্তেই তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে। এটাও বলা যায়, আয়াতগুলোর ব্যতিক্রমি কাঠামোয় অন্ত্যমিলের বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে। কুতায়বা তার গ্রন্থটিতে মানুষের হৃদয়ে কুরআনের প্রভাব নিয়েও আলোচনা করেছেন। কুরআনের কথাগুলো অনেকটা অজ্ঞাতে মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয় ও মুগ্ধ করে। কুরআনের রূপকালঙ্কারের বর্ণনায় কুতায়বা লিখেছেন, খোদা আরবী কবিতা তৈরি করেছেন আরবদের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে, কিন্তু কুরআন নাযিল করেছেন তাদেরকে জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে ও জাহিলী যুগের কুসংস্কার থেকে বাঁচাতে। এ যুক্তিকে মেনে নিয়েই আর রুমমানি তার আল নুকাত ফী ইজায আল কুরআন গ্রন্থে অলঙ্কারের একটি সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছেন। তিনি লিখলেন, অলঙ্কার শুধু অর্থকে সুস্পষ্ট করতে মাধ্যম হিশাবে নয়, বরং এটি মানুষের প্রকাশ ভঙ্গিকে আলাদা একটি মাধুর্যে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার মানে অলঙ্কার হলো, লেখার শৈলীগত রীতি ও তার প্রভাব।
আল খাত্তাবী তার বাইয়ানু ইজায আল কুরআন গ্রন্থটিতে কুরআনের দুইটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। একটিতে তিনি খুবই যথার্থ ও সহজে বোধগম্য হওয়ার মতো কুরআনের অলঙ্কারের ওপর বর্ণনা দিয়েছেন। অন্যটিতে তিনি লিখেছেন, সাহিত্যকে বুঝার জন্য তার স্বতঃস্ফূর্ততা, সাবলীলতাই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে আবশ্যিক উপাদানগুলোর সমন্বয় থাকতে হবে। আরবী বর্ণমালার উচ্চারণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে ইসলামপূর্ব আরবী কবিতার সমালোচনা করা সম্ভব নয়। কারণ, আবৃত্তির উচ্চারণ ছিল তাদের প্রধান কেতা, এটাকে কেন্দ্র করেই আরবদের কবিতায় উৎকর্ষতা লাভ করে। আল বাকিল্লানি আরবদের বাগ্মীতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্বীকার করেছেন কুরআনের আয়াত ও কবিতার চরণ বা কবিতা ও কুরআনের সুরার সঙ্গে কোনো তুলনা টানা সম্ভব নয়। তার দৃষ্টিতে এ দুইয়ের ভিতরে কোনো মিল নেই। কারণ, কোরান হচ্ছে বাগ্মীতার নমুনা, এটাকে শৈল্পিক রচনার কোনো সমগ্রতার নিদর্শন মনে করা ঠিক হবে না। কুরআন সবসময় এ রকম ধারণার ওপরে ছিল। আরবী সাহিত্যকে তিনি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। তা হলো, কবিতা, গাইরুল মুকাফ্ফা বা অন্ত্যমিল ছাড়া ছন্দযুক্ত বক্তৃতা, সাজা বা ছন্দযুক্ত বক্তব্য, গাইরুল মুসাজ্জা বা অন্ত্যমিলহীন বক্তৃতা অথচ কোনো স্বরসাদৃশ্য নেই এবং অন্ত্যমিল ছাড়াই সে গদ্য রচিত হয়। আল বাকিল্লানি দাবি করেছেন, আলাদা ও একক বৈশিষ্ট্যের জন্য উপরের বর্ণিত পাঁচটি শ্রেণীবিভাগের কোনোটির ভিতরেই একে রাখা যায় না। ইমরুল কায়েস ও আল বারুদীদের কবিতাই উদাহরণ হোক না কেন। তাদের একজনের কবিতা প্রাচীন আরবী অন্যজনেরটি আধুনিক আরবী কবিতার প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেন, এদের কবিতা আরবী কাব্য জগতের নেতৃত্ব দিলেও এগুলো নিখুঁত ছিল না। এটা ঠিক যে, এদের কবিতা পাঠকের ভিতরে মোহ তৈরিতে সক্ষম। আরব ঐতিহ্যানুসারে এরা বাহবা পেয়েও যাবে কিন্তু কুরআনের সঙ্গে এসবের কোনো তুলনা টানলে ভুল হবে।
কুরআন নাযিলের পর তা পাঠ করা হতো দুটি ছকে, প্রথমত, এটা ছিল প্রাচীন আরবী কবিতার ঐতিহ্যগত রূপ, যা আরব কবিদের সহজাত কাব্যপ্রতিভা। বলা হয়ে থাকে যে, মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট রূপ ছিল ইসলাম পূর্ব আরবী কবিতা। দ্বিতীয়ত, এ সহজাত কাব্য প্রতিভাকে ধরে রাখার ও লালন করার উপায়। আরবরা লেখালেখির জগতে ঢোকে এ পথেই। কিন্তু কুরআন এ সহজাত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে শুধু লিখিত রূপই দেয় নি, এটি চিরন্তুন আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিগত ভাষা হিশাবে আরবদের সংস্কৃতিকে পাল্টে দিয়েছে। যদি কুরআনের ভাষা একই সঙ্গে নবীদের বা ঐশ্বরিক ভাষা ও ইসলাম পূর্ব আরব কবিদের ভাষা হতো, তারপরেও তার সৌন্দর্যে কোনো ঘাটতি থাকতো না। আল সাওলীর মন্তব্য, কুরআন যদিও জাহেলি আরব কবিদের অনেকগুলো রীতিকে রুদ্ধ করেছে, আবার অন্যদিকে কবিতা রচনার অসংখ্য রীতি তার ভিতরে সুপ্ত আছে। সাওলী যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেন, তা হলো, কুরআন কবিতার ভাষায় নতুন বিপ্লব এনেছে। জাহেলি আরবী শ্রুতি কাব্যচর্চার অস্পষ্ট দিকগুলি যা আরবদের অজানা ছিল, কুরআনের নাযিল, সেসব বিষয়গুলিকে অজ্ঞান আরবদের সামনে দিনের আলোর মতো ফুটিয়ে তুলেছে। আরবী কবিতাকে প্রাচীনত্বের গৎবাঁধা নিয়ম থেকে মুক্ত করে আধুনিকতায় নিয়ে এসেছে। সাওলী স্পষ্ট করেই বলেন, কোনো কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব বাছাইয়ের জন্য তার প্রাচীনত্ব কোনো মানদণ্ড নয়, বরং কবিতায় নতুন বিষয় যুক্ত করেই আধুনিকতার রূপ দিতে হয় এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব বাছাই করতে হয়।
কাব্য সমালোচনার জন্য সংস্কৃতির নিতান্ত প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর ওপর সুনির্দিষ্ট জ্ঞান থাকতে হয়, যাতে রচনার ত্রুটির জায়গাগুলো সহজে চিহ্নিত করা যায়। কারণ, কাব্য সমালোচনা একমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই মানায় যারা কাব্য সংক্রান্ত উপাদান সর্ম্পকে অগাধ জ্ঞান রাখে। সাওলী মন্তব্য করেন আবু তাম্মাম ছিল এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ব্যক্তি। আবু তাম্মাম কবিতায় নতুন শৈলীও নিয়ে
আল জুরজানি এ ইস্যুগুলোকে আরও কাছে নিয়ে আসেন। তার মতে, আসরার আল বালাগা বা অলঙ্কারের রহস্যময়তা ও দালাইল আল ইজায বা অনুসরণ না করার প্রতি ইঙ্গিত এ দুটি রীতির সঙ্গে সমালোচনার রীতিও যুক্ত। লেখ্য কাব্যচর্চার মান বিচার করতে এ দুটি বৈশিষ্ট্যকে প্রধান মনে করতেন তিনি। তার মতে, কাব্যজ্ঞান তখনই স্পষ্ট হবে যখন সেটা দ্বারা সুনির্দিষ্ট অর্থ বুঝাবে। পাঠকের চিন্তায় নতুন কিছু সংযোগ হবে। তাই শ্রুতি রীতির ভিতর দিয়েই এটা সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কবিতা অবশ্যই পাঠ করতে হবে, এবং তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। ছন্দ সম্পর্কে আল জুরজানি বলেন, ছন্দ কখনও চিন্তায় প্রভাব ফেলতে পারে না। কাজেই শুধু ছন্দ দিয়েই কবিতা হয় না। এজন্য দরকার হয় উপমা, রূপকালঙ্কার, সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা, মোহ। এগুলোর সূক্ষ্ম প্রয়োগের ভিতর দিয়েই কবিতা পূর্ণতা পেতে পারে। আল জুরজানি আরো বলেন, কবিতার এই রূপটি কুরআন থেকে পাওয়া। কাব্যজগতে কুরআনই পেরেছে এ বিপ্লবটি আনতে। সত্য কথাটি হচ্ছে, যে যাই বলুক না কেন, বর্তমান আরব জগতে যে সাহিত্য চর্চা হচ্ছে, যাকে আমরা আধুনিক বা অন্য যাই বলি না কেন, এর শেকড়টি রয়েছে কুরআনের ভিতরে। এমনকি আধুনিক সাহিত্য সমালোচনার যে কাঠামোটি তৈরি হয়েছে তা কুরআনের পাঠের ফলেই সম্ভব হয়েছে। কুরআন নন্দনতত্ত্বের যে বিজ্ঞানটি নিয়ে এসেছে তা আরব কবিদেরকে নতুন নতুন ধারায় কবিতা রচনা উব্দুদ্ধ করেছে। লেখালেখির যে জগতটি আরবদের কাছে অচেনা রহস্য ছিল, কুরআন সে রহস্য জগতের পর্দা খুলে দিয়েছে। আরবদেরকে শিখিয়েছে কবিতায় কেমন করে শৈল্পিক ভাষার প্রয়োগ করতে হয়, কৌশল সৃষ্টি করতে হয়। একথাগুলো বলেছেন ইবনে আল আতহির। নবম শতকের মধ্যভাগে মুসলিম ইবনে আল ওয়াহিদ কুরআনের অনুকরণে কবিতায় ছন্দ প্রয়োগের চেষ্টা করেন। ইবনে কুতায়বার দেয়া তথ্যানুসারে, ইবনে আল ওয়াহিদই সবার আগে কবিতার ভিতরে সূক্ষ্ম চিন্তার বুনন ও ভাষাকে কমণীয় করার চেষ্টা করেন। কুরআনের ভাষাকে অনুসরণ করে কবিতায় রূপকালঙ্কার, স্বরসাদৃশ্য ও বিপরীত শব্দের প্রয়োগ করেন।
শ্রুতি কাব্যচর্চা থেকে প্রথম যিনি মুখ ঘুরিয়ে নেন, তিনি হলেন কবি বাসার বিন বুরদ। তিনিই প্রথম লেখ্যরীতির প্রচলন করেন। বুরদ যেটাকে শুরু করলেন কবি আবু নুউয়াস এসে সেটাকে অসাধারণ এক উচ্চতায় নিয়ে যান। কবিতা, ভাষা ও সংস্কৃতিতে নতুনত্ব আনতে সবাই তখন কুরআনের দারস্থ হচ্ছে। কুরআনের শৈলী ও অলঙ্কারকে আয়ত্বে আনতে সবাই ব্যাপকহারে লেগে যায়। কারণ, নতুন ধারায় কবিতা লিখতে জ্ঞান, দক্ষতা, বুদ্ধিগত শৃঙ্খলার দরকার পড়েছিল। ইসলাম পূর্ব যুগের প্রকৃতগত পাওয়া কাব্যশক্তি, প্রতুৎপন্নমতিত্ব ও ভাষাজ্ঞানই যথেষ্ট ছিল না। কাব্যচর্চার এ ধারা প্রতিটি আরবের মধ্যেই ছড়ায় নি। মাত্র কয়েকটি দল এ ধারায় কাব্যচর্চা করত। যে বা যারা এই গ্রুপের বাইরে থাকত তাদের জন্য এ রীতিটি আয়ত্বে আনা খুবই কঠিন হতো। বলা হতো, প্রতিটি পাঠ্য, তা প্রাচীন হোক, বা আধুনিকই হোক, তাদের সহজাত শৈল্পিক প্রতিভা বা রচনার সময়কাল দিয়ে তা তারা বিবেচনা করতে পারতো না।
এ জন্য প্রাচীন আরবী কবিতা আদর্শ কবিতার মডেল হিশাবে বিবেচিত হয় না। বলা হয়, ওই সময়ের কবিতা, কবিতার নির্ধারিত মানও রক্ষা করতে পারে নি। আল জুরজানি যেখানে দেখিয়েছেন কবিতায় ছন্দ প্রয়োগ করা খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ। আল বাকিল্লানি কুরআনের সুরার মতো কবিতায় শব্দ সংগতির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। একটা সময় যখন দেখা যেত শব্দ ও অর্থের মতো চিন্তা কবিতার আলাদা কোনো উপাদান ছিল না। শব্দ বিশ্রী হবে না সুশ্রী হবে তা নির্ভর করতো কবি কী বলতে চায় তার উপর। ফলে শব্দের বুননে একটির সঙ্গে অন্যটির সম্পর্ক তৈরি হতো। আল রুমমানি বলেন যে, প্রাচীন কবিতার সৃষ্টিশীলতা ও কবিতা তৈরির দক্ষতার ভিতরে যে গতিপ্রকৃতি ছিল তাই যুগের পর যুগ একটি অপরিবর্তনীয় নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু কুরআন নাযিল এই নিয়মাবলী ভেঙ্গে দেয়। সর্বশেষে আবু নুউয়াসের কথাই বলা যায়, তিনি লিখেছেন, আমি বলি, আমার ভিতরে নতুন যা কিছু আসে, আমার অভ্যন্তরীণ চিন্তা থেকে, তা আমার চোখকে অস্বীকার করে। আমি কিছু লিখতে শুরু করেছি, সামান্য একটি শ্লোক, কিন্তু বিচিত্র অর্থ, মোহ তাড়িত করে, যাতে আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাই, যাচ্ছি আমি অন্ধের মতোই, যেন কোনো অপার সৌন্দর্যের পিছু নিয়ে, আমার আগে যা ছিল অস্পষ্ট।
কাব্য ও চিন্তা
কবিতা ও চিন্তার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গেলে, শুরুতে তিনটি বিষয়কে সামনে রাখতে হয়। তা হল, আরবী সাহিত্য সমালোচনা, আরব-ইসলামী ভাষাতত্ত্ব ও ধর্মীয় বিজ্ঞান সম্পৃক্ত জ্ঞানতত্ত্বের নিয়মাবলী এবং দার্শনিক নিয়মনীতি। এ তিনটি চিন্তাধারার প্রথমটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইসলাম পূর্ব কবিতাকে আদল ও আদর্শ হিশাবে বেছে নেয় এবং এ সময়ের কবিতাবলির নিয়মনীতিকে বিবেচনায় রেখে পরবর্তী সময়ের কবিতার আলোচনা-সমালোচনা হয়। যদি ধরে নেয়া হয়, ইসলাম পূর্ব কবিতা শুধু সঙ্গীতেরই ডিপো ছিলো না, বরং এর অনেকটা অংশ জুড়ে জ্ঞান ও সত্য ছিল, তবে বলতে হবে সেসব কবিতায় চিন্তারও স্থান ছিল। তাই বলা যায়, এসব কবিতা চিত্তবিনোদনের একক একটি মাধ্যম হিশাবে কবিরা আবৃত্তি করতো না, বরং তাতে সে সময়ের জ্ঞান ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। অন্যভাবে, আরবরা তখন নানা গোত্রে বিভক্ত ছিল, তাদের সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছিল স্ব-স্ব গোত্রকেন্দ্রিক, তাই তাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ছিল, ছিল বৈচিত্র্যও। কবিরা মুখে মুখে যে কবিতা আবৃত্তি করতো তাতে যুদ্ধের কৌশল থাকতো, থাকতো বীরদের বীরত্ব গাথা এবং বেদুইনদের জীবন কাহিনী। চিন্তার প্রভাব না থাকলে এতসব কিছু আসতো না। এটা খুবই সহজ কথা। আরবদের এ চিন্তা-চেতনা তাদের কবিতায় মিশে গেছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন আরবদের এ বিচিত্র চিন্তা-চেতনা একটি একক আদলের ভিতরে সীমাবদ্ধ হয়ে রইল। শুধু সঙ্গীত হিশাবে পরিচিত পেল। সঙ্গীত ও আবৃত্তিই ইসলাম পূর্ব আরবী কাব্য চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্বাচনে স্তুতিবাচক কবিতাই প্রাধান্য পেয়েছে। এই গুজবটি তখন ছড়িয়ে পড়ল। বলা যায়, আরবদের কাব্যচর্চা নিয়ে খুবই হাস্যকর একটি মন্তব্য ছিল এটি। বহুকাল ধরে এ মূল্যায়নটি বহাল থেকেছে, তাই, সত্যিসত্যিই কবিতা ও চিন্তা দুটি একটি অন্যটি থেকে আলাদা হয়ে গেল। যাদের মাথা থেকে এ ধারণাটি বের হল, তারা এও বলল, বেশ ক’জন কবির কবিতায় চিন্তা উপাদান হিশাবে ছিল, তবে তাদের সংখ্যা নগণ্য বৈকি। এ সময়ের কবিতাকে চিহ্নিত করা হলো রীতিবিচ্যুত কবিতা, অনেকটা গোত্রচ্যুতির মতো। বলা হলো, বিচ্যুতির জন্য কবিতার বিষয়বস্তু পরিণত হলো অস্পষ্ট, জটিল, অতিরঞ্জন কিছুতে। এগুলোকে কখনও কখনও অদ্ভূত ও আজগুবি নিয়মের কবিতাও বলা হয়। বলা হলো, সত্য ও জ্ঞান থেকে দূরে সরে যাওয়া কবিতাগুচ্ছ। কিন্তু এক সময় যখন কবিতার সত্যিকার মূল্য বিচারে যাওয়া হলো তখন এ যুক্তি আর ধোপে টিকল না। এমনকি এসব সমালোচকরা আবুল আ’লা আল মা’আরিকে কবি হিশাবে বিবেচনা করতো না। যদিও তাকে আরবদের ঋষী বলা হতো। তার আগে আল মুতানাব্বিকেও এরকম এক শ্রেণীর কবিদের তালিকায় ফেলা হতো। তবে এই দুজনের আগেই তারা আবু তাম্মামকে আরব কবিতা ও “আরব তরিকা”র “ফাসাদকারী” হিশাবে আখ্যায়িত করেন। দৃষ্টিভঙ্গির এ ক্ষুদ্রতা পরবর্তী সময়ের কবি ও তাদের কবিতায় প্রভাব ফেলে। সমালোচকরা উদাসীনের মতো, প্রাচীন আরব কবিতায় চিন্তার উপাদান ধরতে ব্যর্থ হন। যেহেতু, অজ্ঞানরা এসব কবিতা রচনা করেছে, তারা তো জাহেল ছিল, তাই তাদের কবিতায় চিন্তা বলে কিছু থাকতে পারে, তা হতেই পারে না, তাদের বিবেচনা মোটামুটি এমন বলে মনে হয়।
প্রাচীন আরব কবিরা কোনো গৎবাঁধা রীতিনীতির ধার ধরতো না, তাই এসব কবিতা প্রকৃতিগতভাবেই বিচিত্র ছিল। প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরপুর ছিল। যা আধুনিক কবিতায় খুবই কম দেখা যায়। এসব থাকা সত্ত্বেও কেন প্রাচীন কবিতাগুলো সমালোচিত হয়ে আসছে গানের সংকলন, আরবদের নিজস্ব সীমিত জ্ঞানের সংকলন, অজ্ঞানদের ভালো ও মন্দ কাজের স্বাক্ষী প্রভৃতি হিশাবে। ইবনে খালদুন যাকে এক কথায় বলেছেন, আলোর যুগের আরবরা প্রাচীন যা কিছু প্রত্যাখ্যান করেছে তারই স্বাক্ষী এসব কবিতা। কিন্তু এসব কবিতায় রয়েছে সত্য ও প্রজ্ঞা। মনে হচ্ছে, সমালোচকরা সচেতনভাবেই এসব এড়িয়েছেন। আল জুরজানি এসব কবিতাকে বলেছেন, জ্ঞানশস্যের সংগ্রহ, নেতৃত্বের নির্দেশনা, সংস্কৃতির প্রচারক এবং এসব কবিতার ফলেই প্রাচীন আরবদের রীতিনীতি ও তাদের গৌরবগাথা এ পর্যন্ত টিকে আছে, বর্তমানেও আমরা প্রাচীন আরব ইতিহাস খুঁজি এসব কবিতা থেকেই। মূল কথা হলো, সমালোচকরা আদতে প্রাচীন আরবী কবিতার প্রকৃতরূপটা ধরতে পারে নি। কারণ, এসব কবিতায় তাদের অসংযত আবেগের বহির্প্রকাশ সহ মেধা ও মননের প্রতিফলন ঘটেছে। যাকে সমালোচকরা গানের সংকলন বলে পার পেতে চেয়েছেন। কিন্তু সেসব কবিতায় যে চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল তা তো আর মুছে যাবে না। আরবী সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গি এ জন্য দায়ী। কুরআন নাযিলের পর সবাই মানে সমালোচকরা ইসলামপূর্ব আরবী সাহিত্যকে কিছু নেতীবাচক শিরোনামে অব্যাহতি দিয়েছেন। বর্তমানে এসে দেখা যায়, তা আসলে পুরোপুরি সঠিক ছিল না।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, আরব-ইসলামী ভাষাতত্ত্বকে জ্ঞানতত্ত্ব ও ধর্মীয় বিজ্ঞানের দিক থেকে পর্যালোচনা। সে হিশাবে আরবী ব্যাকরণ ও অলঙ্কার থাকবে জ্ঞানতত্ত্বের এবং বিচারব্যবস্থা ও ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মীয় বিজ্ঞানের কাতারে। খুবই স্পষ্ট, একদিকে বিচারব্যবস্থা ও ধর্মতত্ত্ব, অপর দিকে ব্যাকরণ ও অলঙ্কার। এগুলো কবিতা ও চিন্তাকে স্পষ্টভাবেই দুটি দিকে আলাদা করে রেখেছিল। এটা এক তিক্তসত্য, কিন্তু স্বীকার না করে উপায় নাই যে, তখন ধর্মতত্ত্ব ভ্রান্ত কিছু একটা হিশাবে বিবেচিত হতো। নন্দনতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিকতাকে ভিন্ন দুটি নিয়মে পৃথক করা হয়েছিল। অর্থাৎ নান্দনিতার উপভোগটি ছিল একরকম ও আধ্যাত্মিক আনন্দটি ছিল অন্যরকম। কুরআন এখানে এসে আরবী শ্রুতিকাব্যকে তাত্ত্বিকভাবে সমর্থন করে। কিন্তু নতুন একটি সংস্কৃতির আওতায় এনে সেটাকে একরকম শৈল্পিক শৈলীতে পুর্নজীবন দান করে। কুরআনের এ ভূমিকার ফলে প্রাচীন কবিতার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠে নি।
তৃতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বের দাবি নিয়ে আসে, তা একেবারে দার্শনিক বিচারে আরব কবিতার চিন্তাকে যাচাই-বাছাই করা। দার্শনিক যুক্তিগুলো একটি জায়গায় ওপরে উল্লেখ করা বিষয়দুটির সঙ্গে মতপার্থক্য তৈরি করে। তা হলে, পদ্ধতিবিজ্ঞান (মেথডলোজি) ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিদ্যা। কিন্তু আবার একরকম স্ববিরোধীতার মতো, ওপরের বর্ণিত বিষয়দুটিকে চালু রেখে তাদের সত্যতার স্বীকৃতি দেয়। ওইসব যুক্তি নিজের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলে, গ্রীকদর্শন থেকেও কিছুটা ধার করে।
এমন করেই তাত্ত্বিকদের চোখে আরবী কবিতা কখনও উৎসব ও সঙ্গীতের আনন্দ আবার ছুঁড়ে ফেলা বাজে জিনিস বলে ধরা পড়েছে। এতে আরবী কবিতা পরিচিতি পেয়েছে হয় অসত্য ও অদ্ভূত সংস্কৃতি না হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক উপাদান হিশাবে। আরবী কবিতাকে সবাই ভাবতো ত্রুটিপূর্ণ বা নেতিবাচক কিছু শব্দের সমন্বয়। সবচেয়ে ভালো ধারণাটি ছিল, খেলাধুলার মতো এসব কবিতাও একপ্রকার আনন্দ বহন করতো। কিন্তু এর ভিতরে চিন্তা বা জ্ঞানধর্মী কিছু থাকতে পারে তা কেউ হিসাব করে দেখে নি ।
কিন্তু ধর্মীয়-ভাষাতাত্ত্বিকভাবে প্রাচীন আরবী কাব্যচর্চার চিন্তার দিকগুলো খুবই আলোচনার যোগ্য ছিল কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে করা হয় নি। যেমন, কবিতার আরবী প্রতিশব্দ শে’র। যা শা’র থেকে উদ্ভূত। এর বাংলা অর্থ হতে পারে জানা, বোঝা বা উপলব্ধি করা। কবিকে আরবীতে বলা হয় শায়ের অর্থাৎ যিনি জানেন, বোঝেন ও উপলব্ধি করতে পারেন। কবি ইয়াশউরু বা কল্পনা করতে পারেন, তবে যেটাকে তিনি কল্পনা ও বুঝতে পারেন না কিন্তু সেটা তিনি ই’লামু বা জানেন। সেক্ষেত্রে কবিতা বা শে’র হলো ছন্দ ও অন্ত্যমিলযুক্ত বক্তব্য। শাআরা ক্রিয়াটি অনুভব করা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, কবিতা বা শে’র আসলে কী? এর উত্তরে বলা যায়, যা অনুভব করা হয় এবং সে অনুমিত জিনিসটি জ্ঞানের দ্বারা প্রকাশ করা হয়। মানুষ কেন বলে, তাকে আমি খুব প্রিয় ভাবতাম। কিন্তু কেউ বলে না, আমি অনুভব করি আল্লা হচ্ছেন একজন। কারণ, আল্লাহকে অনুভব করা যায় না, তবে উপলদ্ধি করা সম্ভব। এ ব্যাপারটিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে চিন্তা করা যেতো, কবিতা ইন্দ্রিয়কে কেন সীমিত করে রাখে! কেনইবা কবিতা ও চিন্তার মধ্যে একটি ভেদরেখা তৈরি হলো। কবিতা কখনোই জ্ঞানের প্রাথমিক স্তরটিকে অতিক্রম করতে পারে না, করেও না। ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধির সঙ্গে খাপ খেয়ে যেতে পারে কিন্তু ধর্ম ইদ্রিয়গত বিষয়াদি থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। চিন্তার শুরুটা আসলে এমনই। কিন্তু কবিতার যে সংজ্ঞাটি তৈরি হয়েছে, তা জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে নি; সত্যকে যথার্থভাবে প্রকাশ করতে পারে নি। কবিতায় চিন্তার যে প্রতিফলন হয়েছে, সমালোচকরা তা না ধরে ইচ্ছা-স্বাধীন অসম্পূর্ণ একটি সংজ্ঞা তৈরি করে। এ কথা সত্য, ধর্মীয় বিধি-বিধানকে পুরোপুরি সত্য হিশাবে ধরে নেয়া যায়, কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে সেটা হয় না, সেখানে কল্পনার মিশ্রণ আছে। কবিতা সীমিত নান্দনিক আনন্দ দিয়েই ক্ষান্ত হবে। কিন্তু ধর্ম তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেখলে তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করতে পারবে। কবিতায় শব্দ প্রয়োগের এসব জটিলতার জন্য কোনো কোনো সময় শব্দ বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে বসে। ফলে কবিতায় শব্দের ব্যবহারিক দিক, কবিতাকে একত্রিকরণ ও তাতে চিন্তার অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
কবিতা শুধুই অনুভব করা বিষয়টির কোনো উপাদান হিশাবে লেখা হয় না; বরং তাতে চিন্তাও একটি উপাদান। ভাষাতত্ত্ব ও ধর্মীয় রীতিতে কবিতায় শব্দের ব্যবহার নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কবিতা তার মৌলিক নিয়মের ভিতরে আটকে না থেকে কখনও কখনও স্বাধীন ভাব প্রকাশ করে। কারণ, কবিতার সঙ্গে সামাজিক ও নৈতিক সম্পর্ক আছে, এ সম্পর্কই তাকে নিয়মরীতির বাইরে নিয়ে যায়। সমাজ জীবনে যা কিছু আমরা করি ও বলি তার একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে কবিতায়। যদি কেউ প্রশ্ন করে কবিতা জিনিসটি কী? এর জবাব হলো, কবিতাকে সমালোচনা ও বুদ্ধি খাটিয়ে পড়তে হবে, কবিতার ইতিহাসটি পুনরায় লিখতে হবে, কবিতার নান্দনিকতার জ্ঞান থাকতে হবে। তা হলে কবিতা কী তা জানা সম্ভব হবে। কবিতার থিওরী থেকে যা হারিয়ে গেছে, তা পেতেও এ মাধ্যমটি গ্রহণ করা যেতে পারে।
কবিতা ও চিন্তার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক আছে, যে কোনো কবিতা পড়ার সময় বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। বলা হয়, কবিতা পড়ার এ দিকগুলো নন্দনতত্ত্বের নতুন ধারা ও চিন্তার জগতের নতুন মেরু তৈরি করে। চিন্তা ও অনুভূতি এ দুটি দিয়ে মানুষকে ভাগ করা যায় না। মানুষ হলো একটি স্বতন্ত্র সত্তা যাতে সবকিছুর সম্মিলন আছে, জাগ্রত একটি শক্তি আছে। কবিতা ও চিন্তার সঙ্গে যে এক ধরণের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক আছে, সেটি স্পষ্ট করতে আরবের তিন কবিকে নিয়ে আলোচনা করা যায়। তারা হলেন, আবু নুউয়াস, আল নিফারি ও আবুল আলা আল মাআরী।
আবু নুউয়াস:
কবিতা ও চিন্তার সম্পর্কের দিকগুলো আলাদা করলে আবু নুউয়াসের কবিতা অস্পষ্টই থেকে যায়। কবির সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও কবিতার কেন্দ্রবিন্দু সে অনেকটা দ্বান্দ্বিকতার কায়দায় প্রকাশ করেছে। বেদুইন সংস্কৃতিকে স্থান না দিয়ে প্রতিপাদ্য হিশাবে নিয়েছেন শহুরে সংস্কৃতিকে। ধর্মীয় গোড়ামিকে কখনওই মেনে নেন নি। তিনি ভাবতেন, কবিতাকে সকল প্রকার গোড়ামির ঊর্ধ্বে রাখা উচিত। তবে তার কবিতায় অশ্লীলতার প্রভাব ছিল প্রবলভাবে। অশ্লীল বলতে ধর্মশাস্ত্রে যেসব ক্রিয়কলাপ মানুষের জন্য নাজায়েয করেছে তাই। দ্বান্দ্বিক চিন্তা-চেতনার বাইরে তার কবিতার সংখ্যা খুবই কম। এ দ্বান্দ্বিকতা পাঠকের মনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের আচার-আচরণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাগুলোর একটা চিত্র আঁকে। তার কবিতা একপ্রকার বিশেষ জ্ঞান ও নৈতিকতার সঙ্গে পরিচয় করায় পাঠককে। মানুষের সম্ভাবনাময় ও হতাশার জায়গাগুলো চিহ্নিত হয়েছে ভিন্নভাবে, উপাদানও গ্রহণ করেছেন এ বিষয় দুটোকে ঘিরে। কোনো কোনো জায়গায় তার কবিতা মানুষের গ্রহণ-বর্জনের রীতিনীতিকে একেবারেই মুক্ত করে দিয়েছে। কোনো প্রকার নিয়মনীতির বালাই রাখে নি। এ মুক্ত করার মানেটা কী? প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক। তিনি মানুষের স্বাধীনতার সব জায়গাগুলো উন্মুক্ত করে দিয়ে বিধি-নিষেধের সব দেয়াল ভাঙতে চেয়েছেন। তাই নুউয়াসের কবিতা হয়ে উঠেছিল জ্বলন্ত অগ্নি শিখার মতো, যা ধর্মীয় ও সামাজিক বাধ্য বাধকতা ভেঙে ফেলেছে। তিনি মনে করতেন, আনন্দ জিনিসটা মানুষের স্বাভাবিক জীবন থেকে পাওয়া যায় না, এটা পেতে হলে নিষিদ্ধ ও অনৈতিকতার পেছনে ছুটতে হয়। পুরোপুরি বিপরীত স্রোতে। তিনি ঘোষণা করেন, নিষিদ্ধি জিনিসের ভিতরেই আনন্দ লুকিয়ে আছে। তিনি একথাও বলেছেন, আমার ধর্ম আমার ভিতরেই বিদ্যমান।
আন নাফারি :
নাফারী মনে করতেন, মানুষের প্রকাশ করার স্বাধীনতা থাকবে অবাধ, চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। তিনি মানব জীবনের অজানাকে জানার জন্য কাজ করেছেন। তিনি বলতেন, যা জানো না তা জানতে চেষ্টা করো, নতুন কিছু সৃষ্টি করো। নিজেকেই নিজে বলতেন, আমি কিছু জানি, কিন্তু আসলে কিছুই জানি না। নাফারিকে সহজ ভাষায় বললে মোটামুটি মুক্ত চিন্তার মানুষ বলা যায়। তিনি যুক্তি ও রীতিনীতির কায়-কারবার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। নিজের ভিতরে একরকম চিন্তার রাজ্য তৈরি করেছিলেন। যা বলা হয় নি, প্রকাশ পায় নি তা বলার জন্য ভাষাকে তিনি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে বলেছেন। মানুষের জানার বাইরে গিয়ে তিনি প্রগতি খোঁজ করতেন। অচেনা, অজানাকে জানতে সদা প্রস্তত থাকাকেই তিনি প্রগতি বলতেন। যার ভাষা আছে অথচ সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না তাকে বলেছেন শক্তিহীন। তবে নাফারির কবিতার ভাষা ছিল রূপকালঙ্কারিক। তার মতে, এটা কবিতাকে পাঠকের কাছে ব্যাখ্যা করে দেয় এবং যুক্তি ও গুরুত্বকে সঠিকভাবে প্রকাশ করে। তিনি গতানুগতিক ধর্ম চর্চা থেকে ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। তবে জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিটি স্থাপন করেছেন এই ধর্ম থেকে। বিষয় হিশাবে ধর্মকে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার করেছেন। কবিতার সৌন্দর্য তৈরিতে কুরআনের দারস্থ হয়েছেন। কবিতার ধারায় পরিবর্তন আনতে এটাকে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করতেন। ভাসা ভাসা বর্ণনার চেয়ে পাঠককে অর্থের গভীরে নিয়ে যান, যুক্তিজ্ঞান ও ভাব বা অন্তর্জ্ঞান দুই দিক থেকেই। তবে তিনি তার কবিতা রচনায় বিষয়বস্তুর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে কবিতার রীতিনীতিকে একপ্রকার অবজ্ঞাই করেছেন বলা যায়। তিনি একইসঙ্গে আরবদের সৃষ্টিশীল শক্তি ও কবিতার ভাষায় চমৎকার পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। সমালোচকরা আরবদের ভিতরে তার কবিতার ভিতরেই প্রথম মানুষের ব্যথা-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া দেখতে পান। মানুষের ভিতরে কতো প্রকার প্রশ্ন জাগতে পারে তা প্রথমে তার কবিতার মধ্যে প্রকাশ পায়। বলা হয়, কবিতার প্রকৃতিগত দিক দিয়ে তার কবিতার চরিত্রগুলো ছিল অত্যন্ত গভীর। কবিতায় ভাষার চাতুর্যের বদলে পাঠককে চিন্তার গভীরে নিয়ে যেতেন। বলা যায়, কানা গলিতে চিন্তার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটাকে আলোকিত করেছেন। তিনি ব্যবহারিক ও যুক্তিগত দুইদিক দিয়েই তার চিন্তাকে প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
আবুল আ’লা আলা মাআরী :
মাআরী তার বিশ্বাস ও চেতনাকে চিন্তা শক্তির দ্বারা কবিতায় প্রকাশ করেছেন। কবিতার ভিতরে মনস্তাত্ত্বিক বৈচিত্রকে স্থাপন করেছেন বুদ্ধিগত কাঠামোয়। তার কবিতা পাঠককে এমন এক চিন্তার জগতে নিয়ে যায়, যেখানে মানুষের কণ্ঠকে তিনি বিচিত্রভাবে প্রদর্শন করেছেন। কবিতায় তিনি ধর্মজ্ঞানকে অবজ্ঞা করেন নি। তার সময়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাবলিকে তিনি দেখিয়েছেন এমনভাবে যে, এই সকল ঘটনাবলি তাকে তার চিন্তা জগতকে সঠিকভাবে গড়ে উঠতে দেয় নি। তিনি তার সময়ের সকল প্রকার ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দলাদলি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন। চারপাশে যা-ই হোক না কেন, তার রীতি ছিল তিনি সত্যকে প্রকাশ করবেনই। তার সময়ের বিশ্বের বাস্তব ঘটনাবলি দেখে যে কবিতা লিখেছেন তা পাঠকের হৃদয়ে এই ধারণা দেয় যে, এখন সময়টা হলো সবকিছু হারানোর। কবিতা যদি হয় আরবদের নিয়ম-রীতির সারবস্তু বা বিশ্বের শৈল্পিক রূপ তবে তার কবিতাকে বলতে হবে অর্থের শিল্প। মাআরী শব্দাবলীকে খুবই যাচাই-বাছাই করে ব্যবহার করেছেন যার ফলে তার কবিতার অর্থ প্রকাশে কোনো দুর্বোধ্যতা ছিল না। তার কবিতার শব্দ ব্যবহারটি ছিল এরকম যে, জীবন মানুষকে সবসময় মৃত্যর দিকে নিয়ে যায়। ব্যক্তির গায়ের কাপড়টি তাকে ঢেকে দেয়, তার বাড়িটি হচ্ছে যেন তার কবর, তার জীবনটা হল মৃত্যু, কাজেই মৃত্যুই হলো মানুষের সত্যিকারের জীবন। জীবন বলতে তিনি কোনো অস্তিত্বকে স্বীকার করেন নি। তিনি মনে করতেন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করাই হলো, তার সবচেয়ে বড় গুনাহ। মাআরী বলেছেন, শরীর আমার টুকরা কাপড়, গাঁথা ধরার সনে, অহো, কে আমারে করল সেলাই, গাঁথল বিশ্বটাকে?
এ তিন কবির কবিতা আরবী সাহিত্যে চিন্তার বিকাশ ঘটিয়েছে বিভিন্নভাবে। কল্পনা শক্তিকে কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছে নিখুঁতভাবে। জ্ঞানতত্ত্বের সূক্ষ্মতা ও সমসাময়িক প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অতিক্রম করে তাদের চিন্তার উপাদানগুলো সংযুক্ত করেছে কবিতায়। তাতে চিন্তা ও কবিতা এ দুইয়ে কোনো বিভেদ ধরা পড়ে না। চিন্তার আরবী প্রতিশব্দ হলো ফিক্র। যখন আমরা চিন্তার গভীরে যাবো তখন দেখবো হৃদয় ও আত্মা জাগ্রত, সচেতন। মানুষের মনের বা হৃদয়ের সকল ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। চিন্তা আসলে অন্তর্জ্ঞান ও সমাজে তার প্রতিফলনের দ্বারাই প্রকাশ পায়। তবে কবিরা চারটি ক্ষেত্রে কবিতায় চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পেরেছে। প্রথমত, মানুষের পশ্চাৎপদতা ও বাজে সংস্কৃতিকে কাব্যচিত্রে প্রকাশ করেছে একটি সৃষ্টিশীল পাঠ্য হিশাবে। যা পাঠক অনুভব করে বা তা নিয়ে চিন্তা করে। তা থেকে নিজের অন্তর জগতকে জানার চেষ্টা করে পরিস্কারভাবে। দ্বিতীয়ত, মানুষের অন্তর জগতের চিন্তা-ভাবনা কবিতার দ্বারা প্রকাশ পায়। জানতে চেষ্টা করে যা তার কাছে এখনও অজানা, অন্ধকার, কিন্তু কঠিন বাস্তবতাকে অস্বীকার করে নয়। তাতে মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। তৃতীয়ত, মানুষ তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে যা সে পড়ে বা শিখে তার ওপরে সৃষ্ট নানা প্রশ্ন ও জবাব কবিতা হয়ে ফুঠে ওঠে। জীবন ও চিন্তার বিশাল সীমানা থেকে যে সত্যটি সে খুঁজে পায়, কবিতায় তার নান্দনিক প্রকাশ ঘটে। চতুর্থত, এ প্রকাশটির ভিতরে কিছু কিছু এমন আছে যা অনেকটা উঁচু মানের রচনা হিশাবে বিবেচিত হয় এবং অজানাকে জানার ব্যাপারে তা তালা-চাবির কাজ করে। নতুন কিছু রচনার ভিত্তিভূমিও হয় এটি। যা শুধু বর্তমান বাস্তবতাকে বুঝতেই সাহয্য করে না, ভবিষ্যৎ কোনো কিছু গড়ে উঠলেও এটাকে কেন্দ্র করেই তা হয়।
কবিতা ও চিন্তা এভাবেই একটি সময়ে একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে, এটা হয়েছে অত্যন্ত সজ্ঞানে। বলা হয়, কবিতার সঙ্গে যখন চিন্তার মিশেল ঘটে তখন এটা হয়ে ওঠে সুগন্ধি ফুলের মতো, যার গন্ধ মানুষকে মুগ্ধ করে। যখন কবিতার সঙ্গে রূপকালঙ্কার যুক্ত হয় তখন কবিতার চরিত্রগুলোকে মানুষের হৃদয়ে শৈল্পিক দৃশ্য আঁকে।
[সংক্ষেপিত তরজমা: আদোনীস এর “আশ শি’রিআতুল আরাবিয়্যাহ” থেকে]
আরো পড়ুন:
১.আল মাআরী ও আন নাফারী এর কবিতা