শ্রম দিবস, নারী দিবস ও পোশাক শিল্পে নারী শ্রমকি


আজ পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। আবার কিছূদিন আগে ঘটা করে পালিত হয়েছে ৮ই মার্চ- আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পূর্তি। মে দিবস পালনে বিশেষ জোর না থাকলেও নারী দিবস পালনে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেমন বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল তেমনি সমানগুরুত্ব পেয়েছে দেশের উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার সংস্থা, নারী সংগঠন, রাজনৈতিক দল সমূহ এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কাছে।

এবারের নারী দিবসের শতবর্ষে সমঅধিকার ও সমসুযোগ প্রতিষ্ঠায় নারী হোক রাজনীতির সমঅংশিদার, শ্লোগানটি সামনে রাখা হয়েছে। তারপরও অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাছে নারীর উপর সহিংসতার নানা মাত্রা প্রধানভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিষয়বস্তু হিশাবে এসব সংস্থা শতকরা কতোভাগ নারী পারিবারিক জীবনে স্বামী অথবা নিকট আত্মীয়ের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হলো, বছরে কতোজন নারী এসিডদগ্ধ হন, কতোজন নারী সামাজিক ও পারিবারিক চাপে আত্মহত্যা করেন, কতোজন নারী ভিন দেশে বিক্রি হয়ে যান, কতোজন নারী ফতোয়াবাজীর শিকার হন, ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো তথ্য সহকারে জাতির সামনে তুলে ধরেন। পাশাপাশি অনেকের কাছে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। সেখানে কতোজন নারী ক্ষুদ্র ঋণের কল্যাণে পুরুষের মতো সক্ষমতা অর্জন করছেন সেই তথ্যচিত্র যেমন রয়েছে, তেমনি নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের অক্ষমতার বয়ানও অনেক আছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ঘরে বাইরে সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্র কাঠামো পরিচালনার ক্ষেত্রে নারী যে নিরাপদ নয় এই দিকটার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐ দিনের এক আলোচনা সভায় ঘোষণা দিয়েছেন, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব আইন বাতিল করা হবে। অর্থাৎ নারী দিবসকে সামনে রেখে যেসব ইস্যু উত্থাপন করা হয়েছে তা প্রধানভাবেই আইনগত ও রাজনৈতিক। ফলে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিশাবে রাষ্ট্রের আইনগত কাঠামোর মধ্যে ফয়সালা করার কথা বলতে পারাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সাধনে প্রচলিত আইনসমূহ যে বৈষম্যমূলক তা নয়, সেটা নিপীড়নমূলকও। এটা নারীর জন্য যেমন সত্যি, তেমনি শ্রমজীবী জনগণ ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্যও সমান সত্যি। প্রচলিত আইন কানুন শুধু যে বৈষম্যমূলক তা নয় সেটা সহিংসতারও জন্ম দেয়। নারীর প্রতি বৈরী মনোভাব উৎপাদন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণায় সেই বাস্তবতা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। তবে আমাদের আলোচনা উপরে উত্থাপিত সামগ্রিকতা নিয়ে নয়। আলোচ্য বিষয় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের একটি বিশেষ দিক নিয়ে। যা এবার নারী দিবসের শত বর্ষের অনুষ্ঠানগুলোতে বলতে গেলে অনুল্লেখিত থেকে গেছে। তাছাড়া আমাদের সমাজ জীবনে ফতোয়াবাজী নিয়ে যতো বাহাস রয়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান নিয়ে অতোটা বিতর্ক নেই। বিশেষত মধ্যবিত্তের সমাজ মানসিকতায় বিষয়টি প্রবল আকারে রয়েছে। তবে মূল আলোচনায় প্রবেশ করার পূর্বে আমরা নারী দিবসের সূচনা ও তার মর্মবস্তুর দিকে প্রথমে নজর দেবো।

দুই.

যে ৮ই মার্চকে আমরা নারী দিবস হিশাবে উদযাপন করছি তার একটি ইতিহাস রয়েছে। ওই দিবসের সূচনা করেছিলো শ্রমজীবী নারীরাই কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাকে ভিত্তি করে।

১৮৫৭ সালের ৮ ই মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে একটি সুঁই তৈরি কারখানার শত সহস্র নারী শ্রমিক রাজপথে নামেন। তাঁদের দাবি ছিলো মজুরি বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রে শ্রম সময় ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ করা। ওই দিন তাঁদের দাবির প্রতি তো মনোযোগ দেয়া হলোই না বরং ওই ধরনের দাবি ভিত্তিক সমাবেশ আইনের দৃষ্টিতে সমস্যাজনক হওয়ায় সমাবেশকারীরা পুলিশী নিপীড়নের মুখে পড়েন। ফলে নারী শ্রমিকদের লড়তে হয় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের আইনগত অধিকার নিয়ে। ১৮৬০ সালে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সুঁই তৈরি কারখানার নারী শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠনের আইনগত অধিকার পান। এর পরবর্তিতে ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ আবারো নিউইয়র্ক শহরের রাজপথে সমবেত হন পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের হাজার হাজার নারী শ্রমিক। তারাও দাবি জানান ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের। মজুরি বৃদ্ধি। কর্মক্ষেত্রে শিশুশ্রম বন্ধ এবং ভোটাধিকারের।

পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৯ সালে আমেরিকার ৩০ হাজার নারী শ্রমিক ১৩ সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট পালন করেন। তাদের এবারের দাবি ছিল সমকাজের সমমজুরি, মজুরি বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রে জীবন ধারণের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।

এর পরের বছর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সমাজতান্ত্রিক নারীদের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় সভায় জর্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নারী নেত্রী ক্লারা জেতকিন শ্রমজীবী নারীদের বছরে একটি নির্দিষ্ট দিনে একত্রিত হওয়ার একটা খসড়া প্রস্তাব করেন। যাতে ঐ নির্দিষ্ট দিনে শ্রমিক নারীরা একত্রিত হয়ে মত বিনিময় করতে পারেন। পুঁজির সাথে শ্রমের যে লড়াই তার মাত্রা নির্ধারণ করতে পারেন। এবং পরবর্তী বছরের পরিকল্পনা হাজির করতে পারেন। ক্লারা জেতকিনের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ৮ই মার্চকে নারীদের একত্রিত হবার দিবস হিশাবে ধরা হয়। যাতে করে ১৮৫৭ সালের পূর্বে এবং ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার স্বীকৃত হওয়ার আগে ইওরোপ ও আমেরিকাতে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মেশিন ও কারখানা ভাঙার আন্দোলন করেছেন। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন স্বীকৃত না হওয়াতে আমরা মাঝেমধ্যে একই ধরনের ঝোঁক দেখতে পাচ্ছি। সেই বিবেচনায় ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ আমেরিকার নারী শ্রমিকদের আন্দোলন একটা বিশেষ দিক নির্দেশনা যে হাজির করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটা হলো পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মেশিন ভাঙা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনার ভিত্তিতে পথে নামা এবং দাবি আদায়ের আন্দোলনে সক্ষমতা অর্জন করা। ইতিহাসের বিচারে মেশিন ভাঙার আন্দোলনের চেয়ে শ্রমিকদের দাবি ভিত্তিক সংগঠিত আন্দোলন যে খুবই শক্তিশালী সেটা আজ প্রমাণিত। ১৯১০ সালের পর ইওরোপ আমেরিকায় শ্রমিক আন্দোলন কিছুটা থিতিয়ে পড়েছিল নানাবিধ কারণে। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে রাশিয়া এবং জর্মানিতে তা একটা নতুন মাত্রা নেয়। ১৯১৭ সালে বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে সামনে রেখে নারী দিবসে রাশিয়ার নারী শ্রমিকরা একত্রিত হন। তাঁরা শ্লোগান হিশাবে ‘শান্তি’ ও ‘রুটি’র দাবি সামনে রাখেন। নারীদের শান্তিপূর্ণ মিছিল ধর্মঘটে গড়ায়। ধর্মঘট থেকে রাস্তার লড়াই। এবং রাস্তার লড়াই থেকে জারের পতন ও বুর্জোয়াদের ক্ষমতা দখল সম্পন্ন হয়। তার পরপরই ঘটে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। যে বিপ্লবে ‘শ্রমজীবী নারীদের সোভিয়েত’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে কর্মক্ষেত্রে সমকাজের সমান মজুরি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। শ্রমের লিঙ্গভেদ পাশ কাটাতে সোভিয়েত সরকার সব ধরনের শ্রমক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে আইনগতভাবে স্বীকৃতি দেয়। ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস নির্দিষ্ট করে এবং শ্রমকে সেচ্চা ও আবশ্যিক এই নির্দিষ্ট দুই ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে। এখানে একটি বিষয় আমাদের স্মরণ রাখা দরকার সোভিয়েত সরকারের এসব পদক্ষেপগুলোর কোনোটাকে তার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি হিশাবে দেখে নি। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আশু ও প্রাথমিক পদক্ষেপ হিশাবে গণ্য করেছিলেন।

রুশ বিপ্লবের এসব পদক্ষেপগুলো সেদিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঝড় তোলে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভ্যন্তরে পরিবর্তনের চাপ বাড়তে থাকে। তারই প্রতিক্রিয়াতে ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত লিগ অব নেশানসের প্রথম ঘোষণা পত্র ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) সূচনা থেকেই শ্রমজীবী নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান মজুুরি ও সম মানসম্পন্ন সুযোগ সুবিধা প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ৮ ই মার্চকে ঐসব প্রতিষ্ঠান থেকে নারী দিবস হিশাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় নি। তবে দিবসটি সমাজতান্ত্রিক নারীরা পালন করে আসছিলেন।

অন্যদিকে লিগ অব নেশানস গঠন হওয়ার পরপরই কার্যক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়ে। কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের দাবি দাওয়াগুলো অনেক উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ঝুলে যায়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা জাতিসংঘের চার্টারে ১৯৪৫ সালে নারীর সমঅধিকারের দাবিকে মৌলিক মানবাধিকার হিশাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু সেদিনও ৮ ই মার্চকে নারী দিবস হিশাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় নি। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিশাবে স্বীকৃতি দেয়ার পর বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর কাছে দিবসটি গ্রহণযোগ্যতা পায়। তার পূর্বে বহু বছর ধরে ৮ ই মার্চ সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক কর্মসূচি আকারে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো সমাজতান্ত্রিক ঘরানার নারী নেতৃত্বের কাছে ৮ই মার্চের বার্তা কখনো সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বা নারীমুক্তির পদক্ষেপ হিশাবে বিবেচিত হয় নি। তাছাড়া, ৮ই মার্চের জন্মলগ্ন সময়কাল থেকেই তার গা গতরে নারীমুক্তির ছাপ কখনো ছিল না। এমনকি ১৮৫৭ সালেও ইওরোপের অনেক রাষ্ট্রে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় নি। তারপরেও সমাজতান্ত্রিক ঘরানার নারীরা ৮ই মার্চের আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। কারণ পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমের যে লড়াই সেখানে ৮ই মার্চের আন্দোলন একটা ঐতিহাসিক কর্তব্যকে হাজির করেছিল। সেটা হলো বুর্জোয়া সমাজে শ্রমজীবী নারীদের নাগরিক হয়ে ওঠার লড়াই। যেমন আমেরিকার বুর্জোয়া সমাজে আধুনিক শ্রেণী হিশাবে পুঁজি ও পণ্যের মালিক পুঁজিপতি শ্রেণীই স্বীকৃত ছিল। তারাই ঐ রাষ্ট্রের নাগরিক হিশাবে গণ্য হতেন। তাদেরই সংগঠিত হওয়ার অধিকার ছিল। তাদেরই সংগঠন করার অধিকার ছিল। রাষ্ট্রনীতিতে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হিশাবে তারাই নাগরিক হিশাবে গণ্য হতেন। সেই হিশাবে তাদেরই ভোটাধিকার ছিল। বিপরীতে শ্রমজীবী নারী ও পুরুষ, বুর্জোয়া সমাজের অঙ্গ হলেও তাঁরা ঐ সমাজের নাগরিক হিশাবে গণ্য হতেন না। সমাজে তাঁদের কোনো অধিকার স্বীকৃত হতো না। তাঁদের সংগঠিত হওয়ার কোনো অধিকারও ছিল না। যদিও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রথম জাতীয় মুক্তির আন্দোলন বা ১৭৭৬-১৭৮২ সালব্যাপী আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনায় ‘ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেনডেন্ট’-এ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের নীতিকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিশাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তারপরেও ‘শ্রম পণ্যের’ মালিক হিশাবে শ্রমজীবীদের অধিকার ওই রাষ্ট্রে ছিল না। আমেরিকার নারী সমাজ ১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ সংগঠিত আকারে ও সুনির্দিষ্ট দাবির ভিত্তিতে প্রথম নিউইয়র্কের রাজপথে নামেন। টানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁরাও যে ‘শ্রম পণ্যে’র মালিক এবং তাঁদেরও যে সংগঠিত হওয়ার অধিকার রয়েছে--এই স্বীকৃতিটা অর্জন করেন। তারই ফলশ্রুতিতে তাঁরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার পান। যেটা ছিল আমেরিকান বুর্জোয়া সমাজে শ্রমজীবী নারী সমাজের নাগরিক হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। একইভাবে আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে শ্রমের লিঙ্গভেদ ও মজুরি বৈষম্য নারীকে নাগরিকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে না। ফলে নারীর দিক থেকে শ্রম বৈষম্য উচ্ছেদের লড়াই হলো সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই। এবং এই লড়াইয়ে বিজয় অর্জনের সাথে তাঁর ভোটাধিকারের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট। ফলে সমকাজের সমমজুরির আন্দোলনটি কোনোভাবেই অর্থনীতিবাদী আন্দোলন ছিল না। তার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিক ছিল ও আছে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে নাগরিক হিশাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একই সাথে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিও কোনোভাবেই বিনোদনমুখি অবসরের ব্যাপার ছিল না। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের নাগরিক শ্রমজীবীরা যাতে করে জীবন ধারণের প্রয়োজনে শ্রমে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মে অংশগ্রহণ করতে পারেন, মতামত রাখতে পারেন, জনমত গঠন করতে পারেন, সেই পটভূমির সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ বুর্জোয়া রাষ্ট্রে জনগণের বৃহদাংশ হিশাবে শ্রমজীবী জনগণ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কর্মে যখন অংশগ্রহণ করেন তখনই ওই রাষ্ট্র রাজনৈতিক রাষ্ট্র হিশাবে আবির্ভূত হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। মূলত ৮ই মার্চের তাৎপর্য ছিল ঠিক এখানেই। অর্থাৎ পুঁজির দাপটে শ্রমশক্তির মালিকরা যাতে বিকলাঙ্গ না হয়ে পড়েন, তারা যাতে নাগরিক হয়ে উঠতে পারেন, রাজনৈতিক কর্তাসত্তা হিশাবে আবির্ভূত হতে পারেন, সমাজ যাতে আরো গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, এসব কর্তব্য ধারণ করেই ১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কের নারী শ্রমিকরা রাজপথে নেমে ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক নারীরা ৮ই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকেই স্বাগত জানিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে যা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে দীর্ঘদিন যাবত উপেক্ষা করে আসা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ থেকে ৮ই মার্চকে নারী দিবস হিশাবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও ওই দিবসের মর্মবস্তুকে ধোঁয়াশে করে ফেলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থা আরো খারাপ। আমাদের দেশে উন্নয়ন তরিকার নারী সমাজ, নারী দিবসকে তাদেরই ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হিশাবে গণ্য করেছেন। ফলে শতবর্ষের নারী দিবস উদযাপনে শ্রমজীবী নারী সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলো তাদের আলাপচারিতায় ধরতে গেলে অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে। অথচ কর্মক্ষেত্রে এদেশের শ্রমজীবী নারী সমাজের অবস্থান এবার নারী দিবসের শতবর্ষের কেন্দ্র বিন্দু হতে পারতো। কিন্তু সেটা হয় নি।

তিন.

বাংলাদেশের নারীরা শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছেন বহু পূর্বেই। তবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের চাপে প্রান্তিক নারীরা শ্রমবাজারে উপস্থিত হয়েছিলেন অপরাপর বছরের তুলনায় অধিক। তারপর থেকে শ্রমবাজারে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। এই হতদরিদ্র ও প্রান্তিক নারীদের সংগঠিত করে ১৯৭৮ সালে এদেশে পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে। অর্থাৎ পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৯০ শতাংশই নারী। এবং প্রায় ১৫ লাখ নারী পোশাক শিল্পের কোনো না কোনো শাখায় কর্মরত রয়েছেন।

অন্যদিকে সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আজ শীর্ষ রপ্তানীমুখি খাতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প একটি পরিপক্ব খাত হিশাবে বিবেচিত। তবে তৈরি পোশাকের মধ্যে সোয়েটার এখন সবচেয়ে লাভজনক এবং বর্ধনশীল খাত। আগামী বছরগুলোতে এই খাতের আরো বৃহত্তর বাজার প্রসারের সম্ভাবনা রয়েছে। এর কারণ হলো বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানীকারক দেশ ছিল চীন। অতি স¤প্রতি ওই দেশটি গার্মেন্টস শিল্প খাত ছেড়ে দিয়ে উচ্চপ্রযুক্তি বা হাইটেক শিল্পের দিকে ঝুঁকছে। আর এই সুযোগ পুুরোপুরি কাজে লাগানোর কথা ভাবছে পোশাক শিল্পের মালিকরা। বাংলাদেশ সরকার তাদের পূর্ণ সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এখন আমাদের আলোচনার বিষয় হলো কেমন আছেন এ শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকেরা? আর এই প্রশ্নের জবাব পেতে আমরা একটি নির্দিষ্ট ফ্যাক্টরিকে কেন্দ্র বিন্দু ধরে আলাপচারিতা চালাতে পারি।

‘গরিব এন্ড গরিব’ সোয়েটার ফ্যাক্টরি। গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তার পাশে ভোগড়া এলাকায় এই কারখানাটি অবস্থিত। পাশাপাশি দুটি বিশাল ভবন নিয়ে কারখানাটি গড়ে উঠেছে। ভবনটি ছয়তলা হলেও ছাদের উপরে অবৈধভাবে টিনের বেড়া ও চাল দিয়ে সাততলা বানানো হয়েছে। ভিতরে বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা দেড় হাজার। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় ওই ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে এবং সাততলার ওই অবৈধ স্থাপনার মধ্যে ২১ জন শ্রমিক শ্বাস রুদ্ধ হয়ে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ৬ জন পুরুষ, ১৫ জন নারী ছিলেন। এবং একই পরিবারের দুই সদস্য মা ও মেয়ে রয়েছেন। ওই দিন আরো ৫০ জন শ্রমিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনতলার গ্রিল কেটে ২৫ জনকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এখন আমাদের প্রথম প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কর্মঘণ্টা কতো? সকাল ৮টায় কারখানায় ঢুকে রাত প্রায় ১১টার দিকে যখন কর্মরত শ্রমিকরা আগুনে ঝলসে ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান তখন মালিক পক্ষের ৮ ঘণ্টা জোচ্চুরির গল্প ফাঁস হতে বাধ্য। বাংলাদেশের শ্রমআইন অনুযায়ী পোশাক শিল্পেও দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসটি নির্ধারিত। তবে একজন শ্রমিক অতিরিক্ত মজুরির বিনিময়ে দিনে দুই ঘণ্টা ওভার টাইম করতে পারেন। কেবল শ্রমিক রাজি থাকলে সেটা করানো সম্ভব। দুই ঘণ্টার অধিক ওভারটাইম বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ীই অবৈধ। এখন আমরা যদি বাংলাদেশের শ্রম আইনকেই আলোচনার ভিত্তি ধরি, তাহলে ওভারটাইম সহ ‘গরিব এন্ড গরিব’ কারখানার কর্মরত শ্রমিকদের ছুটি পাওয়ার কথা ছিল সন্ধ্যা ৬ টায়। কিন্তু মালিকপক্ষ কর্মরত শ্রমিকদের আইন অনুযায়ী ছুটি দেন নি। অতিরিক্ত মুনাফা কামানোর ধান্ধায় শ্রমিকদের ওভার টাইমেরও অধিক আরো ৫ ঘণ্টা অবৈধভাবে শ্রমদিতে বাধ্য করে। মালিক পক্ষের এই অতি (কম শ্রমিক নিয়োগ করে বেশি কাজ আদায়) মুনাফার তাড়নার নির্মম বলি হয়েছেন ‘গরিব এন্ড গরিব’ কারখানার ২১ জন শ্রমিক। ফলে মালিক পক্ষ যতোই অস্বীকার করুক না কেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে শ্রমিকের প্রকৃত কর্মদিবস ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা। এবং অবৈধ শ্রমঘণ্টার কর্ম তৎপরতার মধ্য দিয়েই মালিক পক্ষ অধিক মুনাফা কামাই করে। এটাই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সাধারণ চিত্র। যদিও শ্রমআইন অনুযায়ী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের জন্য মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু ৬০ শতাংশ কারখানায় মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে সরকার ও মালিক পক্ষের সমন্বিত এই মজুরি নীতি মানা হয় না। অন্যদিকে ওভার টাইম কাজের জন্য মজুরি হবে মূল মজুরির সাধারণ হারের দ্বিগুণ। অর্থাৎ একঘণ্টা ওভার টাইম কাজের জন্য দুইঘণ্টা কাজের মজুরি পাবে। মজুরিকাল শেষ হওয়ার সাতদিনের মধ্যে মজুরি ও ওভার টাইমের মজুরি পরিশোধ করার কথা শ্রমআইনে লিপীবদ্ধ থাকলেও পোশাক শিল্পের কোনো মালিক সেটা মানেন না। তারা ওভার টাইম কাজের জন্য ১৬৬২ টাকা স্কেলেই ওই মজুরি পরিশোধ করেন। এছাড়া শ্রমআইন অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক পূর্ণ মজুরিতে সপ্তাহে ১ দিন, বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি পাওয়ার কথা থাকলেও সেটা দেওয়া হয় না। এমনকি বছরে ১৪ দিন অসুস্থকেন্দ্রিক ছুটি ও বছরে ১১ দিন উৎসব ছুটি শ্রমিকদের ভোগ করার আইনগতভাবে স্বীকৃতি থাকলেও মালিক পক্ষ তা দেন না।

এবার আসা যাক পোশাক শিল্পে আগুন লাগার বিষয়টিতে। আমরা সবাই কমবেশি অবগত আছি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু। কিন্তু পোশাক শিল্পে আগুন লাগার সূচনা ১৯৯০ সাল থেকে। এবং সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী এ যাবৎ পাঁচশোর অধিক কারখানায় আগুন লেগেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গড়ে ৪১ জন শ্রমিক নিহত হচ্ছেন। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪১৪ জন। আহত শ্রমিকের সংখ্যা ৩ হাজার। প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ঘটনা তদন্ত হয়েছে কিন্তু কোনো তদন্ত রিপোর্টই আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় নি। এবং লক্ষণীয় বিষয় হলো ’৯০ সালের পূর্বে পোশাক শিল্পে আগুন ধরার রেকর্ড নেই। অর্থাৎ এই শিল্প গড়ে ওঠার সময় বা দুর্বলতম সময়ে আগুন লাগার ইতিহাস নেই। পরিপক্বতার সময় ঘটনাগুলো ঘটছে। ফলে এতোদিনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ছিল এটা কি শুধুমাত্র বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট কেন্দ্রিক দুর্ঘটনা, নাকি অন্যকিছু? যেমন তদন্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসন সহ ব্যাংক ও বীমা কোম্পানীর যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কি এটা নতুন এক রাস্তা? যা ইতোপূর্বে আমরা পাট গুদামে আগুন লাগানোর ক্ষেত্রে দেখেছি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজ একদমই প্রশ্নহীন। অর্থাৎ বীমা কোম্পানীর টাকা হাতানোর অনেক পথের মধ্যে আগুন লাগানো একটা নতুন পদ্ধতি হতে পারে।

আমাদের আলোচিত ‘গরিব এন্ড গরিব’ কোম্পানীর পোশাক কারখানায় গত ৫ মাসে আগুন লেগেছে মোট তিনবার। প্রথমবার আগুন নেভাতে গিয়ে ১ জন দমকল বাহিনীর সদস্য মারা যান। দ্বিতীয়বারের আগুনে ৪ জন শ্রমিক নিহত হন। এবং এবার নিহত হয়েছেন ২১ জন। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের লাশ দাফনের জন্য পরিবার প্রতি ১৫ হাজার করে টাকা দেয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিল এবং বিজিএমই’র পক্ষ থেকে পরিবার প্রতি ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। পাঠকের জেনে রাখা ভালো, বাংলাদেশের শ্রমআইন অনুযায়ী যেকোনো পোশাক শিল্প-কারখানা গ্র“প বীমা করতে বাধ্য। গ্রুপ বীমার টাকা পোশাক শিল্পের মালিকরা বছরে নির্দিষ্ট হারে দিয়ে থাকে। ফলে আইন মাফিক ‘গরিব এন্ড গরিব’ কোম্পানীর শ্রমিকরা এমনিতেই পাবে। তারপরও ওই টাকা তোলার অনেক চোরাই রাস্তা রয়েছে। মালিক পক্ষ অনেক সময় বীমা কোম্পানীর কাছ থেকেও ওই টাকা উসুল করে থাকে। আসলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মালিকদের এতোটা উদার ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা কোটি টাকার দাও মারতে কয়েক শ বস্তা জুটের সাথে নারী শ্রমিকদের পুড়িয়ে মারতে দ্বিধা করবে না। অর্থাৎ পোশাক শিল্পে আগুন লাগার বিষয়টি নিছক দুর্ঘটনা নাও হতে পারে। কখনো স্টকলটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, কখনো শিফটমেন্টের ঝামেলা, কখনো ব্যাংকের টাকা লোপাট এবং কখনো বীমার টাকা হাতানোর জন্যই আগুন লাগানো হতে পারে মালিক পক্ষ থেকে। এসব কিছুর তথ্য প্রমাণ গবেষণা অনুসন্ধান করলে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে।

এবার আসা যাক কাজের পরিবেশ সম্পর্কে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের বারংবার মৃত্যু হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করা ও আগুনজনিত কারণে। এবং প্রতিটি দুর্ঘটনার পরপরই মালিক পক্ষ থেকে আশ্বস্থ করা হয়েছে কারখানার মান ও কাজের উন্নত পরিবেশের কথা বলে। কিন্তু ‘গরিব এন্ড গরিব’ কোম্পানীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে পরিস্থিতি একচুল পরিমাণও এদিক ওদিক হয় নি। এই বিশাল ফ্যাক্টরিতে পূর্বে দুইবার আগুন লাগলেও সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা হিশাবে পানির কোনো রিজার্ভ ট্যাংক ছিল না। কারখানায় এই নিজস্ব পানির উৎস না থাকায় দমকল বাহিনী বিপাকে পড়েন। পরে পাশের একটি ওয়াশিং কারখানার ময়লা পানি ব্যবহার করতে হয়। ফলে অভিযান চালাতে অনেকটা বিলম্ব হয়। শ্রমআইন অনুযায়ী কাজ চলাকালে কারখানার গেট বন্ধ রাখা দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এ যাবত যতোগুলো কারখানায় আগুন লেগেছে সব ঘটনার ক্ষেত্রেই আগুন লাগার পরে গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। গরিব এন্ড গরিব কারখানাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না। একইসাথে আগুন লাগার পরপর লাইটগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়। তাছাড়া, কারখানাটিতে আগুন নেভানোর নিজস্ব কোনো যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য ছিল না। আগুন লাগার পর পর কর্মরত শ্রমিকদেরকে সতর্ক করার কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। আগুন লাগার একঘণ্টা পরে কর্মরত শ্রমিকরা বিষয়টি অনুধাবন করেন। কিন্তু সমস্ত গেটে তালা মারা থাকায় তাঁরা বের হতে পারেন নি। আগুনে ঝলসে ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন শ্রমিকরা। পাঠকগণ এবার একটু স্মরণ করুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসী বাহিনীর কথা। নাজি ক্যাম্পগুলোতে বন্দীদের শেষ শ্রমশক্তিটুকু নিংড়ে নেয়ার পর তাদেরকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ ঘরে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে যেভাবে হত্যা করা হতো, আমাদের পোশাক শিল্পের মালিকরা কি তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু করছে? তাদের এই কর্মকাণ্ডকে কি কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলা যাবে? অথচ বাস্তবে ঘটছে সেটাই। অবৈধ স্থাপনায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে নিয়ম বহির্ভূত বাড়তি শ্রম দিতে গিয়ে, তালাবদ্ধ অবস্থায় ঝলসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণকে বরাবর বলা হচ্ছে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। ফলে ঘটনার পরপর নিয়ম মাফিক মামলা হলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এদেশে কোনো নজির নেই। ‘গরিব এন্ড গরিব’ পোশাক কারখানায় আগুন লাগার পর পর জেলা প্রশাসন এবং তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানী কারক সমিতি (বিজিএমই) পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বাহাত্তরঘণ্টার মধ্যে তাদের রিপোর্ট প্রদানের কথা ছিল। কিন্তু তার পূর্বেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বিবৃতি দেন সেটাই মালিক পক্ষের রক্ষাকবচ হিশাবে কাজ করবে। বাসসের বরাতে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। একইসাথে তিনি সব পোশাক শিল্পের মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভবিষ্যতে এ ধরনের ‘দুর্ঘটনা’ এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শ্র্রমআইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, সেই কথা বলা যায় না। তারপরও তাঁর দৃষ্টিতে ওটা নিছকই দুর্ঘটনা।

এ দেশের পোশাক শিল্পে নারীদের মজুরি সবচেয়ে কম। তাঁদের কম মজুরি দিয়ে এইসব দেশীয় মালিক ও বিদেশী কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা কামানোর ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় নীতিতেই কার্যকর করা হয়েছে। এই শিল্পে শ্রমিকদের নিজস্ব ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। তাঁদের চাকরির নিয়োগপত্র নেই। তাঁদের মাতৃকালীন ছুটিভাতা নেই। নিয়মিত মজুরি নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। চিকিৎসা সুবিধা নেই। অথচ বাংলাদেশের শ্রমআইন অনুযায়ী, উপরে উল্লেখিত সমস্ত ক্ষেত্রেই তাঁদের প্রাপ্য দেয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পুরুষের সমান কাজ করেও নারীরা তাদের অর্ধেক বেতন পান। আবার অনেক সময় বেতন বোনাস বাকি রেখে দিনের পর দিন আধাপেট খেয়ে উৎপাদনকে সচল রাখেন। পরিস্থিতি যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, নূন্যতম দাবি নিয়ে তাঁরা যখন রাজপথে নামেন তখন ভদ্রজনের দৃষ্টিতে তাঁদের আন্দোলন হয়ে পড়ে বিদেশীদের ষড়যন্ত্র। আবার তালাবদ্ধ রুমে ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলে বলা হয় দুর্ঘটনা। এবং রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যখন কথাটি বলেন, তখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক পোশাক শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকরা কি প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের নাগরিক? আজকের মে দিবস বা নারী দিবসের শতবর্ষ পালনের সময় এই সব জ্বলন্ত প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে চলছি আমরা। ফলে প্রশ্ন দাঁড়ায় আঠারো শতকে আমেরিকার শ্রমজীবী নারীরা যেসব দাবির ভিত্তিতে রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন। একুশ শতকে বাংলাদেশের শ্রমজীবী নারীরা সেই তুলনায় কতোটা অগ্রসর জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছেন? এই বিচারের ভার প্রতিটি নাগরিক ও দেশের সংগঠক নারী নেতৃত্বের কাছে রইল। এবার অন্য একটি তথ্যের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখার ইতি টানব, ১১ মার্চ, ২০১০ সাল। দৈনিক কালের কণ্ঠে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে, সংবাদে বলা হয়েছে ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেশের সমস্ত পুলিশ ইউনিট কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (গোপনীয়) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান ছয়টি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে গত বুধবার এই নির্র্দেশ দেয়া হয়। প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, রাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার। উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে অভিনন্দন কিন্তু শ্রমবাজারে কর্মরত নারীদের ক্ষেত্রে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে সেটা কিন্তু জানা হলো না। পাশাপাশি বর্তমান বাংলাদেশের নারী নির্যাতনে সবচেয়ে পৈশাচিক ও ভয়ংকর উদাহরণ হলো মালিক কর্তৃক পোশাক শিল্পে কর্মরত নারীদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা। এবং বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশই হলো একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে নির্বিচারে এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ফতোয়া আক্রান্ত গৃহবন্দী নারী মুক্তি হলে তো দুনিয়া উল্টে যাবে না। ইতিহাসের নিয়মানুযায়ী একসময় ওই নারীও শ্রমবাজারে এসে উপস্থিত হবে। যে বাজার ইতোমধ্যে নাজি ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে, ফলে সেটাও পরিষ্কার করার দায়দায়িত্ব উন্নয়ন সংস্থা ও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তারা সেদিকে নজর ফেরাবেন কবে সেটা এই মুহূর্তের জন্য জরুরি প্রশ্ন। তাছাড়া একই দেশে একই শহরে উন্নয়ন সংস্থার সদর দপ্তর ও নাজি ক্যাম্পগুলোর অবস্থান মানবাধিকার কর্মী ও জল্লাদের সহাবস্থান ভীষণ দৃষ্টিকটু লাগে। এটা তামাশাও বটে!


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।