‘তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করে খাদ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব’
তামাক চাষ বন্ধে নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি চাষি ও সংশ্লিষ্টদের নিরুৎসাহিত করতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান উবিনীগ’র উদ্যোগে সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত ‘পরিপ্রেক্ষিত বাজেট ২০১০-২০১১ : তামাক উৎপাদনে খাদ্য ঘাটতির ঝুঁকি ও নীতিনির্ধারণী পর্যালোচনা’ শীর্ষক সভায় আলোচকরা এ মত দেন। জানাচ্ছেন আতাউর রহমান রাইহান
সাবেক তামাক চাষি আমিনুল ইসলাম গায়েন তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, এ দেশে এত উর্বর জমি থাকা সত্ত্বেও খাদ্য ঘাটতি কেন? কারণ তামাক চাষ করা হলে অন্য কোনো ফসল আর সে জমিতে চাষ করা সম্ভব হয় না। তামাক মৌসুমটাই হলো ডাল ও আলু চাষের মৌসুম। আবার ডাল ও আলু চাষের পরের মৌসুমে একই জমিতে ধান চাষ করা যায়। মশুরির জমিতে মিশ্র ফসল চাষ করা যায়। এছাড়া তামাক তো কৃষকের ফসল না। এটা হলো কোম্পানির ফসল। তার মতে, তামাক কৃষকের প্রধান খাদ্যশস্য না, অন্যদিকে একে অন্য কোনো কাজেও ব্যবহার করা যায় না।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ২৭ এপ্রিল বিকালে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শওকত মোমেন শাহজাহান, সভাপতিত্ব করেন নয়াকৃষি আন্দোলনের ফরহাদ মজহার। আলোচকরা বলেন এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে যাতে তামাক উৎপাদনে জড়িতরা ও সেবনকারীরা নিরুৎসাহিত হয়। পাশাপাশি সামাজিকভাবেও তামাক বিরোধী প্রচারণা চালানো জরুরি। সভায় ‘তামাক খাদ্য সংকট সৃষ্টি করছে, অবিলম্বে খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ বন্ধ করা প্রয়োজন’ শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার।
কৃষি-স্বাস্থ্য-পরিবেশের ওপর তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলেন বিশিষ্ট প্রাণী বিজ্ঞানী অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন, কমিউনিস্ট পাটির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদ, আমিন আল রশীদ, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, পরিবেশকর্মী রিয়াজউদ্দিন, আইনজীবী এস এম সৈকত। সাংবাদিক সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, আইন করে আদমজী পাটকল বন্ধ করা গেলে তামাক উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না কেন, তা বুঝে আসে না। এদেশে আইন করে আমরা অনেক কিছু করতে পারি, কিন্তু আমাদের খাদ্য সংকট সৃষ্টিকারী তামাক চাষ বন্ধ করতে পারি না!
প্রধান অতিথি শওকত মোমেন শাহজাহান বলেন, এমন আইন করা যেতে পারে যাতে কোম্পানি ও চাষি নিরুৎসাহিত হয়ে তামাক উৎপাদন কমিয়ে দেয়। তিনি মনে করেন, এসব আইনের কারণে কোম্পানী ও কৃষকরা তামাক উৎপাদনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। যেমন, দু’ফসলী জমিতে তামাক চাষ করা যাবে না। সম্ভাব্য বিধানগুলি কেমন হতে পারে সে বিষয়ে তিনি প্রস্তাব দেন যে, তামাক চাষে ব্যবহৃত সারে ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে। ব্যাংক ঋণ দেয়া যাবে না। কাঠ দিয়ে তামাক পোড়ানো হয়, তাই তামাক পোড়াতে কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো পুরষ্কারে ভূষিত করা যাবে না। যেসব জমিতে তামাক চাষ করা যাবে না, ল্যান্ড ম্যাপ তৈরি করে সেসব চিহ্নিত করতে হবে। সর্বোপরি নদী-জলাশয়ের পাড়ের জমিতে তামাক চাষ নিষিদ্ধ করতে হবে।
কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদীয় কমিটির সভাপতির প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়ে বলেন, এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রবীণ সম্পাদক আতাউস সামাদ তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান যে, উর্বর জমি বেছে বেছে তামাক চাষ করা হয়। যে জমিতে একবার তামাক চাষ করা হয়, সে জমির অন্য ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তিনি মনে করিয়ে দেন যে, যারা বিড়ি কিংবা সিগারেট খান না তারাও তামাক সেবন করছেন নানাভাবে। পানের সাথে বা এমনিতে তামাক পাতা মুখে দিয়ে রাখার কারণে বর্তমানে মুখের ক্যান্সারের হার ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে, তাছাড়া গুলের ব্যবহারও এজন্য দায়ী।
তিনি বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো দাবি করছে যে তারা ভ্যাট দিচ্ছে। কিন্তু ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি সহ অন্যান্য তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানি যে পরিমাণ ভ্যাট দিচ্ছে, তার তুলনায় দেশের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। তামাক চাষের ফলে যেহেতু খাদ্যের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, কাজেই খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর আমদানি খাতে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে।
জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম ধূমপান বিরোধী আন্দোলনে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ধূমপান নিয়ে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাছাড়া সমাজের নানা স্তরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ধূমপান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন, মসজিদের ইমাম সহ ধর্মীয় নেতারা একাজটি করতে পারেন।
সভাপতির বক্তব্যে ফরহাদ মজহার সরকারকে আশ্বাস দেন যে, তামাক চাষ বন্ধে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপে তারা সরকারের পাশে থাকবে।