আলাপচারিতায় হক-কথা সম্পাদক


ভাসানীর পরে ফারাক্কা আর আমরা জাতীয় ইস্যু হিশাবে ধরে রাখতে পারি নাই

সৈয়দ ইরফানুল বারী বর্তমানে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। জাতীয় পর্যায়ে তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তার শুরু স্বাধীনতার পরপরই, মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক সচিব হিশাবে। মওলানা’র প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক হক-কথার সম্পাদক ছিলেন তিনি। মজলুম জননেতার ঘনিষ্ঠ এক সহচর হিশাবে সৈয়দ বারী বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের স্বাক্ষী। ঊনিশশো ছিয়াত্তরের ষোলই মে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা লংমার্চেও তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা হিশাবে কাজ করেছেন। গতকাল পনেরোই মে’তে আমাদের আমন্ত্রণে তিনি চিন্তা’র কার্যালয়ে এসেছিলেন। সৈয়দ ইরফানুল বারীর সাথে আলাপচারিতায় ছিলেন মুসতাইন জহির ও মোহাম্মদ আরজু

সৈয়দ বারী: তিরানব্বই’র থার্টিন নভেম্বরে তো আপনারা চিন্তা’য় মওলানা ভাসানীকে নিয়ে একটা সংখ্যা করছিলেন। এরপর তো আমার আর রেগুলার পড়া হয় নাই। তারপর চিন্তায় আর মওলানা ভাসানীকে নিয়ে কোনো সংখ্যা করছিলেন কি না, বলতে পারবো না . . .

জহির: সেটা ঠিক মওলানা ভাসানীকে নিয়ে ছিল না। পুরো পানি সমস্যা নিয়ে, ফারাক্কা নিয়ে . . .

সৈয়দ বারী: সেটাতে অন্য বিষয় থাকলেও মওলানা ভাসানীর বিষয়টাই প্রাধান্য পেয়েছিল। এমনকি তাঁর আসাম জীবনের ও ওখানের জীবন যাত্রার বিস্তারিত কথা ছিল। এরপর আমার আর মনে পড়ে না যে, আর কোনো একক সংখ্যা দেখেছিলাম।

জহির: না, সেটা ঠিক আছে। আলাদা করে হয়তো সংখ্যা ছিল না, কিন্তু সবসময়ই প্রাসঙ্গিক ইস্যুতে ভাসানীর কথা আসছে, এটা তো আসতে বাধ্য। পানি সমস্যার ইস্যুতে, ফারাক্কা ইস্যুতে।

সৈয়দ বারী: আমি বলবো এটা আমাদের জন্য একটা ট্রাজেডি, যখন মে মাস আসে তখনই এর আলোচনা শুরু হয়। মওলানা ভাসানী এখন থেকে প্রায় চৌত্রিশ বছর আগে এমন একটা বিষয়কে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পৌঁছে দিয়েছিলেন, এর একটা গভীর ও ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো, অথচ এরপর তেত্রিশ চৌত্রিশ বছরে আমাদের তেমন কোনো অর্জন নাই . . .

জহির: আপনার মতো করে আপনি বলে যান। আমরা ফারাক্কা আর লংমার্চকে কেন্দ্র করেই কথা বলবো।

সৈয়দ বারী: ফারাক্কা লংমার্চে মওলানা ভাসানীর জীবন দর্শনেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর জীবনদর্শন একটা শব্দ দিয়ে তিনি প্রকাশ করতেন--রবুবিয়াত। এটা আরবি শব্দ। এর মানে হলো আমাদের রব বা প্রতিপালক সমস্ত জগত-পৃথিবী যেভাবে মানুষকে দান করেছেন, সেটা ঠিক সেভাবে অবিকৃতভাবে-স্বাভাবিকভাবে মানুষের কাছে থাকবে। মানুষকে এর থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সে যেকোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দেশের মানুষই হোক না কেন তার ওপর জুলুম চলবে না, তার স্বাভাবিক অধিকার কেড়ে নেয়া যাবে না। সে--স্রষ্টায় বিশ্বাস না করলেও না--স্রষ্টা এটা চান না। যেমন পানি, সারা বিশ্বের সুপেয় পানির ওপর সবমানুষের স্বাভাবিক অধিকার আছে। প্রবহমান পানির স্বাভাবিক প্রাপ্তির ওপরে যে আঘাত ইনডিয়া থেকে আসলো, সেই সত্তরের দশকে প্রথম ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে। মওলানা ভাসানী লংমার্চ করেছিলেন ঊনিশশো ছিয়াত্তরে, কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তিনিই প্রথম কথা বলেছিলেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠারও আগে। আমি যতদূর জানি, সেটা হলো ঊনিশশো ঊনসত্তর সালের বারোই মার্চ। তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের তোবাতেক সিং-এর কৃষক সম্মেলনে তিনি প্রথম ফারাক্কা বাঁধের বিষয়ে সতর্ক করেন . . .

আরজু: আয়োজনটা ঠিক কারা করছিলো?

সৈয়দ বারী: ন্যাপ তো ছিলই, কৃষক সমিতিও ছিল। ওখানে পশ্চিমপাকিস্তানেও তখন কৃষক আন্দোলনের ভিত্তি মজবুত ছিল।

জহির: পাঞ্জাবের তোবাতেক সিং-এ?

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। লাহোর থেকে দুই কিলোর চেয়েও বেশি দূরে হবে।

জহির: ওই সম্মেলনে উনি নির্দিষ্টভাবে ঠিক কী বলেছিলেন?

সৈয়দ বারী: বলেছিলেন যে, ইনডিয়া যে বাঁধ তৈরি করছে ফারাক্কায় এতে উত্তরবঙ্গে মরুকরণ শুরু হবে। আমার বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও তখনো বাঁধ নির্মাণ শেষ হয় নাই, কিন্তু কারিগরী দিকগুলো এবং সম্ভাব্য বিরুপ প্রভাবের বিষয়ে ওনার ধারণা ছিল। বি.এম. আব্বাস এসব বিষয়ে হুজুরের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। কারিগরী বিষয়গুলো জানাতেন। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চুয়াত্তরে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পরে যখন একচল্লিশ দিন পরীক্ষামূলকভাবে বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়, সেই প্রত্যাহার আর বন্ধ করা হলো না . . .।

আরজু: এইটাতো চুয়াত্তরের চুক্তিতে ছিল না। ওই চুক্তিটায়তো গঙ্গা বা পানি সমস্যা বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসে নাই। কেবল বলা হইছিল যে, গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার বাড়ানোর উপায় খোঁজার ব্যাপারে তারা একমত হইছেন। এরপরে পঁচাত্তরে বাংলাদেশকে তারা জানায় যে, ফিডার খাল দিয়া পরীক্ষামূলকভাবে পানি প্রত্যাহার করবে। বাংলাদেশ রাজি হয়। আর পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করে দেখার নাম করে বাঁধ চালু করে দিল . . .

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। কথা ছিল পরীক্ষামূলক প্রত্যাহারের পরে দুই দেশের হিস্যার পরিমাণ নির্ধারণ করে পরে বাঁধ চালু করার বিষয় দেখা হবে। কিন্তু সেটা হয় নাই। তারপর তো সেই বছরই মুজিবের জীবনের অবসান ঘটলো, তার রেজিমের অবসান ঘটলো। তারপর তো দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, এ বিষয়টি আর সামনে থাকলো না, বাঁধ চলতে থাকলো। তারপর ঊনিশশো ছিয়াত্তরে হুজুর আবার বিষয়টি সামনে আনলেন। ইসলামী ফাউন্ডেশনের মিলনায়তনে ছিয়াত্তরের আঠারোই এপ্রিল হুজুর ঘোষণা দিলেন--বাংলাদেশের মানুষ পানির স্বাভাবিক প্রবাহের দাবিতে ফারাক্কার দিকে লংমার্চ করবে। আঠারো এপ্রিলে তিনি ঘোষণা দিলেন, আর ডেটটা বললেন যে আগামী ষোলোই মে, ষোলোই মে থেকে শুরু হবে . . .। ওখান থেকে তিনি পিজিতে ফিরে আসলেন, কাছের লোকজন, নেতারা বললেন যে, হুজুর এত কম সময়ে কিভাবে শুরু হবে! হুজুর বললেন মানুষ এটা চায়। তারা এটা করবে। প্রস্তুতি নিতে তোমাদের অনেক দিন লাগতে পারে কিন্তু লংমার্চে যারা হাঁটবে সেই মানুষের প্রস্তুতি নিতে সাতদিনও লাগে না। তোমরা না পারলে কোরো না, মানুষ ঠিকই মার্চ করবে। এসব বলে ধামকি দিলেন আরকি! যারা আরো সময় নেয়ার পক্ষে ছিল তাদের ধামকি টামকি দিলেন। আমার নিজেরও মনে ভয় ছিল, এত কম সময়ের প্রস্তুতিতে হবে কি না। মওলানার যারা ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমরা, আমাদের অনেকের চিন্তার আরো কারণ ছিল, হুজুরের এই শেষবয়সে এসে যদি এমন একটা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানের জন্য তো ভালো হবে না। কিন্তু বললাম না, বলার সাহস নাই। কারণ, এই ডেটটা রাখার পক্ষে হুজুর বেপরোয়া ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এগারোই মে’তে এসে বললাম, হুজুর! ডাক্তারদের তো নিষেধ আছে, আপনার অসুখ অনেক, বাইরে যাবেন কিভাবে? দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ডাক্তার নুরুল ইসলাম সাহেব তো এখনো বেঁচে আছেন। উনি তখন তো একেবারে হাতে পায়ে ধরছেন যে হুজুর! এই অবস্থায় আমরা আপনাকে যেতে দিতে পারি না। এটা দশ তারিখ বিকালের কথা। পরের দিন মানে এগারোই মে’তে ডাক্তারের চোখ ফাঁকি দিয়ে, সোজা কথায় পালানো আরকি! পালায়ে চলে গেলেন রাজশাহী। রাজশাহী গিয়া আমাকে বললেন ...

আরজু: আপনি তখন কই ছিলেন?

সৈয়দ বারী: আমি তো হুজুরের সাথে সাথেই . . .

আরজু: রাজশাহী যাওয়ার সময় সাথে আছিলেন?

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। রাজশাহী যাওয়ার পরও আমি চিন্তা করছিলাম যে এত তড়িঘড়ি করা, তারিখ না পেছানোর পেছনে হুজুরের কী পলিসি থাকতে পারে। তখন দেখলাম যে, হুজুর রাজশাহী থেকে তুরস্কের তখনকার প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেলকে টেলিগ্রাম করলেন। ষোলো তারিখেই তুরস্কের ইস্তাম্বুলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শীর্ষ সম্মেলন--ওআইসি’র শীর্ষ সম্মেলন শুরু হবে। ডেমিরেল সম্মেলনে প্রিসাইড করবেন। তিনি তুর্কি প্রেসিডেন্টকে বললেন ফারাক্কা এবং বাংলাদেশের মানুষের এই লংমার্চের বিষয়টি সম্মেলনে আলোচনায় তুলতে। অর্থাৎ হয়তো তারিখ ঠিক করার সময় তিনি এই সম্মেলনের কথা মাথায় রেখেছিলেন . . .

জহির: আর্ন্তজাতিক ফোরামে বিষয়টি তোলার সুযোগ . . .

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। আবার দেখেন এই টেলিগ্রাম তিনি ঢাকা থেকেও করতে পারতেন, বরং আরো সহজ হইতো। কিন্তু আমি বুঝলাম তিনি তাদের এই চিত্র দিচ্ছেন যে, লংমার্চ যেখান থেকে শুরু হচ্ছে সেখানেই মানুষের নেতা আছেন। ফারাক্কা বাঁধের যথাসম্ভব কাছে, যেখানে মানুষ চুড়ান্ত বিক্ষোভের, লংমার্চের জন্য সারাদেশ থেকে জড়ো হচ্ছে। মওলানার বয়স তখন ৯৬, গুরুতরভাবে অসুস্থ, এরপরে আগস্ট মাসেই চরম অসুখে পড়লেন, দেশের বাইরে নিতে হলো; অথচ তখনো তাঁর রাজনৈতিক-কৌশলগত সক্রিয়তা টনটনে। যদিও অনেকের লেখায় দেখি ভিন্ন রকম; এমন লেখার ব্যাখ্যা হতে পারে যে, চুয়াত্তরে মুজিব-ইন্দিরার চুক্তিও হয়েছিল ষোলোই মে’তে। তাঁর প্রতিবাদেও মওলানা এটা করতে পারেন, একই তারিখে। এটা মিলতে পারে, মিলে যেতে . . . কিন্তু সেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল না।

জহির: একটা হলো স্থানীয় ঘটনা আর একটা হলো আর্ন্তজাতিক পরিসরে বা কোনো ফোরামে বিষয়টি তোলার সুযোগ . . .

সৈয়দ বারী: যাই হোউক, তারপর ষোলোই মে প্রথম সমাবেশটা হলো ওই যে মাদ্রাসা ময়দান, ওখানে সমাবেশ হয় সকাল দশটায়। মওলানা ভাসানী সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন।

আরজু: আপনারা পুরা আয়োজনটা ম্যানেজ করলেন কিভাবে? মানে জাতীয় পর্যায়ে কমুনিকেট করা বা তৃণমূলে সংগঠিত করা ইত্যাদি।

সৈয়দ বারী: আয়োজনের ধরনটা . . . এর মধ্যে . . . যেমন মওলানা ভাসানী বারবার প্রেস কনফারেন্স করছেন, প্রেসে বিবৃতি দিচ্ছেন। ও! যেমন আরো বিষয় আছে। আঠারো এপ্রিল ঘোষণা দেয়ার পর আঠাইশে এপ্রিল এইযে পুরান ঢাকার তখন বার লাইব্রেরী ছিল, অ্যাডভোকেটদের যে মিলনায়তন, সেইখানে একটা সভা, মানে ঢাকার বিশিষ্টজনদের সাথে একটা আলোচনা সভা করা হলো। এরকমভাবেই আরকি! সম্ভাব্য সব উপায়ে জাতীয় পর্যায়ে বিষয়টাকে তোলা হলো।

আরজু: লংমার্চে, লোকজন নিয়া আসা- সংগঠিত করা- যোগাযোগ ইত্যাদি . . .

সৈয়দ বারী: ন্যাপের লোকজন ছাড়াও হাজী দানেশের একটা পার্টি ছিল--জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি ইউনিয়ন মানে ‘জাগমুই’, তাদের লোক কম থাকতে পারে কিন্তু খুব সক্রিয় ছিল। তারা কাজ করেছেন। আমি মিছিলে জাসদের একটা অংশকেও দেখেছি। কৃষক সমিতির কর্মীরা, নেতারা তারা তৃণমূলে সবচাইতে বেশি কাজ করেছে। তাদের কাছে মেসেজটা শুধু পৌঁছে গেলেই হতো। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো তখনো বাম ঘরানার অনেকেই এ জাতীয় ইস্যুতে আসতেন। যেমন তোহা ভাইরা, সবে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়েছেন। আগে পরে প্রেস কনফারেন্স ইত্যাদি করেছিলেন। আবদুল হক সাহেবদেরও সমর্থন ছিল। কর্মীদের প্রতি তাদের নির্দেশ ছিল। পত্রিকায় খবর আসছিল নিয়মিত, কমবেশি। তাছাড়া সাংবাদিকদের মধ্যে এনায়েতউল্লাহ খান, সিরাজুল হোসেন খান ওনারা ব্যক্তিগতভাবেও ভূমিকা রেখেছেন।

আরজু: সরকারের তরফে . . .

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। যেমন ধরেন বাংলাদেশ বেতার। বেতারে তো দুইদিন ব্যাপী ধারাবিবরণী দিয়েছিল। এটাতো সরকারের সমর্থন ছাড়া সম্ভব ছিল না। তখন বেতারের হয়ে ফিল্ডে যে কাজ করছিল--রফিকুল আমীন ফেরদৌস, সে আমার ক্লাসমেটও ছিল ইউনিভার্সিটি লাইফে।

আরজু: উনি কি আপনাদের সাথে মিছিলে আছিলেন পুরা সময়?

longmarck................................

ছিয়াত্তরে ইনডিয়ার সরকারের কাছে, আর্ন্তজাতিক মহলে এটা উঠে এসেছিল যে, ফারাক্কা ইস্যু বাংলাদেশের জনগণের ইস্যু। এরপর তো ইনডিয়া দেখেছে যে, এটা আর জনগণের জায়গায়--জাতীয় পরিমণ্ডলের প্রধান ইস্যু হিশাবে বাংলাদেশের কোনো নেতৃত্ব সামনে আনতেছে না। একটা আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার মাত্র।

.................................

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। মিছিলের সাথেই ছিল।

আরজু: বিবরণী কি সরাসরি দিতেছিল?

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। সরাসরি। মনে করেন, বলছিল যে এখন মিছিল এগারো মাইল আসছে, এখন মিছিল প্রেমতলী . . . এমন করে বলছিল আরকি! এইযে বলাটা, এটা কিন্তু তখন মানুষ যারা অংশগ্রহণ করি করি মনোভাবে ছিল তারা কিন্তু তখন যোগ দিয়া দিল। আগের দিন থেকেও বাংলাদেশ বেতার একটা ভালো ভূমিকা রেখেছিল। বলছিলো যে মওলানা ভাসানী লংমার্চে যাচ্ছেন, মওলানা ভাসানী রাজশাহী পৌঁছেছেন . . . এইসব তো বেতার জানাচ্ছিল।

আরজু: এইসব ছাড়া সরকারের তরফে আর কোনো প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিলো প্রোগ্রামে?

সৈয়দ বারী: যেমন ধরেন ওখানকার সরকারি ডিসি অফিস তো কিছু সহযোগিতা করেছিল।

জহির: এর বাইরে আপনার কি এমন কিছু মনেপড়ে যে, তখন লং মার্চের বিরুদ্ধে জাতীয় পর্যায়ে কোনো মত ছিল? যে লংমার্চ করা ঠিক হচ্ছে না--এ জাতীয় কোনো মত?

সৈয়দ বারী: না, আমার মনে পড়ে না। ছিল এটুকুই যে, এতো অল্পসময়ের প্রস্তুতিতে করা ঠিক হবে না। লংমার্চের মতো কর্মসূচী ঠিক হবে না--এরকম কোনো মত ছিল না। তবে ইনডিয়ার সব মহলই এটাকে খারাপভাবে নিয়েছিল। সরকার তো বটেই। ইন্দিরাও ভাসানীকে চিঠি লিখেছিলেন।

জহির: আগে তো মওলানা ভাসানী চিঠি লিখেছিলেন।

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। হুজুরের চিঠির জবাবে লিখেছিলেন ইন্দিরা। কিন্তু ইনডিয়া বরাবরই অন্যায্যভাবে আক্রমণ করে লিখেছিল। যেমন এই ইস্যুতে জাতিসংঘে যাওয়ার পরের ঘটনা; বি.এম আব্বাসের বইতে (ফারাক্কা ব্যারাজ ও বাংলাদেশ, ১৯৮৮ ঢাকা।) দেখবেন রেফারেন্স আছে--বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে ইন্দিরা একদম রেগেমেগে বলেছিলেন, হু! জাতিসংঘে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে? বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর সাথে--রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান তখন প্রতিনিধিদলে ছিলেন, তাঁর সাথে এটা হলো ইনডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কথা বলার ধরন। ধমকি ধামকি আরকি। ইন্দিরা বা কংগ্রেস বরাবরই এমন ভূমিকায় ছিলো। দেখবেন প্রথম পানি-বণ্টন চুক্তিটা যে হতে পারলো, তখন কিন্তু কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিলো না।

আরজু: মোরারজি দেশাইয়ের সরকার ছিলো তখন। ইনডিয়ার ইতিহাসে ওই ক’বছরই মাত্র দেশটা প্রতিবেশিদের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলো।

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। দেশাইয়ের সরকারের কারণেই চুক্তিটা হতে পারলো। এই পাঁচবছর মেয়াদী চুক্তি যখন শেষ হলো তখন অলরেডি ইন্দিরার সরকার আবার ক্ষমতায় আসছে। বিরাশিতে। বাংলাদেশ চাইলো চুক্তি নবায়ন করতে। কিন্তু ইনডিয়া রাজি হলো না। চুক্তির চাইতে অনেক কম মর্যাদার মউ করলো, সমঝোতা স্মারক। তাও দুই বছরের জন্য। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দেয়া হলো। ছিয়ানব্বই পরের আওয়ামী লীগ আমলে যখন আবার পানি-বণ্টন চুক্তি হলো তখনো কিন্তু শেখ হাসিনা আর আইনুন নিশাত গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়াই রাজি হলেন। গ্যারান্টি ক্লজের সুবিধা হলো- প্রাকৃতিক কারণ বা অন্য কোনো কারণে গঙ্গার ফারাক্কার ওপারে পানি প্রবাহ কম থাকলেও বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য পরিমাণের কমপক্ষে আশি শতাংশ দিতে হবে। এখন তো আর সেটা নাই।

আরজু: তাইলে এমনকি ইন্দিরার আমলেও কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের বক্তব্য গুরুত্বের সাথে নেয় নাই? না কি বাংলাদেশ ঠিকঠাক কইরা বলতে পারে নাই?

সৈয়দ বারী: গুরুত্ব দিবো কি? বলতে পারেন এটা একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ইনডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মনে হয় এমন ব্যাপারই তো। আর বাংলাদেশের জন্য আরো দুঃখজনক ব্যাপার, মওলানা ভাসানীর পরে আমরা এটাকে আর জাতীয় ইস্যু হিশাবে আনতে পারি নাই।

জহির: বিরাশিতে যখন বাংলাদেশ নবায়ন করতে চাইলো, তখন সরকার ঠিক কতটুকু জোরালো অবস্থান নিয়েছিলো? এ বিষয়ে জনমত তৈরি করতে সমাজের নানা অংশ তখন কী অবস্থান নিয়েছিল বাংলাদেশে?

সৈয়দ বারী: আসলে কী ঘটেছিলো দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সে বিষয়ে এই প্রশ্ন আমিও করেছিলাম একজনকে--খুরশীদা বেগম। ওনাকে নাইন্টি ফোরে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বলছিলেন--কোথায় ভারতের একটা গণতান্ত্রিক সরকার আর কোথায় একটা মিলিটারি সরকার! মানে উনি বুঝাতে চাইছিলেন যে . . .

জহির: কিন্তু ছিয়াত্তর সালেও তো মিলিটারি সরকার ছিলো বাংলাদেশে। অথচ সেই সময়েও একটা জনআন্দোলন জাতীয় ইস্যু সফলভাবে হয়েছিল। সরকার সফলভাবে সেটাকে জায়গা দিতে পেরেছিলো ইনডিয়ার সাথে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যেও।

সৈয়দ বারী: ছিয়াত্তর সালে মিলিটারি গভর্নমেন্ট হলেও মওলানা ভাসানীর করা আন্দোলনে প্রস্তুত একটা জনমত কিন্তু তাঁর ছিলো।

আরজু: মওলানার এই আন্দোলন কিন্তু ছিয়াত্তরের সরকারকে হেল্প করছে . . .

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। হেল্প করেছে। ছিয়াত্তরে ইনডিয়ার সরকারের কাছে, আর্ন্তজাতিক মহলে এটা উঠে এসেছিল যে, ফারাক্কা ইস্যু বাংলাদেশের জনগণের ইস্যু। এরপর তো ইনডিয়া দেখেছে যে, এটা আর জনগণের জায়গায়--জাতীয় পরিমণ্ডলের প্রধান ইস্যু হিশাবে বাংলাদেশের কোনো নেতৃত্ব সামনে আনতেছে না। একটা আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার মাত্র।

আরজু: আচ্ছা, রাজশাহী থেকে আপনারা লংমার্চ শুরু করার পর ইনডিয়া কি যোগাযোগ করেছিলো?

সৈয়দ বারী: না। চৌঠা মে’র পরে আর কোনো যোগাযোগ করে নাই। তখন ইন্দিরা বলছিলেন যে, আপনি যদি চান তবে ইনডিয়ার হাইকমিশনার আপনার সাথে যোগাযোগ করবে।

আরজু: মওলানা তো রাজি হন নাই।

সৈয়দ বারী: না। হুজুর রাজি হন নাই। তিনি তো নেতা, কর্মীরা আর জনগণ কিন্তু স্থির করে ফেলেছিলো বর্ডার ক্রস করার, কিন্তু হুজুর জানতেন কর্মীদের কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। আমরা সবাই চাপাইনবাবগঞ্জ গিয়েও জানি যে, আমরা মনাকষা যাচ্ছি। বর্ডারের কাছে। এতো কাছে যে, খুব সহজেই ওখান থেকে বর্ডার ক্রস করা যায়। ওখানে তখন ইনডিয়ার আর্মি একদম গানপয়েন্টে। কিন্তু হয়তো এসব চিন্তা করেই হুজুর সিদ্ধান্ত বদলালেন। চাপাই থেকে শিবগঞ্জ গিয়ে ওখানে দুই দিকে দুটা রাস্তা। একটা মনকষার দিকে আরেকটা কানসাটের দিকে। শিবগঞ্জে গিয়ে হুজুর বললেন যে আমরা কানসাট যাবো।

জহির: তখন কেউ কিছু বলে নাই? দ্বিমত করে নাই?

সৈয়দ বারী: না, হুজুর বলছে তো এর বাইরে আর কথা কি! কানসাটে যেতে হয়েছে আমাদের একটা নদী পার হয়ে, নদীটার নাম হলো পাগলা। এতো খরস্রোতা ছিল নদীটা যে নাম হয়েছিলো ‘পাগলা’। অথচ বাঁধ নির্মাণে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করায় তখনই ওই নদীতে পানি ছিলো না। তার পারেই একটা হাইস্কুল, স্কুলের মাঠ, নদীর পাড় মিলাইয়া মানুষ আর মানুষ . . .

জহির: কত মানুষ হতে পারে?

সৈয়দ বারী: লক্ষাধিক বলতে পারেন। তো, ওখানে তো স্টেজ নাই। সব তো ছিল মনাকষায়। তারপর স্কুলের ছাদের ওপর ওঠানো হলো মওলানা ভাসানীকে। দুইজনের কাঁধে ভর দিয়ে। মওলানার শারীরিক অসুস্থতা তখন খুব চরমে। শরীরের অবস্থা এত খারাপ যে, এমনকি তিনি প্রস্রাবের স্বাভাবিক বেগও ধরে রাখতে পারছিলেন না। তারপরও তিনি সমাপনী বক্তৃতা করলেন।

জহির: কানসাটের ওদিকে বর্ডারে আর্মি ছিল?

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ, ইনডিয়ার প্রস্তুতি ছিল। বিএসএফ’কে তারা যথেষ্ঠ মনে করে নাই। আর্মির চলাচল ছিল।

জহির: ফেরার সময় কেমন ছিলো? মানুষের মনোভাব . . .

সৈয়দ বারী: হুজুর তো বক্তৃতায় বলছেন ইনডিয়াকে উদ্দেশ্য করে যে, আমরা আর্ন্তজাতিক আইনের মধ্য থেকেই আমাদের কথা বলেছি। বর্ডারে যাই নাই। ইনডিয়ার মানুষের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নাই। কিন্তু আমাদের পানির হক থেকে বঞ্চিত করার চিন্তা বাদ না দিলে আমরা সেটা হতে দেবো না। তো, আসা যাওয়ার পথে মানুষ আমাদের জন্য অনেক করেছে। খাবার নিয়ে পানি নিয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন আম ছিল গাছে, পাকে নাই, কাঁচা, মালিকেরা বলছে ইচ্ছামতো খাওয়ার জন্য। তবে ফিরবার সময় বৃষ্টিতে বেশ কষ্ট হয়েছিলো।

জহির: ফিরে আসার পর জাতীয় পর্যায়ে মতামত বা প্রতিক্রিয়া কেমন ছিলো?

সৈয়দ বারী: সেটা এখনো পুরানো পত্র-পত্রিকা দেখলে বুঝতে পারবেন। ছিলো, মানুষের আলোচনায়, মতামতে ছিল। চুক্তির আগে পর্যন্ত আমাদের জন্য সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিলো। মে মাসের সতেরো তারিখ গেলো, আঠারো তারিখ হুজুরকে নিয়া সন্তোষে ফিরে আসলাম। তারপর আঠারো তারিখের পর, একুশে মে তখন যিনি শিক্ষা উপদেষ্টা--তিনি হলেন প্রফেসর আবুল ফজল--ওইযে চিটাগাং ইউনিভার্সিটির, আবুল মোমেন সাহেবের ফাদার, এই আবুল ফজল গেলেন হুজুরের সাথে সাক্ষাত করতে টাঙ্গাইলে, মানে সন্তোষে, জিয়াউর রহমান মানে গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে। ফজল সাহেব হুজুরকে বললেন যে, হুজুর আপনি বলেন- কিভাবে এটাকে আরো আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়া যাওয়া যায়। আপনার বলাটাই আমি গভর্নমেন্টকে সাবমিট করবো। হুজুর তাকে বলেছিলেন, আমাদের যে অ্যাম্বাসিগুলা আছে বিভিন্ন দেশে--সেইসব অ্যাম্বাসেডরদের নির্দেশ দিতে-- সবাই যাতে নিজের দায়িত্বরত দেশে যেভাবে যেধরনের পারেন ফারাক্কা ও পানি সমস্যা বিষয়ে নানা ফোরাম তৈরি করেন। অক্টোবর মাসে হুজুর আমাকে নির্দেশ দিলেন, শুধু ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে হক-কথা’র একটা বিশেষ সাপ্লিমেন্ট করতে। এবং ওই সাপ্লিমেন্টটার একটা ইংরেজি সংস্করণও করতে হবে, তখন তো হক-কথা বাংলাতেই বেরুতো। ট্যাবলয়েড সাইজে রেগুলার ষোলো পৃষ্ঠা বেরুতো। ওই সময় হুজুর বললেন যে সাপ্লিমেন্টটা হবে বত্রিশ পৃষ্ঠার, এবং সেটা বাংলাদেশের সব অ্যাম্বাসি ও দেশের বাইরে বাংলাদেশি অ্যাম্বাসিগুলাতে পাঠাতে হবে। এমনিতে তো আমাদের রেগুলার সংখ্যা ছাপা হইতো এক লক্ষের উপরে, কখনো কখনো এক লক্ষ বিশের মতো, কিন্তু দেড় লক্ষ কপি ছাপা হয়েছিল ওই সাপ্লিমেন্টটার। আবুল ফজল সাহেবের কাছে, মানে গভর্নমেন্টকেই বিশ হাজারের মতো কপি পাঠানো হইছিল, অ্যাম্বাসি ও বাইরের দেশে দেয়ার জন্য। তখনো বাংলাদেশ সরকারের তরফে এই নিয়া কোনো প্রকাশনা ছিলো না। তারপরে জাতিসংঘে যিনি তখন স্থায়ী প্রতিনিধি তাকেও হুজুর গভর্নমেন্টের মাধ্যমে দিকনির্দেশনা দিলেন যে কী করতে হবে।

জহির: তখনকার সরকার প্রধানের সাথে . . .

সৈয়দ বারী : ও! ও! ভালো ব্যাপার মনে পড়ছে। একুশে মে লংমার্চ বিষয়ে গভর্নমেন্টের হয়ে ফজল সাহেব দেখা করলেন হুজুরের সাথে। তারপরই, আটাইশে মে হুজুর একটা প্রেস কনফারেন্স করলেন, প্রচুর বিদেশী সাংবাদিক উপস্থিত ছিল। বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমের দিল্লী, সিংগাপুর আর হংকং বেসড সাংবাদিকরা। নিউজউইকের টোকিও ব্যুরো চীফ আসছিলো। দেশে আর দেশের বাইরে নানা পেশার বাংলাদেশিরা সাহায্য করেছিলো যথাসম্ভব বেশি করে যাতে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিষয়টি ওঠে। যতটা না হুজুরের প্রতি ভালোবাসা সম্মান থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নে। তারপর আগস্ট মাসের স্যাকেন্ড উইকে কলম্বোতে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন ছিল। এর আগে জিয়াউর রহমান পিজিতে গিয়ে হুজুরের সাথে দেখা করলেন। হুজুর বললেন, সম্মেলনে সায়েম যাইতেছে না তো? তুমি যাইতেছো তো? জিয়া জানালেন, হ্যাঁ। (সেখান থেকে আমি বুঝলাম যে, রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন হলেও ওটা হুজুরেরই পরামর্শেই জিয়া ওখানে যোগদান করতে যাচ্ছেন)। হুজুর সেদিন বলছিলেন, আমি তো চলে যাচ্ছি--আমার তো সময় নাই, আমি তো থাকবো না--তোমরা যদি জাতীয় চেতনা ধরে রাখতে না পারো তাইলে কিন্তু টিকে থাকতে পারবা না। তোমাদেরই এখন দায়িত্ব নিতে হবে। এই সাক্ষাতটা আগস্টের সাত কি আট তারিখের কথা হবে। তেরই আগস্ট রাত্রিতে তো হুজুর চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলেন।

জহির: লন্ডনে যাওয়ার পর ফারাক্কা ইস্যুতে আর কোনো ভূমিকা ছিল ওনার?

সৈয়দ বারী: তাতো থাকবেই। ওখানে হুজুরকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয় সেখানেও উনি ফারাক্কার বিষয়ে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন। ফারাক্কা আমাদের জীবন মরণ সমস্যা। তাহলে দেখেন, হুজুর প্রথমত দেশের জনমত ফারাক্কা ইস্যুতে নিয়া আসলেন, লংমার্চ হইলো, আবার ইস্তাম্বুলের ওইআইসি সম্মেলন--কলম্বোর জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন এইসব কাজে লাগালেন বাংলাদেশের পক্ষে। তারপর তো জাতিসংঘে ফারাক্কা ইস্যু তোলা হলো। আন্তর্জাতিক চাপ ছিল ইনডিয়ার ওপর। পাশাপাশি ইতোমধ্যে ইনডিয়ায় কংগ্রেস সরকার বিদায় নিলো, মোররাজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় চুক্তিটা হলো, বাংলাদেশের জন্য উপকারী চুক্তি।

জহির: সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর তো ইনডিয়া ইচ্ছামতো পানি প্রত্যাহার করেছে। গত আওয়ামী লীগ আমলে যে চুক্তি হয়--সেটাতে গ্যারান্টি ক্লজ না থাকার ফলে কোনো কাজে আসছে না। পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে তো গত বিশবছরেও মানুষের জীবনের সাথে অস্তিত্বের সাথে জড়িত এইসব ইস্যু প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে নাই। জাতীয় ঐক্যের মধ্যে তো আসে নাই।

সৈয়দ বারী: জাতীয় রাজনীতিতে মনে হয় ফারাক্কার মতো ইস্যু বিএনপি’র ইস্যু, আওয়ামী লীগের না . . .

জহির: কোথায়? বিএনপি তো তার রাজনীতির মধ্যে এটাকে প্রাধান্য দেয় নাই . . .

সৈয়দ বারী: হ্যাঁ। বিএনপিও সেটা তার শুধু ভোটের রাজনীতির ইস্যু করে রাখছে।

জহির: কিন্তু সেটাও কি গত অন্তত দুটো নির্বাচনে ছিল?

সৈয়দ বারী: তাতেও তার তেমন কিছু নাই যে তারা কিছু করবে বলে ধরা যায়। গত ইশতেহারেও তারা উল্লেখ করে নাই। একানব্বই-ছিয়ানব্বই আমলে তিরানব্বই-চুরানব্বই সনে শুধু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছিল। ইনডিয়ার সাথে আলোচনা, জাতিসংঘে নিয়ে যাওয়ার কাজ হয়েছিল। তাদের লাস্ট গভর্নমেন্ট যেটা গেল, সর্বশেষ দুই হাজার একের নির্বাচনে জেতার পর তো এ নিয়া কিছুই করে নাই তারা। হাফিজ সাহেব বিএনপি করেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কই? ওনারা যখন ক্ষমতায় যান তখন বলেন--বারী ভাই! ময়দানে এক রকম আর চেয়ারে বসলে আরেক রকম বিষয় . . .

জহির: মানে চেয়ারে বসলে আর রাষ্ট্রের চিন্তা করার সময় থাকে না!

সৈয়দ বারী: আমাদের জাতীয় ইস্যুতে, জাতীয় চেতনার বিকাশে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের অভাব। সংকীর্ণতা ও দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আটকা পড়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার আগেও তো হুজুর স্বাধীনতার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। আর শেষ দায়িত্ব দিয়েছেন শেখ মুজিবকে। বলেছিলেন শেখ মুজিব আমার ছেলের মতো। মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকলে হাসিনাকে বলতেন--দেখো তোমার সাথে ইনডিয়ার খাতির আছে, তুমি এটার একটা সমাধান করো।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।