বর্ণ, নারীবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ: সুনেরা থোবানির বক্তৃতা


গত ৮ জানুয়ারি শুক্রবার ‘চিন্তা পাঠচক্র’ ও ‘নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা’র উদ্যোগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে “ফেমিনিজম এন্ড কনটেমপোরারি গ্লোবাল পলিটিক্স” বিষয়ক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্সটিটিউট ফর জেন্ডার, রেইস, সেক্সুয়ালিটি এন্ড সোশ্যাল জাস্টিস’-এর সহযোগী অধ্যাপক ড. সুনেরা থোবানি। রেইস বা বর্ণবাদকে ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিশ্লেষণের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে হিসাবে হাজির করে সুনেরা থোবানি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে নতুন ভাবে বোঝা ও নতুন রাজনীতি পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলনে তাঁর সুখ্যাতিও সেই কারনে।

সুনেরা থোবানি কানাডার নাগরিক, বাস ভ্যাঙ্কুভারে। কানাডার সর্ববৃহৎ ফেমিনিস্ট সংগঠন “ন্যাশনাল অ্যাকশন কমিটি অন স্ট্যাটাস অফ উইমেন (এনএসি)” এর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত।

সুনেরা থোবানি তাঁর আলোচনায় মালটিকালচারালিজম, অভিবাসী ও আদিবাসী সঙ্কট, বিশ্বজোড়া মুসলিম প্রধান দেশসমূহে যুদ্ধ, জেন্ডার ভায়োলেন্স ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। ফেমিনিজম যে মূলধারার হাতে গড়ে উঠেছে সেই ফেমিনিজমে যে হোয়াইট উইমেন বা সাদা বর্ণের নারীরা বাদে তেমন আর কারও অংশগ্রহণ বা অন্যদের গণনা নেই সে ব্যাপারে তিনি আলোকপাত করেছেন। সে কারণে বর্ণবাদকে আড়ালে রেখে ফেমিনিজমের চরিত্র বোঝা যাবে না।

তিনি বলেন, নাইন ইলেভেনের পরে মূলধারার ফেমিনিজমে বড় ধরণের পরিবর্তন আসে। বুশ প্রশাসনের হাত ধরে নাইন ইলেভেন পরবর্তী সময়ে যে ওয়ার অন টেরর প্রকল্প চালু হয় তার পরিধি থেকে বাদ যায়নি আক্রান্ত দেশসমূহের নারী ও শিশুরাও। আর এক্ষেত্রে মূলধারার ফেমিনিজম আক্রান্ত দেশসমূহের নারীদের পক্ষে দাঁড়াতে তো ব্যর্থ হয়েছেই বরং ওয়ার অন টেরর প্রকল্পের হাতিয়ার রূপে উপস্থিত হয়েছে। এই প্রকল্পে তার দেশ কানাডাও অংশীদারি হয়েছিল।

তিনি একে তুলনা করেন কলোনি বিস্তারের সাথে। কলোনি বিস্তারেও ঠিক একইভাবে অ-ইউরোপীয়দের সভ্য করতে হবে এমন বয়ান দিয়েই ইউরোপ সারা বিশ্বে কলোনি বিস্তার করেছিল। ঠিক একইভাবে এখন মুসলিমপ্রধান দেশসমূহের নারীদের “নির্যাতিত” আখ্যা দিয়ে তাদের উদ্ধারের কথা বলেই ওয়ার অন টেরর প্রকল্প চালু আছে। এ ছাড়াও তিনি বলেন এখন আর এই বিদ্বেষ শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। আমেরিকা ও কানাডায় হিন্দু ও শিখরাও এখন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের স্বীকার হচ্ছেন। শুধু মুসলিম নারীরাই নন, পশ্চিমের নারীরাও নিজ দেশেই জেন্ডার ভায়লেন্সের স্বীকার হচ্ছেন বলে তিনি দাবী করেন। মোটা দাগে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে পশ্চিমের ফেমিনিজম ওয়ার অন টেরর প্রকল্পের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ও নিজেকে বর্ণ বৈষম্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে।

বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে বিরুদ্ধে যে কোন সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনকে অবশ্যই বর্ণ ও বর্ণ বৈষম্যের প্রশ্নকে আলোচনাকে কেন্দ্রে আনতে হবে। সেই দিক থেকে ইসলামের প্রতি আতংক ও ইসলাম বিদ্বেষ মূলত বর্ণবাদী ইতিহাস ও চিন্তারই প্রকাশ মাত্র – সুনেরা থোবানি এই দিকটির প্রতি বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছেন এবং নারী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। নারীকে তার মর্যাদার জন্য অবশ্যই লড়তে হবে, কিন্তু যারা নারীর অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়ছেন তাঁদের সতর্ক থাকতে হবে যেন তাঁরা ‘নারী’কে এমন কোন ক্যাটাগরি না করে তোলেন যা ইসলামের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। একালে এটাই নারীবাদের প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ। ইসলাম সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নে নারীবাদকে অবশ্যই অংশগ্রহণ করতে হবে, কিন্তু সেটা পাশ্চাত্যের ইসলাম বিদ্বেষী চিন্তার অধীনে থেকে নয়। বর্ণ ও বর্ণ বৈষম্যের প্রশ্নকে ইতিহাস বিচারের কেন্দ্রে আনবার মধ্য দিয়েই আমরা বুঝব ইসলামের প্রতি আতংক ও ইসলাম বিদ্বেষ মূলত বর্ণবাদী চিন্তা ও রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা মাত্র। নিজের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে নারীকে তাই নতুন ভাবে চিন্তা করতে শিখতে হবে। তাঁর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ও বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখে। নতুন ভাবে চিন্তা করবার তাগিদ দিয়ে ঢাকাকে সুনেরা থোবানি কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেন।

সুনেরা থোবানির মূল বক্তব্যের শেষে তিনি দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।

দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারী প্রশ্নে অন্তরঙ্গ সহযোদ্ধা হিসাবে সুনেরা থোবানিকে পরিচয় করিয়ে দেন নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার প্রধান উদ্যোক্তা ও নারীনেত্রী ফরিদা আখতার। চিন্তা পাঠচক্রের পক্ষ থেকে সঞ্চালনের দায়িত্ব পালন করেন মুসতাইন জহির।

পুরো অনুষ্ঠানের বক্তব্য বাংলা ও ইংরেজিতে অচিরেই চিন্তার ওয়েবপাতায় পাঠকেরা পাবেন।

 

 

 

 


৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।