টাঙ্গাইলে  নয়াকৃষির ধান মেলা


ধানের বৈচিত্র রক্ষা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম

উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলনের আয়োজনে দুই থেকে চার ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের রিদয়পুর বিদ্যাঘরে ধান মেলা ও কৃষক সমাবেশ চলছে। মেলায় বিভিন্ন এলাকার নয়াকৃষির কৃষকদের সংগৃহীত ধানের বীজের প্রদর্শনী চলবে। প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত এ মেলা চলবে। এসবের পাশাপাশি ডিসেম্বরের তিন তারিখে বিশ্ব কীটনাশক বন্ধ দিবস উপলক্ষে সকাল নয়টায় মিছিল হবে। চার ডিসেম্বর হবে কৃষকদের শপথ অনুষ্ঠান। এছাড়া প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে একটা পর্যন্ত ও বিকাল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত দুটি অধিবেশনে কৃষক, গবেষক এবং কৃষিবিজ্ঞানীদের উপস্থিতিতে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনার বিষয় হল ‘ধানের বৈচিত্র্য রক্ষার উদ্যোগ’, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় স্থানীয় জাতের ধান, ধানের বৈচিত্র্য রক্ষায় কীটনাশকের হুমকি-প্রভাব ও ফলাফল, ধানের বীজ রক্ষার কাজে নারীর অবদান। এছাড়া আরও কিছু সম্পূরক আলোচনা হবে। যেমন, খাদ্য সার্বভৌমত্ব, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় নারীর অবদান, পানির অধিকার ইত্যাদি। এই সব আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ‘খাদ্যে সার্বভৌমত্ব নেটওয়ার্ক, ‘নারী ও প্রাণবৈচিত্র্য নেটওয়ার্ক’, ‘বাংলাদেশ পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক’-এর সদস্যরা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নবপ্রাণ ও নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের আয়োজনে বাংলার ভাবগান সহ কৃষকদের গান ও আনন্দের আয়োজন করা হয়েছে।

বীজমেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে নয়াকৃষি আন্দোলনের পরামর্শক ড. এম এ সোবহানের কাছে জানতে চাইলে তিনি চিন্তাকে জানান, প্রথমত দেশীয় জাতের বীজ রক্ষা, সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদন আমাদের সকলেরই কর্তব্য। দ্বিতীয়ত আমরা সরকার ও দেশের মানুষকে জানাতে চাই স্থানীয় জাতের ধানই একমাত্র খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে পারে। কোম্পানিগুলো খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলে। কিন্তু এই নিরাপত্তার জন্য আমরা কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। বরং তার বিপরীতে খাদ্য সার্বভৌমত্ব বলতে বোঝায় আমরা কি খাব আর কি উৎপাদন করব তার সিদ্ধান্ত নেবে কৃষকদের নেতৃত্বে বাংলাদেশেরই জনগণ। বীজ কৃষকদের হাতে থাকবে, আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাও অক্ষুণœ থাকবে। অন্যদিকে দেশীয় ধানের জাত যে উচ্চ ফলন দিতে পারে কোম্পানিগুলো আমাদের তা ভুলিয়ে দিতে চায়। আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি ধানের বৈচিত্র্য রক্ষা করেই আমরা যেমন পরিবেশ রক্ষা করতে পারব, তেমনি খাদ্যের উৎপাদনও বাড়াতে পারব।

কৃষি সংস্কৃতির বিপরীতে কৃষি কারখানা

বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই বা সংক্ষেপে বিরি) যে সকল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে সেগুলাকে উচ্চফলনশীল ধান বলা হয়। সংক্ষেপে, উফশী ধান। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পনের হাজারের মত ধান বাংলাদেশের কৃষকরা সেই আদিকাল থেকে চাষ করছে। এরপর কৃষকরা স্থানীয় জাতের ধান চাষ না করে সরকারের উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় উফশী জাতের ধান চাষ শুরু করে। এভাবে একসময় কৃষকদের কাছ থেকে বেহাত হয়ে যায় নিজস্ব শস্যবীজ। এখন এসব বীজের মালিক অল্প কয়েকটা কোম্পানি। নয়াকৃষি আন্দোলনের কর্মী রবিউল ইসলাম চুন্নু এই প্রতিবেদককে জানান, তিন-চার বছর ধরে কৃষকরা ধানের একটা জাত আবাদ না করলে তা হারিয়ে যায়। এতে কৃষকদের বীজ গিয়ে জমা হয় জিনব্যাংক বা বীজাগারের মাধ্যমে কোম্পানির কাছে। তাই কৃষকরা এখন কোম্পানির কাছে জিম্মি। বিজ্ঞানীরা একটি জাতের ধানের সাথে এক বা একাধিক জাতের মিলন বা সংকরায়ন করে উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদন করে। প্রথম উচ্চফলনশীল ধান তৈরি করে ইরি বা আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ((International Rice Research Institute)) উনিশশ ছিয়ানব্বই সালে। উনিশশ ছিষট্টি সালকে বিরি আন্তর্জাতিক ধান বছর ঘোষণা করেছিল। ইরি প্রধানত উফশী ধানের বিস্তারের জন্যই এ উদ্যোগ নিয়েছিল।

শুধু তাই নয় ফসলের বৈচিত্র্যও পরিবর্তন হয়ে গেছে। যেখানে স্থানীয় জাতের ধান প্রকৃতির সকল বৈরিতা সইতে পারত। কিন্তু উফশী জাতের ধান প্রকৃতি মোকাবেলায় সব সময়ই হার মেনেছে। উফশী ধান চাষ করতে রাসায়নিক সার, বিষ, মাটির নিচের পানির সেচ লাগে। কোম্পানিগুলাও এই সুযোগে যাচ্ছেতাইভাবে কৃষকদের সাথে সার, বীজ, পানি বেচার ব্যবসা করে।

উফশী ধান চাষ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়

সেই ষাটের দশক থেকে পৃথিবীতে একটা খাদ্য নিরাপত্তার রাজনীতি চলছে। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলার পক্ষ থেকে বলা হয়, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা পেতে হলে উচ্চফলনশীল জাতের ধান চাষ করতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত এসে দেখা গেল উফশী ধান চাষ করে মানুষ খাদ্যে নিরাপত্তা পায় নাই। বিপরীতে মানুষ ব্যাপকভাবে খাদ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। উফশী জাতের ধান চাষ করতে গিয়ে যে সার, বীজ, কীট নাশক ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে একদিকে মাটির উর্বরতা কমে গেছে, অপরদিকে শত্রু পোকা মারতে গিয়ে বন্ধুপোকাও মারা গেছে। তাই গাছের পরাগায়নে মধুপোকা বা প্রজাপতি এখন আর ফসলের মাঠে দেখা যায় না। তাছাড়া মানুষ একবার জমি চাষ করে তিনচারটি ফসল তুলত। ধান পাকলে মাসকলাই মাঠে থাকত, আবার তিল চাষও করা হত। এতে জমির উর্বরতা কমত না, মাটির ক্ষয়ও রোধ হত। কিন্তু একই জমিতে পরপর ধান চাষ করায় প্রতিবারের জন্য নতুন করে জমি চাষ করতে হচ্ছে। তাতে মাটির ক্ষয় হচ্ছে যেমনি, তেমনি কমে যাচ্ছে উর্বরতা। এছাড়া ফসলের মাঠ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজি পেত কৃষকরা। কিন্তু নানা ধরনের কীটনাশক ও আগাছানাশক ওষুধ দেয়ায় আগাছার সাথে সাথে কুড়িয়ে পাওয়া শাকসবজিও মরে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল উফশী চাষ করে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা বলা হলেও তা সম্ভব হয় না।

বীজসম্পদশালাতে দেশীজাতের বীজ

নয়া কৃষি আন্দোলনের বীজ সম্পদশালায় স্থানীয় জাতের দুই হাজার তিনশ উনপঞ্চাশটা স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহে আছে। নয়া কৃষি বীজ সম্পদশালা প্রতিষ্ঠা করা হয় উনিশশ আটানব্বই সালে। তখন ভয়াবহ বন্যায় কৃষকরা বীজ সংকটে পড়েছিল। এ বিষয়ে নয়া কৃষি আন্দোলনের পরামর্শক ড. এম. এ সোবহান প্রতিবেদককে জানান, কৃষকরা মারাত্মকভাবে বীজ সংকটে পড়লে এই বীজ সম্পদশালা প্রতিষ্ঠা করেন তারা। অঞ্চলভেদে বীজের বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখেই নয়া কৃষি আন্দোলনের বীজ সম্পদশালা গড়ে উঠেছে। যেমন বন্যাপ্রবণ সমতল এলাকার জন্য বীজসম্পদশালা গড়ে উঠেছে টাঙ্গাইলের রিদয়পুর বিদ্যাঘরে। খরা এলাকার জন্য ঈশ্বরদী আরশিনগর বিদ্যাঘরে এবং উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকার জন্য কক্সবাজার পদ্মাবতী বিদ্যাঘরে। ড. এম. এ সোবহান জানান, মাইনাস আঠার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় জিনব্যাংকে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ডিগ্রি কমালে বীজের আয়ু দ্বিগুণ হবে। আবার কেবল বীজশালায় বীজ সংগ্রহ করে রাখলে চলবে না, বরং জমি চাষের সাথে বীজের সম্পর্ক তৈরি করে রাখতে হবে। অর্থাৎ কৃষকরা প্রতিবছর তাদের ফসল থেকে এই বীজ হেফাজত করবেন। পরের বছর সেই বীজ আবার রোপন করবেন। কারণ, জিনব্যাংকে বীজ সংগ্রহ করে পাঁচ বছর রেখে দিলে এই সময়টা বীজ প্রকৃতির সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক হারাবে। এরপর বীজ রোপন করা হলে তা পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারবে না। প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনের সাথে কীটপতঙ্গও বিবর্তিত হয়ে যায়। ফসল ধ্বংসের ক্ষমতাও তার বেড়ে যায়। জিনব্যাংকে বীজ জমানো থাকায় এবং প্রতিবছর চাষ না করায় প্রকৃতির বিবর্তনের সাথে এর কোন বিবর্তন হয় না। তাই নয়াকৃষির বীজশালার কৃষকরা ঘরে যেমন বীজ রাখেন সেইভাবেই বীজ রাখা হয়। প্রতিবছর উৎপাদিত ফসল থেকেই বীজ রাখা হয় বলে জানালেন নয়াকৃষি আন্দোলনের পরামর্শক ড. এম. এ. সোবহান। তিনি জানান, সরকারি বীজাগার বা জিনব্যাংকে প্রায় আঠার হাজারের মত ধানের বীজ গচ্ছিত ছিল। তা থেকে বার হাজার বীজ নষ্ট হয়ে ছয় হাজার বীজ তাদের সংগ্রহে আছে।

উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলনের ধানমেলায় এই বিষয়গুলো আরও খোলামেলা আলোচনা হবে। কৃষকরাও নয়াকৃষি সম্পর্কে দর্শকদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারবেন।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।