পূর্ব বঙ্গের কৃষক আন্দোলনঃ সাম্প্রদায়িকতা না শ্রেণীসংগ্রাম?


আবুল মনসুর আহমদরে অনেকেই কেবল ব্যঙ্গ লেখক হিশাবে চিনতে চান। কিন্তু তাকে কেবল ব্যঙ্গ লেখক মনে করা তাঁকে ব্যঙ্গের শামিল। এতে তাঁর আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আড়াল হইয়া যায়। ১৯৪৭ সালের আগের ও পরের ইতিহাস, বিশেষ কইরা আমাদের এই অঞ্চলের কৃষি প্রশ্ন ও তার রূপান্তর জানতে বুঝতে চাইলে আবুল মনসুর আহমদরে বাদ দিয়া সেইটা এক প্রকার অসম্ভব। তিনি ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নামে একটা আত্মজীবনী লেইখা গেছেন। যেইটা নিছক আবুল মনসুরের আত্নজীবনী না, আমাদের এই ভু-খন্ডের আত্মজীবনীও বটে।

বইটা বিশাল, পুরা বইয়ের আলোচনা এইখানে সম্ভব না। আমরা শুধু কৃষক-প্রজা পার্টির ইতিহাসে নজর ফিরাব। আমাদের ইতিহাস আলোচনায় কৃষক-প্রজা পার্টি নিয়া আলোচনা করতে দেখা যায় না। সাতচল্লিশ পুর্ব আলোচনায় কেবলি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঘুইরা ফিইরা আসে। কিন্তু সে সময় কী ভুমিকা ছিল কৃষক-প্রজা পার্টির? সে হদিস কাউরে খুব বেশি নিতে দেখি না। সেই হদিস নিতে আমাদের সাহায্য করে আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’।

কৃষক-প্রজা পার্টি

আবুল মনসুর তাঁর বইয়ের বয়ান শুরু করছেন জমিদারের বিরুদ্ধে তাঁর নিজের একটা ঘটনা দিয়া। ঘটনাটা হইতেছে আবুল মনসুর জমিদারের নায়েবরে তুই তুকারি করছেন। কেন? মনসুর দেখতেছেন নায়েব আমলারা সমাজের মু্রুব্বিদের ‘তুমি’ বইলা সম্বোধন করে, মুরব্বিদের কাছারিতে বসতে দেয় না। পাশের গ্রামের যে গণক ঠাকুর মনসুরদের বাড়িতে ভিক্ষা করতে আসেন কাছারিতে তারও বসার জায়গা আছে। এসব দেইখা আবুল মনসুর অসহ্য হইয়া গেছেন। তারপর একদিন মওকা বুইঝা মুখের উপর নায়েবরে তুই ফিরাইয়া দিলেন।

আবুল মনসুরের সময়টা হইতেছে ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি উত্থানপর্বের সময়। ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত শ্রেণী জাতীয়তাবাদী চেতনা ধারন কইরা রাজনৈতিক সংগঠন আকারে সংগঠিত হওয়া শুরু করছে। এই কালপর্বে পূর্ব-বাংলার কৃষক-প্রজারাও আবার নতুন আশায় সংগঠিত হইতে শুরু করে। তাদের সংগঠিত হওয়ার বয়ান ইতিহাস আমরা আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরে পাই।

১৯১১ সালে দরিরামপুর মাইনর স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন আবুল মনসুর আহমদ একটা প্রজা সভা ডাকেন। তাতে কাছারিতে প্রজাদের শ্রেণীমত বসিবার আসন দাবী এবং শরার বরখেলাফ কালী পূজার মাথট আদায় মওকুফ রাখিবার অনুরোধও করা হইল(পৃষ্ঠা ১০)।এইটারে আবুল মনসুর প্রজা আন্দোলনের বীজ বইলা আখ্যায়িত করছেন। এই বীজ ১৯২৯ সালে নিখিল-বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠনের মাধ্যমে চারায় পরিণত হয়।

শুধু সমিতি আকারে সংগঠিত হওয়া নয়, কৃষকদের স্বার্থের প্রতিনিধি হিশাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করে প্রজা সমিতি।আবুল মনসুর ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রজা সম্মিলনীতে প্রাদেশিক আইন পরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ উপলক্ষে একটা নির্বাচন মেনিফেস্টো লেখেন । “এই মেনিফেস্টোতে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ, খাজনা নিরিখ হ্রাস, খাজনা ঋণ মওকুফ, মহাজনী আইন প্রণয়ন, সালিশী বোর্ড প্রভৃতি দাবি লিপিবদ্ধ করা হয়(পৃষ্ঠা ৬৭)।” এই সম্মিলনীতেই প্রজাদের আরো ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রজা সমিতির নাম কৃষক-প্রজা সমিতি করা হয়।


শুধু সমিতি আকারে সংগঠিত হওয়া নয়, কৃষকদের স্বার্থের প্রতিনিধি হিশাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করে প্রজা সমিতি।আবুল মনসুর ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত প্রজা সম্মিলনীতে প্রাদেশিক আইন পরিষদের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ উপলক্ষে একটা নির্বাচন মেনিফেস্টো লেখেন । “এই মেনিফেস্টোতে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ, খাজনা নিরিখ হ্রাস, খাজনা ঋণ মওকুফ, মহাজনী আইন প্রণয়ন, সালিশী বোর্ড প্রভৃতি দাবি লিপিবদ্ধ করা হয়(পৃষ্ঠা ৬৭)।” এই সম্মিলনীতেই প্রজাদের আরো ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রজা সমিতির নাম কৃষক-প্রজা সমিতি করা হয়।


১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করে কৃষক-প্রজা পার্টি। নির্বাচন শেষে দেখা গেল কৃষক-প্রজা পার্টির সমর্থনের উপর মন্ত্রী সভা গঠন নির্ভর করতেছে। কংগ্রেসের সাথে সমঝোতা ব্যর্থ হওয়ায় মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন কইরা কৃষক-প্রজা পার্টির সভাপতি ফজলুল হকের নেতৃত্বে হক-মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। এই হক-মন্ত্রীসভার মাধ্যমে কৃষক-প্রজা পার্টি সীমিত হইলেও তাদের দাবী দাওয়ার অনেকগুলা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আদায় কইরা নেয়। “১৯৩৮ সালের মধ্যেই সালিশী বোর্ড স্থাপন শেষ হইল। ১৯৩৯ সালের মধ্যে কৃষক-প্রজার দাবী মত প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হইল এবং মুসলিম লীগের দাবী মত কলিকাতা মিউনিসিপাল আইন সংশোধন করিয়া কর্পোরেশনের পৃথক নির্বাচন-প্রথা প্রবর্তন করা হইল। ১৯৪০ সালের মধ্যে মহাজনি আইন পাশ হইয়া গেল। সালিশী বোর্ড প্রজাস্বত্ব আইন ও মহাজনী আইনে বাংলার কৃষক প্রজা ও কৃষি-খাতকদের জীবনে এক শুভ সূচনা হইল। তারা কার্যতঃ আসন্ন মৃত্যুর হাত হইতে বাঁচিয়া গেল (পৃষ্ঠা ১০৭)।” পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলন বেগবান হইয়া উঠলে ১৯৪৬ সালের দিকে কৃষক-প্রজা পার্টি স্তমিত হইয়া পড়ে।

সাম্প্রদায়িকতা না শ্রেণিসংগ্রাম?

কৃষক-প্রজা পার্টির সদস্যরা সম্প্রদায়গতভাবে ছিল মুসলমান এবং তাদের লড়াই ছিল হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে। এ কারণে অনেকেই মনে করেন এইটা একটা সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল। কিন্তু আসলেই কি কৃষক-প্রজা পার্টি সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছিল? কৃষক-প্রজা পার্টি কি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করত? কোন ঐতিহাসিক সামজিক পরিস্থিতিতে কৃষক-প্রজা পার্টি মুসলমানদের সংগঠনে পরিণত হয় সেইদিকে নজর না দিয়া সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলার পেছনে কাজ করে ধর্মকে একাট্টা প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক মনে করার চিন্তা। ভুইলা যাওয়া যে ইতিহাসে ধর্মের দুইটা ভূমিকা দেখা গেছে সবসময়। কেউ ধর্মের নামে নিপীড়ন করে আবার কেউ সেই ধর্মের নামেই প্রতিরোধ গইড়া তুলে।

এই ভারতবর্ষেই তিতুমীর, শরিয়তুল্লাহরা ধর্মীয় বয়ানে জমিদারদের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে। ধর্মীয় বয়ানে সংগঠিত এই সব আন্দোলনরে এঙ্গেলস তাঁর ‘জর্মনিতে কৃষক যুদ্ধ’ বইয়ে বলছেন, “এমনকি ষোল শতকের যেগুলিকে বলা হয় ধর্ম যুদ্ধ সেগুলিতেও প্রধানত জড়িত ছিল বিভিন্ন স্পষ্ট-নির্দিষ্ট বৈষয়িক শ্রেণিস্বার্থ; সেগুলো ছিল শ্রেণিযুদ্ধও, ঠিক যেমন ছিল ইংলন্ড আর ফ্রান্সের পরবর্তী আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষগুলো। যদিও তখন শ্রেণিসংগ্রামগুলি চলত ধর্মীয় বাগধারা অবলম্বন করে, যদিও বিভিন্ন শ্রেনীর স্বার্থ, প্রয়োজন এবং দাবিদাওয়া থাকত ধর্মীয় পর্দার আড়ালে, তাতে বিষয়টায় কিছুই বদলাত না, তদানীন্তন পরিবেশ থেকে সেটা বোঝা যায় সহজেই”(মার্কস-এঙ্গেলস ১৯৮১,পৃ-৯৬)। ধর্মীয় পর্দার আড়ালে তিতুমীররা নিজেদের শ্রেণীর দাবি দাওয়া হাজির করছিলেন এঙ্গেলস যেইটারে বলতেছেন শ্রেণী সংগ্রাম।

কৃষক-প্রজা পার্টির সেই অর্থে কোনও ধর্মীয় পর্দাও ছিল না। কৃষক প্রজা পার্টি নামেই এইটা সংগঠিত হইছে। তারপরও এইটা মুসলমানদের সংগঠনে পরিণত হইছিল। কেন? ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে বাংলার ভূমি মালিকানা সম্পর্কের রূপ জমিদার-প্রজায় পরিণত হয়। আর “বাংলার জমিদাররা প্রধানত হিন্দু এবং প্রজারা প্রধানত মুসলমান। জমিদারিতে যা মহাজনি ব্যাপারেও তাই। মহাজনরা প্রধানত হিন্দু এবং খাতকরা প্রধানত মুসলমান (পৃ-৪২)।” বাঙালি হিন্দু তখন জমির মালিকানা ব্যবস্থা দ্বারা তৈরি হওয়া মালিক বা শাসক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আর মালিকানা হারিয়ে কৃষিতে বিপর্যস্ত, ঋণভারে জর্জরিত ভূমিহীন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন মুসলমান। ফলে দুইটা শ্রেণি দুইটা সম্প্রদায়ে ভাগ হইয়া পড়ে।“ বাংলার আর্থিক সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর আগাগোড়াই এমন দুই-জাতি-ভিত্তিক ছিল যে প্রজা-খাতক নামের চুলে ধরিয়া টান দিলে মুসলমান নামের মাথাটি আসিয়া পড়িত। অপরপক্ষে জমিদার-মহাজনের নামের টানে হিন্দুরাও কাতারবন্দী হইয়া যাইত (পৃ-৯৯)।” দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিরোধ আরো জোরালো হইয়া উঠে যখন “শুধু হিন্দু জমিদাররাই মুসলমান প্রজাদিগকে তুই-তুংকার করিয়া অবজ্ঞা করিতেন এবং তাঁদের কাছারিতে ও বৈঠকখানায় এদেরে বসিতে আসন দিতে অস্বীকার করিতেন, তা নয়। তাঁদের দেখাদেখি তাঁদের আত্নীয়-স্বজন, তাঁদের ঠাকুর-পুরোহিত, তাদের উকিল-ডাক্তাররাও মুসলমানদেরে নিজেদের প্রজা ও সামাজিক মর্যাদায় নিম্নস্তরের লোক মনে করিতেন (পৃ-৯৮)।” ফলে শ্রেণিগত বিরোধ আরও বেশি সম্প্রদায়গত বিরোধে পরিণত হয়।


বাঙালি হিন্দু তখন জমির মালিকানা ব্যবস্থা দ্বারা তৈরি হওয়া মালিক বা শাসক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আর মালিকানা হারিয়ে কৃষিতে বিপর্যস্ত, ঋণভারে জর্জরিত ভূমিহীন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছিলেন মুসলমান। ফলে দুইটা শ্রেণি দুইটা সম্প্রদায়ে ভাগ হইয়া পড়ে।


বাংলার এই সম্প্রদায়গত বিরোধে আরো তা দেওয়া ঘটে যখন ১৯২৮ সালে বাংলার আইন পরিষদে প্রজাস্বত্ব বিলের ভোটাভুটিতে “কংগ্রেসী-অকংগ্রেসী প্রজা-জমিদার সব হিন্দু জমিদারের পক্ষে এবং কংগ্রেসী-অকংগ্রেসী প্রজা-জমিদার সব মুসলমান প্রজার পক্ষে ভোট দিয়াছিলেন (পৃ-৯৯)।” আইনসভাও সাম্প্রদায়িকভাবে ভাগ হইয়া পড়ে। ফলশ্রুতিতে মুসলমান কংগ্রেসীরা মওলানা আকরম খাঁ নেতৃত্বে নিখিল-বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠন করে। এইভাবে রাজনৈতিক দল-মত নির্বিশেষে বাংলার সমস্ত হিন্দু নেতা জমিদারদের পক্ষে কংগ্রেসে এবং সমস্ত মুসলিম নেতা প্রজার পক্ষে প্রজা সমিতিতে সংঘবদ্ধ হন। তবুও আবুল মনসুর কৃষক-প্রজা পার্টি যাতে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় যথাসাধ্য সেই কোশেশ করছেন। প্রজা সমিতি গঠনের পর আঞ্জুমনে ইসলামিয়া কর্মী সম্মিলনী না ডাইকা মুসলিম কর্মী সম্মিলনী ডাকার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সমিতির অসাম্প্রদায়িক রূপ বজায় রাখার স্বার্থে আবুল মনসুর এই প্রস্তাবে সায় দেন নাই। যারা কারণে আঞ্জুমনের সাথে প্রজা সমিতির বিরোধ শুরু হয়।

বাংলার জমিদার ও প্রজা এই দুইটা শ্রেণী দুইটা সম্প্রদায়ে ভাগ হওয়ার ঐতিহাসিক বাস্তবতা বাদ দিয়া আমরা যদি কৃষক-প্রজা পার্টির দাবী দাওয়ার দিকেও নজর দেই তাইলেও এইটারে সাম্প্রদায়িক বলা যায় না। কৃষক-প্রজা পার্টির প্রধান দাবী ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। এই দাবী কি সাম্প্রদায়িক দাবী? এইটা একটা বৈপ্লবিক দাবী। কৃষক-প্রজার স্বার্থের, তাদের মুক্তির এই দাবী। এইটা সত্য যে কৃষক-প্রজা পার্টি নিজেদের সংগ্রামরে শ্রেণি সংগ্রাম দাবী করে নাই, তারা বলে নাই যে তারা শ্রেণী সংগ্রাম করতেছে। কিন্তু আমরা এইটারে শ্রেণী সংগ্রাম আকারে পাঠ করতেছি। কেন? মার্কসের তরিকা অনুযায়ী “আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস(মার্কস এঙ্গেলস পৃ-২৬)।” এইটা শ্রেণী সংগ্রামের একটা নির্বিশেষ সংজ্ঞায়ন। দুনিয়ার তাবৎ ইতিহাসরে মার্কস শ্রেণী সংগ্রাম বলছেন। বাস্তবে শ্রেণী সংগ্রাম কি বিশেষ রূপ নিয়া হাজির হয় সেইটাকে কেন্দ্র কইরা কথাটা বলেন নাই। বলছেন বাস্তবে লড়াইগুলা বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সংঘটিত হয় কখনও আড়ালে কখনও প্রকাশ্যে।মার্কস ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণি ক্যামনে গইড়া উঠে সেইটা বুঝার একটা কোশেশ করছেন ‘জর্মান ভাবাদর্শে’। মধ্যযুগের উদাহরণ দিয়া মার্কস বলতেছেন “বিদ্যমান(উৎপাদন) সম্পর্কের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও এর শর্তের মধ্যে নির্ধারিত শ্রমের ধরণের কারণে বিচ্ছিন্ন নগর-বাসিন্দাদের জীবন যাপন পরিস্থিতির মধ্যে এমন পূর্বশর্তের উদ্ভব ঘটেছিল যা তাদের সবার ক্ষেত্রে সাধারণ লক্ষণ ও সবার থেকে স্বাধীন। নগর-বাসিন্দারা এই শর্ত ততটুকুই সৃষ্টি করতে পেরেছিল যতটুকু সামন্ততান্ত্রিক বন্ধন তাঁরা ছিন্ন করে মুক্ত হতে পেরেছিল আর যতটুকু বিদ্যমান সামন্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধচারণে তাঁরা একনিষ্ঠ ছিল। আলাদা আলাদা নগর একত্রিত হতে শুরু করলে এই সাধারণ শর্তগুলো শ্রেণি(উদ্ভবের) শর্ত আকারে বিকশিত হয়েছিল(জর্মান ভাবাদর্শ-অনুবাদ গৌতম দাস, পৃ-১৮৫)।” বাংলাদেশে এখানে উৎপাদন সম্পর্কের রূপ ছিল জমিদার আর প্রজা। এই বিশেষ সম্পর্কের মধ্যে একটা বিশেষ শ্রেণি ভূমিহীন কৃষক সম্প্রদায়ের পরিগঠন হইল। এই শ্রেণি নিজেরদের স্বার্থ জমিদারের উচ্ছেদের দাবীতে কৃষক-প্রজা পার্টি আকারে সংগঠিত হয়। যেইটা মার্কসের তরিকা অনুযায়ী শ্রেণী সংগ্রামই।

শ্রেণি সংগ্রাম থেইকা জাতীয়তা

কৃষক-প্রজা পার্টি ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের লক্ষে পরিচালিত একটা আঞ্চলিক শ্রেণি সংগঠন। কোন জাতীয় প্রশ্ন এই সংগঠন ডিল করার সুযোগ হয় নাই। সমগ্র ভারতবর্ষে তখন জাতীয়তাবাদী উপনিবেশ বিরোধী রাজনীতি প্রধান রাজনৈতিক ধারা আকারে গইড়া উঠছে। ভারতবর্ষের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের অভিমুখ ছিল জাতীয়তার দিকে। জমিদারি উচ্ছেদ তাদের কর্মসুচী ছিল না। আর কৃষক-প্রজা পার্টির অভিমুখ ছিল ভূমি মালিকানা প্রশ্নের সমাসধানরে কেন্দ্র কইরা পরিচালিত। যেহেতু ভারতবর্ষের মুল রাজনীতি তখন জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে পর্যবসিত, ফলে কৃষক প্রজা পার্টিরে জাতীয়তার প্রশ্নে একটা সমাধানে আসতে হইব। সমাধানটা কী? কৃষক প্রজা পার্টির সামনে দুইটা পথ খোলা ছিল। সমগ্র ভারতবর্ষ জুইড়া তার মত যারা প্রজা তাদের সাথে একটা ক্লাস এলায়েন্স গইড়া তোলা। কিন্তু সেইটাতে সমস্যা ছিল গোটা ভারতজুড়ে ভূমি ব্যবস্থা একইরকম ছিল না। বৃটিশ ভারতের প্রশাসনিক মুল প্রেসিডেন্সী বেঙ্গল, বোম্বাই আর মাদ্রাসের মধ্যে শুধু বেঙ্গলের ভূমি ব্যবস্থাপনায় জমিদারি সিস্টেম চালু ছিল। তার উপর জমিদার-প্রজা দুইটা শ্রেণী দুইটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ে ভাগ হইয়া গেছে। আর এর অন্যটা হইল, একটা জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যেইটা সামনে হাজির হইতে চলেছে সেখানেই নিজের মিত্র তালাশ করা। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ভূমি প্রশ্নের সমাধান করা।


কৃষক-প্রজা পার্টির প্রধান দাবী ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। এই দাবী কি সাম্প্রদায়িক দাবী? এইটা একটা বৈপ্লবিক দাবী। কৃষক-প্রজার স্বার্থের, তাদের মুক্তির এই দাবী। এইটা সত্য যে কৃষক-প্রজা পার্টি নিজেদের সংগ্রামরে শ্রেণি সংগ্রাম দাবী করে নাই, তারা বলে নাই যে তারা শ্রেণী সংগ্রাম করতেছে। কিন্তু আমরা এইটারে শ্রেণী সংগ্রাম আকারে পাঠ করতেছি। কেন? মার্কসের তরিকা অনুযায়ী “আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস


জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে নিজেদের মিত্র তালাশ করতে গিয়া একটা কমন কম্যুনিটি স্বার্থবোধের জায়গা থেইকা মুসলিম লীগের কাছাকাছি আসা শুরু করছে। বলছি যে কাছাকাছি আসা শুরু করছে কিন্তু এইটা এত সরলভাবে ঘটে নাই। প্রথমে কংগ্রেসের সাথে মৈত্রী গড়তে যায় কৃষক-প্রজা পার্টি। দাবির প্রশ্নে বনিবনা না হওয়ায় আপষ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বাকি থাকে মুসলিম লীগ। আইন পরিষদের নির্বাচনের পর মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন গঠনের কথা আগেই বলছি। কিন্তু তখনও কৃষক-প্রজা পার্টির মূল দাবি জমিদারি উচ্ছেদের কোন সুরাহা হয় নাই। এইটার সুরাহা না হওন তক আলোচনা চলতে থাকে যার পুরা বিবরণ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’এ পাওয়া যায়। শেষতক ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের এক নির্বাচনী সম্মেলনে “মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদে কমিটেড হইলেন (পৃ-১৫০)।” কলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের দল মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যে এই দাবীর আত্মীকরণ ঘটে। বাংলার ভূমি প্রশ্ন জাতীয়তায় রূপান্তর হয়। ফলে আলাদা শ্রেণি প্রতিষ্ঠান হিশাবে কৃষক-প্রজা পার্টির সমাপ্তি ঘটে।

ইতিহাসরে ইতিহাস আকারে না দেইখা সাম্প্রদায়িক আকারে দেখলে ঘটনার গভীরে প্রবেশ করা যাবে না। বাস্তবে কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে কিভাবে সংগ্রাম তৈরি করে সেইটা বুঝা জরুরি। পূর্ব বঙ্গের কৃষক-প্রজাদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসরে এর উত্থান-পতনসহ ইতিহাস আকারে পাঠ করতে আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ একটা অসাধরণ বই।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।