- মনসান্তোর জিএমও কারসাজি
- আমাদের এখনকার সংকট
- আওয়ামি লিগের ইতিহাসও পারিবারিক ইতিহাসে পর্যবসিত হয়েছে...
- বাংলাদেশে 'নিউকনি' সিপাই
- রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ আদালত নিয়ে রাজনীতি
- রোকেয়া পাঠের স্থান কাল পাত্র
- গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তিন লক্ষ্য
- মোদীর ভারত এবং বিশ্ব শক্তির ভারসাম্য বদল
- দেখলেই গুলি?
- আদালতের কর্তৃত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ভাসানী, রবুবিয়াত ও নতুন বিপ্লবী রাজনীতি
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের উদয়, বেড়ে ওঠার ইতিহাস এবং উপমহাদেশের জনগনের লড়াই সংগ্রাম থেকে যেভাবে মুছে ফেলা হয়েছে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির পুনর্গঠনের প্রশ্ন মওলানা ভাসানীকে নতুন ভাবে জানা, পড়া ও চর্চায় নিয়ে যাবার ওপর নির্ভরশীল। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লেখাগুলোর পাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গঠনের গলদ, গণতন্ত্র ও এখনকার কর্তব্য
বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচারব্যবস্থার গোড়ার গলদ হচ্ছে শুরু থেকে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা ও গঠন করা যায় নি। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু ও সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে -- যার ঘোষিত ও লিখিত মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বা ইনসাফ কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু ডান কি বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল বা ধারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণশক্তির বিকাশ ও বিজয় ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবই অসমাপ্ত যুদ্ধ সম্পন্ন করতে পারে, এটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। এদেশের সকল মানুষের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার, লোকায়ত জ্ঞান ও ভাবুকতা সবই রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে গড়ে ওঠার আন্তরিক ও ঐতিহাসিক উপাদান। কিন্তু গণ ঐক্য ও গণশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যারা ধর্মের নামে, ধর্ম বিরোধিতার নামে কিম্বা বাস্তবতা বিবর্জিত নানান আসামানি মতাদর্শের দোহাই দিয়ে জনগণকে বিভক্ত ও আশু রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও কর্তব্য পূরণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে তারাই -- ডান কিম্বা বাম -- জনগণের শত্রু।
- চতুর্থ সংশোধনীতে হারানো ক্ষমতা সামরিক আইনে ফিরে পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছে আদালত
- আইনের শাসনের তামাশা ও বাকশাল ‘দর্শনের’ জের
- আদালত অবমাননার বিচার ও দণ্ড প্রসঙ্গ
- ‘কমিউনিস্ট’দের রিমান্ড সমস্যা
- হাসিনার কনস্টিটিউশন সংশোধন: আসলে কি হতে যাচ্ছে?
- সংজ্ঞাহীন অবারিত এখতিয়ার বন্ধ হবে কবে?
- ছয় বছরেও চূড়ান্ত হয় নাই আদালত অবমাননা আইন
বাংলার ভাবসম্পদ
লালন ও ভাবান্দোলন
চিনিয়ে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া
‘পরান পিরীতিখানি ভাবিলে নবীন’
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শাখার পদাবলী সাধারণতঃ ধর্ম সম্পৃক্ত রচনা বলেই মনে করা হয়। মুহাম্মদ আব্দুল হাই ও ডক্টর আহমদ শরীফ তাঁদের সম্পাদিত ‘‘মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা” গ্রন্থের ক নম্বর পৃষ্ঠায় বলেন ‘‘এগুলো ধর্মমতবাদীর একাধারে সাধন সঙ্গীত, বোদন গীতি, ও ভজন”। আর ধর্ম তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিতদের কাছে পশ্চাদপদতার প্রতীক বিধায় পরিত্যাজ্য। একারণেই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য আমাদের কাছে মধ্যযুগীয়(?) বলে অবহেলিত। এই অবহেলার মনোভাব সৃষ্টিতে কায়েমি পণ্ডিত সমাজ সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের কারো কারো মতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত অষ্টাদশ শতকে এই অঞ্চলে ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। এবং তখন থেকেই শুরু হয়েছে বাংলা সাহিত্যের ভদ্র/শালীন/শিষ্ট/ শ্লীল ধারাটি। এসব কথাকে মেনে নিলে বলতে হয় ইংরেজদের আগমনের আগে এদেশে যে সাহিত্য চর্চা হয়েছে তা ছিল অভদ্র, অশ্লীল, অশালীন এবং অশিষ্ট। স্বাভাবিক ভাবেই তখন এই অভদ্র, অশ্লীল এবং অশিষ্ট সাহিত্য পড়তে আমাদের মন উঠে না। ওখানে আমাদের আধুনিক মনের উপযোগী চিন্তার খোরাক থাকতে পারে বলে আমরা মনে করি না। তাই এইসব লেখা পড়ে সময় অপচয় করার কোনো মানে হয় না।
আসলেও কি তাই? ওখানে কি চিন্তার কোনো পরিচয় কিংবা বিকাশ লক্ষ করা যায় না? ওখানে কি শুধুই ধর্মচিন্তা ঠাঁই পেয়েছে, নাকি সমাজের নানান সংকট ও জিজ্ঞাসার দার্শনিক আলোচনাও আছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য সৈয়দ মর্তুজার কয়েকটি বৈঞ্চব পদ আলোচনা করার খায়েশ আমার। এক্ষেত্রে দর্শন জিজ্ঞাসার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র--ভাষার উপর চোখ রেখে পদগুলো পড়ব। ভাষাদর্শনের যেসব জিজ্ঞাসার সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি এই বিগত বিশ শতকে পশ্চিমা দর্শনের বদৌলতে, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের মধ্যযুগে আমাদের চিন্তার জগতেও যে সেসব জিজ্ঞাসার পরিণত আলোচনা ছিল, এ আলোচনায় তার দেখা পাব বলে মনে করি। সৈয়দ মর্তুজা ষোড়শ শতকের শেষভাগ থেকে সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। সৈয়দ মর্তুজার পদে পরমতত্ত্বের চমৎকার বিকাশ লক্ষ করা যায়। পরমাত্মা বা স্রষ্টা বা পুরুষের স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে সৈয়দ মর্তুজা বলছেন:
সাঁই, এক বিনে মাওলা এক বিনে
আর নাহি কোন কোই।।
আপে হরে আপে রাখে সখি!
মাওলা আপে করে কেলি।
আনন্দ মোহন মাওলা খেলায় ধামালী।
আপে মন আপে তন আপে মন হরি।
আপে কানু আপে রাধা আপে মুরারি।।
সৈয়দ মর্তুজা কহে সখি
মাওলা গোপতের চিন।
পরান পিরীতিখানি ভাবিলে নবীন।। (২৯২)
এই পদটির শেষ দুটি চরণ দিয়ে আমি আলোচনা শুরু করব।
‘মাওলা গোপতের চিন।
পরান পিরীতিখানি ভাবিলে নবীন’।।
এখানে ‘মাওলা’, ‘গোপত’, এবং ‘চিন’ শব্দ তিনটি ভাষাদর্শনের এক বিরাট জিজ্ঞাসার দিকে ইঙ্গিত করে। ‘গোপত’ শব্দটির অর্থের দিকে খেয়াল করলে আমরা দেখি এর অর্থ হল ‘গুপ্ত; লুক্কায়িত; অগোচর’। আর অগোচর মানে হল ‘বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয়ের অতীত এমন’। আর ‘চিন’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ‘দাগ; চিহ্ন; ছাপ; নিদর্শন। অভিজ্ঞান; পরিচয়’ ইত্যাদি। আহমদ শরীফ সম্পাদিত বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান থেকে এই অর্থগুলো নেওয়া হয়েছে। তার মানে, যা বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয়ের অতীত তার পরিচয় যে ‘চিন’ বা চিহ্ন বা দাগ বা ছাপ দিয়ে প্রকাশ করি তা হল ‘মাওলা’। অর্থাৎ মাওলা শব্দটি এখানে একটি চিহ্ন বা দাগ বা sign। আর আধুনিক ভাষাতত্ত্বের বদৌলতে আমরা জানি যে চিহ্ন বা sign ভাষার মৌল একক।
আধুনিক ভাষাতত্ত্বের প্রবাদ পুরুষ সুইশ ভাষাবিজ্ঞানী সস্যুরের মতে ভাষা হল চিহ্নের বিন্যাস। যেখানে অর্থের মৌল একক হল চিহ্ন (sign); যা চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের সমন্বয় বা প্রণয় বা পিরীতির ফসল। এখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রণয় ও পিরীতি শব্দ দুইটি ব্যবহার করেছি। কারণ আমাদের এই অঞ্চলের চিন্তা চর্চার পদ্ধতি ও পরিভাষার নিজস্ব ধরণ আছে যার সাথে পরিচয় না থাকলে এইসব আলোচনা নিতান্তই খামখেয়ালী বলে মনে হবে। আর এই ধারায় চিন্তার জন্য আমি কবি ফরহাদ মজহারের কাছে ঋণী। যাহোক, চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের কথায় আসা যাক। এখানে চিহ্নায়ক হল ’শব্দচিত্র’ (word-image) যা হতে পারে দর্শনযোগ্য বা শ্রবণযোগ্য। আর চিহ্নায়িত হল ‘মানসিক ধারণা’ (mental concept)। যেমন ‘গাছ’ এই চিহ্নায়কটির চিহ্নায়িত হল গাছের ধারণা। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সস্যুর এখানে কোনো বস্তু এবং তার নামের মধ্যকার স্বাতন্ত্র্যকে বুঝাচ্ছেন না। বরং তিনি ‘শব্দচিত্র’ (word-image) এবং ‘মানসিক ধারণা’ (mental concept) এর মধ্যকার স্বাতন্ত্র্যকেই নির্দেশ করছেন। কেবলমাত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেই চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের পৃথককরণ সম্ভব। চিন্তার ক্ষেত্রে এদেরকে আলাদা করা সম্ভব নয়। ‘শব্দচিত্র’ (word-image) কে ‘মানসিক ধারণা’ (mental concept) থেকে এবং বিপরীতভাবে ‘মানসিক ধারণা’ (mental concept) কে ‘শব্দচিত্র’ (word-image) থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। সৈয়দ মর্তুজার আলোচনায়ও দুটি বিষয় জড়িত আছে। এর একটি হল ‘মাওলা’ এবং আরেকটি ‘গোপত’। বৈষ্ণব মতবাদ অনুসারে কৃষ্ণ পরমাত্মা বা স্রষ্টার প্রতীক এবং রাধা জীবাত্মা বা সৃষ্টির প্রতীক। স্রষ্টা পুরুষস্বরূপ আর সৃষ্টি নারীস্বরূপা। পরমাত্মা ও জীবাত্মা, স্রষ্টা ও সৃষ্টি, পুরুষস্বরূপ ও নারীস্বরূপা পরস্পর প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ। এক্ষেত্রে সৃষ্টি স্রষ্টার লীলাসঙ্গিনী, আনন্দ যোগের সহচরী। এই পরমাত্মা বা স্রষ্টা বা পুরুষস্বরূপকেই সৈয়দ মর্তুজা বলছেন গুপ্ত, লুক্কায়িত বা অগোচর কারণ তা বুদ্ধি বা ইন্দ্রিয়ের অতীত। আর এই ‘পরমাত্মা’ই ‘‘মাওলা গোপতের চিন” এই বাক্যানুসারে চিহ্নায়িত বা signified এবং ‘মাওলা’ ‘শব্দচিত্র’টি (word-image) তার একটি নির্দেশক বা চিহ্নায়ক (signifier)। এই দুইয়ের মিলনে জন্ম হয়েছে যে চিহ্ন (sign) বা দাগ তা হল ‘মাওলা’।
সস্যুরের তত্ত্বের প্রাথমিক নীতি হল চিহ্ন অযুক্তিনিষ্ঠ (arbitrary)। বিষয়টি দুই দিক থেকে দেখা যায়। প্রথমতঃ চিহ্নায়কের দিক থেকে এবং দ্বিতীয়ত চিহ্নায়িতের দিক থেকে। উদাহরণ হিসাবে আমরা ‘গাছ’ শব্দটিকে বিবেচনা করতে পারি। চিহ্নায়কের দিক থেকে চিহ্ন অযুক্তিনিষ্ঠ, কারণ চিহ্নায়ক ‘গাছ’ এবং চিহ্নায়িত গাছের ধারণার মধ্যে কোনো অত্যাবশ্যক বন্ধন বা সম্পর্ক নেই। ধ্বনি বা লিখিত বিভিন্ন রূপের যেকোনো সমষ্ঠি গাছকে চিহ্নিত বা নির্দেশ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, বৃক্ষ, তরু, শাখী, বিটপী, দ্রুম, মহীরুহ, রসাল, ও বনস্পতি ইত্যাদি। চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের মধ্যকার সম্পর্ক/পিরীতি একটি প্রথা বা চল এর ব্যাপার। বাংলা ভাষায় আমরা প্রথাগতভাবেই ‘গাছ’ শব্দটিকে ‘গাছ’ ধারণার সাথে সম্পৃক্ত করি। চিহ্নের অযুক্তিনিষ্ঠ প্রকৃতি এই দিক থেকে সহজেই বুঝা যায়। চিহ্নের এই অযুক্তিনিষ্ঠ প্রকৃতির খবর সৈয়দ মর্তুজার কাছেও পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলছেন, এক পরমাত্মা বা স্রষ্টাকে বিভিন্নজন ভিন্ন ভিন্ন নামে বা চিহ্নে প্রকাশ করে থাকে।
কেহ বলে কালা কালা কেহ বলে শ্যাম।
মুসলমান কলমা পড়ে হিন্দু বলে রাম।। (২৫৯)
অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন চিহ্নে বা নামে একই ধারণাকে প্রকাশ করার মানে হল একই চিহ্নায়িত ভিন্ন ভিন্ন চিহ্নায়ক দ্ধারা প্রকাশিত হতে পারে। এভাবে দেখা যাচ্ছে সৈয়দ মর্তুজা এখানে পরমাত্মার আলোচনা করতে গিয়ে আধুনিক ভাষাতত্ত্বের অবতারণা করেছেন। কিন্তু কেন তিনি ভাষাতত্ত্বের অবতারণা করলেন? এই প্রশ্নটির উত্তর চিহ্নায়িতের দিক থেকে চিহ্নের অযুক্তিনিষ্ঠ প্রকৃতিকে বুঝতে পারার সাথে জড়িত।
কিন্তু চিহ্নায়িতের দিক থেকে চিহ্নের অযুক্তিনিষ্ঠ প্রকৃতিকে বুঝতে পারা বেশ জটিল। সস্যুর তা বুঝাতে চেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন ভাষা ভিন্ন ভিন্ন চিহ্নায়ক ব্যবহার করে, ব্যাপারটা কেবল এরকম নয়। বিভিন্ন ভাষা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভাগ করে। এবং তাকে প্রকাশ করে ভাষা-নির্দিষ্ট ধারণার দ্বারা। অর্থাৎ তারা ভিন্ন ভিন্ন চিহ্নায়িত ব্যবহার করে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল এটা বুঝা যে, ভাষা কোনো সরল নামকরণের পদ্ধতি নয়। স্বাধীন অর্থপূর্ণ অস্তিত্ব আছে এমন জিনিস বা ধারণার নামকরণ করা ভাষার কাজ নয়। সস্যুর তাঁর Course in General Linguistics গ্রন্থে বলেন, “If words stood for pre-existing concepts, they would all have exact equivalents in meaning from one language to the next; but this is not true.” (শব্দ যদি পূর্বেই বিদ্যমান ধারণাকে প্রকাশ করতো তাহলে এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় তাদের সঠিক সমার্থক শব্দ থাকতো। কিন্তু বাস্তবে তা থাকে না।) এর বহুল ব্যবহৃত উদাহরণ হল বর্ণালী। বর্ণালীর বর্ণগুলো বস্তুতঃ বর্ণের একটি স্তর-পরম্পরা তৈরি করে। যেখানে বর্ণালীর যে অংশটি নীল থেকে শুরু করে লাল পর্যন্ত বর্ণগুলোকে দেখায় তা একে অপর থেকে স্বাধীনভাবে বিদ্যমান নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল ইত্যাদি বিভিন্ন বর্ণক্রম দ্বারা গঠিত নয়। বরং বর্ণালী হল একটি স্তর-পরম্পরা যা আমাদের ভাষা দ্বারা বিশেষভাবে বিভক্ত।
বর্ণক্রমের বর্ণগুলোকে আলাদা অলাদাভাবে বিভক্ত করার মধ্যে যেমন প্রাকৃতিক কোনো ব্যাপার নাই, (প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য ভাষা এটাকে অন্যভাবে বিভক্ত করে।) তেমনি আমাদের বিশ্বকে অন্যভাবে বিভক্ত এবং প্রকাশ করার মধ্যেও কোনো প্রাকৃতিক ব্যাপার নাই। প্রতিটি ভাষা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে জগতকে বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন অর্থপূর্ণ শ্রেণী এবং ধারণা নির্মাণ করে। মাঝে মাঝে বুঝতে পারা কঠিন যে, আমাদের দৈনন্দিন ধারণাসমূহ অযুক্তিনিষ্ঠ। এবং ভাষা কেবল ইতিমধ্যে বিদ্যমান জিনিসের নাম প্রদান করে না। আমাদের ভাষা বিন্যাস যেভাবে জগতকে নির্মাণ করেছে তাতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যেতে চাই যে, তা আমাদের কাছে প্রাকৃতিক বলে মনে হয়, বিশ্বকে দেখার সঠিক এবং অপরিবর্তনীয় পন্থা বলে মনে হয়। কিন্তু সস্যুরের তত্ত্বের যুক্তি বলে, আমাদের জগত আমাদের জন্য আমাদের ভাষার নির্মাণ এবং ভাষিক প্রকাশের পূর্বে কোনো কিছুরই অর্থের কোনো পূর্বনির্দিষ্ট সার বা সত্তা নেই। সৈয়দ মর্তুজার ‘‘মাওলা গোপতের চিন” ভাষ্যটিতে ভাষার এই দিকটিরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চিন শব্দটির একটি অর্থ আমরা পেয়েছি ‘নিদর্শন’। ‘নিদর্শন’ শব্দটির অর্থ আমরা পাই ‘প্রমাণ’, ‘দৃষ্টান্ত’ ইত্যাদি। তাহলে ‘মাওলা’ চিহ্নটিই সেই ইন্দ্রিয়াতীতের প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত। এই চিহ্নটি ইন্দ্রিয়াতীতের উপস্থিতি ঘোষণা করে। অর্থাৎ এই ইন্দ্রিয়াতীত আমাদের জন্য আমাদের ভাষার নির্মাণ এবং ‘মাওলা’ শব্দটি দ্বারা ভাষিক প্রকাশের পূর্বে এর কোনো পূর্বনির্দিষ্ট সার বা সত্তা নেই। সৈয়দ মর্তুজার এই সিদ্ধান্তে আসার পথ পরিক্রমাটি আমরা আরেকবার দেখে নিতে পারি। তিনি বলছেন,
সাঁই, এক বিনে মাওলা এক বিনে
আর নাহি কোন কোই।।
আপে হরে আপে রাখে সখি!
মাওলা আপে করে কেলি।
আনন্দ মোহন মাওলা খেলায় ধামালী।
আপে মন আপে তন আপে মন হরি।
আপে কানু আপে রাধা আপে মুরারি।।
অর্থাৎ এক মাওলা ছাড়া আর কোথাও কোনো মাওলা নাই। মাওলা নিজেকেই দেখে, নিজের সাথে নিজে লীলা করে। আনন্দে মুগ্ধ মাওলা রঙ্গলীলা করে। মাওলা নিজেই মন, নিজেই শরীর, নিজেই মনের আকাঙ্ক্ষা। কানু, রাধা, মুরারী সবই নিজে। অর্থাৎ ‘মাওলা’। আর মাওলা হল চিহ্ন। এক মাওলা ছাড়া আর কোথাও কোনো মাওলা না থাকা মানে তো তাহলে চিহ্ন ছাড়া মাওলা নাই। অর্থাৎ ভাষার মধ্যেই মাওলার বাস। ভাষা বিনে মাওলা নেই। আর ভাষা অর্থ নির্মাণের ‘ধামালী’ খেলায় রত। তাইতো পরমাত্মার সন্ধান করতে হলে ভাষাতত্ত্বের আলোচনা অত্যাবশ্যক। সৈয়দ মর্তুজা তাই এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ‘মাওলা গোপতের চিন’।
কিন্তু মর্তুজার পরের বক্তব্যটি আমাদেরকে সংকটে ফেলে দেয়। তিনি বলেন, ‘পরান পিরীতিখানি ভাবিলে নবীন’। প্রশ্ন হতে পারে চিহ্নের আলোচনার সাথে এই পিরীতির প্রাসঙ্গিকতা কী। কার কার মধ্যে এই পরাণ পিরীতি? ভাবনার দ্বারা সে পিরীতি আবার কিভাবে নবীন বা নতুন হতে পারে? ইতিপূর্বে যে আলোচনা আমরা করেছি তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই পিরীতি চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের পিরীতি। আর এই পিরীতের ফসল চিহ্ন। কিন্তু ভাবিলে তা কি করে নবীন হবে? হবে, যদি তা নতুন অর্থ প্রদান করতে পারে। আর তা সম্ভব কেবল মানুষের ভাবনার জগতেই। তাইতো ‘পরান পিরীতিখানি ভাবিলে নবীন’। ফরাসী তাত্ত্বিক রোলাঁ বার্থের চিহ্নতত্ত্বের আলোচনায় মর্তুজার এই চরণটি বুঝতে সহায়ক হতে পারে।
চিহ্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে সস্যুরের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যাখ্যাতাদের একজন হলেন রোলাঁ বার্থ। তিনি তাঁর Myth Today নামক প্রবন্ধে দেখান যে, যেকোনো চিহ্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেই চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের মধ্যে একটি প্রণয় বা সম্পর্ককে সত্য বলে ধরে নিতে হয়। ভাষার ক্ষেত্রে ধ্বনি চিত্র (sound-image) এবং ধারণার (চিহ্নায়িত) এই ‘কাঠামোগত সম্পর্ক’ (structural relationship) বা পিরীতিই সস্যুরের ভাষায় ‘ভাষিক’ চিহ্ন নির্মাণ করে। অভাষিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে, রোলাঁ বার্থ বলেন, এই চিহ্নায়ক এবং চিহ্নায়িতের ‘সম্পৃক্ত সমগ্র’ বা মিলন জন্ম দেয় কেবল ‘চিহ্ন’।
এক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ হিসাবে এক গুচ্ছ গোলাপ এর কথা ভাবতে পারি। প্রেমাবেগ বুঝাতে ইহা ব্যবহার করা যায়। এখানে গোলাপ গুচ্ছ চিহ্নায়ক এবং প্রেমাবেগ চিহ্নায়িত। এই দুইয়ের মিলন (‘সম্পৃক্ত সমগ্র’) তৃতীয় পরিভাষার জন্ম দেয়। তখন গোলাপ গুচ্ছ চিহ্ন হয়। এ পর্যায়ে ইহা বুঝা খুবই জরুরি যে চিহ্ন হিশাবে গোলাপ গুচ্ছ তখন চিহ্নায়ক হিশাবে গোলাপ গুচ্ছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দুইয়ের মিলনে সৃষ্ট সত্তা। চিহ্নায়ক হিশাবে গোলাপ গুচ্ছ শূন্যগর্ভ/খালি। চিহ্ন হিশাবে তা পূর্ণগর্ভ/ভরা। আর খালি চিহ্নায়ককে (চিহ্নায়ন দিয়ে) পূর্ণ করতে তিনটি বিষয় মিলিতভাবে সহায়তা করে: এগুলো হল (ক) আমার উদ্দেশ্য, (খ) সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন রূপ-প্রকৃতি এবং (গ) বিভিন্ন মাধ্যম (channels) যা আমাকে এই উদ্দেশ্য সাধনে বেশ কিছু বাহন দান করে। এর বিস্তৃতি ব্যাপক কিন্তু প্রথাগত। আর তাই তা সসীম। ইহা চিহ্নায়ন পদ্ধতির এক জটিল বিন্যাস প্রদান করে:
…take a black pebble: I can make it signify in several ways, it is a mere signifier; but if I weigh it with a definite signified (a death sentence, for instance, in an anonymous vote), it will become a sign. (Mythologies, p113)
[..... ধরা যাক একটি কালো নুড়ি পাথরের কথা। আমি ইহাকে বিভিন্নভাবে চিহ্নায়ন কাজে ব্যবহার করতে পারি। ইহা একটি চিহ্নায়ক; কিন্তু আমি যদি ইহাকে কোনো নির্দিষ্ট চিহ্নায়িত (যেমন বিরাট সমর্থনে মৃত্যুদণ্ড) দিয়ে সমৃদ্ধ করি তখন তা চিহ্ন হয়ে যাবে।]
যাই হোক, চিহ্নায়ণ প্রক্রিয়া এখানেই শেষ হয়ে যায় না। সমাজে মিথ কিভাবে চিহ্নায়ন কাজ করে বার্থ তাও দেখাতে চেষ্টা করেছেন। আর মিথ বলতে তিনি ধ্রুপদী পুরাণতত্ত্বকে যতটা না বুঝান তার চেয়ে বেশি বুঝান চিত্র এবং বিশ্বাসের সেই জটিল বিন্যাসকে যা সমাজ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এবং নিজের সত্তাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নির্মাণ করে। অর্থাৎ মিথ বলতে তিনি সমাজের অর্থ-বিন্যাস-কাঠামোকে বুঝান।
তার মতে মিথের ক্ষেত্রে আমরা উপরে বর্ণিত ত্রিপক্ষীয় চিহ্নায়ন ক্রিয়া পাই: চিহ্নায়ক, চিহ্নায়িত এবং তাদের উৎপাদ চিহ্ন। আর মিথের স্বাতন্ত্র্য এখানে যে, ইহা সবসময় দ্বিতীয় স্তরের চিহ্নতাত্ত্বিক বিন্যাস হিশাবে কাজ করে। যে বিন্যাস এর আগে বিদ্যমান চিহ্ন ক্রম এর ভিত্তিতে নির্মিত। অর্থাৎ প্রথম বিন্যাসে যা চিহ্নের (অর্থাৎ চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের ‘সম্পৃক্ত সমগ্র’ বা মিলন) মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল দ্বিতীয় বিন্যাসে তা কেবলই এক চিহ্নায়কে পরিণত হয়। এভাবে ভাষা প্রাথমিক চিহ্নায়নের জন্য নমুনা সরবরাহ করে (যেমন গোলাপগুচ্ছ-এর ক্ষেত্রে), কিন্তু দ্বিতীয় স্তরের (অথবা পৌরাণিক) চিহ্নায়নের নমুনা অতটা সরল নয় আরও জটিল:
Everything happens as if myth sifted the formal system of the first significations sideways. As this lateral shift is essential for the analysis of myth, I shall represent it in the following way, it being understood, of course, that the specialization of the pattern is here only a metaphor (সবকিছু এমনভাবে ঘটে যেন পুরাণ প্রথম চিহ্নায়ণসমূহের আনুষ্ঠানিক বিন্যাসকে পাশে সরিয়ে রাখে। যেহেতু পুরাণ বিশ্লেষণে এই নতুন বা নবীন পরিবর্তন অত্যাবশ্যক, আমি ইহাকে নিরূপে পেশ করব, অবশ্যই এটা বুঝে নিয়েই যে নকশাটির অবস্থান এখানে কেবলই রূপক):
১. চিহ্নায়ক |
২. চিহ্নায়িত |
|
৩. চিহ্ন 1©. চিহ্নায়ক |
2©. চিহ্নায়িত |
|
3©. চিহ্ন |
(Mythologies, পৃ. ১১৫)
অন্য কথায় পুরাণ বা সমাজের অর্থ-বিন্যাস-কাঠামো কাজ করে পূর্বে প্রতিষ্ঠিত চিহ্ন (যা চিহ্নায়নে ‘পূর্ণ’) নিয়ে এবং পরে তাকে খালি করে শূন্য চিহ্নায়কে পরিণত করে। অর্থাৎ অর্থ নির্মাণের এই ধামালী খেলায় চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িতের পিরীতে জাত চিহ্ন আমাদের ভাবনার জগতে প্রতিনিয়ত নবীন চিহ্নায়কে রূপান্তরিত হয় এবং নতুন নতুন চিহ্নায়িতকে নির্দেশ করে নতুন নতুন অর্থ তৈরি করে। আর এজন্যই সৈয়দ মর্তুজা বলেন, ‘পরান পিরীতিখানি ভাবিলে নবীন’।
লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)