‘সকলে আমার মধ্যে আছে, আমি সকলের মধ্যে আছি।’ আহমদ ছফা

ব্যক্তির নাম, রাজনীতি এবং ইতিহাস নিয়ে আমি এখানে লিখব। আহমদ ছফার ওপর নয়। কিন্তু তার নাম আসবে। তাকে নজির হিশাবে নেবো। ছফা বেঁচে থাকলে তাকে নজির হিশাবে ব্যবহার করছি দেখলে সে বিলকুল খেপত। খিস্তিখেউড়ের অভ্যাস ছিল তার। কী বলত তার এক ঘণ্টার একটা ফিরিস্তি আমি এখনই দিতে পারি। তার ঘনিষ্ঠজনরা একা থাকলে এই আনন্দটি সে পুরোমাত্রায় উপভোগ করত। তবে সত্যি যে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের ধোপদুরস্ত করে দেবার চর্চা করে সে নিজেকে প্রকট প্রতিকূলতার মধ্যে প্রকৃতিস্থ রাখার চেষ্টা করত। আগে কার সামনে কী বলত খুব একটা বাছবিচার করত না। কিন্তু এক সময় সে নিজেই বুঝত তুমুল অট্টহাসি ও অবিনাশী মশকরায় ছাদ ফাটিয়ে দেবার সমাজ এটা নয়। এই সমাজের আড্ডা পরচর্চার অধিক এগোয় না। বড়োজোর দলা পাকায় চক্রান্তে আর ষড়যন্ত্রে। বয়স যখন তার খানিকটা বাড়ল তখন প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে তার এই প্রতিভাটুকুর চর্চা করে সে নির্মল শিশুর আনন্দ উপভোগ করত। তেমনি বন্ধুদেরও ছাড় দিত খুব কম। ওতে আজ অবধি তার সত্যিকারের বন্ধুদের সঙ্গে কোনো মনোমালিন্য হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কেউ তার আড্ডার খিস্তিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করছে টের পেলে তাকে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে দিত না। ফরাসি দার্শনিক রঁলা বার্থ কোথায় বুঝি ত্রিক্রয়েটিভ মানুষদের খিস্তিখেউড় সর্ম্পকে কিছু একটা মন্তব্য করেছিলেন। ওর দ্বারা ছফার উৎসাহিত হবার কোনো প্রমাণ পাইনি। ফরাসি দর্শন কেন, পশ্চিমের কোনো জ্ঞানকান্ডের প্রতি তার অভিভূত ভাব কখনোই ছিল না। নিজের জ্ঞানমন্ডল ও বিচারশক্তির ওপর তার ঈমান ছিল পাথরের মতো মজবুত। তবুও, চিন্তার নতুন দিগন্তের খিলগুলো সহজে না খুললে হাতুড়ি পিটিয়ে উন্মুক্ত করা যেমন, চিন্তাশীলের খিস্তি কি সেইরকমই? কে জানে? মগর কবরে উঠে বসে সে আমার সাতপুরুষ উদ্ধার করলেও আমি তাকে নজির হিসেবে গ্রহণ না করে উপায় দেখছি না।

আমার প্রধান প্রস্তাব : আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি এমনকি জীবনযাপনের নজির সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যক্তি আহমদ ছফা এবং তার লেখালিখি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করে যাদের লেখালিখি ও কর্মকান্ডের চেয়েও খোদ মানুষটিই বড়ো হয়ে ওঠে। আহমদ ছফা সেই মানুষদেরই একটা নজির। তার লেখালিখি ও কর্মকান্ডের একটা বিচার নিশ্চয়ই মানুষ করবে, কিন্তু আমার অনুমান তার নামটা হয়ে উঠবে পাতাকুড়ুনি মেয়েদের পাতার বস্তার মতো। যেখানে এই নাম আশ্রয় করে বাংলাদেশের আগামী দিনের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অপরাপর তৎপরতা একটা শক্তি হিশাবে সংগৃহীত হতে থাকবে এবং ত্রমাগত নিত্যনতুন অর্থোৎপাদন করবে। ছফা বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির একটি শক্তিশালী প্রবণতার ধারক এবং বাহক। আগামী দিনে সেই ধারারই বিকাশ ঘটবে এবং কাজেকাজেই তার নামের তাৎপর্যও ক্রমশ পরিচ্ছন্ন হতে থাকবে।

তার নাম বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবিতার ইতিহাসে উচ্চারিত হবে, বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেটা আমার প্রস্তাব মোটেও নয়। তার নামের পাতাকুড়ানি মাধুর্য সরাসরি তার লেখা থেকে আসবে, এই দাবিও আমি করছি না। মুশকিল হলো, আহমদ ছফার লেখা সরল ও সুখপাঠ্য। কিন্তু যে সকল সিদ্ধান্ত ও জ্ঞানকান্ড অনুমান করে নিয়ে তিনি লেখেন সেটা অধিকাংশ সময়ই মৌলিক, ফলে তাকে পড়া যত আরামের,পাঠ করা ঠিক সেই পরিমাণই কামলাগিরির— পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের। তার পুরো রাজনীতি, জীবনাচরণ ও কর্মকান্ড সর্ম্পকে সম্যক ধারণা না থাকলে তার রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তাকে পেশ করা বিপজ্জনক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা এবং একটি জনগোষ্ঠীর বিকাশের সমস্যা তিনি নানাদিক থেকে ভেবেছেন। সেই ভাবনার মধ্যে সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সৃষ্টিশীল ও প্রায়োগিক দুটো দিকই তার মন অধিকার করে রাখত। তাঁর রচনা মাত্রই রাজনৈতিক। সেটা উপন্যাসই হোক, কিংবা হোক কবিতা বা প্রবন্ধ। সাহিত্যিক শখে তিনি ফাউস্ট অনুবাদ করতে বসেননি। গ্যেটে তার রচনা দিয়ে একটি ভাবুক কিন্তু সুশৃঙ্খল জাতির বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছিলেন। এই প্রকার ভবিষ্যৎ নির্মাণের বাসনা আহমদ ছফার মধ্যে ষোলো আনা বর্তমান ছিল। কী করে এই বাসনাকে তিনি নিজের জীবনাচরণে ও লেখালিখিতে রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন? কী ছিল আমাদের ‘জাতি ভাবনা?’, রাষ্ট্রচিন্তা? ‘বাঙালি মুসলমান’ নামক ধারণাটির অর্থ ও তাৎপর্য কী? এমন নয় যে এইসব প্রশ্নের উত্তর ছফা দিয়ে ফেলেছেন, তাকে কোট করলেই ল্যাঠা চুকে। এইসকল নানান প্রশ্ন আমাদের ভবিষ্যতে ভাবাবে। ফলে তার নাম আশ্রয় করে আমাদের ঝোলায় আরও অনেক সংগ্রহ বাড়তে থাকবে। অনেক ঝাড়াপোঁছার কাজ এখনও বাকি আছে আমাদের। তার গৌরব ওখানেই যে তিনি এমন একটা অবস্থা তৈরি করে দিয়ে গেছেন যে এইসকল প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে আমাদের আর গত্যন্তর নেই। তার আবির্ভাব ও তিরোভাবের মধ্য দিয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে বাগাড়ম্বর টাল্টিবাল্টি বকোয়াজগিরি অসম্ভব হয়ে উঠবে। এই অর্থেই তার নামের পাতাকুড়ানি ভূমিকার কথা তুলেছি।

এমনকি তার খুচরো মন্তব্যগুলোও রাজনৈতিক-দার্শনিক দিক থেকে বিপদে ফেলে দেয়। তার তরুণ বয়েসের বিপ্লবী শ্লোগান ছিল,‘বৃষ্টি আসলে সব কিছুই ভিজে যায়’। বিপ্লবী, বিপ্লববিরোধী, অ-বিপ্লবী প্রত্যেকেই ‘ভিজে’ যায়। বিপ্লব প্রত্যেকেরই মুক্তি আনে। এর সঙ্গে কি মার্কসের কথা মেলানো যায়? সর্বহারা শ্রেণী শুধু যে তার বিপক্ষ শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটায় তা-ই নয়, তার নিজ শ্রেণীসহ সকল শ্রেণীর বিলয় নিশ্চিত করে। বিপ্লব সকল শ্রেণীর মুক্তির জন্য, শুধু সর্বহারার মুক্তি নয়। সশস্ত্র সংগ্রামের ঘোর ঝনঝনানি ও হিংসার যুগে ছফাকে কথা বলতে হয়েছে কাব্যের ভাষায়, কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের ফলাফল সর্ম্পর্কে হুঁশ বজায় রেখে। তা হলে কর্তব্য কী? কর্তব্য হচ্ছে মেঘ ও বাষ্প তৈরি করা-- অর্থাৎ সেই সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক শর্ত তৈরি করা যাতে ‘বৃষ্টি’ অর্থাৎ বিপ্লব সম্ভব হতে পারে। ছফা গান্ধীবাদী ছিল না, কিন্তু সহিংসতার পক্ষালম্বীও ছিল না। তার বিপ্লবী তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে থেকে এতটুকু সে অনায়াসেই আমল করেছিল যে হিংসা বাস্তব, শ্রেণীসংগ্রাম সত্য। অতএব ‘অহিংস’ হওয়া অবাস্তব, রোমান্টিক প্রস্তাব। বাংলাদেশের সশস্ত্র যুদ্ধে এই বোধ তার আরও দৃঢ় হয়েছে। বিদ্যমান শ্রেণী হিংসার যারা শিকার ‘অহিংসবাদ’ সেই নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে বেইমানি করে। কারণ একদিকে তা হিংসাকে মেনে নেবার ‘নৈতিকতা’ তৈরি করে অন্যদিকে হিংসার বিরুদ্ধে নির্যাতিত যখন রুখে দাঁড়ায় তখন তাকে নিন্দার শর্তও তৈরি করে রাখে।

অন্যদিকে হিংসাবাদীদের সঙ্গেও ছফার সায় ছিল না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টি বা অন্যান্য বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে এখানেও তার বিরোধ ছিল প্রকট। গান্ধীর সমালোচক ছিল সে অবশ্যই, কিন্তু গান্ধীর সঙ্গে সে পুরোমাত্রায় একমত ছিল যে বিপ্লবের প্রক্রিয়া বিপ্লবের ফলাফলের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে-প্রক্রিয়ায় বিপ্লব সাধিত হয় সেই প্রক্রিয়ার ছাপ থেকে যায় ফলাফলে, বিপ্লবের পরিণতিতে। হিংসা বর্তমানের বাস্তবতা নিঃসন্দেহে, কিন্তু ভবিষ্যতের লক্ষ্য তো হিংসার অধিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠা নয়, বরং তার বিলুপ্তি। যদি বিপ্লবের প্রক্রিয়া-- অর্থাৎ রণনীতি ও রণকৌশলের মধ্যে এই সত্য হাড়েমজ্জায় হাজির না থাকে তা হলে সমুহ বিপদের সম্ভাবনা। মানুষ হিংসুক হয়, দাঙ্গাহাঙ্গামা করে, যুদ্ধবিগ্রহ করে। কিন্তু সেটা তার স্বভাব নয়, মানুষ মাত্রই হিংসুক হতে পারে না, অসম্ভব। তা হলে তো ভবিষ্যৎ নির্মাণের ধারণাটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিপ্লব মানুষের মুক্তি আনে কথাটির অর্থ হতে পারে মনুষ্য-স্বভাবের অফুরন্ত সম্ভাবনা বাস্তবায়নের শর্ত তৈরি করতে পারে বিপ্লব। যদি হিংসাই বৈপ্লবিক রূপান্তরের একমাত্র পথ, প্রকরণ ও পদ্ধতি হয়, তাহলে সেই সম্ভাবনাও সীমিত ও সংকীর্ণ হয়ে যেতে বাধ্য। ছফা বিপ্লবী, মনেপ্রাণে সে সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর চাইত। কিন্তু বিপ্লব নামক ধারণার মধ্যে যে-সহিংসার ইঙ্গিত আছে, সেটা একদমই তার পছন্দ ছিল না। কেন? কারণ বৈপ্লবিক ফলাফলের মধ্যে যে সজল-মাধুর্য আস্বাদনের আকাঙ্খা ও প্রতিশ্র“তি তার সঙ্গে বিপ্লবের সহিংস ভাবমূর্তি তার কাছে ছিল রাষ্ট্রবিরোধী এবং অসংগত। গান্ধীর কাছ থেকে প্রতিত্রিক্রয়াশীল শ্রেণীগুলো ‘অহিংসাবাদ’ গ্রহণ করেছে। আহমদ ছফা গ্রহণ করেছে তার প্রায়োগিক তাৎপর্য। কার্ল মার্কসের কাছ থেকে বিপ্লবীরা ‘হিংসা’ ইতিহাসের ধাত্রী— এই শিক্ষাটাই গ্রহণ করেছে, কিন্তু ছফা গ্রহণ করেছে মার্কসের মানবেতিহাসের আনন্দময় প্রতিশ্রুতি। সেই দিন যখন আসবে তখন বাংলাদেশে শ্রাবণের মতো অঝোর ধারায় শুধু বৃষ্টি হবে এবং সব কিছুই ভিজে যাবে। বিপ্লব ও বৃষ্টির মধ্যে এই পার্থক্য নিছকই কাব্যিক জ্ঞান করলে তার রাজনৈতিক-দার্শনিক অনুমান ও জ্ঞানকান্ডগুলো কখনোই নজরে পড়বে না। এই কারণেই বলেছি, আহমদ ছফা হয়তো পাতাকুড়ানিয়া নাম হয়ে উঠবে। তার নামকে কেন্দ্র করে যেসব লেখালিখি ও কর্মকান্ড সেইসব নানা অর্থ তৈরি করতে থাকবে। এখানেই তার সঙ্গে অন্যদের প্রধান পার্থক্য ঘটবে বলে আমার অনুমান।

আহমদ ছফাকে নিছকই সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী হিশাবে গণনা করলে মারাত্মক গলতি হবার সম্ভাবনা। তার জীবনযাপন, সামাজিকতা, লেখালিখি, রাজনীতি, তরুণদের দুর্দান্ত প্রেরণায় উজ্জীবিত করার ক্ষমতা— ইত্যাদি  মিলিয়ে তার তাৎপর্য অন্যরকম। তার সাহিত্য ও অপরাপর চর্চা তার মহান ব্যক্তিত্বের গৌণ দিক, প্রধান দিক নয়। আহমদ ছফা অন্য জিনিশ। আহমদ ছফা বাংলাদেশে একটি ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস আহমদ ছফা-নামক ঘটনাটি ঘটে যাবার পর বাংলাদেশ আর আগের মতো থাকবে না। আমার এই কথা বন্ধুর প্রতি অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে। সেই কারণে এখানে নিজের তরফে কিছু যুক্তি আমাকে পেশ করতে হবে। প্রথমেই বলি, আহমদ ছফা তিরিশ দশকীয় সাহিত্যের প্রডাক্ট নন। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক কলকাতায় সাহিত্যসর্বস্ব কেরানিমার্কা লেখালিখির যে ধারা, ছফা সেই ধারার মানুষ নন। এই কালের বাংলা ভাষার বাইরের জাঁকজমকে সে অভিহিত হয়নি, সুধীন দত্ত বা বুদ্ধদেব বসুকে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে সে অচিরে টের পেয়েছিল এগুলো ঠুনকো জিনিস। ওসব দিয়ে আনন্দবাজার-সানন্দা মার্কা ব্যবসা চালানো যায় কিন্তু ভেতরে খাঁটি মাল কিছু নেই বললেই চলে। অন্তঃসারশুন্য। এই কথাটা যত সহজে এখন বলা যাচ্ছে ষাট দশকে তার সংস্পর্শে আসা তরুণদের ‘আধুনিক’ হবার দাপটে বলা যেত না। ধরতে পারাও কঠিন ছিল।

একমাত্র কবি ও বিপ্লবী হুমায়ুন কবীর ছাড়া ছফাকে সেই সময় বুঝতে পারে বা কোনোভাবে বুঝেছিল— এই স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। কারণ হুমায়ুন ইতিহাস তৈরি করতে চেয়েছিল। মত, পথ ও প্রকরণের ভেদ থাকলেও সেখানে ছফার সঙ্গে তার একটা আন্তরিক মিল ছিল অবশ্যই। দুজনেই ইতিহাসে নিজেদের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে সজ্ঞান ছিল। সেই দিক থেকে দুই জনেই ছিলেন মাঝি ও সচেতন কারবারি। ফলে পরস্পরকে বোঝার একটি সাধারণ পাটাতন ছিল, যেখানে দুজনের মোলাকাত সব সময়ই সম্ভব। হুমায়ুন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী, মাও জে দংয়ের অনুরাগী ও অনুশীলনে বিশ্বাসী। ছফা খানিকটা বুর্জোয়া নবজাগরণের সাধক, সমালোচকও। রেনেসাঁপন্থী, ইউরোপে কী করে শিল্পবিপ্লব ঘটল এবং একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠী বিকশিত হল ছফা সেটা জানতে চায় বুঝতে চায়। কেন লেনিন শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লবের এজেন্সি দিয়েছিলেন, তাদেরকেই শ্রেণীগতভাবে কর্তাশক্তি গণ্য করেছিলেন সেটা জানার জন্য তার আকুতি ছিল তীব্র। তার গুরু আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে সেই পাঠ নিতে সে উদ্গ্রীব। মাও জে দংয়ের চিন্তাধারা তাকে হুমায়ুনের মতো আপ্লুত করেনি। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক যখন তাকে লেনিনের রাশিয়ায় পুঁজিতন্ত্রের বিকাশ বইটি পড়ে তার কাছে সারসংক্ষেপ করে দেওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন ছফা দৈনিক সাত আট ঘণ্টা কাজ করে কাজটি ঠিকই করল। যদি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কী বলা উচিত সেই দায়িত্ব তাকে মাথায় নিতে হয় তা হলে রাশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে লেনিন আসলে কী বলেছেন সেটা তো তাকে জানতেই হবে। নিজের সেই সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ছফা লিখেছে,‘লেনিনের অন্ততৃষ্টি আমাকে বিস্ময়াবিস্ট করে তুলেছিল।’ কেন সে এত বিস্মিত হয়েছিল তার একটা নজির দিয়েছে ছফা, তার যদ্যপি আমার গুরু বইটিতে। লিখেছে :লেনিন সাহেব দেখিয়েছেন বৃহৎ জোতের জমি চাষের প্রচলন শুরু হওয়ার পরে উন্নত জাতের ঘোড়া জমি চষার কাজে ব্যবহার হওয়ার কারণে উৎকৃষ্ট অশ^ প্রজননের ধুম পড়ে যায়। ভালো জাতের ঘোড়ার প্রজনন বৃদ্ধির জন্য ঘোড়ার বৈদ্য নামক একটি অর্থনৈতিক শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, সেই জিনিসটি [লেনিন] উল্লেখ করতে ভুল করেননি।

ইতিহাসের সঙ্গে আর্থসামাজিক গতিপ্রকৃতির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক সম্বন্ধে তার ধারণা এর পর থেকে সবসময়ই ছিল পাকা। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সে টের পেয়েছিল যে সকলেই তো লেনিন হয় না। তা হলে জ্ঞান বিচারের এই অন্তদৃষ্টিটা কোথা থেকে আসে? একে তো অর্থনৈতিক বিচারের বিষয় জ্ঞান করলে চুনকে দই বলে ভুল করার দোষ ঘটে যায়। তা হলে বৈপ্লবিক অন্তদৃষ্টিটা আসলে কী জিনিস? এই প্রশ্ন তার তরুণ বয়েসেই মনে গেঁথে গিয়েছিল। ফলে যান্ত্রিক বস্তুবাদ বা শ্লোগানসর্বস্ব বিপ্লবী কর্মকান্ডকে সে সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করতে পেরেছে। কিন্তু কেন লেনিন রুশদেশের বাস্তবতায় শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবের কথা বলেছেন তার ব্যাখ্যাটি সে বুঝে নিয়েছে ভালো করে। এটাও হয়তো বুঝেছিল যে বাংলাদেশে রুশ বা চীনের অনুকরণে বিপ্লবের ধারণা পন্ডশ্রম মাত্র।

তখন বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারা বাংলাদেশে সামান্ততান্ত্রিক প্রধান নাকি পুঁজিতান্ত্রিক— এই বিতর্ক করছে। ছফা তখন বিদেশী কারো বিচার বা সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়নি। এমনকি মার্কসেরও নয়। বরং মনোযোগ দিয়ে শুনেছে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সিদ্ধান্ত। ছফা রাজ্জাক স্যারের বাচনভঙ্গি ধারণ করে এই বিষয়ে তার বক্তব্য লিখছে :ইন দ্য স্ট্রিকেস্ট সেন্স অব দ্যা টার্ম ইন্ডিয়াতে কোনো ফিউডালিজম আছিল না। বেঙ্গলের কথা তো এক্কেরে আলাদা। বেঙ্গলের কথায় পরে আইতাছি। তার আগে রেস্ট অভ দি ইন্ডিয়ার খবর লই। ফিউডালিজম হইল একটা ক্লোজড সিস্টেম। বংশপরম্পরায় একটি পরিবার স্থায়ী অইয়া একটা জায়গায় বাস করব। তার ধোপা, নাপিত, কামার, কুমার সব আলাদা। এক জায়গার মানুষ অন্য জায়গায় যাইবার পারব না। কাঁঠালের যেমন কোয়া ফিউডাল সিস্টেমে সামন্তের জমির সঙ্গে সকলের তেমন সম্পর্ক... আর যদি বেঙ্গলের কথায় আইয়েন, তাইলে এক্কেরে অন্য কথা বলতে অয়। পুরানা বাংলা পুঁথিতে দেখা যায় বাংলার বাণিজ্যবহর জাভা, সুমাত্রা এই সকল অঞ্চলে যাওয়া-আসা করছে। যেখানে বাণিজ্য এই রকম সচল থাকে সেই সমাজটারে অন্য যা ইচ্ছা কইবার চান কন, কিন্তু ফিউডালিজম বলবার পারব না। ভিটফোগেলের হাইড্রোফিক থিয়োরি বেঙ্গলের বেলায় এক্কেরে খাটে না।

আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যের সঙ্গে তার আক্ষরিক সায় ছিল কি না সেটা সে কোথাও উল্লেখ করেনি। ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুদের কাছে তার অবস্থান ছিল এই রকম যে, বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতি এই তর্কটিকে কখনোই আন্তরিকতার সঙ্গে করেনি। এই তর্কটি করবার জন্য লেনিনের যে মেধা ও পরিশ্রমের প্রয়োজন ছিল সেটা অর্জন করবার জন্য বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতি কখনোই সচেষ্ট ছিল না। এই তর্কের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব প্রগতিশীল রাজনীতি কখনোই বোঝেনি। একটা কিছু বলা দরকার বা বলতে হবে, যেন তার জন্যই বলা, ব্যস। তারপর কেউ হার্মোনিয়াম বাজাতে ভালোবেসেছে, বাজিয়েছে। কেউ রাজপথে শ্লোগান হাঁকতে পুলকিত বোধ করেছে, রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছে। কেউ ছেলেবেলায় বাপ-মায়ের কাছ থেকে খেলনা উপহার না পাবার অভাবে বন্দুক দিয়ে খেলতে নেমে নিজের প্রাণ দিয়ে শৈশবের অভাব মিটিয়েছে। কিন্তু এগুলাম কই? জ্ঞানচর্চা ও বিচার ছাড়া কি কোনো জনগোষ্ঠীর বিকাশ সম্ভব? বাষ্প আর মেঘ আর তৈরি করা গেল না,দিন গেল ভয়াবহ দাবদাহে আর খরায়।

সেই সময়ে হুমায়ুন ছফাকে বুঝতে পারত, তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছি। কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা না বললে কথাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ইলিয়াস ইচ্ছে করলে ষাট দশকের ছফাকে বুঝতে পারত। কিন্তু যতদূর জানি ইলিয়াসের সঙ্গে সেই সময় তার কোনো আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। কিন্তু উভয়ের একটা পার্থক্যও ছিল। সেটা হয়তো পরের লেখাগুলোতে খানিক আসবে। কিন্তু সেটা এখন আমার আলোচনার বিষয় নয়। ছফার আলোচনায় আমি হুমায়ুন কবির ও ইলিয়াসকে বারবার টেনে আনছি এই কারণে যে, আমি মনে করি ষাট দশকে যে-চিন্তা, রাজনীতি ও চর্চার উন্মেষ ঘটেছিল তার গোড়ায় এই তিনজনের নাম আসতে বাধ্য। বাংলাদেশে যেখানে সাহিত্য, প্রজ্ঞার চর্চা ও রাজনীতি হাত ধরাধরি করে চলেছে সেখানে শুধু এই তিনজনকেই দন্ডায়মান দেখি। আর কাউকে তো দেখি না।

মনে রাখা দরকার ষাট দশকের কথা বলছি। তখন সমকাল, কণ্ঠস্বর আর ‘হাংরি জেনারেশনে’র যুগ। ছফার বিপরীতে ইলিয়াস ত্রিশের তৈরি। কিছুটা সমকাল এবং তারও বেশি কণ্ঠস্বর আর হাংরি-জেনারেশন ধরনের আন্দোলনে ইলিয়াসের সায় ছিল পুরোমাত্রায়। গদ্যে ও কবিতার ভাষায় পরাবাস্তবতা চর্চার জ্বর ততক্ষণে একশ তিন ডিগ্রি পেরিয়ে গিয়েছে। তখন কেউ গ্রাম্য, পশ্চাৎপদ, কথা বলতে জানে না, আধা-তোতলা আহমদ ছফাকে পাত্তা দেবে কেন? ছফার লেখালিখি তো ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না। তার চেহারা, পোশাক-আশাক, কথা বলার ধরন নিয়ে হাসাহাসি-তামাশার অন্ত ছিল না। নামও ছিল ‘ছফা’। এই নাম নিয়েও তাকে কম বিড়ম্বনা সইতে হয়নি। এ কেমন নাম? কেমনই-বা বানান? প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাপের দেওয়া নাম বদলাল, প্রত্যেকের নামের বানানের মধ্যে ‘আধুনিকতা’ জ্বলজ্বল করতে লাগল। কিন্তু ছফার নাম আর বদলাল না। আহমদ ছফা আধুনিক বা স্মার্ট হবার লোভে কাতর হল না। সে টের পেয়ে গিয়েছিল ত্রিশ দশকীয় আধুনিকতা তার সাধনার বিষয় নয়, বরং তার বাসনা সে বিদ্যাসাগর হবে। বুদ্ধদেব বসুর শার্ল বোদলেয়ার নামক কলকাত্তাইয়া চরিত্রের অনুসরণে বেশ্যাবাড়ি যাওয়া আর মদ খাওয়া ছিল তখন আধুনিকতা। বুদ্ধদেবের বোদলেয়ারকে কলকাত্তাইয়া বলছি কারণ ওর সঙ্গে আসল বোদলেয়ারের মিল খুব সামান্যই। এমনকি অনুবাদের সাড়ে পনেরো আনা বুদ্ধদেব বসুর নিজের মৌলিক সৃষ্টি সেখানেই হয়তো বুদ্ধদেবের সার্থকতা। কবি-সাহিত্যিকরা যখন রেক্স রেস্তোরাঁর আড্ডায় আর মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটের বাংলা দোকানে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, চন্দনাইশের গ্রাম আর গাছবাড়িয়া থেকে পাশ করা ল্যাবরধ্যাবর ছফা তখন রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসুদের সময়কাল গভীরভাবে অধ্যয়নে রত। মাও জে দংয়ের লাল বইয়ের কদরও তখন বাড়ছে। কিন্তু ছফার কাছে মহান চীন বিপ্লবের তুলনায় বইয়ের শ্লোগান কম আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। সে তখন বোঝার চেষ্টা করছে হিন্দু নবজাগরণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি কী? কী করে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মপরিচয়ের চেতনা জাগল। হঠাৎ তো জাগেনি। কীভাবে সেটা জাগল? সেই জাগরণের পেছনে ব্যক্তির ভূমিকাটা কী? কী ভূমিকা ছিল সাহিত্যের, সংস্কৃতির, লেখালিখির?

মদ খাওয়া আর টাকা দিয়ে মেয়েমানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করা মন্দ কি ভালো সেই নৈতিক বিতর্কের জন্য এখানে এই প্রসঙ্গটি তুলিনি। ষাট দশকে সাহিত্য ও ‘আধুনিকতা’-সংক্রান্ত ধারণা নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যক্তিজীবনের স্বেচ্ছাচারের মহিমা কীর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যারা এই স্বেচ্ছাচারকেই ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠা বলে গণ্য করেছেন, তারা পুরোটা ভুল করেছেন বলা যাবে না। যে-দেশে রাজনৈতিক দিক থেকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি, সেখানে নিজের সার্বভৌমত্ব আর স্বাধীনতা আস্বাদনের আর কী পথ থাকতে পারে? মদ না খেয়ে আর বেশ্যাবাড়ি না গিয়ে অপরিণত ব্যক্তির পক্ষে আর কীভাবে নিজের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ অনুধাবন সম্ভব? পুরনো ও পশ্চাৎপদ সমাজে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার স্বাদ মদ খেয়ে আর মেয়েমানুষের সঙ্গে স্বাধীন সম্পর্ক নির্মাণ ছাড়া অসম্ভব এই কথা বলছি না। তাকে কাব্যে এবং সহিত্যাদর্শে নিয়ে আসাটা দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়া আর কীভাবে আধাখেঁচড়া ব্যক্তিতান্ত্রিক সাহিত্যিক ব্যক্তির মহিমা প্রচার করতে পারে? ষাট দশকে এটাই প্রধান ধারা। চরম অরাজনৈতিক ও প্রতিক্রিয়াশীল এই ধারাটিই স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে রাতারাতি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হয়ে গিয়ে রাজনৈতিক হয়ে গেল। সাহিত্য, সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতিতেও যারা স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে ব্যক্তির মহিমা কীর্তন করেছেন তারা কেউই কিন্তু শহরের নাগরিক নন। তাদের অধিকাংশই ছফার মতো গ্রাম থেকে শহরে আসা। অনেকে নিজের জবানিতে লিখিতভাবে তাদের স্বেচ্ছাচারের বর্ণনাও দিয়েছেন। এই ধারার বিপরীতে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে আরেকটি শক্তিশালী ধারা ছিল, আহমদ ছফা যার শিরোমণি। সেই ধারা ব্যক্তির মুক্তি আস্বাদন করতে চায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মুক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মুক্তির সম্পর্ক বিচার করতে চায়, সেই সম্পর্কের মহিমা বুঝতে চায়, লক্ষ্য অর্জনে সক্রিয় হতে চায়। তরুণ বয়েসে তার সেই অন্বেষণ অধিকতর পরিণত বয়েসে এসে অসাধারণ প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠেছিল। তার পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ নামক আত্মজৈবনিক বয়ানে ছফা লিখছে :‘একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে।’ এই জ্ঞানবাক্যটি সে পাখির কাছে শিখেছে, বিশেষত সেই পাখিটির কাছে যাকে যে নিজের পুত্রজ্ঞান করত। মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা ও হানাহানি দেখে ছফা আকাশের পাখির জগতে আশ্রয় নিয়ে আবিষ্কার করল সেখানেও হিংস্রতা এবং জাতিবৈরিতার প্রকোপ আছে। ‘সুতরাং’, আহমদ ছফা লিখছে ‘মানুষের মতো কর্তব্য পালন করার জন্য আমার মানুষের কাছে ফিরে না গিয়ে উপায় কি? আমি বৃক্ষ নই, মানুষ। ভালো হোক মন্দ হোক আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মতো মানুষের সমাজে মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে।’

ছফা যখন পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ লিখছিল তখন তার ধারণা ছিল সে একটি ‘পরিবেশবাদী’ উপন্যাস লিখছে। বোধহয় সেইভাবেই সে তার রচনার প্রচার চালাচ্ছিল। পরিবেশবাদিতার দার্শনিক কিংবা রাজনৈতিক কোনো দিক সম্পর্কে ছফার নিজের খুব একটা উৎসাহ কখনোই ছিল না। তার পান্ডুলিপি শুনে ও পড়ে আমি যতবারই তাকে বলেছি তার উপন্যাস পরিবেশবাদী উপন্যাস নয় এবং লেখাটি অসাধারণ হওয়ার জন্য পরিবেশবাদিতার আলখাল্লা পরানো অনাবশ্যক, খামাখা বোঝা— ছফা সবসময়ই মনঃক্ষুন্ন হয়েছে। বইটি প্রকাশের পর আমাকে কোনো কপি দেয়নি। কিন্তু বইটি ছাপা হবার পর আমি নিজে কিনে পড়েছি। পরে অবশ্য নিজেই পাঠিয়েছিল। প্রচ্ছদের প্রচারছত্রে বলা ছিল,‘রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে জীবনবোধের উন্মেষ এবং বিভূতিভূষণের প্রকৃতিনির্ভর রচনাসমুহে জীবনের যে-উপলব্ধির বিকাশ, আহমদ ছফার এ লেখাটি একই গোত্রভুক্ত হয়েও স্বাতন্ত্র্যের দাবি করতে পারে।’

বলা বাহুল্য,‘একই গোত্র’ জ্ঞান করবার এই মূল্যায়ন ঠিক নয়। এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের রচনা। আদৌ উপন্যাস বলা যায় কি না সেই আঙ্গিকগত প্রশ্ন তো আছেই। বাস্তব আর কল্পনার কোনো সীমারেখা মানা হয়নি। তাতে ক্ষতি তো দূরের কথা নগদ লাভ অপরিসীম। অন্যদিকে আমরা ছফার একটি আত্মজীবনী পড়ছি কি না সেই ভুলেও হোঁচট খেতে হয়েছে। পড়বার উত্তেজনায় উন্মাদ হয়ে যাবার জোগাড়। যখন তাকে আমার অসম্ভব ভালো লাগার কথা বললাম, শিশুর মতো খুশি হল অবশ্যই। পরিবেশবাদী উপন্যাস হিশাবে চালাবার জন্য আর জবরদস্তি করল না। মানবজীবনের সঙ্গে বিহঙ্গজীবন আর উদ্ভিদজীবনের ‘অবিচ্ছিন্ন’ সম্পর্কের বয়ান এটি নয়। তা হলে তো ছফা পাখির জগৎ ছেড়ে মানুষ্যজীবনের রঙ্গালয়ে মনুষ্যকর্তব্য সম্পাদনের জন্য আর ফিরে আসতে চাইত না। কিম্বা পাখির জগতে হিংসা-হানাহানি, জাতিবৈরিতা বা শ্রেণীসংগ্রাম দেখত না। এমনই সেই ‘শ্রেণীসংগ্রাম’ যে ছফা লিখছে : একসময় হয়তো এমনও হতে পারে দাঁড়কাকেরা এই শহর থেকে পাতিকাকদের তাড়িয়ে দেবে। বাস্তব জগতের দ্বন্দ্বটাই সে উদ্ভিদ আর পাখির জগতে দেখতে ও আমাদের দেখাতে পেরেছে— এটাই শক্তিধর লেখক হিশাবে তার নিদারুণ মুনশিয়ানা।

ব্যক্তি-স্বেচ্ছাচারিতা বা ব্যক্তিতন্ত্র নিয়ে কথাটা তুলেছিলাম। তার বিপরীতে এখানে দেখছি ব্যক্তি আর ব্যক্তির দায়িত্ব বা ছফার ভাষায় ‘মনুষ্যজীবনের কর্তব্য’ সম্পর্কে অসাধারণ ভাবুকতায় সমৃদ্ধ এই রচনা। দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মুক্তির ধারণা নিহিত রয়েছে। কারণ স্বাধীন ও মুক্ত ব্যক্তির পক্ষেই কেবল অন্য মানুষ, পশু, পাখি, উদ্ভিদ এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য প্রাণী ও অপ্রাণী জগতের দায়িত্ব গ্রহণ করা সম্ভব। বিপরীতে মুক্ত বা স্বাধীনমাত্রই দায়িত্বশীল নয়, মনুষ্যজীবনের কর্তব্য তার আরাধ্য নয়। ফলে তা স্বেচ্ছাচার ও ব্যক্তিতন্ত্রেই শেষ হয়। হতে বাধ্য। সেই জীবন শেষাবধি একাকিত্বের, নৈঃসঙ্গের। কিন্তু আহমদ ছফার কোনো একাত্বিবোধ ছিল না। তাকে কেউ কোনোদিন হতাশ হতে দেখেনি। তার কোনো নৈঃসঙ্গচেতনা ছিল না। একমাত্র মুক্ত ও স্বাধীন ব্যক্তির পক্ষেই এই ঘোষণা দেওয়া সম্ভব যে,‘এই পুষ্প, এই বৃক্ষ, তরুলতা, এই বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে, আমার মধ্যে কোনো একাকিত্ব, কোনো বিচ্ছিন্নতা আমি অনুভব করতে পারিনে। সকলে আমার মধ্যে আছে, আমি সকলের মধ্যে আছি।’

এই বাক্যের গঠনে রাবীন্দ্রিকতা আছে বলে এর সাথে ‘বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেই খানে যোগ তোমার সাথে আমারও’– সমার্থক নয়। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আহমদ ছফা বাংলাদেশে মুক্ত ও স্বাধীন নতুন মানুষের জগতের ঘোষণা দিয়ে গেল, যাদের মানুষ্যজীবনের কর্তব্য পালন করবার জন্য মানুষের করুণ রঙ্গভূমিতে ফিরে আসতেই হবে। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতি ও সংস্কৃতিচর্চার নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত, ইশারা ও অতি আবশ্যকীয় কিছু উপাদান আমাদের জন্য রেখে গেল। বলা বাহুল্য সে লেনিন নয়, মার্কস নয়, মাও জে দংও নয়। নিজেকে সে আউলিয়া বলে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করলেও সে জানত সে আউলিয়াও নয়। সে গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি গ্রামের ছেলে। কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে সে যে উথালপাথাল ধাক্কা দিয়ে গেল তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলি, সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি, বৈপ্লবিক কর্মকান্ড বলি— তার সঙ্গে খোদ একটা বোঝাপড়া না করে কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রসর হওয়া যাবে না।

আমি নিশ্চিত আগামী দিনগুলোতে সেটা আরও পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠবে।

*(লেখাটি কালের খেয়া-তে প্রকাশিত হয়েছিল,  দুই হাজার সাত সনে ছফা’র ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে। এবার আহমদ ছফার সাতষট্টিতম জন্মবার্ষিকীতে আমরা তা আবারো তুলে দিলাম আমাদের পাঠকের জন্য। - সম্পাদক)


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


লেখাটি নিয়ে এখানে আলোচনা করুন -(0)

Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  

View: 12044 Leave comments (0) Bookmark and Share


Go Back To Arts & Culture
EMAIL
PASSWORD