রাষ্ট্রের অখণ্ড চরিত্র বিরোধী ও রাজনৈতিক বিভক্তি সূচক বলে চুক্তি অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন আদালত

শান্তি চুক্তি সহ চুক্তি অনুযায়ী তৈরি করা চারটা আইনের বৈধতা এবং সাংবিধানিক ন্যায্যতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে দুইটা আবেদন (রিট) করা হয়। দুই হাজার সালে প্রথম রিট আবেদনটি দায়ের করেন মোঃ বদিউজ্জামান। দ্বিতীয় আবেদনটি দায়ের করেন দুই হাজার সাত সালে অ্যাডভোকেট মোঃ তাজুল ইসলাম। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক সৈয়দ রিফাত আহমেদ এবং মইনুল ইসলামের বেঞ্চে শুনানি শুরু হয় দুই হাজার নয় সালের বাইশে অক্টোবর। মোট চব্বিশ দিনের শুনানি শেষ হয় দুই হাজার দশ সালের তেইশে মার্চ। রায় দেয়া হয় দুই হাজার দশ সালের বার এবং তের এপ্রিল। পরে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারক হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। সেই থেকে মামলাটি আর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য উপস্থাপিত হয় নাই। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের নানা দিক নিয়ে পুরা আয়োজনটি করেছেন জহিরুল ইসলাম মুসা

পার্বত্য চুক্তি এবং চুক্তি কার্যকর করতে গৃহীত আইনগুলা সম্পর্কে আদালতের নিরীক্ষণ

পার্বত্য চুক্তি এবং ওই চুক্তি কার্যকর করতে গৃহীত আইনগুলা বিচারবিভাগীয় নিরীক্ষণের আওতায় পড়ে না বলে বিবাদীগণ যুক্তি দিয়েছেন। আর বাদী পক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, ওই চুক্তি এবং আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, একই সাথে ওই চুক্তি এবং আইনগুলা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার এখতিয়ার হাইকোর্ট বিভাগের আছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়া আদালত বেশ সতর্কতার সাথেই পুরা বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আদালতের বক্তব্য হল, ‘বহুমাত্রিক ও বহুস্তর বিশিষ্ট শান্তি চুক্তিতে উপস্থাপিত বিষয়গুলা অনেকাংশেই তর্কিত চারটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই কার্যকারিতা পেয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তর্কিত আইন চারটি বিচার বিভাগীয় নিরীক্ষণের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। ঝুলে থাকা শান্তি চুক্তির আরও অনেক বিধান এখনও কার্যকর হওয়ার পথে রয়েছে। বিবেচনায় এটা প্রমাণিত যে, এইসব আইনের বিধানগুলাকে পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করার জন্য এখনও কিছু প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও আইনগত কাঠামো সৃষ্টি বা তার অনুসরণ করতে হবে। এসব কাঠামোর বিশেষ করে ভূমি কমিশনের কার্যপ্রণালীর সাথে জড়িত ক্ষেত্রগুলা যেহেতু এখনও পরিপূর্ণতা পায় নাই তাই এগুলো সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষণের জন্য যথার্থ নয়। এই বিবেচনায় শান্তি চুক্তি একটি ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতির নির্দেশ করে যা রাজনৈতিক-সামরিক দ্বন্দ্বের সমাধানের ওপর নির্ভরশীল। আদালত মনে করে যে, এ চলমান দ্বন্দ্বের রাজনৈতিক সমাধান অবধারিতভাবে শান্তি চুক্তির রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল।’ এমন বিবেচনার পর আদালত এই আইনগুলাকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণের ও নিরীক্ষণের জন্য গ্রহণ করেছেন।

বিবাদীদের তরফ থেকে আদালতে যুক্তি দেয়া হয়েছে তা আদালত রায়ে এভাবে তুলে ধরছেন, ‘যেহেতু তর্কিত আইনগুলা ১৯৯৮ সালে শান্তি চুক্তি পরবর্তী সময়ে প্রণীত হয় এবং কোন সরকারই এমন যুক্তি দেয় নাই যে, যেহেতু ১৯৯৭ সাল থেকে এ বিষয়ে সংসদে কোন ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নাই এবং যেহেতু ধারাবাহিকভাবে ছয়টি সরকার শান্তি চুক্তিকে রহিত করে নাই, তাই এরূপ দীর্ঘসময় ও গ্রহণীয়তা চুক্তিটির বিচারবিভাগীয় নিরীক্ষণকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে।’ কিন্তু এরকম যুক্তি আদালত পুরাপুরি নাকচ করে দিয়েছেন। আদালত যুক্তি দিয়ে দেখান যে, ‘পঞ্চম সংশোধনী মামলা’ নামে পরিচিত ইটালিয়ান মার্বেল কোম্পানি মামলা দায়ের হয়েছিল দুই হাজার সালের ডিসেম্বরে। এই মামলার অভিযোগের ভিত্তিতেই পরে উনিশশ উনাশি সালের পঞ্চম সংশোধনী পুনর্বিবেচনা করা হয়েছিল। আর দুই হাজার পাঁচ সালে ওই পঞ্চম সংশোধনী বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয়। আসল কথা হল, শান্তি চুক্তিরও একটা মৌলিক এবং নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। আদালতের বিবেচনায় এই বৈশিষ্ট্যই চুক্তিকে সাংবিধানিক কাঠামোর সাথে আলাদা ফলে সাংঘর্ষিক করে। চুক্তি বাস্তবায়নে বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে আদালত বলেছেন যে, ‘বাস্তবায়ন পদ্ধতি অনেকাংশে পক্ষগুলো বোঝাপড়ার ওপর নির্ভরশীল। এই আদালত মনে করে যে, শান্তি চুক্তিটি মূলত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের একটি রাজনৈতিক চুক্তি যা প্রতিপক্ষের সাথে শত্রুতার অবসান করে। এই জটিল শান্তি চুক্তিটি একটি ‘শান্তির সনদ’ (ট্রিটি অফ পিস) যার গন্তব্য শান্তির লক্ষ্যে বিদ্রোহের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তির চেয়েও বেশি কিছু।’

কিন্তু আদালত মনে করেন ‘শান্তি চুক্তি সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের ১৪৫ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীন চুক্তি বা দলিলের শ্রেণীভুক্ত না কিম্বা ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদের অধীন আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায়ও পড়ে না। এটা পরিপূর্ণরূপে একটি চুক্তি না, কারণ এটা নিজস্ব শাসনের অধিকার আছে এমন দু’টি স্বাধীন সত্তা বা সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় নাই, যথা জনসংহতি সমিতির কোন স্বায়ত্তশাসন নাই।’

আদালত আরও বলেন ‘এই আদালত মনে করে, বহু-বৈচিত্র্যময় শান্তি চুক্তিটি সংবিধানের অধীন বর্ণিত চুক্তির অন্তর্ভুক্ত না। দীর্ঘদিন ধরে চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং রাষ্ট্রের ভেতরকার দুটো পক্ষের মাঝে সম্পাদিত শান্তি চুক্তিটি মূলত সংবিধান সংশ্লিষ্ট না এবং সাংবিধানিক বিবেচনার বাইরে থেকেই এর প্রকৃতি ও বৈধতা নির্ধারণ করতে হবে।’ আদালতের মতে, এই চুক্তি হল স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শাসন এবং নির্বাহি বিভাগ কর্তৃক গৃহীত পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণের একটা কার্যতালিকা। তবে এই চুক্তি নিজে স্থায়ী ও প্রয়োগযোগ্য অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে না, বরং শান্তি অর্জনের স্রেফ একটা পথরেখা (পাথওয়ে) নির্দেশ করে।

আদালতের মতে চুক্তি বাস্তবায়নের বিধানগুলা ছিল অস্পষ্ট। এবং এর জন্য বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ও ছিল কম। তবে এ চুক্তির পক্ষগুলার অধিকার এবং স্বার্থে আঘাত হানার মত কোন আইনি দলিল হওয়ার উদ্দেশ্য চুক্তিতে পরিস্কারভাবে ছিল না। ফলে দেখা যাচ্ছে যে এমন কিছু বিধান রাখা হয়েছে যেগুলার দ্বারা শান্তির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পালনের জন্য কিছু মাত্রায় সুযোগ রাখা ছিল। এমন বিধানের অংশ হিশাবেই শাসনবিভাগের ওপরে আইন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যায়।

আঞ্চলিক পরিষদ সাংবিধানিকভাবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিশাবে গঠিত হয় নাই

সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ বলে স্থানীয় সরকারকে প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব দিয়েছে। এই স্থানীয় সরকারকে সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে সংজ্ঞায়িত ‘জেলা অথবা আইন দ্বারা নির্ধারিত ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে অন্য এলাকায়’ (ডিস্ট্রিক্ট অর আদার এরিয়া ডিজাইনেটেড বাই ল’ ফর দা পারপাস অফ আর্টিক্যাল ৫৯) প্রশাসনিক ইউনিট হিশাবে তৈরি হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম একক কোন জেলা না, বরং রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান--এই তিনটা জেলার সমষ্টি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আঞ্চলিক পরিষদ আইনের কোন বিধানে ‘প্রশাসনিক ইউনিট’ হিশাবে পরিস্কার বলা হয় নাই। তাই আঞ্চলিক পরিষদকে ৫৯ অনুচ্ছেদের লক্ষ্য অর্জনে প্রশাসনিক ইউনিট এর স্থানীয় সরকার বলা যাবে না। একইভাবে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের হিশাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কিত পরিচালনা কার্যক্রমও অসাংবিধানিক। আদালত মনে করে, আঞ্চলিক পরিষদকে একটা স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের মতই মনে হয়। সেটা নির্বাচিত কর্তৃপক্ষও বটে। চুক্তির বদৌলতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল একটা প্রশাসনিক ইউনিট হিশাবে প্রকাশ্য আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করা ছাড়াই উল্টা স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ হিশাবে কাজ করে যাচ্ছে। আদালত এই আলোচনার সমাপ্তি টেনে আদালত বলছেন যে এই আঞ্চলিক পরিষদ ও এর আইন ‘এইক্ষেত্রে সংবিধানের আওতা বহির্ভূত (আল্ট্রা ভাইরাস)’।

আঞ্চলিক পরিষদ আইন রাষ্ট্রের এক সত্তাকে আঘাত করে, কাজেই তা অসাংবিধানিক

এ প্রসঙ্গে তুলনা হিশাবে যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশের সাংবিধানিক কাঠামো নিয়া আলোচনা করা হয়েছে। আদালতের মতে, বিকেন্দ্রীকরণ আর রাষ্ট্রের একক চরিত্রকে খণ্ডিত করা এক জিনিস না। যুক্তরাজ্যেও বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া আছে। কিন্তু সেটা খুবই বাস্তব সম্মত এবং স্পষ্ট। তবে আদালতের কাছে এটা পরিস্কার যে, যুক্তরাজ্যের কোন লিখিত সংবিধান নাই। ফলে শাসনতান্ত্রিক বা নির্বাহি কার্য প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়। এবং এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের একক চরিত্র বা কাঠামো ভেঙ্গে দিলে তা বড় ধরনের কোন সাংবিধানিক সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিন্তু সার্বিকভাবে এই পরিস্থিতি বাংলাদেশে বর্তমান নাই।

বাংলাদেশে সংবিধান নিজেই এর মৌলিক কাঠামো স্থাপন করেছে। এর ওপর ভিত্তি করেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে রাষ্ট্রের একক কাঠামোকে (ইউনিটারি ন্যাচার অফ স্টেট) জোরালোভাবে সংবিধানের একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য (বেসিক স্ট্রাকচার) আকারে গণ্য করেছে। আদালতের মতে ‘আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ সাংবিধানিক অনুমোদন ছাড়াই একটি আঞ্চলিক ইউনিট তৈরি করেছে। এসব কারণেই এটা আশঙ্কা করা অবশ্যম্ভাবী যে, আঞ্চলিক পরিষদ আইনটি শেষপর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ফেডারেল ইউনিটের মর্যাদা দেয়ার দাবি করবে এবং এর দ্বারা একক প্রজাতন্ত্রের কাঠামোই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’

আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং আদালতের দৃষ্টিতে সংসদের দায়িত্ব

সবকিছু বিবেচনায় নিয়া আদালত তর্কিত আইনের বেশ কিছু বিধানের অসাংবিধানিকতা চিহ্নিত করেছেন।

এক. আদালতের মতে, উনিশশ আটানব্বই সালের আইনের ছয় নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি উপজাতি কি না তা নির্ধারিত হবে গ্রাম প্রধানের সনদের ভিত্তিতে। এখন এই বিধান এমন কোন বাস্তব মানদণ্ড নিশ্চিত করে নাই, যার দ্বারা ওই সনদ প্রদান করা হবে কি হবে না তা আইনিভাবে নিশ্চিত করা যায়। তাই এটা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮(১), ২৯(১) এবং ৩১ এর বিধান সমূহের লঙ্ঘন। ফলে ‘উপজাতি’ নির্ধারণে গ্রাম প্রধানের ক্ষমতা অসাংবিধানিক।

দুই. সংবিধানের একই বিধানসমূহ দ্বারা উনিশশ উনানব্বই সালের আইনের ১৭ নং ধারা (যা ১৯৯৮ সালের আইনের ১১ নং ধারার সংশোধিত) ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনে ভোট প্রদান করতে হলে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই পাহাড়ী অঞ্চলে জমির অধিকারী এবং ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে’--অংশটুকু বাতিল করে। আদালত মনে করে, এ আইন দ্বারা বাস্তবিক অর্থে একজন অ-উপজাতীয় ব্যক্তিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেকোন নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। অথচ বাংলাদেশ সংবিধানে সেই অধিকারগুলা রক্ষিত আছে। ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য অসাংবিধানিক।

তিন. উনিশশ আটানব্বই সালের আইন দ্বারা পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোন ব্যক্তি কিভাবে এবং কিসের ওপর ভিত্তি করে আরেক ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘন করে এবং তাকে বাদ দিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগের সুবিধা পাবে, এই আইনে সে বিষয়ে কিছুই বলা নাই। তাই আদালত মনে করে, স্বেচ্ছাচারী নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালিত এই বিধানগুলা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮(১), ২৯ এবং (২) এর লঙ্ঘন, ফলে এই বিধান অসাংবিধানিক।

চার. উনিশশ উনানব্বই সালের আইনের ওপর তুলে ধরা আপত্তিগুলার সুষ্ঠু সমাধান করার জন্য বিধান তৈরির ক্ষমতা (যা ১৯৮৯ সালের আইনের ধারা ৬৮ স্বীকৃত) সার্বিকভাবে ব্যবহার করে আইনের অসামঞ্জস্যতা দূর করা এবং আদালত নির্দেশিত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮(১), ২৯(১) এবং (২) এবং ৩১ এর লঙ্ঘন প্রতিহত করা অবশ্যই সংসদ ও সরকারের দায়িত্ব।

শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং ভবিষ্যত নির্দেশনা

এক. সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্ত করে সকল প্রায়োগিক উদ্দেশ্যকে পার্বত্য শান্তিচুক্তির আওতাভুক্ত করতে হবে। যদিও আঞ্চলিক পরিষদ আইনের সাথে ওপরে তুলে ধরা বিষয়গুলাতে পূর্ণতার অভাব থাকা সত্ত্বেও আদালত তার মতামত দিয়েছেন। কিন্তু আদালত মনে করেন, শান্তি রক্ষার্থে আঞ্চলিক পরিষদকে হতে হবে সংবিধান স্বীকৃত উপায়ে সরকারের তরফে গঠিত জন-প্রশাসন। যা মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত হবে, স্থানীয় সরকারকে সহায়তা করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করে কাজ করবে।

দুই. এত সময় চলে যাবার পরও পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা পুরাপুরি নিশ্চিত হয় নাই। আসলে শান্তি প্রতিষ্ঠার সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন আর সে সময়টা নাই- এই বিষয়গুলা আদালতের নজর এড়াতে পারে নাই। আদালত এটা মনে করে না। কারণ বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বিপরীত রাজনীতির চরম অবস্থা জারি হয়েছে। আর এর জন্য দায়ী হল সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা না করা। একইসাথে এটা পরিস্কার, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া একটা প্রশংসনীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ব্যর্র্থ হয়েছে। স্থানীয় সরকার বা জেলা পরিষদের কার্যাবলীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার একটা

সম্ভাব্য সহজতর পদ্ধতি হল জেলা পরিষদের নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি পার্বত্য অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে। পাশাপাশি বর্তমান বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ এবং সহিংসতা সৃষ্টিকারী শক্তিকেও মোকাবেলা করবে। সুতরাং আদালতের মত হল, সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সরকার ব্যবস্থাই তিন পার্বত্য জেলার শান্তি প্রতিষ্ঠার জীবনীশক্তি, যাকে সহযোগিতা ও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

তিন. এ দেশের ইতিহাসের শুরু থেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থা, বেশি পরিমাণে অকৃষি জমি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয়, সমতল ভূমির স্বল্পতা সহ নানা দিক থেকে পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠী পিছিয়ে আছে। তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এবং ২৯(৩) এর আলোকে ওপরে বর্ণিত মানদণ্ডগুলার সঠিক বস্তুগত নির্দেশ মূল্যায়নের ও সমাধানের জন্য একটা চলমান ইতিবাচক আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাছাড়া সরকারের এখতিয়ার আছে, জাতীয় পর্যায়ে কোন অঞ্চলকে অন্যদের থেকে পিছিয়ে আছে বলে চিহ্নিত করে তাদেরকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া। এ ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতার কারণে আদালতের তরফ থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নির্ধারণে কোন নীতিমালা, পদ্ধতি বা কার্যবিধি তৈরিতে মতামত দেয়া ঠিক না। এ অবস্থায় পিছিয়ে পড়া অঞ্চল নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের ওপরেই বর্তায়। তার কাছে যা যৌক্তিক ও সুষ্পষ্ট তার ওপর ভিত্তি করে সে কোন পথ বা পদ্ধতি নির্দেশ করতে পারে। বাংলাদেশে আগের কোন নজির ছাড়াই পার্বত্য অঞ্চলে সরকারের তরফ হতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নাই। এই আদালত ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তরফে ২০০৮ সালে ওপরে বলা বিষয়গুলার ওপর কিছু কাজের নোট নিয়েছে। পরবর্তীতে এ নোট অঞ্চলটিতে কোন অনুসন্ধানের বা কোন বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করলে মূলসূত্র হিশাবে কাজে লাগবে।

চার. আদালত বলছেন যে, অ্যামিকাস কিউরি বা আদালতের বন্ধু হিশাবে আইনজীবী জনাব টি এইচ খান তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ও বাস্তব নির্দেশনা দিয়ে আদালতের সামনে যথার্থই তুলে ধরেছেন যে, শান্তি প্রক্রিয়ায় সরকারের ভূমিকা বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী।

পাঁচ. আদালত আরও মনে করেন যে, বাংলাদেশ পৌরসভা আইন ও তার বিধানগুলাকে বিশেষ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আইন এবং ১০৭ নং আই. এল. ও সনদের বিধানগুলার সাথে অবশ্যই সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। বাংলাদেশের দায়িত্ব হল, শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে ১০৭ আই. এল. ও সনদ এবং অন্যান্য সর্বজনীন মানবাধিকার দলিল সমূহের সাথে সামঞ্জস্যশীল ও নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় সুযোগ সৃষ্টি করা।

ছয়. শান্তি প্রক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্ততা, নতুন বিধানের প্রবর্তন ও এর মানদণ্ড সবকিছুই টেকসই উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে। আদালতের নির্দেশনা হচ্ছে, এ সবকিছুই সংবিধানের বিধানাবলীর আলোকে করতে হবে। যেকোনও সংকট বা দাবি নিরসনে আইন তৈয়ারকারীরা বুদ্ধিদীপ্তভাবে সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টা বিবেচনায় রাখবেন।

কিন্তু পার্বত্যবাসী ও পুরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য বিপদ হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার মত একটা জটিল রাজনৈতিক সমস্যাকে আপাতত আড়ালে রাখার জন্য, ওখানকার অস্বাভাবিক অবস্থাকে ঢেকে রাখার জন্য বাংলাদেশের সরকার তড়িঘড়ি করে এমন এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে যা সাংবিধানিকভাবে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নাই। চুক্তির অধিকাংশ বিষয়কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার পরও আদালত এটা স্পষ্টভাবে বলছে যে, যে কোনও রাজনৈতিক সমাধানের পথ খোলা আছে। কিন্তু সেই সাথে আদালতের অবস্থান পরিস্কার যে, এমন সমাধানের উদ্যোগ অবশ্যই সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, যাতে করে পার্বত্যবাসীর শান্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। এবং সাংবিধানিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য আদালত ‘আইন তৈয়ারকারী’ রাজনীতিবিদদের ওপর ভরসা করছেন।

পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় উনিশশ সাতানব্বই সালের দুই ডিসেম্বর। চুক্তি হয় রাষ্ট্রের তরফে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় পর্ষদ (কমিটি) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে। চুক্তিটি আইন হিশাবে কার্যকর করার জন্য উনিশশ আটানব্বই সালে চারটা আইন গ্রহণ করা হয়। আইনগুলা হল, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান পাহাড়ি জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ (সংশোধন) আইনসমূহ ১৯৯৮, মানে ১৯৯৮ সালের ৯, ১০ এবং ১১ নম্বর আইন। আর চার নম্বর আইনটা হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ মানে ১৯৯৮ সালের ১২ নম্বর আইন। পার্বত্য চুক্তি এবং এই আইনগুলার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেই হাইকোর্ট বিভাগে দুইটা আবেদন করা হয়।

প্রথম আবেদনটির (২৬৬৯ নম্বর) তরফে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক। দ্বিতীয় আবেদনটির (৪৬৫১ নম্বর) তরফে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং আবেদনকারি নিজে। দুইটা আবেদনেই রাষ্ট্রকে বিবাদী করা হয়। রাষ্ট্রের তরফে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সহ মোট আটজন শুনানিতে অংশ নেন। প্রথম আবেদনে তিন নম্বর এবং দ্বিতীয় আবেদনের নয় নম্বর বিবাদীর তরফে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, সারা হোসেন এবং চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। আদালতের অনুরোধে বিচারপতি টি এইচ খান ও রোকনুদ্দিন মাহমুদ ‘অ্যামিকাস কিউরি’ বা আদালতের বন্ধু হিশাবে শুনানিতে অংশ নেন।

.....ছকে দেখা যাচ্ছে যে, মোট আটটা সাংবিধানিক আপত্তি পেশ করে বাদী পক্ষ। এ দুইটা রিট আবেদনে আদালতের কাছে নিবেদন করা হয় যে, বাংলাদেশ সরকারের তরফে জনাব আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর চুক্তি স্বাক্ষর করার কোন সাংবিধানিক এখতিয়ার ছিল না। এছাড়া পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে কার্যকারিতা দেয়ার জন্য তৈরি করা আইনগুলার বিশেষ কিছু বিধানের সাংবিধানিক সম্পর্ক নিয়াও প্রশ্ন তোলা হয়। এই আইনগুলা একটা ‘সমান্তরাল সরকার’ (প্যারালাল গভর্নমেন্ট) বা ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র’ (স্টেট উইদিন স্টেট) সৃষ্টি করেছে ইত্যাদি।

আবেদনকারী (রিট আবেদন নম্বর ২৬৬৯/২০০০) নিবদেন করেন যে, আঞ্চলিক পরিষদের ধারণা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ এইটা সংবিধানের এক, সাত ও উনষাট অনুচ্ছেদ এর লঙ্ঘন করে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের একক সত্তা বা কাঠামোকে অবজ্ঞা করে। আরও নিবেদন করা হয় যে, আঞ্চলিক পরিষদ একটা ‘স্ব-শাসিত’ এলাকার সৃষ্টি করে যা সংবিধানের সাথে প্রতারণার শামিল। আবেদন কারী আরও দাবি করেন যে, উনিশশ আটানব্বই সালের ৯, ১০, ১১ এবং ১২ নম্বর আইন দ্বারা ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ সৃষ্টি দ্বারা শুধু সংবিধানের বিভিন্ন বিধানের লঙ্ঘনই হয় না বরং রাষ্ট্রের একক সত্তা (ইউনিটারি ক্যারেক্টার অফ দি স্টেট) নামক সংবিধানের একটি মৌলিক কাঠামোকে (বেসিক স্ট্রাকচার অফ দি কনস্টিটিউশন) ধ্বংস করে।

বিবাদীদের তরফে যুক্তি ও বক্তব্য

রায়ে বলা হয়েছে, ‘উভয় রিট আবেদনের এক নম্বর বিবাদী যথাক্রমে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় শান্তি প্রক্রিয়ার সমর্থনে নিবদেন করেন যে, জনস্বার্থে এবং বিশেষভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মানুষের স্বার্থে, উক্ত এলাকায় শান্তি ও সংহতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে উনিশশ সাতানব্বই সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তি প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ করে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর (backward sections of the population) অগ্রগতির জন্য সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন এবং কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকরণ।’ এই দুইটা রিট আবেদনের বিষয়গুলাকে বিবাদীগণ একটা রাজনৈতিক এবং বিতর্কিত বিষয় (পলিটিক্যাল অ্যান্ড ডিসপিউটেড কোয়েশ্চন্স অফ ফ্যাক্টস) হিশাবে দেখেছেন। সেকারণে এ রিট আবেদনের বিষয় সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন আদালতের বিবেচ্য বিষয় হিশাবে গ্রহণযোগ্য হবে না।

বিবাদীরা বলেন, আবেদনকারীগণ পার্বত্য শান্তিচুক্তির স্বাক্ষর, কার্যকারিতা ও বাস্তবায়নের বিরোধিতা করেন। এ বিরোধিতা পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সহায়ক একটা চুক্তি। সেকারণে, আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুসারে আদালত এধরনের রাজনৈতিক চুক্তি (পলিটিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট) বা প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করা থেকে পরিস্কার বিরত থাকবেন। এ প্রসঙ্গে বিবাদীরা জোর দিয়ে বলেন, শান্তিচুক্তি ছিল একটা রাজনৈতিক সমঝোতা চুক্তি। চুক্তিটা সংবিধানের ৯, ১০ ও ১৪ নং অনুচ্ছেদে প্রণীত বিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এর সাথে মিল রেখেই পার্বত্য চট্টগ্রাম স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলার উন্নয়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার সরকারি নীতির আলোকে গৃহীত ও কার্যকর হয়।

তারা আরও নিবেদন করেন, এ শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য রাষ্ট্রের নির্বাহি ক্ষমতা প্রয়োগে স্বাক্ষরিত চুক্তি বা দলিলের ক্ষেত্রে সংবিধানের ১৪৫(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে না। কারণ এগুলা শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির নামে প্রকাশিত হয়। ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ সরকারের একটা সাধারণ চর্চা। সেদিক থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও সরকার রাষ্ট্রের একটি অংশে শান্তি ও সংহতি ফিরিয়ে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ সেখানে প্রায় দু’দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতিগত দ্বন্দ্ব ও বিদ্রোহ চলে আসছিল।

বিবাদীগণের পক্ষে জোর দাবি জানানো হয় যে, আদালত শান্তি চুক্তিকে শুধু সাম্প্রতিক অবস্থায় না বরং এর যথার্থ ঐতিহাসিক অবস্থা দেখবেন। এ সম্পর্কে বলা হয়, উনিশশ ছিয়াত্তর সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি হয়। সহিংসতা সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়; যার মোকাবেলায় সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সরকার পিসিজেএসএস-কে সক্রিয় আলোচনায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে। উনিশশ আশির দশকের আলোচনার ফলাফল হিশাবে উপজাতীয় নেতাদের সাথে দুইটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। উনিশশ পঁচাশি সালে এইরকম একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মেজর জেনারেল নুরুদ্দীন, জিওসি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন। আর পিসিজেএসএস-এর প্রতিনিধিত্ব করেন হরি কিষ্ট চাকমা ওরফে মেজর বিদু্যুৎ। উনিশশ আটাশি সালে আরেকটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাতে সরকারের পক্ষে থাকেন তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রী--এনসিসিএইচটি-এর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার। আর উপজাতীয়দের পক্ষে থাকেন পয়াত শান্তিময় দেওয়ান সহ অনেকে। শেষ চুক্তিটার ওপর ভিত্তি করেই স্থানীয় শাসন পরিষদ আইন- ১৯৮৯ তৈরি করা হয়।

বিবাদীগণ জোর দিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই গৃহীত হয়েছিল। এবং এটি বাংলাদেশ দ্বারা (রেটিফাইড) অনুমোদিত দা ইন্টারন্যাশনাল কভেনান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস, দা ইন্টারন্যাশনাল কভেনান্ট অন ইকোনমিক, সোশ্যল অ্যান্ড কালচারাল রাইটস, দা আইএলও কনভেনশন অন ইনডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশন্স (কনভেনশন নং ১০৭) অফ ১৯৫৭, অ্যান্ড দা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন দা ইলিমিনেশন অফ অল ফর্মস অফ রেইশিয়াল ডিসক্রিমিনেশন এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। শান্তি চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল উপজাতীয় ও অ-উপজাতীয় অধিবাসীদের মানবাধিকারের সমতা নিশ্চিত করে এবং প্রজাতন্ত্রের একক সত্তাকে আঘাত করে না। অন্যদিকে শান্তি চুক্তির গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জাতির রাজনৈতিক অঙ্গে যুক্ত করার পথে একটি আবশ্যকীয় পদক্ষেপ হিশাবে দেখা হয়। যার মাধ্যমে এই অঞ্চলে দীর্ঘ মেয়াদী শান্তি, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার এবং স্থিতিশীলতার পথ সুগম হবে। শান্তি চুক্তির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই অবস্থিত এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত।


প্রাসঙ্গিক অন্যান্য লেখা


Name

Email Address

Title:

Comments


Inscript Unijoy Probhat Phonetic Phonetic Int. English
  


Available tags : পার্বত্য চুক্তি, সাংবিধানিক ন্যায্যতা, রাষ্ট্রের অখণ্ড চরিত্র

View: 5227 Leave comments (0) Bookmark and Share

Go Back To Issues
EMAIL
PASSWORD