অবরোধ কবলিত ইরানের অবস্থা
অবরোধের আওতা
এ অবরোধের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সাথে অন্যান্য রাষ্ট্রের সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। ইরানের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক দিকই সীমিত হয়ে পড়েছে। ইরানের পরমাণু প্রকল্পের ওপর অবরোধের প্রধান দিক হলো জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র পরমাণু সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ভিতরে খনিজ ইউরোনিয়াম, পরমাণু প্রযুক্তি, ভারি পানি প্রক্রিয়াজাতকরণ, পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে এরকম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের সাথে বিনিময় করতে পারবে না। কি কি বিষয়ে ইরানের ওপর এই অবরোধ আরোপ করা হল, সে বিষয়ে একনজর;
সামরিক সরঞ্জাম
যুদ্ধে ব্যবহার করা হয় এমন আট ধরনের ভারি অস্ত্র ইরানের কাছে বেচতে পারবে না জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্র। এগুলো হল, ট্যাংক, সাজোয়া যান, দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধের জন্য বিমান ঘাটি, হেলিকপ্টার, যুদ্ধ জাহাজ, মিসাইল এবং এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো প্রযুক্তি।
যুদ্ধে ব্যবহার করা হয় এমনসব প্রযুক্তি সহায়তা বা প্রশিক্ষণ ইরানের সাথে আদান-প্রদান করা যাবে না। যুদ্ধাস্ত্র কেনা বা পরমাণু চুল্লির কাজ ইরান এগিয়ে নিতে পারে এমনতরও অর্থনৈতিক সহায়তাও দেয়া যাবে না।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানি
পরমাণু ও দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবসার সাথে জড়িত এরকম একজন ব্যক্তি ও চল্লিশটার মতো কোম্পানিকে অবরোধের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়াও কিছু সংখ্যক সংস্থা এ অবরোধের আওতায় থাকবে। এদের বাইশ রকমের মালামাল জব্দ করা হবে। অবরোধ করা চল্লিশটা কোম্পানির পনরোটার মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ কোনো না কোনোভাবে ইরানের রেভ্যুলুশনারী গার্ডের। আর তিনটা পরিচালনা করছে ইরানের কয়েকটা জাহাজ কোম্পানি।
এই ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলার কোনো নৌযানকে বন্দর ব্যবহার করতে দিতে পারবে না জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র। তাছাড়া এদের সাথে কোনো ধরনের লেনদেনও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জাহাজ চলাচল
জাতিসংঘের প্রতিটা সদস্য রাষ্ট্রের ওপর এটা বাধ্যতামূলক হবে যে, কোনো জাহাজকে যদি ইরানের এসব কোম্পানির বলে সন্দেহ হয় তবে সাথে সাথে সেটাকে আটক করতে হবে। ইরানের নাগরিকদের মালিকানাধীন কোম্পানিকে জ্বালানি সরবরাহ করা যাবে না। জাতিসংঘের বিধি-নিষেধ অবজ্ঞা করে কোনো জাহাজ অবাধে চলাচল করতে যেন না পারে সেদিকে প্রতিটা রাষ্ট্রকেই সতর্ক হতে হবে।
অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সাথে সম্পর্ক আছে এরকম অর্থনৈতিক, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করা যাবে না। প্রস্তাব অনুযায়ী, এ প্রতিষ্ঠানগুলো শেষাবধি ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকেই এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে।
সকল রাষ্ট্রকেই এমন নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের কোনো রাষ্ট্রীয় বা ব্যাক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি ইরানের বা ইরানের সাথে সম্পর্ক আছে এমন সব কোম্পানির সাথে লেদদেন যেন বন্ধ রাখে। নিষিদ্ধ কোম্পানিগুলো সরকারের অজান্তে যেন লেনদেন করতে না পারে, সে ব্যাপারে কড়া পাহারা বসাতে হবে। যদি কোনো ব্যাংক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইরানের সাথে সম্পর্ক আছে এমন তথ্য পাওয়া যায়, তবে সাথে সাথে সেই কোম্পানির সনদ বাতিল করতে হবে।
অবরোধের কবলে ইরানি জনগণের জীবনযাত্রা
অবরোধ ছাড়াই ইরানের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থা খুব সুবিধার না। যদিও নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতি অনেকটা সামাল দিচ্ছে দেশটার প্রদান রপ্তানি পণ্য তেলের উচুঁ দাম । তেল রপ্তানি থেকে আসা রাজস্ব আয় দিয়ে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে সমস্যা সমাধান হচ্ছে না, বরং সামনের দিকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকবে ।
দেশটির কর্মসংস্থানের হার বর্তমানে খুব ভালো না। সরকারি হিশাবেই বর্তমানে বেকারত্বের হার শতকরা ১১.৮ ভাগ। আর আঠারো থেকে বত্রিশ বছর বয়সি কর্মক্ষম নাগরিকদের মধ্যে বেকারত্বের হার শতকরা ৫২ ভাগ। বিশ্ববিদ্যায়লয় বা এরকম সমমানের প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশুনা করা তিন বিলিয়নের বেশি যুবক বেকার বসে আছে। গত এক দশকে দেশটাতে বেকার লোকের সংখ্যা এত বেশি আর কখনোই ছিল না।
পেট্রোলিয়াম রপ্তানি থেকে পাওয়া রাজস্ব আয় দেশটাতে নতুন কোনো অর্থনৈতিক খাত তৈরিতে ভূমিকা রাখে নাই। পেট্রোলিয়াম উত্তোলন অর্থাৎ খনি খাতে দেশটির মাত্র শতকরা একভাগ লোক কাজ করে। অন্যদিকে অবরোধের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশটাতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পরমাণু চুল্লি স্থাপন নিয়ে বিতর্ক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞায় ইরানে দেশী-বিদেশী বিনোয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগ করছে না।
এছাড়া ইরানে আইন-কানুনের নানা বিধি-নিষেধের কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। ইরানের বিশাল জনশক্তি আছে। অথচ সে হিশাবে ইরান নতুন চাকরি দিতে পারছে অর্ধেকের কম সংখ্যাক লোককে। আহমাদিনেজাদ ইতোমধ্যে যে বাজেট দিয়েছেন, তাতে নতুন করে কাজ সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। বেকার সমস্যার ব্যাপারে কোনোস্থায়ী সমাধান-পরিকল্পনা তাতে নাই।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় আহমাদিনেজাদ কথা দিয়েছিলেন, তেল ব্যবসার অর্থ ইরানের গরিব লোকের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করবেন। যা তিনি এখনো করতে পারেন নাই। নির্বাচনী ইশতেহারে তার প্রস্তাব ছিল মূলত ছোট ছোট ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা। এ জন্য হাউজ লোন দেয়ার কথা বলেছিলেন। বিশেষ করে নতুন বিবাহিত জুটিকে সহায়তা করতেই এ প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু কারখানার শ্রমিকরা অল্প সময়ে জন্য এরকম চাকরি তৈরির বিরোধী। এর প্রতিবাদে দুই হাজার ছয় সালের মে মাসের এক তারিখে প্রায় দশ হাজার শ্রমিক রাস্তায় মিছিল বের করেছে।
পৃথিবীর চার নম্বর অপরিশোধিত তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরান। এছাড়াও প্রায় সাত শতাংশ পরিশোধিত তেলের মালিক । ২০০৫ সালে ইরান পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ডলার তেল ব্যবসা থেকে আয় করেছে। চুয়াত্তর সাল থেকে এভাবে তেল রফতানি চলছে। এদিক দিয়ে তেল এবং গ্যাসের বাজারের সাথে ইরানের একটা নাড়ীর সম্পর্ক আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক নানা সমস্যা, সংস্কারে ইরানের তেল বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ যে ভালো যাবে, তা বলা যাবে না। বাইরের বাজারে একমাত্র তেল ছাড়া অন্যকোনো পণ্য প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো কোনো পণ্য ইরানের কারখানাগুলোতে তৈরি করার মতো বিনিয়োগ নাই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান যদি এ অবস্থায় নতুন করে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে না পারে তবে সামনের দিকে ইরানের অর্থনীতির সংকট আরো ঘনীভূত হবে।
দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা কাটিয়ে উঠার মতো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে না পারলে তা ইরানের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাইরের হস্তক্ষেপের বিপদ মোকাবলোয় মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে এখনকার বাস্তবতা হল, অবরোধে ইরানের তেল-গ্যাস ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারলে, ইরানকে কাবু করা যাবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম সত্তর ডলারের বেশি থাকলে খুব একটা ক্ষতি ইরানের হবে না। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৭৬.৫৭ ডলার।